শবে কদরের তালাশ || শবে কদর কবে ||

শবে কদর কবে


আজকে আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে শবে কদর কবে অর্থাৎ লাইলাতুল কদর কত তারিখে। রমজান মাস এলে মুসলিমগণ শবে কদরের ফজিলত লাভের আশায় এই বরকতময় রাত্রি তালাশ করে থাকেন। তাই শবে কদরের রাতটি কবে এবং কিভাবে বুঝবো যে আজ শবে কদর, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

শবে কদর কোন রাত্রি

রমযান মাসের শেষ দশকের যে কোন একটি রাত্রি শবে কদরের রাত্রি।
একদা মহানবী (সা:) শবে কদরের অন্বেষণে রমজানের প্রথম দশকে ইতেকাফ করলেন। অতঃপর মাঝের দশকে ইতিকাফ করে ২০শের ফজরে বললেন, আমাকে শবে কদর দেখানাে হয়েছে; কিন্তু পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে; অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত্রে তা অনুসন্ধান কর; আর আমি দেখেছি যে, আমি পানি ও কাদাতে সিজদা করছি।
বুখারী ২০১৬ মুসলিম ১১৬৭ 

অতঃপর ২১শের রাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল। অতএব সে বছরে ঐ ২১শের রাতেই শবে কদর হয়েছিল।

পূর্বোক্ত হাদীসের ইঙ্গিত অনুসারে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ এই ৫ রাত হল শবে কদর হওয়ার অধিক আশাব্যঞ্জক রাত। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, বিজোড় রাত্রি ছাড়া জোড় রাত্রে শবে কদর হবে না; বরং শবে কদর জোড়-বিজোড় যে কোন রাত্রিতেই হতে পারে। তবে বিজোড় রাতে শবে কদর সংঘটিত হওয়াটাই অধিক সম্ভাবনাময় ও আশাব্যঞ্জক। যারা প্রকৃতই শবে কদর পেতে চান তাদেরকে রমজানের প্রতি রাতেই শবে কদর তালাশ করা উত্তম। 

শেষ দশকের মধ্যে শেষ সাত রাত্রিগুলো অধিক আশাব্যঞ্জক।
মহানবী সঃ বলেন, আমি দেখছি যে, তােমাদের সবারই স্বপ্ন শেষ সাত রাতের ব্যাপারে একমত হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি শবে কদর অনুসন্ধান করতে চায়, সে যেন শেষ সাত রাতগুলোতে করে। 
বুখারী ২০১৫, মুসলিম ১১৬৫


অবশ্য এর অর্থ যদি ‘কেবল ঐ বছরের রমজানের শেষ সাত রাতের কোন এক রাতে শবে কদর হবে এবং আগামী প্রত্যেক রমজানে হবে না এমনটা হয় তাহলে। কারণ, এরূপ অর্থ হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করা যায় না। তাছাড়া যেহেতু মহানবী (সা:) তার শেষ জীবন অবধি রমজানের শেষ দশকের পুরােটাই ইতিকাফ করে গেছেন এবং এক বছর শবে কদর ২১শের রাত্রিতেও হয়েছে – যেমন এ কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ দশকের বিজোড় রাত্রি গুলোর মধ্যে ২৭শের রাত্রি শবে কদরের জন্য অধিক সম্ভাবনা। কেননা, উবাই বিন কা’ব রাঃ ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলেই কসম খেয়ে বলতেন, শবে কদর রাত্রি হল ২৭শের রাত্রি; ঐ রাত্রিতে কিয়াম করতে আল্লাহর রাসুল (সা:) আমাদেরকে আদেশ করেছেন। 
মুসলিম ৭৬২

মুআবিয়া রাঃ মহানবী (সা:) এর নিকট থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘২৭শের রাত্রি হল শবে কদরের রাত্রি।
সহীহ আদাবুল মুফরাদ ১২৩৬

কিন্তু ঐ রাতে হওয়াই জরুরী নয়। কারণ, এ ছাড়া অন্যান্য হাদীস রয়েছে, যার দ্বারা বুঝা যায় যে, শবে কদর অন্য তারিখের রাতেও হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, শবে কদরের রাত প্রত্যেক বছরের জন্য একটি মাত্রই রাত নয়। বরং তা বিভিন্ন রাত্রে সংঘটিত হতে পারে। সুতরাং কোন বছরে ২৯শে, কোন বছরে ২৫শে, আবার কোন বছরে ২৪শের রাতেও শবেকদর হতে পারে। আর এই অর্থে শবে কদর প্রসঙ্গে বর্ণিত সমস্ত হাদীসের মাঝে পরস্পর-বিরােধিতা দূর হয়ে যাবে।

শবে কদর একটি নির্দিষ্ট রাত না হয়ে এক এক বছরে শেষ দশকের এক এক রাতে হওয়ার পশ্চাতে হিকমত এই যে, যাতে অলস বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের মর্যাদা ও ফজিলতের উপর নির্ভর করে অন্যান্য রাতে ইবাদত ত্যাগ না করে বসে। পক্ষান্তরে অনির্দিষ্ট হলে এবং প্রত্যেক রাতের মধ্যে যে কোন একটি রাতের শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বান্দা শেষ দশকের পুরােটাই কিয়াম ও ইবাদত করতে আগ্রহী হবে। আর এতে রয়েছে তারই লাভ। 

ঠিক হুবহু একই যুক্তি হল মহানবী সঃ এর হৃদয় থেকে শবে কদর (তারিখ) ভুলিয়ে দেওয়ার পিছনে। আর এতে রয়েছে সেই মঙ্গল; যার প্রতি ইঙ্গিত করে মহানবী সঃ বলেছেন, আমি শবে কদর সম্বন্ধে তােমাদেরকে খবর দেওয়ার জন্য বের হয়ে এলাম। কিন্তু অমুক ও অমুকের কলহ করার ফলে শবে কদরের সে খবর তুলে নেওয়া হল। এতে সম্ভবতঃ তোমাদের জন্য মঙ্গল আছে। সুতরাং তোমরা নবম, সপ্তম এবং পঞ্চম রাত্রে তা অনুসন্ধান কর।
বুখারী ২০২৩

শবে কদরের সওয়াব অর্জনের জন্য শবে কদর কোন রাতে হচ্ছে তা জানা বা দেখা শর্ত নয়।
তবে ইবাদতের রাতে শবে কদর সংঘটিত হওয়া এবং তার অনুসন্ধানে সওয়াবের আশা রাখা শর্ত। শবে কদর কোন রাতে ঘটছে তা জানা যেতে পারে। আল্লাহ যাকে তাওফিক দেন, সে বিভিন্ন লক্ষণ দেখে শবে কদর বুঝতে পারে; সাহাবাগণ ও একাধিক নিদর্শন দেখে জানতে পারতেন শবে কদর ঘটার কথা; তবে তা জানা বা দেখা না গেলে যে তার সওয়াব পাওয়া যাবে না তা নয়। বরং যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশা রেখে সে রাত্রিতে ইবাদত করবে সেই তার সওয়াবের অধিকারী হবে। চাহে সে শবে কদর দেখতে পাক বা না-ই পাক।


বলা বাহুল্য, মুসলিমের উচিত, সওয়াব ও নেকী অর্জনের উদ্দেশ্যে মহানবী (সা:) এর আদেশ ও নির্দেশ মত রমযানের শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ করতে যত্নবান ও আগ্রহী হওয়া। অতঃপর দশটি রাতে ঈমান ও নেকীর আশা রেখে ইবাদত করতে করতে যে কোন রাতে যখন শবেকদর লাভ করবে, তখন সে সেই রাতের অগাধ সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে, যদিও সে বুঝতে না পারে যে, ঐ দশ রাতের মধ্যে কোন রাতটি শবে কদর রূপে অতিবাহিত হয়ে গেল। 

মহানবী সঃ বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান রেখে ও নেকী লাভের আশা করে শবে কদরের রাত্রি কিয়াম করে (নামায পড়ে), সে ব্যক্তির পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ হয়ে যায়।
বুখারী ৩৫, মুসলিম ৭৬০

অন্য এক বর্ণনায় আছে, যে তার খোঁজে কিয়াম করল এবং সে তা পেতে তাওফিক লাভ করল তার পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ হয়ে গেল।
আঃ ৫/৩ ১৮, ২২৬১২

আর একটি বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি শবে কদরে কিয়াম করবে এবং সে তা ঈমান ও নেকীর আশা রাখার সাথে পেয়ে যাবে, তার গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যাবে।
মুসলিম ৭৬০

আর এ সব সেই ব্যক্তির ধারণা কে খন্ডন করে, যে মনে করে যে, যে ব্যক্তি শবে কদর মনে করে কোন রাতে কিয়াম করবে, তার শবে কদরের সওয়াব লাভ হবে; যদিও সে রাতে শবে কদর না হয়। 

শবে কদরের আলামত

শবে কদরের কিছু লক্ষণ আছে যা রাত মধ্যেই দেখা যায় এবং আর কিছু লক্ষণ আছে যা রাতের পরে সকালে দেখা যায়। যে সব লক্ষণ রাতে পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপঃ

১। শবে কদরের রাতের আকাশ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল থাকে
অবশ্য এ লক্ষণ শহর বা গ্রামের ভিতর বিদ্যুতের আলোর মাঝে থেকে লক্ষ্য করা সম্ভব নয়; কিন্তু যারা আলো থেকে দুরে মাঠে-ময়দানে থাকে, তারা সে ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করতে পারে। 

২। অন্যান্য রাতের তুলনায় শবে কদরের রাতে মুমিন তার হৃদয়ে এক ধরনের প্রশস্ততা, স্বস্তি ও শান্তি বোধ করে। 
৩। অন্যান্য রাতের তুলনায় মুমিন শবে কদরের রাতে কিয়াম বা নামাযে অধিক মিষ্টতা অনুভব করে। 
৪ এই রাতের বাতাস নিস্তব্ধ থাকে। অর্থাৎ, সে রাতে ঝােড়াে বা জোরে হাওয়া চলে না। আবহাওয়া অনুকূল থাকে। 
মহানবী সঃ বলেন, শবে কদরের রাত উজ্জ্বল। অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, নাতিশীতোষ্ণ; না ঠান্ডা, না গরম।
আঃ, ত্বাবঃ, ইখুঃ ২১৯২, প্রমুখ, সজাঃ ৫৪৭২, ৫৪৭৫
৫। শবে কদরের রাতে উল্কা ছুটে না।
৬। এ রাতে বৃষ্টি হতে পারে। 

মহানবী  (সা:) বলেন, আমাকে শবে কদর দেখানাে হয়েছিল; কিন্তু পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত্রে তা অনুসন্ধান কর। আর আমি দেখেছি যে, আমি পানি ও কাদাতে সিজদা করছি।  বুখারী ২০ ১৬, মুসলিম ১১৬৭
অতঃপর ২১শের রাত্রিতে সত্যই বৃষ্টি হয়েছিল। 

৭। শবে কদর কোন নেক বান্দা স্বপ্নের মাধ্যমেও দেখতে পারেন
যেমন কিছু সাহাবা রাঃ তা দেখেছিলেন; পক্ষান্তরে যে সব লক্ষণ রাতের পরে সকালে দেখা যায় তা হল এই যে, সে রাতের সকালে উদয় কালে সূর্য হবে সাদা; তার কোন কিরণ থাকবে না। (মুসলিম ৭৬২) অথবা ক্ষীণ রক্তিম অবস্থায় উদিত হবে; (সজাঃ ৫৪৭৫ নং) ঠিক পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মতো। অর্থাৎ, তার রশ্মি চারিদিকে বিকীর্ণ হবে না।


আর লােক মুখে যে সব লক্ষণের কথা প্রচলিত; যেমন সে রাতে কুকুর ভেকায় না বা কম ভেকায়; গাছ-পালা মাটিতে নুয়ে পড়ে আল্লাহকে সিজদা করে; সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মিঠা হয়ে যায়; নুরের ঝলকে অন্ধকার জায়গা আলোকিত হয়ে যায়; নেক লোকেরা ফেরেশতাদের সালাম শুনতে পান ইত্যাদি লক্ষণ সমূহ কাল্পনিক। এগুলো শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়; তাছাড়া এসব কথা নিশ্চিতরূপে অভিজ্ঞতা ও বাস্তববিরােধী। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও শবে কদরের ফজিলত লাভ করার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url