আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-১০) || উদ্বিগ্ন হবেন না, তকদীর আপনার হাতে নয় || জীবন শুধু আজকের জন্যই) ||





দুঃখিত হবেন না, সব কিছু ভাগ্যানুসারেই ঘটবে। ধরে নিন জীবন শুধু আজকের জন্যই


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

জীবন শুধু আজকের জন্যই

আজই যেন আপনার শেষ দিন এভাবে আজকের দিনটি কাটান। এ ধরনের মানসিকতা ও জীবন সম্বন্ধে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যদি থাকে তবে রাগ-দুঃখকে প্রশ্রয় দিয়ে আপনার সামান্য যে সময়টুকু আছে তা নষ্ট করার কোন যুক্তি নেই। এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إذا أَصْبَحْتَ فَلا تَنْتَظِرِ المساءَ وإذا أمسيـْتَ فلا تَنْتَظِرِ الصَّباحَ

“সকাল বেলা সন্ধ্যাবেলা দেখার আশা করো না। আর সন্ধ্যাকালে সকাল বেলা দেখার আশা করো না।”

অন্য কথায় অতীত নিয়ে না ভেবে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে আত্মা-দেহ-মন নিয়ে জীবন শুধু আজকের জন্যই।

একজন আরব কবি বলেন-

“যা অতীত হয়ে গেছে তা চিরদিনের জন্য চলে গেছে আর যা আশা করা হয় তাতো অজানা –অজ্ঞাত।”

“আর তোমার যা আছে তা হলো বর্তমান মুহূর্তটি।”

অতীতের চিন্তায়-বিভোর হওয়া এবং অতীতের দুঃখ-কষ্টকে বর্তমানে টেনে আনা অস্থির ও অসুস্থ মনের লক্ষণ।

চীনা (চীন দেশীয়) প্রবাদে বলা হয় “সেতুতে পৌছার আগেই সেতু পার হয়ো না।” অন্য কথায়, ঘটনা ঘটার আগেই তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।

আমাদের একজন ধাৰ্মিক পূর্বসূরী বলেছেন-

“হে আদম সন্তান! নিশ্চয় তোমাদের দিন মাত্র তিনটি। গতকাল আর এটা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আগামীকাল যা এখনও আসেনি এবং আজ। সুতরাং আজকের দিনে আল্লাহকে ভয় কর, তাকে মান্য কর।”

যে নাকি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের উদ্বেগ নিয়ে বেড়ায় সে কিভাবে বাচতে পারে? তা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে সর্বদা তার কথা মনে করে করে মানুষ কিভাবে শান্তি পেতে পারে? যে অতীতের দুঃখজনক ঘটনার কথা মনে করে, সে শুধু ব্যথাই পায়, এতে তার কোন লাভ হয় না।

“সকালে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁচার আশা করো না ও সন্ধ্যায় সকাল পর্যন্ত বাঁচার আশা করো না।”

এ কথার অর্থ হল এ পৃথিবীর জন্য আমাদের বড় ধরনের ও দীর্ঘ-কালীন আশা থাকা উচিত নয়। মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করুন। নেক আমল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করুন। আপনার উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে আজকের দিনের সীমা পেরিয়ে যেতে দেবেন না। এ নীতি আপনাকে মনোযোগী হতে এবং প্রতিদিন উৎপাদনশীল হওয়ার জন্য আপনার সমস্ত শক্তিকে ব্যয় করতে সাহায্য করবে। দক্ষতার সাথে সময়কে কাজে লাগান এবং আপনার আচার-আচরণ, চাল-চলনের উন্নতি করে, আপনার স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে ও অন্যের সাথে আপনার সম্পর্ক দৃঢ় করে আজ কোন কিছু অর্জন করার জন্য আপনার সকল প্রচেষ্টাকে কাজে লাগান।

উদ্বিগ্ন হবেন না, তকদীর আপনার হাতে নয়

দুঃখিত হবেন না, কেননা যা তকদীরে আছে তা তো সিদ্ধান্ত করা হয়ে গেছে এবং আপনি পছন্দ না করলেও তা ঘটবে। কলমের কালি শুকিয়ে গেছে, কাগজ গুটিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সবকিছু দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই আপনার দুঃখ বাস্তবতাকে একটুও পাল্টাতে পারবে না।

দুঃখ করবেন না, কারণ আপনার বিষন্নতার দ্বারা আপনি সময়ের গতিরোধ করতে চান, সূর্যকে তার উদয়স্থলে থামিয়ে দিতে চান, ঘড়ির কাঁটাকে স্থির-নিশ্চল করে দিতে চান, পেছনের দিকে হাঁটতে চান এবং নদীকে তার উৎসের দিকে উল্টো বহাতে বা প্রবাহিত করতে চান যা সবই অসম্ভব। (অর্থাৎ আপনার বিষণ্নতার কারণে এগুলোর পরিবর্তন যেমন সম্ভব নয়, তেমনই আপনার ভাগ্যের পরিবর্তনও সম্ভব নয়; সুতরাং বিষন্ন হয়ে কোন লাভ নেই-এ কথাই লেখক এখানে বুঝাতে চাচ্ছেন। -বঙ্গানুবাদক)

বিষন্ন হবেন না, কারণ বিষন্নতা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঢেউগুলোকে ভয়ংকরভাবে আছড়ায়। পরিবেশকে নষ্ট করে বা বায়ুমণ্ডলকে পরিবর্তন করে এবং সমৃদ্ধ বাগানের ফুটন্ত ফুলগুলোকে ধ্বংস করে।

বিষন্ন হবেন না, কেননা বিষগ্ন ব্যক্তি তার মতো, যে নাকি তলায় ছিদ্রযুক্ত বালতিতে পানি ঢালে। যে লেখক নিজের আঙুল দিয়ে পানিতে লিখতে চায় সে (অর্থাৎ বিষন্ন ব্যক্তি) তার মতো।

দুঃখিত হবেন না, কারণ প্রকৃত জীবন কাল মাপা হয় দিনের সংখ্যা দিয়ে-যে দিন আপনি কাটাচ্ছেন। সুতরাং আপনার দিনগুলোকে দুঃখ করে করে শেষ করবেন না। আপনার রাতগুলোকে দুঃখ করে নষ্ট করবেন না এবং আপনার সময়ের অপচয় করবেন না। কারণ, সত্যসত্যই আল্লাহ অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না।

দুশ্চিন্তা করবেন না, কেননা সত্যিই আপনার প্রভু পাপ মার্জনা করেন ও অনুতাপ-অনুশোচনা গ্রহণ করেন (অর্থাৎ গুনাহ মাফ করেন ও তওবা কবুল করেন)।

“বলুন: “হে আমার সেসব বান্দারা যারা (গুনাহ করে) নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছ! তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।” (৩৯-সূরা আয যুমার: আয়াত-৫৩)

যখন আপনি এ আয়াতখানি পড়েন তখন কি আপনার আত্মা শান্তি পায় না? আপনার উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তা কি দূর হয় না? এবং আপনার সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়ে কি সুখের প্রবাহ বয়ে যায় না?

তাদের আত্মাকে পোষ মানাতে তিনি তাদেরকে ‘হে আমার বান্দারা!' বলে আহবান করেছেন। তিনি বিশেষ করে সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে এ কারণে উল্লেখ করেছেন, কারণ তারা অন্যদের তুলনায় অনবরত গুনাহ করতে বেশি অভ্যস্ত। তাহলে অন্যদের জন্য আল্লাহর করুণা কতই না বেশি হবে! এভাবে তিনি তাদেরকে হতাশ হওয়া থেকে এবং ক্ষমা পাওয়ার আশাহত হওয়া থেকে বারণ করেছেন। এবং তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, যে তওবা করবে তার ছোট-বড়, সাংঘাতিক বা তুচ্ছ সব গুনাহই তিনি ক্ষমা করে দিবেন।

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ

“আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে অমনিই আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহর নিকট তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং জেনে শুনে তারা যে (পাপ) করেছে তা করতে থাকেন না (তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন)। আর আল্লাহ ছাড়া কে আছে যে পাপ ক্ষমা করতে পারবে?” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত ১৩৫)

“আর যে মন্দ কাজ করে বা নিজের প্রতি অত্যাচার করে তারপর আল্লাহর নিকট ইসতিগফার করে বা গুনাহ মাফ চায়, সে আল্লাহকে মহা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবে পাবে।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-১১০)

“তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে যদি তোমরা তার মধ্য হতে বড় বড় গুনাহ এড়িয়ে চল, তবে আমি তোমাদের (ছোট ছোট) পাপ ক্ষমা করে দিব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থান বেহেশতে প্রবেশ করাব।” (৪-সূরা নিসা: আয়াত-৩১)

“আর যদি তারা নিজেদের প্রতি অবিচার করে আপনার নিকট এসে আল্লাহর কাছে পাপ ক্ষমা চায় এবং তাদের জন্য রাসূলও ক্ষমা চান তবে তারা আল্লাহকে অবশ্যই পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবে পাবে।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-৬৪)

“আর যে ব্যক্তি তওবা করে, ঈমান আনে ও আমলে সালেহ করে, অতঃপর হিদায়েতের পথে চলে সে ব্যক্তিকে অবশ্যই আমি ক্ষমা করে দিব।” (২০-সুরা ত্বাহা: আয়াত-৮২)

তবে কি আপনি এসব (উপরোক্ত পাঁচটি) আয়াতসমূহ পড়তে আনন্দ পান না?

মূসা (আঃ) যখন একজন লোককে (অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভুলক্রমে) হত্যা করে ফেলেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন-

হে আমার প্রভু! আমি অবশ্যই আমার প্রতি জুলুম করেছি, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন।” (২৮-সূরা আল কাছাছ: আয়াত-১৬)

দাউদ (আঃ) যখন অনুতপ্ত হলেন তখন আল্লাহ বলেন-

“অতঃপর আমি তার সে ভুল ক্ষমা করেছিলাম এবং তার জন্য আমার নিকট নৈকট্য ও শুভ পরিণাম রয়েছে।” (৩৮-সূরা ছোয়াদ: আয়াত-২৫)

আল্লাহ কতই না উৎকৃষ্ট, করুণাময় ও উদার! এমনকি যারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে তারাও যদি তওবা করে, তবে তিনি তাদেরকেও তার করুণা ও ক্ষমার প্রস্তাব করেছেন।

“তারা অবশ্যই কুফুরি করে যারা বলে যে, আল্লাহ তিনজনের মধ্যে তৃতীয় (একজন); অথচ একমাত্র ইলাহ (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা যা বলে তা হতে তারা বিরত না হলে তাদের মধ্য হতে যারা কুফুরি করেছে তাদের উপর অবশ্যই অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত হবে। তবে কি তারা আল্লাহর নিকট তওবা ও ইসতিগফার করবে না? আল্লাহ তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম মেহেরবান।” (৫-সূরা মায়িদা: আয়াত-৭৩-৭৪)

একখানি নির্ভরযোগ্য (সহীহ) হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

“আল্লাহ তা'আলা বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যখন আমার নিকট প্রার্থনা করবে ও আমার নিকট আশা করবে তখন তোমার আশা, একনিষ্ঠতা ও বিশ্বাস অনুসারে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব আর এতে আমি কিছু মনে করব না (বা কারো পরওয়া করব না); হে বনী আদম! যদি তোমার গুনাহের পরিমাণ আকাশের চূড়ার সমানও হয়, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এবং তাতে আমি কিছু মনে করব না (বা এতে আমি কারো পরওয়া করব না)। হে বনী আদম সন্তান। যদি তুমি আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করে পৃথিবীর সমপরিমাণ পাপ নিয়ে আমার নিকট আস তারপর আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, তবে আমিও তোমার নিকট পৃথিবীর সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে আসব।”

ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“দিনের বেলা যারা পাপ করেছে তাদেরকে মাফ করার জন্য নিশ্চয় আল্লাহ রাত্রিবেলা তার হাত প্রসারিত করেন। এবং রাত্রিবেলা যারা গুনাহ করেছে তাদেরকে ক্ষমা করার জন্য দিনের বেলা তার হাতকে প্রসারিত করে দেন। এবং সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এরূপ করতে থাকবেন।”

আরেকটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন-

“হে আমার বান্দারা! তোমরা অবশ্যই দিন-রাত গুনাহ কর, আর আমি সব পাপ মাফ করে দেই। অতএব, তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও। তাহলেই আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব।”

আরেকটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللهُ بِكُمْ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ

“যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, যদি তোমরা গুনাহ না করতে (এবং এর কারণে অহংকার বশত: ক্ষমা না চাইতে) তবে আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে অবশ্যই অন্য জাতিকে আনতেন যারা পাপ করে পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতো ফলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।” (এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ ক্ষমা চাওয়াকে পছন্দ করেন। -বঙ্গানুবাদক)

এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-

“যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার শপথ; যদি তোমরা পাপ না করতে তবে আমি তোমাদের ব্যাপারে এমন কিছুর ভয় করতাম যা গুনাহের চেয়েও বেশি ভয়ংকর আর তা হলো আত্মগরিমা।”

অন্য একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

كلكم خطاء وخير الخطائين التوابون

“তোমরা সবাই পাপী আর সর্বোত্তম পাপী তারাই যারা তওবাকারী।”

নিম্নের এই নির্ভরযোগ্য হাদীসখানিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-

“আল্লাহ তার বান্দার তওবাতে তোমাদের সে ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন, যে নাকি তার সওয়ারী বা বাহনের উপর ছিল, এর উপর তার খাদ্য-পানীয়ও ছিল তারপর বাহনটি তার কাছ থেকে মরুভূমিতে হারিয়ে গেল, তারপর সে এটাকে খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল, এরপর ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর ঘুম থেকে জেগেই দেখে বাহনখানি তার মাথার কাছে। ফলে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভুলে বলে ফেলল, 'হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার প্রভু, ভীষণ খুশির চোটেই সে ভুল করে ফেলল।”

নির্ভরযোগ্যভাবে আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

“নিশ্চয় এক বান্দা গুনাহ করে বলল, “হে আল্লাহ! আমার পাপ ক্ষমা করে দিন, কেননা, আপনি ছাড়া কেউ পাপ মার্জনা করতে পারে না।’ তারপর আবারও পাপ করে বলল, 'হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করে দিন, কেননা, আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। এরপর আবারও গুনাহ করে বলল, হে আল্লাহ! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দিন। কারণ, আপনি ব্যতীত কেউই গুনাহ মার্জনা করতে পারবে না। অতপর মহান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা জানে যে, তার একজন প্রভু আছেন যিনি কাউকে পাপের কারণে পাকড়াও করবেন এবং কাউকে ক্ষমা করে দিবেন। অতএব আমার বান্দা যা ইচ্ছা করুক। অর্থাৎ (এভাবে গুনাহ হয়ে গেলে তওবা করতে থাক এবং) যতক্ষণ পর্যন্ত সে অনুতপ্ত হতে থাকবে, অনুশোচনা ও তওবা করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করতে থাকব।”

দুঃখিত হবেন না, সব কিছুই ভাগ্যানুসারে ঘটবে

তকদীর অনুপাতে ও যা সিদ্ধান্ত করা হয়েছে সে অনুসারেই সব কিছু ঘটে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত মুসলিমদের ধর্ম-বিশ্বাস এমনই। আল্লাহর ইলমের বাইরে, তার অনুমতি ছাড়া এবং ঐশী পরিকল্পনা ছাড়া এ বিশ্ব জগতে কোন কিছুই ঘটে না।

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

“পৃথিবীতে এবং তোমাদের মাঝে যে বিপর্যয় আসে তা আমি ঘটানোর পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে, নিশ্চয় সে কাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ।” (৫৭-সূরা আল হাদীদ: আয়াত-২২)

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

“নিশ্চয় আমি প্রতিটি জিনিসকেই তার পূর্বনির্ধারণী অনুসারেই সৃষ্টি করি।” (৫৪-সূরা আল ক্বামারঃ আয়াত-৪৯)

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি ইত্যাদি কতিপয় জিনিস দ্বারা পরীক্ষা করব এবং (হে নবী মুহাম্মাদ) আপনি ধৈর্যশীলদেরকে (জান্নাতের) সুসংবাদ দিন।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৫৫)

একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“মুমিনের কাজ বড়ই আশ্চর্যজনক! নিশ্চয় তার সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর। যখন তার কোন কল্যাণ হয় তখন শুকরিয়া আদায় করে, ফলে তা তার আরো কল্যাণকর হয়ে যায়। আর যখন তার কোন ক্ষতি হয় তখন সে ধৈর্য ধারণ করে, ফলে সে ক্ষতিও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। আর এমনটি মু’মিন ছাড়া অন্য কারো জন্যই হয় না।”

একটি বিশুদ্ধ হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“যখন তুমি কোন কিছু চাইবে, তখন তুমি তা আল্লাহর নিকটে চাও, আর যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন তুমি আল্লাহর নিকটই সাহায্য চাও। আর জেনে রাখ যে, সব মানুষও যদি কোন বিষয়ে তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয় তবুও তারা তা করতে পারবে না। তবে আল্লাহ তোমার ভাগ্যলিপিতে যেটুকু লিখে রেখেছেন ততটুকু উপকার করতে পারবে। আর যদি তারা তোমার ক্ষতি করার জন্যও একত্রিত হয় তবুও তারা তা করতে পারবে না, তবে তোমার ভাগ্যলিপিতে আল্লাহ যেটুকু লিখে রেখেছেন-সেটুকু ক্ষতি তারা করতে পারবে। কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে এবং (কালিতে লিখিত) পৃষ্ঠাসমূহ শুকিয়ে গেছে।”

নবী করীম (তার উপর করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক) আরো বলেছেন-

“এবং জেনে রাখ যে, যা তোমার নিকট এসেছে তা তোমার নিকট না আসার ছিল না এবং যা তোমার নিকট আসেনি তা তোমার নিকট আসার ছিল না।”

অন্য একটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“যা তোমার উপকার করবে তার জন্য চেষ্টা কর, আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও, দুর্বল হয়ো না ও এ কথা বলো না যে, আমি অমুক অমুক কাজ করলে অবস্থা এমন এমন হতো। বরং একথা বল যে, আল্লাহ সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন এবং তিনি যা চান তা তিনি করেন।”

আরো একখানি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“বান্দার জন্য আল্লাহ যে ফয়সালা করেন তা তার জন্য কল্যাণকর।”

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াকে পাপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলো, এটা কি কারো জন্য উপকারী? তিনি বললেন “হ্যাঁ, তবে এ শর্তে যে, পাপের পর লজ্জিত, অনুতপ্ত, ক্ষমা প্রার্থনাকারী ও মানসিকভাবে চরম অনুতপ্ত হতে হবে।”

মহান আল্লাহ বলেন-

“এবং এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা অপছন্দ কর তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর আর এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা পছন্দ কর তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর এবং আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-২১৬)

 ৫০. দুঃখিত হবেন না- একটি সুখদায়ক পরিণতির জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করুন
নিচের হাদীসখানি তিরমিযী শরীফে পাওয়া যায়-

“সর্বোত্তম ইবাদত হলো (ধৈর্য সহকারে) স্বস্তির জন্য অপেক্ষা করা।”

أَلَيْسَ الصُّبْحُ بِقَرِيبٍ

“প্রভাত কি নিকটবর্তী নয়?”

দুর্দশাগ্রস্তদের প্রভাত আবির্ভূত হচ্ছে, সুতরাং এর জন্য অপেক্ষা করুন। একটি আরবী প্রবাদ আছে, “রশি যদি বেশি কষে তবে তা ছিড়ে যায়।”

অন্য কথায়, যদি কোন অবস্থা সংকটজনক স্তরে পৌছে যায় তবে আলো ও খোলা পথের প্রত্যাশা কর। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

“আর যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তবে আল্লাহ তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দিবেন।” (৬৫-সূরা আত তালাক্ব: আয়াত-৫)

“আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে- আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।" (৬৫-সূরা আত তালাক্ব : আয়াত-৪)

একখানি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর এ কথা বলেন-

“আমার বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা পোষণ করে আমি (তার প্রতি) সেরূপই (আচরণ করি); সুতরাং, সে যেরূপ ইচ্ছা আমার প্রতি সেরূপই ধারণা পোষণ করুক।”

সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন-

“অবশেষে যখন রাসূলগণ হতাশ হয়ে গেলেন আর মানুষেরা ধারণা করল, তাদেরকে (অর্থাৎ রাসূলদেরকে) মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে বা (নবীগণ ভাবলেন,) মানুষেরা তাদেরকে মিথ্যুক ভাবছে, তখন তাদের নিকট আমার সাহায্য আসল। অতএব, আমি যাকে ইচ্ছা করি সে মুক্তি পায়।” (১২-সূরা ইউসুফ : আয়াত-১১০)

জেনে রাখুন যে, কষ্টের সাথে অবশ্যই স্বস্তি আছে। কোন কোন মুফাচ্ছির বা কুরআনের ব্যাখ্যাকার বলেন, “একটি সঙ্কট দু'টি আরামকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।” এবং এ কথাকে তারা হাদীস মনে করেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
“জেনে রাখ যে ধৈর্যের মাধ্যমে বিজয় আসে এবং কষ্টের মাধ্যমে আরাম আসে।”

একজন আরবী কবি বলেছেন-
“যখন নাকি কিছু চোখ ঘুমিয়ে আছে তখন কিছু আঁখি আছে বিশ্রামহীন,

কী ঘটবে আর কী ঘটবে না তা নিয়ে গভীর ধ্যানেমগ্ন;
অতএব, যথাসম্ভব দুশ্চিন্তা ত্যাগ কর;
কেননা, দুশ্চিন্তার বোঝা বহন করা পাগলামি।
তোমার প্রভু আছেন, যিনি তোমার গতকালের সমস্যা সমাধান করেছেন,
তিনিই আগামীকালও তোমার যা সমস্যা হবে তা সমাধান করবেন।”

আরেক আরবী কবি বলেছেন-
১. “ঘটনা প্রবাহকে তার পূর্বনির্ধারিত পথে চলতে দাও, আর দুশ্চিন্তামুক্ত মন নিয়ে ঘুমাও।
২. কেননা, আল্লাহ এক পলকের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন করে দেন।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url