প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫৭] || মহানবীর জীবনী ||




ইসলামের তাওহীদী চেতনার ফলাফল ও প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর বিদায়ী হজ্জ

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

ইসলামের তাওহীদী চেতনার ফলাফল

মক্কায় প্রথম ‘অহি’ আগমনের পরপরই নির্দেশ এসেছিল,يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ- قُمْ فَأَنْذِرْ ‘হে চাদরাবৃত! ওঠো, ভয় দেখাও’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১-২)। তারপর নির্দেশ এল,يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ اللَّيْلَ ‘হে চাদরাবৃত! ওঠো রাত্রিতে আল্লাহর স্মরণে দাঁড়িয়ে যাও’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১-২)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর শেষনবী ও তাঁর সাথীদেরকে নৈতিক বলে অধিকতর বলিয়ান করে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ সূচী প্রদান করেন। অতঃপর তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন,إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلاً ثَقِيْلاً ‘আমরা সত্বর তোমার উপরে কিছু ভারী কথা নিক্ষেপ করব’ (ঐ, ৭৩/৫)। আর সেই ‘ভারী কথা’-ই ছিল ভবিষ্যৎ ইসলামী সমাজ বিনির্মানের গুরু দায়িত্ব। যার ভিত্তি ছিল আল্লাহ প্রেরিত অহি-র উপরে।

ব্যক্তির নৈতিক ভিত্তি মযবুত না হ’লে তার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা ও তাকে শয়তানের আনুগত্য হ’তে বের করে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরিয়ে আনা যে কতবড় কঠিন কাজ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। কিন্তু নবীগণকে তো যুগে যুগে আল্লাহ এজন্যই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। অন্যান্য নবীগণ স্ব স্ব গোত্র ও অঞ্চলের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন পুরা মানব জাতির জন্য (সাবা ২৫/২৮)। আর সেজন্যই তাঁর দায়িত্বের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক এবং সাথে সাথে অনেক দুরূহ। অঞ্চল ও ভাষাগত গন্ডি পেরিয়ে তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর সর্বত্র। জাতীয়তার প্রচলিত সংজ্ঞা ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হ’ল বিশ্বব্যাপী এক নতুন জাতীয়তা। যাকে বলা হয়, ইসলামী জাতীয়তা। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম মিল্লাত’ (হজ্জ ২২/৭৮) বা ‘খায়রে উম্মাহ’ (আলে ইমরান ৩/১১০) অর্থাৎ ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’।

ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তার বিপরীতে এ ছিল এক অমর আদর্শ ভিত্তিক বিশ্ব জাতীয়তা। ভিন দেশের, ভিন রং ও বর্ণের ভিন ভাষার সকল মানুষ একই ভাষায় সকলকে সালামের মাধ্যমে সম্ভাষণ জানায়, একই ভাষায় আযান দেয়, একই ভাষায় ছালাত আদায় করে। সকলে একই ভাষায় কুরআন ও হাদীছ পড়ে। সবাই এক আল্লাহর বিধান মেনে চলে। সেজন্যই তো দেখা গেল, মাত্র কয়েক বছরের দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে বিশ্বসেরা কুরায়েশ বংশের আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলীর পাশে দাঁড়িয়ে পায়ে পা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছালাত আদায় করার মর্যাদা লাভ করল তৎকালীন সমাজের সবচাইতে নিকৃষ্ট শ্রেণীর কৃষ্ণকায় নিগ্রো ক্রীতদাস বেলাল হাবশী, যায়েদ বিন হারেছাহ, মেষ চারক আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ইসলামের আগমন না ঘটলে সমাজের নিগৃহীত, নিস্পেষিত, নিপীড়িত এইসব মহান মানুষগুলির সন্ধান পৃথিবী কোনদিনই পেত না। এই মহান আদর্শের বরকতেই আমরা দেখেছি ইয়ামনের যেমাদ আযদী, ইয়াছরিবের আবু যার গেফারী, তোফায়েল দাওসী, যুলকালা‘ হিমইয়ারী, ‘আদী বিন হাতেম তাঈ, ছুমামাহ নাজদী, আবু সুফিয়ান উমুভী, আবু ‘আমের আশ‘আরী, কুরয ফিহরী, আবু হারেছ মুছত্বালেক্বী, সুরাক্বাহ মুদলেজী, আব্দুল্লাহ বিন সালাম আহবারে ইহূদী, ছুরমা বিন আনাস রুহবানে নাছারা প্রমুখ ভিন গোত্রের ভিনভাষী ও ভিন ধর্মের লোকদের একই ধর্মে লীন হয়ে পাশাপাশি বসতে ও আপন ভাইয়ের মত আচরণ করতে। ইসলামের বরকতেই দুনিয়া দেখেছে শ্বেতাঙ্গ আবুবকর কুরায়শী ও কৃষ্ণাঙ্গ বেলাল হাবশীকে এবং রোমের খ্রিষ্টান ছুহায়েব রূমী ও পারস্যের অগ্নিপূজক সালমান ফারেসীকে একত্রিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক ইসলামী সমাজ গড়তে। আমরা দেখেছি মক্কার মুহাজির ভাইদের জন্য মদীনার আনছার ভাইদের মহান আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। মুষ্টিমেয় ত্যাগপূত এইসব মহান ব্যক্তিদের হাতেই আল্লাহ বিজয়ের সেই মহান মুকুট তুলে দেন, যার ওয়াদা তিনি করেছিলেন।-

هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্যধর্ম সহকারে। যাতে তিনি একে সকল ধর্মের উপরে বিজয়ী করেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে’ (ছফ ৬১/৯)। তিনি মুমিন ও সৎকর্মশীল বান্দাদের হাতে ইসলামী খিলাফত অর্পণের ওয়াদা করেছেন (নূর ২৪/৫৫-৫৬)। তিনি বলেন,وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا ‘(এ ব্যাপারে) সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (ফাৎহ ৪৮/২৮)। অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানকে আল্লাহর অনুগ্রহ পাবার যোগ্য করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহই যথেষ্ট হবে ইসলামের বিজয়ের জন্য। জনবল, অস্ত্রবল সহায়ক শক্তি হ’লেও তা কখনো মূল শক্তি নয়। মূল শক্তি হ’ল ঈমান এবং যার কারণেই নেমে আসে আল্লাহর সাহায্য। তিনিই মুমিনদের পক্ষে শত্রুদের প্রতিরোধ করেন। যেমন তিনি বলেন,إِنَّ اللهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُوْرٍ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের পক্ষ থেকে (শত্রুদের) প্রতিরোধ করেন। আর আল্লাহ কোন খেয়ানতকারী ও অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে ভালোবাসেন না’ (হজ্জ ২২/৩৮)।

বস্ত্ততঃ আরবরা শিরক ও কুফরী ছেড়ে ঈমানের দিকে ফিরে এসেছিল। আর তাই আল্লাহ তাদের থেকে শত্রুদের হটিয়ে দেন। তৎকালীন বিশ্বশক্তি ক্বায়ছার ও কিসরা পর্যন্ত তাদের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা সর্বত্র ইসলামের বিজয়ী ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ইসলাম আদর্শিক ও রাজনৈতিক সবদিক দিয়েই বিজয় লাভ করেছিল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

সামাজিক পরিবর্তন

ইসলামী শিক্ষার বরকতে দুনিয়াপূজারী মানুষগুলি হয়ে উঠলো আখেরাতের পূজারী। আখেরাতের বিনিময়ে তারা দুনিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করল। যে কাজে আখেরাতে কল্যাণ নেই, সে কাজ পরিত্যক্ত হ’ল। সম্পদের প্রাচুর্য তাদেরকে দিকভ্রান্ত করতে পারেনি। বরং আখেরাতের স্বার্থে দ্বীনের কাজে অকাতরে সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতেই তারা অধিক আনন্দ বোধ করলেন। নিজের সবচেয়ে পসন্দের বস্ত্তটি দান করে দিয়ে তাঁরা মানসিক তৃপ্তি পেতেন। দিনের বেলা দাওয়াত ও জিহাদে কিংবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যস্ততায় সময় কাটলেও রাতটি ছিল স্রেফ আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিবেদিত। যে মানুষটি দু’দিন আগেও আল্লাহকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মূর্তির শরণাপন্ন হ’ত, মহামূল্য নযর-নেয়ায নিয়ে প্রাণহীন মূর্তির সন্তুষ্টিতে রত ছিল এবং নিজেদের কপোল কল্পিত বিভিন্ন অসীলার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করত, সেই মানুষটিই এখন সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে সরাসরি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছে। দেহমন ঢেলে দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি কামনায় রাত্রি জাগরণে ও ইবাদতে লিপ্ত হচ্ছে। দু’দিন আগেও যারা পথে-ঘাটে রাহাযানি করত, নারীর ইযযত লুট করত, তারাই আজ অপরের জান-মাল ও ইযযত রক্ষায় হাসিমুখে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। মানুষ এখন একাকী রাস্তায় নির্ভয়ে চলে। ইরাকের হীরা নগরী থেকে একজন পর্দানশীন গৃহবধু একাকী মক্কায় এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে চলে যান নিরাপদে নির্বিঘ্নে। বিপদগ্রস্ত নারীকে শক্তিশালী একজন পরপুরুষ মায়ের মর্যাদা দিয়ে তার বিপদে সাহায্য করছে স্রেফ পরকালীন স্বার্থে।

দু’দিন আগেও যারা সূদ ব্যতীত কাউকে ঋণ দিত না, এখন তারাই সূদকে নিকৃষ্টতম হারাম গণ্য করছে এবং নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ‘কর্যে হাসানাহ’ দিচ্ছে। যেখানে ছিল গাছতলা ও পাঁচতলার আকাশসম অর্থনৈতিক বৈষম্য, সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, যাকাত নেওয়ার মত হকদার খুঁজে পাওয়া যায় না। দু’দিন আগেও যে সমাজে ছিল মদ্যপান, নগ্নতা, বেহায়াপনা ও যৌনতার ছড়াছড়ি, আজ সেই সমাজে চালু হয়েছে পর্দানশীন, মার্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার। যে সমাজে ছিল ধর্মের নামে অসংখ্য শিরক-বিদ‘আত ও অর্থহীন লোকাচার। ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও হানাহানি। আজ সেখানে সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরে আদর্শিক মহববত ও ভালোবাসার অটুট বন্ধনের এক জান্নাতী আবহ। সবকিছুই সুন্নাহ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত। আগে যেখানে ছিল মানুষের মধ্যে প্রভু ও দাসের সম্পর্ক, ছোট-বড় ও সাদা-কালোর ভেদাভেদ। আজ সেখানে এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অর্থনৈতিক বৈষম্য, বংশীয় কৌলিন্য ও আভিজাত্যের অহংকারের বদলে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হ’ল আল্লাহভীরুতার মাপকাঠিতে। বলা হ’ল, সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী। তাই কারু কোন অহংকার নেই। বলা হ’ল সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তাই তাঁর প্রেরিত বিধান সকলের জন্য সমান। আগে যেখানে দুনিয়াবী ভোগবিলাস ছিল মূল লক্ষ্য। আজ সেখানে দুনিয়া তুচ্ছ, আখেরাতই মুখ্য।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের এই আমূল পরিবর্তনের ফলে মুসলমানদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজনীতি সবকিছুতেই সূচিত হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। যা পুরা মানব সভ্যতায় আনে এক বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতিতে পরবর্তীকালে মুসলমানদের যে অনন্য অবদানের স্বাক্ষর বিশ্ব অবলোকন করেছিল, তার মূলে ছিল ইসলামের তাওহীদী চেতনার অম্লান ছাপ। তার সর্বজয়ী আবেদনের বাস্তব প্রতিফলন। তাওহীদ ও সুন্নাহর সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে পারলে মুসলমান আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়োনা ও চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) আদর্শিক বিজয় রাজনৈতিক বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
(২) বৃহত্তর রাজনৈতিক বিজয় আদর্শ কবুলে সহায়ক হয়। কিন্তু তাতে সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(৩) শেষনবী হিসাবে তাঁর মাধ্যমে ইসলামের সার্বিক বিজয় আল্লাহর কাম্য ছিল। কিন্তু সকল যুগে সর্বত্র এটি আবশ্যিক নয়।
(৪) রাজনৈতিক বিজয় সাময়িক। কিন্তু তাওহীদের বিজয় চিরস্থায়ী। তাই ইক্বামতে দ্বীন অর্থ ইক্বামতে হুকূমত নয়, বরং ইক্বামতে তাওহীদ। যার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক কিংবা পূর্ব শর্ত নয়।
(৫) হুকূমত থাক বা না থাক, মুসলমানকে সর্বাবস্থায় তাওহীদের অনুসারী থাকতে হবে। তাহ’লেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার অব্যাহত থাকবে। এমনকি অঞ্চল বিশেষে রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হবে, যদি আল্লাহ চান।

রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ

নবগঠিত মাদানী রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত মযবুত করার জন্য এবং ফরয যাকাত ও অন্যান্য ছাদাক্বা সমূহ সুশৃংখলভাবে আদায় ও বণ্টনের জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেন্দ্রীয়ভাবে রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দান করেন। ৯ম হিজরী সনের মুহাররম মাস থেকে এই সকল নিয়োগ কার্যকর হয়। এতদুদ্দেশ্যে তিনি রাষ্ট্রের অধীন ১৬টি অঞ্চল ও গোত্রের জন্য ১৬ জন রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ করেন।[1] উল্লেখ্য যে, ২য় হিজরীর রামাযান মাসে ছিয়াম ফরয হয় এবং শাওয়াল মাসে যাকাত ফরয হয়। নিম্নে যাকাত আদায়কারীসহ রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব অঞ্চল সমূহের বিবরণ প্রদত্ত হ’ল।-



নাজরান (ছাদাক্বা ও জিযিয়া উভয়টি আদায়ের জন্য)

এ সময় কোন কোন গোত্র জিযিয়া ও ছাদাক্বা দিতে অস্বীকার করে। এমনকি অন্যকে দিতে বাধা প্রদান করে। এমনি একটি গোত্র ছিল বনু তামীম। ৯ম হিজরীর মুহাররম মাসে উক্ত গোত্রের জন্য দায়িত্বশীল রাজস্ব কর্মকর্তা উয়ায়না বিন হিছন মুহাজির ও আনছারদের বাইরে ৫০ জনের একটি অশ্বারোহী দল নিয়ে এদের উপরে আকস্মিক হামলা চালালে সবাই পালিয়ে যায়। তাদের ১১ জন পুরুষ, ২১ জন মহিলা ও ৩০ জন শিশু বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয় এবং রামলা বিনতুল হারেছ-এর গৃহে তাদের রাখা হয়। পরদিন বনু তামীমের আক্বরা বিন হাবেস সহ কয়েকজন নেতা বন্দীমুক্তির জন্য মদীনায় আসেন। অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করেন। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে উত্তম উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাদের বন্দীদের ফেরৎ দেন’।[2] (বিস্তারিত দ্রঃ প্রতিনিধি দল ক্রমিক ৯)।

জনৈক রাজস্ব কর্মকর্তা ইবনুল লুৎবিয়াহ(إِبْنُ اللُّتْبِيَّة) ছাদাক্বা আদায় করতে গিয়ে নিজের জন্য হাদিয়া গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে আবু হুমায়েদ সা‘এদী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয্দ গোত্রের ইবনুল লুৎবিয়াহকে ছাদাক্বা আদায়ের দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ দান করেন। অতঃপর যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন বলেন,هَذَا لَكُمْ، وَهَذَا أُهْدِىَ لِىْ ‘এটি তোমাদের জন্য এবং এটি আমাকে হাদিয়া প্রদান করা হয়েছে’। একথা শুনতে পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে যান এবং হামদ ও ছানার পরে বলেন,فَمَا بَالُ الْعَامِلِ نَسْتَعْمِلُهُ؟ فَيَأْتِينَا فَيَقُولُ هَذَا مِنْ عَمَلِكُمْ وَهَذَا أُهْدِىَ لِى ‘আদায়কারীর কি হয়েছে? যাকে আমরা নিয়োগ দিলাম। অতঃপর সে আমাদের কাছে এল আর বলল, এটি তোমাদের এবং এটি আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে’।فَهَلاَّ جَلَسَ فِى بَيْتِ أَبِيهِ أَوْ بَيْتِ أُمِّهِ، فَيَنْظُرَ يُهْدَى لَهُ أَمْ لاَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يَأْخُذُ أَحَدٌ مِنْهُ شَيْئًا إِلاَّ جَاءَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَحْمِلُهُ عَلَى رَقَبَتِهِ ‘তাহ’লে কেন সে তার পিতা বা মাতার গৃহে বসে থাকেনা? অতঃপর সে দেখুক তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি না? যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমাদের যে কেউ আদায়কৃত মাল থেকে যতটুকু গ্রহণ করবে, ততটুকু ক্বিয়ামতের দিন তাকে স্বীয় স্কন্ধে বহন করে নিয়ে উঠতে হবে। যদি তা উট হয়, গরু হয় বা ছাগল হয়’। অতঃপর তিনি তাঁর দু’হাত উঁচু করলেন। এমতাবস্থায় আমরা তাঁর দুই বগলের সাদা অংশ দেখতে পেলাম। অতঃপর তিনি তিনবার বলেন,اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ ‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিলাম?’ (বুখারী হা/২৫৯৭, ৬৬৩৬; মুসলিম হা/১৮৩২)।

[শিক্ষণীয়: (১) জনগণের প্রয়োজনে ও রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন একান্তভাবেই যরূরী। সেকারণ কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল ফান্ডে ছাদাক্বা প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে যুদ্ধ করা জায়েয। (২) বায়তুল মাল আদায়কারী ও হিসাব সংরক্ষণকারীর জন্য তাকে প্রদত্ত বেতন-ভাতার বাইরে কোনরূপ হাদিয়া গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।]

[1]. আর-রাহীক্ব ৪২৪-২৫ পৃঃ; ওয়াক্বেদী ৩/৯৭৩; ইবনু হিশাম ২/৬০০; ইবনু সা‘দ ২/১২১; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৫।
ইবনুল ক্বাইয়িম ও মুবারকপুরী ইয়াযীদ ইবনুল হুছাইন লিখেছেন। কিন্তু ওয়াক্বেদী ও ইবনু সা‘দ বুরাইদা বিন হুছাইব আল-আসলামী লিখেছেন। ইয়াযীদ ইবনুল হুছাইন নামে ‘আসলাম’ গোত্রের কাউকে না পাওয়ায় আমরা বুরাইদা বিন হুছাইব আল-আসলামী নামটিকেই অগ্রাধিকার দিলাম। যিনি ‘আসলাম’ গোত্রের নেতা ছিলেন (আল-ইছাবাহ, বুরাইদা ক্রমিক ৬৩২)।
[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা হুজুরাত ৪-৫ আয়াত; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৬; ইবনু হিশাম ২/৫৬২, ৫৬৭; তিরমিযী হা/৩২৬৭।

বিদায় হজ্জ

(১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাস)
মক্কা বিজয়ের পর থেকেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায়ের আশংকা করছিলেন। এরি মধ্যে রাষ্ট্রীয় সব কাজকর্ম করে যাচ্ছিলেন। ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান সমূহ নাযিল ও তার বাস্তবায়ন সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে চলছিল। যেহেতু তিনি শেষনবী ও বিশ্বনবী, তাই শুধুমাত্র জান্নাতের সুসংবাদদাতা বা জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের বাস্তব রূপকার হিসাবে তাঁর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য একটা আদর্শ সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও সম্ভবতঃ আল্লাহ পাকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী খলীফাগণ উক্ত কাঠামোকে ভিত্তি করে আরও সুন্দররূপে ইসলামী খেলাফত ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, এ আশা রেখেই তিনি উম্মতকে অছিয়ত করে বলেন,

عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصُّبْحَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا، فَقَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- وفى رِوَايَةٍ للنَّسائىِّ : وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ-

ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন। অতঃপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় ওয়ায করলেন যে, চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হ’ল এবং হৃদয় সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক মুছল্লী বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে যেন এটি কোন বিদায় গ্রহণকারীর অন্তিম উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও তা মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি সমূহ হ’তে বিরত থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হ’ল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হ’ল ভ্রষ্টতা’। জাবের (রাঃ) কর্তৃক নাসাঈ-র বর্ণনায় এসেছে, ‘আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’।[1]

ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لاَ يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِى إِلاَّ هَالِكٌ ‘আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছ দ্বীনের উপর ছেড়ে যাচ্ছি। যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায়। আমার পরে এই দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না ধ্বংসন্মুখ ব্যক্তি ব্যতীত’...।[2]

উপরোক্ত অছিয়তের মধ্যে ৫টি বিষয় রয়েছে। (১) সর্বক্ষেত্রে আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করা (২) আমীর বা শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা (৩) মতভেদের সময় রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা (৪) ইসলামের মধ্যে নবোদ্ভূত বিষয় সমূহ সৃষ্টি তথা যাবতীয় বিদ‘আত উদ্ভাবন থেকে বিরত থাকা (৫) বিদ‘আত ছেড়ে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত হাতে-দাঁতে কামড়ে ধরা এবং তাঁদের ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের ব্যাখ্যা করা।

উক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে শাসক মুসলিম বা অমুসলিম, মুমিন বা ফাসেক দুইই হ’তে পারেন। সর্বাবস্থায় তার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে হবে সামাজিক শৃংখলার স্বার্থে। এছাড়া মুসলিম নাগরিকগণ সর্বাবস্থায় তাদের সামাজিক জীবন যাপন করবেন জামা‘আতবদ্ধভাবে একজন আল্লাহভীরু যোগ্য আমীরের অধীনে। যেভাবে মাক্কী জীবনে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনায় জীবন যাপন করতেন। অতঃপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। বাধ্যগত অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করবেন ও আল্লাহর নিকট তার হক চাইবেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু বিদ্রোহ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করবেন না। কেননা আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে না এবং বিশৃংখলা কামনা করে না। আর শুভ পরিণাম হ’ল কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।

অতঃপর উম্মতের সবাইকে বা অধিকাংশকে একত্রিত করে তাদের সম্মুখে সর্বশেষ উপদেশবাণী প্রদান করা এবং সেই সাথে চির বিদায় নেবার আগ্রহে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জে গমনের আকাংখা ব্যক্ত করলেন। সেই সাথে তিনি উম্মতের কাছ থেকে এ সাক্ষ্য নিতে চাইলেন যে, তিনি তাদের নিকটে আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন যথাযথরূপে পৌঁছে দিয়েছেন। যদিও আল্লাহ বড় সাক্ষী। রাসূল (ছাঃ) হজ্জে যাবেন এবং তিনি উম্মতের সামর্থ্যবান সবাইকে শেষবারের মত একবার পেতে চান ও দেখতে চান- এ ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে চারদিকে ঢেউ উঠে গেল। দলে দলে মানুষ মক্কা অভিমুখে ছুটলো। মদীনা ও আশপাশের লোকেরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হ’ল। এই সময়েও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখাননি। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনের গবর্ণর নিয়োগ দিয়ে পাঠালেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দান শেষে বললেন, يَا مُعَاذُ، إِنَّكَ عَسَى أَنْ لاَ تَلْقَانِيْ بَعْدَ عَامِيْ هَذَا، وَلَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِيْ وَقَبْرِيْ ‘হে মু‘আয! এ বছরের পর তোমার সঙ্গে আমার হয়ত আর সাক্ষাৎ হবে না। তখন হয়ত তুমি আমার এই মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে’। অর্থাৎ জীবিত রাসূলকে আর দেখতে পাবে না। মৃত রাসূল-এর কবর যেয়ারতে হয়ত তোমরা আসবে। রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে এই কথা শুনে ভক্ত ছাহাবী মু‘আয ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদ বেদনায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,لاَ تَبْكِ يَا مُعَاذُ إِنَّ الْبُكَاءَ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘কেঁদ না হে মু‘আয! নিশ্চয় কান্না শয়তানের পক্ষ থেকে আসে’।[3] এর দ্বারা ‘অধিক কান্না ও শোক’ বুঝানো হয়েছে (বুখারী হা/১২৯৭)। কেননা স্বাভাবিক কান্না আল্লাহর রহমত স্বরূপ (বুখারী হা/১৩০৩)।

[1]. আহমাদ হা/১৭১৮৪; আবুদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫; ছহীহাহ হা/২৭৩৫; নাসাঈ হা/১৫৭৮।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩; ছহীহাহ হা/৯৩৭।
[3]. আহমাদ হা/২২১০৭; ছহীহাহ হা/২৪৯৭।

হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা

আবু দুজানা সা‘এদী অথবা সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ গেফারীকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে ১০ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসের ছয় দিন বাকী থাকতে (অর্থাৎ ২৪শে যুলক্বা‘দাহ) শনিবার যোহরের পর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রীগণসহ ছাহাবায়ে কেরাম সমভিব্যাহারে মক্কার পথে রওয়ানা হ’লেন (যাদুল মা‘আদ ২/৯৮-৯৯)। অতঃপর মদীনা থেকে ১০ কি. মি. দক্ষিণে ‘যুল-হুলায়ফা’ গিয়ে আছরের পূর্বে যাত্রাবিরতি করেন। এটা হ’ল মদীনাবাসীদের জন্য হজ্জের মীক্বাত। গলায় মালা পরানো কুরবানীর পশু সঙ্গে ছিল। এখানে তিনি রাত্রি যাপন করেন। পরদিন রবিবার দুপুরের পূর্বে ইহরামের জন্য গোসল করেন এবং গোসল শেষে হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে তাঁর সারা দেহে ও পোষাকে সুগন্ধি মাখিয়ে দেন। অতঃপর তিনি যোহরের দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন এবং মুছাল্লায় থাকা অবস্থাতেই হজ্জ ও ওমরাহর জন্য একত্রে ইহরাম বাঁধেন ও সেমতে ‘তালবিয়া’ পাঠ করেন। অর্থাৎ ‘লাববায়েক হাজ্জান ও ওমরাতান’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন ও হজ্জে ক্বেরান-এর নিয়ত করেন।[1] যোহরের দু’রাক‘আত ফরয ব্যতীত ইহরামের জন্য পৃথকভাবে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেছেন মর্মে রাসূল (ছাঃ) থেকে কিছুই বর্ণিত হয়নি।[2]

অতঃপর তিনি বের হন এবং স্বীয় ক্বাছওয়া (الْقَصْوَاءِ) উটনীর উপরে সওয়ার হয়ে পুনরায় ‘তালবিয়া’ পাঠ করেন। অতঃপর খোলা ময়দানে এসে পুনরায় ‘তালবিয়া’ বলেন।[3] অতঃপর মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন এবং মধ্যম গতিতে সাত দিন চলে ৩রা যিলহাজ্জ শনিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে মক্কার নিকটবর্তী ‘যূ-তুওয়া’(ذُو طُوَى) তে অবতরণ করেন ও সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন রবিবার দিনের বেলায় তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন’।[4] ফলে মদীনা থেকে মক্কায় প্রবেশ পর্যন্ত মোট সফরকাল হয় নয় দিন।

[1]. আর-রাহীক্ব ৪৫৯ পৃঃ। এতে প্রমাণিত হয় যে, মীক্বাত থেকেই ইহরাম বাঁধতে হয়, তার পূর্বে থেকে নয় এবং ইহরামের জন্য পৃথক কোন নফল ছালাত নেই।
একই ইহরামে হজ্জ ও ওমরাহ দু’টিই সম্পন্ন করাকে ‘হজ্জে ক্বেরান’ বলা হয়। এটি কঠিন। প্রথমে ওমরাহ পালন অতঃপর হালাল হয়ে পুনরায় হজ্জের ইহরাম বাঁধাকে ‘হজ্জে তামাত্তু’ বলা হয়। এটি সহজ। শুধুমাত্র হজ্জের ইহরাম বাঁধাকে ‘হজ্জে ইফরাদ’ বলা হয়। সময় স্বল্পতার জন্য এটা অনেকে করে থাকেন। শরী‘আতে তিনটিরই সুযোগ রাখা হয়েছে।
[2]. যাদুল মা‘আদ ২/১০১ পৃঃ। উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে ইহরাম বাঁধার পূর্বে কেবল দু’রাক‘আত ছালাতের কথা এসেছে (মুসলিম হা/১১৮৪ (২১)। যার প্রেক্ষিতে ইমাম নববী ঐ দু’রাক‘আতকে ইহরামের পূর্বেকার দু’রাক‘আত নফল ছালাত হিসাবে গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত একই হাদীছে যোহরের ছালাত স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে (মুসলিম হা/১২৪৩)। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, যোহরের দু’রাক‘আত ক্বছর ছালাত আদায়ের পরেই রাসূল (ছাঃ) হজ্জের ইহরাম বাঁধেন ও তালবিয়াহ পাঠ করেন।
[3]. আর-রাহীক্ব ৪৫৯ পৃঃ। এতে বুঝা যায় যে, তিনি তাঁবুতে ইহরাম পরে একাকী যোহর-আছর জমা ও ক্বছর করে বের হন।
[4]. আর-রাহীক্ব ৪৫৮-৫৯ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ২/২০৬-০৭।

বিদায় হজ্জের জন্য মক্কায় প্রবেশ

৪ঠা যিলহজ্জ রবিবার ফজরের ছালাতের পর গোসল শেষে রওয়ানা হন এবং পূর্বাহ্নে মক্কায় প্রবেশ করেন (যাদুল মা‘আদ ২/২০৬-০৭)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, মানুষের ভীড় এড়ানোর জন্য তিনি উটে সওয়ার হয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন (মুসলিম হা/১২৭৪)। তিনি বনু ‘আব্দে মানাফ দরজা (بَابُ بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ) দিয়ে প্রবেশ করেন। যাকে এখন ‘বাবে বনু শায়বাহ’(بَابُ بَنِي شَيْبَةَ) বলা হয় (যাদুল মা‘আদ ২/২০৭)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এসময় হাতের মাথাবাঁকা লাঠি (مِحْجَن) দিয়ে তিনি হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন (বুখারী হা/১৬০৭)। তিনি বলেন, অতঃপর উট বসিয়ে রাসূল (ছাঃ) মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন।[1] এতে তিনি সূরা ফাতিহার পরে সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাছ পাঠ করেন।[2] অতঃপর সওয়ার অবস্থায় ছাফা ও মারওয়া সাঈ করেন (বুখারী হা/১৬০৭)। এভাবে ওমরাহ শেষ করেন।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি হালাল না হয়ে মক্কার উপরিভাগে তাঁর অবস্থানস্থল ‘হাজূন’ (الْحَجُون)-য়ে গমন করেন। কেননা তাঁর সাথে কুরবানী ছিল। তবে যাদের সঙ্গে কুরবানী ছিল না, তিনি তাদেরকে ওমরাহ শেষে হালাল হ’তে বলেন (বুখারী হা/১৫৪৫)। এতে অনেকে ইতস্ততঃ বোধ করতে থাকেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমার নিকটে ক্রুদ্ধ অবস্থায় আসেন। আমি বললাম, যে আপনাকে ক্রুদ্ধ করেছে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তখন তিনি বললেন, তুমি কি দেখছ না, আমি লোকদের একটা নির্দেশ দিয়েছি। অথচ তারা ইতস্ততঃ করছে।وَلَوْ أَنِّى اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِى مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا سُقْتُ الْهَدْىَ مَعِى حَتَّى أَشْتَرِيَهُ ثُمَّ أَحِلُّ كَمَا حَلُّوا ‘এখন যেটা বুঝছি, সেটা আগে বুঝতে পারলে আমি কুরবানী খরিদ করে নিয়ে আসতাম না। অতঃপর আমি হালাল হয়ে যেতাম। যেমন তারা হালাল হয়েছে’।[3] এর দ্বারা হজ্জে ক্বেরান যে কষ্টকর হজ্জ, সেটা বুঝানো হয়েছে। অতএব হজ্জে তামাত্তু উত্তম।

[1]. বুখারী হা/৪০২; বাক্বারাহ ২/১২৫। তবে এটি মাত্বাফের যেকোন স্থানে পড়া চলে (হাকেম হা/৯৩৩, সনদ ছহীহ)।
এটি তাহিইয়াতুল মসজিদ নয়। বরং তাওয়াফ শেষের ছালাত। কেননা এখানে তাহিইয়াতুল মসজিদ হ’ল তাওয়াফে কুদূম। যা হজ্জ বা ওমরাহ কালে মক্কায় এসেই প্রথমে করতে হয় (যাদুল মা‘আদ ২/২১০)।
[2]. যাদুল মা‘আদ ২/২০৮; মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭)।
[3]. মুসলিম হা/১২১১ (১৩০); মিশকাত হা/২৫৬০ ‘মানাসিক অধ্যায়’ ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।

বিদায় হজ্জে মিনায় গমন

রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধবার মক্কায় অবস্থান শেষে ৮ই যিলহাজ্জ বৃহস্পতিবার তারবিয়ার দিন(يَوْمُ التَّرْوِيَة) সকালে রাসূল (ছাঃ) মিনায় গমন করেন। সেখানে তিনি জমা না করে পৃথক পৃথক ভাবে শুধু ক্বছরের সাথে যোহর, আছর, মাগরিব, এশা ও ফজর পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন এবং ৯ তারিখ সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করেন।[1]

[1]. যাদুল মা‘আদ ২/২১৫; মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭); মিশকাত হা/২৫৫৫; বুখারী হা/১০৮১, ১০৮৩; মুসলিম হা/৬৯৪ (১৬), ৬৯৬ (২০); মিশকাত হা/১৩৩৪, ১৩৩৬।

বিদায় হজ্জে আরাফাতে অবস্থান

৯ই যিলহাজ্জ শুক্রবার সকালে তিনি মিনা হ’তে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ওয়াদিয়ে নামেরায়(وَادِي نَمِرَةَ) অবতরণ করেন। যার একপাশে আরাফাত ও অন্যপাশে মুযদালিফাহ অবস্থিত। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে তিনি ক্বাছওয়ার (الْقَصْوَاءِ) পিঠে সওয়ার হয়ে আরাফাত ময়দানের বাত্বনে ওয়াদীতে(بَطْنُ الْوَادِي) গমন করেন। এটি ছিল একটি পাহাড়ী টিলা। যা বর্তমানে ‘জাবালে রহমত’(جَبَلُ الرَّحْمَةِ) বলে খ্যাত। অতঃপর তিনি সেখানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় উপস্থিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে সারগর্ভ ভাষণ দেন (যাদুল মা‘আদ ২/২১৫)। এসময় সেখানে এক লক্ষ চবিবশ হাযার বা ত্রিশ হাযার মুসলমান উপস্থিত ছিলেন।[1] মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এক লক্ষ অথবা এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাযার বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪৪৪ পৃঃ)।
[1]. মির‘আত, শরহ মিশকাত হা/২৫৬৯-এর আলোচনা।

বিদায় হজ্জে আরাফাতের ভাষণ

১. জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম (রাঃ) বলেন, আরাফার দিন বিদায় হজ্জের ভাষণে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنِّى وَاللهِ لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَ أَلْقَاكُمْ بَعْدَ يَوْمِى هَذَا بِمَكَانِى هَذَا، فَرَحِمَ اللهُ مَنْ سَمِعَ مَقَالَتِى الْيَوْمَ فَوَعَاهَا، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ وَلاَ فِقْهَ لَهُ، وَلَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَاعْلَمُوا أَنَّ أَمْوَالَكُمْ وَدِمَاءَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ هَذَا الْيَوْمِ فِى هَذَا الشَّهْرِ فِى هَذَا الْبَلَدِ، وَاعْلَمُوا أَنَّ الْقُلُوبَ لاَ تَغِلُّ عَلَى ثَلاَثٍ: إِخْلاَصِ الْعَمَلِ للهِ، وَمُنَاصَحَةِ أُولِى الأَمْرِ، وَعَلَى لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ، فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ- رواه الدارمىُّ-

(১) ‘হে জনগণ! আল্লাহর কসম, আমি জানিনা আজকের পরে আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হ’তে পারব কি-না। অতএব আল্লাহ রহম করুন ঐ ব্যক্তির উপরে যে ব্যক্তি আজকে আমার কথা শুনবে ও তা স্মরণ রাখবে। কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যের নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়) এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকটে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। (২) জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৩) জেনে রেখ, তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর খিয়ানত করে না : (ক) আল্লাহর উদ্দেশ্যে এখলাছের সাথে কাজ করা। (খ) শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা এবং (গ) মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা। কেননা তাদের দো‘আ তাদেরকে পিছন থেকে (শয়তানের প্রতারণা হ’তে) রক্ষা করে’ (দারেমী হা/২২৭, সনদ ছহীহ)। অর্থাৎ মুমিন যতক্ষণ উক্ত তিনটি স্বভাবের উপরে দৃঢ় থাকবে, ততক্ষণ তার অন্তরে খিয়ানত বা বিদ্বেষ প্রবেশ করবে না। যা তাকে ইলম প্রচারের কাজে বাধা দেয়। আর তিনিই হবেন কামেল মুমিন’ (মির‘আত হা/২২৯-এর ব্যাখ্যা)।

ছাহেবে মিরক্বাত বলেন,لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ অর্থ আক্বীদা ও সৎকর্মে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং জুম‘আ, জামা‘আত ও অন্যান্য বিষয়ে সকলে অংশগ্রহণ করা।فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ অর্থ তাদের দো‘আ তাদেরকে শয়তানী প্রতারণা এবং পথভ্রষ্টতা হ’তে পিছন থেকে তাদের রক্ষা করে। এর মধ্যে ধমকি রয়েছে, যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাবে, সে ব্যক্তি জামা‘আতের বরকত ও মানুষের দো‘আ থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা অধিক উত্তম বিচ্ছিন্ন থাকার চাইতে’। কোন কোন বর্ণনায়مَنْ وَرَائَهُمْ এসেছে। অর্থাৎ তাদের পিছনে যারা আছে, তারা তাকে রক্ষা করে। ত্বীবী বলেন, এর দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে। যাদের দো‘আ তাদের পরবর্তী বংশধরগণকেও পথভ্রষ্টতা হ’তে রক্ষা করে’ (মিরক্বাত, শরহ মিশকাত হা/২২৮-এর ব্যাখ্যা)।

২. জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের দিন সূর্য ঢলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বাছওয়া (الْقَصْوَاءُ) উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে বাত্বনুল ওয়াদীতে আরাফাহ ময়দানে আসেন। অতঃপর লোকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا، فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا- أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوْعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ كَانَ مُسْتَرْضِعًا فِى بَنِى سَعْدٍ فَقَتَلَتْهُ هُذَيْلٌ- وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوْعٌ كُلُّهُ- فَاتَّقُوا اللهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوْهُنَّ بِأَمَانِ اللهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوْجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لاَّ يُوْطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُوْنَهُ. فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوْهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ- وَقَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللهِ، وَأَنْتُمْ تُسْأَلُوْنَ عَنِّىْ فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ- قَالُوْا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ. فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلىَ السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ، اللهُمَّ اشْهَدْ، اللهُمَّ اشْهَدْ- ثَلاَثَ مَرَّاتٍ- رواه مسلم-

‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৪) ‘শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবী আমি পরিত্যাগ করছি, তা হ’ল রাবী‘আহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব-এর শিশু পুত্রের রক্ত। যে তখন বনু সা‘দ[1] গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’। (৫) ‘জাহেলী যুগের সকল সূদ পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের সূদ সমূহের প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটি হ’ল (আমার চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের পাওনা সূদ। যার সবটুকুই বাতিল করা হ’ল। (৬) ‘তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের প্রাপ্য হক হ’ল এই যে, তারা তোমাদের বিছানা এমন কাউকে মাড়াতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা সেটা করে, তবে তোমরা তাদের প্রহার করবে যা গুরুতর হবে না। আর তোমাদের উপরে তাদের প্রাপ্য হক হ’ল উত্তমরূপে খাদ্য ও পরিধেয় প্রদান করা’। (৭) ‘আর জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্ত্ত, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। সেটি হ’ল আল্লাহর কিতাব’। (৮) ‘আর তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তখন তোমরা কি বলবে? লোকেরা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌঁছে দিয়েছেন, (রিসালাতের আমানত) আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’। অতঃপর তিনি শাহাদাত অঙ্গুলী আসমানের দিকে উঁচু করে অতঃপর সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’ (তিনবার)।[2]

৩. ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِالْمُؤْمِنِ؟ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَالْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ النَّاسُ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِى طَاعَةِ اللهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذُّنُوبَ

(৯) ‘আমি কি তোমাদেরকে মুমিন সম্পর্কে খবর দিব না? সে ঐ ব্যক্তি যার হাত থেকে অন্যদের মাল ও জান নিরাপদ থাকে। আর মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে। আর মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এবং মুহাজির সেই, যে সকল প্রকার অন্যায় ও পাপকর্ম সমূহ পরিত্যাগ করে’।[3]

উক্ত কথাটি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় অন্যভাবে এসেছে,الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং মুহাজির সেই, যে আল্লাহর নিষেধ সমূহ পরিত্যাগ করে’।[4]

৪. আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আরাফাতের ময়দানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় প্রদত্ত ভাষণে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

أَلاَ وَإِنِّى فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ وَأُكَاثِرُ بِكُمُ الأُمَمَ فَلاَ تُسَوِّدُوا وَجْهِى أَلاَ وَإِنِّى مُسْتَنْقِذٌ أُنَاسًا وَمُسْتَنْقَذٌ مِنِّى أُنَاسٌ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُصَيْحَابِى. فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ تَدْرِى مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ-

(১০) ‘মনে রেখ! আমি তোমাদের সকলের আগেই হাউয কাউছারে পৌঁছে যাব। আর আমি অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে গর্ব করব। অতএব তোমরা আমার চেহারাকে কালেমালিপ্ত করো না। (১১) মনে রেখ! আমি অনেককে সেদিন মুক্ত করব এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন আমি বলব, ‘হে আমার প্রতিপালক! এরা তো আমার সাথী। তিনি বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা (ইসলামের মধ্যে) কত বিদ‘আত সৃষ্টি করেছিল’ (ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৭)।

সাহল বিন সা‘দ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এ জওয়াব পাওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) বলবেন,سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى ‘দূর হও দূর হও! যে ব্যক্তি আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ’।[5]

৫. মিখনাফ বিন সুলায়েম (রাঃ) বলেন,

كُنَّا وُقُوفًا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَفَاتٍ فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَعَتِيرَةً- رواه الترمذى وأبو داؤد وابن ماجه-

(১২) ‘আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম যে, হে জনগণ! নিশ্চয় প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও ‘আতীরাহ’।[6]

৬. সুলায়মান বিন আমর ইবনুল আহওয়াছ তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, এদিন রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন,

أَىُّ يَوْمٍ هَذَا؟ قَالُوا يَوْمُ الْحَجِّ الأَكْبَرِ. قَالَ: فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِى بَلَدِكُمْ هَذَا، أَلاَ لاَ يَجْنِى جَانٍ إِلاَّ عَلَى نَفْسِهِ لاَ يَجْنِى وَالِدٌ عَلَى وَلَدِهِ وَلاَ مَوْلُوْدٌ عَلَى وَالِدِهِ- أَلاَ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يُعْبَدَ فِى بِلاَدِكُمْ هَذِهِ أَبَدًا وَلَكِنْ سَتَكُونُ لَهُ طَاعَةٌ فِيمَا تَحْتَقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ-

(১৩) ‘আজকে কোন দিন? লোকেরা বলল, হাজ্জে আকবারের দিন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও (১৪) সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম। যেমন এই দিন ও এই শহর তোমাদের জন্য হারাম। ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে বর্তাবে না। পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপর এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার উপর বর্তাবে না’। (১৫) ‘মনে রেখ, শয়তান তোমাদের এই শহরে পূজা পাওয়া থেকে (অর্থাৎ তোমাদের কাফের হওয়া থেকে) চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশী থাকবে’।[7] যেমন মিথ্যা, প্রতারণা, আপোষে ঝগড়া-মারামারি ইত্যাদি। যা পরবর্তীদের মধ্যে ঘটেছিল (মির‘আত)। জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছেوَلَكِنْ فِى التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ ‘কিন্তু শয়তানী প্ররোচনা বাকী থাকবে’।[8] (১৬) একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَلاَ إِنَّ الْمُسْلِمَ أَخُو الْمُسْلِمِ فَلَيْسَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ مِنْ أَخِيهِ شَىْءٌ إِلاَّ مَا أَحَلَّ مِنْ نَفْسِهِ ‘মনে রেখ! এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। অতএব কোন মুসলমানের জন্য তার ভাই-এর কোন বস্ত্ত হালাল নয় কেবল অতটুকু ব্যতীত যতটুকু সে তার জন্য হালাল করে’ (তিরমিযী হা/৩০৮৭)। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে,لاَ يَحِلُّ لاِمْرِئٍ مِنْ مَالِ أَخِيهِ إِلاَّ مَا أَعْطَاهُ مِنْ طِيبِ نَفْسٍ وَلاَ تَظْلِمُوا ‘কোন ব্যক্তির মাল তার ভাই-এর জন্য হালাল নয়। যতক্ষণ না সে তাকে খুশী মনে তা দেয়। আর তোমরা যুলুম করো না...।[9] এদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সওয়ারীর পিঠে বসে একটি খুৎবা দিয়েছিলেন, দু’টি খুৎবা নয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুসফিরের জন্য জুম‘আর ছালাত অপরিহার্য নয় (যাদুল মা‘আদ ২/২১৬)।

আরাফাতের ভাষণে উপরে বর্ণিত ৬টি হাদীছের মধ্যে আমরা ১৬টি বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য পেয়েছি। যার প্রতিটিই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লেখ্য যে, আরাফাতের ময়দানে রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত ভাষণ উচ্চকণ্ঠে জনগণকে শুনিয়েছিলেন রাবী‘আহ বিন উমাইয়া বিন খালাফ’।[10] আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! মক্কায় হযরত বেলালের উপরে লোমহর্ষক নির্যাতনকারী, রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ নেতার অন্যতম নিকৃষ্টতম নেতা ও বদর যুদ্ধে নিহত উমাইয়া বিন খালাফের ছেলে রাবী‘আহ আজ রাসূল (ছাঃ)-এর দেহরক্ষী ছাহাবী ও তাঁর বিদায়ী ভাষণ প্রচারকারী। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী, সুবহা-নাল্লা-হিল ‘আযীম।

[1]. অন্য বর্ণনায় বনু লাইছ।- ইবনু হিশাম ২/৬০৪।
[2]. মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭) ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২৫৫৫ ‘মানাসিক’ অধ্যায়; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭৪।
[3]. আহমাদ হা/২৪০০৪; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৬২; ছহীহাহ হা/৫৪৯।
[4]. বুখারী হা/১০; মিশকাত হা/৬।
[5]. বুখারী হা/৬৫৮৩-৮৪; মুসলিম হা/২২৯৭ (৩২); মিশকাত হা/৫৫৭১।
অতএব জন্মনিরোধ করে উম্মতের সংখ্যা কমানো এবং ধর্মের নামে ও রাজনীতির নামে ইসলামের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি বা আমদানী করা নিষিদ্ধ।
[6]. তিরমিযী হা/১৫১৮; আবুদাঊদ হা/২৭৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৩১২৫; মিশকাত হা/১৪৭৮, সনদ ‘হাসান’।
‘আতীরাহ’ অর্থ ঐ পশু যা রজব মাসে যবহ করা হয়। যা ইসলামের প্রথম যুগে চালু ছিল এবং পরে রহিত করা হয় (মির‘আত হা/১৪৯২-এর ব্যাখ্যা)। অত্র হাদীছে প্রমাণিত হয় যে, মুক্বীম অবস্থায় পরিবার পিছু একটি করে কুরবানী দেওয়া আবশ্যক। তাছাড়া আল্লাহ বলেন, আমরা ইসমাঈলের কুরবানীর বিনিময়ে একটি মহান কুরবানী পেশ করলাম’। আর সেটিকে আমরা পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১০৭-০৮)। আর সেটি ছিল একটি দুম্বা। রাসূল (ছাঃ) মদীনাতে মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে একটি বা দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন’ (বুখারী হা/৫৫৫৮; মুসলিম হা/১৯৬৬; মিশকাত হা/১৪৫৩-৫৪)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, হজ্জের সফরে তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী দিয়েছে (আবুদাঊদ হা/১৭৫০)। আনাস (রাঃ) বলেন, হজ্জের সফরে রাসূল (ছাঃ) দাঁড়ানো অবস্থায় ৭টি উট নহর করেন এবং মদীনাতে ঈদুল আযহার দিন দু’টি শিংওয়ালা সুঠামদেহী দুম্বা যবহ করেছেন’ (বুখারী হা/১৭১২)। মুসাফির অবস্থায় সাত জনে মিলে একটি গরু বা উট কুরবানীর বিধান রয়েছে। হোদায়বিয়া ও হজ্জের সফরে এবং অন্যান্য সফরে ছাহাবীগণ এভাবেই কুরবানী করেছেন’ (মুসলিম হা/১৩১৮ (৩৫০-৫১); আবুদাঊদ হা/২৮০৯; তিরমিযী হা/৯০৪-০৫; ইবনু মাজাহ হা/৩১৩১; মিশকাত হা/১৪৬৯)। উক্ত হাদীছটি আবুদাঊদে ও মিশকাতে সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে,الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُورُ عَنْ سَبْعَةٍ ‘গরু ও উট সাত জনের পক্ষ হ’তে’ (আবুদাঊদ হা/২৮০৮; মিশকাত হা/১৪৫৮ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ)। সেখান থেকেই সম্ভবতঃ সাত ব্যক্তি কিংবা সাত বা একাধিক পরিবার মিলে একটি গরু কুরবানী দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। যা সুন্নাত সম্মত নয়। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : লেখক প্রণীত ‘মাসায়েলে কুরবানী’ বই)।
[7]. তিরমিযী হা/২১৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৫, হাদীছ ছহীহ; মিরক্বাত শারহ মিশকাত হা/২৬৭০।
আরাফার দিনকে ‘হজ্জে আকবার’ বলা হয় এবং শুধু ওমরাকে ‘হজ্জে আছগার’ বলা হয়। তবে প্রসিদ্ধ মতে আরাফা ও জুম‘আর দিন একত্রিত হওয়াকে ‘হজ্জে আকবার’ বলা হয় (মিরক্বাত হা/২৬৭০-এর আলোচনা)। এর জন্য ৭০টি হজ্জের সমান নেকী পাওয়া যায় বলে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তা ভিত্তিহীন ও জাল (যঈফাহ হা/২০৭, ১১৯৩, ৩১৪৪)।
[8]. মুসলিম হা/২৮১২; মিশকাত হা/৭২।
[9]. বায়হাক্বী হা/১১৩০৪; ইরওয়া হা/১৪৫৯-এর আলোচনা ১/২৮১, সনদ হাসান।
[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৯২৭, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৬০৫।




প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url