প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৬৫] || মহানবীর জীবনী ||




আল কুরআন একটি জীবন্ত মু’জেযা হওয়ার প্রমাণসমূহ

(তৃতীয় অংশ)
[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

কুরআন সহজে মুখস্থ হবার যোগ্য

কুরআন এমনই এক গ্রন্থ যা সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। একটু চেষ্টা করলেই তা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। মাতৃভাষা বাংলায় একশ’ পৃষ্ঠার একটা গদ্য বা পদ্যের বই হুবহু কেউ মুখস্থ করতে পারবে কি-না সন্দেহ। অথচ ছয়শো পৃষ্ঠার অধিক পুরো কুরআন মুখস্থকারী বাংলাভাষীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে লাখ লাখ হবে।

ইহূদী, নাছারা, ফার্সী, হিন্দু, বৌদ্ধ কেউ কি একথা দাবী করতে পারবে যে, তাদের কেউ তাদের ধর্মগ্রন্থ আগাগোড়া মুখস্থ বলতে পারে? এ দাবী কেবল মুসলমানেরাই করতে পারে। আর কেউ নয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ। বস্ত্ততঃ কুরআনকে হেফাযতের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর ওয়াদার এটাও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।

সর্বাধিক পঠিত ইলাহী গ্রন্থ

কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও প্রচারিত ইলাহী গ্রন্থ। আল্লাহ বলেন, وَكِتَابٍ مَسْطُوْرٍ، فِيْ رَقٍّ مَنْشُوْرٍ ‘কসম ঐ কেতাবের যা লিখিত হয়েছে’ ‘বিস্তৃত পত্রে’ (তূর ৫২/২-৩)। এখানে কুরআন মজীদের তিনটি বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে- ‘কিতাব’ (গ্রন্থ), ‘মাসতূর’ (লিখিত) এবং ‘মানশূর’ (বিস্তৃত)। বস্ত্ততঃ কুরআন সর্বাধিক উচ্চারিত ও বিস্তৃত গ্রন্থ এ কারণে যে, তা মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে। কুরআন প্রচারের জন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া অপরিহার্য নয়। যেকোন মুমিন কুরআন মুখস্থ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে যতদিন পৃথিবীতে মুসলমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে কুরআন থাকবে ইনশাআল্লাহ।

কুরআন সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ 

কুরআন এমনই একটি গ্রন্থ, যার প্রতিটি কথাই চূড়ান্ত সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। পরিস্থিতির কারণে যে সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর কালামের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।

মানুষ সাধারণতঃ অধিকাংশের মত অনুযায়ী চলে। তাই অধিকাংশের দোহাই দিয়ে মানুষ যেন সত্যকে এড়িয়ে না যায়, সে বিষয়ে সাবধান করে পরের আয়াতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।

 কুরআন সিদ্ধান্তকারী গ্রন্থ
মানুষ যত সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক, তা যুগে যুগে পরিবর্তনশীল। কারণ সে তার ভবিষ্যৎ মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখে না। কিন্তু আল্লাহ কালের স্রষ্টা। তাঁর জ্ঞান অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ কোন কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি মানুষের ভূত ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখেন। তাই তাঁর বিধান অভ্রান্ত ও চূড়ান্ত। মানুষ যতদিন আল্লাহর বিধান মতে চলবে, ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে। বস্ত্ততঃ কোন ধর্মগ্রন্থই নিজেকে إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ ‘নিশ্চয়ই এটি সিদ্ধান্তকারী বাণী’ (ত্বারেক ৮৬/১৩) বলে ঘোষণা দেয়নি। এটা কেবল কুরআনেরই বৈশিষ্ট্য। কেননা কুরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহর সর্বশেষ প্রেরিত কিতাব।

কুরআন ব্যাপক অর্থবোধক গ্রন্থ 

কুরআনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এর কোন আয়াত কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে নাযিল হ’লেও তার অর্থ হয় ব্যাপক ও সর্বযুগীয়। যাতে সকল যুগের সকল মানুষ এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও উপকৃত হয়। যেমন (১) সূরা ‘আলাক্ব’-এর ৬ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত মক্কার মুশরিক নেতা আবু জাহ্ল সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু এর বক্তব্য সকল যুগের ইসলামদ্রোহী নেতাদের প্রতি প্রযোজ্য। অমনিভাবে (২) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, সূরা আহক্বাফ ১৫ আয়াতটি হযরত আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِي إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘... অবশেষে যখন সে পূর্ণ বয়স্ক হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয় তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দান করেছ এবং আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্ম সমূহ করতে পারি। তুমি আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম (তওবা করলাম) এবং আমি তোমার আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ৪৬/১৫)।

এই দো‘আ কবুল করে আল্লাহ তাকে এমন তাওফীক দান করেন যে, তাঁর চার পুরুষ অর্থাৎ তিনি নিজে, তাঁর পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও পৌত্রাদি ক্রমে সবাই মুসলমান হয়ে যান। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেবল আবুবকর (রাঃ)-কেই আল্লাহ এই সৌভাগ্য দান করেন। কিন্তু আয়াতের উদ্দেশ্য হ’ল সকল মুসলমানকে এই নির্দেশনা দেওয়া যে, বয়স চল্লিশ বছর হয়ে গেলে তার মধ্যে পরকাল চিন্তা প্রবল হওয়া উচিত এবং বিগত গোনাহসমূহ হ’তে তওবা করা উচিত। আর সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনদার ও সৎকর্মশীল করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। নির্দিষ্ট ও ব্যাপক অর্থবোধক এই দ্বৈত ভাবধারা কুরআনী ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির এক অনন্য দিক, যা অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে নেই।

(২) কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল এর ‘মাছানী’ (مَثَانِي) নীতি। অর্থাৎ যেখানেই জান্নাতের সুসংবাদ। তার পরেই জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلًا بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَأَمَّا الَّذِينَ فَسَقُوا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا وَقِيلَ لَهُمْ ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়ন স্বরূপ রয়েছে বসবাসের জান্নাত’। ‘আর যারা অবাধ্যতা করে, তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, জাহান্নামের যে শাস্তিকে তোমরা মিথ্যা বলতে, তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সাজদাহ ৩২/১৯-২০)। কুরআনের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এরূপ প্রমাণ মিলবে। যাতে পাঠকের মনে বারবার জান্নাত ও জাহান্নামের দোলা দেয়। যাতে তার মধ্যে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আকুতি সৃষ্টি হয় ও জান্নাতের প্রতি আকাংখা প্রবল হয়। এভাবে সে প্রকাশ্য ও গোপন সকল পাপ থেকে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়।

কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সত্যায়নকারী

কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী সকল এলাহী কিতাবের সত্যায়ন করেছে এবং সেগুলির সুন্দর শিক্ষাসমূহের প্রশংসা করেছে। এজন্য কুরআনের একটি নাম হ’ল مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ‘পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী’।[1]

[1]. বাক্বারাহ ২/৯৭; আলে ইমরান ৩/৩; মায়েদাহ ৫/৪৬; ফাত্বির ৩৫/৩১; আহক্বাফ ৪৬/৩০।

 কুরআন জিন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জকারী

কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা জিন ও ইনসান উভয় জাতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনার জন্য এবং তারা যে ব্যর্থ হবে, সে কথাও বলে দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا ‘তুমি বলে দাও, যদি মানুষ ও জিন জাতি একত্রিত হয়ে পরস্পরের সহযোগিতায় কুরআনের ন্যায় একটি কিতাব নিয়ে আসতে চায়, তবুও তারা তা পারবে না’ (ইসরা ১৭/৮৮)। এমনকি তারা অনুরূপ একটি ‘সূরা’ (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) বা ১০টি আয়াতও (হূদ ১১/১৩-১৪) রচনা করতে পারবে না। অর্থাৎ একটিও নয়। এভাবে কুরআন মক্কায় মুশরিকদের চারবার[1] এবং মদীনায় ইহূদী-নাছারাদের একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) চালেঞ্জ করেছে। কিন্তু ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস তখনও কারু হয়নি, আজও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। এটা কুরআনের জীবন্ত মু‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল। যা পৃথিবীর সর্বযুগের সকল বিদ্বানকে পরাজিত করেছে ও তাদেরকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে।

[1]. ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯।
 কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ- ২৫. বাতিল হ’তে নিরাপদ (السالم من الأباطيل)
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা সর্বাবস্থায় বাতিল ও মিথ্যা হ’তে নিরাপদ। কুরআনের শত্রুরা এতে একটি বর্ণও ঢুকাতে পারেনি বা বের করতে পারেনি এবং পারবেও না কখনো। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘তার সম্মুখ দিয়ে বা পিছন দিয়ে কখনোই বাতিল প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। তিনি বলেন, وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ مُبَشِّرًا وَنَذِيْرًا ‘আমরা সত্যসহ এ কুরআন নাযিল করেছি এবং সত্যসহ এটা নাযিল হয়েছে। আমরা তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি’ (বনু ইসরাঈল ১৭/১০৫)।

কুরআন থেকে মুখ ফিরানোই হ’ল জাতির অধঃপতনের মূল কারণ
কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াকেই উম্মতের অধঃপতনের কারণ বলে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় পালনকর্তার নিকটে ওযর পেশ করে বলবেন, وَقَالَ الرَّسُوْلُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوْا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوْرًا ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)। অন্যদিকে যালেমদের কৈফিয়ত হবে আরও করুণ।

যেমন আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً- يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً- لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- ‘যেদিন যালেম নিজের দু’হাত কামড়িয়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূল-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম’! ‘হায়! যদি আমি অমুককে (শয়তানকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’! ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকটে উপদেশ (কুরআন) এসে যাবার পর। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য মহা প্রতারক’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।

হাদীছের পরিচয়

আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوْحَى ‘তিনি নিজ থেকে (দ্বীন বিষয়ে) কোন কথা বলেন না’। ‘যা বলেন অহী করা হ’লেই তবে বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। সেকারণ রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ হেফাযতের দায়িত্বও আল্লাহ নিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ‘অতঃপর কুরআনের ব্যাখ্যা দানের দায়িত্ব আমাদেরই’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)। তিনি বলেন وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ‘আমরা তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি কেবল এজন্য যে, তুমি তাদেরকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দিবে যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে এবং (এটি নাযিল করেছি) মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত স্বরূপ’ (নাহল ১৬/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَاناً لِّكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমরা তোমার উপর কুরআন নাযিল করেছি সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে’.. (নাহল ১৬/৮৯)। ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হি.) বলেন, এর অর্থ بِالسُّنَّةِ ‘সুন্নাহ দ্বারা’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ সুন্নাহ সহ কুরআন সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেমন কুরআনে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জ ফরয করা হয়েছে। কিন্তু হাদীছে তার নিয়ম-কানূন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেকারণ আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)। আর সেটাই হ’ল রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ ‘আর আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি কেবল এজন্য যে, তাদের আনুগত্য করা হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (নিসা ৪/৬৪)।

একদা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হাদীছ শুনিয়ে বলেন, আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐসব মহিলাদের প্রতি, যারা অপরের অঙ্গে উল্কি করে ও নিজেদের অঙ্গে উল্কি করে। যারা (কপাল বা ভ্রুর) চুল উপড়িয়ে ফেলে এবং সৌন্দর্যের জন্য দাঁত সরু ও তার ফাঁক বড় করে। যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বদলিয়ে ফেলে। এ কথা বনু আসাদ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে ইয়াকূবের কর্ণগোচর হ’লে তিনি এসে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে বলেন, আপনি নাকি এরূপ এরূপ কথা বলেছেন? জবাবে তিনি বলেন, আমি কেন তাকে লা‘নত করব না, যাকে আল্লাহর রাসূল লা‘নত করেছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে আছে? মহিলা বললেন, আমি কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। কিন্তু কোথাও একথা পাইনি। ইবনু মাসঊদ বললেন, আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়লে অবশ্যই পেতেন। আপনি কি পড়েননি যে আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা বর্জন কর’ (সূরা হাশর ৫৯/৭)। মহিলা বললেন, হ্যাঁ, পড়েছি। তখন তিনি বললেন, রাসূল (ছাঃ) এটি নিষেধ করেছেন। এরপর মহিলাটি বললেন, সম্ভবতঃ আপনার পরিবারে এটি করা হয়। ইবনু মাসঊদ বললেন, তাহ’লে যেয়ে দেখে আসুন। অতঃপর মহিলাটি ভিতরে গেলেন। কিন্তু সেরূপ কিছু না পেয়ে ফিরে এসে বললেন, আমি কিছুই পেলাম না। তখন ইবনু মাসঊদ বললেন, এরূপ কিছু থাকলে আমরা কখনোই একত্রিত থাকতাম না (অর্থাৎ তালাক দিতাম)।[1]

বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ) হ’লেন মানদন্ড। যেমন তিনি বলেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[2] প্রখ্যাত তাবেঈ সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না (১০৭-১৯৮ হিঃ) বলেন, الْمِيزَانُ الْأَكْبَرُ هُوَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تُعْرَضُ الْأَشْيَاءُ كُلُّهَا عَلَيْهِ ... فَمَا وَافَقَهُ فَهُوَ حَقٌّ، وَمَا خَالَفَهُ فَهُوَ بَاطِلٌّ ‘শ্রেষ্ঠতম মানদন্ড হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। সকল বিষয় তার উপরেই ন্যস্ত হবে।... অতঃপর যেটি তার অনুকূলে হবে, সেটি সত্য এবং যেটি তার বিরোধী হবে, সেটি মিথ্যা’।[3]

কুরআন সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক বিধান সম্বলিত। সেকারণ তা সবার মুখস্থ এবং তা অবিরত ধারায় বর্ণিত (মুতাওয়াতির)। কিন্তু হাদীছ হ’ল শাখা-প্রশাখা সহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত। তাই কেবল শ্রোতার নিকটেই তা মুখস্থ। শ্রোতার সংখ্যা একাধিক হ’লে ও সকল যুগে বহুল প্রচারিত হ’লে তা হয় ‘মুতাওয়াতির’। যা সব হাদীছের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কুচক্রীরা তাই সুযোগ নিয়েছিল জাল হাদীছ বানানোর। কিন্তু আল্লাহ সে চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছেন এবং তাঁর রাসূলের হাদীছসমূহকে হেফাযত করেছেন। ইমাম মালেক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখের ন্যায় অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তি সৃষ্টি করে আল্লাহ ছহীহ হাদীছগুলিকে পৃথক করে নিয়েছেন। ফলে জাল-যঈফের হামলা থেকে হাদীছ শাস্ত্র নিরাপদ হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন নবী-রাসূলের বাণী ও কর্মের হেফাযতের জন্য এমন নিখুঁত ব্যবস্থাপনা কেউ কখনো দেখেনি বা শোনেনি।

রাসূল বিদ্বেষী জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) হাফেয ইবনু হাজারের আল-ইছাবাহ গ্রন্থ রিভিউ করে তার ভূমিকায় নিরুপায় হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘পৃথিবীতে এমন কোন জাতি অতীতে ছিল না এবং বর্তমানেও নেই, যারা মুসলমানদের ন্যায় রিজাল শাস্ত্রের অনুরূপ কোন শাস্ত্র সৃষ্টি করেছে। যার ফলে আজ প্রায় পাঁচ লক্ষ জীবন চরিত সম্পর্কে জানা যায়’ (মর্মার্থ)।[4] বলা বাহুল্য, এগুলি কেবল বর্ণনাকারী ছাহাবীদের হিসাব নয়, বরং তাঁদের নিকট থেকে যারা শুনেছেন, সেই সকল সূত্র সমূহের সামষ্টিক হিসাব হ’তে পারে। রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে হেফাযতের জন্য এত বিরাট সংখ্যক মানুষের এই অতুলনীয় প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে তার জীবন্ত মো‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল।

[1]. বুখারী হা/৪৮৮৬; মুসলিম হা/২১২৫; মিশকাত হা/৪৪৩১ ‘পোষাক’ অধ্যায়, ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪।
[3]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘ লি আখলাক্বির রাবী হা/৮ (মর্মার্থ)।
[4]. সুলায়মান নাদভী, Muhammad The Ideal Prophet পৃঃ ৪০; গৃহীত : Al-Isabah, I, P. 1.



There is no nation, nor there has been any which like them has during twelve centuries recorded the life of every man of letters. If the biographical records of the Mohammadans were collected, we should probably have accounts of the lives of half a million of distinguished persons, and it would be found that there is not a decennium of their history, not a place of importance which has not its representatives. Al-Isabah, I, P. 1.



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url