সাহাবাগণের জীবনকথা-৮ || ইসলামের দুঃসময়ে প্রথম হাল ধরা সাহসী সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)





হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)


সবচেয়ে সাহসী, পরোপকারী, সবচেয়ে দানশীল, সবচেয়ে বিশ্বাসী এবং রাসুল (সা:) এর সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় সাহাবী ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সর্বাধিক প্রিয় মানুষ। মক্কার কুরাইশ বংশের তাইম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতার নাম আবু কুহাফা। মাতার নাম খায়র সালমা। তাঁর পিতামাতা উভয়ে বিশ্বনবী (সা) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু বকর (রা) এর জন্মের পর পিতামাতা তাঁর নাম দিলেন আবুল কাবা। পবিত্র কাবার নামে পুত্রকে উৎসর্গ করলেন। 

পরে মুহাম্মাদ (সা.) আবুল কাবার বদলে নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ। তবে তাঁর নাম আবু বকর বলে সবাই ডাকতো। মা-বাবা তাদের স্নেহের পুত্রকে ‘আতিক’ বলেও ডাকতেন। ‘আতিক‘ শব্দের অর্থ হল, ‘মুক্ত‘।

আবু বকরের স্ত্রী কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা ইসলাম গ্রহণ করেননি। আবু বকর তাকে তালাক দিয়েছিলেন। তার অন্য স্ত্রী উম্ম রুমান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ছেলে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর ছাড়া অন্য সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু বকরের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটলেও পরবর্তীকালে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর মুসলিম হয়েছিলেন।

শিশু বয়স হতেই আবু বকর ছিলেন অতিশয় কোমল ও সুন্দর স্বভাবের অধিকারী। শিক্ষা-দীক্ষায় তিনি ছিলেন সুপরিচিত। তখনকার যুগের একজন বড় কবি ছিলেন তিনি। একজন সুবক্তা হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। বংশ পরিচয় জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। কুরআন ও হাদিসে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য।

শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি তার গোত্রীয় পেশা ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। বিশ্বনবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) প্রায় সমবয়সী হওয়ায় নবীজী’র সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি নবীজীকে খুব ভালবাসতেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তখনও নবী হননি। অথচ আবু বকর তাঁকে খুব বিশ্বাস করতেন।

হযরত আবু বকর (রা.) একবার ব্যবসার কাজে গেলেন ইয়েমেনে। ব্যবসার কাজ সেরে এসে শুনলেন মুহাম্মাদ (সা) নবুয়ত লাভ করেছেন। তিনি একত্ববাদের প্রচার শুরু করেছেন। এ সব কথা শুনে আবু বকর (রা.) আর দেরি করলেন না। তিনি সোজা গিয়ে নবীজীর কাছে হাজির হলেন। নবীজীর দ্বীনের দাওয়াত কবুল করে মুসলমান হয়ে গেলেন।

এদিকে ইসলাম প্রচার করায় মক্কার অবিস্বাসীরা নবীজীর উপরে ক্ষেপে গেল। তারা বিশ্বনবীর সাথে শত্রুতা শুরু করল। নবীজীর উপরে জুলুম নিপীড়ন চালাতেও তারা দ্বিধা করল না। মহানবী (সা.) এর এ দুর্দিনে আবু বকর (রা.) নবীজীর সাথে সাথে থাকতেন। এ জন্য তিনিও কম কষ্ট সহ্য করেননি। নবীজী যখন যুদ্ধে যেতেন আবু বকর (রা) তাঁর সাথে থেকে কাফেরদের সাথে লড়াই করতেন। এক সময় নবীজী যখন আর মক্কায় থাকতে পারলেন না তখন তিনি আবু বকর (রা) কে সাথে নিয়ে বহু কষ্টে তিনি মদীনায় হিজরত করেন।

মক্কায় রাসুল (সা.) অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আবু বকরের বাড়ীতে গমন করা । কোন বিষয়ে পরামর্শে প্রয়োজন হলে তাঁর সাথে পরামর্শ করা। রাসুল (সা.) দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে কোথাও গেলে তিনিও সাধারণত সঙ্গে থাকতেন।

নাম ও পরিচয়: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ৫৭২ খ্রীস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু কোহাফা এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল খাইর সালমা। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুল্লাহ। আরবের রীতি অনুযায়ি তিনি তাঁর ছেলের নাম বকর থেকে আবু বকর অর্থাৎ বকরের পিতা নামে পরিচিতি লাভ করেন। ‘সিদ্দিক’ ছিল তাঁর উপাধি। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। তিনি ছিলেন উজ্জল গৌরবর্ণ, পাতলা ছিপছিপে ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট। শেষ বয়সে চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল । মেহেদীর খিজাব লাগাতেন। অত্যন্ত দয়ালু ও সহনশীল ছিলেন।

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর চারিত্রিক গুণাবলী: 

হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষনতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। জাহিলী যুগে মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরব বাসীর নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। কাব্য প্রতিভাও ছিল। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। বক্তৃতা ও বাগ্মিতায় খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন।

তিনি ছিলেন তার গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পান্ডিত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষার কারণে অনেকেই তার সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। তাঁর বাড়ীতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো। 

তিনি ছিলেন ন্যায়বান, সত্যনিষ্ট ও স্থিরচিত্তের মানুষ। তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়নতা, অসীম ধৈর্য্য, কঠিন সংযম তাঁকে মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। হযরত আবু বকর (রা) সম্পর্কে হযরত আলী (রা) বলেন, রাসূলে করীম (সা) এর পর, আবু বকর ছিলেন শ্রেষ্ঠ মুসলমান।

মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেছেন, আবু বকর (রা) এর নম্রতা, একনিষ্ঠ অনাড়ম্বর জীবন, মহান নীতিজ্ঞান, ইসলামে দৃড় সংকল্প, অবিচল অধ্যবসায় প্রভৃতি চারিত্রিক বৈষিষ্ট্যের জন্য মহানবী (সা) এর পরই তাঁর স্থান।

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর ইসলাম গ্রহণ এবং ইসলামের সেবা: 

হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের একজন বড় সেবক ছিলেন। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তারই একনিষ্ঠ চেষ্টায় হযরত উসমান (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত যুবায়ের (রা.), হযরত আবদুর রহমান (রা.), হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) – এমন বড় বড় সাহাবী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন।

যে সব দাসদাসী ইসলাম কবুল করত তাদের উপরে নেমে আসত অকথ্য নির্যাতন। তাদের মুনিবরা তাদের উপরে চালাত অসহ্য নির্যাতন। এসব নিপীড়ন হযরত আবু বকর (রা.) এর মনে খুব কষ্ট দিত। তাই তিনি তাঁর নিউ অর্থে এসব দাসদাসীদেরকে কিনে মুক্ত করে দিতেন। 

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল (রা.) সহ এমন বহু দাসকে তিনি কাফেরদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

আবু বকর (রা.) এর এ কাজ দেখে তাঁর পিতা আবু কুহাফা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন গরিব দাসদাসী মুক্ত করছ, এতে কোমার কী লাভ? জবাবে আবু বকর (রা.) বলেছিলেন, “শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি এ কাজ করে থাকি”। কত বড় মহান লোক ছিলেন আবু বকর (রা.)।

তাবুক যুদ্ধের সময় মুসলমানরা অর্থের সংকটে পড়ে গিয়েছিল। এ সময় হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সকল সম্পদ নিয়ে নবীজী’র সাওমনে এনে হাজির করলেন। নবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঘরে কী রেখে এলে? তিনি সাফ সাফ জবাব দিলেন, আমার ঘরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি”।

রাসুল (সাঃ) এর মুখে মি‘রাজের কথা শুনে অনেকেই যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোল খাচ্ছিল, তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন ।

কৃতদাসদের মুক্তি ও নবী সা: এর উক্তি : রাসুল (সাঃ) যখন নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষনা দিলেন তখন আবু বকরের নিকট তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিল। এ সময় তিনি ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সকল সম্পদ ওয়াকফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলামে গ্রহণের কারণে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরীদ করে মুক্ত করে দেন। তেরো বছর পর যখন রাসুল (সাঃ) সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তখন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার অবশিষ্ট ছিল। অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহাম গুলির ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয়। বিলাল, খাব্বার, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব. আবু ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই পরবর্তীকালে রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দিবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।

নবী সা. এর সহচর: তিনি মহানবী (সাঃ) এর একজন ঘনিষ্ট সাহাবী ছিলেন। তিনিই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর দাবীর সত্যতাকে নিশ্চিত বলে গ্রহণ করেন এবং এভাবে ‘সিদ্দীক’ উপাধি লাভ করেন। তিনি মহানবী (সাঃ) এর মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময় তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। তিনিই হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর একমাত্র সাহাবী, যিনি তাঁর সাথে সেই সফরে ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

রসুল সা. এর সাথে কন্যার বিয়ে: মক্কায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার ওফাতের পর রাসূলকে (সাঃ) যখন আবু বকর (রাঃ) বিমর্ষ দেখলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আদব সহকারে নিজের অল্পবয়স্কা কন্যা আয়িশাকে (রাঃ) রাসুল (সাঃ) সাথে বিয়ে দেন। মোহরের অর্থও নিজেই পরিশোধ করেন।


হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর ইমামতি ও খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ:  

৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেন। তখন মুসলমানদের নেতা ও খলিফা নির্বাচিত হন হযরত আবু বকর (রা)। এ সময় বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য নানা রকম সমস্যার মুখে পড়ে। মহানবী (সা.) এর অনুপস্থিতিতে কাফের-মুশরেকসহ বিভ্রান্ত মুসলমানরা নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।

কিছু লোক তখন নিজেদের নবী হওয়ার মিথা দাবি তুলে। আবার কেউ কেউ যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কেউবা ইসলাম ত্যাগ করে আবার নিউ নিউ ধর্মে ফিরে যায়। হযরত আবু বকর (রা.) কঠোর হাতে সে সব ষড়যন্ত্র দমন করেন। 

তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শুধু তাই নয়, তিনিই মুহাম্মাদ (সা.) এর আদর্শ ও নির্দেশমত দেশের শাসন কার্য পরিচালনা করেন।

হযরত আবু বকরের (রা.) আরেকটি অবদান ছিল, তিনি পবিত্র কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিলা পালন করেন। তাঁর শাসনামলে ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত গলে অনেক কুরআনে হাফিজ শহীদ হন। এতে পবিত্র কুরআন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় আবু বকর (রা.) কুরআন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নির্দেশ দেন।

সে সময় না ছিল কাগজপত্র, না ছিল ছাপাখানা। তাই সব সাহাবা গাছের বাকল, হাড়, চামড়া, ইত্যাদিতে কুরআনের আয়াত লিখে রেখেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) এসব আয়াত আকত্রিত করে একটি কপি করালেন এবং বিশ্বনবী (সা.) এর স্ত্রী হযরত হাফসার নিক্ত সেগুলো গচ্ছিত রাখলেন।

এভাবে ইসলামকে রক্ষা এবং মহৎ কাজের নেতৃত্ব দানের জন্য হযরত আবু বকর (রা.) কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়। তিনি দু’বছরের কিছু অধিককাল খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করার জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর ইন্তেকালের আগে এক সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন, যারা উত্তর সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করছিল। নবীজী (সা.) এর ইন্তিকালের পরও এই সৈন্যবাহিনী মদীনাতেই অবস্থান করছিল।

হযরত আবু বকর (রা.) খলীফা হওয়ার পর মদীনার ভিতর এবং বাইরের অবস্থা সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ সময় মহানবী (সা.) এর অনেক সাহাবী তাঁকে এই সৈন্য বাহিনী রোমানদের বিরুদ্ধে তখনই প্রেরণ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কিন্তু, হযরত আবু বকর (রা.) দৃঢ়তার সাথে তাদের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আবু কোহাফার পুত্রের কি অধিকার আছে যে, মহানবী (সা.) এর দ্বারা সূচিত কোন কাজকে রোধ করে”।

মুসলিম সেনারা হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) এর নেতৃত্বে বাহরাইনে এক বিদ্রোহকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তারপর পারস্যরা পরাজিত হয়, যারা বাহরাইনের বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছিল। অতঃপর, মুসলিম সৈন্যবাহিনী ‘আজনাদান’ এবং ‘ইয়ারমুকে’র যুদ্ধে রোমান পরাশক্তিকে পরজিত করে এবং এভাবে গোটা সিরিয়ায় ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়।

হযরত আবু বকর (রা.) এর খেলাফত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ P.K. Hetti তার “The History of Arab” গ্রন্থে লিখেছেন যে,

If someone in the first-third of the seventh Christian century had the audacity to prophesy that within a decade some unheralded, unforeseen power from the hitherto barbarians and little known land of Arabia was to make its appearance, hurl itself against the only two powers of the age, fall heir to the one-the Sassanian, and strip the other, the Byzantine of its fairest provinces, he would undoubtedly be declared a lunatic. Yet that was what happened.”

H.G. Wale হযরত আবু বকর (রা.) কে যেভাবে মূল্যায়ন করেন, সে সম্পর্কে বলেছিলেন, 

“It (Islam) prevailed because everywhere it found politically apathetic people, robbed, oppressed, bullied, uneducated and unorganized and it found selfish and unsound governments out of touch with the people.”


হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) কর্তৃ ক সমস্যা ও সমাধান: 

নবী (সা:) বিদায়ের পর কিছু গোত্র প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকার করে বসে, কেবল এই কারণে যে, তাদের গোত্রীয় প্রধান মহানবী (সাঃ) এর খলীফার প্রতি অনুগত্ থাকার আর প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু তাই নয়, তারা বরং নবপ্রতিষ্ঠিত খিলাফতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাদের অভিসন্ধি জানতে পেরে, সৈন্য প্রেরণ করেন এবং তাদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি রোমান বিদ্রোহ দমন ও ভন্ড নবী দমন করেন।

দ্বিতীয়তঃ হযরত আবু বকর (রাঃ) বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হন, তা ছিল যে, বহু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করে, যা ইসলামী রাষ্ট্রের বিবিধ চাহিদা পূরণ এবং দরিদ্রদের তত্ত্বাবধানের জন্য জন্য অপরিহার্য ছিল। হযরত আবু বকর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে এবং তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।

ভন্ড নবী দমন: সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা এই ছিল যে কিছুসংখ্যক উচ্চাকাংখী ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবী করে বসে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। মোসায়লিমাতুল কাজ্জাব এবং আসওয়াদ আনসী বিপুল সৈন্য সমারোহ করে এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা দখল করে নেয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) এইসব বিদ্রোহী মিথ্যা নবুয়তের দাবীকারকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রসদের স্বল্পতা সত্ত্বেও আল্লাহতালা তাঁকে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেন।

কোরান সংকলন: তাঁর খিলাফতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের একটি হলো পবিত্র কুরআনকে একস্থানে সংগৃহিত করা। যদিও মহানবী (সাঃ) স্বয়ং পবিত্র কুরআনের লিখন ও বিন্যস্তকরণ কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত তা বিবিধ চামড়ার টুকরা, বৃক্ষ পত্ররাজি এবং পাথরের ফালিতে লিখিত ছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) এই সকল বিছিন্নভাবে লিখিত অংশকে সংগ্রহ করে একত্রিত করেন এবং কুরআন সংরক্ষণের নিমিত্তে হিফযকারীদের ব্যবস্থাপনাকে পদ্ধতিগত ভাবে পূনর্বিন্যস্ত করেন।

রোমান বিদ্রোহ দমন: মহানবী (সাঃ) তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করার জন্য এক সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন, যারা উত্তর সীমান্তে উপদ্রব করছিল। এই সৈন্যবাহিনী তখনও মদীনাতেই অবস্থান করছিল, যখন মহানবী (সাঃ) পরলোকগমন করে গেলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর মদীনার ভিতর এবং বাইরের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়লো। এই মহা বিপদের আশঙ্কা করে, মহানবী (সাঃ) এর অনেক সাহাবী তাঁকে এই পরামর্শ দিলেন যেন এই সৈন্য বাহিনী রোমানদের বিরুদ্ধে তখনই প্রেরণ করা না হয়। কিন্তু হযরত আবু বকর (রাঃ) জোরের সাথে জবাব দিলেন, “আবু কোহাফার পুত্রের কি অধিকার আছে যে মহানবী (সাঃ) এর দ্বারা সূচিত কোন কাজকে রোধ করে”। মুসলিম সেনারা হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর নেতৃত্বে বাহরাইনে এক বিদ্রোহকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তারপর পারস্যরা পরাজিত হয়, যারা বাহরাইনের বিদ্রোহীদের মদদ করছিল। মুসলিম সৈন্যবাহিনী অতঃপর ‘আজনাদান’ এবং ‘ইয়ারমুকে’র যুদ্ধে রোমান পরাশক্তিকে পরজিত করে এবং এভাবে গোটা সিরিয়া ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।

হিজরতের পর সকল অভিযানেই তিনি রাসুল (সা.) সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কোন একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হননি।


হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর ইন্তেকাল ও জানাজা: 

হযরত আবু বকর (রা) ১৩ হিজরী সালের ৭ জমাদিউস উখরা জ্বরে প্রচণ্ড আক্রান্ত হন। ১৫ দিন জ্বরে ভোগার পর ২১ জমাদিউল উখরা ২৩ আগস্ট ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

হযরত উমার (রা.) তাঁর জানাজা নামাযে ইমামতি করেন। তাঁকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পাশে দাফন করা হয়।

হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর চরিত্রগুণ, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ইসলামের সেবায় তাঁর অনন্য অবদান সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর চরিত্র বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করলে বর্তমান সমাজ বহু সমস্যা থেকে স্বস্তি পেতে পারে।


★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায়

অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url