আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-১৯) || বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ ঔষধ || জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত || আপনি আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি ||





আপনি আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি

ডা. জেমস গর্ডন গিলকী বলেছেন- “আত্ম পরিচিতির অভাবের সমস্যা বা সংকট প্রাগৈতিহাসিক এবং এটা সকল মানুষের বেলায় একই রকমের; একই রকমভাবে আত্মপরিচয়ের অভাবহীনতাও একটি সমস্যা, যা বহু ব্যক্তিগত ভারসাম্যহীনতা ও সমস্যার উৎস।”

অন্য একজন বলেছেন- “সৃষ্টির মাঝে আপনি এক অনন্য সৃষ্টি; কোনো কিছুই হুবহু আপনার মতো নয়, আর আপনি হুবহু অন্য কোনও কিছুর মতো নন। কারণ, স্রষ্টা সৃষ্টির মাঝে বিভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন।”

إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّىٰ

“নিশ্চয় তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন রকমের।" (৯২-সূরা আল লাইল: আয়াত-৪)

শিশু শিক্ষা বিষয়ে এনজেলো ব্যাটারো তেরোটি বই ও হাজার হাজার প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি একবার লিখেছেন- “যে ব্যক্তি নিজের মতো (অর্থাৎ স্বাধীনভাবে) বড় না হয়ে অন্যের আকৃতি ও চিন্তা-চেতনার অনুকরণে বড় হয়েছে তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই।”

“তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, ফলে উপত্যকাসমূহ পরিমাণমত প্লাবিত হয়।” (১৩-সূরা হুদঃ আয়াত-১৭)

প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজস্ব স্বভাব বৈশিষ্ট্য, মেধা ও ক্ষমতা আছে, সুতরাং, কারো উচিত নয় তার ব্যক্তিত্বকে অন্যের মাঝে গলিয়ে বা বিকিয়ে দেয়া।

নোট: এ পুস্তকে এ ধরনের কথা বারবার এসেছে। তবে পাঠকগণ মনে রাখবেন যে, ধর্মীয় বিধি-বিধান, আদর্শ, রীতি-নীতি তথা আল্লাহ প্রেরিত আদর্শ মহামানব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ, রীতি-নীতি, বিধি-বিধান ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ ধরনের কথাবার্তা প্রযোজ্য নয়। —বঙ্গানুবাদ।

নিঃসন্দেহে আপনাকে সীমিত উপায়-উপকরণ ও ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো আপনাকে অতি নির্দিষ্ট ও সীমিত উদ্দেশ্য সম্পাদনে সাহায্য করবে। একথা বিজ্ঞতার সাথেই বলা হয়েছে যে, নিজেকে বুঝতে ও চিনতে চেষ্টা কর; তাহলেই তুমি তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কী তা জানতে পারবে।

ইমারসন তার আত্মবিশ্বাস বা স্ব-নির্ভরতা বিষয়ক প্রবন্ধে বলেছেন- “এমন এক সময় আসবে যখন মানুষের জ্ঞান এমন স্তরে পৌছবে যেখানে তার বিশ্বাস জন্মাবে যে, হিংসা হলো মূর্খতা এবং অনুকরণ হলো আত্মহত্যার শামিল। এবং প্রত্যেকেই নিজে যেমন তেমনই রীতিনীতি গ্রহণ করবে-পরিবেশ যেমনই থাক না কেন; (আল্লাহর পছন্দনীয় রীতি-নীতির পক্ষেই এ কথা গ্রহণীয় নচেৎ নয়। -অনুবাদক) কেননা, এতেই তার ভাগ্য। গোটা দুনিয়া কল্যাণে ভরপুর থাকলেও যতক্ষণ না কেউ তার নিজের জমিতে ফসলের চারা রোপণ করবে ও তার যত্ন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই কিছুই অর্জন করতে পারবে না। (অর্থাৎ নিজের কল্যাণ নিজেই সাধন করতে হবে। -অনুবাদক)

প্রত্যেকের মাঝে যে (নতুন নতুন) প্রতিভা লুকায়িত আছে তা পৃথিবীর নিকট নতুন এবং কেউই চেষ্টা না করে এ ক্ষমতার বিস্তার সম্বন্ধে জানতে পারে না।”

“এবং হে মুহাম্মদ! বলুন, “আমল কর। কেননা, শীঘ্রই আল্লাহ, তার রাসূল ও মু’মিনগণ তোমাদের আমল দেখবেন।”

“বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা পাপ করে নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।” (সূরা-৩৯ আয-যুমার আয়াত-৫৩)

“এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে এবং (পাপ করে) নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেললে (তৎক্ষণাৎ আল্লাহকে স্মরণ করে নিজেদের গুণাহ ক্ষমা চায়, আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ মাফ করতে পারে এবং তারা যা করে ফেলেছে জেনে শুনে তারা তা করতে থাকে না।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৫৩)

“আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে বা (পাপ করে) নিজের প্রতি জুলুম করে পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে সে আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময় পাবে।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-১১০)

“এবং যখন আমার বান্দাগণ আপনাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে তখন (তাদেরকে বলে দিন যে,) আমি নিকটেই। যখন আহবানকারী আমাকে আহবান করে তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিই। সুতরাং তারাও যেন আমার আহবানে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে- যাতে করে তারা সঠিক পথ পায়।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৮৬)

“(না-কি তিনি উত্তম) যিনি দুর্দশাগ্রস্তরা যখন তাকে ডাকে তখন তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন এবং দুঃখ দুর্দশা দূর করেন এবং তোমাদেরকে (যুগে যুগে) পৃথিবীর প্রতিনিধি বানান (না-কি তোমাদের প্রভুগণ উত্তম)? আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ বা উপাস্য আছে কি? তোমরা খুব কমই উপদেশগ্ৰহণ কর।” (২৭-সূরা আন নামল: আয়াত-৬২)

“যে সব ঈমানদারদিগকে মুনাফিকরা বলেছিল যে, নিশ্চয় (কাফির) লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার জন্য) জমায়েত হয়েছে। অতএব, তাদেরকে ভয় কর; এতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তারা বলেছিলঃ ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি (আমাদের) কতইনা উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে বিজয়ী হয়ে ফিরে এল- তাদের কোন ক্ষতিই হয়নি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহের অধিকারী।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৭৩-১৭৪)

“আর আমি আমার বিষয়কে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করছি। নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। অতএব আল্লাহ তাকে তাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করলেন।” (৪০-সূরা আল মু'মিন: আয়াত-৪৪-৪৫)

যা কিছু ক্ষতিকর মনে হয় তার অনেক কিছুই কল্যাণকর

উইলিয়াম জেমস বলেছেন- “আমাদের বাধা-বিপত্তি আমাদেরকে এতটাই সাহায্য করে যে, আমরা তা কখনো আশাই করতে পারিনি। যদি ডষ্টয়িভস্কি ও টলষ্টয় দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপন না করত তবে তারা তাদের কালজয়ী পুস্তকাদি লিখতে সক্ষম হতো না। অতএব, এতীম, অন্ধ ও দরিদ্র হওয়া বা গৃহ ও আরাম-আয়েশ হতে দূরে থাকা হলো এমন সব অবস্থা যা আপনাকে অর্জন, খ্যাতি, অগ্রসর হওয়া ও অবদান রাখার পথে পরিচালিত করতে পারে।”

একজন আরব কবি বলেছেন-

قد ينعم الله بالبلوى وإن عظمت ٭ و يبتلي الله بعض القوم بالنعم

অর্থাৎ" আল্লাহ বালা-মুসিবতের মাধ্যমে (তার বান্দাদেরকে) অনুগ্রহ ধন্য করতে পারেন- আর সে বালা-মুসিবত যতই গুরুতর (মনে) হোক না কেন; এমনকি সন্তান-সন্ততি ও সম্পদও (অর্থাৎ জনবল ও ধন বলও) দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

(হে মুহাম্মদ!) অতএব তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন আপনাকে বিস্মিত না করে; আসলে আল্লাহ্ তো এসব দ্বারা তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৫৫)

ইবনুল আছীর পঙ্গু হওয়ার কারণে তার বিখ্যাত দুটি কিতাব জামেউল উসূল এবং আন-নিহায়াহ সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সারাখসি তাঁর সর্বমহলে সাদরে গৃহীত। পনেরো খণ্ড কিতাব আল ‘মাবসূত’ কূপের তলদেশে বন্দী থাকাকালে লিখেছেন। ইবনুল কাইয়েম সওয়ারীতে চড়ে ভ্রমণকালে ‘জাদুল মায়াদ’ লিখেছেন। ইমাম কুরতুবী জাহাজে চড়ে ভ্রমণকালে সহীহ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া জেলে থাকাকালে তার ‘ফাতাওয়ার’ অধিকাংশ লিখেছেন।

যে সকল হাদীস শাস্ত্রবিদগণ লক্ষ লক্ষ হাদীস সংকলন করেছেন তারা দরিদ্র ও পরবাসী ছিলেন। একজন ধাৰ্মিক লোক আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি কিছুদিন কারাভোগ করেছেন এবং তার কারাভোগ কালে তিনি সমগ্র কুরআন মাজীদ মুখস্ত করে ফেলেছেন আর ইসলামি আইন শাস্ত্রের (ফেকাহর) বড় বড় চল্লিশ খণ্ড কিতাব পড়েছেন।

আবুল আল মুয়াররি অন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর কিতাবাদি অন্যদেরকে দান করে দিয়েছিলেন। ত্বা-হা হোসাইন তার দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলার পরপরই তার প্রসিদ্ধ পত্রিকাবলি ও পুস্তকসমূহ লেখা শুরু করেছিলেন। অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিই পদচ্যুত বা চাকরীচ্যুত হওয়ার পর জ্ঞান ও চিন্তার জগতে তাদের (চাকরিচ্যুত হওয়ার বা পদচ্যুত হওয়ার) পূর্ববর্তী জীবনের তুলনায় অনেক বেশি অবদান রেখেছেন।

ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন যে-

“A little philosophy makes one lean towards disbelief, and to delve into philosophy brings the mind closer to religion.”

“অল্প দর্শন (জ্ঞান) মানুষকে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যায় আর দর্শন নিয়ে গভীর গবেষণা মনকে ধর্মের নিকটবর্তী করে।"

“আমি মানবজাতির জন্য এসব উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত পেশ করি, অথচ জ্ঞানী ব্যক্তিরা ছাড়া অন্যরা এসব বুঝতে পারে না।” (২৯-সূরা আল আনকাবূতঃ আয়াত-৪৩)

“আল্লাহর বাদাগণের মধ্য হতে শুধুমাত্র জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে।” (৩৫-সূরা ফাতির: আয়াত-২৮)

“এবং যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দান করা হয়েছে তাঁরা বলবে, “তোমরাতো আল্লাহর বিধানানুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত অবস্থান করেছিলে।” (৩০-সূরা আর রূম: আয়াত-৫৬)

হে মুহাম্মদ! আপনি বলে দিন যে, “আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে বিশেষভাবে উপদেশ দিচ্ছি, আর তা হলো যে, তোমরা জোড়ায় জোড়ায় বা পৃথক পৃথকভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দাঁড়াও এবং তারপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখ যে, তোমাদের এই সঙ্গী (মুহাম্মদ) পাগল নন-তিনি তো আসন্ন এক কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের জন্য একজন সতর্ককারী মাত্র।” (৩৪-সূরা আস সাবা: আয়াত-৪৬)

ডা. এ. এ. বিল বলেছেন- “সত্যিকার ঈমানদার কখনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হবে না।”

“নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য পরম করুণাময় (আল্লাহ) নিজেও মু’মিনদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন।” (১৯-সূরা মারইয়াম: আয়াত-৯৬)

“যে কোনো ঈমানদার পুরুষ বা মহিলা নেক আমল বা আমলে সালেহ করে আমি (আল্লাহ) অবশ্য অবশ্যই তাকে পবিত্র জীবন যাপন করাব এবং আমি (আল্লাহ) অবশ্যই অবশ্যই তারা যে নেক আমল করত তদানুপাতে তাদেরকে তাঁদের পুরস্কার দিব।” (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-৯৭)

“এবং নিশ্চয় আল্লাহ ঈমানদারদেরকে সরল সঠিকপথে পরিচালিত করেন।” (২২-সূরা আল হাজ্জ: আয়াত-৫৪)

বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ ঔষধ

আমাদের যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানী ডা. কার্লজাংগ তাঁর “The Modern Man in Search of Spirit” নামক পুস্তকের ২৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- “বিগত ত্রিশ বছর যাবৎ পৃথিবীর সবখান থেকেই লোকজন আমার নিকট উপদেশ গ্রহণ করার জন্য এসেছে। আমি শত শত রোগী চিকিৎসা করেছি। এদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা ৩৫ বছরের অধিক বয়স্ক। প্রত্যেকের সমস্যার একটিই সমাধান দেয়া হয়েছিল (আর তা হলো) ধর্মের মাঝে আশ্রয় সন্ধান করে জীবনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি (বা উদ্দেশ্য) ধারণ করতে সক্ষম হওয়া। আমি যথার্থই বলতে পারি যে, তারা প্রত্যেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এ কারণে যে, বিশ্বাসীদেরকে ধর্ম যে কল্যাণ দান করে তারা তা নির্ণয় করতে পারেনি। আর যে নাকি সত্যিকার বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না তাকে আরোগ্য করা যায় না।

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ

আর যে ব্যক্তি আমার জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অবশ্যই তার জন্য কষ্টকর জীবন রয়েছে।” (২০-সূরা ত্বাহা: আয়াত ১২৪)

“আমি অচিরেই কাফিরদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করব, কেননা, তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৫১)

“একের উপর আরেক অন্ধকারের স্তরসমূহ (এর মাঝে) কখনো যদি কেউ নিজের হাত বাহির করে তবে সে তা দেখতে পায় না। আর আল্লাহ যার জন্য আলো সৃষ্টি করেননি তার জন্য কোনো আলো নেই। (২৪-সূরা আন নূর: আয়াত-৪০)


আশাহারা হবেন না

দুঃখে-কষ্টে আছে এমন কাফেরদের প্রার্থনাতে আল্লাহ সাড়া দেন। অতএব, যে মুসলিমগণ আল্লাহর সাথে শরীক করে না তারা কত বেশি আশা করতে পারে? বুদ্ধের পর ভারতে সম্ভবত দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা মহাত্মা গান্ধী; তিনি যদি তার প্রার্থনার শক্তির উপর স্বাধীন না থাকতেন তবে পদস্খলনের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। একথা আমি কীভাবে জানি (আমার জানার) কারণ এই যে, তিনি নিজেই বলেছেন “আমি যদি প্রার্থনা না করতাম তবে আমি অনেক আগেই পাগল হয়ে যেতাম।” এ ছিল প্রার্থনার ফল। আর গান্ধী মুসলিমও ছিলেন না। সন্দেহাতীতভাবে তার ভ্রান্তি বিরাট ছিল; কিন্তু যা তাকে নিরাপদ পথে পরিচালিত করেছিল তা ছিল এমন এক পথ বা মত যাকে বলা যায়- কাজের সময় কাজী কাজ ফুৱালে পাজী- আর তা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ-

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

“আর যখন তারা জাহাজে চড়ে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডাকে, ফলে যখন তিনি তাদেরকে তীরে পৌছিয়ে উদ্ধার করেন তখন তারা শিরক করে।” (২৯-সূরা আল আনকাবূতঃ আয়াত-৬৫)

(“তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক কর তারা ভালো) নাকি তিনি (ভালো) যিনি দুর্দশাগ্রস্তের ডাকে সাড়া দেন-যখন সে তাকে ডাকে?” (২৭-সুরা আশ শেয়ারা আয়াত ৬২)

“এবং তারা মনে করে তারা তাতে পরিবেষ্টিত, তারা (তখন) একনিষ্ঠ চিত্তে আল্লাহকে ডাকে (আর বলে) : আপনি যদি আমাদেরকে এ বিপদ থেকে মুক্তি দেন তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ হব।” (১০-সূরা ইউনুস: আয়াত-২২)

মুসলিম পণ্ডিতবর্গ, মুসলিম ঐতিহাসিকবৃন্দ ও মুসলিম লেখকবৃন্দের জীবনীসমূহকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করেও আমি তাদের একজনকেও এমন পাইনি যে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত ও মানসিকরোগগ্ৰস্ত হয়ে

পড়েছে। কারণ এই যে, তারা সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করেছে এবং তারা এমন সরল জীবন-যাপন করত যে তা সব ধরনের আবেগমুক্ত ছিল।

“আর যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ঈমান আনে- আর তা (কুরআন) হলো তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য (কিতাব)- তিনি তাদের থেকে তাদের পাপ সমূহকে বিদূরিত করে দিবেন এবং অবস্থা ভালো করে দিবেন।” (৪৭-সুরা মুহাম্মদ বা কেতাল: আয়াত-২)

ইবনে হাজিমের নিম্নোক্ত কথাকে গভীরভাবে ভেবে দেখুন- “বাদশা ও আমার মাঝে পার্থক্যকারী মাত্র একটি দিনই আছে।”

অতীত সম্বন্ধে আমার কোনো অভিরুচি নেই; তারা এবং আমি উভয়েই ভবিষ্যতে যা ঘটবে তাকে সমভাবে ভয় করি, এভাবে মাত্র আজকের দিনটিই থাকে। আজ কি ঘটবে?

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আজকের দিনের কল্যাণ চাই এর বরকত, সাহায্য, নূর ও হেদায়েত চাই।”

“হে মু’মিনগণ! সতর্কতা অবলম্বন কর”। (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-৭১)

“আর সে যেন সতর্ক থাকে এবং তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও জানতে না দেয়।” (১৮-সূরা আল কাহাফ: আয়াত-১৯)

“তারা শুধু একথাই বলেছিল যে, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপসমূহকে এবং আমাদের কাজে আমাদের সীমালঙ্ঘনকে আপনি ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের কদমকে (পদক্ষেপকে) দৃঢ় রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪৭)

জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত

ডেল কার্নেগী এক ক্ষতযুক্ত রোগীর গল্প বর্ণনা করেছিলেন, সে রোগীর ক্ষত বেড়ে গিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল, চিকিৎসকগণ তাকে বলেছিল যে, তার জীবনের খুব অল্প সময়ই আছে (অর্থাৎ সে খুব কম সময় বাঁচবে)। তারা তাকে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, দাফন-কাফনের প্রস্তুতি গ্রহণ করাই তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

হঠাৎ করে রোগী হানী (রোগীর নাম-হানী) এক স্বত:স্ফূর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল: সে মনে মনে ভাবল যে, জীবনে যদি তার এত অল্পসময়ই অবশিষ্ট থেকে থাকে তবে কেন এটাকে সর্বোচ্চ উপভোগ করব না? সে ভাবল, কতবারইনা আমার মৃত্যুর পূর্বেই পৃথিবীটাকে ভ্রমণ করার ইচ্ছা করেছি। আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার এটাই নিশ্চিত সুযোগ।” সে তার টিকেট ক্রয় করে নিল।

চিকিৎসকগণ যখন তার পরিকল্পনার কথা জানতে পারল তখন তারা বিক্ষিত হয়ে গেল এবং তারা তাকে বলল, “আমরা বিধিমতে আপনার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছি এবং আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি: যদি আপনি এই ভ্রমণে অগ্রসর হন তবে আপনি মহাসাগরের তলদেশে কবরস্থ হবেন।” তাদের যুক্তি তর্ক বৃথা হয়ে গেল এবং তিনি শুধু বলেছিলেন “না, এমন কিছুই ঘটবে না। আমার পরিবারের সদস্যদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে আমি পারিবারিক গোরস্থানে কবরস্থ হওয়ার জন্য ফিরে আসব।”

এভাবে সে তার পরমোল্লাস ও আনন্দের যাত্রা শুরু করল। সে তার স্ত্রীকে একথা বলে চিঠি লিখল যে, “আমি ভ্রমণ-জাহাজের সর্বাপেক্ষা মনোরম খাবার খাই। আমি কাব্য পড়ি এবং এ যাবৎ আমি যে সুস্বাদ চর্বিযুক্ত খাবার খেতাম না তা এখন খাই। আমি আমার পূর্বের গোটা জীবনে যে আনন্দ করছি এখন আমি তার চেয়ে বেশি জীবনকে উপভোগ করছি।”

ডেল কার্নেগী দাবি করেন যে, লোকটি তার রোগ থেকে মুক্ত হয়েছিল এবং সে যে উদ্দীপক পন্থা গ্রহণ করেছিল তা রোগ-শোক ও ব্যথা-বেদনা দূর করতে সক্ষম।

উপদেশ: সুখ, আনন্দ-স্ফূর্তি এবং শান্ত ভাব ও সৌম্যতা প্রায়ই চিকিৎসকদের বড়ির চেয়েও বেশি উপকারী।

মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থাকা পর্যন্ত হতাশ হবেন না

“যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে তা তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি নয়; কিন্তু যে ব্যক্তি ঈমান আনে ও আমলে সালেহ করে তাদের জন্য তাদের আমলের বিনিময়ে রয়েছে বহু গুণ পুরস্কার এবং তারা (জান্নাতে বহুতল) ভবনে নিরাপদে থাকবে।” (৩৪-সূরা আস সাবা: আয়াত-৩৭)

ডেল কার্ণেগী বলেছেন- “পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমেরিকাতে উদ্বিগ্নতা ও মানসিক চাপই এক নম্বর হত্যাকারী। গত বিশ্বযুদ্ধে আমাদের সৈন্যের এক মিলিয়নের এক-তৃতীয়াংশ নিহত হয়েছে। একই সময়ে হৃদ-রোগে মারা যায় দুই মিলিয়ন। দ্বিতীয় দলে দুশ্চিন্তা উদ্বিগ্নতা ও মানসিক চাপই এক মিলিয়ন লোকের রোগের মূল কারণ।”

এলেক্সিস কারলাইল বলতে চান- “যে সব কাজের লোক মানসিক চাপ দমন করতে জানে না তারা অকালে মারা যায়।”

যে যুক্তির কারণে কারলাইল একথা বলতে চান তা সঠিক এবং আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।

“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া ও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া কোনো লোকেরই মৃত্যুবরণ করার সাধ্য নাই”। (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪৫)

কৃঞ্চ আমেরিকানরা ও চীনারা খুব কমই হৃদ-রোগের শিকার হয়। তারা সৌম্যতার সাথে ও শান্ত ভাবের সাথে জীবন যাপন করে। পক্ষান্তরে, আপনি দেখতে পাবেন যে, যেসব চিকিৎসকেরা হৃদ-রোগে মারা যায় তাদের সংখ্যা হৃদরোগে মারা যাওয়া কৃষকের সংখ্যার তুলনায় বিশগুণ বেশি। চিকিৎসকেরা এক কঠিন ও চাপ যুক্ত জীবন যাপন করেন- যার কারণে তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হয়।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



***************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url