প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪৬ (দ্বিতীয় অংশ)] || মহানবীর জীবনী ||
হোনায়েন যুদ্ধ
(৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস)
হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হ’তে আরাফাতের দিকে ১০ মাইলের কিছু বেশী দক্ষিণ-পূর্বে হোনায়েন উপত্যকায় মালেক বিন ‘আওফের নেতৃত্বে ৪০০০ দুর্ধর্ষ সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাওয়াল শনিবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার ২০০০ নওমুসলিমসহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন। যুদ্ধে বিরাট পরিমাণের গণীমত হস্তগত হয়।[1] বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
[1]. আর-রাহীক্ব ৪১৩-১৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৪৩৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৪০৮-১৮।
হোনায়েন যুদ্ধের পটভূমি
মুসলমানদের আকস্মিক মক্কা বিজয়কে কুরায়েশ ও তাদের মিত্রদলগুলি মেনে নিলেও প্রতিবেশী বনু হাওয়াযেন ও তার শাখা ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ গোত্র এটাকে মেনে নিতে পারেনি।
উল্লেখ্য যে, হাওয়াযেন ও কুরায়েশ দু’টিই বনু মুযার বংশোদ্ভূত। মুযার ছিলেন হাওয়াযেনের ৬ষ্ঠ দাদা এবং কুরায়েশের ৭ম অথবা ৫ম দাদা। উভয়ের মধ্যে বংশগত ও আত্মীয়তাগত গভীর সম্পর্ক ছিল। মক্কা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ত্বায়েফের দূরত্ব মাত্র ৯০ কি. মি.। সেখানে কুরায়েশদের বহু ভূ-সম্পত্তি ও বাগ-বাগিচা ছিল। সেকারণ ত্বায়েফকে ‘কুরায়েশদের বাগিচা’(بُسْتَانُ قُرَيش) বলা হয়।
হাওয়াযেন গোত্রের অনেকগুলি শাখা ছিল। তন্মধ্যে ছাক্বীফগণ ত্বায়েফে এবং অন্যেরা লোহিত সাগরের তীরবর্তী তেহামায় বসবাস করত। ছাক্বীফদের এলাকাতেই আরবদের বড় বড় বাণিজ্য কেন্দ্র সমূহ অবস্থিত ছিল। যেমন ওকায বাজার। যেটি নাখলা ও ত্বায়েফের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল। যুলমাজায, যা আরাফাতের নিকটবর্তী এবং মাজান্নাহ, যা মার্রুয যাহরানে অবস্থিত ছিল। ফলে ব্যবসায়িক কারণেও কুরায়েশ ও ছাক্বীফদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল এবং কুরায়েশ ও হাওয়াযেন উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন ছিল। যেকারণে উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী কুরায়েশদের প্রতিনিধি হিসাবে হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে অন্যতম আলোচক হিসাবে প্রেরিত হন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৮৯-৯০)।
ছাক্বীফদের ছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ, যা প্রাকৃতিকভাবে চারদিক দিয়ে ত্বায়েফের দুর্গম খাড়া পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তাদের নির্মিত মযবুত দরজাসমূহ ব্যতীত সেখানে প্রবেশের কোন উপায় ছিল না। সে যুগের সেরা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত এই দুর্গে পুরা এক বছরের খাদ্য সঞ্চিত থাকত (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫০৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ত্বায়েফের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই মাক্কী জীবনে সেখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে দাওয়াত কবুল করেনি। বরং নির্যাতন করে তাঁকে বের করে দেয়। কুরায়েশদের সঙ্গে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধের মধ্যে হাওয়াযেন গোত্র জড়ায়নি। কারণ তারা হয়ত ভেবেছিল, কুরায়েশ একাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর তারা মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে হুঁশিয়ার হয়। এমনকি তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই শংকিত হয়ে পড়ে। সেকারণ তারা শিরকের ঝান্ডা উন্নীত করে সকল কুফরী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।
এতদুদ্দেশ্যে তারা মক্কা ও ত্বায়েফের মধ্যবর্তী বনু মুযার ও বনু হেলাল এবং অন্যান্য গোত্রের লোকদেরকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিল। এরা সবাই ছিল ক্বায়েস বিন ‘আয়লানের বংশধর। তবে বনু হাওয়াযেন-এর দু’টি শাখা বনু কা‘ব ও বনু কেলাব এই অভিযান থেকে দূরে থাকে’ (ইবনু হিশাম ২/৪৩৭)।
অতঃপর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে হাওয়াযেন নেতা মালেক বিন ‘আওফ আন-নাছরীর(مَالِكُ بْنُ عَوْفٍ النَّصْرِيُّ) নেতৃত্বে চার হাযার সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী হোনায়েন-এর সন্নিকটে আওত্বাস (أَوْطَاس) উপত্যকায় অবতরণ করে। যা ছিল হাওয়াযেন গোত্রের এলাকাভুক্ত। তাদের নারী-শিশু, গবাদিপশু ও সমস্ত ধন-সম্পদ তারা সাথে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, এগুলির মহববতে কেউ যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাবে না। তাদের ১২০ বছর বয়সী প্রবীণ অন্ধ নেতা ও দক্ষ যোদ্ধা দুরাইদ বিন ছিম্মাহ(دُرَيْدُ بْنُ الصِّمَّةِ) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তোমরা এগুলিকে দূরে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দাও। যুদ্ধে তোমরা বিজয়ী হ’লে ওরা এসে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। আর পরাজিত হ’লে ওরা বেঁচে যাবে’।[1] কিন্তু তরুণ সেনাপতি মালেক বিন ‘আওফ তার এ পরামর্শকে তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেয় এবং সবাইকে যুদ্ধের ময়দানে জমা করে।
[1]. ইবনু হিশাম ২/৪৩৮; ওয়াক্বেদী ৩/৮৮৬-৮৭।
ইসলামী বাহিনী হোনায়েন-এর পথে
৮ম হিজরীর ৬ই শাওয়াল শনিবার মক্কা থেকে ২০০০ নওমুসলিম সহ ১২,০০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এদের মধ্যে অনেক চুক্তিবদ্ধ মুশরিক মিত্র ছিল। যেমন ছাফওয়ান বিন উমাইয়া। যুদ্ধযাত্রাকালে রাসূল (ছাঃ) তার নিকট থেকে ১০০ বর্ম ধার নিয়েছিলেন তার সরঞ্জামাদিসহ। ঐ অবস্থায় তিনি হোনায়েন যুদ্ধে গমন করেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলাম কবুলের জন্য চার মাসের সময় দিয়েছিলেন। এই সময় আত্তাব বিন আসীদকে মক্কার আমীর নিযুক্ত করা হয় যিনি ছালাতে ইমামতি করবেন এবং মু‘আয বিন জাবলকে রেখে যান দ্বীন শিক্ষা দানের জন্য (ওয়াক্বেদী ৩/৮৮৯)।
যাতু আনওয়াত্ব
হোনায়েন যাওয়ার পথে তারা একটি বড় সতেজ-সবুজ কুল গাছ দেখতে পান। যাকে ‘যাতু আনওয়াত্ব’(ذَاتُ أَنْوَاطٍ) বলা হ’ত। মুশরিকরা এটিকে ‘কল্যাণ বৃক্ষ’ মনে করত। এখানে তারা পশু যবহ করত। এর উপরে অস্ত্র-শস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। এখানে পূজা দিত ও মেলা বসাত। তা দেখে নও মুসলিমদের কেউ কেউ বলে উঠলো,اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ ‘আমাদের জন্য একটি ‘যাতে আনওয়াত্ব’ দিন, যেমন ওদের ‘যাতে আনওয়াত্ব’ রয়েছে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিস্ময়ের সুরে বলে উঠলেন, سُبْحَانَ اللهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ) وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘সুবহানাল্লাহ! এটিতো সেরূপ কথা যেরূপ কথা মূসার কওম বলেছিল। ‘আমাদের জন্য একটি উপাস্য দিন, যেমন তাদের বহু উপাস্য রয়েছে’। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন নিহিত, তোমরা তোমাদের পূর্বের লোকদের রীতি-নীতি অবশ্যই অবলম্বন করবে’।[1] অন্য বর্ণনায় ‘সুবহানাল্লাহ’-এর স্থলে ‘আল্লাহু আকবার’ এসেছে (আহমাদ হা/২১৯৫০)। আর একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা ঠিক সেইরূপ কথা বলছ, যেরূপ মূসার কওম বলেছিল,اِجْعَلْ لَّنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘আমাদের জন্য একটি উপাস্য দিন, যেমন তাদের বহু উপাস্য রয়েছে’। আর মূসা তাদের জওয়াবে বলেছিলেন,إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُوْنَ ‘নিশ্চয়ই তোমরা মূর্খ জাতি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮)। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, إِنَّهَا السُّنَنُ، لَتَرْكَبُنَّ سُنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ‘এটাই হ’ল রীতি। তোমরা তোমাদের পূর্বের লোকদের রীতি অবশ্যই অবলম্বন করবে’ (আহমাদ হা/২১৯৪৭)।
[1]. তিরমিযী হা/২১৮০, মিশকাত হা/৫৪০৮ ‘ফিতান’ অধ্যায়।
হোনায়েন-এর পূর্ব রাতের ঘটনা
হোনায়েন পৌঁছার আগের রাতে আবু হাদরাদ আসলামী (রাঃ)-কে গোপনে পাঠিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের সব খবর জেনে নিয়ে বললেন,تِلْكَ غَنِيمَةُ الْمُسْلِمِينَ غَدًا إِنْ شَاءَ اللهُ ‘এসবই আগামীকাল মুসলমানদের গণীমতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ’। তিনি আনাস বিন আবু মারছাদ আল-গানাভীকে রাত্রিকালীন পাহারার দায়িত্ব দেন। সকালে উঠে রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, রাতে শুয়েছিলে কি? তিনি বললেন, না। কেবল ছালাত আদায় করেছি এবং হাজত সেরেছি। তখন খুশী হয়ে রাসূল (ছাঃ) বললেন, قَدْ أَوْجَبْتَ فَلاَ عَلَيْكَ أَنْ لاَ تَعْمَلَ بَعْدَهَا ‘তুমি জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিলে। এর পরে আর কোন আমল না করলেও তোমার চলবে’ (আবুদাঊদ হা/২৫০১)।
আমরা কখনোই পরাজিত হব না
এ সময় নিজেদের সৈন্যসংখ্যা বেশী দেখে কেউ কেউ বলে উঠেন, لَنْ نُغْلَبَ الْيَوْمَ مِنْ قِلَّةٍ ‘শত্রু সংখ্যা কম হওয়ার কারণে আজ আমরা কখনোই পরাজিত হব না’। ইবনু ইসহাক বলেন, এরা ছিল নওমুসলিম বনু বকরের কোন কোন ব্যক্তি।[1] মাত্র ১৯ দিন পূর্বে মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হওয়া এই সব ব্যক্তিগণ ইতিহাসে ‘তুলাক্বা’ (الطُّلَقاءُ) বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল নামে খ্যাত (যাদুল মা‘আদ ৫/৫৯)। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক স্থানে এবং হোনায়েন-এর দিনে। যেদিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের গর্বিত করেছিল। অথচ তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি। ফলে যমীন প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য তা সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে’ (তওবা ৯/২৫)।
ছুহায়েব রূমী (রাঃ) বলেন, হোনায়েনের দিন ফজরের ছালাতের পর রাসূল (ছাঃ) বারবার ঠোট নাড়াতে থাকেন। এরূপ আমরা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। তখন আমরা তাঁকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তোমাদের পূর্বে একজন নবী ছিলেন, যিনি তাঁর উম্মতের আধিক্য দেখে গর্বিত হন এবং বলেন, لَنْ يَرُومَ هَؤُلاَءِ شَىْءٌ ‘এদের উপর কেউ কখনো বিজয়ের আশা করবে না’। তখন আল্লাহ তাঁর উপর অহী নাযিল করে বললেন, তোমার উম্মতকে তিনটির যেকোন একটির ব্যাপারে এখতিয়ার দেওয়া হ’ল। তাদের উপরে শত্রুদের চাপিয়ে দেওয়া হবে। যারা তাদেরকে ধ্বংস করে দিবে। অথবা ক্ষুধা চাপিয়ে দেওয়া হবে। অথবা মৃত্যু পাঠানো হবে’। তখন উক্ত নবী তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তারা বলল, শত্রুর সঙ্গে মুকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। অতঃপর ক্ষুধার উপর ধৈর্য্য ধারণের শক্তি আমাদের নেই। অতএব মৃত্যুই উত্তম’। তখন আল্লাহ তাদের উপর মৃত্যু প্রেরণ করেন। তাতে তিন দিনে ৭০ হাযার উম্মত মারা যায়। এ ঘটনা বলার পর রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি এখন আমাদের সংখ্যাধিক্য দেখে বলব, اللَّهُمَّ بِكَ أُحَاوِلُ وَبِكَ أُصَاوِلُ وَبِكَ أُقَاتِلُ ‘হে আল্লাহ! তোমার মাধ্যমে আমি কৌশল করি, তোমার মাধ্যমে আমি হামলা করি এবং তোমার মাধ্যমেই আমি যুদ্ধ করি’ (আহমাদ হা/১৮৯৬০, সনদ ছহীহ)।
নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাহায্য তখনই নেমে আসে, যখন বান্দা তার শর্ত পূরণ করে। আর তা হ’ল, আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা গুলিকে দৃঢ় করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। আর আল্লাহকে সাহায্য করা অর্থ হ’ল, যাবতীয় বস্ত্তগত প্রস্ত্ততিসহ আল্লাহর উপরে খালেছ তাওয়াক্কুল করা। হোনায়েন যুদ্ধে বস্ত্তগত প্রস্ত্ততি পূর্ণ মাত্রায় থাকলেও অনেকের মধ্যে খালেছ তাওয়াক্কুলের অভাব ছিল বলেই যুদ্ধের প্রথম দিকে বিপর্যয় নেমে আসে। অতঃপর যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ঈমানের দৃঢ়তা ফিরে আসে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় নেমে আসে।
আনাস (রাঃ) বলেন, كَانَ مِنْ دُعَاءِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ حُنَيْنٍ- اللَّهُمَّ إِنْ شِئْتَ أَنْ لاَ تُعْبَدَ بَعْدَ الْيَوْمِ ‘হোনায়েনের দিন রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম প্রার্থনা ছিল, হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও, তাহ’লে আজকের দিনের পর তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’ (আহমাদ হা/১২২৪২, সনদ ছহীহ)।
[1]. ইবনু হিশাম ২/৪৪৪। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭৪৯)।
মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়
ভোর রাতের অন্ধকারে মুসলিম বাহিনী হোনায়েন পৌঁছল। শত্রুপক্ষের ছাক্বীফ ও হাওয়াযেন গোত্রের দক্ষ তীরন্দাযরা সেখানে আগেই ওঁৎ পেতে ছিল। তারা গিরিসংকটের সংকীর্ণ পথে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামী দলকে নাগালের মধ্যে পাওয়া মাত্রই চারদিক থেকে তীরবৃষ্টি শুরু করে দিল। তাদের এ আকস্মিক হামলায় মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে ছুটতে লাগল। বিভিন্ন বর্ণনা মোতাবেক এ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ছিলেন ৪, ৯, ১০, ১২, ৮০ অথবা সর্বোচ্চ ১০০ জন লোক’ (ফাৎহুল বারী হা/৪৩১৫-এর আলোচনা)। হ’তে পারে শুরুতে ৪জন এবং পরে সংখ্যা বাড়তে থাকে।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) মুসলিম বাহিনীর ডান দিকে অবস্থান করছিলেন। এ সময় হাওয়াযেন বাহিনীর সম্মুখভাগে কালো পতাকাবাহী জনৈক সুসজ্জিত ব্যক্তি লাল উটে সওয়ার হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। সে যাকেই পাচ্ছিল তাকেই মেরে দিচ্ছিল। হযরত আলী ও একজন আনছার ছাহাবী তাকে টার্গেট করেন। অতঃপর তার উটের পিছন পায়ের হাঁটুর স্থানে আঘাত করেন। তাতে লোকটি পিছন দিকে পড়ে যায়। অতঃপর আনছার ব্যক্তি তার পায়ের নলায় আঘাত করলে তা দু’টুকরা হয়ে পতিত হয়। তারপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অবশেষে পরাজয় এসে যায়।[1] এ সময় ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই কালাদাহ বিন হাম্বল বলল,أَلاَ بَطَلَ السِّحْرُ الْيَوْمَ ‘দেখ জাদু আজ ব্যর্থ হয়ে গেল’। একথা শুনে ছাফওয়ান বললেন, যিনি তখনও মুশরিক ছিলেন, চুপ কর, আল্লাহ তোমার চেহারাকে বিকৃত করুন! আল্লাহর কসম! কুরায়েশ-এর কোন ব্যক্তি আমার নিকটবর্তী হওয়া আমার নিকট অধিক প্রিয় হাওয়াযেন-এর কোন ব্যক্তি আমার নিকটবর্তী হওয়ার চাইতে’।[2] পালানোর এ দৃশ্য দেখে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান বিন হারব, যিনি মাত্র ২০ দিন আগে মুসলমান হয়েছেন, তিনি বলে ওঠেন,لاَ تَنْتَهِي هَزِيمَتُهُمْ دُونَ الْبَحْرِ ‘সাগরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এদের পালানোর গতি শেষ হবে না’।[3]
এভাবে প্রথম ধাক্কাতেই এদের ঈমান ভঙ্গুর হয়ে গেল এবং পূর্বের কুফরীতে ফিরে যাবার উপক্রম হ’ল। যারা মূলতঃ গণীমত লাভের উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ঈমানের স্বাদ এবং আল্লাহর পথে জিহাদের মহববত তাদের অন্তরে তখনও প্রবিষ্ট হয়নি। মুসলিম বাহিনী শেষ পর্যন্ত পরাজিত হ’লে হয়তোবা তারা পুনরায় কুফরীতে ফিরে যেতেন।
[1]. ইবনু হিশাম ২/৪৪৫, সনদ ছহীহ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১৭৫১)।
[2]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৭৭৪, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৪৪৪; মুহাক্কিক এটি ধরেননি।
[3]. আবু জা‘ফর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আত্ব-ত্বাহাবী আল-মিছরী (২৩৯-৩২১ হি.), মুশকিলুল আছার হা/২১৫৭; ইবনু হিশাম ২/৪৪৩; মুহাক্কিক এটি ধরেননি।
হোনায়েন যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা
শায়বা বিন ওছমান বিন আবু ত্বালহা আল-‘আবদারী আল-হাজাবী, যিনি মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন এবং হোনায়েন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে বিপর্যয়কর অবস্থায় যখন রাসূল (ছাঃ) খচ্চর থেকে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে সুযোগ পেয়ে হত্যা করার অপচেষ্টা চালান। কারণ তার পিতা ওছমান বিন আবু ত্বালহা ওহোদ যুদ্ধের দিন আলী (রাঃ)-এর হাতে নিহত হন। তিনি বলেন, তখনই আমি প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি যে, আরব-আজমের সবাই যদি মুহাম্মাদের অনুসারী হয়, আমি কখনই তাঁর অনুসারী হবো না। ফলে যখন আমি মক্কা থেকে যুদ্ধে বের হই, তখন থেকেই আমি সুযোগের সন্ধানে থাকি। অতঃপর আমি সুযোগ পেয়ে তাঁর নিকটবর্তী হই এবং হত্যার জন্য তরবারী উঠাই। হঠাৎ আমার সামনে বিদ্যুতের চমকের ন্যায় একটা আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে। যা আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে। আমি ভয়ে চোখে হাত দেই। তখন রাসূল (ছাঃ) আমার দিকে তাকান ও আমাকে ডেকে বলেন, হে শায়বা আমার নিকটে এসো! আমি তাঁর নিকটে গেলাম। অতঃপর তিনি আমার বুকে হাত রেখে বললেন,اللَّهُمَّ أَعِذْهُ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘হে আল্লাহ! তুমি একে শয়তান থেকে পানাহ দাও’। এতে আমার ভিতরের সব উত্তেজনা দূর হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তখন তিনি আমার নিকটে আমার জীবনের চাইতে প্রিয় হয়ে যান’। আমৃত্যু তাঁর ইসলাম সুন্দর ছিল। ৫৮ বা ৫৯ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[1] উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের দিন তার চাচাতো ভাই ওছমান বিন ত্বালহাকে রাসূল (ছাঃ) কা‘বাগৃহের চাবি হস্তান্তর করেন’ (আল-ইছাবাহ, ওছমান বিন ত্বালহা ক্রমিক ৫৪৪৪)।
[1]. আল-ইছাবাহ, শায়বা বিন ওছমান ক্রমিক ৩৯৪৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪১২; ইবনু হিশাম ২/৪৪৪; সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭৪৮)।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
পর্ব-০১ পর্ব-০২ পর্ব-০৩ পর্ব-০৪ পর্ব-০৫ পর্ব-০৬ পর্ব-০৭ পর্ব-০৮ পর্ব-০৯ পর্ব-১০ পর্ব-১১ পর্ব-১২ পর্ব-১৩ পর্ব-১৪ পর্ব-১৫ পর্ব-১৬ পর্ব-১৭ পর্ব-১৮ পর্ব-১৯ পর্ব-২০ পর্ব-২১ পর্ব-২২ পর্ব-২৩ পর্ব-২৪ পর্ব-২৫ পর্ব-২৬ পর্ব-২৭ পর্ব-২৮ পর্ব-২৯ পর্ব-৩০ পর্ব-৩১ পর্ব-৩২ পর্ব-৩৩ পর্ব-৩৪ পর্ব-৩৫ পর্ব-৩৬ পর্ব-৩৭ পর্ব-৩৮ পর্ব-৩৯ পর্ব-৪০ পর্ব-৪১ পর্ব-৪২ পর্ব-৪৩ পর্ব-৪৪ পর্ব-৪৫ পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়) পর্ব-৪৭ পর্ব-৪৮ পর্ব-৪৯ পর্ব-৫০ পর্ব-৫১ পর্ব-৫২ পর্ব-৫৩ পর্ব-৫৪ পর্ব-৫৫ পর্ব-৫৬ পর্ব-৫৭ পর্ব-৫৮ পর্ব-৫৯ পর্ব-৬০ পর্ব-৬১ পর্ব-৬২ পর্ব-৬৩ পর্ব-৬৪ পর্ব-৬৫ পর্ব-৬৬ পর্ব-৬৭
******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url