প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৬০] || মহানবীর জীবনী ||







রাসূল (ছাঃ) এর জীবনের শেষ সপ্তাহ, শী’আদের ভুল ধারণা এবং সর্বশেষ অভিযান প্রেরণ


[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

রাসূল (ছাঃ)-এর অসুখের সূচনা

ইবনু কাছীর বলেন, ছফর মাসের দু’একদিন বাকী থাকতে অথবা রবীউল আউয়াল মাসের প্রথম দিন অসুখের সূচনা হয় (আল-বিদায়াহ ৫/২২৪)। এদিন মধ্যরাতে রাসূল (ছাঃ) স্বীয় গোলাম আবু মুওয়াইহিবাহ(أَبُو مُوَيْهِبَةَ) কে সাথে নিয়ে বাক্বী‘ গোরস্থানে গমন করেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর প্রচন্ড মাথাব্যথার মাধ্যমে অসুখের সূচনা হয়। যা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল’ (আহমাদ হা/১৬০৪০)।[1] আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন যেদিন তাঁর অসুখ শুরু হয়। তখন আমি বললাম, হায় মাথাব্যথা!... তিনি বললেন, আমারও প্রচন্ড মাথাব্যথা। অতঃপর তিনি বললেন, ادْعُو إِلَىَّ أَبَاكِ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ لأَبِى بَكْرٍ كِتَاباً فَإِنِّى أَخَافُ أَنْ يَقُولَ قَائِلٌ وَيَتَمَنَّى مُتَمَنِّى أَنَا أَوْلَى. وَيَأْبَى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‘তুমি তোমার পিতা ও ভাইকে আমার নিকটে ডেকে আনো। যাতে আমি আবুবকরের জন্য একটি কাগজ লিখে দিতে পারি। কেননা আমি ভয় পাচ্ছি যে, কোন ব্যক্তি বলবে বা কোন উচ্চাভিলাষী আকাংখা করবে যে, আমিই যোগ্য। অথচ আল্লাহ ও মুমিনগণ আবুবকর ব্যতীত অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে’।[2] অত্র হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় যে, আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে থাকা অবস্থাতেই মাথাব্যথা শুরু হয় এবং একথাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (ছাঃ) অসুখের শুরুর দিনেই আবুবকর (রাঃ)-এর নামে খিলাফত লিখে দিতে চেয়েছিলেন।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর গৃহে প্রবেশ করলাম। অতঃপর তাঁর দেহের উপর হাত রাখলাম। তখন তাঁর লেপের উপরেও তাপ অনুভূত হচ্ছিল। শরীর এত গরম ছিল যে, হাত পুড়ে যাচ্ছিল। এতে আমি বিস্ময়বোধ করলে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

إِنَّا كَذَلِكَ يُضَعَّفُ لَنَا الْبَلاَءُ وَيُضَعَّفُ لَنَا الأَجْرُ. قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً قَالَ : الأَنْبِيَاءُ. قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ : ثُمَّ الصَّالِحُونَ، إِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيُبْتَلَى بِالْفَقْرِ حَتَّى مَا يَجِدُ أَحَدُهُمْ إِلاَّ الْعَبَاءَةَ يُحَوِّيهَا، وَإِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيَفْرَحُ بِالْبَلاَءِ كَمَا يَفْرَحُ أَحَدُكُمْ بِالرَّخَاءِ- رواه إبن ماجه-

‘এভাবে আমাদের কষ্ট দ্বিগুণ হয় এবং আমাদের পুরস্কারও দ্বিগুণ হয়। অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত কারা? তিনি বললেন, নবীগণ। আমি বললাম, তারপর কারা? তিনি বললেন, নেককার ব্যক্তিগণ। এমনকি তাদের কেউ দারিদ্রে্যর কষাঘাতে এমনভাবে জর্জরিত হবে যে, পোষাক হিসাবে মাথার ‘আবা’ (الْعَبَاءَةُ) ছাড়া কিছুই পাবে না। তাদের কেউ বিপদে পড়লে এমন খুশী হবে, যেমন তোমাদের কেউ প্রাচুর্য পেলে খুশী হয়ে থাক’।[3]

তাঁর মোট অসুখের সময়কাল ছিল ১৩ অথবা ১৪ দিন। যার মধ্যে অধিকাংশ দিন তিনি মসজিদে এসে জামা‘আতে ইমামতি করেন। শেষের দিকে বৃহস্পতিবার এশা থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত ১৭ ওয়াক্ত ছালাতে আবুবকর (রাঃ) ইমামতি করেন।

[1]. আহমাদ হা/১৬০৪০; মুহাক্কিক শু‘আয়েব আরনাঊত্ব বলেন, হাদীছ ছহীহ। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন ওমর আল-‘আবলীর অপরিচিতির কারণে সনদ যঈফ। আলবানী, যঈফাহ হা/৬৪৪৭। মুবারকপুরী সূত্র বিহীনভাবে ২৯শে ছফর সোমবার বাক্বী‘ গোরস্থানে একটি জানাযায় অংশগ্রহণ শেষে ফেরার পথে অসুখের সূচনা হয় বলেছেন’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৪-৬৫ পৃঃ)। যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

[2]. আহমাদ হা/২৫১৫৬; ছহীহাহ হা/৬৯০; মুসলিম হা/২৩৮৭।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪০২৪; ছহীহাহ হা/১৪৪।

রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের শেষ সপ্তাহ

রাসূল (ছাঃ)-এর শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হ’তে থাকে। এ সময় তিনি বারবার স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতে থাকেন,أَيْنَ أَنَا غَدًا أَيْنَ أَنَا غَدًا ‘আগামীকাল আমি কোথায় থাকব? আগামীকাল আমি কোথায় থাকব’? তারা এর অর্থ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি যেখানে খুশী থাকতে পারেন’। তখন তিনি আয়েশার গৃহে গমন করেন।[1] এ সময় তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। ফযল বিন আববাস ও আলী ইবনু আবী ত্বালেবের কাঁধে ভর করে অতি কষ্টে তিনি পা টিপে টিপে হাঁটছিলেন(تَخُطُّ قَدَمَاهُ)। অতঃপর তিনি আয়েশার কক্ষে প্রবেশ করেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহটি সেখানেই অতিবাহিত করেন।

অন্য সময় আয়েশা (রাঃ) সূরা ফালাক্ব ও নাস এবং অন্যান্য দো‘আ, যা তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শিখেছিলেন, সেগুলি পাঠ করে ফুঁক দিয়ে বরকতের আশায় রাসূল (ছাঃ)-এর হাত তাঁর দেহে বুলিয়ে দিতেন। এ সময় তিনি সেটাই করতে চাইলেন। কিন্তু নিজের হাত টেনে নিয়ে রাসূল (ছাঃ) বললেন,اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الأَعْلَى ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে দয়া কর এবং আমাকে সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর’ (বুখারী হা/৫৬৭৪)।

[1]. বুখারী হা/৪৪৫০; মিশকাত হা/৩২৩১।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে

জীবনের শেষ বুধবার। এদিন তাঁর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় তিনি ঘরের মধ্যে মিসরীয় খ্রিষ্টান দাসী মারিয়া ক্বিবত্বিয়াহ এবং হিজরতে থাকা অবস্থায় স্ত্রী উম্মে সালামাহ ও উম্মে হাবীবাহ হাবশাতে তাদের দেখা খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের কবর সমূহে তাদের প্রতিকৃতি আঁকিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে আলোচনা করলে রাসূল (ছাঃ) মুখের চাদর ফেলে দিয়ে মাথা উঁচু করে বলেন, إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا ‘ওদের মধ্যে কোন নেককার মানুষ মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো এবং তার মধ্যে তাদের ছবি আঁকতো। ওরা হল ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে সৃষ্টিজগতের নিকৃষ্টতম জীব। আল্লাহ ইহূদী-নাছারাদের উপরে লা‘নত করুন! তারা তাদের নবীগণের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’।[1]

সুলায়মান বিন ইয়াসার ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি আরও বলেন,اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ، اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ো না, যাকে পূজা করা হয়। ঐ কওমের উপরে আল্লাহর প্রচন্ড ক্রোধ রয়েছে, যারা নবীগণের কবরসমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করে’।[2] কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنِّيْ أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ، اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ اشْهَدْ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ‘আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’। দেখো, আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছে দিলাম’ (৩ বার)? হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’ (৩ বার)।[3]

আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে তিনি বলেন, ‘তোমরা বিভিন্ন কূয়া থেকে পানি এনে আমার উপরে সাত মশক পানি ঢাল। যাতে আমি বাইরে যেতে পারি এবং লোকদের উপদেশ দিতে পারি। অতঃপর আমরা তাঁকে হাফছা বিনতে ওমরের পাথর অথবা তাম্র নির্মিত একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে দিলাম এবং তাঁর উপরে পানি ঢালতে লাগলাম। এক পর্যায়ে তিনি বলতে থাকেন,حَسْبُكُمْ حَسْبُكُمْ ‘ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও’। অতঃপর একটু হালকা বোধ করলে তিনি মাথায় কাপড় দিয়ে যোহরের প্রাক্কালে মসজিদে প্রবেশ করেন। অতঃপর ছালাত আদায় করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন’।[4]

এদিন বের হবার মূল কারণ ছিল আনছারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, আবুবকর ও আববাস (রাঃ) আনছারদের এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁরা তাদেরকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন যে, আমরা আমাদের সঙ্গে রাসূল (ছাঃ)-এর উঠাবসার কথা স্মরণ করছিলাম। অতঃপর তাঁদের একজন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গিয়ে আনছারদের এই অভিব্যক্তির কথা অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে চাদরের এক প্রান্ত মাথায় বাঁধা অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ও মিম্বরে আরোহন করেন। এদিনের পর তিনি আর মিম্বরে আরোহন করেননি’। অতঃপর সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,

(১) أُوْصِيْكُمْ بِالأَنْصَارِ، فَإِنَّهُمْ كَرِشِى وَعَيْبَتِى، وَقَدْ قَضَوُا الَّذِى عَلَيْهِمْ، وَبَقِىَ الَّذِى لَهُمْ، فَاقْبَلُوْا مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَتَجَاوَزُوْا عَنْ مُسِيْئِهِمْ ‘আমি তোমাদেরকে আনছারদের বিষয়ে অছিয়ত করে যাচ্ছি। তারা আমার বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্য বাকী রয়েছে। অতএব তোমরা তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করো এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে দিয়ো’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,فَإِنَّ النَّاسَ يَكْثُرُونَ وَيَقِلُّ الأَنْصَارُ، حَتَّى يَكُونُوا فِى النَّاسِ بِمَنْزِلَةِ الْمِلْحِ فِى الطَّعَامِ، فَمَنْ وَلِىَ مِنْكُمْ شَيْئًا يَضُرُّ فِيهِ قَوْمًا، وَيَنْفَعُ فِيهِ آخَرِينَ، فَلْيَقْبَلْ مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَيَتَجَاوَزْ عَنْ مُسِيْئِهِمْ ‘মানুষ ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু আনছারদের সংখ্যা কমতে থাকবে। এমনকি তাদের অবস্থা হবে খাদ্যের মধ্যে লবনের ন্যায়(كَالْمِلْحِ فِي الطَّعَامِ)। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কারু ক্ষতি বা উপকার করার মালিক হবে (অর্থাৎ নেতৃত্বে আসবে), সে যেন তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করে এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে’।[6]

(২) জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে বলতে শুনেছি,

إِنِّىْ أَبْرَأُ إِلَى اللهِ أَنْ يَكُونَ لِى مِنْكُمْ خَلِيْلٌ فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِىْ خَلِيْلاً كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيْلاً وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِىْ خَلِيْلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً، لَكِنَّهُ أَخِيْ وَ صَاحِبِيْ، إنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُوْ بَكْرٍ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوْا يَتَّخِذُوْنَ قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيْهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُوْرَ مَسَاجِدَ، إنِّيْ أنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ-

‘আমি আল্লাহর নিকট দায়মুক্ত এজন্য যে, তিনি আমাকে তোমাদের মধ্যে কাউকে ‘বন্ধু’(خَلِيْل) হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দেননি। কেননা আল্লাহ আমাকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি ইবরাহীমকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে যদি আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবুবকরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তিনি আমার ভাই ও সাথী। লোকদের মধ্যে নিজের সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন আবুবকর। মনে রেখ, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছিল। তোমরা যেন এরূপ করো না’। আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’।[7]

(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এদিন তিনি মিম্বরে বসে আরও বলেন,إِنَّ عَبْدًا خَيَّرَهُ اللهُ بَيْنَ أَنْ يُؤْتِيَهُ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا مَا شَاءَ، وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ، فَاخْتَارَ مَا عِنْدَهُ ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, সে চাইলে দুনিয়ার জাঁকজমক সবকিছু তাকে দেওয়া হবে অথবা আল্লাহর নিকটে যা আছে তা সে গ্রহণ করবে। অতঃপর সে বান্দা সেটাকেই পসন্দ করেছে, যা আল্লাহর নিকটে রয়েছে’। একথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) কেঁদে উঠে বললেন,فَدَيْنَاكَ بِآبَائِنَا وَأُمَّهَاتِنَا ‘আমাদের পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌন’।[8] অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَأَنْفُسِنَا وَأَمْوَالِنَا ‘আমাদের জীবন ও সম্পদ সমূহ’।[9] রাবী বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই শায়খ কাঁদছেন কেন? এতে কাঁদবার কি আছে? বস্ত্ততঃ ‘আবুবকর ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি’(وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ هُوَ أَعْلَمُنَا)। অতঃপর তিনি বললেন,يَا أَبَا بَكْرٍ لاَ تَبْكِ، إِنَّ أَمَنَّ النَّاسِ عَلَىَّ فِى صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلاً مِنْ أُمَّتِى لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ، وَلَكِنْ أُخُوَّةُ الإِسْلاَمِ وَمَوَدَّتُهُ، لاَ يَبْقَيَنَّ فِى الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلاَّ سُدَّ إِلاَّ بَابُ أَبِى بَكْرٍ ‘হে আবুবকর! তুমি কেঁদো না। নিশ্চয় লোকদের মধ্যে সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ করেছেন আবুবকর। যদি আমি উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবুবকরকেই করতাম। কিন্তু ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসাই উত্তম। আর মসজিদের সকল দরজা বন্ধ হবে কেবল আবুবকরের দরজা ব্যতীত’।[10]

[1]. বুখারী ফাৎহুল বারী হা/৪২৭, ৪৩৫, ১৩৩০, ১৩৪১; মুসলিম হা/৫২৯-৩০; মিশকাত হা/৭১২।
[2]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৫৯৩; আহমাদ হা/৭৩৫২, সনদ শক্তিশালী; মিশকাত হা/৭৫০।
[3]. ত্বাবারাণী হা/৮৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২২৮৮।
[4]. বুখারী হা/৪৪৪২; ইবনু হিশাম ২/৬৪৯; বর্ণনাটি ছহীহ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ২০৭৯)। এদিন রাসূল (ছাঃ)-এর একটু সুস্থতাকে উপলক্ষ্য করেই বাংলাদেশে আখেরী চাহার শাম্বা’ (শেষ বুধবার) নামে সরকারী ছুটি পালন করা হয়। যা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। এরূপ প্রথা ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় ছিল না।
[5]. বুখারী হা/৩৭৯৯, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৬২১২ ‘সামষ্টিক ফযীলতের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. বুখারী হা/৩৬২৮, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৬২১৩।
[7]. মুসলিম হা/৫৩২, জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৭১৩; বুখারী হা/৪৬৭; মুসলিম হা/২৩৮২; মিশকাত হা/৬০১০-১১।
[8]. বুখারী হা/৪৬৬; মুসলিম হা/২৩৮২ (২); মিশকাত হা/৫৯৫৭।
[9]. দারেমী হা/৭৭, আবু সাঈদ খুদরী হতে, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৯৬৮ ‘মক্কা হ’তে ছাহাবীগণের হিজরত ও রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাত’ অনুচ্ছেদ।
[10]. বুখারী হা/৪৬৬; মুসলিম হা/২৩৮২ (২); মিশকাত হা/৫৯৫৭। ইবনু হাজার বলেন, এর মধ্যে আবুবকরের খেলাফতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে’ (ফাৎহুল বারী হা/৪৪৬-এর ব্যখ্যা)।

মুবারকপুরী এখানে একটি প্রসিদ্ধ কাহিনীর অবতারণা করেছেন। যেমন, এ সময় রাসূল (ছাঃ) তাঁর নিকট থেকে বদলা নেওয়ার জন্য সকলের সামনে নিজেকে পেশ করেন। তিনি বলেন, যদি আমি কাউকে পিঠে মেরে থাকি, তাহলে এই আমার পিঠ পেতে দিলাম। তোমরা প্রতিশোধ নাও। যদি আমি কারু সম্মানের ব্যাপারে গালি দিয়ে থাকি, তাহলে তোমরা তারও প্রতিশোধ নিয়ে নাও’। এরপর তিনি মিম্বর থেকে নামলেন ও যোহরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর পুনরায় মিম্বরে বসলেন এবং পূর্বের কথার পুনরুক্তি করলেন। তখন একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, আপনার নিকট আমার ৩টি দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) পাওনা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) স্বীয় চাচাতো ভাই ফযল বিন আববাসকে সেটা দেবার জন্য বলে দিলেন। অতঃপর তিনি আনছারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শুরু করলেন’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৫-৬৬)। বর্ণনাটি প্রমাণিত নয়। ইবনু কাছীর উক্ত ঘটনার বিষয়ে বলেন, وفي إسناده ومتنه غرابة شديدة ‘বর্ণনাটির সনদে ও মতনে কঠিন ধরনের বিস্ময়কর বস্তু রয়েছে’ (আল-বিদায়াহ ৫/২৩১)।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নভেম্বর ১৯৮৮-তে নিজের অনূদিত উর্দূ ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত অনেক ভুল সংশোধিত হলেও এটি সংশোধিত হয়নি। এমনকি লাহোর দার সালাফিইয়াহর বিজ্ঞ প্রকাশকগণও এটা খেয়াল করেননি। এভাবেই বিদ্বানগণ তাদের পরবর্তীদের জন্য অনেক খিদমতের সুযোগ রেখে যান। অতএব সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। -লেখক।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর চার দিন পূর্বে শেষ বৃহস্পতিবার

বৃহস্পতিবার রাসূল (ছাঃ)-এর রোগযন্ত্রণা বেড়ে যায়। পরে যন্ত্রণা খুব বৃদ্ধি পেলে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন,هَلُمُّوا أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ ‘কাগজ-কলম নিয়ে এসো! আমি তোমাদের জন্য লিখে দিয়ে যাই। যাতে তোমরা পরে পথভ্রষ্ট না হও’। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ওমর (রাঃ) বললেন,قَدْ غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ، حَسْبُنَا كِتَابُ اللهِ ‘তাঁর উপরে এখন রোগ যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। তোমাদের নিকটে কুরআন রয়েছে। আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট’। এতে গৃহবাসীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ কাগজ-কলম আনতে চান। কেউ নিষেধ করেন। ফলে এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) বললেন,قُوْمُوْا عَنِّىْ ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও’।[1]

শী‘আদের ভুল ধারণা

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুকালীন রোগশয্যায় আমাকে বললেন,ادْعِى لِى أَبَا بَكْرٍ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ كِتَابًا فَإِنِّى أَخَافُ أَنْ يَتَمَنَّى مُتَمَنٍّ وَيَقُولَ قَائِلٌ أَنَا أَوْلَى. وَيَأْبَى اللهُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‘তোমার পিতা আবুবকর ও তোমার ভাই (আব্দুর রহমান)-কে আমার কাছে ডেকে আন। আমি তাদেরকে একটি কাগজ লিখে দেব। কেননা আমি ভয় পাচ্ছি যে, কোন উচ্চাভিলাষী (খেলাফতের) উচ্চাকাংখা পোষণ করতে পারে এবং কোন ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে, আমিই এর অধিক হকদার(أَنَا أَوْلَى)। অথচ আল্লাহ ও মুমিনগণ আবুবকর ব্যতীত অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে’।[2]

এতে বুঝা যায় যে, খিলাফত লিখে দিলে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর নামেই লিখতেন। আয়েশা (রাঃ)-এর বাধার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। অথচ আলী (রাঃ) প্রথম খলীফা না হওয়ার জন্য শী‘আরা অন্যায়ভাবে তাঁকেই দায়ী করে থাকে।

[1]. বুখারী হা/৭৩৬৬; মুসলিম হা/১৬৩৭; মিশকাত হা/৫৯৬৬ ‘মক্কা হ’তে ছাহাবীগণের হিজরত ও রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাত’ অনুচ্ছেদ।

এ ঘটনা থেকে শী‘আরা ধারণা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) হযরত আলীর নামে ‘খিলাফত’ লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) সেটা হতে দেননি। অতএব আবুবকর, ওমর, ওছমান সবাই তাদের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে খেলাফত ছিনতাইকারী এবং কাফের (নাঊযুবিল্লাহ)। এজন্য ইবনু আববাস (রাঃ) রাবী সুলায়মান আল-আহওয়ালের সামনে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, يَوْمُ الْخَمِيسِ، وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ বৃহস্পতিবার, হায় বৃহস্পতিবার! এসময় তাঁর চোখের পানিতে কংকর-বালু ভিজে যায়। মদীনার শ্রেষ্ঠ সপ্ত ফক্বীহর অন্যতম ওবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উৎবাহ বিন মাসঊদ বলেন, ইবনু আববাস (রাঃ) উক্ত ঘটনা স্মরণ করে প্রায়ই বলতেন, إِنَّ الرَّزِيَّةَ كُلَّ الرَّزِيَّةِ ‘হায় বিপদ চরম বিপদ, যা লোকদের শোরগোল ও রাসূল (ছাঃ)-এর অছিয়ত লিখে দেওয়ার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল’ (বুখারী হা/৪৪৩২; মুসলিম হা/১৬৩৭; মিশকাত হা/৫৯৬৬; বঙ্গানুবাদ হা/৫৭১৪)। অথচ আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ (বুখারী হা/৫৬৬৬; মিশকাত হা/৫৯৭০) দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর নবী (ছাঃ) যদি ‘খিলাফত’ লিখতেন, তবে সেটা আবুবকর (রাঃ)-এর নামেই লিখতেন।

[2]. মুসলিম হা/২৩৮৭; মিশকাত হা/৬০১২; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭৬৭ ‘আবুবকরের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৫৬৬৬; মিশকাত হা/৫৯৭০; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭১৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
 তিনটি অছিয়ত (الوصايا الثلاثة)
অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সবাইকে তিনটি অছিয়ত করেন।-

(১) ইহূদী, নাছারা ও মুশরিকদের আরব উপদ্বীপ থেকে বের করে দিয়ো।
(২) প্রতিনিধিদলের সম্মান ও আপ্যায়ন অনুরূপভাবে করো, যেভাবে আমি করতাম।[1]
(৩) তৃতীয় অছিয়তটির কথা রাবী সুলায়মান আল-আহওয়ালের বর্ণনায় আসেনি’ (বুখারী হা/৩১৬৮)। তবে ছহীহ বুখারীর ‘অছিয়ত সমূহ’ অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন আবু ‘আওফা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, সেটি ছিল আল্লাহর কিতাবকে অাঁকড়ে ধরো’ (বুখারী হা/২৭৪০)।

[1]. বুখারী হা/৩০৫৩; মুসলিম হা/১৬৩৭; মিশকাত হা/৪০৫২, ৪০৫৩, ৫৯৬৬।

রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ ইমামতি

মৃত্যুর চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবার মাগরিবের ছালাতের ইমামতিই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ ইমামতি। অসুখ সত্ত্বেও তিনি এযাবত প্রতি ওয়াক্ত ছালাতে ইমামতি করেছেন। সর্বশেষ এই ইমামতিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রথম দু’রাক‘আতে সূরা মুরসালাত পাঠ করেন’। যার সর্বশেষ আয়াত ছিলفَبِأَيِّ حَدِيْثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُوْنَ ‘এর পরে কোন্ বাণীর উপরে তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে’? (মুরসালাত ৭৭/৫০)। অর্থাৎ কুরআনের পরে আর কোন্ কালামের উপরে তোমরা ঈমান আনবে?

এর দ্বারা যেন তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, আল্লাহ পাকের আহবানের সাথে সাথে উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি আমার জীবনের সর্বশেষ আহবান হ’ল, সর্বাবস্থায় তোমরা কুরআনের বিধান মেনে চলবে। কোন অবস্থাতেই কুরআন ছেড়ে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না।[1]

[1]. অথচ উম্মতে মুহাম্মাদী এখন কুরআন ছেড়ে জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের অনুসরণ করছে। ফলে পদে পদে তারা লাঞ্ছিত ও অধঃপতিত হচ্ছে।

আবু বকরের ইমামতি শুরু

এশার ছালাতের জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তিনবার ওযূ করেন ও তিনবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে আবুবকরকে ইমামতি করার নির্দেশ পাঠান। এরপর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত আবুবকর (রাঃ) একটানা ১৭ ওয়াক্ত ছালাতের ইমামতি করেন।[1] লোকেরা খারাপ ধারণা করবে মনে করে আয়েশা (রাঃ) তিন থেকে চারবার তার পিতার ইমামতির ব্যাপারে আপত্তি তুলে অন্যকে ইমামতির দায়িত্ব প্রদানের অনুরোধ করেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন,إِنَّكُنَّ صَوَاحِبُ يُوْسُفَ، مُرُوْا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ ‘তোমরা ইউসুফের সহচরীদের মত হয়ে গেছ। আবুবকরকে বলে দাও যেন সে ছালাতে ইমামতি করে’।[2] অর্থাৎ যুলায়খা ও তার সহচরী মহিলারা যেভাবে ইউসুফকে অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিল, তোমরাও তেমনি আমাকে আবুবকরকে বাদ দিয়ে অন্যকে ইমামতি করার মত অন্যায় নির্দেশ দানে প্ররোচিত করতে চাও? এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ খেলাফতের জন্য আবুবকরের প্রতি ইঙ্গিত ছিল। হযরত ওমর (রাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই সম্ভবতঃ তাঁর নাম খলীফা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন এবং সাথে সাথেই সর্বসম্মতভাবে তা গৃহীত ও অভিনন্দিত হয়। তাছাড়া তাঁর তুলনীয় ব্যক্তিত্ব উম্মতের মধ্যে তখনও কেউ ছিল না। ভবিষ্যতেও হবে না।

[1]. এই ১৭ ওয়াক্ত ছালাতের কোন ক্বাযা বা কাফফারা রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে কেউ আদায় করেননি। কারণ এটি দৈহিক ইবাদত। যা নিজেকেই আদায় করতে হয়। অন্যের উপর তা বর্তায় না। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, لاَ يَصُومُ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ وَلاَ يُصَلِّي أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ ‘একজনের ছিয়াম বা ছালাত অন্যজনে আদায় করতে পারে না’ (মুওয়াত্ত্বা হা/১০৬৯; সনদ মুনক্বাতে‘ বা ছিন্নসূত্র। কিন্তু বায়হাক্বীতে এটি সংযুক্ত সনদে এসেছে (বায়হাক্বী হা/৮০০৪, ৪/২৫৪)। যার সনদ ছহীহ। আলবানী, হিদায়াতুর রুওয়াত শরহ মিশকাত হা/১৯৭৭ টীকা-২, ২/৩৩৬; মিশকাত হা/২০৩৫)। অতএব জানাযাকালে মৃতের ক্বাযা ছিয়াম ও ছালাতের কাফফারা স্বরূপ টাকা-পয়সা নেওয়া বা দান করা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র।

[2]. বুখারী হা/৬৭৯ ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৪৬; মিশকাত হা/১১৪০।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বে সর্বশেষ অভিযান

শনিবারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কিছুটা হালকা বোধ করেন।[1] এমতাবস্থায় তিনি দু’জনের কাঁধে ভর করে মসজিদে আগমন করেন। তখন আবুবকর (রাঃ)-এর ইমামতিতে যোহরের জামা‘আত শুরু হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর আগমন টের পেয়ে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসার উদ্যোগ নিতেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে আবুবকর (রাঃ)-এর বামপাশে বসিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি তখন রাসূল (ছাঃ)-এর ইক্বতেদা করতে থাকেন এবং লোকদেরকে তাকবীর শুনাতে থাকেন’।[2] বস্ত্ততঃ এটাই ছিল ছালাতে মুকাবিবর হওয়ার প্রথম ঘটনা। আর আবুবকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ‘মুকাবিবর’।

তাছাড়া এদিন তিনি উসামাহ বিন যায়েদ-এর নেতৃত্বে শাম অঞ্চলে সর্বশেষ সেনাদল প্রেরণ করেন (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ৯০)।

[1]. ফাৎহুল বারী ‘যে রোগে তাঁর মৃত্যু হয়, সেই অবস্থায় রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক উসামার সেনাদল প্রেরণ’ অনুচ্ছেদ-এর আলোচনা হা/৪৪৬৬-এর পরে।
[2]. বুখারী হা/৭১৩; মুসলিম হা/৪১৮; মিশকাত হা/১১৪০।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) উম্মতের প্রতি তীব্র দায়িত্বানুভূতির কারণে মৃত্যুর প্রাক্কালে রাসূল (ছাঃ) গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমটি ছিল তাঁর পরবর্তী খলীফা নির্বাচন বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান। কারণ নেতৃত্বের ঐক্য ব্যতীত জাতির ঐক্য সম্ভব নয়। এজন্য আবুবকর (রাঃ)-এর ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ও আচরণসমূহ থাকা সত্ত্বেও তিনি সেটি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তাই লেখা সম্ভব হয়নি। অবশেষে তাঁর আগ্রহই কার্যকর হয় এবং আবুবকর (রাঃ) সর্বসম্মতভাবে উম্মতের ‘খলীফা’ নির্বাচিত হন। এতে নির্দেশনা রয়েছে যে, ইসলামে আমীর নির্বাচনের সর্বোত্তম পদ্ধতি হ’ল পূর্বতন আমীরের অছিয়ত। যা পরে আবুবকর (রাঃ) ওমর (রাঃ)-এর ব্যাপারে করেছিলেন। অথবা উম্মতের সেরা ব্যক্তিদের মধ্য হ’তে পূর্বতন আমীরের বাছাইকৃত ব্যক্তিগণের একজন। যা সেরা ব্যক্তিগণের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। যেমন ওমর ফারূক (রাঃ) করে গিয়েছিলেন। (দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ বই)।

(২) দ্বিতীয়টি ছিল বহিঃশত্রুর হাত থেকে ইসলামী খিলাফতকে রক্ষার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনার নির্দেশ দান। এর মাধ্যমে তিনি নিজের মৃত্যুর চাইতে উম্মতের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন। যা পরবর্তী খলীফাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে রয়ে যায়।

(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর এই দায়িত্ব সচেতন কর্মকান্ডের মধ্যে যেকোন দায়িত্বশীল মুমিন ব্যক্তির জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কারণ প্রত্যেকেই ক্বিয়ামতের দিন স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে (মুসলিম হা/১৮২৯ (২০)।

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর একদিন পূর্বে

সম্ভবতঃ মৃত্যুর পূর্বদিন রবিবার তিনি স্ত্রী আয়েশাকে বলেন, দীনারগুলি কি বিতরণ করেছ? তিনি বললেন, আপনার রোগ যন্ত্রণায় ব্যস্ত থাকার কারণে বিতরণের সময় পাইনি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওগুলি আমার কাছে নিয়ে এস। ঐ সময় ঘরে ৫ থেকে ৯টি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। আয়েশা (রাঃ) সেগুলি এনে তাঁর হাতে দিলেন। তখন তিনি বললেন, এগুলি এখুনি বিতরণ করে দাও। কেননা কোন নবীর জন্য এটি মর্যাদাকর নয় যে, এইরূপ (নিকৃষ্ট) বস্ত্তগুলি নিয়ে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবেন’।[1] অথচ ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।[2]

[1]. আহমাদ হা/২৫৫৩১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩২১২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/১৮৮৪, ঐ মিরক্বাত।

‘তিনি এদিন সকল গোলাম আযাদ করে দেন এবং অস্ত্র-শস্ত্র সব মুসলমানদের দিয়ে দেন। অথচ ঐদিন সন্ধ্যায় আয়েশা (রাঃ)-এর গৃহে বাতি জ্বালানোর মত তৈল ছিল না। ফলে প্রতিবেশীর নিকট থেকে তৈল ধার করে আনতে হয়’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৭ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৪৮-৪৯)। কথাগুলির কোন সূত্র পাওয়া যায়নি।

[2]. বুখারী হা/২৯১৬; মিশকাত হা/২৮৮৫ ‘বন্ধক’ অনুচ্ছেদ।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url