আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-১৩) || মনমরা হবেন না- পরোপকার করুন || যাতনার সময় ধৈর্য ধারণই হলো সফলতার উপায় ||





যাতনার সময় ধৈর্য ধারণই হলো সফলতার সবচেয়ে বড় উপায়


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

একটু গভীরভাবে ভাবুন

বিষন্ন হবেন না : কারণ, অসুস্থতা জীবের সাময়িক অবস্থা মাত্র; পাপ মাফ করা হবে; ঋণ পরিশোধ (করা) হবে; বন্দী মুক্তি পাবে; আপনার প্রিয় প্রবাসী ব্যক্তি ফিরে আসবে; পাপী অনুতপ্ত হবে এবং গরীবরা ধনী হবে।

দুঃখিত হবেন না : এজন্য যে, আপনি কি দেখতে পান না যে, কিভাবে কালো মেঘ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় এবং প্রচণ্ড ঝঞ্চা বায়ু কিভাবে প্রশমিত হয়ে যায়? আপনার কষ্টের পরেই শান্তি আসবে এবং আপনার ভবিষৎ উজ্জ্বল হবে।

দুশ্চিন্তা করবেন না : কারণ সূর্যের উষ্ণ কিরণ প্রচুর ছায়ায় দূর হয়ে যাবে, দুপুর-রোদের তৃষ্ণা শীতল পানিতে মিটে যাবে, ক্ষুধার জ্বালা উষ্ণ খাবারে মিটে যাবে এবং নিদ্রাহীনের উদ্বিগ্নতা গভীর ঘুমে দূর হয়ে যাবে বা উদ্বিগ্ন ব্যক্তির অনিদ্রার পর গভীর ঘুম আসবে। স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারের পর অসুস্থ ব্যক্তি যাতনার কথা শীঘ্রই ভুলে যাবে। আপনার কর্তব্য শুধু অল্প সময়ের জন্য সহ্য করা এবং কয়েক মুহুর্তের জন্য ধৈর্যশীল হয়ে থাকা।

আলী ইবনে জাবলা বলেছেন-
সম্ভবত : একটি উদ্ধারের পথ পাওয়া যাবে,
সম্ভবত : আমরা সম্ভাবনার দ্বারা সান্তনা পাব।

সুতরাং তোমার মনকে দমন করে যে দুশ্চিন্তা তার মোকাবেলায় তুমি হতাশ হয়ে যেয়ো না, কারণ, মানুষ যখন সব আশা হারিয়ে ফেলে তখন সবচেয়ে নিকটবর্তী সত্তা (আল্লাহ) উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসবেন।

আল্লাহ আপনার জন্য যা পছন্দ করেছেন আপনিও আপনার জন্য তা পছন্দ করুন। তিনি যদি আপনাকে দাঁড়াতে বলে তবে আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন এবং তিনি যদি আপনাকে বসতে বলে তবে আপনি বসে থাকুন। তিনি যদি আপনাকে দরিদ্র বানিয়ে থাকেন, তবে ধৈর্য প্রদর্শন করুন। আর তিনি যদি আপনাকে ধনী বানিয়ে থাকেন তবে কৃতজ্ঞ হোন। একথাগুলো বুঝে আসে একথার দ্বারা যে—

رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا ، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا ، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا

প্ৰভু হিসেবে আল্লাহকে, ধর্ম হিসেবে ইসলামকে এবং নবী হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মেনে নিয়েছি।”

এবং একজন আরব কবি বলেছেন-

لا تُدبِّرْ لك أمراً ٭ فأولوا التدبيرِ هلْكى
وارض عنا ان حكمنا ٭ نحنُ أولى بِك مِنكا

“তোমার জন্য কোন পরিকল্পনা করিও না, কেননা, পরিকল্পনাকারীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত; আর আমার হুকুমে রাজি হয়ে যাও। আমি পরিকল্পনার জন্য তোমার চেয়ে অধিক যোগ্য।”

মনঃক্ষুন্ন হবেন না : অন্যের কাজ কর্মকে উপেক্ষা করুন। তারা ক্ষতি করার, উপকার করার, জীবন-মৃত্যু, পুরস্কার বা শক্তি কোন কিছুই দেয়ার দাবি করতে পারে না।

ইব্রাহিম ইবনে আদহাম বলেছেন- “আমরা যে (ইবাদতের মধ্যে পরমানন্দের) জীবন যাপন করি তা যদি রাজা-বাদশাগণ জানতেন তবে তারা এ বিষয়ে আমাদের সাথে তরবারি দ্বারা যুদ্ধ করতেন।”

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেছেন- “মাঝে মাঝে (মনের এমন অবস্থা হয় যে, তখন) আমি বলি, বেহেশতবাসীরা যদি এ অবস্থা উপলব্ধি করতে পারত তবে বাস্তবিকই তাদের জীবন চমৎকার হতো।”

তিনি অন্য (ঘটনার) সময় বলেছেন- “আল্লাহ্‌র জিকিরের ও আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের অনুভূতি পরমানন্দে আত্মা মাঝে মাঝে নেচে উঠে।”

জেলখানায় প্রবেশকালে প্রহরীরা যখন তার সামনের দরজা বন্ধ করছিল তখন তিনি আরোও বলেছেন-

“অতএব তাদের মাঝে একটি দেয়াল খাড়া করা হবে, তার একটি দরজা থাকবে। এর ভিতরে থাকবে রহমত এবং এর বাহিরে থাকবে শাস্তি।” (৫৭-সূরা আল হাদীদ: আয়াত-১৩)

জেলখানায় থাকাকালে তিনি বলেছিলেন-

“আমার শক্ররা আমার কী করতে পারবে। আমার অন্তরেই আমার বেহেশত আছে; আমি যেখানেই যাই আমার জান্নাত আমার সাথেই থাকে। আমার শক্ররা যদি আমাকে হত্যা করে। তবে আমি শহীদ হব। যদি তারা আমাকে আমার দেশ ত্যাগে বাধ্য করে তবে আমি পর্যটক হিসেবে বিদেশে যাব, আর যদি আমাকে বন্দী করে তারা আমাকে (আল্লাহর ইবাদত করার জন্য) নিরিবিলি পরিবেশের বন্দোবস্ত করে দেয়।”

একদা এক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন “যে আল্লাহকে হারিয়েছে সে কী পেয়েছে? আর যে আল্লাহকে পেয়েছে সে কিসের সন্ধান পেয়েছে? তারা কখনও সমান হতে পারে না। যে আল্লাহকে পেয়েছে সে সবকিছুই পেয়েছে আর যে আল্লাহকে হারিয়েছে সে সবকিছুই হারিয়েছে।”

অন্ধভাবে দুঃখ করবেন না, বরং আপনি যে জিনিসের জন্য দুঃখ করছেন অতি অবশ্যই তার মূল্য আপনাকে জানতে হবে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لأَنْ أَقُولَ : سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ

“আমার নিকট ‘আল্লাহ কতই না পবিত্র: সব প্রশংসা তারই প্রাপ্য: তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’ একথা বলা সূর্য যেসব জিনিসের উপর উদিত হয় তার চেয়েও বেশি প্রিয়।”

ধনী লোকদের অট্টালিকা-দালান-কোঠা-ঘর-বাড়ি এবং তাদের ধন-সম্পদ সম্বন্ধে আমাদের এক পূর্বসূরী বলেন, আমরা খাদ্য খাই তারাও খাদ্য খায়। আমরা পান করি তারাও পান করে। আমরা দর্শন করি তারাও দর্শন করে। আমাদেরকে হিসাব বা জবাব দেয়ার জন্য ডাকা হবে না তাদের মত করে। যেমন তাদেরকে কৈফিয়ত দেয়ার জন্য ডাকা হবে (কীভাবে তারা সম্পদ উপার্জন করেছে এবং কীভাবে এগুলো খরচ করেছে?)

কবির ভাষায়-
“কবরে প্রথম রাত কবরবাসীকে খসরুর রাজ প্রসাদ ও সীজারের স্বর্ণ-ভাণ্ডারের কথা ভুলিয়ে দিবে।”

আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-
“তোমরাতো (সম্পদ, সঙ্গী ও অন্য সবকিছু ছাড়া) ঠিক তেমনি একাকী আমার নিকটই এসেছ, যেমনি তোমাদেরকে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম।” (৬-সূরা আল আন’আম: ৯৪)

মু’মিনগণ বলেন“ইহা তো তাই যা আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে অঙ্গীকার করেছিলেন এবং আল্লাহ ও তার রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছিলেন।” (৩৩-সূরা আল আহযাব: আয়াত-২২)

মুনাফিকরা বলে- “আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।” (৩৩-সূরা আল আহযাব: আয়াত-১২)

আপনার জীবন আপনার চিন্তারই ফসল। আপনি মনে মনে যা ভাবেন তা আপনার জীবনে এক অমোচনীর প্রভাব ফেলবে- তা এবার সুখপ্রদ চিন্তা হোক বা হতাশাব্যঞ্জক চিন্তাই হোক (অর্থাৎ— সুচিন্তায় সুপ্রভাব ও কুচিন্তায় কুপ্রভাব পড়বে। -বঙ্গানুবাদক)

একজন কবি বলেছেন-
لا يملا الهول قلبي قبل وقعته * ولا أضيق به ذرعا إذا وقعا

দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমার মন দুশ্চিন্তায় ভরে যায় না এবং যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি না।”

মনমরা হবেন না- পরোপকার করুন

অন্যদের নিকট কাজের হওয়া সুখের দিকে নিয়ে যায়। একটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে আছে: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেছেন –

“আল্লাহ তা'য়ালা যখন বিচার দিবসে তার বান্দার বিচার করবেন তখন তিনি নিশ্চয় তার বান্দাকে বলবেন, “হে আদম সন্তান! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম অথচ তুমি আমাকে খাওয়াওনি” সে উত্তর দিবে, যখন নাকি আপনি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক তখন আমি আপনাকে কীভাবে খাওয়াতে পারি? তিনি বলবেন, “তুমি কি জানতে না যে, আমার বান্দা অমুকের পুত্র অমুক ক্ষুধার্ত ছিল কিন্তু তুমি তাকে খেতে দাওনি। হায়! তুমি যদি তাকে খেতে দিতে তবে তুমি তা (অর্থাৎ তার পুরস্কার) আমার নিকট পেতে। হে আদম সন্তান আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম অথচ তুমি আমাকে কিছু পান করতে দাওনি।” সে বলবে, আপনি হলেন সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আপনাকে আমি কীভাবে পান করতে দিতে পারি? তিনি বলবেন, “তুমি কি জানতে না যে আমার বান্দা অমুকের পুত্র অমুক পিপাসার্ত ছিল, কিন্তু তুমি তাকে পান করতে কিছু দাওনি। হায়! যদি তুমি তাকে পান করাতে হবে তার পুরস্কার আমার নিকট পেতে। “হে আদম সন্তান আমি অসুস্থ ছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি” সে বলবে, “আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে আসতে পারি? আপনিতো সারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক” তিনি বলবেন, “তুমি কি জানতে না যে, আমার বান্দা অমুকের পুত্র অমুক অসুস্থ ছিল, কিন্তু, তুমি তাকে দেখতে যাওনি। হায়! যদি তুমি তাকে দেখতে যেতে, তবে তুমি আমাকে তার নিকট পেতে।”

এখানে একটি মজার বিষয় হলো যে, হাদীসটির শেষ তৃতীয়াংশে “তুমি তার নিকট আমাকে পেতে।” কথাটি আছে। একথাটি হাদীসটির প্রথম দু'অংশের মতো নয়। সেসব স্থানে আছে– “তুমি তা (অর্থাৎ খাদ্য খেতে দেয়ার ও পানীয় পান করতে দেয়ার পুরস্কার) আমার নিকট পেতে।”

পার্থক্যের কারণ হলো এই যে, পরম করুণাময় আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন যাদের মন দুর্দশাগ্রস্ত, যেমনটি অসুস্থ ব্যক্তির মন। এবং আরেকটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“প্রতিটি তাজা কলিজাতে পুরস্কার আছে (অর্থাৎ যে কোন জীবিত সৃষ্টির বা জীবের সেবাতেই পুরস্কার পাওয়া যাবে।)”

আরো জেনে রাখুন যে, একটি তৃষ্ণাৰ্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে বনী ইসরাঈলের এক বেশ্যা মহিলাকে আল্লাহ তা'আলা জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং যে অন্য মানুষদেরকে খাদ্য দিয়ে, পানি দিয়ে এবং তাদের কষ্ট ক্লেশ অভাব-অনটন দূর করে তাদের সেবা করে তার (পুরস্কারের) বিষয়টি কতই না সুন্দর হবে!

একখানি সহীহ হাদীসে আছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় আছে, সে যেন এর থেকে যার কোন পাথেয় নেই তাকে দেয়। এবং যার একটি অতিরিক্ত বাহন আছে সে যেন তা তাকে দেয় যার কোন বাহন নেই।”

হাতেম তাই তাঁর চাকরকে মেহমান তালাশের আদেশ দিয়ে তাঁর সুন্দর এক কবিতার কয়েকটি পঙক্তিতে বলেছেন-

“আগুন জ্বালাও, কেননা রাত্রিটি অবশ্যই ঠাণ্ডা, তুমি যদি আমাকে একজন মেহমান এনে দিতে পার তবে তুমি মুক্ত” এবং তিনি তার স্ত্রীকে বলেছেন-

“যখন তুমি খাদ্য প্রস্তুত করবে তখন একজন ক্ষুধার্তের তালাশ করিও, কেননা, আমি একাকী খাই না।”

ইবনে মুবারক (রহঃ)-এর প্রতিবেশী একজন ইহুদী ছিল। তিনি নিজের সন্তানদেরকে খাওয়ানোর পূর্বেই সর্বদা সে ইহুদীকে খাওয়াতেন এবং প্রথমে তাকে কাপড় দেয়ার পর তার সন্তানদেরকে কাপড়-চোপড় দিতেন। এক সময় কিছু লোক ইহুদীকে বলেছিল যে, “আমাদের নিকট তোমার বাড়িটি বিক্রি করে দাও।” সে উত্তর করল যে, “আমার বাড়ির দাম দু'হাজার দিনার, এক হাজার বাড়ির মূল্য আরেক হাজার ইবনে মুবারক (রহঃ) প্রতিবেশী হওয়ার কারণে।” আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) একথা শুনে পরমানন্দে চিৎকার দিয়ে বলেন, “হে আল্লাহ! তাকে ইসলামের পথ দেখান” তারপর সে আল্লাহর ইচ্ছায় ইসলাম কবুল করেছিল।

আরেক বার আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক হজ্জ্ব কাফেলার সাথে মক্কায় হজ্জ্ব করতে যাচ্ছিলেন। তিনি কাফেলার এক মহিলাকে নোংরা আবর্জনার স্থান থেকে একটি মরা কাক তুলে নিতে দেখলেন। তিনি তার খাদেমকে এ বিষয়ের তত্ত্ব-তালাশ করার জন্য পাঠালেন। সে যখন মহিলাটিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করল তখন মহিলাটি উত্তর দিল, “তিনদিন যাবৎ আমাদের কিছুই নেই তাই বাধ্য হয়ে একাজ করেছি” আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক যখন একথা শুনলেন তার নয়ন যুগল তখন অশ্রুতে ভরে গেল। তিনি তার সব পাথেয়কে সকল সদস্যের মাঝে বণ্টন করে দিতে আদেশ দিলেন এবং যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার মতো কোন পাথেয় না থাকায় তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন এবং সে বছরের জন্য হজ্জ্ব মুলতবি রাখলেন। পরে তিনি দেখলেন যে, কেউ একজন বলছে, তোমার হজ্জ কবুল হয়েছে, যেমনটি হয়েছে তোমার অন্যান্য নেক আমলও এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।”

মহান আল্লাহ বলেন-

وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
“সে সব জিনিসের অভাব থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যদেরকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়।” (৫৯-সূরা আল হাশর: আয়াত-৯)

একজন কবি বলেছেন- “আমি যদি এমন ব্যক্তি হই যে তার বন্ধু থেকে বহুদূরে থাকে, তবুও তাকে আমার সাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করি এবং তার কষ্ট লাঘব করার ইচ্ছা রাখি।

যদি সে চমৎকার নতুন পোশাকে সাজসজ্জা করে তবে আমি বলব না যে, “হায়! সে যে পোশাক পরে আছে তা পরে আমি যদি ধন্য হতাম” আল্লাহর কসম! কতইনা উত্তম আচরণ এবং কতইনা উদার হৃদয়।

ভালো কাজে বাড়াবাড়ি করলেও কেউ অনুতপ্ত হয় না। অনুতাপ অনুশোচনা শুধু ভুলের জন্য এবং অন্যায় কৃতকৃর্মের জন্যই, এমনকি সে অন্যায় যদি ছোট খাট অন্যায়ও হয় তবুও।

হিংসা নতুন কিছু নয়

আপনি যদি আপনার কানে কিছু রুষ্ট কথা-বার্তার শব্দ বাজতে শুনতে পান তবে এতে উদ্বিগ্ন হবেন না- কেননা, হিংসা নতুন কিছু নয়। যেমনটি একজন কবি বলেছেন-

“মহৎ গুণাবলি অর্জন করতে মনোযোগ দাও এবং প্রচেষ্টা কর, যে ব্যক্তি তোমার নিন্দ করে তার হিংসার জ্বালা ঠান্ডা করে তার প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর। জেনে রাখ যে, জীবনটা নেক আমল করার মওসুম; আর মৃত্যুর পর সব হিংসা বন্ধ হয়ে থাকে।”

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন-
“অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তিরা যখন নিন্দ ও অন্যায় তিরস্কারের কবলে পড়ে তখন তাদেরকে অবশ্যই তাদের স্নায়ুসমূহে কিছু পরিমাণ শীতলতা জোর করে ঢেলে দিতে হবে।” অর্থাৎ জোর করে হলেও তাদের মন-মস্তিস্ক ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

আরেকজন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন-
“কাপুরুষ মরে বারবার আর সাহসী মানুষ মরে একবার।” আল্লাহ যদি তার কোন বান্দার কল্যাণ চান তবে তিনি তাকে নিরাপত্তা হিসেবে তন্দ্রা দ্বারা আচ্ছন্ন করে নেন। যেমনটি ঘটেছিল তালহা (রাঃ)-এর উহুদ যুদ্ধের পূর্বে। যুদ্ধের কিছুক্ষণ আগে কাফেররা যখন মানসিক আশংকায় অপেক্ষা করছিল তখন তিনি তন্দ্ৰালু হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তার হাত থেকে কয়েকবার তরবারি পড়ে গিয়েছিল তিনি এতটাই প্রশান্তি বোধ করেছিলেন।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন-

قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَن يُصِيبَكُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِّنْ عِندِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا

“বল তোমরা কি আমাদের জন্য (শাহাদত বা বিজয় এই) দুটি কল্যাণের একটির প্রতীক্ষা করছ? অথচ আমরা তোমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছি যে, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট শাস্তি প্রেরণ করবেন অথবা আমাদের হাতে তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত ৫২)

“আল্লাহর অনুমতি এবং একটি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া কেউ কখনও মারা যেতে পারে না।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪৫)

আলী (রাঃ) বলেছেন-
“মৃত্যুর দুটি দিবসের কোনটিকে আমি ভয় করি? যেদিন আমার মৃত্যু নির্দিষ্ট নয় সেদিনকে না-কি যেদিন আমার মৃত্যু নির্দিষ্ট সেদিনকে? যেদিন আমার মৃত্যু নির্দিষ্ট সেদিনকে আমি ভয় করি না; কিন্তু, যেদিন মৃত্যু নির্দিষ্ট সেদিন সতর্ক ব্যক্তিরাও বাচতে পারবে না।”

আবু বকর (রাঃ) বলেছেন- “মৃত্যুকে তালাশ কর (অর্থাৎ সাহসী হও) তবেই তোমাদের জীবন দান করা হবে।”

একটু পজেটিভলী ভাবুন

দুঃখিত হবেন না : কেননা, আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করছেন এবং ফেরেশতারা আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। মু’মিনগণ প্রতি সালাতে তাদের দোয়ায় আপনাকে অংশীদার করছে (অর্থাৎ আপনার জন্য দোয়া করছে)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারদের জন্য সুপারিশ করবেন। কুরআন মজীদ ভালো ভালো উপদেশে ভরা, সর্বোপরি পরম করুণাময়ের দয়াতো আছেই।

বিষন্ন হবেন না : নেক আমলকে দশগুণ এমননি সাতশতগুণ বা তারও বেশি বর্ধিত করা হবে। অপরপক্ষে যখন নাকি বদ আমলকে বর্ধিত করা বা গুণ করা হবে না এবং আপনার প্রভু তা ক্ষমা করেও দিতে পারেন। কতবারইনা আমরা আল্লাহর মহানুভবতা লক্ষ্য করেছি। এ মহানুভবতা, উদারতা ও দয়া অপ্রতিদ্বন্দী ও অতুলনীয়। অন্য কারোও বদান্যতা তার বদান্যতার এমনকি নিকটেও পৌছতে পারে না।

যদি আপনি আল্লাহর সাথে কোন শরীক না করেন, আপনি সত্য ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন বা দ্বীনে হক্কের উপর ঈমান রাখেন, আপনি যদি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভালোবাসেন তবে আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। যদি আপনি আপনার মন্দ কাজের জন্য অনুতাপ করেন এবং সওয়াবের কাজ করার পর যদি আপনার খুশি লাগে তাহলে আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনার সাথে অনেক কল্যাণ আছে যা আপনি বুঝতে পারেন না।

নিচের হাদীসে যেমনটি আছে তেমনভাবে যদি আপনি আপনার জীবনের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে পারেন তাহলে আপনার কোন ভয় নেই।

“মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। ঈমানদার ছাড়া অন্য কারো জন্য এমনটি নয়। যদি সুখী হওয়ার মতো কিছু ঘটে তবে সে কৃতজ্ঞ হয়। আর এটা তার জন্য মঙ্গলজনক। আর যদি তিনি সমস্যা বা অভাব-অনটনে পড়েন তবে তিনি ধৈর্য ধরেন এবং এটা তার জন্য উপকারী।”

যাতনার সময় ধৈর্য ধারণই হলো সফলতার উপায়

মন:ক্ষুণ হবেন না: দু:খ যাতনার সময় ধৈর্য ধারণ হলো সফলতা ও সুখের উপায়।

“এবং ধৈর্য ধরুন, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আপনার ধৈর্য ধরা সম্ভব নয়।” (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-১২৭)

“অতএব, ধৈর্য ধরাই ভাল। আর তারা যা বলছে এর বিরুদ্ধে আল্লাহই সহায়ক।” (১২-সূরা ইউসুফ: আয়াত-১৮)

“সুতরাং তুমি ধৈর্য ধারণ কর উত্তম ধৈর্য।” (৭০-সূরা আল মাআরিজ: আয়াত-৫)

“তোমাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ।” (১৩-সূরা রাআদ: আয়াত-২৪)

“তোমার উপর যে বালা মুসিবত এসেছে বা আসবে তাতে ধৈর্য ধারণ কর এবং করিও।" (৩১-সূরা লোকমান: আয়াত-২৭)

“তোমরা ধৈর্য ধর এবং (তোমাদের শক্ৰদের সাথে) ধৈর্যের প্রতিযোগিতা কর (অর্থাৎ তাদের চেয়েও বেশি ধৈর্য ধর) এবং যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত থাক বা যেখান থেকে শত্রু বাহিনী আক্রমণ করতে পারে সেখানে সৈন্য-বাহিনী স্থাপন করে তোমাদের অঞ্চলকে রক্ষা কর।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-২০০)

ওমর (রাঃ) বলেন : “ধৈর্যের মাধ্যমে আমরা সুন্দর জীবন লাভ করেছি।”

আহলে সুন্নতের বা সুন্নতের অনুসারী লোকদের বালা-মুসিবতের মুকাবিলার তিনটি উপায় আছে: ধৈর্য, দোয়া ও শুভ পরিণতির জন্য অপেক্ষা।

একজন কবি বলেছেন-

“আমরা তাদেরকে এক গ্লাস পানীয় পান করালাম, অনুরূপভাবে তারাও আমাদেরকে একগ্লাস পানীয় পান করাল। কিন্তু মৃত্যুমুখে আমরাই বেশি ধৈর্যশীল ছিলাম.”

একটি সহীহ হাদীসে আছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“মন্দ কথা শুনার পরে আল্লাহর চেয়ে বেশি ধৈর্যশীল অন্য কেহ নেই। তারা দাবি করে যে, আল্লাহর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে, তবুও আল্লাহ তাদেরকে সুস্থ রাখছেন ও রিযিক দিচ্ছেন।"

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-

“আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। (আমি যে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি) তিনি এর চেয়েও বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-

“যে ধৈর্য ধরে আল্লাহ তাকে অনবরত ধৈর্য ধরার জন্য অতিরিক্ত শক্তি প্রদান করবেন।”

একজন কবি বলেছেন-

“মর্যাদার পথে আমি হামাগুড়ি দিয়ে চললাম আর যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তারা এতে পৌছে গেছে।”

কঠোর পরিশ্রম করে, চেষ্টার সামান্য ক্রটিও না করে অনেকে সেখানে পৌছার চেষ্টা করেছে, আর অধিকাংশরাই যাত্রা পথে বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর তারা প্রকৃত মর্যাদার সাক্ষাৎ পেয়েছে এবং তারা ধৈর্যশীল। তুমি যে আপেল খাও মর্যাদাকে তা মনে করিওনা (অর্থাৎ মর্যাদা অর্জন করা আপেলের মত মজাদার বা সহজ নয়, বরং তা কষ্টসাধ্য। -অনুবাদক) ধৈর্য দ্বারা সমস্যাকে জয় করতে না পারলে তুমি মর্যাদা অর্জন করতে পারবে না।”

উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্বপ্ন ও কল্পনার মাধ্যমে অর্জিত হয় না; একমাত্র ত্যাগ ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই তা অর্জিত হতে পারে। মানুষেরা আপনার সাথে কতটা খারাপ আচরণ করল তাতে দুঃখ করবেন না। বরং তারা আল্লাহর সাথে কতটা খারাপ আচরণ করে। (আর আল্লাহ কতটা ধৈর্য ধরছেন) তা পর্যবেক্ষণ করে (ধৈর্য ধারণ করে) শিক্ষা গ্রহণ করুন।

ইমাম আহমদ (রহঃ) তার ‘কিতাবুয যুহদ’ বা ‘যুহদ’ নামক পুস্তকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন-

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ বলেন-

“হে আদম সন্তান! তুমি বড়ই অদ্ভুত। আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি অথচ তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত কর এবং আমি তোমাকে রিযিক দিলাম অথচ তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্যের প্রশংসা কর। তোমাকে আমি নেয়ামত দিয়ে তোমার প্রতি আমার ভালবাসার প্রকাশ ঘটাই অথচ তোমার নিকট আমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি পাপ করে আমার অবাধ্যচারিতা করছ অথচ তুমি আমার নিকট ফকীর, অভাবী ও মুখাপেক্ষী! আমার কল্যাণ তোমার নিকট অবতীর্ণ হচ্ছে অথচ তোমার পাপ ও মন্দকার্য আমার দিকে উঠে আসছে।”

ঈসা (আঃ)-এর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় ত্রিশটি রোগী ও অনেক অন্ধ লোককে আরোগ্য করেছিলেন। পরবর্তীতে তারা তার (বিরুদ্ধে) শক্র হয়ে গিয়েছিল।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url