সাহাবাগণের জীবনকথা-৯ || জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবা হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ), পর্ব - ১








হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ)
প্রথম পর্ব


আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর বংশ পরিচয়ঃ

ইমাম বুখারীর মতে জাহিলী যুগে আবদুর রহমান ইবন ’আউফের নাম ছিল ’আবদু ’আমর। ইবন সা তাঁরতাবাকাতে’ উল্লেখ করেছেন, জাহিলী যুগে তাঁর নাম ছিল ’আবদু কাবা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা. তাঁর নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান তাঁর মাতা-পিতা উভয়ে ছিলেন ‘যুহরা’ গোত্রের লোক। মাতার নাম শিফা বিনতু ’আউফ। দাদা নানা উভয়ের নামই ছিল ’আউফ। ‘যুহরা’ গোত্রটি হচ্ছে হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর মাতা হযরত আমিনার পিতৃগোত্র।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর জন্মঃ

ইবন সা ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, তিনি ’আমূল ফীলের (হস্তীর বৎসর) দশ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বয়সে দশ বছরের ছোট। রাসূল সা. ’আমুল ফীলের ঘটনার পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ইবন হাজার তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. তের বছর ছোট বলে উল্লেখ করেছেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর ইসলাম গ্রহণঃ


রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথম পর্যায়ে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাঁদেরই একজন। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিনই হযরত আবু বকরের বাড়ীতে বৈঠকে মিলিত হতেন। আবদুর রহমানও ছিলেন বৈঠকের একজন নিয়মিত সদস্য। আবু বকরের সাথে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের বাড়ীর বৈঠকের নিয়মিত পাঁচজন সদস্যের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমনঃ উসমান, সা, তালহা, যুবাইর এবং আবদুর রহমান। তাঁদের সকলেই আবু বকরের দাওয়াতে প্রথম পর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের জন্য অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর হিজরাতঃ

নবুওয়াতের পঞ্চম বছর রজব মাসে যে এগারজন পুরুষ চারজন নারীর প্রথম কাফিলাটি মক্কা থেকে হাবশায় হিজরাত করে তার মধ্যে আবদুর রাহমানও ছিলেন। আবার রাসূল (সা.) এর মদীনায় হিজরাতের পর তিনিও মদীনায় হিজরাত করেন। যাঁরা হাবশা মদীনা দুস্থানেই হিজরাত করেছিলেন তাঁদেরকে বলা হয় ‘সাহিবুল হিজরাতাইন মদীনায় তিনি হযরত সা ইবন রাবী’ বলে আল-খাযরাজীর গৃহে আশ্রয় নেন এবং তাঁর সাথেই রাসূল সা. ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর সাথে সা’দ ইবন রাবী’র ভাতৃত্য স্থাপনঃ

সম্পর্কে ইমাম বুখারী একাধিক সনদের মাধ্যমে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। সম্পর্কে হযরত আনাস রা. বলেনঃ ‘আবদুর রহমান ইবন ’আউফ হিজরাত করে মদীনায় এলে রাসূল সা. সা ইবন রাবী সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দেন। সা ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের নেতা ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান দুভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দুজন স্ত্রী আছেন। আমি চাই, আপনি তাদের দুজনকে দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন।’ আবদুর রহমান বললেনঃ ‘আল্লাহ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত কল্যাণ দান করুন! ভাই, এসব কোন কিছুর প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর ব্যবসা ও বিয়েঃ


ইসলামী ভ্রাতৃত্বে হযরত সাদের দৃঢ় আস্থা অতুলনীয় উদারতার দৃষ্টান্ত ইসলামী উম্মাহ তথা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে হযরত আবদুর রহমানের মহত্ব, আত্মনির্ভরতা নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্পও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। 

মদীনায় অবস্থানের দ্বিতীয় দিন আবদুর রহমান তাঁর আনসারী ভাই সাদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বেচাকেনা হয় এমন কোন বাজার কি এখানে আছে?’’ বললেনঃ ‘‘হাঁ, ইয়াসরিবে (মদীনায়) কায়নুকার বাজার তো আছে।’’ হযরত আব্দুর রহমান এক স্থান থেকে কিছু ঘি পনির খরিদ করে বাজারে যান। দ্বিতীয় দিনও তিনি এমনটি করলেন। এভাবে তিনি বেচাকেনা জারি রাখেন। কিছু পয়সা হাতে জমা হলে তিনি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন।

বিয়ের পর তিনি একদিন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলেন। তাঁর কাপড়ে হলুদের দাগ দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বিয়ে করেছ?’ বললেন, ‘হাঁ জিজ্ঞেস করলেন কাকে?’ তিনি বললেন, ‘এক আনসারী মহিলাকে।’ রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোহর কত নির্ধারণ করেছ?’ তিনি বললেন, ‘কিছু সোনা।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করে নাও।

তিনি ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছুদিন পর তার হাতে আরও কিছু অর্থ জমা হলে রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশমত ওয়ালিমার কাজটি সেরে নেন। ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হয়। মক্কার উমাইয়া ইবন খালফের সাথে একটি ব্যবসায়িক চুক্তিও সম্পাদন করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা:) এর জেহাদে অংশগ্রহণঃ

হযরত আবদুর রহমান ইবন ’আউফ বদর, উহুদ খন্দক সহ সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সাহস দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ইমাম বুখারী ‘কিতাবুল মাগাজীতে বদর যুদ্ধের একটি ঘটনা তাঁরই যবানে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

‘‘বদর যুদ্ধে, আমি সারিতে দাঁড়িয়ে। তুমুল লড়াই চলছে। আমি ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে আমার দুপাশে দুই নওজোয়ানকে দেখলাম। তাদের ওপর আমার খুব একটা আস্থা হলো না। তাদের একজন ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলোঃ ‘‘চাচা, বলুন তো আবু জাহল কোন দিকে?’’ বললাম, ‘‘ভাতিজা, তাকে দিয়ে কি করবে?’’ সে বলল, ‘‘আমি আল্লাহর সাথে অংগীকার করেছি, হয় আমি তাকে কতল করবো, না হয় উদ্দেশ্যে আমার নিজের জীবন কুরবান করবো।’’ একই কথা ফিসফিস করে আমাকে বলল অন্যজনও। আবদুর রহমান বলেন, ‘‘তাদের কথা শোনার পর আমার আনন্দ হলো এই ভেবে যে, কত মহান দুব্যক্তির মাঝাখানেই না আমি দাঁড়িয়ে। আমি ইশারা করে আবু জাহলকে দেখিয়ে দিলাম। অকস্মাৎ তারা দুজন একসাথে বাজপাখীর মত আবু জাহলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে কতল করে। দুনওজোয়ান ছিল ’আফরার দুপুত্র মুয়ায মুয়াওবিয।’ বদর যুদ্ধে আবদুর রহমান পায়ে আঘাত পান।

উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধেও তিনি অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। রাসূল সা. উহুদ পর্বতের এক কোণে আশ্রয় নিয়েছেন, উবাই ইবন খালফ এগিয়ে এলো আল্লাহর রাসূলকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে। আবদুর রহমান তাকে জাহান্নামে পাঠাবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে রাসূল সা. তাঁকে বাধা দেন। অতঃপর রাসূল সা. নিজেই হারিস ইবন সাম্মার নিকট থেকে বর্শা নিয়ে উবাই ইবন খালফের গর্দানে ছুড়ে মারেন। সামান্য আহত হয়ে সে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে যায় এবং মক্কার পথে ‘সারফনামক স্থানে নরক যাত্রা করে।


ইবন সা ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উহুদের যুদ্ধে আবদুর রহমান অসীম সাহস বীরত্বের পরিচয় দেন। বালাযুরী তাঁর ফুতুহুল বুলদান, ইবনে হাজার তাঁর আলইসাবা এবং ইবন খালদুন তাঁর তারীখে বর্ণনা করেছেন, যুদ্ধে তিনি সারা দেহে মোট একত্রিশটি আঘাত পান।

ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে রাসূল সা. মদীনা থেকে প্রায় তিন শো মাইল উত্তরে ‘দুমাতুল জান্দালে’ একটি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব দেন আবদুর রহমানকে। যাত্রার পূর্বে তিনি উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। রাসূল সা. নিজ হাতে আবদুর রহমানের মাথার পাগড়ীটা খুলে রেখে দিয়ে অন্য একটি কালো পাগড়ী তার মাথায় বেঁধে দেন। তারপর যুদ্ধের পলিসি সংক্রান্ত কিছু হিদায়াত দিয়ে তিনি আবদুর রহমানকে রা. বিদায় দেন।

মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সা. মুহাজিরদের যে ছোট্ট দলটির সংগে ছিলেন, আবদুর রহমানও ছিলেন সেই দলে। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সা. আরব উপদ্বীপে দাওয়াতী কাজের জন্য কতকগুলি তাবলীগী গ্রুপ বিভিন্ন দিকে পাঠান। তখনও আরব গোত্রগুলি মূর্খতা আসাবিয়্যাতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কারণে রাসূল সা. তাবলীগী গ্রুপগুলিকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠলেন। যাতে প্রয়োজনে তারা আত্মরক্ষা করতে পারে। এরকম তিরিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি দলকে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে বনু খুযায়মার লোকদের নিকট পাঠানো হলো। কিন্তু হযরত খালিদ বনু খুযায়মার মধ্যে ভুল বুঝা-বুঝি সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে হযরত খালিদ বনু খুযায়মার ওপর হামলা করে তাদের বহু লোককে হতাহত করেন। ঘটনা অবগত হয়ে রাসূল সা. হযরত খালিদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তঁর ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট মাগফিরাত কামনা করেন। রাসূল সা. নিহত ব্যক্তিদের দিয়াত আদায় করেন। এমন কি কারও একটি কুকুরও মারা গিয়ে থাকলে তারও বিনিময় মূল্য আদায় করা হয।

বনু খুযায়মার দুর্ঘটনা নিয়ে খালিদ আবদুর রহমানের মধ্যে বচসা বিতর্ক হয়। কথা রাসূল সা. অবগত হয়ে খালিদকে ডেকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, ‘তুমি সাবেকীনে আওয়াবীন’ (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) একজন সাহাবীর সাথে ঝগড়া তর্ক করেছ। এমনটি করা তোমার শোভন হয়নি। আল্লাহর কসম, যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিকও তুমি হও এবং তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দাও, তবুও তুমি আমার সেসব প্রবীণ সাহাবীর একজনেরও সমকক্ষ হতে পারবে না।’ উল্লেখ থাকে যে, হযরত খালিদ আহযাবের যুদ্ধের পর ষষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানের সময় মুসলমানগণ যে ঈমানী পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সে পরীক্ষায়ও তিনি কৃতকার্য হন। রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে অভিযানের জন্য হযরত আবু বকর, উসমান আবদুর রহমান রা. রেকর্ড পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন। আবদুর রহমান আট হাজার দিনার রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দিলে মুনাফিকরা কানাঘুষা শুরু করে দেয়। তারা বলতে থাকে, ‘সে একজন রিয়াকার- লোক দেখানোই তার উদ্দেশ্য।’ তাদের জবাবে আল্লাহ বলেন,

তো সেই ব্যক্তি যার উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে।’(সূরা তাওবাহঃ ৭১)




★★সমাপ্ত★★

 

সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url