কেমন ছিল রাসুল (সা:) এর সালাত || রাসুলুল্লাহ (সা:) এর নামাজ || (পর্ব - ১৪)





মহান আল্লাহর বাণী- ‘সফলকাম হবে সেই সব মুমিন যারা সালাতে রত থাকে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে’। অতএব গভীরভাবে চিন্তা করুন! আপনার প্রভু আল্লাহ কিজন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন? মনে রাখবেন তিনি আপনাকে বিনা প্রয়োজনে সৃষ্টি করেননি। তাঁর সৃষ্ট এ সুন্দর সৃষ্টি জগতকে সুন্দরভাবে আবাদ করার দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই তিনি আপনাকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কে এখানে কত বেশী সুন্দর আমল করে এবং তার সৃষ্টিকর্তার হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তা পরীক্ষার জন্য আল্লাহ মউত ও হায়াতকে সৃষ্টি করেছেন। আপনার হাত-পা, চক্ষু-কর্ণ, নাসিকা-জিহবা সর্বোপরি যে মূল্যবান জ্ঞান-সম্পদ এবং ভাষা ও চিন্তাশক্তির নেয়ামত দান করে আপনাকে আপনার প্রভু এ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তার যথার্থ ব্যবহার আপনি করেছেন কি-না, তার কড়ায়-গন্ডায় হিসাব আপনাকে আপনার সৃষ্টিকর্তার নিকটে দিতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান ‘সালাতে’ রত হই ‘তাকবীরে তাহরীমা’-র মাধ্যমে দুনিয়ার সবকিছুকে হারাম করে একনিষ্ঠভাবে বিনম্রচিত্তে বিগলিত হৃদয়ে!! শ্রেষ্ট ইবাদত সালাত বা নামাজে সফলতার জন্য চাই সালাতের সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ। আর এই সঠিক পদ্ধতিটি পাওয়া যাবে কেবলমাত্র হযরত মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সালাত বা নামাজের মধ্যেই। তাই আমরা এখানে রাসুল (সা:) এর সালাত বা নামাজ কেমন ছিল এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করবো। পুরো আলোচনাটিই নেওয়া হয়েছে ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব রচিত “ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)” নামক গ্রন্থ থেকে। আল্লাহ আমাদেরকে সালাত বা নামাজের সকল বিষয়ে সঠিকভাবে জানার ও মানার তৌফিক দান করুন। আমিন।।

মৃত্যুর পরে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ এবং জানাযা বিষয়ে অন্যান্য জ্ঞাতব্য সমূহ

মৃত্যুর পরে প্রচলিত বিদ‘আত সমূহ

(১) মৃত্যুর আগে বা পরে মাইয়েতকে ক্বিবলার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া
(২) মাইয়েতের শিয়রে বসে সূরা ইয়াসীন বা কুরআন তেলাওয়াত করা (তালখীছ ৯৬, ৯৭)।
(৩) মাইয়েতের নখ কাটা ও গুপ্তাঙ্গের লোম ছাফ করা (৯৭)
(৪) কাঠি দিয়ে (বা নির্দিষ্ট সংখ্যক নিম কাঠি দিয়ে) দাঁত খিলাল করানো
(৫) নাক-কান-গুপ্তাঙ্গ প্রভৃতি স্থানে তুলা ভরা (৯৭)
(৬) দাফন না করা পর্যন্ত পরিবারের লোকদের না খেয়ে থাকা (৯৭)
(৭) বাড়ীতে বা কবরস্থানে এই সময় ছাদাক্বা বিলি করা (৯৯, ১০৩)
(৮) চীৎকার দিয়ে কান্নাকাটি করা, বুক চাপড়ানো, কাপড় ছেঁড়া, মাথা ন্যাড়া করা, দাড়ি-গোঁফ না মুন্ডানো ইত্যাদি (১৮, ৯৭)
(৯) তিন দিনের অধিক (সপ্তাহ, মাস, ছয় মাস ব্যাপী) শোক পালন করা (১৫, ৭৩) কেবল স্ত্রী ব্যতীত। কেননা তিনি ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করবেন
(১০) কাফির, মুশরিক, মুনাফিকদের জন্য দো‘আ করা (৪৮)
(১১) শোক দিবস (শোকের মাস ইত্যাদি) পালন করা, শোকসভা করা ও এজন্য খানাপিনার বা (কাঙ্গালী ভোজের) আয়োজন করা ইত্যাদি (৭৩-৭৪)
(১২) মসজিদের মিনারে বা বাজারে মাইকে অলি-গলিতে ‘শোক সংবাদ’ প্রচার করা (১৯, ৯৮)
(১৩) কবরের উপরে খাদ্য ও পানীয় রেখে দেওয়া। যাতে লোকেরা তা নিয়ে যায় (১০৩)
(১৪) মৃতের কক্ষে তিন রাত, সাত রাত (বা ৪০ রাত) ব্যাপী আলো জ্বেলে রাখা (৯৮)
(১৫) কাফনের কাপড়ের উপরে কুরআনের আয়াত ও দো‘আ-কালেমা ইত্যাদি লেখা (৯৯)
(১৬) এই ধারণা করা যে, মাইয়েত জান্নাতী হ’লে ওযনে হালকা হয় ও দ্রুত কবরের দিকে যেতে চায় (৯৯)
(১৭) মাইয়েতকে দূরবর্তী নেককার লোকদের গোরস্থানে নিয়ে দাফন করা (৯৯)
(১৮) জানাযার পিছে পিছে উচ্চৈঃস্বরে যিকর ও তেলাওয়াত করতে থাকা (১০০)
(১৯) জানাযা শুরুর প্রাক্কালে মাইয়েত কেমন ছিলেন বলে লোকদের কাছ থেকে সমস্বরে সাক্ষ্য নেওয়া (১০১)
(২০) জানাযার ছালাতের আগে বা দাফনের পরে তার শোকগাথা বর্ণনা করা (১০০)
(২১) জুতা পাক থাকা সত্ত্বেও জানাযার ছালাতে জুতা খুলে দাঁড়ানো (১০১)।
(২২) কবরে মাইয়েতের উপরে গোলাপ পানি ছিটানো (১০২)
(২৩) কবরের উপরে মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে ও পায়ের দিক থেকে মাথার দিকে পানি ছিটানো। অতঃপর অবশিষ্ট পানিটুকু কবরের মাঝখানে ঢালা (১০৩)
(২৪) তিন মুঠি মাটি দেওয়ার সময় প্রথম মুঠিতে ‘মিনহা খালাক্বনা-কুম’ দ্বিতীয় মুঠিতে ‘ওয়া ফীহা নু‘ঈদুকুম’ এবং তৃতীয় মুঠিতে ‘ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা-রাতান উখরা’ বলা (ত্বোয়াহা ৫৫; ১০২) (২৫) অথবা ‘আল্লা-হুম্মা আজিরহা মিনাশ শায়ত্বান’.... পাঠ করা (ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৩, ‘যঈফ’)। (২৬) কবরে মাথার দিকে দাঁড়িয়ে সূরায়ে ফাতিহা ও পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে সূরায়ে বাক্বারাহর শুরুর অংশ পড়া (১০২)
(২৭) সূরায়ে ফাতিহা, ক্বদর, কাফেরূণ, নছর, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই সাতটি সূরা পাঠ করে দাফনের সময় বিশেষ দো‘আ পড়া (১০২)
(২৮) কবরের কাছে বসে কুরআন তেলাওয়াত ও খতম করা (১০৪)
(২৯) কবরের উপরে শামিয়ানা টাঙ্গানো (১০৪)
(৩০) নির্দিষ্ট ভাবে প্রতি জুম‘আয় কিংবা সোম ও বৃহস্পতিবারে পিতা-মাতার কবর যেয়ারত করা (১০৫) (৩১) এতদ্ব্যতীত আশূরা, শবে মে‘রাজ, শবেবরাত, রামাযান ও দুই ঈদে বিশেষভাবে কবর যেয়ারত করা (৩২) কবরের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ানো ও সূরায়ে ফাতিহা ১ বার, ইখলাছ ১১ বার কিংবা সূরা ইয়াসীন ১ বার পড়া (১০৫)।
(৩৩) কুরআন পাঠকারীকে উত্তম খানা-পিনা ও টাকা-পয়সা দেওয়া বা এ বিষয়ে অছিয়ত করে যাওয়া (১০৪, ১০৬)
(৩৪) কবরকে সুন্দর করা (১০৭)।
(৩৫) কবরে রুমাল, কাপড় ইত্যাদি বরকত মনে করে নিক্ষেপ করা (১০৮) ।
(৩৬) কবরে চুম্বন করা (১০৮)।
(৩৭) কবরের গায়ে মৃতের নাম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা (১০৯)।
(৩৮) কবরের গায়ে বরকত মনে করে হাত লাগানো এবং পেট ও পিঠ ঠেকানো (১০৮)।
(৩৯) ত্রিশ পারা কুরআন (বা সূরা ইয়াসীন) পড়ে এর ছওয়াব সমূহ মৃতের নামে বখশে দেয়া (১০৬)। যাকে এদেশে ‘কুরআনখানী’ বলে।
(৪০) কাফেরূণ, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই চারটি ‘কুল’ সূরার প্রতিটি ১ লক্ষ বার পড়ে মৃতের নামে বখশে দেওয়া, যাকে এদেশে ‘কুলখানী’ বলে।
(৪১) কালেমা ত্বাইয়িবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ১ লক্ষ বার পড়ে মৃতের নামে বখশে দেওয়া, যাকে এদেশে ‘কালেমাখানী’ বলে।
(৪২) ১ম, ৩য়, ৭ম (বা ১০ম দিনে) বা ৪০ দিনে চেহলাম বা চল্লিশার অনুষ্ঠান করা
(৪৩) ‘খানা’র অনুষ্ঠান করা (১০৩)
(৪৪) যারা কবর খনন করে ও দাফনের কাজে সাহায্য করে, তাদেরকে মৃতের বাড়ী দাওয়াত দিয়ে বিশেষ খানার ব্যবস্থা করা। যাকে এদেশে ‘হাত ধোয়া খানা’ বলা হয়
(৪৫) আযান শুনে নেকী পাবে বা গোর আযাব মাফ হবে ভেবে মসজিদের পাশে কবর দেওয়া
(৪৬) কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ফাতিহা’ পাঠ করা (২০)
(৪৭) কাফন-দাফনের কাজকে নেকীর কাজ না ভেবে পয়সার বিনিময়ে কাজ করা
(৪৮) মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে আলো জ্বেলে ও মাইক লাগিয়ে রাত্রি ব্যাপী উচ্চৈঃস্বরে কুরআন খতম করা
(৪৯) মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা (১০৪, ১০৬)
(৫০) ছালাত, ক্বিরাআত ও অন্যান্য দৈহিক ইবাদত সমূহের নেকী মৃতদের জন্য হাদিয়া দেওয়া (১০৬)। যাকে এদেশে ‘ছওয়াব রেসানী’ বলা হয়
(৫১) আমল সমূহের ছওয়াব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নামে (বা অন্যান্য নেককার মৃত ব্যক্তিদের নামে) বখশে দেওয়া (১০৬)। যাকে এদেশে ‘ঈছালে ছওয়াব’ বলা হয়
(৫২) নেককার লোকদের কবরে গিয়ে দো‘আ করলে তা কবুল হয়, এই ধারণা করা (১০৮)।
(৫৩) মৃত্যুর সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় বলে ধারণা করা
(৫৪) জানাযার সময় স্ত্রীর নিকট থেকে মোহরানা মাফ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা
(৫৫) ঐ সময় মৃতের ক্বাযা ছালাত সমূহের বা উমরী ক্বাযার কাফফারা স্বরূপ টাকা আদায় করা
(৫৬) মৃত্যুর পরপরই ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে চাউল ও টাকা-পয়সা বিতরণ করা
(৫৭) দাফনের পরে কবরস্থানে মহিষ বা গবাদি-পশু যবহ করে গরীবদের মধ্যে গোশত বিতরণ করা (৫৮) লাশ কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় তিনবার নামানো
(৫৯) কবরে মাথার কাছে ‘মক্কার মাটি’ নামক আরবীতে ‘আল্লাহ’ লেখা মাটির ঢেলা রাখা
(৬০) মাইয়েতের মুখে ও কপালে আতর দিয়ে ‘আল্লাহ’ লেখা
(৬১) কবরে মোমবাতি, আগরবাতি ইত্যাদি দেওয়া
(৬২) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের সময় বদনায় পানি দিয়ে যাওয়া এই নিয়তে যে, মৃতের রূহ এসে ওযূ করে ছালাত আদায় করে যাবে
(৬৩) মৃতের ঘরে ৪০ দিন যাবৎ বিশেষ লৌহজাত দ্রব্য রাখা
(৬৪) মৃত্যুর ২০দিন পর রুটি বিলি করা ও ৪০ দিন পর বড় ধরনের ‘খানা’র অনুষ্ঠান করা
(৬৫) মৃতের বিছানা ও খাট ইত্যাদি ৭দিন পর্যন্ত একইভাবে রাখা
(৬৬) মৃতের পরকালীন মুক্তির জন্য তার বাড়ীতে মীলাদ বা ওয়ায মাহফিল করা
(৬৭) নববর্ষ, শবেবরাত ইত্যাদিতে কোন বুযর্গ ব্যক্তিকে ডেকে মৃতের কবর যিয়ারত করিয়ে নেওয়া ও তাকে বিশেষ সম্মানী প্রদান করা
(৬৮) শবেবরাতে ঘরবাড়ী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মৃত স্বামীর রূহের আগমন অপেক্ষায় তার পরিত্যক্ত কক্ষে বা অন্যত্রে সারা রাত জেগে বসে থাকা ও ইবাদত-বন্দেগী করা
(৬৯) ঈছালে ছওয়াবের অনুষ্ঠান করা
(৭০) নিজের কোন একটি বা একাধিক সমস্যা সমাধানের নিয়তে কবরের গায়ে বা পাশের কোন গাছের ডালে বিশেষ ধরনের সুতা বা ইটখন্ড ঝুলিয়ে রাখা।
(৭১) মাযার থেকে ফিরে আসার সময় কবরের দিকে মুখ করে বেরিয়ে আসা
(৭২) মৃত্যুর আগেই কবর তৈরী করা (১০৪)
(৭৩) কবরে মৃত ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্ত্ত সমূহ রাখা এই ধারণায় যে, সেগুলি তার কাজে আসবে
(৭৪) কবরে কা‘বা গৃহের কিংবা কোন পীরের কবরের গেলাফের অংশ কিংবা তাবীয লিখে দাফন করা এই ধারণায় যে, এগুলি তাকে কবর আযাব থেকে বাঁচিয়ে দেবে
(৭৫) কবরে ‘ওরস’ উপলক্ষে বা অন্য সময়ে রান্না করা খিচুড়ী বা তৈরী করা রুটি বা মিষ্টি ‘তাবাররুক’ নাম দিয়ে বরকতের খাদ্য মনে করে ভক্ষণ করা
(৭৬) আজমীরে খাজাবাবার কবরে টাকা পাঠানো বা অন্য কোন পীর বাবার কবরে গরু-ছাগল, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য হাদিয়া পাঠানো
(৭৭) কবরের মধ্যবর্তী স্থানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে মৃতের জন্য দো‘আ পড়া
(৭৮) কবরের উপরে একটি বা চার কোণে চারটি কাঁচা খেজুরের ডাল পোতা বা কোন গাছ লাগানো এই ধারণা করে যে, এর প্রভাবে কবর আযাব হালকা হবে।
(৭৯) খাটিয়া ও মাইয়েত ঢাকার কাপড় খুব সুন্দর করা (৯৯)
(৮০) কালেমা ও পবিত্র কুরআনের আয়াত লিখিত কালো কাপড় দিয়ে খাটিয়া ঢাকা।
(৮১) মৃতের প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় পৃথক পৃথক দো‘আ পড়া (৯৮)
(৮২) জানাযা বহনের সাথে সাথে ছাদাক্বা বিতরণ করা এবং লোকদের কোল্ড ড্রিংকস পান করানো (৯৯)
(৮৩) লাশের নিকট ভিড় করা (৯৯)
(৮৪) মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বা অন্য কোন উপলক্ষে দিনভর উচ্চৈঃস্বরে তার বক্তৃতা বা কুরআনের ক্যাসেট বাজানো
(৮৫) বিশেষ কোন নেককার ব্যক্তির কবর থাকার কারণে জনপদের লোকেরা রূযিপ্রাপ্ত হয় ও আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হয় বলে ধারণা পোষণ করা (১০৬)।
(৮৬) জানাযা শুরুর পূর্বে ইমামের পক্ষ থেকে মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে উচ্চৈঃস্বরে ‘নিয়ত’ বলে দেওয়া
(৮৭) ইমাম ও মুক্তাদীর ‘ছানা’ পড়া (১০১)।
(৮৮) সূরা ফাতিহা ও একটি সূরা ছাড়াই জানাযার ছালাত আদায় করা (১০১)।
(৮৯) জানাযা শেষ হবার পরেই সেখানে দাঁড়িয়ে অথবা দাফন শেষে একজনের নেতৃত্বে সকলেদু’হাত তুলে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত করা।
(৯০) জানাযার সময়ে সকলকে মৃতের বাড়ীতে কুলখানির অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া।

উপরে বর্ণিত বিষয়গুলি ছাড়াও মৃত ব্যক্তি ও কবরকে কেন্দ্র করে হাযারো রকমের শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ উপমহাদেশে মুসলিম সমাজে চালু আছে। অতএব প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হবে এসকল শিরক ও বিদ‘আতী কর্মকান্ড হ’তে দূরে থাকা। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।- আমীন!!

জানা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি কবরের উপরে যে খেজুরের দু’টি কাঁচা চেরা ডাল পুঁতেছিলেন, সেটা ছিল তাঁর জন্য ‘খাছ’। তাঁর বা কোন ছাহাবীর পক্ষ থেকে পরবর্তীতে এমন কোন আমল করার নযীর নেই বুরাইদা আসলামী (রাঃ) ব্যতীত। কেননা তিনি এটার জন্য অছিয়ত করেছিলেন (বুখারী)। অতএব এটা স্পষ্ট যে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নেক আমলের কারণেই কবর আযাব মাফ হ’তে পারে। ফুল দেওয়া বা কাঁচা ডাল পোতার কারণে নয়। কেননা এসবের কোন প্রভাব মাইয়েতের উপর পড়ে না। যেমন আব্দুর রহমান (রাঃ)-এর কবরের উপর তাঁবু খাটানো দেখে ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ওটাকে হটিয়ে ফেল হে বৎস! কেননা ওটা তার আমলের উপরে ছায়া করছে বা বাধা সৃষ্টি করছে।[121]

[121]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৩৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৯৯।

কবরে আলোকসজ্জা করা

কবরে বাতি দেওয়া নিষেধের হাদীছটি যঈফ।[122] তবে এটি কয়েকটি কারণে নিকৃষ্টতম বিদ‘আত। (১) এটি নবাবিষ্কৃত বিষয়, যা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না
(২) এটি অগ্নি উপাসক মজূসীদের অনুকরণ
(৩) এতে স্রেফ মালের অপচয় হয়, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
(৪) একে আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের মাধ্যম বলে ধারণা করা হয়।[123] যা ভিত্তিহীন ও ইসলাম বিরোধী আক্বীদা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’। [124] আল্লাহ বলেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً، اَلَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا-

‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (কাহ্ফ ১৮/১০৩-৪)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ، متفق عليه- ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[125] ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, إِنَّ كُلَّ مَا لَمْ يَكُنْ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابِهِ دِيْنًا لَمْ يَكُنِ الْيَوْمَ دِيْنًا- ‘নিশ্চয়ই যে সকল বস্ত্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের সময়ে দ্বীন হিসাবে গণ্য ছিল না, এ যুগে তা দ্বীন হিসাবে গণ্য হবে না’।[126]

[122]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/৭৪০; সিলসিলা যঈফাহ হা/২২৩।
[123]. তালখীছ ৯০ পৃঃ।
[124]. নাসাঈ হা/১৫৭৯; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৭৮৫।
[125]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।
[126]. আবু বকর জাবের আল-জাযায়েরী, আল-ইনছাফ (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, তাবি) পৃঃ ৩২।

জানাযা বিষয়ে অন্যান্য জ্ঞাতব্য সমূহ

(১) কবর ও লাশ বিষয়ে (فى القبر والميت) :

(ক) সাগরবক্ষে মৃত্যুবরণ করলে এবং স্থলভাগ না পাওয়া গেলে গোসল, কাফন ও জানাযা শেষে কবরে শোয়ানোর দো‘আ পড়ে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিবে। [127]

(খ) কবরে যতদিন মুমিনের লাশের কোন অংশ বাকী থাকবে, ততদিন তাকে সম্মান করতে হবে। সেখানে পুনরায় কবর দেওয়া যাবে না। যদি লাশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ও মাটি হয়ে যায়, তাহ’লে সেখানে পুনরায় দাফন করা যাবে ও সাধারণ মাটির ন্যায় সেখানে সবকিছু করা যাবে। কিন্তু তাই বলে কোন সাধারণ অজুহাতে কবরের সম্মান হানিকর কোন কিছু নির্মাণ করা যাবে না।[128]

(গ) কবর খুঁড়তে গিয়ে যদি প্রথম দিকেই মৃত ব্যক্তির হাড় পাওয়া যায়, তাহ’লে কবর খনন বন্ধ করবে। কিন্তু যদি খনন শেষে পাওয়া যায়, তবে হাড়টিকে কবরের একপাশে রেখেই সেখানে নতুন লাশের কবর দিবে। কেননা এক কবরে একাধিক লাশ দাফন করা জায়েয আছে।[129]

(ঘ) যদি বিনা জানাযায় কারু দাফন হয়ে যায় অথবা জানাযা করে দাফন হ’লেও যদি কেউ পরে জানাযা পড়তে চান, তাহ’লে কবরকে সামনে করে জানাযার ছালাত আদায় করা যাবে। [130]

(ঙ) যদি কোন গর্ভবতী মহিলা মারা যান এবং তার পেটে জীবিত বাচ্চা আছে বলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক নিশ্চিত হন, তাহ’লে পেট কেটে বাচ্চা বের করে আনা জায়েয আছে।[131]

(চ) শারঈ ওযর বশতঃ যরূরী কারণে কবর পুনঃখনন, লাশ উত্তোলন ও স্থানান্তর করা জায়েয আছে।[132]

মৃতের ক্বাযা ছালাত ও ছিয়াম

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, একজনের ছিয়াম ও ছালাত অন্যজনে করতে পারেনা।[133] কারণ এগুলি দৈহিক ইবাদত, যা নিজেকেই করতে হয়। এগুলি জীবদ্দশায় যেমন অন্যের দ্বারা সম্ভব নয়, মৃতের পরেও তেমনি সম্ভব নয় এবং এগুলির ছওয়াবও অন্যকে দেওয়া যায় না কেবলমাত্র দো‘আ, ছাদাক্বা ও হজ্জ ব্যতীত।[134]

আল্লাহ বলেন, وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلاَّ مَا سَعَى ‘মানুষ সেটাই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা করে’ (নাজম ৫৩/৩৯)। অবশ্য মানতের ছিয়াম থাকলে উত্তরাধিকারীগণ তা রাখতে পারেন।[135] অথবা প্রতি ছিয়ামের বদলে একজন মিসকীন খাওয়াবেন কিংবা এক মুদ (৬২৫ গ্রাম) গম (বা চাউল) মিসকীনকে দিবেন,[136] যদি তা মাইয়েতের রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াংশে সংকুলান হয়। নইলে তা পূরণ করা ওয়ারিছের জন্য ওয়াজিব নয়।[137] জানাযাকালে মৃতের ক্বাযা ছালাতের কাফফারা স্বরূপ টাকা-পয়সা দান করা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র।

গর্ভচ্যুত শিশুর জানাযা

(ক) বাচ্চা যদি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ক্রন্দন করে বা হাঁচি দেয় বা এমন আচরণ করে যাতে তার জীবন ছিল বলে বুঝা যায়, অতঃপর মারা যায়। তবে তার জানাযা পড়তে হবে। ‘এসময় তার মুসলিম বাপ-মায়ের প্রতি ক্ষমা ও অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে হবে’।[138] অর্থাৎ সূরা ফাতিহা, দরূদ ও জানাযার ১ম দো‘আটি পাঠের পর শিশুর জন্য বর্ণিত ৫ম দো‘আটি পাঠ শেষে বলবে, ‘আল্লা-হুম্মাগফির লি আবাওয়াইহে ওয়ারহামহুম’ (হে আল্লাহ! তুমি তার পিতামাতাকে ক্ষমা কর এবং তাদের উপর রহম কর)।

(খ) যদি বাচ্চা চার মাসের আগেই গর্ভচ্যুত হয়, তাহ’লে তাকে গোসল বা জানাযা কিছুই করতে হবে না। বরং কাপড়ে জড়িয়ে দাফন করবে।

(গ) চার মাসের পরের কোন সন্তান যদি মৃত ভূমিষ্ঠ হয়, তবে তারও জানাযা করার প্রয়োজন নেই। কেননা হাদীছে বাচ্চার ‘চীৎকার করার’ কথা এসেছে।[139] গর্ভচ্যুত সন্তানের জানাযা করতে হবে মর্মের ‘আম ছহীহ হাদীছের [140] ভিত্তিতে একদল বিদ্বান গর্ভচ্যুত মৃত সন্তানের জানাযা করার জন্য বলেন। জবাবে শাওকানী বলেন, মায়ের গর্ভে চার মাস অতিক্রম করাটাই শিশুর জীবনের প্রমাণ নয়, বরং ভূমিষ্ট হওয়ার পর কান্নাটাই তার জীবনের প্রমাণ হিসাবে গণ্য হবে। ইমাম মালেক, শাফেঈ, আওযাঈ ও জমহূর বিদ্বানগণ সেকথা বলেন।[141]

মৃতের প্রতি আদব

(ক) মৃতের প্রতি সাধ্যমত সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। হাদীছে মৃতের হাড্ডি ভাঙ্গাকে জীবিতের হাড্ডি ভাঙ্গার সাথে তুলনা করা হয়েছে।[142] অন্য হাদীছে মৃতের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। [143] অতএব যরূরী রাষ্ট্রীয় নির্দেশ ব্যতীত মৃতদেহ কাটাছেঁড়া বা পোষ্ট মর্টেম করা গুরুতর অন্যায়। আজকাল পোষ্ট মর্টেম-এর বিষয়টি অনেকটা সস্তা হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও লাশের প্রতি সেখানে অসম্মান করা হয় বলে শোনা যায়। যা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে অবশ্যই বিরত থাকা কর্তব্য।

(খ) মৃত মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ تَسُبُّوا الْأَمْوَاتَ فَإِنَّهُمْ قَدْ أَفْضَوْا إِلَى مَا قَدَّمُوْا‘তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না। কেননা তারা তাদের অগ্রিম পেশকৃত অর্জনের প্রতি ধাবিত হয়েছে’।[144] তবে ঐ ব্যক্তি যদি ফাসিক ও বিদ‘আতী হয়, তবে তা থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। নতুবা বিরত থাকতে হবে।[145] কেননা সুন্দর মুসলমানের পরিচয় হ’ল অনর্থক বিষয় সমূহ হ’তে বিরত থাকা।[146] তাছাড়া ‘সন্দেহযুক্ত বিষয়াবলী থেকে নিঃসন্দেহ বিষয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার’ জন্য হাদীছে নির্দেশ এসেছে। [147]

মৃতের প্রতিবেশীদের কর্তব্য

মৃত্যুর পরে মৃতের প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়দের কর্তব্য হ’ল, মৃতের পরিবারের লোকদেরকে (কমপক্ষে) একটি দিন ও রাত পেট ভরে খাওয়ানো। জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব (রাঃ) শহীদ হ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার প্রতিবেশীদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতদ্ব্যতীত বন্ধু-বান্ধব ও সকল হিতাকাংখীর কর্তব্য হ’ল মৃতের উত্তরাধিকারীদের সান্ত্বনা প্রদান করা ও তার বাচ্চাদের মাথায় সহানুভূতির হাত বুলানো।[148] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে তিন দিনের বেশী কান্নাকাটি করতে নিষেধ করেন।[149]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃতের বাড়ীতে গিয়ে তাদেরকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতেন। নিজের সন্তানহারা কন্যা যয়নব (রাঃ)-কে দেওয়া সর্বোত্তম সান্ত্বনা বাক্য হিসাবে বর্ণিত হাদীছটি নিম্নরূপ :

إِنَّ ِللهِ مَا أَخَذَ وَ ِللهِ مَا أَعْطَى وَكُلُّ شَيْئٍِ عِنْدَهُ إِلَى أجَلٍ مُّسَمَّى فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ

উচ্চারণ : ইন্না লিল্লা-হি মা আখাযা ওয়া লিল্লা-হি মা আ‘ত্বা; ওয়া কুল্লু শাইয়িন ইনদাহূ ইলা আজালিম মুসাম্মা; ফালতাছবির ওয়াল তাহতাসিব ।

অনুবাদ : ‘নিশ্চয়ই সেটা আল্লাহর জন্য, যেটা তিনি নিয়েছেন এবং সেটাও আল্লাহর জন্য যেটা তিনি দিয়েছেন। প্রত্যেক বস্ত্ত তাঁর নিকটে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য। অতএব তুমি ছবর কর ও ছওয়াবের আকাংখা কর’।[150] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এটিই সর্বোত্তম হাদীছ।[151]

ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোন মুমিন ভাইয়ের বিপদে সান্ত্বনা প্রদান করল, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন সবুজ রেশমের ঈর্ষণীয় জোড়া পরিধান করাবেন’।[152]

মৃতের জন্য করণীয়

১. আল্লাহ বলেন, إِنَّا نَحْنُ نُحْيِ الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِينٍ ‘আমরা মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা তারা অগ্রে প্রেরণ করে ও যা তারা পশ্চাতে রেখে যায়। আমরা প্রত্যেক বস্ত্ত স্পষ্ট কিতাবে (অর্থাৎ স্ব স্ব আমলনামায়) সংরক্ষিত রাখি’।[153]

২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

إِذَامَاتَ الْإِنْسَانُ اِنْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، رواه مسلم-

‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কেবল তিনটি আমল ব্যতীত : (ক) ছাদাক্বায়ে জারিয়া (খ) এমন ইল্ম যা থেকে কল্যাণ লাভ হয় এবং (গ) নেককার সন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’।[154]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ তার মাল তিনটি: (ক) যেটা সে খায় অতঃপর শেষ হয়ে যায় (খ) যেটা সে পরিধান করে অতঃপর তা জীর্ণ হয়ে যায় (গ) যেটা সে ছাদাক্বা দেয় বা দান করে সেটা তার জন্য সঞ্চিত থাকে। বাকী সবকিছু চলে যায় এবং লোকদের জন্য সে ছেড়ে যায়’। [155]

৪. তিনি আরও বলেন, ‘মাইয়েতের সঙ্গে তিনজন যায়। দু’জন ফিরে আসে ও একজন থেকে যায়। তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে। কেবল ‘আমল’ তার সাথে থেকে যায়’। [156]

৫. তিনি আরও বলেন, ‘আখেরাতের সুখণ্ডসম্পদের তুলনায় দুনিয়া একটি মরা ছাগলের বাচ্চার চাইতেও তুচ্ছ’।[157]

৬. আল্লাহ বলেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন সুখ সম্ভার প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শোনেনি, কোন হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি’। [158]

৭. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘জান্নাতের একটি চাবুক রাখার মত ক্ষুদ্রতম স্থান, সমস্ত পৃথিবী ও তার মধ্যকার সম্পদরাজি অপেক্ষা উত্তম’। [159]

তিন প্রকার ছাদাক্বা

(১) ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ: ছাদাক্বার মধ্যে ঐ ছাদাক্বা উত্তম, যা ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ বা চলমান উপঢৌকন। যা সর্বদা জারি থাকে ও স্থায়ী নেকী দান করে। যেমন মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ ও পরিচালনা, রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, অনাবাদী জমিকে আবাদ করণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল স্থাপন ও পরিচালনা ইত্যাদি।

(২) ইলম: ঐ ইল্ম উত্তম যা মানুষকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর কল্যাণ পথ দেখায় এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত হতে বিরত রাখে। উক্ত উদ্দেশ্যে উচ্চতর ইসলামী গবেষণা খাতে সহযোগিতা প্রদান, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা। বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল সম্পন্ন বই ছাপানো ও বিতরণ করা এবং এজন্য অন্যান্য স্থায়ী প্রচার মাধ্যম স্থাপন ও পরিচালনা করা ইত্যাদি।

(৩) নেককার সন্তান: সন্তান পিতা-মাতার উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত।[160] নেককার সন্তানের সকল নেক আমলের ছওয়াব তার পিতা-মাতা পাবেন, যদি তারা কাফের-মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ না করে থাকেন। মৃতের জন্য সর্বোত্তম হাদিয়া হ’ল তার ইস্তেগফারের জন্য দো‘আ করা, তার জন্য ছাদাক্বা করা ও তার পক্ষ হ’তে হজ্জ করা।[161]... তবে এজন্য উত্তরাধিকারীকে প্রথমে নিজের ফরয হজ্জ আদায় করতে হবে।[162]

জানা আবশ্যক যে, ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ দু’ভাবে হতে পারে। এক- মৃত ব্যক্তি স্বীয় জীবদ্দশায় এটা করে যাবেন। এটি নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম। কারণ মানুষ সেটাই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা করে (নাজম ৫৩/৩৯)। দুই- মৃত্যুর পরে তার জন্য তার উত্তরাধিকারীগণ বা অন্যেরা যেটা করেন। সাইয়িদ রশীদ রিযা বলেন, দো‘আ, ছাদাক্বা (ও হজ্জ)-এর নেকী মৃত ব্যক্তি পাবে, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ সকলে একমত। কেননা উক্ত বিষয়ে শরী‘আতে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।[163]

আরেকটি বিষয় মনে রাখা আবশ্যক যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ছাদাক্বায়ে জারিয়াহর ধরন পরিবর্তন হয়ে থাকে। অতএব যেখানে বা যাকে এটা দেওয়া হবে, তার গুরুত্ব ও স্থায়ী কল্যাণ বুঝে এটা দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে, যেন উক্ত ছাদাক্বা ধর্মের নামে কোন শিরক ও বিদ‘আতের পুষ্টি সাধনে ব্যয়িত না হয়। যা স্থায়ী নেকীর বদলে স্থায়ী গোনাহের কারণ হবে। ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার আয় ও ব্যয় দু’টিরই হিসাব দিতে হবে।[164] অতএব হে ছাদাক্বা দানকারী! সাবধান হৌন!!

[127]. বায়হাক্বী ৪/৭।
[128]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১; তালখীছ, পৃঃ ৯১।
[129]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১।
[130]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৮১-৮২।
[131]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০০।
[132]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১-২।
[133]. (عن نافع أن ابن عمر كان إذا سئل عن الرجل يموت وعليه صوم من رمضان أو نذر يقول: لا يصوم أحد عن أحد ولكن تصدقوا عنه من ماله للصوم لكل يوم مسكينا، مدا من حنظه لكل مسكين، وفى رواية فى المؤطأ ولا يصلي أحد عن أحد) বায়হাক্বী ৪/২৫৪, সনদ ছহীহ, আলবানী, হেদায়াতুর রুওয়াত ২/৩৩৬; যঈফাহ ১০ (১)/৬২ পৃঃ; মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/২০৩৫, ‘ছওম’ অধ্যায়-৭, ‘ক্বাযা ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৫।
[134]. আবুদাঊদ হা/২৮৩৩; ঐ, মিশকাত হা/৩০৭৭; বায়হাক্বী, শু‘আব; মির‘আত হা/১৭৩১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য ৫/৪৫৩ পৃঃ; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১০; তালখীছ ৭৬ পৃঃ।
[135]. আবুদাঊদ হা/৩৩০০; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২০৩৩; তালখীছ পৃঃ ৭৫; মির‘আত ৭/২৮-২৯, ৩১-৩২।
[136]. বায়হাক্বী ৪/২৫৪; যঈফাহ হা/৪৫৫৭-এর আলোচনা শেষে দ্রষ্টব্য ১০ (১)/৬২।
[137]. মির‘আত ৭/৩২, হা/২০৫৪-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[138]. আহমাদ, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৬৭।
[139]. (إذا استهل الصبى صلي عليه وورث) ইবনু মাজাহ, দারেমী, মিশকাত হা/৩০৫০, ‘ফারায়েয ও অছিয়ত’ অধ্যায়-১২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৩।
[140]. (السقط يصلي عليه) আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৬৭, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৫।
[141]. নায়ল ৫/৪৭; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২৭৭; মির‘আত ৫/৪০৩-০৪, ৪২৪-২৫।
[142]. (كسر عظم الميت ككسره حياً) আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৭১৪, অধ্যায়- ৫, অনুচ্ছেদ-৬।
[143]. (نهى عن النهبة والمثلة) বুখারী, মিশকাত হা/২৯৪১, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১, অনুচ্ছেদ-১১।
[144]. বুখারী, মিশকাত হা/১৬৬৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৫।
[145]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০০।
[146]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬; ঐ, মিশকাত হা/৪৮৩৯ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-১০।
[147]. তিরমিযী, নাসাঈ, মিশকাত হা/২৭৭৩ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১, অনুচ্ছেদ-১; আররওযাতুন নাদিইয়াহ ১/৪৫২-৫৩।
[148]. তালখীছ পৃঃ ৭৪।
[149]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪৪৬৩ ‘পোষাক’ অধ্যায়-২২, ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ-৩; তালখীছ পৃঃ ১৫, ৭৩।
[150]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৭২৩, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, ‘মৃতের উপর ক্রন্দন’ অনুচ্ছেদ-৭।
[151]. তালখীছ পৃঃ ৭১।
[152]. তালখীছ পৃঃ ৭০; বায়হাক্বী, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, হাদীছ হাসান; ইরওয়া হা/৭৬৪।
[153]. ইয়াসীন ৩৬/১২।
[154]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩, ‘ইলম’ অধ্যায়-২।
[155]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৬৬, ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-২৬।
[156]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৬৭।
[157]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৭, অধ্যায়-২৬।
[158]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১২ ‘জান্নাত ও জান্নাতবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ।
[159]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১৩।
[160]. সুনানু আরবা‘আহ, দারেমী, মিশকাত হা/২৭৭০, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-১১, অনুচ্ছেদ-১।
[161]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩১০; তালখীছ ৭৬।
[162]. আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৫২৯ ‘মানাসিক’ অধ্যায়-১০।
[163]. মির‘আত ৫/৪৫৩।
[164]. তিরমিযী হা/২৪১৬; ঐ, মিশকাত হা/৫১৯৭ ‘হৃদয় গলানো’ অধ্যায়-২৬, পরিচ্ছেদ-২; ছহীহাহ হা/৯৪৬।

গায়েবানা জানাযা

গায়েবানা জানাযা জায়েয আছে।[165] তবে সকলের জন্য ঢালাওভাবে এটা জায়েয নয় বলে ইমাম খাত্ত্বাবী, ইবনু আব্দিল বার্র, হাফেয যায়লাঈ, ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম, শায়খ আলবানী প্রমুখ বিদ্বানগণ মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য সমূহ সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

গায়েবানা জানাযার জন্য হাবশার (আবিসিনিয়া) বাদশাহ আছহামা নাজ্জাশীর গায়েবানা জানাযা আদায়ের ঘটনাই হ’ল একমাত্র বিশুদ্ধ দলীল, যিনি ৯ম হিজরী সনে মারা যান। নাজ্জাশী খৃষ্টানদের বাদশাহ ছিলেন। কিন্তু নিজে মুসলমান ছিলেন। সেকারণ তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের নিয়ে জামা‘আত সহকারে গায়েবানা জানাযা আদায় করেন এবং বলেন, صَلُّوْا عَلَى أَخٍ لَّكُمْ مَاتَ بِغَيْرِ أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জানাযা পড়। যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন’।[166] ইমাম আবুদাঊদ নাজ্জাশী বিষয়ক হাদীছের বর্ণনায় অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে, باب في الصلاة على المسلم يموت في بلاد الشرك ‘মুশরিক দেশে মৃত্যুবরণকারী মুসলিমের জানাযা’ অনুচ্ছেদ। এতে বুঝা যায় যে, মুশরিক বা অমুসলিম দেশে মুত্যু হওয়ার কারণে যদি কোন মুসলমানের জানাযা হয়নি বলে নিশ্চিত ধারণা হয়, তাহ’লে সেক্ষেত্রে ঐ মুসলমান ভাই বা বোনের জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া যাবে।

এ সম্পর্কে দ্বিতীয় দলীল হিসাবে মু‘আবিয়া বিন মু‘আবিয়া লায়ছী আল-মুযানী (রাঃ)-এর গায়েবানা জানাযা পড়ার কথা বলা হয়। মদ্বীনায় তাঁর মৃত্যু হ’লে তাবূকের যুদ্ধে অবস্থানকালে জিব্রীল মারফত এই সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর গায়েবানা জানাযা পড়েন।[167] ইবনু আব্দিল বার্র ও ইবনু হাজার প্রমুখ বলেন যে, হাদীছটি ‘ছহীহ’ নয়। দ্বিতীয়ত : এ হাদীছে বলা হয়েছে যে, জিব্রীল (আঃ) স্বীয় পাখার ঝাপটায় সব পর্দা উঠিয়ে দেন ও জানাযা উঁচু করে ধরেন। তাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানাযা দেখতে পান ও ছালাত আদায় করেন (حتى نظر إليه وصلي عليه)। ফলে সেটা আর গায়েবানা থাকে না। সেকারণ ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন যে, এই হাদীছ দ্বারা গায়েবানা জানাযার দলীল গ্রহণ বাতিল যোগ্য’।

ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, যদি গায়েবানা জানাযা জায়েয হ’ত, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিশ্চয়ই নিজের ছাহাবীদের গায়েবানা জানাযা আদায় করতেন (যাদের জানাযায় তিনি শরীক হ’তে পারেননি)। অনুরূপ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলমানেরা তাদের প্রিয় চার খলীফার গায়েবানা জানাযা পড়ত। কিন্তু এরূপ কথা কারু থেকে কখনো বর্ণিত হয়নি’। [168]

পরিশেষে বলা যায় যে, গায়েবানা জানাযা নিঃসন্দেহে জায়েয ঐসব ক্ষেত্রে, যাদের জানাযা হয়নি বলে জানা যায়। কিন্তু যাদের জানাযা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, সেক্ষেত্রে গায়েবানা জানাযা না পড়ায় কোন দোষ নেই। বিশেষ করে আজকাল যেখানে গায়েবানা জানাযা নোংরা রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আরও বেশী হুঁশিয়ার হওয়া কর্তব্য।

[165]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫২ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৫।
[166]. আহমাদ হা/১৬৫৭৭; ইবনু মাজাহ হা/১৫৩৭; উভয়ের সনদ ‘ছহীহ’।
[167]. বায়হাক্বী ৪/৫০।
[168]. আল-জাওহারুন নাক্বী শরহ সুনানুল বায়হাক্বী ৪/৫১।

কবর যিয়ারত

কবর যিয়ারত করা সুন্নাত। এর দ্বারা মৃত্যু ও আখেরাতের কথা স্মরণ হয়। কবর আযাবের ভীতি সঞ্চারিত হয়। হৃদয় বিগলিত হয়। চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়। অন্যায় থেকে তওবা এবং নেকীর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পরকালীন মুক্তির প্রেরণা সৃষ্টি হয়। উপরোক্ত উদ্দেশ্যেই কেবল কবর যিয়ারতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নইলে প্রথমে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল। নারী-পুরুষ সবার জন্য এই অনুমতি রয়েছে। তবে ঐসব নারীদের জন্য লা‘নত করা হয়েছে, যারা কবর যিয়ারতের সময় সরবে কান্নাকাটি ও বিলাপ ধ্বনি করে।

যিয়ারতের সময় এমন কাজ করা যাবে না, যা করলে আল্লাহ নাখোশ হন। যেমন : লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা দুনিয়াবী স্বার্থে যিয়ারত করা, সেখানে ফুল দেওয়া, কবরবাসীর নিকটে কিছু কামনা করা, সেখানে বসা, ছালাত আদায় করা বা সিজদা করা, তার অসীলায় মুক্তি প্রার্থনা করা, সেখানে দান-ছাদাক্বা ও মানত করা, গরু-ছাগল-মোরগ ইত্যাদি ‘হাজত’ দেওয়া বা কুরবানী করা প্রভৃতি।

সকল প্রকারের শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমল থেকে মুক্ত মন নিয়ে কেবল মৃতের জন্য দো‘আ এবং আখেরাতকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে কবর যিয়ারত করতে হবে। নইলে ঐ যিয়ারত গোনাহের কারণ হবে। উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা নিষিদ্ধ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ও নেকী হাছিলের জন্য কা‘বা গৃহ, বায়তুল মুক্বাদ্দাস ও মসজিদে নববী ব্যতীত অন্যত্র সফর করতে নিষেধ করেছেন।[169] তাই শুধুমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদ্বীনায় যাওয়া নাজায়েয। তবে মসজিদে নববীতে ছালাত আদায়ের নেকী হাছিলের উদ্দেশ্যে কেউ মদ্বীনায় গেলে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত করতে পারেন। অতএব হজ্জের সময় যারা মদ্বীনা হয়ে মক্কায় যান, তাদের নিয়ত হ’তে হবে মসজিদে নববীতে ছালাত আদায়ের অশেষ নেকী হাছিল করা।

বর্তমানে যেভাবে রাজনৈতিক নেতাদের ও পীরদের কবর যেয়ারত করা হচ্ছে এবং মৃত পীরের অসীলায় ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির আশায় মানুষ যেভাবে বার্ষিক ওরস ও অন্যান্য সময়ে বিভিন্ন মাযারে ছুটছে, তাদের সাবধান হওয়া উচিৎ যে, এর মাধ্যমে তারা দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই হারাচ্ছেন। কেননা আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের বিরোধিতা করলে কেবল আল্লাহর ক্রোধ লাভ হয় ও তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হ’তে হয়।

যিয়ারতের আদব

এই সময় নিজের মৃত্যু ও আখেরাতকে স্মরণ করবে এবং কবরবাসীদের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে খালেছ মনে নিম্নোক্ত দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। দো‘আর সময় একাকী দু’হাত উঠানো যাবে। বাক্বী‘ গারক্বাদ গোরস্থানে দীর্ঘক্ষণ ধরে দো‘আ করার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাকী তিন বার হাত উঠিয়েছিলেন। [170] এই সময় স্রেফ দো‘আ ব্যতীত ছালাত, তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, দান-ছাদাক্বা কিছুই করা জায়েয নয়।

১ম দো‘আ : এটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

اَلسَّلاَمُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ، وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَآءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ-

উচ্চারণ : আসসালা-মু ‘আলা আহলিদ দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা ওয়াল মুসলিমীনা; ওয়া ইয়ারহামুল্লা-হুল মুস্তাক্বদিমীনা মিন্না ওয়াল মুস্তা’খিরীনা; ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লা লা-হেকূনা।

অনুবাদ : মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক। আমাদের অগ্রবর্তী ও পরবর্তীদের উপরে আল্লাহ রহম করুন! আল্লাহ চাহে তো আমরা অবশ্যই আপনাদের সাথে মিলিত হ’তে যাচ্ছি’।[171]

২য় দো‘আ : এটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।-

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ، نَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ-

উচ্চারণ : আসসালা-মু ‘আলা আহলিদ দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা ওয়াল মুসলিমীনা; ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লা লা-হেকূনা। নাসআলুল্লা-হা লানা ওয়া লাকুমুল ‘আ-ফিয়াতা’।

অনুবাদ : মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগণ! আপনাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আল্লাহ চাহে তো আমরা অবশ্যই আপনাদের সাথে মিলিত হ’তে যাচ্ছি। আমাদের ও আপনাদের জন্য আমরা আল্লাহর নিকটে মঙ্গল কামনা করছি’।[172]

৩য় দো‘আ :

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْلَهُمْ-

উচ্চারণ : আসসালামু ‘আলায়কুম দা-রা ক্বাওমিন মু’মিনীনা, ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লা-হেকূনা; আল্লা-হুম্মাগফিরলাহুম।

অনুবাদ : মুমিন কবরবাসীদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক। আল্লাহ চাহে তো আমরা অবশ্যই আপনাদের সাথে মিলিত হ’তে যাচ্ছি।হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। [173]

তিরমিযী বর্ণিত ‘আসসালামু ‘আলায়কুম ইয়া আহলাল কুবূরে! ইয়াগফিরুল্লা-হু লানা ওয়া লাকুম’ বলে প্রসিদ্ধ হাদীছটি ‘যঈফ’। [174]

জ্ঞাতব্য: 
কাফির-মুশরিক বাপ-মায়ের কবর যিয়ারত করা যাবে। ক্রন্দন করা যাবে। কেননা এর মাধ্যমে মৃত্যুকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে সালাম করা যাবে না। তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাঁর মায়ের কবর যিয়ারতের জন্য অতটুকুই মাত্র অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।[175]

[169]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৯৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[170]. ১১৬৫. মুসলিম হা/২৩০১, ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৩৫; ঐ, মিশকাত হা/১৭৬৬; তালখীছ পৃঃ ৮৩। উলে−খ্য যে, এখানে ফাতেমা (রাঃ)-এর কবর আছে বিধায় শী‘আরা একে ‘জান্নাতুল বাক্বী‘ বলে, যা গুরুতর অন্যায়।
[171]. মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/১৭৬৭ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, ‘কবর যিয়ারত’ অনুচ্ছেদ-৮।
[172]. মুসলিম হা/২২৫৭; মিশকাত হা/১৭৬৪।
[173]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৮, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩; ঐ, হা/১৭৬৬ ‘জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৮।
[174]. তিরমিযী হা/১০৫৩; ঐ, মিশকাত হা/১৭৬৫।
[175]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৬৩।




***********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url