ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শুধুমাত্র ভাষাবিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজসেবক, বাঙালি জাগরণের প্রবক্তা এবং একজন খাঁটি মুসলমান







"আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন, যে মালা তিলক টিকিতে বা টুপি লুঙ্গি দাঁড়িতে তা ঢাকবার জো নেই।

হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে, কিন্তু তাহা যে করিতেই হইবে।"


উপরের উক্তিগুলোই বলে দেয় . মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর হৃদয়ে লালিত জাতিসত্ত্বার প্রতি মমত্ব শ্রদ্ধাবোধ। এদেশে বাঙালি এবং মুসলিম জাতিসত্ত্বা একইসাথে ধারণ করেছেন, এমন ব্যক্তিদের তালিকায় বহুভাষাবিদ এই ব্যক্তির নাম প্রথমেই থাকবে। ১৯৫২ সালে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপনের পরই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, অনুবাদক, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং ভাষাসৈনিক।

মোতাহার হোসেনের সাথে . মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম শিক্ষাজীবন



মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই, পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরিফের খাদেম। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মকালীন নাম ছিল মুহাম্মাদ ইব্রাহিম। কিন্তু তার মা হুরুন্নেসা মনে করলেন, যেহেতু তার সন্তান শহীদে কারবালার চাঁদে গর্ভে এসেছে, তাই নামটা শহীদুল্লাহ হলেই ভালো হয়। তাই তিনি ছেলেকে 'শহীদুল্লাহ' বলেই ডাকতে লাগলেন। পরে নাম স্থায়ী হয়ে গেল।

তখনকার সময়ে গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মক্তবকেন্দ্রিক। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও ছোটবেলায় বই আর শ্লেট হাতে নিয়ে মক্তব যেতে লাগলেন। সেখান থেকে তিনি মীর মোশাররফ হোসেনসহ বিভিন্ন লেখকের বই পড়া শুরু করেন। তার জ্ঞানের ফোয়ারাও প্রস্ফুটিত হতে লাগল।

মক্তবের পড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। ১৯০৪ সালে তিনি এন্ট্রান্স (বর্তমান এসএসসি- সমমান) পাশ করেন। সেই সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন ভাষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিজে নিজে শুরু করে দেন ভাষা শিক্ষা। এন্ট্রান্স পাশ করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯০৬ সালে এফ.. (বর্তমান এইচএসসি- সমমান) পাশ করেন তিনি।

 

যুবক বয়সে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতা সিটি কলেজে। ১৯১০ সালে সংস্কৃতে সম্মানসহ বি.. পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত নিয়ে এম.-তে ভর্তি হতে চাইলে সেই বিভাগের এক অধ্যাপক মুসলিম ছাত্রকে সংস্কৃত পড়াতে অস্বীকার করেন। সত্যব্রত সামশ্রমী নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক জেদ ধরে বসেন, হিন্দু নন এমন কাউকে তিনি বেদ পড়াবেন না।

শেষপর্যন্ত বিতর্ক গড়াল আদালত পর্যন্ত। তখন দিল্লি হাইকোর্ট নির্দেশ দিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব নামে একটি বিভাগ খোলা হবে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভর্তি হন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.. পাশ করেন।

 


পড়াশোনা চলাকালে ১৯০৮-০৯ সালের দিকে যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯১৩ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পান শহীদুল্লাহ। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তার আর বিদেশে যাওয়া হলো না। তবে ঘরে বসে না থেকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৪ সালে বি.এল. পাশ করেন। ১৯১৫ সালের শুরুর দিকে কিছুদিন সীতাকুণ্ড হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে নিজ এলাকায় ফেরত এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এতে এলাকায় তার ব্যাপক পরিচিতি জনপ্রিয়তা তৈরি হয়।

 

 


১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেখানে সংস্কৃত এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়া ১৯২২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯২৬ উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি ফ্রান্সে পাড়ি জমান। ১৯২৮ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট। ওই বছরই ধ্বনিতত্ত্বে গবেষণার জন্য সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন।


মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গবেষণা কৃতিত্ব

১৯১৯-২১ সাল পর্যন্ত . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের . দীনেশচন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। সময় বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে লেখা তাঁর কিছু প্রবন্ধ শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর এই প্রবন্ধ নজরে পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জিরও। সেই প্রবন্ধ পড়ে স্যার আশুতোষ মুখার্জী মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে অবগত হন। এরপর তিনি মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে নিয়ে উৎসাহ দেন, অনুপ্রেরণা যোগান। পরবর্তীকালে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর 'বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত' গ্রন্থটি . আশুতোষ মুখার্জির স্মরণে উৎসর্গ করেন।

 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন। ১৯২৫ সালে তিনি প্রমাণ করেন গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। তার মতে, বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা নয়, তবে নিকটাত্মীয়। তার গবেষণা অনুযায়ী বাংলা ভাষার উৎপত্তি কাল সপ্তম শতাব্দী। শ্রীলঙ্কান ভাষার উৎপত্তিও নির্ধারণ করেন এই মহান বিজ্ঞানী।

১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত এবং বাংলাকে আলাদা করা হলে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

২৪ ভাষায় কথা বলতেন; সংস্কৃতের ছাত্র, শিক্ষক ছিলেন আইনেরও


অবসরের
পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। করাচিতে ঊর্দু অভিধান বোর্ডের প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন এই ভাষাবিদ। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রফেসর এমিরেটাস হন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রফেসর এমিরেটাস। ১৯৪৮ সালে তিনি আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তাছাড়া কলা অনুষদের ডিন হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

 

. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মোট ২৪টি ভাষার উপর গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সর্বমোট ২৭টি ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ভাষা হলো বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি, ইংরেজি, অসমিয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত ইত্যাদি।

. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা একাডেমি থেকে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান বের করার পরিকল্পনা। তখন মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় বিশাল একটি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান তৈরি হয়। তিনি দুই খণ্ডে বাংলা ভাষার ইতিহাস রচনা করেছেন। তাছাড়া তিনি বিদ্যাপতির পদগুলো সম্পাদনা করেন। তার আরেকটি অসামান্য কৃতিত্ব হলো তিনি বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন 'চর্যাপদ' এর সম্পাদনা করেন।

 

বাংলা একাডেমি থেকে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, দুই খণ্ডে বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন 'চর্যাপদএর সম্পাদনা করেন তিনি।

 

বাংলা একাডেমির ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাছাড়া বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।

. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শুধু তার কর্মজীবনই নয়, একজন মহৎ মানুষ হিসেবে এবং একজন সমাজসেবী হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজের সাথে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, ১৯২৮ সালে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন, ১৯৪১ সালে হায়দরাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্য বিদ্যা সম্মেলন ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সম্মানিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

 

অবসর সময়ে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বই নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর চকবাজারের বাড়িতে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন এই ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারেই পাঠে নিমগ্ন থাকতেন।




মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো আল-ইসলাম পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, আঙ্গুর, দি পীস, তকবীর বঙ্গভূমি ইত্যাদি। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় ৪০টি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ৬০টিরও অধিক প্রবন্ধ লিখেছেন শুধুমাত্র বাংলা ভাষার উপর। ভাষাতত্ত্বের ওপর তার ৩৭টি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া শখের বশে তিনি তিনটি ছোট গল্প এবং ২৯টি কবিতাও লিখেছেন।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url