ইস্তিখারা নামাজ কি এবং কেন || ইস্তিখারা নামাজের গুরুত্ব || ইস্তিখারা নামাজের নিয়ম || ইস্তিখারা সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা ||




ইস্তিখারা নামাজের নিয়ম এবং কিছু ভুল ধারণা


পাঠ্যসূচীঃ

ইসতিখারা কি এবং কেন করবো

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক বিরাট দান- ইসতিখারা।কমজোর বান্দা দুনিয়ার জীবনে কত কিছুর মুখাপেক্ষী। তার কত প্রয়োজন, কত দায়িত্ব। এই সব বিষয়ে সে আসমানী শান্তনার ছায়া পেতে পারে ইসতিখারার মাধ্যমে। আল্লাহর ফায়সালার প্রতীক্ষা, আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজেকে সমর্পণ এবং আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট হওয়ার অপূর্ব এক অনুশীলন এই ইসতিখারা। এরচেয়েও বড় কথা হল, ইসতিখারার মাধ্যমে বান্দা যেন সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। নিজের ভবিষ্যত ও ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, দ্বিধাগ্রস্ত, দোদুল্যমান এক বান্দার জন্য এ কত বড় প্রাপ্তি!

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইসতিখারার আমল শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُعَلِّمُنَا الِاسْتِخَارَةَ فِي الأُمُورِ كُلِّهَا، كَمَا يُعَلِّمُنَا السّورَةَ مِنَ القُرْآنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কুরআনের সূরা যেভাবে শেখাতেন, সকল বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) সেভাবে ইসতিখারা করতে শিখিয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৬
অর্থাৎ কুরআনের আয়াত যেভাবে মুখস্থ করিয়েছেন সেভাবেই ইসতিখারার আমল শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইসতিখারার দুআ মুখস্থ করিয়েছেন।

ইসতিখারা শব্দের অর্থ হল, খাইর বা কল্যাণ প্রার্থনা করা। অর্থাৎ যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আগে উক্ত বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা এবং দুআ করা যে, হে আল্লাহ! যেভাবে এই কাজ করলে আমার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ হবে, সেইভাবে কাজটি করার তাওফীক দান করুন। তার জন্য সহায়ক সকল আসবাবের ব্যবস্থা আপনি করে দিন এবং আমার মনকে সেইদিকে ঝুঁকিয়ে দিন। আর যেভাবে করলে অকল্যাণ হবে, সেভাবে করা থেকে আমাকে বিরত রাখুন এবং আমার মনকে আপনার ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট করে দিন। মনের দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা দূর করে দিন।

দুই রাকাত নামায পড়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো বিশেষ একটি দু’আর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার কাছে কল্যাণ চাওয়াকে ইসতিখারা বলে। ইসতিখারা করা সুন্নাত।

দ্বীন-দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো কাজ এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে কর্তব্য হল- প্রথমে আল্লাহ প্রদত্ত আকল ও বিবেক-বুদ্ধিকে ব্যবহার করা। সেই কাজ ও সিদ্ধান্তের নানা দিক বিবেচনা করে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং উপকারী-অনুপকারী বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা।

এরপর দুই রাকাত নামায পড়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দু’আর মাধ্যমে ইসতিখারা করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা।
এর সঙ্গে সঙ্গে আপনজন, ঘনিষ্ঠজন, হিতাকাঙ্খি ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে মাশওয়ারা বা পরামর্শ করা।

ইসলামী শরীয়তে মাশওয়ারার গুরুত্বও অনেক। কুরআনুল কারীমে খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে-  وَ شَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِ
অর্থাৎ (গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে) আপনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে মাশওয়ারা করুন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৫৯
অন্য এক আয়াত আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন-
وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰی بَیْنَهُمْ.
অর্থাৎ তাঁদের বিষয়াবলী পারস্পরিক মাশওয়ারার মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়। -সূরা শূরা: ৩৮

ইসতিখারার সুন্নাতী নিয়ম ও দু’আ

সহীহ বুখারীসহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য অনেক কিতাবে হযরত জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা করবে প্রথমে দুই রাকাত নামায পড়বে। এরপর এই দো’আ-

اَللّٰهُمّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوْبِ، اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ، ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ. وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِه.

হে আল্লাহ! আমি আপনার ইলমের ওসিলায় আপনার কাছে (আমার উদ্দিষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই এবং আপনার কুদরতের ওসিলায় আপনার কাছে (কল্যাণ অর্জনের) শক্তি চাই, আর আপনার কাছে চাই আপনার মহা অনুগ্রহের কিছু। কেননা, (সকল বিষয়ে) আপনার ক্ষমতা রয়েছে, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনি (সবকিছু) জানেন, আমি কিছুই জানি না। আপনি তো আল্লামুল গুয়ূব-গায়েবের সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। (অর্থাৎ আমার কাঙ্খিত বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর কি না- তা আপনিই জানেন, আমি জানি না।) হে আল্লাহ! আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণামের বিচারে যদি এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর বলে জানেন, তাহলে আমার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে দিন এবং বিষয়টিকে আমার জন্য সহজ করে দিন। এরপর তাতে আমার জন্য বরকত দান করুন।

আর যদি বিষয়টি আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও কাজের পরিণাম বিচারে আমার জন্য ক্ষতিকর বলে জানেন, তাহলে আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে দিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন; তা যেখানেই হোক। অতপর তাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাই সেই তাওফীক দান করুন।
তিনি ইরশাদ করেন, দু’আটির যে দুই জায়গায় هَذَا الأَمْرَ শব্দ আছে, সেখানে নিজ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। (কিংবা অন্তত মনে মনে কল্পনা করবে।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৬, ৬৩৮২, ৭৩৯০; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮০ ; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৩৮

কোনো কোনো বুযুর্গ বলেন, ইসতিখারা করলে সম্ভাব্য বিষয়গুলোর কোনো একটির দিকে দিলের ঝোঁক সৃষ্টি হয়। তবে যদি কোনো দিকে ঝোঁক নাও হয় এবং কোন্ কাজটি করবে সে ব্যাপারে মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বও থেকে যায় তবু ইসতিখারার মাকসাদ পূর্ণ হয়ে যাবে। কারণ, ইসতিখারা করার পর আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে দিয়ে সেই কাজই করিয়ে নেন, যা বান্দার জন্য কল্যাণকর। ইসতিখারার পর সেই কাজেরই প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি তৈরি হয়, যাতে বান্দার জন্য কল্যাণ নিহিত থাকে। বান্দা তখন নিজের অজান্তেই সেই কাজের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।


আবার কখনো বান্দা কোনো বিষয়কে কল্যাণকর মনে করে সেটি করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ কোনোভাবে সেই কাজে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে সেই কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এভাবে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে তা থেকে বিরত রাখেন। অতএব ইসতিখারা করার পর বান্দা ধীরে ধীরে কাজের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাকে কল্যাণকর বিষয়ের দিকেই নিয়ে যাবেন- এই বিশ্বাস রেখে কাজ করবে।
এক্ষেত্রে হযরত ইবনে উমর (রাঃ)-এর বিখ্যাত বাণীটিও মনে রাখবে, তিনি বলেছেন-

إِنّ الرّجُلَ يَسْتَخِير اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَيَخْتَارُ لَهُ، فَيَسْخَطُ عَلَى رَبِّهِ عَزّ وَجَلّ، فَلَا يَلْبَثُ أَنْ يَنْظُرَ فِي الْعَاقِبَةِ، فَإِذَا هُوَ خَيْرٌ لَهُ.

অনেক সময় মানুষ ইসতিখারার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সেই বিষয়টিই নির্বাচন করেন, যাতে তার কল্যাণ নিহিত। কিন্তু (বাহ্যিক দৃষ্টিতে বান্দার কাছে তা কল্যাণকর মনে না হওয়ায়) সে আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এরপর যখন বিষয়টির সুন্দর পরিণাম দেখতে পায় তখন বুঝতে পারে, সেই ফায়সালা কত কল্যাণময় ছিল। -কিতাবুয যুহদ, ইবনুল মুবারক,  পৃষ্ঠা ৩৩,  রেওয়ায়েত ১২৮

অর্থাৎ ইসতিখারার পর আল্লাহ তাআলা যে কাজের দিকে বান্দাকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন বান্দা যেন সেটিকেই তার জন্য কল্যাণকর মনে করে। কারণ বান্দা যখন ইসতিখারা করে তখন আল্লাহ তাআলা তাকে কল্যাণের দিকেই নিয়ে যান। এক্ষেত্রে বান্দা বিষয়টি না বোঝার কারণে কিংবা প্রকৃত অবস্থা না জানার কারণে কখনো মনে কষ্ট পায়। ভাবে, আল্লাহর কাছে আমি কল্যাণ প্রার্থনা করলাম কিন্তু আল্লাহ আমার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করলেন না (আল্লাহ সম্পর্কে এমন ধারণা থেকে আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন)। অবশ্য পরে যখন প্রকৃত বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় এবং বান্দা নিজেই তার কল্যাণ দেখতে পায় তখন ভুল ভাঙ্গে। তাতে আল্লাহর প্রতি সমর্পণের বরকত থেকে সে বঞ্চিত হয় এবং তাঁর প্রতি মন্দ ধারণার গোনাহে লিপ্ত হয়। কখনো তো এমনও হয় যে, আল্লাহর ফায়সালার কল্যাণকরতা দুনিয়াতে প্রকাশ পায় না। আখিরাতে প্রকাশ পায়। সেক্ষেত্রে বান্দা কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভুল শোধরানোর এবং তাওবা ইসতিগফারের সুযোগও পায় না। তাই ইসতিখারার হাকীকত ও গুরুত্ব জেনে আমল করলে বান্দা অনেক স্বস্তি ও আনন্দের সাথে কামিয়াবী অর্জন করতে পারে।

ইসতিখারা করার সঠিক পদ্ধতি

ইসতিখারার যে সুন্নত পদ্ধতিটি বর্ণনা করা হল সেটি তখনকার জন্য প্রযোজ্য যখন এই নিয়মে ইসতিখারা করার সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ইসতিখারার নিয়তে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে ইসতিখারার মাসনূন দু’আটি পড়া যায়। কিন্তু অনেক সময় তো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিংবা দুই রাকাত নামায পড়ে উক্ত দু’আটি পাঠ করার মতো সময় ও সুযোগ পাওয়া যায় না। তখনকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত দু’আ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। 
দু’আটি হল-  اللّهُمّ خِرْ لِي وَاخْتَرْ لِي.

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর বাবা হযরত আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতেন এই দু’আ পড়তেন। দু’আটির অর্থ হল, হে আল্লাহ! আমাকে কল্যাণ দান করুন এবং আমার জন্য আপনিই নির্বাচন করে দিন (কোন বিষয়টি আমার অবলম্বন করা উচিত)। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫১৬

এক্ষেত্রে পড়ার মতো আরেকটি দুআ হল- اللهُمّ اهْدِنِي وَسَدِّدْنِي.

হে আল্লাহ! আমাকে পথ প্রদর্শন করুন এবং সঠিক পথে অবিচল রাখুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২৫

এমন আরেকটি মাসনূন দু’আ-  اللّهُمّ أَلْهِمْنِي رُشْدِي وَأَعِذْنِي مِنْ شَرِّ نَفْسِي.
হে আল্লাহ! আমার অন্তরে সঠিক পথের ‘ইলহাম’ করুন এবং নফসের মন্দত্ব থেকে আমাকে রক্ষা করুন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৮৩

এই দু’আগুলোর মধ্য থেকে যেটি মনে আসবে পড়ে নিবে। এমনকি যদি আরবী দু’আ মুখস্থ না থাকে কিংবা মনে না আসে তাহলে নিজের ভাষায় আল্লাহকে বলবে, হে আল্লাহ! আমি দ্বিধান্বিত। আমাকে সঠিক পথ অবলম্বন করার এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাওফীক দিন। যদি মুখে বলা সম্ভব না হয় তাহলে মনে মনেই আল্লাহর কাছে আবেদন করবে, হে আল্লাহ! আমি এই সমস্যার সম্মুখীন। আমাকে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার তাওফীক দিন। যে পথে আমার জন্য কল্যাণ নিহিত এবং যে পথ ধরে অগ্রসর হলে আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব সে পথে অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দান করুন।
 

ইসতিখারা কতবার করবে

একই বিষয়ের জন্য ইসতিখারা একাধিকবার করার কথা কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় নাই। তাই সাধারণ নিয়ম হল, ইসতিখারা একবার করা। তবে যেহেতু বারবার দুআ করার বিষয়টি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর ইসতিখারা তো দুআরই একটি প্রকার। সেজন্য ইসতিখারার নামায ও দুআ বারবার করা যায়।

ইসতিখারা সম্পর্কিত কিছু বিষয় জানা উচিৎ

১. ইসতিখারার নামাযে যে কোনো সূরা বা কুরআন মাজীদের যে কোনো জায়গা থেকে তিলাওয়াত করা যায়। উলামায়ে কেরামের কেউ কেউ প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরূন দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়ার পরামর্শ দেন। কেউ কেউ পরামর্শ দেন প্রথম রাকাতে সূরা কাসাসের ৬৮ নম্বর আয়াত-
وَ رَبّكَ یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ وَ یَخْتَارُ  مَا كَانَ لَهُمُ الْخِیَرَةُ  سُبْحٰنَ اللهِ وَ تَعٰلٰی عَمّا یُشْرِكُوْنَ.
পড়তে, 
আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা আহযাবের ৩৬ নম্বর আয়াত-
وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَّ لَا مُؤْمِنَةٍ اِذَا قَضَی اللهُ وَ رَسُوْلُهٗۤ اَمْرًا اَنْ یَّكُوْنَ لَهُمُ الْخِیَرَةُ مِنْ اَمْرِهِمْ  وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیْنًا. পড়তে। 
কিন্তু এজাতীয় কোনো কথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব কুরআন মাজীদের যে কোনো সূরা বা আয়াত পড়তে পারে। উপরোক্ত সূরা বা আয়াত পড়তেও কোনো সমস্যা নেই।

২. যদি সময় ও সুযোগ থাকে এবং বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে একাধিকবার আমল করা যেতে পারে।

৩. ইসতিখারা ও মশওয়ারার পর স্বপ্ন দেখার বিষয়টি আবশ্যকীয় নয়। তাছাড়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুবই জটিল একটি শাস্ত্র। কখনো বিভিন্ন কারণে একই স্বপ্নের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়, সঠিক ব্যাখ্যা নির্ধারণ করা যথেষ্ট মুশকিল হয়। উপরন্তু স্বপ্ন তো শরীয়তের কোনো দলীলও নয়।

৪. ইসতিখারার পর মন যেদিকে ঝুঁকবে সেই দিকটি শরীয়ত ও আকল-বিবেকের বিচারেও উত্তম হওয়া জরুরী। অন্যথায়, নফস বা শয়তানের ধোঁকায় মানুষ এমন কোনো দিক অবলম্বন করতে পারে, যা শরীয়ত ও আকল-বিবেকের দৃষ্টিতে উত্তম নয়। কিন্তু প্রবৃত্তির টানে মানুষ সেই দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।

৫. একথাও সবসময় মনে রাখা দরকার যে, দুনিয়া ভালো-মন্দ উভয়ের সম্মিলনস্থল। তাই ইসতিখারার পর যে দিকটি অবলম্বন করা হবে তাতে ইনশাআল্লাহ কল্যাণের অংশই বেশি হবে। বাকি অকল্যাণের কিছু অংশ তাতে থাকা বিচিত্র নয়। অর্থাৎ অধিক কল্যাণের বিবেচনাই এখানে কল্যাণ।

৬. ইসতিখারার পর যে পথ ও পন্থা অবলম্বন করা হবে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হবে। অর্থাৎ ইসতিখারার পর বান্দার জন্য কল্যাণের পথই উন্মুক্ত হবে। অকল্যাণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এই কল্যাণ ধরে রাখার মেহনতও অব্যাহত রাখতে হবে। নিজের বদ আমল, গাফলত কিংবা অন্য কোনো কারণে যেন সেই কল্যাণ বন্ধ হয়ে না যায়- সেই চেষ্টাও করে যেতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- ইসতিখারার পর কোনো গাড়ি, বাড়ি বা কোনো জমি সংগ্রহ করা হল, কিংবা কোনো মেয়েকে বিয়ে দেয়া হল, ছেলেকে বিয়ে করানো হল, এখন এসবের হক আদায় করে সেই কল্যাণ বজায় রাখতে হবে।  নিজের কোনো বদ আমলের কারণে যদি কোনো ধরনের অকল্যাণ প্রকাশ পায় সেটার জন্য ইসতিখারাকে দোষারোপ করা যাবে না।

৭. সর্বোপরি আখেরাতের কল্যাণই মুমিনের প্রকৃত কল্যাণ। সুতরাং দুনিয়ার জীবনে যদি কোনো সমস্যা, সংকট বা পেরেশানী হয় কিন্তু আখেরাতের হিসাবে তা কল্যাণের হয়, তাহলে তো মুমিনের কল্যাণ তাতে আরো বেশি।

সবচেয়ে বড় কথা, ইসতিখারার মাধ্যমে যেহেতু মুমিন আল্লাহর কাছেই কল্যাণ প্রার্থনা করছে, তো নিশ্চয় আল্লাহ কল্যাণ দান করবেনই। সে দানের মাধ্যম কখনো বুঝে আসে কখনো বুঝে আসে না। তাই তো বাহ্যত অকল্যাণ দেখার পর আল্লাহ নির্ধারিত কল্যাণ যখন মুমিন লাভ করে তখন বলে- ‘আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।’

ইস্তিখারাহ নিয়ে কিছু ভুল ধারণা

ইস্তেখারার জন্য দুটি কাজ করণীয় বলে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে। দু’ রাকাত নামায আদায় করা এবং ইস্তেখারার প্রসিদ্ধ মাসনূন দুআটি মনোযোগের সাথে পড়া। সময়ের স্বল্পতা বা অন্য কোনো কারণে এই দু’টি কাজ সম্ভব না হলে তিনবার বা সাতবার এই দুআ পড়েও ইস্তেখারা করা যায়, اللهم خر لي واخترلي (ইবনুস সুন্নী, হাদীস : ৫৯৭, ৫৯৮) অতঃপর যে দিকে কলবের ইতমিনান হবে আল্লাহর উপর ভরসা করে সেই কাজ আরম্ভ করবে। এভাবে আমল করলে ইস্তেখারা হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, এই আমল করার জন্য শরীয়তে নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। রাত বা দিনের যেকোনো সময় তা করা যায়। কিন্তু অনেকে মনে করে, ইস্তেখারার জন্য ঘুমাতে হয় কিংবা রাত্রি বেলায় ঘুমানোর আগেই শুধু ইস্তেখারা করা যায়। আবার অনেকে মনে করে, স্বপ্ন দেখলেই ইস্তেখারা পূর্ণ হবে। আসলে এর কোনোটিই ইস্তেখারার জরুরি কোনো বিষয় নয়; বরং রাত-দিনের যে সময় নামায পড়া যায় তখনই দুই রাকাত নামায ও নির্দিষ্ট দুআটি পড়ে ইস্তেখারা করে নেওয়া যায়।

কিন্তু কেউ কেউ মনে করে, ইস্তিখারার নামায ও দুআ শোয়ার আগে করতে হয়। আর ইস্তিখারার ফলাফল অর্থাৎ কাজটি করা উচিত কি উচিত না-তা স্বপ্নযোগে জানিয়ে দেওয়া হয়। এটি নিঃসন্দেহে ভিত্তিহীন ধারণা। ইস্তিখারার পর কেউ কোনো স্বপ্ন দেখতেও পারে। কিন্তু স্বপ্ন তো ইস্তিখারা ছাড়াও দেখা যায়। স্বপ্নে কোনো কিছু দেখলে তাকে বিচার করতে হবে স্বপ্নের বিষয়ে শরীয়তের যে বিধান আছে তারই ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরঈ বিধান অনুযায়ী। আর স্বপ্ন যে কোনো দলিল নয়-এ তো সবাই জানে।

ইস্তিখারা বিষয়ক আরেকটি ভুল হল, দুআ-ওযিফার কোনো কোনো অনির্ভরযোগ্য বইপত্রে ইস্তিখারার যে পদ্ধতি উল্লেখ রয়েছে তা পালন করা। অথচ ইস্তিখারার মাসনুন পদ্ধতি ছেড়ে কারো অভিজ্ঞতা বা উদ্ভাবন গ্রহণ করার কোনো অর্থ হতে পারে না।
ইস্তিখারার একটি নবউদ্ভাবিত ও বিদআতী পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন মজীদ থেকে কিংবা দেওয়ানে হাফেয, মাছনবী ইত্যাদি থেকে ইঙ্গিত গ্রহণ। এটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। আর কুরআন মজীদ থেকে এ জাতীয় ইঙ্গিত গ্রহণ মূলত কুরআনের সাথে বেআদবী।
আরেকটি ভুল হল, নিজে না করে অন্যকে দিয়ে ইস্তিখারা করানো। অনেকে মসজিদের ইমাম সাহেব অথবা পরিচিত কোনো আলিমের কাছে ইস্তিখারার আবেদন করে থাকেন। অথচ হাদীস শরীফে প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তিকেই ইস্তিখারা করতে বলা হয়েছে।

সবচেয়ে মারাত্মক ভ্রান্তি এই যে, কোনো কোনো মানুষ শুধু কাজের ইচ্ছার সময়ই নয়; বরং গায়েবের বিভিন্ন কথা জানার জন্য বে-শরা তদবিরকারীর কাছে যায় এবং এটাকেও ইস্তিখারা বলে। এমনকি ঐ সকল কথা বিশ্বাসও করে। অথচ গায়েব জানার জন্য কারো কাছে যাওয়া এবং তার কথা বিশ্বাস করা এক প্রকারের শিরক। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের শিরক থেকে হেফাযত করুন। আমীন।

(বিস্তারিত জানার জন্য অধ্যয়ন করুন: আলমাদখাল, ইবনুল হাজ্ব ৪/৩৬-৪০; হায়াতুল হায়াওয়ান ৩/৩৮; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, মুরতাযা যাবী ২/২৮৫। উর্দু দায়েরায়ে মাআরিফে ইসলামিয়া, লাহোরের (২/৫৭১-৫৭৩) প্রবন্ধটিও ভালো।)




****************************************

>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url