আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-২০) || অল্পে তুষ্টি বিষন্নতা ও হতাশা দূর করে || দুনিয়া হচ্ছে মানুষের জন্য পরীক্ষার স্থান ||





অল্পে তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখাতেই জীবনের সফলতা


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

অল্পে তুষ্টি বিষন্নতা ও হতাশা দূর করে

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “আমাদের প্রভুকে যা সন্তুষ্ট করে আমরা শুধু তাই বলি।” আপনার জন্য যা পূর্বেই নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে তার নিকট আপনাকে সঁপে দেয়ার এক পবিত্র দায়িত্ব আপনার উপর রয়েছে। আপনি যদি এ দায়িত্ব পূর্ণ করেন তবে আপনার একটাই সুযোগ আছে আর তা হলো তকদীরে বিশ্বাস স্থাপন করা। কেননা, যা তকদীরে নির্ধারিত হয়ে গেছে তা অতি অবশ্যই ঘটবে। কোনরূপ কৌশল, ছল-চাতুরী ও চালাকিই আপনাকে এ থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

ইমারসন বলেছেন- “বাধা ও দুঃখ-কষ্টহীন এক বিলাসবহুল ও সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন সুখী-সমৃদ্ধ-সফল ও মহামানব সৃষ্টি করে- এমন ধারণা কোথা হতে আমাদের নিকট আসল? আসল ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা সহজ জীবন যাপন করার অভ্যাস গড়ে নিয়েছে তারা জীবনের পথে যতই এগিয়ে যাবে ততই অধিকতর অলস অভ্যাস গড়ে তুলতে থাকবে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, মাহাত্ম্য বিভিন্ন পরিবেশের মানুষের নিকট তার লাগামকে সঁপে দিয়েছে।

এসব পরিবেশের মাঝে ভালো-মন্দ পরিবেশও রয়েছে আবার-এমন পরিবেশও রয়েছে যার ভালো-মন্দ নির্ণয় করা যায় না। আর এসব পরিবেশ থেকেই জন্ম নিয়েছে এমন সব মহামানব যারা নিজেদের কাঁধে মহান মহান দায়িত্ব নিয়েছেন আর কখনো সেসব দায়িত্বকে দূরে ছুড়ে ফেলেননি।”

ইসলামের প্রাথমিক যুগে স্বর্গীয় পথ নির্দেশক কিতাবের পতাকা কারা বহন করেছিল? তারা ছিল আযাদ, গোলাম বা মুক্ত দাস। গরীব বা দরিদ্র এবং বঞ্চিত বা নিঃস্ব। যারা তাদের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসহকারে লেগেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল (তৎকালীন) মহৎ ব্যক্তিবর্গ, নেতৃবর্গ এবং ধনী ব্যক্তিবর্গ।

وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا أَيُّ الْفَرِيقَيْنِ خَيْرٌ مَّقَامًا وَأَحْسَنُ نَدِيًّا

এবং যখন আমার স্পষ্ট আয়াতসমূহ তাদের নিকট তেলাওয়াত করা হয় তখন (ধনী) কাফেররা (দরিদ্র) ঈমানদারদেরকে বলে: (ধনী কাফির ও দরিদ্র ঈমানদার এই) দু’দলের কোন দল মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতর ও মজলিস হিসেবে উত্তম।” (১৯-সূরা মারইয়াম: আয়াত ৭৩)

“এবং তারা বলে, “আমরা ধনে জনে সমৃদ্ধশালী এবং আমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না।” (৩৪-সূরা আস সাবা: আয়াত-৩৫)

“এভাবেই আমি তাদের একদলকে অপর দল দ্বারা পরীক্ষা করলাম যাতে করে তারা বলে, ‘আমাদের মাঝ থেকে কি আল্লাহ এই (দরিদ্র) লোকদিগকে অনুগ্রহ দানে ধনী করলেন?’ আল্লাহ কি কৃতজ্ঞদের সম্বন্ধে সর্বাধিক জ্ঞাত নন?” (৬-সূরা আল আন’আম: আয়াত-৫৩)

“কাফেররা মু’মিনদের উদ্দেশ্যে বলে, “যদি এ কুরআন ভালো হতো তবে তারা (অর্থাৎ দরিদ্র মু’মিনগণ) এ কুরআনের দিকে আমাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারত না (তাদের আগে আমরা এ কুরআন পেতাম) আর যখন তারা এ কুরআন দ্বারা হেদায়াত প্রাপ্ত হলো না তখন (ফলে) তারা অচিরেই বলবে যে, এ কুরআন এক পুরাতন মিথ্যা রচনা।” (৪৬-সূরা আল আহকাফ: আয়াত-১১)

“দাম্ভিকেরা বললঃ তোমরা যাতে বিশ্বাস কর আমরা নিশ্চয় তাতে অবিশ্বাস করি।” (৭-সূরা আল আ'রাফ: আয়াত-৭৬)

“আর তারা বলে, এই কুরআন (মক্কা ও তায়েফ) এই দুই নগরীর কোনো এক মহান ব্যক্তির উপর কেন নাযিল করা হলো না? তারা কি আপনার প্রভুর করুণাকে বণ্টন করছে?” (৪৩-সূরা আয যুখরুফ: আয়াত-৩১-৩২)

আমার প্রায়ই আন্তারার কবিতার পংক্তিগুলো মনে পড়ে। তাতে সে একথাটি প্রতিষ্ঠিত করে যে, তার মূল্য তার চরিত্রে ও তার কাজে তাঁর বংশ মর্যাদায় নয়। তিনি বলেছেন- “কৃতদাস হওয়া সত্ত্বেও আমি এক মহান নেতা, কালো চামড়া হওয়া সত্ত্বেও আমার চরিত্র সাদা।”

একটি অঙ্গ না থাকলেও অন্য অঙ্গটি আপনার আছে

আপনার যদি একটি অঙ্গহানি হয়ে থাকে তবুও তো এর ক্ষতিপূরণ করার জন্য অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন- “আল্লাহ যদি আমার চোখের জ্যোতি দূর করে দেন, তবুও আমার জিহ্বা ও কানে আলো আছে।

আমার হৃদয় বুদ্ধিদীপ্ত আর আমার মন বক্র নয়, আর আমার জিহ্বা বীরযোদ্ধার তরবারীর মতো ধারালো।

আপনার যদি কোনো ক্ষতি হয় তবে সম্ভবত: এরপরেই আপনার কোনো লাভ আছে- আর তা এমন লাভ যা আপনি বুঝতে পারেন না।

وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ

“এমনও হতে পারে যে তোমরা যা অপছন্দ কর তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত ২১৬)

বাশার ইবনে বুরদ বলেছেন- “আমার শক্ররা আমাকে অসম্মান করে অথচ দোষ তাদের মাঝেই। আর এটা এমন কোনো অপমান নয় যাকে দোষণীয় বলা যায়। কোনো লোক যদি সাহস ও সত্যকে দেখতে পায় তবে চোখের অন্ধত্ব প্রতিবন্ধক হবে না। অন্ধত্বের মাঝে আমি পুরস্কার, সঞ্চয় ও রক্ষা দেখতে পাই, আর এ তিনটি জিনিস আমার খুবই দরকার।”

যা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন অথবা যা বাশার বলেছেন তার মাঝে এবং যা সালেহ ইবনে আব্দুল কুদ্দুস অন্ধ হওয়ার পরে বলেছেন তার মাঝে তুলনা করে দেখুন-

“বিদায় পৃথিবী যে বৃদ্ধ অন্ধ,
এ জীবনে তার কোনো অংশই নেই।
সে মরে অথচ মানুষ তাকে জীবিত মনে করে।
শুরু থেকেই মিথ্যা আশা তাকে প্রতারিত করেছে।”

সকল স্বর্গীয় বিধানই ঘটবে- যে এটা স্বীকার করে তারও ঘটবে আর যে এসব অস্বীকার করে তারও ঘটবে। পার্থক্য হলো এই যে, যে এটা স্বীকার করে সে পুরস্কার পাবে আর যে এটা অস্বীকার করে সে পাপী হবে ও কষ্ট পাবে। উমার ইবনে আব্দুল আজীজ (রহঃ) মাইমুন ইবনে মেহরানের নিকট লিখেছেন: “আব্দুল মালেককে হারানোর কারণে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য লিখেছেন। এমন একটা ঘটনার জন্যই আমি অপেক্ষা করতে ছিলাম এবং যখন এমনটা সত্যিই ঘটে গেল তখন আমার আর কোনো সন্দেহই রইল না।”


দিন বদলের সাথে ভালো-মন্দ পালাক্রমে আসে

বর্ণিত আছে যে, ইমাম আহমদ (রহঃ) বাকী ইবনে মুখাল্লিদকে তাঁর অসুখের সময় দেখতে গেলেন এবং তাকে বললেন- “হে বাকী! আল্লাহর পুরস্কারের শুভ সংবাদে খুশি হও! সুস্থ থাকাকালীন দিনগুলো অসুস্থতা থেকে মুক্ত আর অসুস্থ থাকাকালীন দিনগুলো সুস্থতা থেকে মুক্ত।” অর্থাৎ সুস্থতার সময়ে কেউ অসুস্থতার কথা কল্পনাও করে না, কেননা, তখন যেমনটি আশা করে তেমনটিই পরিকল্পনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। যাহোক, সাংঘাতিক অসুস্থতার সময়ে মানুষ সুস্থতার সময়ের বিষয়াদি ভুলে যায়।

দুর্বল হতাশা অসুস্থ আত্মার ভিতরেই পরিবেষ্টিত থাকে এবং এভাবেই হতাশা প্রবল হয়।

মহান আল্লাহ বলেছেনঃ “আর যদি আমি মানুষকে আমার পক্ষ থেকে রহমত আস্বাদন করাই, অতঃপর তার থেকে তা ছিনিয়ে নেই, তবে সে অবশ্যই হতাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়। আর যদি দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করার পর আমি তাকে সুখ-শান্তি আস্বাদন করাই তবে সে অবশ্যই বলবে যে, “আমার কাছ থেকে সব দুঃখ দূর হয়ে গেছে” তখন সে নিশ্চয় উৎফুল্ল ও অহংকারী হয়। তবে যারা ধৈর্য ধরে ও আমলে সালেহ করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”

এ আয়াত কয়টির ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেন-

“আল্লাহ মানুষের মন্দ চরিত্র সম্বন্ধে বর্ণনা দিচ্ছেন; তবে যেসব মু’মিন বান্দাগণের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন তারা এর ব্যতিক্রম। সাধারণত মানুষ যদি স্বচ্ছলতার পর অভাব-অনটনে পড়ে তবে সে ভবিষ্যতে আদৌ কল্যাণ দেখা থেকে হতাশ হয়ে যায়। সে অতীত সম্বন্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করে-যেন সে কখনো সুদিন ভোগ করেনি এবং সে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হয়ে যায় যেন সে কখনো উদ্ধার ও মুক্তির আশা করে না।”

যখন সে দুঃখ-কষ্ট অভাব-অনটনের পর স্বচ্ছলতার অভিজ্ঞতা লাভ করে তখন তার অবস্থা নিম্নরূপই হয়-

ذَهَبَ السَّيِّئَاتُ عَنِّي

আমার কাছ থেকে সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে গেছে। (১১-সূরা হুদ: আয়াত-১০) অন্যকথায়, এরপর আমার উপর মন্দ কোনো কিছুই আপতিত হবে না।

“নিশ্চয় সে উৎফুল্ল ও অহংকারী হয়।” (১১-সূরা হুদ: আয়াত ১০)

“তবে যারা ধৈর্য ধরে এবং আমলে সালেহ করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (১১-সূরা হুদ: আয়াত-১১)

আল্লাহর প্রশস্ত জমিনে ভ্রমণ করুন

একথা সঠিকভাবেই বলা হয়েছে যে, ভ্রমণ উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তা বিতাড়িত করে। রামহারমুযি তার “The Noble Scholar of Hadeeth (المحدث الفاضل)” নামক কিতাবে ইলম তলবের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের উপকারিতার কথা ধারাবাহিক বর্ণনা করেছেন। পৃথিবী ভ্রমণ করে কোনো বোধগম্য উপকারিতা নেই- একথা যারা বলে তিনি তাদের যুক্তি-তর্ক খণ্ডন করতেছিলেন।

তিনি বলেছেন- “নতুন নতুন ভূমি ও ঘর-বাড়ি দেখে, সুন্দর সুন্দর বাগ-বাগিচা, মাঠ-ঘাট দেখে, ভিন্ন ভিন্ন মুখ দেখে এবং বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণের সান্নিধ্যে এসে এবং বিভিন্ন দেশের নানান আশ্চর্য জিনিস প্রত্যক্ষ করে অনেক উপকারিতা লাভ করা যায়। বৃহৎ বৃক্ষের ছায়ায় বসে যে শান্তি পাওয়া যায় তা অনুপম। মসজিদে মসজিদে খানা খাওয়া, ঝর্নাধারা থেকে পানি পান করা এবং যেখানে রাত সেখানেই কাত (অর্থাৎ ঘুমানো)- এসব কিছু ব্যক্তির মনে ধীরে ধীরে অমায়িকতা এবং বিনয় ও নম্রতা সঞ্চারিত করে।

ভ্রমণকারী বা পরিব্রাজক আল্লাহর উদ্দেশ্যে যাদের ভালোবাসে সে তাদেরকে তার বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তোষামোদ করার বা কৃত্রিম হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা তার নেই। এসব উপকারিতার সাথে সেসব সুখকে যোগ করে নিন যেসব সুখ ভ্রমণকারী বা পর্যটক তার লক্ষ্যস্থলে পৌছার পর তার অন্তরে অনুভব করে এবং সে শিহরণকেও যোগ করে নিন যে শিহরণ সে পথের সব বাধা অতিক্রম করার পর অনুভব করে। যারা তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে বের হতে নারাজ তারা যদি এসব কথা জানত তবে তারা বুঝতে পারত যে পৃথিবীর সকল স্বতন্ত্র আনন্দ ভ্রমণের মহান বৃত্তির মাঝেই নিহিত। ভ্রমণকারীর নিকট সুন্দর সুন্দর দৃশ্য ও আল্লাহর প্রশস্ত জমিনে ভ্রমণের অংশ আশ্চর্য সব ক্রিয়াকলাপের চেয়ে অধিক উপভোগ্য আর কিছুই নেই। কিন্তু অপরিব্রাজক এসব কিছু থেকে বঞ্চিত।"


দুনিয়া হচ্ছে মানুষের জন্য পরীক্ষার স্থান

“আল্লাহ যদি কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তবে তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন; এতে যে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য রয়েছে সন্তুষ্টি আর এতে যে ক্রুদ্ধ হয় তার জন্য রয়েছে গজব।”

“সর্বাপেক্ষা কঠিন পরীক্ষা করা হয়েছে (সর্বোত্তম মানুষ) নবীদেরকে এর পরবর্তী স্তরের লোকদের জন্য এর পরবর্তী স্তরের পরীক্ষা মানুষকে তার ধর্মের গুরুত্ব অনুসারে পরীক্ষা করা হয়, যদি তার দীনদারী শক্ত স্তরের হয় তবে তার পরীক্ষাও কঠিন স্তরের হয়। যদি তার দীনদারী দুর্বল স্তরের হয় তবে তার পরীক্ষাও তদানুপাতে (দুর্বল) স্তরের হয়। জমিনের বুকে কোনরূপ ভুল ছাড়া চলার আগ পর্যন্ত বান্দাকে অনবরত পরীক্ষা করা হতে থাকবে।”

“মুমিনের অবস্থা ও কাজ কারবার বড়ই আশ্চর্যজনক। কেননা তার সব কিছুই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা মু’মিন ছাড়া অন্য কারো জন্যে নয়। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে শোকরিয়া আদায় করে এবং এটা তার জন্য কল্যাণকর আর যদি তার কোনো ক্ষতি হয় তবে সে ধৈর্য ধরে আর এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়।”

“যেনে রাখ! যদি সব মানুষ তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয় তবে তারা তোমার কোনো উপকারই করতে পারবে না- তবে শুধুমাত্র এতটুকু উপকার করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য তকদীরে লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয় তবে তারা তোমার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না- তবে শুধুমাত্র ততটুকু ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য তকদীরে লিখে রেখেছেন।” “ধামিকদেরকে তাদের স্তর অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়।”

“মু’মিন ব্যক্তি শস্যের কচি ডগার মতো যা বাতাসে ডানে বামে হেলে দুলে যায়।”


জীবনের শেষ মুহুর্তে করণীয়

আবু রায়হান বাইরূনী এমন এক উর্বর চিন্তাশীল ও লেখক ছিলেন যার কলম তার হাত ছাড়া হতনা বললেই চলে। তিনি আটাত্তর (৭৮) বছরের এক পরিপক্ক জীবন যাপন করেছিলেন এবং তার সারাজীবনে কখনো প্রয়োজনে লেখা-পড়া ও শিক্ষাদান থেকে অবসর গ্রহণ করেননি।

আবুল হাছান আলী ইবনে ঈছা বলেছেন- “আবু রায়হান যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রবেশকালেই আমি বুঝতে পারি যে তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছে গেছেন। তার যখন এ অবস্থা তখন তিনি আমাকে বললেন যে, শেষের বার আমরা যখন সাক্ষাৎ করেছিলাম তখন আমরা মীরাস নিয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং আমি কিছু বলেছিলাম তা ভুল ছিল এখন তিনি তা বুঝতে পারছেন। তার জন্য আমার মায়া লাগল এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি যখন এতটা অসুস্থ তখন তার সাথে এমন (জটিল) এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ঠিক হবে কি-না।

তিনি উত্তর দিলেন, “আমি জানি যে, আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কিন্তু বিচার্য বিষয়ে অজ্ঞ থাকার চেয়ে সে বিষয়টাকে উপলব্ধি করা তুমি কি আমার জন্য ভালো মনে কর না। আমি তখন বিষয়টি পুনরায় বললাম আর তিনি তা আমার নিকট ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। আমাদের কথা-বার্তা শেষ হলে পরে আমি চলে গেলাম আর জানতে পারলাম যে তিনি ইন্তেকাল পর্যন্ত (মানসিকভাবে) শক্ত থাকেন।”

আততায়ীর ছুরিকাঘাতে উমর (রাঃ)-এর যখন রক্তপাত হতে হতে মৃত্যুপ্রায় অবস্থা তখন তিনি তার সঙ্গী-সাথীদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি সালাত সমাপ্ত করেছিলেন কি-না।

ইব্রাহীম ইবনুল জাররাহ বলেছেন- “(ইমাম) আবু ইউসুফ (রহঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তিনি একবার অজ্ঞান ও আরেকবার সজ্ঞান হতে ছিলেন। যখন তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন তখন তিনি আমাকে ধর্মীয় কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। যখন আমি তার প্রশ্নকে বিস্ময়ের সাথে গ্রহণ করলাম তখন তিনি তা লক্ষ্য করে বললেন, “তাতে কিছু আসে যায় না, আমরা এ বিষয়ে এজন্য গবেষণা করছি যে, এ বিষয়ের জ্ঞান বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে মুক্তি পেয়ে চিরদিনের জন্য বেঁচে থাকুক, এমন কি এটা কারো (জীবন) রক্ষার কারণ হোক।”

আমাদের ধার্মীক পূর্বসূরীগণ এমনই ছিলেন। যখনই তাদের মনে পড়ত, এমনকি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থাতেও তখনই তারা ইসলামী জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতেন- হয়তো শিক্ষক হিসেবে নয়তো ছাত্র বেশে। তাদের অন্তরে জ্ঞান কতইনা মূল্যবান ছিল। জীবনের শেষ মুহুর্তে তারা পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের কথা মনে করতেন না, তারা কেবল জ্ঞানের কথাই মনে করতেন। যে জ্ঞান তাদের জীবনের সাধনা ছিল। আল্লাহ্ তাদেরকে করুণা করুন।


বিপর্যয়ে বিচলিত হবেন না

আহমদ ইবনে ইউসুফ লিখেছেন যে, মানুষ ভালোভাবেই জানে যে, রাত্রির অন্ধকারের পর যেমন দিন আসে তেমনিভাবে দুঃখের পর সুখ আসে। এ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যখন দুর্যোগ আঘাত হানে তখন মানুষের দুর্বল প্রকৃতি প্রবল হয়। যে ব্যক্তি পরীক্ষায় পড়ে তার উচিত, তার অবস্থার সংস্কার করার জন্য (প্রয়োজনীয়) পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অন্যথায় হতাশা তাকে অধিকার করে বসবে। অতীতে যারা পরীক্ষিত হয়েছেন তাদের ধৈর্যের কথা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করার একটি উপায়।

পরে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বস্তির পূর্বে কষ্ট, খাবার পূর্বে ক্ষুধার সদৃশ। (ক্ষুধা লাগার ফলে যখন খাবারের রুচি হয়) খাবার তখন স্বাদগ্রন্থিতে এক বিশেষ প্রভাব ফেলে। প্লেটো বলেছেন- কষ্ট জীবনের জন্য যতটা ক্ষতিকর আত্মার জন্য ততটাই উপকারী। আরাম জীবনের জন্য যতটা উপকারী আত্মার জন্য ততটাই ক্ষতিকর।”

যখন কেউ তার জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে শুরু করে তখন সে জানতে পারবে যে, সে হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য পরীক্ষিত হচ্ছে নয়তো তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে। তানুখীর লেখা একখানি কিতাব পড়ার পর আমি এ তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি-

১. কষ্টের পরে আরাম আসে। এটা জীবনের অটল আদর্শ।
২. আরাম-আয়েশের তুলনায় দুঃখ-কষ্ট মানবাত্মার জন্য অধিকতর উপকারী।
৩. একমাত্র আল্লাহ কল্যাণ বয়ে আনেন এবং মন্দকে বিতাড়িত বা দূরীভূত করেন। জেনে রাখুন যে, আপনার যা কিছু ঘটে তা আপনার জন্য পূর্ব নির্ধারিত আছে এবং যা কিছু আপনি হারিয়েছেন তা কখনো আপনার উদ্দেশ্যে ছিল না।


এ পৃথিবী আপনার দুঃখের যোগ্য নয়

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “আল্লাহর নিকট যদি এ পৃথিবীর মূল্য মশার পাখার সমানও হতো তবে আল্লাহ্ কোনো কাফেরকে একে ঢোক পানিও দিতেন না।” এ পৃথিবীর মূল্য মশার পাখার সমানও নয়। এ পৃথিবীর মূল্য যদি এই-ই হয় তবে কেন এ নিয়ে দুঃখ করা?”


আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখুন

“বরং আল্লাহই তোমাদেরকে ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের প্রতি করুণা করেছেন।” (৪৯-সূরা আল হুজরাত: আয়াত-১৭)

ঈমানদার যখন কাফেরকে পর্যবেক্ষণ করে তখন ঈমানদারকে যে অনুকূল বিশেষ বিষয় দান করা হয়েছে সেই একটি বিশেষ কল্যাণ অধিকাংশ লোকের নিকটই উপেক্ষিত থাকে। ইসলামের পথে মু’মিনকে আল্লাহর পথ-প্রদর্শনের কল্যাণের কথা ঈমানদার স্মরণ করে। সে আল্লাহর প্রতি এজন্য কৃতজ্ঞ যে তিনি তার ভাগ্যে কাফেরের মতো হওয়ার-কথা লিখে রাখেননি। যে (কাফের) না কি বিদ্রোহ করে, আল্লাহর নিদর্শনবলিকে অস্বীকার করে, তার পরম গুণাবলিকে অবিশ্বাস করে, তার নবী-রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করে এবং পরকালকে অবিশ্বাস করে।

অধিকন্তু, মু’মিন ব্যক্তি ইবাদতের সকল বাধ্যতামূলক আমলগুলো সম্পাদন করে। সম্ভবত তার সেসব কর্ম সম্পাদন (অর্থাৎ আমল) নিখুঁত নয়, তবুও শুধুমাত্র আমল করাটাই এক মহা অনুগ্রহ। এটা এমন এক নেয়ামত যার জন্য খুব কম লোকই কৃতজ্ঞ।

أَفَمَن كَانَ مُؤْمِنًا كَمَن كَانَ فَاسِقًا لَّا يَسْتَوُونَ

“তবে যে ব্যক্তি মু’মিন সে কি সে ব্যক্তির মতো যে ফাসেক? তারা সমান নয়।” (৩২-সূরা আস সাজদাহ: আয়াত-১৮)

কুরআনের কিছু কিছু ব্যাখ্যাকার বলেছেন যে, মু’মিনদের জন্য বেহেশতের আনন্দের মাঝে এটাও এক আনন্দের বিষয় হবে যে, তারা দোজখবাসীদেরকে উপর থেকে দেখতে পারবে এবং তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দান করেছেন সে জন্যে তারা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।


আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে ভাবুন

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। এর অর্থ মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য হওয়ার সত্যিকার যোগ্য নয় বা উপাস্য হওয়ার অধিকার কারো নেই। কেননা, তিনি একাই সেসব পরম গুণের অধিকারী যেগুলো সর্বশক্তিমান, ঐশী ও প্রভুত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

এই তাওহীদি কালেমার রহস্য বা মাহাত্ম্য হলো ভালোবাসা, ভয়, আশা, শ্রদ্ধা এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা বা মহিমাকীর্তনের জন্য আল্লাহকে এককভাবে নির্দিষ্ট করে নেয়া। আল্লাহর উপর আমাদের নির্ভরতা তার নিকট আমাদের অনুশোচনাও এর অন্তর্ভুক্তি। অতএব, তাকে ছাড়া অন্যকে ভালোবাসা বিশুদ্ধ নয়। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার ফলেই তিনি ছাড়া অন্য সকলকে ভালোবাসা হয় অথবা তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়ানোর উপায় হিসেবেই।

সুতরাং, আমাদেরকে অবশ্যই একমাত্র তাকেই ভয় করতে হবে, আমাদেরকে অবশ্যই একমাত্র তার উপরেই তাওাক্কুল করতে হবে, একমাত্র তার মাঝেই আমরা আশা করি এবং একমাত্র তাকেই আমরা শ্রদ্ধা করি। একমাত্র তার নামেই আমরা শপথ করি; একমাত্র তার নিকটেই আমরা তওবা করি এবং সব আনুগত্যই তার জন্য। সংকটের সময় আমরা তাকে ছাড়া অন্যকে ডাকতে পারি না এবং তার দরবার ছাড়া অন্যের নিকট আমরা আশ্রয় ভিক্ষা চাইতে পারি না। আরও (বলছি) একমাত্র তাকেই আমরা সেজদা করি বা একমাত্র তার নিকটেই আমরা মাথা নত করি এবং যখন আমরা কোনো পশু জবেহ করি তখন শুধুমাত্র তার নাম নিয়েই আমরা এটা জবেহ করি।

উপরের সব কথা এক কথায় বলা যায়- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাস্য হওয়ার অধিকার নেই। এ কালেমা সব ধরনের ইবাদতের অর্থবহ।


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



***************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url