প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫৩] || মহানবীর জীবনী ||




মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে বিভিন্ন গোত্রের  ইসলাম গ্রহণ

(প্রথম অংশ)
[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

মক্কা বিজয়ের পর প্রতিনিধি দল সমূহের আগমন

৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে হোনায়েন যুদ্ধের পর থেকে ৯ম ও ১০ম হিজরী সনকে আমরা ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমন বছর’(عَامُ الْوُفُود) হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। মূলতঃ ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পর চারিদিকে ইসলাম কবুলের ঢেউ ওঠে। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভের জন্য সমগ্র আরব জাহান যেন মক্কা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল। কেননা তারা বলত,اتْرُكُوهُ وَقَوْمَهُ، فَإِنَّهُ إِنْ ظَهَرَ عَلَيْهِمْ فَهُوَ نَبِىٌّ صَادِقٌ ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর কওমকে ছেড়ে দাও। কেননা যদি তিনি তাদের (অর্থাৎ কুরায়েশদের) উপরে জয়লাভ করেন, তাহ’লে তিনি সত্য নবী’।[1] অতঃপর যখন তিনি মক্কা জয় করলেন এবং কুরায়েশ নেতারা ইসলাম কবুল করলেন, এমনকি হোনায়েন যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ হয়ে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করলেন, তখন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন গোত্রের পক্ষ হ’তে দলে দলে প্রতিনিধি দল মদীনায় আসতে শুরু করল এবং ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’ল। ফলে দেখা গেল যে, মক্কা বিজয়ের মাত্র নয় মাসের মাথায় ৯ম হিজরীর রজব মাসে তাবূক অভিযানের সময় ৩০,০০০ ফৌজ জমা হয়ে গেল। তার এক বছর পর ১০ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে বিদায় হজ্জের সময় এক লক্ষ চবিবশ হাযার বা ত্রিশ হাযার মুসলমান আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হ’লেন।[2] দু’দিন আগেও যারা লাত, মানাত, ‘উয্যা, হোবলের নামে জয়ধ্বনি করত ও তাদের সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন নযর-নেয়ায নিয়ে তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তি লাভের জন্য সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ত, আজ তাদের লাববায়েক আল্লাহুম্মা লাববায়েক, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ধ্বনিতে গগন-পবন মুখরিত হয়ে উঠলো।

[1]. বুখারী হা/৪৩০২; মিশকাত হা/১১২৬, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ; আর-রাহীক্ব ৪৩৫ পৃঃ।
[2]. মির‘আত, শরহ মিশকাত ‘মানাসিক’ অধ্যায়, হা/২৫৬৯-এর আলোচনা।

আগত প্রতিনিধি দল সমূহ

ইবনু সা‘দ, দিমইয়াত্বী, ইবনু সাইয়িদিন নাস, মুগলাত্বাঈ, যয়নুদ্দীন ইরাকী প্রমুখ জীবনীকারগণ ৬০-এর অধিক প্রতিনিধি দলের কথা বর্ণনা করেছেন। যুরক্বানী বলেন, উক্ত সংখ্যা ৭০ পর্যন্ত পৌঁছবে না, যা প্রসিদ্ধ আছে’। তিনি ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে জি‘ইর্রানাতে হোনায়েন যুদ্ধের গণীমত বণ্টন শেষে আগত বনু হাওয়াযেন গোত্রের প্রতিনিধি দলকে তালিকার প্রথমে এনেছেন। অতঃপর মোট ৩৫টি প্রতিনিধি দলের বর্ণনা দিয়েছেন।[1] আমরা সেখান থেকে ৩৪টি, যাদুল মা‘আদ থেকে ২টি ‘বনু তামীম’ ও কা‘ব বিন যুহায়ের’ এবং ত্বাবাক্বাত ইবনু সা‘দ থেকে ১টি ‘ইয়ামনের শাসকদের দূত’ সহ মোট ৩৭টি প্রতিনিধি দলের বর্ণনা দিলাম। যার মধ্যে ইবনুল ক্বাইয়িম বর্ণিত ৩৫টি, মানছূরপুরী বর্ণিত ২৬টি এবং মুবারকপুরী বর্ণিত ১৬টি দলের উল্লেখ রয়েছে। দলগুলি হ’ল যথাক্রমে (১) বনু হাওয়াযেন (২) ছাক্বীফ (৩) বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহ (৪) আব্দুল ক্বায়েস (৫) বনু হানীফা (৬) ত্বাঈ (৭) কিন্দা (৮) আশ‘আরী (৯) বনু তামীম (১০) বনুল হারেছ (১১) হামদান (১২) মুযায়নাহ (১৩) দাউস (১৪) নাজরান (১৫) ফারওয়া বিন আমরের দূত (১৬) বনু সা‘দ বিন বকর (১৭) তারেক বিন আব্দুল্লাহ প্রতিনিধি দল (১৮) তুজীব (১৯) বনু সা‘দ হুযায়েম (২০) বনু ফাযারাহ (২১) বনু আসাদ (২২) বাহরা (২৩) উযরাহ (২৪) বালী (২৫) বনু মুর্রাহ (২৬) খাওলান (২৭) মুহারিব (২৮) ছুদা (২৯) গাসসান (৩০) সালামান (৩১) বনু ‘আব্স (৩২) গামেদ (৩৩) আযদ (৩৪) বনুল মুনতাফিক্ব (৩৫) কা‘ব বিন যুহায়ের (৩৬) ইয়ামনের শাসকদের দূত এবং (৩৭) নাখঈ।

জীবনীকারগণ যতগুলি প্রতিনিধি দলের বিবরণ দিয়েছেন তার অনেকগুলি মুহাদ্দিছগণের নিকটে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। তবে প্রায় সবগুলি মর্মগতভাবে প্রমাণিত। অনেকগুলি বর্ণনা ছহীহ হাদীছ সমূহে এসেছে। যেমন বনু হাওয়াযেন, বনু তামীম, আব্দুল ক্বায়েস, বনু হানীফাহ, নাজরান, ইয়ামনবাসী আশ‘আরীগণ, দাউস, তাঈ, কিন্দা, মুযায়নাহ এবং বনু সা‘দ বিন বকর প্রতিনিধি দল সমূহ। আমরা প্রত্যেকটি দল সম্পর্কে আলোচনা করব। কেননা প্রত্যেকটিতেই রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, যা অতীব যরূরী।

[1]. যুরক্বানী, শারহুল মাওয়াহেব ৫/১১৪-২৩৪। মুবারকপুরী ৭০-এর অধিক লিখেছেন (আর-রাহীক্ব ৪৪৫ পৃঃ)।

বনু হাওয়াযেন প্রতিনিধি দল

৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে হোনায়েন যুদ্ধের পর জি‘ইর্রানাহ্তে গণীমত বণ্টন সম্পন্ন হবার পর যোহায়ের বিন ছুরাদ(زُهَيْرُ بْنُ صُرَدٍ) এর নেতৃত্বে হাওয়াযেন গোত্রের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মুসলমান অবস্থায় সেখানে আগমন করে। এই দলে রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ চাচা আবু বুরক্বান(أبو بُرْقَان) ছিলেন। তাঁরা অনুরোধ করলেন যে, অনুগ্রহ পূর্বক তাদের বন্দীদের ও মাল-সম্পদাদি ফেরৎ দেওয়া হৌক’। তাদের বন্দীনীদের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর দুগ্ধ সম্পর্কিত খালা-ফুফুরাও ছিলেন। যাদের বন্দী রাখা ছিল নিতান্ত অবমাননাকর বিষয়।

অতঃপর তাদের ৬,০০০ যুদ্ধবন্দীর সবাই মুক্তি পেয়ে যায়। মুক্তি দানের সময় প্রত্যেক বন্দীকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একটি করে মূল্যবান ক্বিবতী চাদর উপহার দেন।

(বিস্তারিত দ্রঃ ‘হোনায়েন যুদ্ধ’ অধ্যায়, ‘হাওয়াযেন প্রতিনিধি দলের আগমন ও বন্দীদের ফেরৎ দান’ অনুচ্ছেদ)।

[শিক্ষণীয় : (১) ধন-সম্পদের চাইতে মানুষের নিকট তাদের বংশ মর্যাদার মূল্য অনেক বেশী। কেননা হাওয়াযেন গোত্রের নেতাদেরকে রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাদের সন্তানাদি ও নারীগণ তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয়, না তোমাদের ধন-সম্পদ’? জবাবে তারা বলেছিলেন,مَا كُنّا نَعْدِلُ بِالأَحْسَابِ شَيْئًا ‘আমরা কোন কিছুকেই বংশ মর্যাদার তুলনীয় মনে করি না’। (২) রাসূল (ছাঃ)-এর এই উদারনীতি ছিল তৎকালীন সময়ের যুদ্ধনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা।]

ছাক্বীফ প্রতিনিধি দল

ত্বায়েফের বিখ্যাত ছাক্বীফ গোত্রের এই প্রতিনিধিদল ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় আসে। এগারো মাস আগে ত্বায়েফ দুর্গ হ’তে অবরোধ উঠিয়ে ফিরে আসার সময় তাদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার জন্য সাথীদের দাবীর বিপরীতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হেদায়াতের দো‘আ করে বলেছিলেন।اللَّهُمَّ اهْدِ ثَقِيفًا وَأْتِ بِهِمْ ‘হে আললাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত করো ও তাদেরকে এনে দাও’।[1] আল্লাহ তাঁর রাসূল-এর দো‘আ কবুল করেছিলেন এবং তিনি ত্বায়েফ থেকে ফিরে মক্কায় ওমরাহ করে ৮ম হিজরীর ২৪শে যুলক্বা‘দাহ মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই ছাক্বীফ গোত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ওরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী পথিমধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে ইসলাম কবুল করেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫১৭)। তাঁর দশজন স্ত্রী ছিল। মুসলমান হওয়ার পর রাসূল (ছাঃ)-এর হুকুমে চার জনকে রেখে বাকীদের তালাক দেন। ইতিপূর্বে হোদায়বিয়া সন্ধির প্রাক্কালে তিনি কুরায়েশদের পক্ষে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে দূতিয়ালি করেন। ইনি প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। যিনি আগেই ইসলাম কবুল করেছিলেন।

ওরওয়া ফিরে এসে নিজ সম্প্রদায়ের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। বহু লোক তাঁর দাওয়াতে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একদিন তিনি বাড়িতে নিজ কক্ষে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় এক দুষ্টমতি তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে। তাতে তিনি শহীদ হয়ে যান (আল-ইছাবাহ, ‘উরওয়া ক্রমিক ৫৫৩০)।

কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর দাওয়াত সকলের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই ‘আব্দে ইয়ালীল(عَبْدُ يالِيل بن عمرو) এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় পৌঁছে। এই দলে ছয় জন সদস্য ছিলেন। যাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন পরবর্তীকালে খ্যাতনামা ছাহাবী ও হযরত ওমরের সময়ে প্রথম ভারত অভিযানকারী বিজয়ী সেনাপতি ওছমান বিন আবুল ‘আছ ছাক্বাফী। এঁরা মদীনায় পৌঁছলে রাসূল (ছাঃ)-এর হুকুমে মুগীরা বিন শো‘বা এঁদের আপ্যায়ন ও আতিথেয়তার দায়িত্বে নিয়োজিত হন।

উল্লেখ্য যে, প্রতিনিধি দলের নেতা ‘আব্দে ইয়ালীল ছিলেন সেই ব্যক্তি, যার নিকটে ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের মে/জুন মাসের প্রচন্ড খরতাপের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবলমাত্র যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে ৯০ কি.মি. বা ৬০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি ত্বায়েফের কিশোর ছোকরাদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। তারা তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে তিন মাইল পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ এক যুগ পরে ত্বায়েফের সেই দুর্ধর্ষ নেতাই আজ রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হেদায়াতের ভিখারী। আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা!

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাক্বীফ প্রতিনিধি দলের জন্য মসজিদে নববীর কাছাকাছি তাঁবুর ব্যবস্থা করতে বললেন। যাতে তারা সেখান থেকে মসজিদে ছালাতের দৃশ্য দেখতে পায় ও কুরআন শুনতে পায়।

রাসূল (ছাঃ)-এর এই দূরদর্শী ব্যবস্থাপনায় দ্রুত কাজ হ’ল। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের অন্তরে ইসলাম প্রভাব বিস্তার করল। ‘আব্দে ইয়ালীলের নেতৃত্বে তারা একদিন এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করল। তবে অত্যন্ত হুঁশিয়ার নেতা হিসাবে এবং স্বীয় মূর্খ সম্প্রদায়কে বুঝানোর স্বার্থে বায়‘আতের পূর্বে নিজ সম্প্রদায়ের লালিত রীতি-নীতি ও মন-মানসিকতার আলোকে বেশ কিছু বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যাতে পরবর্তীতে কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ না থাকে এবং লোকেরা বলতে না পারে যে, কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই তারা মুসলমান হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে তাদের প্রশ্নোত্তর সমূহ নিম্নে বর্ণিত হ’ল।-

১ম : আমাদেরকে ছালাত পরিত্যাগের অনুমতি দেওয়া হৌক! কারণ তারা এর মধ্যে নিজেদের হীনতা দেখেছিল।
জওয়াব : তিনি বললেন,لاَ خَيْرَ فِى دِينٍ لاَ رُكُوعَ فِيهِ ‘ঐ দ্বীনে কোন কল্যাণ নেই, যার মধ্যে ছালাত নেই’।[2]

২য় : আমাদেরকে জিহাদ ও যাকাত থেকে মুক্ত রাখা হৌক!
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) এটিকে আপাততঃ মেনে নিলেন। ছাহাবায়ে কেরামকে বললেন,سَيَتَصَدَّقُونَ وَيُجَاهِدُونَ إِذَا أَسْلَمُوا ‘সত্বর ওরা ছাদাক্বা দিবে ও জিহাদ করবে, যখন ওরা ইসলাম কবুল করবে’।[3]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ‘আব্দে ইয়ালীলের আরও কিছু বিষয়ের উপরে কথোপকথন উদ্ধৃত করেছেন। যেমন-

৩য় : আমাদের লোকেরা অধিকাংশ সময় কার্যোপলক্ষে বাইরে থাকে। সেকারণ তাদের জন্য ব্যভিচারের অনুমতি আবশ্যক।
জওয়াব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা বনু ইস্রাঈল ৩২ আয়াতটি পাঠ করে শুনান এবং এটি নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান।

৪র্থ : আমাদের সকল অর্থ-সম্পদই সূদের অন্তর্ভুক্ত। অতএব সূদী কারবারের অনুমতি দেওয়া হৌক।
জওয়াব : তিনি তাদেরকে সূরা বাক্বারাহ ২৭৮ আয়াত শুনিয়ে বলেন, আসল টাকাই কেবল তোমরা পাবে এবং সূদের অর্থ ছেড়ে দিতে হবে।

৫ম : আমাদেরকে মদ্যপানের সুযোগ অব্যাহত রাখা হৌক। কেননা আমাদের লোকেরা এতে এমনভাবে অভ্যস্ত যে, তারা তা ছাড়তেই পারবে না।
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরা মায়েদাহ ৯০ আয়াতটি পাঠ করে শুনান এবং একে সিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই বলে জানান। কথাগুলি শুনে ‘আব্দে ইয়ালীল তাঁবুতে ফিরে গেলেন এবং রাতে সঙ্গীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। পরের দিন এসে পুনরায় রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে কথাবার্তা শুরু করলেন।

৬ষ্ঠ : আমরা আপনার সব কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের উপাস্য দেবী ‘রববাহ’ (ربَّه) সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
জওয়াব : রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা ওটাকে গুঁড়িয়ে দিবে। একথা শুনে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হায় হায় করে উঠে বলল, দেবী একথা জানতে পারলে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেবে। তাদের এই অবস্থা দেখে ওমর ফারূক (রাঃ) আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বলে উঠলেন, হে ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল![4]مَا أَجْهَلَك إنَّمَا الرَّبَّةُ حَجَرٌ ‘তুমি কত বড় মূর্খ! ‘রববাহ’ তো একটা পাথর ছাড়া কিছুই নয়’? ‘আব্দে ইয়ালীল ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ওমর! আমরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে অনুরোধ করলেন যে, দেবীমূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্বটা আপনি গ্রহণ করুন’। রাসূল (ছাঃ) তাতে রাযী হলেন এবং বললেন, ঠিক আছে আমি ওটা ভাঙ্গার জন্য লোক পাঠাব’। প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য বললেন, আপনার লোককে আমাদের সাথে পাঠাবেন না। বরং পরে পাঠাবেন।

সীরাহ ছহীহাহর লেখক আরও কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। যেমন তারা বলেছিল আমাদের দেশ খুবই ঠান্ডা। অতএব আমাদের ওযূ করার কষ্ট থেকে রেহাই দেওয়া হৌক। আমাদেরকে ‘নাবীয’ (খেজুর পচা মদ) বানানোর অনুমতি দেওয়া হৌক এবং আমাদের পলাতক দাস আবু বাকরাহ ছাক্বাফীকে ফেরত দেওয়া হৌক। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাদের এসব দাবী নাকচ করে দেন। এছাড়াও তারা কুরআনের সূরা, পারা ইত্যাদির তারতীব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু কোনটাই গ্রহণ করা হয়নি। অবশেষে তারা মসজিদে নববীর পার্শ্বে দীর্ঘ অবস্থানের ফলে এবং ছাহাবীগণের সাথে মেলামেশার ফলে দ্রুত ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এমনকি তারা রামাযানের অবশিষ্ট ছিয়ামগুলি পালন করে (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫১৯)।

এইভাবে বিস্তারিত আলোচনা শেষে তারা সবাই ইসলাম কবুল করল। অতঃপর ১৫ দিন পর বিদায়কালে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করে দিন। তখন তিনি ওছমান বিন আবুল ‘আছ ছাক্বাফীকে তাদের ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করে দেন। কেননা দলের মধ্যে তিনিই রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর নিকটে কুরআন ও শরী‘আতের বিধান সমূহ বেশী শিখেছিলেন। যদিও বয়সে ছিলেন সবার ছোট। বয়োকনিষ্ঠ হলেও তিনি অত্যন্ত যোগ্য নেতা প্রমাণিত হন। ১১ হিজরীতে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে গেলে ছাক্বীফ গোত্র ধর্মত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তখন তিনি স্বীয় গোত্রকে ডেকে বলেন,كُنتم آخِرَ الناسِ إسلامًا فلا تَكُونوا أوَّلَهُم اِرْتِدادًا ‘তোমরা সবার শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছ। অতঃপর সবার আগে ইসলাম ত্যাগী হয়ো না’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৫৪৪৫)। তার একথা শুনে সবাই ফিরে আসে।

ইসলাম কবুল করার পর ত্বায়েফ ফিরে যাবার পথে প্রতিনিধিদল নিজ সম্প্রদায়ের নিকটে নিজেদের ইসলাম কবুলের কথা গোপন রাখার ব্যাপারে একমত হলেন। যাতে লোকেদের মন-মানসিকতা পরখ করে নেয়া যায়। অতঃপর তারা বাড়ীতে পৌঁছে গেলে লোকজন জমা হয়ে গেল এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। তারা বললেন, মুহাম্মাদ তাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা ইসলাম কবুল কর। ব্যভিচার, মদ্যপান, সূদখোরী ছেড়ে দাও। নইলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও’। একথা শুনে লোকদের মধ্যে জাহেলিয়াত মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো এবং ‘আমরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত’ বলে হুংকার ছাড়ল। প্রতিনিধিদল বললেন, ঠিক আছে। তোমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও এবং দুর্গ মেরামতে লেগে যাও। লোকেরা চলে গেল এবং দু’দিন বেশ তোড়জোড় চলল। কিন্তু তৃতীয় দিন তারা এসে বলতে শুরু করল, মুহাম্মাদের সঙ্গে আমরা কিভাবে লড়ব। সারা আরব তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। অতএব إِرْجِعُوا إلَيْه فَأَعْطُوْهُ مَا سَأَلَ ‘তার কাছে ফিরে যাও এবং তিনি যা চান কবুল করে নাও’। এভাবে আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিলেন।

এতক্ষণে প্রতিনিধিদল প্রকৃত তথ্যসমূহ প্রকাশ করে দিল এবং লোকেরা সবকিছু শুনে ইসলাম কবুল করে নিল (যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৩)।

‘রববাহ’ মূর্তিভাঙ্গা

কয়েকদিন পরেই রাসূল (ছাঃ) আবু সুফিয়ান বিন হারব-এর নেতৃত্বে মুগীরাহ বিন শো‘বা সহ একটি দল প্রেরণ করেন ছাকবীফ গোত্রের দেবীমূর্তি ‘রববাহ’ ভেঙ্গে ফেলার জন্য। যা ‘লাত’ (لات) নামে প্রসিদ্ধ (ইবনু হিশাম ২/৫৪১)। মূর্তি ভাঙ্গার কথা শুনে বনু ছাক্বীফের নারীরা তার চারপাশে জমা হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় মুগীরা (রাঃ) তাঁর সাথীদের বললেন,وَاللهِ لَأَضْحِكَنَّكُمْ مِنْ ثَقِيفٍ ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদেরকে ছাক্বীফদের ব্যাপারে হাসাবো’। অতঃপর তিনি মূর্তির প্রতি গদা নিক্ষেপ করতে গিয়ে নিজেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়তে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে ছাক্বীফের লোকেরা হায় হায় করে উঠে বলল,أَبْعَدَ اللهُ الْمُغِيرَةَ قَتَلَتْهُ الرَّبَّةُ ‘আল্লাহ মুগীরাকে ধবংস করুন! দেবী ওকে শেষ করে দিয়েছে’। একথা শুনে মুগীরা লাফিয়ে উঠিয়ে দাঁড়ালেন এবং ছাক্বীফদের উদ্দেশ্যে বললেন,قَبَّحَكُمُ اللهُ يَا مَعْشَرَ ثَقِيفٍ إنَّمَا هِيَ لَكَاعُ حِجَارَةٍ وَمَدَرٍ فَاقْبَلُوا عَافِيَةَ اللهِ وَاعْبُدُوهُ ‘আল্লাহ তোমাদের মন্দ করুন হে ছাক্বীফগণ! এটা তো পাথর ও মাটির একটা মূর্তি ছাড়া কিছুই নয়। তোমরা আল্লাহর মার্জনা গ্রহণ কর এবং তাঁর ইবাদত কর’।

অতঃপর তিনি মূর্তিটি গুঁড়িয়ে দিলেন এবং ভিত সমেত মন্দির গৃহটি নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। সেখানে রক্ষিত মূল্যবান পোষাকাদি ও অলংকার সমূহ উঠিয়ে তিনি মদীনায় নিয়ে আসেন। রাসূল (ছাঃ) সেগুলিকে ঐদিনই বণ্টন করে দেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন।[5]

[শিক্ষণীয় : অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তাকে মেনে নিলেও মানুষ স্বভাবতঃ দৃশ্যমান কোন ছবি, মূর্তি, প্রতিকৃতি বা বস্ত্তর প্রতি শ্রদ্ধা ও পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করতে বেশী আগ্রহশীল। এর ফলে আল্লাহ গৌণ হয়ে যান এবং মূর্তি মুখ্য হয়। এটা স্পষ্ট শিরক। বর্তমান যুগে মুসলমানেরা কবরপূজা, ছবি ও প্রতিকৃতি পূজা, স্থান পূজা ও স্মৃতিসৌধ পূজার দিকে ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছে। অথচ এগুলি শুনতেও পায় না, দেখতেও পায় না, একেবারেই ক্ষমতাহীন। তবুও এর প্রতি কোন কোন মানুষের আবেগ এত বেশী যে, ভক্তরা এজন্য তাদের জান-মাল ব্যয় করতেও দ্বিধা করে না। আর এই অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করে শয়তান। যাতে মহা শক্তিধর আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের ঠিকানা হয় জাহান্নাম। অতএব শয়তানের ধোঁকা থেকে ঈমানদারগণ সাবধান!]

[1]. সীরাহ ছহীহাহ ২/৫১১; আহমাদ হা/১৪৭৪৩, সনদ শক্তিশালী, -আরনাঊত্ব; তিরমিযী হা/৩৯৪২, আলবানী বলেন, হাদীছটির সনদ মুসলিমের শর্তানুযায়ী। কিন্তু এটি আবুয্ যুবায়ের সূত্রে বর্ণিত যিনি ‘মুদাল্লিস’ -মিশকাত হা/৫৯৮৬-এর টীকা, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়-৩০, অনুচ্ছেদ-১। সেকারণ এটি যঈফ (আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ ৩৪ পৃঃ; ফিক্বহুস সীরাহ ৪৩২ পৃঃ)।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৫৪০; সনদ যঈফ, যঈফুল জামে‘ হা/৪৭১১; আহমাদ হা/১৭৯৪২। বর্ণনাটির সকল সূত্রই বিশুদ্ধ। কেবল ওছমান বিন আবুল ‘আছ থেকে হাসানের শ্রবণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে’ -আরনাঊত্ব।
[3]. আবুদাঊদ হা/৩০২৫, সনদ ছহীহ। উপরোক্ত বিষয়ের মধ্যে নও মুসলিমদের জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধতা প্রমাণিত হয়। এ কৌশল সকল যুগেই প্রযোজ্য। তবে অবশ্যই তাঁকে যোগ্য ও দূরদর্শী আলেম হ’তে হবে। যে কেউ যখন-তখন যেকোন স্থানে এ কৌশল গ্রহণ করতে পারবে না। মানছূরপুরী ‘দাওয়াতে ইসলাম’ নামক গ্রন্থের ৪৬২ পৃষ্ঠার বরাতে একটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ‘একবার রাশিয়ার জার (সম্রাট) ইসলাম কবুলের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যান। কেননা তিনি মূর্তিপূজার প্রতি বিতৃষ্ণ ছিলেন। তবে তিনি মদ্যপানের অভ্যাস ছাড়তে রাযী হননি। কিন্তু মুসলমান আলেম মহোদয় উক্ত শর্ত মানতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি মুসলমান না হয়ে খ্রিষ্টান হয়ে যান। যদি উক্ত আলেম রাসূল (ছাঃ)-এর অত্র হাদীছটি জানতেন, তাহ’লে আজ রাশিয়ার জারের বদৌলতে হয়ত পুরা রাশিয়াকেই আমরা মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে পেতাম’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৭৭ টীকা দ্রঃ)।
[4]. হাদীছে ابْنُ عَبْدِ يَالِيلَএসেছে। কিন্তু জীবনীকারগণ عَبْدُ يَالِيلَ বলেছেন (ফাৎহুল বারী হা/৩২৩১-এর আলোচনা দ্রঃ)।
[5]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫২১-২৪; আল-বিদায়াহ ৫/৩৩-৩৪; ইবনু হিশাম ২/৫৩৭-৪২; আর-রাহীক্ব ৪৪৮-৪৯ পৃঃ।
এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন তারা ত্বায়েফে পৌছে গেলেন, তখন মুগীরাহ বিন শো‘বাহ আবু সুফিয়ান বিন হারব-কে আগে বাড়তে বললেন। আবু সুফিয়ান তাতে অস্বীকার করে বললেন, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রবেশ কর। এ বলে তিনি তার মাল-সামানসহ যুল-হাদাম নামক স্থানে বসে গেলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৫৪১)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক, ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৯০৬)। ইবনুল ক্বাইয়িম এখানে এই সফরের আমীর হিসাবে খালেদ বিন অলীদের কথা বলেছেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৩; আর-রাহীক্ব ৪৪৯ পৃঃ)।

বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দল

নাজদ হ’তে আগত এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন আল্লাহর শত্রু ‘আমের বিন তোফায়েল, যার ইঙ্গিতে ও চক্রান্তে ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে বি’রে মা‘ঊনায় ৭০ জন ছাহাবীর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। আরও ছিলেন বিখ্যাত কবি হযরত লাবীদ বিন রাবী‘আহ (রাঃ)-এর বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আরবাদ বিন ক্বায়েস এবং খালেদ বিন জা‘ফর ও জাববার বিন আসলাম। এরা সবাই ছিলেন স্ব স্ব সম্প্রদায়ের নেতা এবং শয়তানের শিখন্ডী।

মুত্বার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আমি বনু ‘আমের প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হই, তখন আমরা তাঁকে বলিأَنْتَ سَيِّدُنَا وَأَفْضَلُنَا فَضْلاً وَأَعْظَمُنَا طَوْلاً ‘আপনি আমাদের নেতা। আপনি আমাদের চাইতে অনুগ্রহে মহান ও ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,السَّيِّدُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى ‘আল্লাহ হ’লেন নেতা। তিনি মহান ও সর্বোচ্চ। এ ব্যাপারে তোমরা শয়তানকে সাথী করোনা’ (আবুদাঊদ হা/৪৮০৬)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আল্লাহ নেতা’ অর্থ নেতৃত্বের উৎস হ’লেন আল্লাহ। আর সকল সৃষ্টি হ’ল তাঁর দাস (যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৭-টীকা)।

এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনায় আসার আগে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নেতা ‘আমের বিন তুফায়েলকে বলে, হে ‘আমের! লোকেরা সব ইসলাম কবুল করেছে। তুমিও ইসলাম কবুল কর। জবাবে ‘আমের বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি শপথ করেছি যে, আমি কখনই বিরত হব না, যতক্ষণ না পুরা আরব আমার পিছনে না আসবে। আমি কি কুরায়েশের এই যুবকের অনুসারী হ’তে পারি? অতঃপর সে আরবাদকে বলল, যখন আমরা এই লোকটির কাছে যাব, তখন আমি লোকটিকে তোমার থেকে ফিরিয়ে রাখব। আর তখন তুমি তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করবে’।

অতঃপর যখন তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে পৌছল, তখন ‘আমের বিন তোফায়েল বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার সাথে আপনি একাকী নিরিবিলি কথা বলুন’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! সেটা কখনই নয়। যতক্ষণ না তুমি এক আল্লাহর উপরে ঈমান আনবে’। তখন সে কথা বলতে শুরু করে এবং অপেক্ষায় থাকে আরবাদ কি করে। কিন্তু যখন সে দেখল যে, আরবাদ কিছুই করতে পারল না, তখন সে পুনরায় আগের মত বলল। জবাবে রাসূল (ছাঃ)ও আগের মত বললেন। এভাবে মোট তিনবার একাকী হওয়ার আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়ে সে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় সে হুমকি দিয়ে বলে, ‘আল্লাহর কসম! আমি আপনার বিরুদ্ধে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে মদীনা ভরে ফেলব’। তখন রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেন, ‘হে আল্লাহ! ‘আমের বিন তুফায়েল থেকে তুমি আমার জন্য যথেষ্ট হও’।

বেরিয়ে আসার পর ‘আমের আরবাদকে বলল, তোমার ধ্বংস হৌক! তোমাকে যে কাজের নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা করলে না কেন? জবাবে আরবাদ বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে দেখতে পাইনি। তাহ’লে আমি কি আপনাকে হত্যা করব?।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আরবাদ বলল, ‘আমি বারবার তরবারি বের করতে চেষ্টা করেও পারিনি। কারণ তা বাঁটের সাথে আটকে যাচ্ছিল’।[2]

ছহীহ বুখারীতে এসেছে যে, ‘আমের বিন তোফায়েল আল্লাহর রাসূলকে তিনটি বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল। (১) আপনার পরে আমি আপনার স্থলাভিষিক্ত (খলীফা) হব। (২) আপনার জন্য থাকবে উপত্যকার লোকজন এবং আমার জন্য থাকবে লোকালয়ের জনপদ। (৩) না মানলে আমি আপনার বিরুদ্ধে দু’হাযার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গাত্বফানে যুদ্ধ করব’ (বুখারী হা/৪০৯১)।

সমস্ত আরব নেতৃবর্গ ও রোম সম্রাট যে রাসূল ও তাঁর ইসলামী বাহিনীর নামে ভয়ে কম্পমান, সেখানে তাঁর সামনে এসে খোদ রাজধানী মদীনায় বসে এ ধরনের হুমকি দিয়ে কথা বলা ও তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যে হাস্যকর বোকামী ও অদূরদর্শিতার পরাকাষ্ঠা যাই-ই থাক না কেন, আরবরা যে প্রকৃত অর্থেই নির্ভীক ও দুর্দান্ত সাহসী তার বাস্তব প্রমাণ মেলে।

অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে বেরিয়ে চলে যায় এবং পথিমধ্যে বজ্রপাতে আরবাদ নিহত হয়। ‘আমের বিন তোফায়েল এক সালূলিয়া মহিলার বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তার ঘাড়ে হঠাৎ এক ফোঁড়া ওঠে এবং তাতেই সে ঐ রাতে মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুকালে সে আরেক আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের মত অহংকার দেখিয়ে বলে ওঠে,غُدَّةٌ كَغُدَّةِ الْبَعِيرِ فِى بَيْتِ امْرَأَةٍ مِنْ بَنِى فُلاَنٍ ‘উটের ফোঁড়ার ন্যায় ফোঁড়া? তা আবার অমুক বংশের মহিলার ঘরে’? এটাকে সে তার বীরত্বের জন্য অপমানজনক ভেবে তখনই তার ঘোড়া আনতে বলে। অতঃপর সে তার পিঠে উঠে বসে ও সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে’ (আহমাদ হা/১৩২১৮, সনদ ছহীহ)। এভাবেই তাদের দু’জনের উপরে রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ হাতে-নাতে কার্যকর হয়।

[শিক্ষণীয়: হতভাগা হয়ে যারা জন্মগ্রহণ করে, উপদেশ, উদারতা, ভয়-ভীতি কোন কিছুই তাদের সুপথে আনতে পারে না। ধ্বংসই তাদের একমাত্র পরিণতি হয়।]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৫৬৮; যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৭-২৮। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৯৪৩-৪৪)।
[2]. আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ; ইবনু সা‘দ ১/২৩৬; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১০৯১, সনদ যঈফ।

আব্দুল ক্বায়েস প্রতিনিধি দল

বাহরায়েন ও ক্বাতীফ এলাকায় বসবাসকারী বিখ্যাত রাবী‘আহ বিন নিযার(رَبِيعَةَ بْنِ نِزَارِ) গোত্রের নেতা ছিলেন আব্দুল ক্বায়েস। এই গোত্রের পরবর্তী নেতা মুনক্বিয বিন হাইয়ান(مُنقِذُ بن حَيَّان) ৫ম হিজরী বা তার আগে-পরে এক সময় ব্যবসা উপলক্ষ্যে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার গোত্রের প্রতি ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিয়ে তার মাধ্যমে একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাঠ অন্তে তারা ইসলাম কবুল করে নিজ গোত্রের ১৩/১৪ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির একটি দল নিয়ে আল-আশাজ্জ আল-‘আছরীর(الأَشَجُّ العَصْرِيُّ) নেতৃত্বে মদীনায় আসেন। মদীনা এবং আব্দুল ক্বায়েস গোত্রের মাঝখানে শত্রুভাবাপন্ন ‘মুযার’ (مُضَر) গোত্র থাকায় তারা ‘হারাম’ মাসে মদীনায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দেন ও চারটি বিষয়ে নিষেধ করেন, যার বিবরণ ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে রয়েছে (মিশকাত হা/১৭)। এই সময় রাসূল (ছাঃ) তাদের দলনেতাকে বলেছিলেন,إِنَّ فِيْكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالْأَنَاةُ ‘তোমার মধ্যে দু’টি স্বভাব রয়েছে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন, ধৈর্য ও দূরদর্শিতা’।

কোন কোন বিদ্বানের মতে উক্ত গোত্রের ৪০ জনের দ্বিতীয় দলটি আগমন করে ৯ম হিজরীতে। যাদের মধ্যে জারূদ বিন মু‘আল্লা আল-‘আবদী (جارُودُ بنُ بِشْرِ بْنِ الْمُعَلَّى الْعَبْدِىُّ) নামক জনৈক খ্রিষ্টান ছিলেন। যিনি ইসলাম কবুল করেন এবং তাঁর ইসলাম অত্যন্ত সুন্দর থাকে’।[1]

[শিক্ষণীয়: (১) জাহেলী আরবরা হারাম-এর চারটি মাসকে সম্মান করত। এ ঘটনায় তার প্রমাণ রয়েছে। (২) স্রেফ দাওয়াতের মাধ্যমেই এই বিখ্যাত গোত্রটি ইসলাম কবুল করে]

[1]. মির‘আত শরহ মিশকাত হা/১৭-এর ব্যাখ্যা; আর-রাহীক্ব ৪৪৫ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭; বুখারী হা/৮৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৯-৩০; ইবনু হিশাম ২/৫৭৫।

বনু হানীফাহ প্রতিনিধি দল

ইয়ামামাহর হানীফাহ গোত্রের ১৭ সদস্যের অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন (ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭১-এর পরের অনুচ্ছেদ)। তাদের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী(ثُمَامَةُ بْنُ آثَالٍ الْحَنَفِيُّ) ‘যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার কুমতলবে ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে মদীনায় যাওয়ার পথে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে পাকড়াও হয়ে মদীনায় নীত হন। তিনদিন বন্দী থাকার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে মুক্তি দিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করেন। প্রধানতঃ তাঁরই দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। উক্ত প্রতিনিধি দলে ইয়ামামার নেতা মুসায়লামা ছিলেন। তিনি শর্ত দিলেনإنْ جَعَلَ لِيْ مُحَمَّدٌ الْأَمْرَ مِنْ بَعْدِهِ تَبِعْتُهُ ‘যদি মুহাম্মাদ তাঁর পরে আমাকে তাঁর শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাহ’লে আমি তাঁর অনুসারী হব’ (অর্থাৎ বায়‘আত করব)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হাতে রাখা খেজুরের শুকনো ডালটির দিকে ইশারা করে বললেন,لَوْ سَأَلْتَنِيْ هَذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكهَا ‘যদি তুমি এই শুকনা ডালের টুকরাটিও চাও, তাহ’লেও আমি তোমাকে এটা দিব না’। অর্থাৎ নেতৃত্বের শর্তে বায়‘আত নেব না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি বায়‘আত না নিয়ে ফিরে যাও, তবে আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে দিবেন। কারণ তোমার পরিণতি আমাকে দেখানো হয়েছে’ (বুখারী হা/৩৬২০)। রাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি উক্ত বিষয়ে পরে আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমাকে পৃথিবীর ধনভান্ডার দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমার দুই হস্ততালুতে দু’টি সোনার বালা এসেছে। এতে আমি খুব ভারি বোধ করি। তখন স্বপ্নেই আমাকে বলা হয় যে, ওটা ফুঁক দিয়ে উড়িয়ে দাও। ফলে আমি ফুঁক দিতেই বালা দু’টি উড়ে গেল। আমি এর ব্যাখ্যা করছি এভাবে যে, এরা হ’ল ঐ দু’জন ভন্ডনবী, যারা আমার পরে বের হবে। তাদের একজন হ’ল ছান‘আর আসওয়াদ ‘আনাসী। অপরজন হ’ল ইয়ামামার মুসায়লামা কাযযাব’।[1] উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) ত্রিশ জন ভন্ডনবী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২; হাকেম হা/৮৩৯০)।

অতঃপর মুসায়লামা ফিরে গিয়ে মুরতাদ হন ও নিজেই নবুঅত দাবী করেন। তিনি তার অনুসারীদের জন্য ছালাত নিষিদ্ধ করেন এবং মদ্যপান ও ব্যভিচার হালাল করে দেন। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কেও নবী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। যাতে তার এলাকার মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে না চলে যায়। অতঃপর ১০ম হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত পত্র লেখেন।-

مِنْ مُسَيْلِمَةَ رَسُولِ اللهِ، إلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ، سَلاَمٌ عَلَيْكَ، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّي قَدْ أُشْرِكْتُ فِي الْأَمْرِ مَعَكَ، وَإِنَّ لَنَا نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلِقُرَيْشٍ نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلَكِنَّ قُرَيْشًا قَوْمٌ يَعْتَدُونَ-

‘আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ হ’তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমাকে আপনার সাথে রাজত্বে শরীক করা হয়েছে। জনপদের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক কুরায়েশদের জন্য। কিন্তু কুরায়েশরা এমন কওম, যারা সীমালংঘন করে’ (ইবনু হিশাম ২/৬০০)। বালাযুরীর বর্ণনায় এসেছে,ولكن قريشًا لا يُنْصِفُونَ والسَّلامُ عليكَ ‘কিন্তু কুরায়েশরা ন্যায় বিচার করে না। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ফুতূহুল বুলদান ৯৭ পৃঃ)। উক্ত পত্রের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লেখেন,

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى مُسَيْلَمَةَ الْكَذَّابِ، السَّلاَمُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى- أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ الْأَرْضَ ِللهِ يُوْرِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتّقِينَ-

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে মিথ্যুক মুসায়লামার প্রতি। যে ব্যক্তি হেদায়াতের অনুসারী হয়, তার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর জেনে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর হাতে। তিনি স্বীয় বান্দাগণের মধ্য হ’তে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য’।[2] লেখক ছিলেন উবাই ইবনু কা‘ব (ফুতূহুল বুলদান ৯৮ পৃঃ)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত পত্র হাবীব বিন যায়েদ বিন ‘আছেম ও আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব আসলামী (রাঃ) বহন করে নিয়ে যান। কিন্তু প্রচলিত রীতি-নীতি উপেক্ষা করে মুসায়লামা কাযযাব হাবীব বিন যায়েদ-এর দু’হাত ও দু’পা কেটে দেয়। হাবীব-এর মা ছিলেন বায়‘আতে কুবরায় অংশগ্রহণকারিণী দুইজন ভাগ্যবতী মহিলার অন্যতম বীরমাতা উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব (রাঃ)। যিনি ওহোদ যুদ্ধে যোগ দেন এবং হোদায়বিয়াতে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে যোগ দিয়ে তীর ও তরবারির ১২টি আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং একটি হাত হারান।[3]

অথচ ইতিপূর্বে মুসায়লামার পত্র নিয়ে যে দু’জন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসেছিল, তারা তাঁর সামনে চূড়ান্ত বেআদবী করা সত্ত্বেও তিনি তাদের কোনরূপ শাস্তি দেননি। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুসায়লামার দূতদ্বয় রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দিবে? তারা বলল,نَشْهَدُ أَنَّ مُسَيْلِمَةَ رَسُولُ اللهِ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,آمَنْتُ بِاللهِ وَرُسُلِهِ ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর ঈমান রাখি’। অতঃপর বললেন,لَوْ كُنْتُ قَاتِلاً رَسُولاً لَقَتَلْتُكُمَا ‘যদি আমি কোন দূতকে হত্যা করতাম, তাহ’লে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম’।[4]

দুই ভন্ডনবীর অবস্থা

আল্লাহপাক ভন্ডনবী মুসায়লামাকে দুনিয়াতেই এর শাস্তি দেন এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে হযরত খালেদ বিন অলীদকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয় এবং হযরত হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারব, যিনি তখন উত্তম মুসলমান ছিলেন, তার হাতেই এই ভন্ডনবী নিহত হয়। ওয়াহ্শী তাই প্রায়ই বলতেন, কাফের অবস্থায় আমি একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমানকে হত্যা করেছিলাম। মুসলমান হওয়ার পরে আমি একজন নিকৃষ্টতম কাফেরকে হত্যা করেছি (ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩)।

অতঃপর দ্বিতীয় ভন্ডনবী ইয়ামনের আসওয়াদ ‘আনাসী, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের মাত্র একদিন ও একরাত পূর্বে ফীরোয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। সে খবর সাথে সাথে অহী মারফত রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হয় এবং তিনি বিষয়টি ছাহাবীদের জানিয়ে দেন’।[5]

[শিক্ষণীয়: (১) দূতকে অসম্মান করা যায় না বা হত্যা করা যায় না। (২) নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। (৩) উপরে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীতে আবুবকর (রাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। কেননা তাঁর আমলেই রিদ্দার যুদ্ধে মুসায়লামা কাযযাব নিহত হয়। (৪) ইসলামী দাওয়াতের লক্ষ্য হ’ল আখেরাত লাভ, দুনিয়া উপার্জন নয়। কিন্তু ভন্ডরা চিরকাল দুনিয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৫-৩৬; বুখারী হা/৪৩৭৫, ৩৬২১; মুসলিম হা/২২৭৩-৭৪; মিশকাত হা/৪৬১৯।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৬০১; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৪।
[3]. আবুল হাসান আল-বালাযুরী (মৃ. ২৭৯ হি.), ফুতূহুল বুলদান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ ১৪০৩/১৯৮৩) ১০২ পৃঃ ‘ইয়ামামাহ’ অধ্যায়; আল-ইছাবাহ উম্মে ‘উমারাহ ক্রমিক ১২১৭৮।
[4]. আহমাদ হা/৩৭৬১; দারেমী হা/২৫০৩; মিশকাত হা/৩৯৮৪, হাদীছ ছহীহ সনদ যঈফ -আরনাঊত্ব; ইবনু হিশাম ২/৬০০। দারেমীর বর্ণনায় এসেছে, وَفْدًا আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে, أَمَا وَاللهِ لَوْلاَ أَنَّ الرُّسُلَ لاَ تُقْتَلُ لَضَرَبْتُ أَعْنَاقَكُمَا ‘আল্লাহর কসম! যদি দূতদের হত্যা করা বিধি বহির্ভূত না হ’ত, তাহ’লে অবশ্যই আমি তোমাদের দু’জনের গর্দান উড়িয়ে দিতাম’ (আবুদাঊদ হা/২৭৬১)।
[5]. বুখারী হা/৪৩৭৯; ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭৮-এর আলোচনা; আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ।

ত্বাঈ প্রতিনিধি দল

আরবের এই প্রসিদ্ধ গোত্রটির প্রতিনিধি দল তাদের বিখ্যাত অশ্বারোহী বীর যায়েদ আল-খাইলের[1](زَيْدُ الْخَيْلِ) নেতৃত্বে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়। অতঃপর প্রয়োজনীয় কথোপকথন শেষে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। তাদের ইসলাম খুবই সুন্দর থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দলনেতা যায়েদ-এর প্রশংসা করে বলেন, আমার সম্মুখে আরবের যে সব ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছে, সামনে আসার পর তাদের আমি তার চেয়ে কম পেয়েছি, কেবল যায়েদ ব্যতীত। কেননা তার খ্যাতি তার সকল গুণের নিকটে পৌঁছতে পারেনি’। অতঃপর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে যায়েদ আল-খায়ের(زَيْدُ الْخَيْرِ) অর্থাৎ ‘যায়েদ অশ্বারোহী’র বদলে ‘যায়েদ কল্যাণকারী’ রাখেন।[2]

উল্লেখ্য যে, ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে ‘ত্বাঈ’ গোত্রের খ্যাতনামা দানবীর হাতেম ত্বাঈ-এর পুত্র বিখ্যাত খ্রিষ্টান পন্ডিত ও পুরোহিত ‘আদী বিন হাতেম স্বীয় বোন সাফফানাহর (سَفَّانَة) দাওয়াতে সাড়া দিয়ে শাম থেকে মদীনায় এসে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মর্যাদা প্রদর্শন করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। অতঃপর কুশল বিনিময়ের পর আলোচনা শুরু করেন। যথারীতি হাম্দ ও ছানার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন বস্ত্ত তোমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে? তুমি কি মনে কর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য আছেন? ‘আদী বললেন, না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর বললেন, আল্লাহ যে সর্বোচ্চ (আল্লাহু আকবর) একথা বলা থেকে তুমি পালিয়ে যাচ্ছ। তুমি মনে কর যে, আল্লাহর চাইতে অন্য কিছু বড় আছে। ‘আদী বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّ الْيَهُودَ مَغْضُوبٌ عَلَيْهِمْ وَإِنَّ النَّصَارَى ضُلاَّلٌ ‘মনে রেখ ইয়াহূদ হ’ল অভিশপ্ত এবং নাছারা হ’ল পথভ্রষ্ট’। তখন ‘আদী বললেন, فَإِنِّى جِئْتُ مُسْلِمًا ‘আমি একজন মুসলিম হিসাবে এসেছি’। এ জওয়াব শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো’ (তিরমিযী)।

অতঃপর তিনি তাকে এক আনছার ছাহাবীর বাড়িতে মেহমান হিসাবে রেখে দেন এবং সেখান থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে নিয়মিত দু’বেলা যাতায়াত করতে থাকেন। এভাবে দৈনিক যাতায়াতে তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা হয়। বিভিন্ন হাদীছে যার বর্ণনা এসেছে। যেমন- (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন,أَلَسْتَ مِنَ الرَّكُوسِيَّةِ وَأَنْتَ تَأْكُلُ مِرْبَاعَ قَوْمِكَ ‘হে ‘আদী! তুমি কি পুরোহিত ছিলে না? তুমি কি তোমার কওমের কাছ থেকে (বায়তুল মালের) সিকি গ্রহণের নিয়ম চালু করোনি? ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّ هَذَا لاَ يَحِلُّ لَكَ فِى دِينِكَ ‘অথচ এটি তোমার দ্বীনে হালাল নয়’ (আহমাদ)।[3] ‘আদী বললেন,قُلْتُ: أَجَلْ وَاللهِ ‘আল্লাহর কসম! এটা ঠিক কথা’। وَقَالَ: وَعَرَفْتُ أَنَّهُ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، يَعْلَمُ مَا يُجْهَلُ ‘আদী বলেন, আমি তখুনি বুঝে নিয়েছিলাম যে, ইনি আল্লাহর প্রেরিত নবী। যিনি সেসব কথা জানেন, যা অন্যেরা জানে না’ (ইবনু হিশাম)।[4]

[শিক্ষণীয়: ধর্মনেতারা দুনিয়াবী স্বার্থে অনেক সময় এলাহী বিধানের বিকৃতি সাধন করে থাকেন, এটা তার অন্যতম প্রমাণ।]

(২) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আদী বিন হাতেম বলেন,

أَتَيْتُ رسولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي عُنُقِي صُلَيبٌ من ذَهَبٍ، فقال: يا عَدِيُّ، اِطْرَحْ هذا الوَثَنَ مِنْ عُنُقِكَ ! قال: فَطَرَحْتُهُ، وَانْتَهَيْتُ إِلَيْهِ وهُوَ يَقْرَأُ في "سُورةِ بَراءةٍ"، فَقَرأَ هَذهِ الآيةَ : (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ)، قال قلتُ : يا رسولَ الله، إِنَّا لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ! فقال: أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ قال: قُلتُ: بَلَى! قال: فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ- رواه ابن جرير-

‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ (বা রৌপ্যের) ক্রুশ ঝুলানো ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর ৩১ আয়াতটি পাঠ করছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে,اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘ইহূদী-নাছারাগণ আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’। তখন আমি বললাম,لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা ওদের ইবাদত করি না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ ‘তোমরা কি ঐসব বস্ত্তকে হারাম করো না, যা আল্লাহ হালাল করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হারাম করে? তোমরা কি ঐসব বস্তকে হালাল করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হালাল করে? ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[5]

উক্ত হাদীছের ও কুরআনী আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন, لَمْ يَأْمُرُوهُمْ أَنْ يَسْجُدُوا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبَابًا ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার আদেশ দেননি। বরং তারা তাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে নির্দেশ দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[6]

(৩) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আদী বিন হাতেম বলেন, একদিন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে তার অভাব-অনটনের কথা পেশ করল। আরেকজন এসে রাহযানির(قَطْعُ السَّبِيلِ) কথা বলল। (তাদের সমস্যাবলী সমাধান শেষে) রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে ‘আদী! তুমি কি (ইরাকের সমৃদ্ধ নগরী) হীরা চেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন,

فَإِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتَرَيَنَّ الظَّعِيْنَةَ تَرْتَحِلُ مِنَ الْحِيْرَةِ، حَتَّى تَطُوْفَ بِالْكَعْبَةِ، لاَ تَخَافُ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ، وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتُفْتَحَنَّ كُنُوْزُ كِسْرَى. وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ، لَتَرَيَنَّ الرَّجُلَ يُخْرِجُ مِلْءَ كَفِّهِ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ فِضَّةٍ، يَطْلُبُ مَنْ يَقْبَلُهُ مِنْهُ، فَلاَ يَجِدُ أَحَدًا يَقْبَلُهُ مِنْهُ-

(ক) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তুমি দেখবে একজন হাওদানশীন মহিলা একাকী ‘হীরা’ থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করবে। অথচ রাস্তায় সে কাউকে ভয় করবে না আল্লাহ ব্যতীত (খ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তোমরা কিসরার ধনভান্ডার জয় করবে। (গ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, একজন ব্যক্তি হাত ভরে সোনা-রূপা নিয়ে ঘুরবে, অথচ তা নেবার মত কাউকে সে খুঁজে পাবে না’।

উক্ত হাদীছ বর্ণনা করার পর হযরত ‘আদী বিন হাতেম (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আমি পর্দানশীন মহিলাদের একাকী হীরা থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দেখেছি। পারস্য সম্রাট কিসরা বিন হুরমুযের ধন-ভান্ডার জয়ের অভিযানে আমি নিজেই শরীক ছিলাম। এখন কেবল তৃতীয়টি বাকী রয়েছে।وَلَئِنْ طَالَتْ بِكُمْ حَيَاةٌ لَتَرَوُنَّ مَا قَالَ النَّبِىُّ أَبُو الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তোমরা অবশ্যই তৃতীয়টি দেখতে পাবে। যা বলে গেছেন আবুল ক্বাসেম মুহাম্মাদ (ছাঃ)’। অর্থাৎ হাত ভরে স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে ঘুরেও তা নেবার মত কোন দরিদ্র লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।[7]

[শিক্ষণীয়: যোগ্য শিষ্য পেলেই কেবল যোগ্য উত্তর সমূহ পাওয়া সম্ভব]

[1]. ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, যায়েদ ছিলেন কবি, বাগ্মী ও বীর যোদ্ধা। তার দুই পুত্র মুকনিফ ও হুরাইছ (مُكْنِفُ وَحُرَيْثٌ) পিতার ন্যায় রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবী ছিলেন। তারা আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে খালেদ বিন অলীদ-এর নেতৃত্বে রিদ্দার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৯)।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৮-৩৯; ইবনু হিশাম ২/৫৭৭; আর-রাহীক্ব ৪৫৩; সনদ যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৮০ পৃঃ)।
[3]. আহমাদ হা/১৮২৮৬, হাদীছের কিছু অংশ ছহীহ, সনদ হাসান -আরনাঊত্ব।
[4]. তিরমিযী হা/২৯৫৪ সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৫৮০-৮১; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫২-৫৩।
[5]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৬৬৩২; তিরমিযী, হা/৩০৯৫; ছহীহাহ হা/৩২৯৩; সনদ হাসান।
[6]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত : ১৯৮৬) ১০/৮০-৮১; হা/১৬৬৪১। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পতনদশায় উক্ত হাদীছটি অতীব গুরুত্ববহ। এর মধ্যে হেদায়াতের আকাংখীদের জন্য রয়েছে সঠিক পথের দিশা।
[7]. বুখারী হা/৩৫৯৫, আহমাদ হা/১৮২৮৬; মিশকাত হা/৫৮৫৭। বস্ত্ততঃ ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালেই মুসলমানদের মধ্যে উক্তরূপ সচ্ছলতা ফিরে আসে। ‘আদী বিন হাতেম হিজরত-পূর্ব ৫১-৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯ম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেন। তিনি ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন। অতঃপর ৬৭-৬৮ হিজরীর মধ্যবর্তী সময়ে ১২০ বছর বয়সে কূফায় মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ, ‘আদী বিন হাতেম ক্রমিক ৫৪৭৯)।

কিন্দা প্রতিনিধি দল

কিন্দার নেতা আশ‘আছ বিন ক্বায়েস ৬০ অথবা ৮০ জনের একটি দল নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। অতঃপর তারা মসজিদে প্রবেশ করেন। এমতাবস্থায় তাদের পোষাকে রেশমের ঝালর ছিল। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, তোমরা কি ইসলাম কবুল করোনি? তারা বলল, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে তোমাদের পোষাকে রেশমী ঝালর কেন? এগুলি ছিঁড়ে ফেল। অতঃপর তারা এগুলি ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করল। আশ‘আছ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ‘জঙ্গলের মিরার বৃক্ষ ভক্ষণকারী’ হারেছ বিন ‘আমর বিন কিন্দার বংশধর। আর আপনি ‘মিরার বৃক্ষ ভক্ষণকারীদের’ সন্তান’(نَحْنُ بَنُو آكِلِ الْمِرَارِ وَأَنْتَ ابْنُ آكِلِ الْمِرَارِ)। একথা শুনে রাসূল (ছাঃ) হেসে ফেললেন’... (ইবনু হিশাম ২/৫৮৫)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আশ‘আছ বলেন, কওমের লোকেরা আমাকে তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে মনে করে। ফলে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!أَلَسْتُمْ مِنَّا؟ قَالَ لاَ، نَحْنُ بَنُو النَّضْرِ بْنِ كِنَانَةَ لاَ نَقْفُو أُمَّنَا وَلاَ نَنْتَفِي مِنْ أَبِينَا ‘আপনি কি আমাদের বংশধর নন? তিনি বললেন, না। আমরা নযর বিন কিনানাহর বংশধর। আমরা আমাদের মায়ের উপর তোহমত দেই না এবং পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হই না’। রাবী বলেন, একথা শোনার পর থেকে আশ‘আছ বলতেন, যে ব্যক্তি কুরায়েশ বংশের কোন লোককে নযর বিন কিনানাহর বংশধর নয় বলবে, আমি তাকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি হিসাবে বেত্রাঘাত করব’।[1]

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম দাদী উম্মে কিলাব বিন মুর্রাহ(أُمُّ كِلاَبِ بْنِ مُرَّةَ) এই বংশের মহিলা ছিলেন। সেকারণ আশ‘আছ তাঁকে নিজেদের বংশের সন্তান বলে দাবী করেছিলেন। অথচ মায়ের দিক দিয়ে বংশ সাব্যস্ত হয় না। তাছাড়া এই বংশের লোকেরা ‘সম্রাট বংশ’(أَنَّ كِنْدَةَ كَانُوا مُلُوكًا) ছিল (ইবনু হিশাম ২/৫৮৫)।

[শিক্ষণীয়: (১) কওমের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আপনা থেকেই নেতা হন। (২) নযর বিন কিনানাহর বংশধরই মাত্র কুরায়েশ বংশ হিসাবে গণ্য। (৩) মায়ের দিক থেকে বংশধারা সাব্যস্ত হয় না। সেকারণ কিন্দাগণ কুরায়েশ বংশের বলে রাসূল (ছাঃ) স্বীকৃতি দেননি। যদিও তাঁর একজন দাদী এই বংশের মহিলা ছিলেন। (৪) ইসলাম কবুলের পর মুসলিম পুরুষের জন্য সর্বাবস্থায় রেশমের পোষাক নিষিদ্ধ। (৫) হারাম মাল বিনষ্ট করা সিদ্ধ। যেমন এদের রেশমী পোষাক ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করতে বলা হ’ল।]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৯-৪০; ইবনু হিশাম ২/৫৮৫, হাদীছ ‘হাসান’ সনদ ‘মুরসাল’; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৯৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৬১২; ছহীহাহ হা/২৩৭৫।

ইয়ামনবাসী আশ‘আরী প্রতিনিধি দল

ইয়ামনের প্রসিদ্ধ আশ‘আরী গোত্র মুসলমান হয়েই মদীনায় আসে। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقْدَمُ عَلَيْكُمْ غَداً أَقْوَامٌ هُمْ أَرَقُّ قُلُوباً لِلإِسْلاَمِ مِنْكُمْ ‘তোমাদের নিকট একদল লোক আসবে, যারা ইসলামের ব্যাপারে তোমাদের চাইতে নম্র হৃদয়’। অতঃপর আশ‘আরী প্রতিনিধি দল এল। যাদের মধ্যে আবু মূসা আশ‘আরীও ছিলেন। তারা মদীনায় প্রবেশ করার সময় খুশীতে কবিতা পাঠ করতে থাকেন,غَدًا نَلْقَى الْأَحِبَّةَ * مُحَمَّدًا وَحِزْبَهُ ‘কালকে আমরা বন্ধুদের সাথে মিলিত হব। মুহাম্মাদ ও তাঁর দলের সাথে’। অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন এবং পরস্পর মুছাফাহা করলেন। তাদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম মুছাফাহার রীতি চালু হয়’।[1] আবু মূসা আশ‘আরী তাদের বহু পূর্বেই ৭ম হিজরীতে মুসলমান হয়েছিলেন এবং খায়বরে গিয়ে প্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন’ (আল-ইছাবাহ, আবু মূসা আশ‘আরী ক্রমিক ৪৯০১)। তিনি অত্র প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পুনরায় আসাটা অসম্ভব নয়।

وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللهِ أَفْوَاجًا ‘এবং তুমি মানুষকে দেখছ তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (ইসলামে) প্রবেশ করছে’ (সূরা নছর ১১০/২)-এর ব্যাখ্যায় ইকরিমা ও মুক্বাতিল বলেন, এর মধ্যে ইয়ামনী প্রতিনিধিদলের দিকে (বিশেষভাবে) ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা এদের প্রায় ৭০০ লোক মুসলমান হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন পাঠ করতে করতে, কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হন। কিন্তু ওমর ও আববাস (রাঃ) কাঁদতে থাকেন।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেন,أَتَاكُمْ أَهْلُ الْيَمَنِ، أَضْعَفُ قُلُوْبًا وَأَرَقُّ أَفْئِدَةً، الْفِقْهُ يَمَانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ ‘তোমাদের নিকট ইয়ামনবাসীরা এসে গেছে। এদের অন্তর বড়ই দুর্বল, হৃদয় খুবই নরম। বুঝশক্তি ইয়ামনীদের এবং প্রজ্ঞা ইয়ামনীদের’।[3] রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) ৭ম হিজরীতে মুসলমান হয়ে সর্বপ্রথম খায়বরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন (আল-ইছাবাহ, আবু হুরায়রা ক্রমিক ১০৬৭৪)।

উল্লেখ্য যে, খ্যাতনামা ছাহাবী আবু মূসা আশ‘আরী ছিলেন এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ৭ম হিজরী সনে ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে মদীনায় আগমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তাদের নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে তাদেরকে নাজাশীর হাবশায় নামিয়ে দেয়। সেখানে তাঁদের সঙ্গে হযরত জা‘ফর ইবনে আবু তালেবের সাক্ষাৎ হয়। ফলে জাফরের সঙ্গে তাঁরা মদীনায় আসেন। অতঃপর সেখান থেকে খায়বরে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৯০১)। ঐ সময় খায়বর বিজয় সবেমাত্র শেষ হয়েছিল এবং রাসূল (ছাঃ) তখনও সেখানে অবস্থান করছিলেন।

হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতকালে প্রতিনিধিদলের দু’জন সদস্য, যারা আমার চাচাতো ভাই ছিল, তাদের একজন বলল, আল্লাহ আপনাকে বিরাট এলাকার শাসন ক্ষমতা দান করেছেন। আমাকেও আপনি একটি এলাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করুন। অপর ভাইটিও অনুরূপ দাবী করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন,إِنَّا وَاللهِ لاَ نُوَلِّى عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ وَلاَ أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ، وفى رواية : ومَنْ أَرَادَهُ ‘আমরা আল্লাহর কসম, এমন কাউকে আমাদের শাসনকার্যে নিযুক্ত করি না, যে ব্যক্তি তা চেয়ে নেয় বা তার লোভ করে বা তার আকাংখা করে’।[4] আলোচ্য প্রতিনিধি দলটি সম্ভবতঃ ৯ম হিজরীতে আগমন করে। যারা পূর্বের প্রতিনিধি দলের দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেছিলেন।

[শিক্ষণীয়: (১) দ্বীনী ভালোবাসাই হ’ল প্রকৃত ভালোবাসা। যা মানুষকে পরস্পরে নিকটতম বন্ধুতে পরিণত করে। (২) সালামের সাথে পরস্পরে মুছাফাহা করতে হবে। (৩) খুশীতে সুন্দর কবিতা এবং উত্তম দো‘আ পাঠ করা যাবে। (৪) ইসলামে নেতৃত্ব বা কোন পদ চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ]

[1]. আহমাদ হা/১২৬০৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৬৭; ছহীহাহ হা/৫২৭; মিরক্বাত হা/৪৬৭৭-এর ব্যাখ্যা; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪১।
[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর। তিনি ‘ইবনু আববাস’ এবং তানতাভী ‘আববাস’ বলেছেন। সম্ভবত আববাসই সঠিক। কেননা তখন ইবনু আববাসের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছরের মত (জন্ম : হিঃ পূঃ ৩, মৃঃ ৬৮ হিঃ; আল-ইছাবাহ, ইবনু আববাস ক্রমিক ৪৭৮৪)।
[3]. বুখারী হা/৪৩৯০, মুসলিম হা/৫২; মিশকাত হা/৬২৫৮; কুরতুবী হা/৬৫০৩।
[4]. বুখারী হা/৭১৪৯; মুসলিম হা/১৭৩৩; মিশকাত হা/৩৬৮৩ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায়।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url