হযরত ইউনুস (আঃ) -এর জীবনী





হযরত ইউনুস (আঃ)



হযরত ইউনুস বিন মাত্তা (আঃ)-এর কথা পবিত্র কুরআনের মোট ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে[1] বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুন-নূন’ (ﺫﻭ ﺍﻟﻨﻮﻥ) এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত’ ( ﺻﺎﺣﺐ ﺍﻟﺤﻮﺕ ) বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। সামনে তা বিবৃত হবে।

ইউনুস (আঃ)-এর কওম :

ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ (ﻧﻴﻨﻮﻯ) জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
ﻓَﻠَﻮْﻻَ ﻛَﺎﻧَﺖْ ﻗَﺮْﻳَﺔٌ ﺁﻣَﻨَﺖْ ﻓَﻨَﻔَﻌَﻬَﺎ ﺇِﻳﻤَﺎﻧُﻬَﺎ ﺇِﻻَّ ﻗَﻮْﻡَ ﻳُﻮْﻧُﺲَ ﻟَﻤَّﺎ ﺁﻣَﻨُﻮْﺍ ﻛَﺸَﻔْﻨَﺎ ﻋَﻨْﻬُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏَ ﺍﻟْﺨِﺰْﻱِ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺤَﻴَﺎﺓِ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻭَﻣَﺘَّﻌْﻨَﺎﻫُﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺣِﻴْﻦٍ
‘অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম’ (ইউনুস ১০/৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।
ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।

মাছের পেটে ইউনুস :

আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﻥَّ ﻳُﻮﻧُﺲَ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺮْﺳَﻠِﻴْﻦَ – ﺇِﺫْ ﺃَﺑَﻖَ ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟْﻔُﻠْﻚِ ﺍﻟْﻤَﺸْﺤُﻮْﻥِ – ﻓَﺴَﺎﻫَﻢَ ﻓَﻜَﺎﻥَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺪْﺣَﻀِﻴْﻦَ – ﻓَﺎﻟْﺘَﻘَﻤَﻪُ ﺍﻟْﺤُﻮْﺕُ ﻭَﻫُﻮَ ﻣُﻠِﻴْﻢٌ
‘আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন’। ‘যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল’। ‘অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হ’ল’। ‘অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী’ (ছাফফাত ৩৭/১৩৯-১৪২)।

আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।

ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) এক ঘণ্টা ছিলেন (২) তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন (৩) ৩ দিন ছিলেন (৪) ৭ দিন ছিলেন (৫) ২০ দিন ছিলেন (৬) ৪০ দিন ছিলেন।[2] আসলে এইসব মতভেদের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এসবের রচয়িতা হ’ল ইহুদী গল্পকারগণ। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহ ভাল জানেন।

ইউনুস কেন মাছের পেটে গেলেন?

এ বিষয়ে জনৈক আধুনিক মুফাসসির বলেন, রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি ঘটায় এবং সময়ের পূর্বেই এলাকা ত্যাগ করায় তাকে এই পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল। আর নবী চলে যাওয়ার কারণেই তার সম্প্রদায়কে আযাব দানে আল্লাহ সম্মত হননি’। অথচ পুরা দৃষ্টিকোণটাই ভুল। কেননা কোন নবী থেকেই তাঁর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটির কল্পনা করা নবীগণের নিষ্পাপত্বের আক্বীদার ঘোর বিপরীত। বরং তিনদিন পর আযাব আসবে, আল্লাহর পক্ষ হ’তে এরূপ নির্দেশনা পেয়ে তাঁর হুকুমেই তিনি এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। আর তার কওম থেকে আযাব উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের আন্তরিক তওবার কারণে, নবী চলে যাওয়ার কারণে নয়।[3]

ইউনুস মুক্তি পেলেন :

 
আল্লাহ বলেন,
ﻓَﻠَﻮْﻻَ ﺃَﻧَّﻪُ ﻛَﺎﻥَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺴَﺒِّﺤِﻴْﻦَ – ﻟَﻠَﺒِﺚَ ﻓِﻲْ ﺑَﻄْﻨِﻪِ ﺇِﻟَﻰ ﻳَﻮْﻡِ ﻳُﺒْﻌَﺜُﻮْﻥَ – ﻓَﻨَﺒَﺬْﻧَﺎﻩُ ﺑِﺎﻟْﻌَﺮَﺍﺀِ ﻭَﻫُﻮَ ﺳَﻘِﻴْﻢٌ – ﻭَﺃَﻧﺒَﺘْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺷَﺠَﺮَﺓً ﻣِّﻦ ﻳَّﻘْﻄِﻴْﻦٍ – ﻭَﺃَﺭْﺳَﻠْﻨَﺎﻩُ ﺇِﻟَﻰ ﻣِﺌَﺔِ ﺃَﻟْﻒٍ ﺃَﻭْ ﻳَﺰِﻳْﺪُﻭْﻥَ – ﻓَﺂﻣَﻨُﻮْﺍ ﻓَﻤَﺘَّﻌْﻨَﺎﻫُﻢْ ﺇِﻟَﻰ ﺣِﻴْﻦ
‘অতঃপর যদি সে আল্লাহর গুণগানকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হ’ত’(ছাফফাত ১৪৩)। ‘তাহ’লে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’?
(১৪৪)।‘অতঃপর আমরা তাকে একটি বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’(১৪৫)। ‘আমরা তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’(১৪৬)। ‘এবং তাকে লক্ষ বা তদোধিক লোকের দিকে প্রেরণ করলাম’(১৪৭)। ‘তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১৪৩-১৪৮)।

আলোচ্য আয়াতে ‘ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত সে মাছের পেটেই থাকত’-এর অর্থ সে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারতো না। বরং মাছের পেটেই তার কবর হ’ত এবং সেখান থেকেই ক্বিয়ামতের দিন তার পুনরুত্থান হ’ত।

অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
ﻓَﺎﺻْﺒِﺮْ ﻟِﺤُﻜْﻢِ ﺭَﺑِّﻚَ ﻭَﻻَ ﺗَﻜُﻦْ ﻛَﺼَﺎﺣِﺐِ ﺍﻟْﺤُﻮْﺕِ ﺇِﺫْ ﻧَﺎﺩَﻯ ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﻜْﻈُﻮْﻡٌ – ﻟَﻮْﻻَ ﺃَﻥْ ﺗَﺪَﺍﺭَﻛَﻪُ ﻧِﻌْﻤَﺔٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻪِ ﻟَﻨُﺒِﺬَ ﺑِﺎﻟْﻌَﺮَﺍﺀِ ﻭَﻫُﻮَ ﻣَﺬْﻣُﻮْﻡٌ – ﻓَﺎﺟْﺘَﺒَﺎﻩُ ﺭَﺑُّﻪُ ﻓَﺠَﻌَﻠَﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦ
‘তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম ৬৮/৪৮-৫০)।

‘যদি আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’-এর অর্থ আল্লাহ যদি তাকে তওবা করার তাওফীক্ব না দিতেন এবং তার দো‘আ কবুল না করতেন, তাহ’লে তাকে জীবিত অবস্থায় নদী তীরে মাটির উপর ফেলতেন না। যেখানে গাছের পাতা খেয়ে তিনি পুষ্টি ও শক্তি লাভ করেন। বরং তাকে মৃত অবস্থায় নদীর কোন বালুচরে ফেলে রাখা হ’ত, যা তার জন্য লজ্জাষ্কর হ’ত।

‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন’ অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আল্লাহ ইউনুসকে মনোনীত করেননি; বরং এটা হ’ল বর্ণনার আগপিছ মাত্র। কুরআনের বহু স্থানে এরূপ রয়েছে। এখানে এর ব্যাখ্যা এই যে, ইউনুস মাছের পেটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাকে পুনরায় কাছে টানলেন ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

অন্যত্র ইউনুসের ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺫَﺍ ﺍﻟﻨُّﻮْﻥِ ﺇِﺫْ ﺫَﻫَﺐَ ﻣُﻐَﺎﺿِﺒﺎً ﻓَﻈَﻦَّ ﺃَﻥ ﻟَّﻦْ ﻧَﻘْﺪِﺭَ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓَﻨَﺎﺩَﻯ ﻓِﻲ ﺍﻟﻈُّﻠُﻤَﺎﺕِ ﺃَﻥ ﻻَّ ﺇِﻟَﻪَ ﺇِﻻَّ ﺃَﻧْﺖَ ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﺇِﻧِّﻲْ ﻛُﻨْﺖُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴْﻦَ – ﻓَﺎﺳْﺘَﺠَﺒْﻨَﺎ ﻟَﻪُ ﻭَﻧَﺠَّﻴْﻨَﺎﻩُ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻐَﻢِّ ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧُﻨْﺠِﻲ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ
‘এবং মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’।[4] ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮)।

ইউনুস (আঃ)-এর উক্ত দো‘আ ‘দো‘আয়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ﺩﻋﻮﺓُ ﺫﻯ ﺍﻟﻨﻮﻥ ﺇﺫْ ﺩﻋﺎ ﺭَﺑَّﻪُ ﻭﻫﻮ ﻓﻰ ﺑﻄﻦ ﺍﻟﺤﻮﺕِ ) ﻵ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ ﺃﻧﺖ ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﺇﻧﻰ ﻛﻨﺖُ ﻣﻦ ﺍﻟﻈﺎﻟﻤﻴﻦ ( ﻟﻢ ﻳَﺪْﻉُ ﺑﻬﺎ ﺭﺟﻞٌ ﻣﺴﻠﻢٌ ﻓﻰ ﺷﻲﺀٍ ﺇﻻَّ ﺍﺳْﺘَﺠَﺎﺏَ ﻟَﻪُ، ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ –
‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক মকছূদ হাছিলের নিমিত্তে) উক্ত দো‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ﻻ ﺗُﻔَﻀِّﻠُﻮْﺍ ﺑﻴﻦ ﺃﻧﺒﻴﺎﺀ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﻣﺎ ﻳَﻨْﺒَﻐِﻲْ ﻟﻌﺒﺪٍ ﺃﻥ ﻳَّﻘﻮﻝَ : ﺇﻧِّﻲ ﺧﻴﺮٌ ﻣِّﻦْ ﻳُﻮْﻧُﺲَ ﺑْﻦِ ﻣَﺘَّﻰ، ﻣﺘﻔﻖ ﻋﻠﻴﻪ –
‘তোমরা আল্লাহর নবীগণের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য করো না। আর কোন বান্দার জন্য এটা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস বিন মাত্তার চাইতে উত্তম’।[6] কুরতুবী এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটা এজন্য বলেছেন যে, তিনি যেমন (মি‘রাজে) সিদরাতুল মুনতাহায় আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছিলেন, নদীর অন্ধকার গর্ভে মাছের পেটের মধ্যে তেমনি আল্লাহ ইউনুস-এর নিকটবর্তী হয়েছিলেন (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)। বস্ত্ততঃ এটা ছিল রাসূলের নিরহংকার স্বভাব ও বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

উপরোক্ত আয়াত সমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকার পরে আল্লাহর হুকুমে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। মাছের পেটে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা তিনি খেয়েছিলেন, যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজ কওমের নিকটে চলে যান। যাদের সংখ্যা এক লক্ষ বা তার বেশী ছিল। তারা তাঁর উপরে ঈমান আনলো। ফলে পুনরায় শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ দেন।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
(১) বিভ্রান্ত কওমের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাজ সংস্কারকের উচিত নয়।
(২) আল্লাহ তার নেক বান্দার উপর শাস্তি আরোপ করবেন না, যেকোন সংকটে এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।
(৩) আল্লাহর পরীক্ষা কিরূপ হবে, তা পরীক্ষা আগমনের এক সেকেন্ড পূর্বেও জানা যাবে না।
(৪) কঠিনতম কষ্টের মুহূর্তে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।
(৫) খালেছ তওবা ও আকুল প্রার্থনার ফলে অনেক সময় আল্লাহ গযব উঠিয়ে নিয়ে থাকেন। যেমন ইউনুসের কওমের উপর থেকে আল্লাহ গযব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
(৬) আল্লাহ ইচ্ছা করলে যেকোন পরিবেশে ঈমানদারকে রক্ষা করে থাকেন।
(৭) পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা ও জলচর প্রাণী সবাই আল্লাহর হুকুমে ঈমানদার ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়। যেমন মাছ ও লতা জাতীয় গাছ ইউনুসের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিল।
(৮) বাহ্যদৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত খারাব মনে হ’লেও নেককার ব্যক্তির জন্য আল্লাহ উত্তম ফায়ছালা করে থাকেন। যেমন লটারীতে নদীতে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিজের জন্য অতীব খারাব মনে হ’লেও আল্লাহ ইউনুসের জন্য উত্তম ফায়ছালা দান করেন ও তাকে মুক্ত করেন।
(৯) আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত দো‘আ কবুল হয় না। যেমন গভীর সংকটে নিপতিত হবার আগে ও পরে ইউনুস আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। ফলে আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করেন।
১০) আল্লাহর প্রতিটি কর্ম তার নেককার বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। যা বান্দা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে। যেমন ইউনুস পরে বুঝতে পেরে আল্লাহর প্রতি অধিক অনুগত হন এবং এজন্য তিনি আল্লাহর প্রতি অধিক প্রত্যাবর্তনশীল (ﺃَﻭَّﺍﺏٌ) বলে আল্লাহর প্রশংসা পান।

সূত্র :
[1]. যথাক্রমে (১) সূরা নিসা ৪/১৬৩; (২) আন‘আম ৬/৮৬; (৩) ইউনুস ১০/৯৮; (৪) আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮; (৫) ছাফফাত ৩৭/১৩৯-১৪৮; (৬) ক্বলম ৬৮/৪৮-৫০। সর্বমোট = ১৮টি \
[2]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২১৮ পৃঃ; কুরতুবী, তাফসীর সূরা ছাফফাত ১৪৪।
[3]. দ্রঃ তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন (বঙ্গানুবাদ, সংক্ষেপায়িত) পৃঃ ৬১৭-১৮।
[4]. অধিকাংশ তাফসীর গ্রন্থে এখানে অনুবাদে মারাত্মক ভুল করা হয়েছে। যেমন (১) বঙ্গানুবাদ তাফসীর ইবনু কাছীরে বলা হয়েছে ‘তিনি মনে করেছিলেন আমি তার উপর কোন ক্ষমতা রাখি না’। অথচ কোন নবী কখনো আল্লাহ সম্পর্কে এরূপ ধারণা করতে পারেন না। এখানে অনুবাদক ‘কুদরত’ মাদ্দাহ থেকে শব্দার্থ করেছেন, যেটা এখানে ভুল শুধু নয় বরং অন্যায়। (২) সঊদী সরকার প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে ধৃত করতে পারব না’ (৩) একই মর্মে অনুবাদ করা হয়েছে সঊদী সরকার প্রকাশিত উর্দূ তাফসীরে এবং (৪) আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অনুদিত ইংরেজী তাফসীরে।
[5]. তিরমিযী হা/৩৭৫২ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ৮৫ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২২৯২ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায় ‘আল্লাহর নাম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-২।
[6]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৯-১০, ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়, ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ- ৯।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url