প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-২৮]





পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

বদর যুদ্ধ শুরু আরবে নতুন যুগের সূচনা

২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয় (ইবনু হিশাম ১/৬২৬)। ইতিমধ্যে কুরায়েশ পক্ষের জনৈক হঠকারী আসওয়াদ বিন আব্দুল আসাদ আল-মাখযূমী দৌড়ে এসে বলল, আমি এই হাউয থেকে পানি পান করব অথবা একে ভেঙ্গে ফেলব অথবা এখানেই মরব’। তখন হামযা (রাঃ) এসে তার পায়ে আঘাত করলেন। এমতাবস্থায় সে পা ঘেঁষতে ঘেঁষতে হাউযের দিকে এগোতে লাগল। হামযা তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করলে সে হাউযেই মরে পড়ল ও তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হ’ল। এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীর যোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হ’তে মু‘আয ও মু‘আবিবয বিন ‘আফরা কিশোর দুই ভাই এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাসহ তিনজন আনছার তরুণ বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরায়েশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তোমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উৎবাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী‘আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী‘আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হ’লেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাহকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন।[1]

প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীর যোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরায়েশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় রাসূল (ছাঃ) শত্রুদের যথাসম্ভব দূরে রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন, إِذَا أَكْثَبُوكُمْ فَارْمُوهُمْ وَاسْتَبْقُوا نَبْلَكُمْ ‘যখন তারা তোমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন তোমরা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ কর এবং এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা কর’ (বুখারী হা/৩৯৮৪)। অতঃপর তিনি এক মুষ্টি বালু হাতে নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, شَاهَتْ الْوُجُوهُ ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌক’। ফলে শত্রুবাহিনীর মুশরিকদের এমন কেউ থাকলো না, যার চোখে ঐ বালু প্রবেশ করেনি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য। তাই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللهَ رَمَى ‘তুমি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলে, প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন’।[2]

নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর একটি মু‘জেযা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা তিনি হোনায়েন যুদ্ধেও করেছিলেন।[3] ফারসী কবি বলেন,

محمد عربى كابروئے ہر دو سراست
كسے كہ خاك درش نيست خاك برسرأو

‘মুহাম্মাদ আরাবী হ’লেন দুনিয়া ও আখেরাতের মর্যাদার উৎস। কেউ যদি তার পায়ের ধূলা হ’তে না পারে, তার মাথা ধূলি ধূসরিত হৌক!’

মুসলিম নামধারী একদল মুশরিক মা‘রেফতী পীর-ফকীর এই ঘটনা দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ বানিয়ে ফেলেছে এবং তারা নিজেদেরকে ‘আল্লাহর অংশ’ বলে থাকে। তাদের দাবী, ‘যত কল্লা তত আল্লা’। তারা সূতায় অথবা পাতায় ফুঁক দিলে এবং তা দেহে বাঁধলে বা পকেটে রাখলে শত্রু তাকে দেখতে পাবে না বলে মিথ্যা ধারণা প্রচার করে। এভাবে তারা সরলমনা ও ভক্ত জনগণের ঈমান নষ্ট করে ও সেই সাথে ভক্তির চোরাগলি দিয়ে ভক্তের পকেট ছাফ করে।

বালু নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বাহিনীকে নির্দেশ দেন, قُوْمُوا إلَى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ ‘তোমরা এগিয়ে চলো জান্নাতের পানে, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত’ (মুসলিম হা/১৯০১)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই আহবান মুসলমানদের দেহমনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল। অতঃপর তিনি বললেন, وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يُقَاتِلُهُمُ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيُقْتَلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلاً غَيْرَ مُدْبِرٍ إلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি আজকে দৃঢ়পদে নেকীর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে, পিছপা হবে না, সর্বদা সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর যদি সে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।[4]

[1]. আবুদাঊদ হা/২৬৬৫; আহমাদ হা/৯৪৮; মিশকাত হা/৩৯৫৭ সনদ ছহীহ; আল-বিদায়াহ ৩/২৭২।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; আনফাল ৮/১৭; হাদীছটির সনদ ‘মুরসাল’। কিন্তু ইবনু কাছীর বলেন, আয়াতটি যে বদর যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্বানগণের নিকট যা মোটেই গোপন নয়। ঐ, তাফসীর সূরা আনফাল ১৭ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৩।
[3]. মুসলিম হা/১৭৭৭; মিশকাত হা/৫৮৯১; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৮২৩, সনদ ‘মুরসাল’; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৭ আয়াত।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২৭; হাদীছ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৪৯); আহমাদ হা/৮০৬১।

যুদ্ধের প্রতীক চিহ্ন

বিভিন্ন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতেন। যেমন (১) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রতীক চিহ্ন ছিল,أَحَدٌ أَحَدٌ (আহাদ, আহাদ)।[1] (২) ওহোদ যুদ্ধে ও সারিইয়া গালিব বিন লায়ছীর প্রতীক চিহ্ন ছিল, أَمِتْ، أَمِتْ (মেরে ফেল, মেরে ফেল)।[2] (৩) খন্দক ও বনু কুরায়যা যুদ্ধে ছিল,حم، لاَ يُنْصَرُونَ (হা-মীম। তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’)।[3] (৪) বনু মুছত্বালিক্ব যুদ্ধে প্রতীক চিহ্ন ছিল,يَا مَنْصُورُ، أَمِتْ أَمِتْ (হে বিজয়ী! মেরে ফেল, মেরে ফেল’)।[4] (৫) মক্কা বিজয়, হোনায়েন এবং ত্বায়েফ যুদ্ধে মুহাজিরদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ ‘হে বনু আব্দুর রহমান’! খাযরাজদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عَبْدِ اللهِ ‘হে বনু আব্দুল্লাহ’! এবং আউসদের প্রতীক ছিলيَا بَنِي عُبَيْدِ اللهِ ‘হে বনু ওবায়দুল্লাহ’![5]

এতে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছাড়াও অন্যান্য দলের বিশেষ পতাকা ছিল। এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বিশেষ প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা যায়। যাকে ‘ব্যাজ’ (Badge) কিংবা মনোগ্রাম (Monogram) ইত্যাদি বলা হয়।

জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হ’ল ও তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক আনছার ছাহাবী উমায়ের বিন হোমাম(عُمَيْرُ بْنُ حُمَامٍ) ‘বাখ বাখ’(بَخْ بَخْ) বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হ’তে চাই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন,فَإِنَّكَ مِنْ أَهْلِهَا ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে ছাহাবী থলি হ’তে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু দ্রুত তিনি বলে উঠলেন, لَئِنْ أَنَا حَيِّيْتُ حَتَّى آكُلَ تَمَرَاتِيْ هَذِهِ إِنَّهَا لَحَيَاةٌ طَوِيْلَةٌ ‘যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন’।[6]

এ সময় রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন,

اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِىْ مَا وَعَدْتَنِىْ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ ... اللَّهُمَّ إِنْ تَهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ بَعْدَ الْيَوْمِ أبَدًا-

‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা করেছ তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা জানাচ্ছি। ... হে আল্লাহ! যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহ’লে আজকের দিনের পর তোমার ইবাদত করার মত কেউ যমীনে আর থাকবে না’। তিনি প্রার্থনায় এমন আত্মভোলা ও বিনয়ী হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন যে, তার স্কন্ধ হ’তে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর ছুটে এসে চাদর উঠিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন,حَسْبُكَ يَا رَسُولَ اللهِ فَقَدْ أَلْحَحْتَ عَلَى رَبِّكَ ‘যথেষ্ট হয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন’।[7]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৪। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৬৪)।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৬৮, ৬১১; খবর ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৭); আবুবকর (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধেও একই প্রতীক চিহ্ন ছিল (হাকেম হা/২৫১৬, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/৩৯৫০)। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধেও বিশেষ প্রতীক চিহ্নসমূহ ছিল।
[3]. ইবনু হিশাম ২/২২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩০৮; মিশকাত হা/৩৯৪৮।
[4]. ইবনু হিশাম ২/২৯৪; সনদ হাসান (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৭৯)।
[5]. ইবনু হিশাম ২/৪০৯ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৬৭৫)।
[6]. মুসলিম হা/১৯০১; মিশকাত হা/৩৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[7]. বুখারী হা/৪৮৭৫, মিশকাত হা/৫৮৭২।

ফেরেশতাগণের অবতরণ

এ সময় আয়াত নাযিল হ’ল -إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ ‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাযার ফেরেশতা দিয়ে, যারা ধারাবাহিকভাবে অবতরণ করবে’ (আনফাল ৮/৯)।[1] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, বদরের যুদ্ধে ব্যতীত অন্য কোন যুদ্ধে ফেরেশতারা যোগদান করেননি (ইবনু কাছীর)। উল্লেখ্য যে, সূরা আনফাল ৯ আয়াতে ‘এক হাযার’, আলে ইমরান ১২৪ ও ১২৫ আয়াতে যথাক্রমে ‘তিন হাযার’ ও ‘পাঁচ হাযার’ ফেরেশতা অবতরণের কথা বলা হয়েছে’। এর ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এক হাযার’ সংখ্যাটি তিন হাযার বা তার অধিক সংখ্যাকে নিষেধ করে না। কেননা উক্ত আয়াতের শেষে مُرْدِفِيْنَ শব্দ এসেছে। যার অর্থ ‘ধারাবাহিকভাবে আগত’। অতএব আল্লাহর হুকুমে যত হাযার প্রয়োজন, তত হাযার ফেরেশতা নাযিল হবে’।[2] বস্ত্ততঃ সংখ্যায় বেশী বলার উদ্দেশ্য মুসলিম বাহিনীকে অধিক উৎসাহিত করা এবং বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি জেগে উঠে বললেন, أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ أَتَاكَ نَصْرُ اللهِ، هَذَا جِبْرِيلُ آخِذٌ بِعِنَانِ فَرَسِهِ يَقُودُهُ عَلَى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর হে আবুবকর! তোমার কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। এই যে জিব্রীল, তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে আসছেন’।[3]

ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,هَذَا جِبْرِيلُ آخِذٌ بِرَأْسِ فَرَسِهِ عَلَيْهِ أَدَاةُ الْحَرْبِ ‘ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছেন’। অতঃপর তিনি তাঁবুর বাইরে এসে বললেন,سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাবে’-ক্বামার ৫৪/৪৫)।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বাইরে এসে আঙ্গুলের ইশারা করে করে বলেন, هَذَا مَصْرَعُ فُلاَنٍ ‘এটি অমুকের বধ্যভূমি’। এটি অমুকের, ওটি অমুকের’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের কেউ ঐ স্থান অতিক্রম করতে পারেনি, যেখানে যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারা করেছিলেন।[5]

[1]. তাফসীর সূরা আনফাল ৯ আয়াত; বুখারী হা/৪৮৭৫; তিরমিযী হা/৩০৮১, সনদ হাসান।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ১২৫ আয়াত।
[3]. আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২৫ পৃঃ, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ১/৬২৬-২৭, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৪৭)।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২৭; বুখারী হা/৩৯৫৩, ৩৯৯৫; মিশকাত হা/৫৮৭২-৭৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, মু‘জেযা অনুচ্ছেদ-৭ ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৫ পৃঃ।
[5]. মুসলিম হা/১৭৭৯ (৮৩); মিশকাত হা/৫৮৭১।

ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যোগদান

মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের আগমন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلاَئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ- ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللهَ وَرَسُولَهُ وَمَنْ يُشَاقِقِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন যে, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। অতএব তোমরা ঈমানদারগণের চিত্তকে দৃঢ় রাখো। আমি সত্বর অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে দেব। কাজেই তোমরা গর্দানের উপর আঘাত হানো এবং তাদের প্রত্যেক জোড়ায় জোড়ায় মারো’। ‘এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ (তার জন্য) কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/১২-১৩)। ইকরিমা বিন আবু জাহল (যিনি ঐ যুদ্ধে পিতার সাথে শরীক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হন) বলেন, ঐদিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেত, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো (তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ)। আবুদাঊদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’। রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথাওয়ালা ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘোড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন। আনছার যোদ্ধা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিই এনাকে বন্দী করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত আনছারকে বললেন, اسْكُتْ فَقَدْ أَيَّدَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيمٍ ‘চুপ কর। আল্লাহ এক সম্মানিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন’ (আহমাদ হা/৯৪৮)। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, ফেরেশতারা কোন মুশরিকের উপরে আক্রমণ করার ইচ্ছা করতেই আপনা-আপনি তার মস্তক দেহ হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।[1] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ দিন একজন মুসলিম সেনা তার সম্মুখের মুশরিককে মারতে গেলে শাণিত তরবারির ও ঘোড়ার আওয়ায শোনেন। তিনি ফেরেশতার আওয়ায শুনেছেন যে, তিনি বলছেনأَقْدِمْ حَيْزُوْمُ ‘হায়যূম আগে বাড়ো’ (‘হায়যূম’ হ’ল ফেরেশতার ঘোড়ার নাম)। অতঃপর ঐ মুশরিক সেনাকে তিনি সামনে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে দেখেন। তিনি দেখলেন যে, তরবারির আঘাতের ন্যায় তার নাক ও মুখমন্ডল বিভক্ত হয়ে গেছে। উক্ত আনছার ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বলেন, صَدَقْتَ، ذَلِكَ مِنْ مَدَدِ السَّمَاءِ الثَّالِثَةِ ‘তুমি সত্য বলেছ। ওটি তৃতীয় আসমান থেকে সরাসরি সাহায্যের অংশ’।[2] কেউ কতক ফেরেশতাকে সরাসরি দেখেছেন। ঐদিন ফেরেশতাদের মাথার পাগড়ী ছিল সাদা। যা তাদের পিঠ পর্যন্ত ঝুলে ছিল। তবে জিব্রীলের মাথার পাগড়ী ছিল হলুদ বর্ণের।[3]

উপরোক্ত ঘটনাবলী এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তারাও যেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন।

[1]. আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ ছহীহ; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৬৬৭৯।
[2]. মুসলিম হা/১৭৬৩ (৫৮); মিশকাত হা/৫৮৭৪।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৩।

প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস স্বয়ং বনু কিনানাহর নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজীর রূপ ধারণ করে যুদ্ধে উপস্থিত থেকে আবু জাহলকে সর্বদা উৎসাহিত করেছে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সর্বদা প্ররোচিত করেছে। কিন্তু এখন যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাদের দেখতে পেয়ে সে ভয়ে পালাতে থাকে। হারেছ বিন হেশাম তাকে সুরাক্বা ভেবে আটকাতে চাইলে সে তার বুকে জোরে এক ঘুষি মেরে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২১৯ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৯ পৃঃ)। মূলতঃ শয়তান কারু রূপ ধরে নয়, বরং অন্তরে খটকা সৃষ্টির মাধ্যমে আবু জাহল ও তার সাথীদের প্ররোচিত করেছিল। যা সূরা আনফাল ৪৮-৪৯ এবং সূরা হাশর ১৬-১৭ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

ফেরেশতা নাযিলের উদ্দেশ্য

এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلَهُ اللهُ إِلاَّ بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ ‘(তোমাদের নিকটে ফেরেশতা প্রেরণের বিষয়টি ছিল) কেবল তোমাদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে এবং যাতে তোমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। বস্ত্ততঃ সাহায্য কেবলমাত্র মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ হ’তেই এসে থাকে’ (আলে ইমরান ৩/১২৬)।

এর দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, মুসলিম বাহিনী যেন এ বিশ্বাস দৃঢ় রাখে যে, ফেরেশতারা তাদের সাহায্যার্থে প্রস্ত্তত হয়ে পাশেই আছে। সেজন্য আল্লাহর হুকুমে তারা যৎসামান্য সাহায্য করছে। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবলকে বর্ধিত করা, ফেরেশতাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো নয়। কেননা তারা সরাসরি জিহাদ করলে মুমিনদের কোন ছওয়াব থাকে না। তাছাড়া সেটা হ’লে তো এক হাযার (আনফাল ৮/৯), তিন হাযার বা পাঁচ হাযার (আলে ইমরান ৩/১২৪-২৫) কেন, একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল কুরায়েশ বাহিনীকে খতম করার জন্য। যেভাবে জিব্রীল (আঃ) একাই লূতের কওমকে তাদের নগরীসহ শূন্যে তুলে উপুড় করে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন আল্লাহর হুকুমে (হূদ ১১/৮২; হিজর ১৫/৭৩-৭৪)।

এ জগতে যুদ্ধ ও জিহাদের দায়িত্ব মানুষকে অর্পণ করা হয়েছে। যাতে তারা তার ছওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হয়। ফেরেশতা বাহিনী দ্বারা যদি দেশ জয় করা বা ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠা করা আল্লাহর ইচ্ছা হ’ত, তাহ’লে পৃথিবীতে কাফেরদের রাষ্ট্র দূরে থাক, তাদের অস্তিত্বই থাকতো না। বরং আল্লাহর বিধান এই যে, দুনিয়াতে কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষ চলতেই থাকবে। ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর সাহায্য পাবেন। তারা ইহকালে ও পরকালে মর্যাদামন্ডিত হবেন। কিন্তু কাফেররা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে এবং ইহকালে ও পরকালে তারা ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হবে। নমরূদ ও ইবরাহীম, ফেরাঊন ও মূসা কি এর বাস্তব উদাহরণ নয়? আজও ফেরাঊন ও মূসার দ্বন্দ্ব চলছে এবং ক্বিয়ামত অবধি তা চলবে।

মাক্কী বাহিনীর পলায়ন

মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলেন, সোরাক্বার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা ও অলীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও ‘উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।

কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল। বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছারদের বনু সালামাহ গোত্রের কিশোর দু’ভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল يَا عَمِّ أَرِنِى أَبَا جَهْلٍ! أُخْبِرْتُ أَنَّهُ يَسُبُّ رَسُوْلَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘চাচাজী! আবু জাহল-কে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়’? তারা প্রত্যেকে পৃথকভাবে গোপনে এসে চাচাজীর কানে কানে একই কথা বলল। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দু’জন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে হেঁচকা টানে সেটাকে নিজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হ’লে তারা উভয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে গর্বভরে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, كِلاَكُمَا قَتَلَهُ ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’।[1] অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন ‘আফরা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকাল (২৩-৩৫ হি.) পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।[2]

পরে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ গিয়ে দেখেন যে, আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে,وَهَلْ فَوْقَ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘তোমরা কি এই ব্যক্তির চাইতে বড় কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে পেরেছ?’فَلَوْ غَيْرَ أَكَّارٍ قَتَلَنِيْ ‘ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষাদের বদলে অন্য কেউ হত্যা করতো’![3] উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইবনু মাসঊদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,أَخْزَاكَ اللهُ يَا عَدُوَّ الله ‘আল্লাহ তোকে লাঞ্ছিত করুন রে আল্লাহর দুশমন!’ জবাবে আবু জাহল বলে ওঠে,وَبِمَاذَا أَخْزَانِي؟ هَلْ أَعْمَدُ مِنْ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘কেন তিনি আমাকে লাঞ্ছিত করবেন? আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করেছ কি?’[4] এখন বল, لِمَنِ الدّائِرَةُ الْيَوْمَ ‘আজ কারা জিতলো’। ইবনু মাসঊদ বললেন, للَّه وَلِرَسُولِهِ ‘আজকের জয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য’। বলেই তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাযির হ’লেন এবং বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، هَذَا رَأْسُ عَدُوِّ اللهِ أَبِي جَهْلٍ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা হ’ল আল্লাহর দুশমন আবু জাহলের মাথা। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, آلله الَّذِي لاَ إلَهَ غَيْرُهُ ‘আল্লাহর কসম? যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আমি বললাম, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। অতঃপর আমি তাঁর সামনে মাথাটি রেখে দিলাম তখন তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন।[5] এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়।

[1]. বুখারী হা/৩১৪১; মুসলিম হা/১৭৫২; মিশকাত হা/৪০২৮।
[2]. উল্লেখ্য যে, মু‘আয ও মু‘আউভিয উভয়ে তাদের বীরমাতা বনু নাজ্জারের ‘আফরা’ বিনতে ওবায়েদ বিন ছা‘লাবাহ-র দিকে সম্বন্ধিত হয়ে ইবনু ‘আফরা (ابْنَا عَفْرَاء) নামে পরিচিত ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)। পিতা ছিলেন বনু নাজ্জার-এর হারেছ বিন রিফা‘আহ বিন সাওয়াদ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৮১৬৮)। ‘আফরা-র মোট ৭ ছেলের প্রত্যেকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সবাই তাদের মায়ের নামে ইবনু ‘আফরা (ابن عفراء) নামে পরিচিত ছিলেন। ‘আফরার প্রথম স্বামী হারেছ-এর ঔরসে মু‘আয ও মু‘আউভিয জন্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর তালাকপ্রাপ্তা হয়ে তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি বুকায়ের বিন ‘আব্দে ইয়ালীল লায়ছী-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ৪ পুত্র খালেদ, ইয়াস, ‘আক্বেল ও ‘আমের জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তালাকপ্রাপ্তা হ’লে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পুনরায় পূর্ব স্বামী হারেছ-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ‘আওফ জন্মগ্রহণ করেন। এইভাবে তিনি মোট ৭টি পুত্র সন্তানের মা হন। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত বীর ও বদরী ছাহাবী (ইবনু সা‘দ, আল-ইছাবাহ, উসদুল গাবাহ)। মু‘আয বিন ‘আফরার পিতা প্রখ্যাত আনছার নেতা ল্যাংড়া ছাহাবী ‘আমর ইবনুল জামূহ ছিলেন (আল-ইছাবাহ মু‘আয ক্রমিক ৮০৫৭; ইবনু হিশাম ১/৬৩৪, ৭১০) কথাটি সঠিক নয়। কেননা ঐ নামে বীর মাতা ‘আফরা বিনতে উবায়েদ-এর কোন স্বামী ছিলেন না (আল-ইছাবাহ ‘আফরা ক্রমিক ১১৪৮১)। সুহায়লী বলেন, এ ব্যাপারে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হ’ল এই যে, তারা উভয়ে ছিলেন ‘আফরার পুত্র। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَدْ ضَرَبَهُ ابْنَا عَفْرَاءَ ‘আফরার পুত্রদ্বয় তাকে হত্যা করেছে’ (মুসলিম হা/১৮০০; ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)।
[3]. বুখারী হা/৪০২০; মুসলিম হা/১৮০০; মিশকাত হা/৪০২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫; বুখারী হা/৩৯৬১; মুসলিম হা/১৮০০।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫-৩৬।

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন,يَرْحَمُ اللهُ ابْنَيْ عَفْرَاءَ، فَهُمَا شُرَكَاءُ فِي قَتْلِ فِرْعَوْنَ هَذِهِ الْأُمَّةِ ‘আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহম করুন! তারা এই উম্মতের ফেরাঊনকে হত্যায় অংশীদার ছিল। আর ছিল ফেরেশতা এবং ইবনু মাসঊদ’ (আল-বিদায়াহ ৩/২৮৯)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ। একইভাবে এ সময় রাসূল (ছাঃ) খুশীতে দু’রাক‘আত শুকরিয়ার ছালাত আদায় করেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীছটিও যঈফ (ইবনু মাজাহ হা/১৩৯১)। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, সিজদায়ে শুক্র ওয়াজিব নয় এবং মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারেও কথা রয়েছে’ (মজমূ‘ ফাতাওয়া ২১/২৯৩; মা শা-‘আ ১১৩-১৪ পৃঃ)।

বদর যুদ্ধে জয়-পরাজয়

এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার মোট ১৪জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হন। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত কূয়ায় (القَلِيب) নিক্ষেপ করা হয়।[1] যাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহলসহ ১৪জন নেতার ১১ জন ছিল। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান (মৃ. মদীনায় ৩০ অথবা ৩৪ হি.), জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম (মৃ. ৫৭ হি.) ও হাকীম বিন হেযাম (মৃ. ৫৪ হি.) মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন এবং তাদের ইসলাম আমৃত্যু সুন্দর ছিল।

উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম ও আবু লাহাব বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। আবু লাহাব বদর যুদ্ধের সপ্তাহকাল পরে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

[1]. আল-বিদায়াহ ৩/২৯৩; আর-রাহীক্ব ২২৪-২৫ পৃঃ। মানছূরপুরী মুসলিম পক্ষে ২২ জন শহীদ বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৭)।

শুহাদায়ে বদর বা বদরের শহিদ

বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর যে ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন, তন্মধ্যে মুহাজির ছয় জন হ’লেন, (১) মিহজা‘ (مِهْجَعٌ), যিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মুক্তদাস ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর প্রথম শহীদ। (২) বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব থেকে উবায়দাহ ইবনুল হারিছ বিন মুত্ত্বালিব। শত্রু পক্ষের নেতা উৎবাহ বিন রাবী‘আহ তাঁর পা কেটে দেন। পরে ‘ছাফরা’ গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (৩) বনু যোহরা থেকে উমায়ের বিন আবু ওয়াকক্বাছ। যিনি সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের ভাই ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সের তরুণ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ) তাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি কাঁদতে থাকেন। ফলে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে যান (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬০৬১)। (৪) মুহাজিরগণের মিত্র যুশ-শিমালাইন বিন ‘আব্দে আমর আল-খুযাঈ। (৫) বনু ‘আদীর মিত্র ‘আক্বেল বিন বুকায়ের। (৬) বনুল হারেছ বিন ফিহর থেকে ছাফওয়ান বিন বায়যা।

অতঃপর আনছারদের মধ্যেকার আট জন হ’লেন, (১) বনু নাজ্জার থেকে হারিছাহ বিন সুরাক্বাহ। (২-৩) বনু গানাম থেকে ‘আফরার দুই পুত্র ‘আওফ ও মু‘আউভিয। (৪) বনুল হারেছ বিন খাযরাজ থেকে ইয়াযীদ বিন হারেছ। (৫) বনু সালামাহ থেকে উমায়ের বিন হুমাম। (৬) বনু হাবীব থেকে রাফে‘ বিন মু‘আল্লা। (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ থেকে সা‘দ বিন খায়ছামা এবং (৮) মুবাশশির বিন আব্দুল মুনযির (ইবনু হিশাম ১/৭০৬-০৮)।

বদরে নিহত কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ

বদর যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হন (ইবনু হিশাম ১/৭১৪)। নিহতদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হ’লেন, (১-৫) বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের উৎবাহ ও তার পুত্র অলীদ এবং ভাই শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, হানযালা বিন আবু সুফিয়ান এবং উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব। যাকে পরে হত্যা করা হয়। (৬) বনু মাখযূম গোত্রের আবু জাহল ‘আমর ইবনু হিশাম। (৭-৮) বনু জুমাহ গোত্রের উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহী ও তার পুত্র আলী। (৯) বনু আসাদ গোত্রের আবুল বাখতারী ‘আছ বিন হিশাম ও (১০) নওফাল বিন খুওয়াইলিদ বিন আসাদ (কুরাইশের শয়তানদের অন্যতম)। (১১) বনু নওফাল গোত্রের তু‘আইমা বিন ‘আদী। জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম-এর চাচা। (১২) বনু ‘আব্দিদ্দার গোত্রের নযর বিন হারেছ। যাকে পরে হত্যা করা হয়। (১৩-১৪) বনু সাহম গোত্রের নুবাইহ ও মুনাবিবহ ইবনুল হাজ্জাজ দুই ভাই (ইবনু হিশাম ১/৭০৮-১৩)।

বদর যুদ্ধে বন্দী কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ

(১) বনু হাশেম গোত্র থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। (২) চাচাতো ভাই ‘আক্বীল বিন আবু ত্বালিব (৩) নওফাল বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (৪) বনু ‘আব্দে শাম্স গোত্রের আমর বিন আবু সুফিয়ান (৫) রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা ‘আব্দে শামস গোত্রের আবুল ‘আছ বিন রবী‘। ইনি যয়নাবের স্বামী ছিলেন। তার বিনিময় মূল্য হিসাবে বিবাহকালে খাদীজা (রাঃ)-এর দেওয়া কণ্ঠহার দেখে রাসূল (ছাঃ) অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে যয়নাবকে ফেরত দেওয়ার শর্তে কোনরূপ বিনিময় মূল্য ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৫২-৫৩)। (৬) বনু জুমাহ গোত্রের আমর বিন উবাই বিন খালাফ (ইবনু হিশাম ২/৩-৮)। ইবনু হিশাম তার তালিকায় আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নাম দেননি। কারণ তিনি আগে থেকেই ‘মুসলিম’ ছিলেন। কিন্তু সম্প্রদায়ের ভয়ে তাঁর ইসলাম গোপন রেখেছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৩-টীকা)।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url