সূরা আত তীন তেলাওয়াত, উচ্চারণ, অনুবাদ ও তাফসীর || কারী শেখ আব্দুল বাসিত ||

সূরা আত তীন তেলাওয়াত

কারী শেখ আব্দুল বাসিত

আল কুরআনের বিষয় ভিত্তিক আয়াতের তাফসীর পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সূরা আত তীন আরবী উচ্চারণ

১   وَ التِّیۡنِ وَ الزَّیۡتُوۡنِ ۙ
২   وَ طُوۡرِ سِیۡنِیۡنَ
৩  وَ هٰذَا الۡبَلَدِ الۡاَمِیۡنِ ۙ
৪   لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ
৫   ثُمَّ رَدَدۡنٰهُ اَسۡفَلَ سٰفِلِیۡنَ ۙ
৬   اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَهُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ
৭   فَمَا یُکَذِّبُکَ بَعۡدُ بِالدِّیۡنِ ؕ
৮   اَلَیۡسَ اللّٰهُ بِاَحۡکَمِ الۡحٰکِمِیۡنَ 

সূরা আত তীন বাংলা উচ্চারণ

১.  ওয়াততীন ওয়াঝঝাইতূন।
২.  ওয়া তূরি ছীনীন।
৩.  ওয়া হা-যাল বালাদিল আমীন।
৪.  লাকাদ খালাকনাল ইনছা-না ফীআহছানি তাকবীম।
৫.  ছু ম্মা রাদাদ না-হু আছফালা ছা-ফিলীন।
৬. ইল্লাল্লাযীনা আ-মানূওয়া‘আমিলুসসা-লিহা-তি ফালাহুম আজরুন গাইরু মামনূন।
৭.  ফামা-ইউকাযযি বুকা বা‘দুবিদ্দীন।
৮. আলাইছাল্লা-হু বিআহকামিল হা-কিমীন।

সূরা আত তীন অনুবাদ

১.  কসম ‘তীন ও যায়তূন’ এর।
২.  কসম ‘সিনাই’ পর্বতের, 
৩.  কসম এই নিরাপদ নগরীর। 
৪.  অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে। 
৫.  তারপর আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি হীনদের হীনতম রূপে।
৬.  তবে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।
৭.  সুতরাং এরপরও কিসে তোমাকে কর্মফল সম্পর্কে অবিশ্বাসী করে তোলে? 
৮.  আল্লাহ কি বিচারকদের শ্রেষ্ঠ বিচারক নন? 

সূরা আত তীন তাফসীর

১. শপথ তীন ও যায়তুন(১)-এর,

(১) এর ব্যাখ্যায় মুফাস্‌সিরগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। হাসান বসরী, ইকরামাহ, আতা ইবনে আবী রাবাহ, জাবের ইবনে যায়েদ, মুজাহিদ ও ইবরাহীম নাখায়ী রাহিমাহুমুল্লাহ বলেন, তীন বা আঞ্জির (গোল হালকা কালচে বর্ণের এক রকম মিষ্টি ফল) বলতে এই সাধারণ তীনকে বুঝানো হয়েছে, যা লোকেরা খায়। আর যায়তুন বলতেও এই যায়তুনই বুঝানো হয়েছে, যা থেকে তেল বের করা হয়। [কুরতুবী, তাবারী] কোন কোন মুফাস্‌সির বলেন তীন ও যায়তুন শব্দের অর্থ এই ফল দুটি উৎপাদনের সমগ্র এলাকা হতে পারে। আর এটি হচ্ছে সিরিয়া ও ফিলিস্তীন এলাকা। কারণ সে যুগের আরবে তীন ও যায়তূন উৎপাদনের জন্য এ দুটি এলাকাই পরিচিত ছিল। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়েম রাহিমাহুমুল্লাহ এই ব্যাখ্যা অবলম্বন করেছেন। অন্যদিকে ইবনে জারীর প্রথম বক্তব্যটিকে অগ্ৰাধিকার দিলেও একথা মেনে নিয়েছেন যে, তীন ও যায়তুন দ্বারা এই ফল দু'টি উৎপাদনের এলাকা উদ্দেশ্য হতে পারে।

২. শপথ তূরে সীনীন(১)-এর,

(১) বলা হয়েছে “তূরে সীনীন” এর অর্থ, সীনীন অঞ্চলের তূর পর্বত। এ পাহাড়ে আল্লাহ তা'আলা মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছিলেন। [মুয়াস্‌সার] এ পাহাড় সীনীন উপত্যকায় অবস্থিত, যার অপর নাম সাইনা। আর সাইনা বা সিনাই মিসর ও ফিলিস্তিন দেশের মধ্যে একটি মরুভূমি। [আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর]

৩. শপথ এই নিরাপদ নগরীর(১)

(১) এ সূরায় কয়েকটি বস্তুর শপথ করা হয়েছে। (এক) তীন অর্থাৎ আঞ্জির বা ডুমুর এবং যায়তুন। (দুই) সিনাই প্রান্তরস্থ তুর পর্বত। (তিন) নিরাপদ শহর তথা মক্কা মোকাররমা। এই বিশেষ শপথের কারণ এই হতে পারে যে, তুর পর্বত ও মক্কা নগরীর ন্যায় ডুমুর ও যায়তুন বৃক্ষও বিপুল উপকারী বস্তু। অথবা এটাও সম্ভবপর যে, এখানে তীন ও যায়তুন উল্লেখ করে সে স্থানকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে এ বৃক্ষ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আর সে স্থান হচ্ছে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অঞ্চল, যা অগণিত রাসূলগণের আবাসভূমি। বিশেষ করে তা ঈসা আলাইহিস সালামের নবুয়ত-প্ৰাপ্তিস্থান। আর তুর পর্বত মূসা আলাইহিস সালাম-এর আল্লাহর সাথে বাক্যালাপের স্থান। সিনীন অথবা সীনা- তুর পর্বতের অবস্থানস্থলের নাম। পরবর্তীতে উল্লেখ করা নিরাপদ শহর হল পবিত্র মক্কা; যা শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মস্থান ও নবুয়ত প্ৰাপ্তিস্থান। [বাদাইউত তাফসীর, ইবন কাসীর]

৪. অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে(১),

(১) তীন ও যায়তুন বা এগুলো উৎপন্ন হওয়ার এলাকা- অর্থাৎ সিরিয়া ও ফিলিস্তান; তূর পর্বত এবং নিরাপদ শহর তথা মক্কার কসম এ কথাটির উপরই করা হয়েছে। বল হয়েছে, মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করা হয়েছে। একথার মানে হচ্ছে এই যে, তাকে এমন উন্নত পৰ্যায়ের দৈহিক সৌষ্ঠব দান করা হয়েছে যা অন্য কোন প্ৰাণীকে দেয়া হয়নি। আয়াতে বর্ণিত تَقْوِيم এর অর্থ কোন কিছুর অবয়ব ও ভিত্তিকে যেরূপ করা উচিৎ, সে-রকমভাবে পরিপূর্ণ আকারে গঠন করা। তা দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ্ তা'আলা মানুষকে দৈহিক অবয়ব এবং আকার-আকৃতি ও আচার-ব্যবহার ও মানুষ্যত্বের মাধ্যমে অন্যান্য সব প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতম করেছেন। [বাদা’ই’উত তাফসীর, আদওয়াউল বায়ান] আকার আকৃতির বাইরেও আল্লাহ তা'আলা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, স্রষ্টা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন। [ফাতহুল কাদীর]

৫. তারপর আমরা তাকে হীনতাগ্রস্তাদের হীনতমে পরিণত করি—(১)

(১) মুফাস্‌সিরগণ সাধারণত এর দু'টি অর্থ বর্ণনা করেছেন। এক, আমি তাকে যৌবনের পর বার্ধক্যের এমন এক অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি যেখানে সে কিছু চিন্তা করার, বুঝার ও কাজ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে; ছোট শিশুর মত হয়ে যায়। দুই. আয়াতের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি তাকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন পর্যায়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার পর যখন মানুষ নিজের দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলোকে দুস্কৃতির পথে ব্যবহার করে তখন আল্লাহ তাকে এর উপযুক্ত প্রতিদান হিসেবে জাহান্নামকে তার আবাসস্থল বানিয়ে দেন। [কুরতুবী]

৬. কিন্তু তাদেরকে নয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে; এদের জন্য তো আছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।(১)

(১) এ আয়াতে মুমিন সৎকর্মশীলগণ এর ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব মুফাসসির “আসফালা সাফেলীন” এর অর্থ করেছেন, বার্ধক্যের এমন একটি অবস্থা যখন মানুষ নিজের চেতনা ও স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, তারা এই আয়াতের অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, বয়সের এই পর্যায়েও তারা ঐ ধরনের সৎকাজগুলো করেনি বলে তাদের ভালো প্রতিদান দেবার ক্ষেত্রে কোন হেরফের হবে না, কমতি হবে না। বাৰ্ধক্যজনিত বেকারত্ব ও কর্মহ্রাস পাওয়া সত্বেও তাদের আমলানামায় সেসব কর্ম লিখিত হয়, যা তারা শক্তিমান অবস্থায় করত। [তাবারী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোন মুসলিম অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা মুসাফির হলে আল্লাহ তা'আলা আমল লেখক ফেরেশতাগণকে আদেশ দেন, সুস্থ অবস্থায় সে যেসব সৎকর্ম করত, সেগুলো তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করতে থাক।” [বুখারী: ২৯৯৬, মুসনাদে আহমাদ: ২/১৯৪, ৩/২৫৮]

পক্ষান্তরে যেসব মুফাস্‌সির “ফিরিয়ে দেবার” অর্থ ‘জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে নিক্ষেপ করা’ করেছেন তাদের মতে, মহান আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করে তাকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে দুনিয়ায় খেল-তামাশায় মত্ত হয়ে যায়। এই অকৃতজ্ঞতার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে জাহান্নামের হীনতম ও নিম্নতম পর্যয়ে পৌছে দেয়া হবে। কিন্তু যারা মুমিন ও সৎকর্মী, তাদেরকে নিকৃষ্টতম পর্যায়ে পৌছানো হবে না; বরং তারা জান্নাতে এমন পুরস্কার পাবে যার ধারাবাহিকতা কোনদিন শেষ হবে না, যে পুরষ্কারের কোন কমতি হবে না। [বাদা'ই'উত তাফসীর, সা’দী]

৭. কাজেই (হে মানুষ!) এরপর কিসে তোমাকে কৰ্মফল দিন সম্পর্কে অবিশ্বাসী করে?(১)

(১) এতে কেয়ামতে অবিশ্বাসীদেরকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, আল্লাহর কুদরাতের উপরোক্ত দৃশ্য ও পরিবর্তন দেখার পরও তোমাদের জন্যে আখেরাত ও কেয়ামতকে মিথ্যা মনে করার কি অবকাশ থাকতে পারে? তোমাদেরকে আল্লাহ তা'আলা সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তিনি ইচ্ছা করলে হীনতম ও নিম্নতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন, তারপরও কেন তোমরা তা অস্বীকার করবে? এর আরেকটি অনুবাদ এও হতে পারে, এসব প্রমাণের পর (হে রাসূল) শাস্তি ও পুরষ্কারের ব্যাপারে কে আপনাকে মিথ্যা বলতে পারে? [কুরতুবী] এই কথাটিকেই কুরআনের অন্যান্য স্থানে এভাবে বলা হয়েছে, “আমি কি অনুগতদেরকে অপরাধীদের মতো করে দেবো? তোমাদের কি হয়ে গেছে? তোমরা কেমন ফয়সালা করছো? [সূরা আল-কলম: ৩৫–৩৬] আরো এসেছে, “দুষ্কৃতকারীরা কি একথা মনে করেছে, আমি তাদেরকে এমন লোকদের মতো করে দেবো যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে? উভয়ের জীবন ও মৃত্যু এক রকম হবে? খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত যা এরা করছে। [সূরা আল-জাসিয়াহ: ২১]

৮. আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক নন?(১)

(১) আল্লাহ তা'আলা কি সব বিচারকের মহাবিচারক নন? তিনি কি সকল শাসকবর্গের মধ্যে সর্বোত্তম শাসক নন? এই ন্যায় বিচারের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রত্যেক অপরাধীকে তার শাস্তি ও প্রত্যেক সৎকর্মীকে তার উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করা। বিচারকদের শ্রেষ্ঠবিচারক আল্লাহ্ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উপনীত করেছেন পরিপূর্ণ ন্যায় ও প্রজ্ঞার সাথে; তবুও কি তিনি মানুষের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিদানও দেবেন না? [বাদাইউত তাফসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া


*******************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url