আল্লাহর উপর ভরসা (পর্ব-২৫) || নিজেকে সুখি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে কি করবেন || ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে ||





নিজেকে সুখি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে কি করবেন?


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলে রহমতের দুয়ার খুলে যায়

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ বলেছেন- “যখন আমি একটি ধর্মীয় বিষয় বুঝতে পারছিলাম না তখন অবিলম্বে আমি কম-বেশি এক হাজার বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তখন আল্লাহ আমাকে তা বুঝার তাওকীক (বা ক্ষমতা) দান করলেন।

“আমি তাই (তাদেরকে) বললাম: “তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহা ক্ষমাশীল। (তাহলে) তিনি তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।” (৭০-সূরা আল মাআরিজঃ আয়াত-১০-১১)

মনের ভিতরে শান্তি পাওয়ার একটি পথ হলো সর্বদা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। ঈমানদার যদি কোন পাপ করে পরে অনুতাপ সহকারে তার প্রভুর নিকট তাওবা করে তবে সে পাপই পুণ্যে বা সওয়াবে পরিণত হয়।

মুসনাদে আহমদে একটি হাদীস আছে। তাতে বলা হয়েছে- “আল্লাহ তার বান্দার জন্য যাই করেন না কেন তা তার ভালোর জন্য করেন।”

এ হাদীস সম্বন্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “পাপ কি তার ভালোর জন্য?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, যদি পাপ করার পর তওবা, অনুশোচনা, অনুতাপ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়ে থাকে।”

“যখন তারা আপনার নিকট আসল যদিও তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল- ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তখন তারা আল্লাহকে অবশ্যই পাপ ক্ষমাকারী ও দয়ালু হিসেবে পেল।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত ৪)

وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ

এবং দিনসমূহও অনুরূপ (ভালো ও মন্দ) আমি পর্যায়ক্রমে মানুষের মাঝে ওগুলোকে আবর্তন করি।” (৩-সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৪০)

“সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন (পৃথিবীতে) শুধুমাত্র এক সন্ধ্যা বা এক সকাল অবস্থান করেছিল।” (৭৯-সূরা আন নাযিআত: আয়াত ৪৬)

আমি কতিপয় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে যখন ভাবি তখন আশ্চর্যবোধ করি। যদিও তারা সংকটের মুখে পড়েছেন তবুও তাদের কাছে সে সংকট যেন পানির ফোটার মতো স্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই অভিজাত সম্প্রদায়ের একেবারে পুরোভাগে রয়েছেন সৃষ্টির নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আবু বকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে তিনি গুহাতে ছিলেন আর তখন তার শক্ররা কাছেই ছিল তবুও তিনি (বিচলিত না হয়ে) তার সাথীকে বললেন: “হতাশ হবেন না (বা ভয় করবেন না), নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৪০)

بشرى من الغيب ألقت في فم الغار

وحيـا وأفضـت إلـى الدنيـا بأسـرار

“গুহার মুখে গায়েব হতে ওহী আকারে সুসংবাদ এলো এবং সারা জাহানে সুখের ঢল বয়ে গেল।”

বদরের যুদ্ধের ঠিক আগ মুহুর্তে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাগ্রহে তার বর্ম পরিধান করে নিলেন আর তখন বলতে ছিলেন-

سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ

“এই দলতো অচিরেই পরাজিত হবে এবং পিঠ দেখিয়ে (পালিয়ে) যাবে।” (৫৪-সূরা আল ক্বামার: আয়াত-৪৫)

ওহুদের যুদ্ধে তার কিছু সাহাবী শহীদ ও কিছু সাহাবী আহত হওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: “তোমরা আমার পিছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়াও যাতে আমি আমার প্রভুর প্রশংসা করতে পারি।” একজন নবীর প্রতিজ্ঞা ও ইচ্ছা শক্তি এমনই ছিল যা পাহাড়-পর্বতকেও কাঁপিয়ে দিতে পারত।

আরবদের মাঝে ক্বায়েস ইবনে আসিম আল-মানক্বারি তার ধৈর্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। একদা তিনি তার কতিপয় সঙ্গীদের নিকট একটি গল্প বলতে ছিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে কায়েসকে বলল: অমুকের পুত্র আপনার পুত্রকে হত্যা করে ফেলেছে।” কায়েস তার গল্পকে সংক্ষিপ্ত না করে বরং শান্তভাবে তা বর্ণনা করে শেষ করলেন। তারপর তিনি বললেন, “আমার ছেলেকে গোসল দাও, তাকে কাফনের কাপড় পরাও এবং আমাকে তার জানাজার সালাত পড়তে দাও।”

وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ

“এবং তারা যারা অভাব-অনটনে, রোগ-শোক-দুঃখ-কষ্ট ও সংকটে এবং যুদ্ধের সময় ধৈর্যশীল।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৭৭)

মৃত্যুর সময়ে ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল (রাঃ)-কে পানি পান করতে দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, “অমুক অমুককে পানি দাও।” সেখানে (এক যুদ্ধের ময়দানে) অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত ছিল এবং প্রত্যেককেই এভাবে পানি দেয়া হয়েছিল এবং প্রত্যেকেই পানি পান না করে বরং অন্যের কথা বলেছিল। আর এরকম আশ্চর্যজনক ভ্রাতৃত্ব দেখিয়ে সকলেই ইন্তেকাল করেছিল।


অন্যরা আপনার উপর নির্ভর করবে কিন্তু আপনি কারও উপর নন

লোকেরা আপনার উপর নির্ভর করুক, কিন্তু , আপনি তাদের উপর নির্ভর করবেন না
মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা জনসেবা করেন কিন্তু জনগণকে তার সেবা করার সুযোগ দেন না। অতএব তিনি এমন প্রকল্প গ্রহণ করেন না যার জন্য তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়।

(অন্যের উপর নির্ভর করে লাভ নেই) কেননা অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপারে মানুষের একটি সীমা আছে সে সীমার ভিতরে থেকেই তারা অন্যের চেষ্টা ও উৎসর্গ করতে চায় এবং এ সীমার বাইরে তারা যায় না বললেই চলে। উদাহরণস্বরূপ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাতি ও আলী (রাঃ)-এর ছেলে হুসাইন (রাঃ)-এর কথা বিবেচনা করে দেখুন। তিনি খুন হলেন অথচ জাতি তার জন্য আন্দোলন করল না বরং তার খুনিরা তাদের বিজয়ের জন্য আল্লাহর প্রশংসা ধ্বনি দিয়ে দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আমোদ উল্লাস করেছিল। একজন আরব কবি লিখেছেন-

جاءوا برأسك يا ابن بنت محمد ٭ متزملا بدمائه تزميلا

ويكبرون بأن قُتلت وإنما ٭ قتلوا بك التكبير والتهليلا

“হে মুহাম্মদের নাতি! তারা তোমার রক্তাক্ত শির নিয়ে এসেছে, (এটা নিয়ে) তারা (রাস্তায় রাস্তায়) আমোদ-উল্লাস করছে, তুমি নিহত হয়েছ তাই তারা আল্লাহর প্রশংসা ধ্বনি দিচ্ছে, অথচ তারা তোমাকে হত্যা করে তারা তাদের আল্লাহর প্রশংসাকরণকে ও তাদের ধর্মকে হত্যা করেছে।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)-কে ভীষণভাবে চাবুক মেরে অত্যাচার করা হয়েছিল। তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে গিয়েছিলেন অথচ কেউ তাকে সাহায্য করার জন্য এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসেনি। (সুতরাং অন্যের উপর নির্ভর করে কী লাভ?)

ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে বন্দী করে গাধার পিঠে চড়িয়ে প্রদর্শন করে অপমান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে যে বিশাল জনতার দল তার জানাযার সালাতে শরীক হয়েছিল, এ ঘটনা যখন ঘটে তারা তো তখন কিছুই করেনি।

কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও এর কারণ শুধুমাত্র এই যে, অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপারে লোকের একটা সীমা আছে, তারা সে সীমা অতিক্রম করে অন্যকে সাহায্য করে না। (অতএব, অন্যের উপর নির্ভর করে লাভ নেই)।

“সুতরাং তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডেক না।” (২৬-সূরা আশ শেয়ারা: আয়াত-২১৩)

“এবং তারা তাদের নিজেদের কোন ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না এবং তারা মৃত্যু, জীবন ও উত্থানের উপর কোন ক্ষমতা রাখে না।” (২৫-সূরা আল ফুরকান: আয়াত-৩)

“হে নবী (মুহাম্মদ), আপনার জন্য এবং যে সমস্ত ঈমানদারগণ আপনাকে অনুসরণ করে তাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” (৮-সূরা আনফাল: আয়াত-৬৪)

“এবং (হে মুহাম্মদ!) সে চিরঞ্জীবের উপর নির্ভর করুন যিনি কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না।” (২৫-সূরা আল ফুরকান: আয়াত-৫৮)

“(আল্লাহ যদি তোমাকে শাস্তি দিতে চান তবে) তারা আল্লাহর মোকাবিলায় তোমার কোনই উপকার করতে পারবে না।” (৪৫-সূরা আল জাছিয়াহ: আয়াত-১৯)


ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে

যে ব্যক্তি বিচক্ষণতার সাথে ব্যয় করে সে অন্যের উপর নির্ভর করা থেকে বাঁচতে পারে। একজন আরব কবি বলেছেন-

اجمع نقودك إنّ العزّ في المال ** واستغن ما شئتَ عن عمّ و عن خال

তোমার ধন-সম্পদকে সঞ্চয় করে রাখ, কেননা সম্পদের মাঝে সম্মান আছে, তাহলেই যতক্ষণ ইচ্ছা চাচা ও মামা থেকে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারবে।

যে দর্শন অপব্যয় বাড়ায় তা ভিত্তিহীন বা ভুল এবং তা মানুষের কল্যাণের পক্ষে ক্ষতিকর। এমন ধারণার মূল ভারতে পাওয়া যায় বা এ ধারণা উৎপত্তি মূৰ্খ সূফীদের থেকে। আসলে ইসলাম সৎভাবে অর্থ উপার্জনের প্রতি ও যথাযথভাবে সে অর্থ ব্যয় করার প্রতি উৎসাহ দেয়। এই দুই মূলনীতি মানুষকে তার সম্পদের মাধ্যমে সম্মানিত করে। নিম্নে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীই একথার প্রমাণ বা দলীল-

نعم المال الصالح في يد الرجل الصالح

অর্থাৎ, “সৎ মানুষের হাতে সৎ (সৎভাবে উপার্জিত) সম্পদ কতইনা ভাল!”

ধনীর বিপরীতে আছে ঋণী ও অভাবী, ঋণী ব্যক্তি সর্বদা এ দুশ্চিন্তা করে যে, তার সব সম্পদ তার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে আর অভাবী লোকতো সর্বদা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার উপকরণ পাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট কুফুরি ও অভাব থেকে আশ্রয় চাই।”

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন- “অভাব প্রায় কুফুরীর মতো”

পূর্বোক্ত হাদীস ও (নিম্নোক্ত) ইবনে মাজাহ শরীফের হাদীসের মাঝে কোন বিরোধ নেই-

“দুনিয়াতে অল্পে তুষ্ট হও, তাইলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন এবং অন্যের যা আছে তা পেতে চেও না, তাহলে মানুষেরাও তোমাকে ভালোবাসবে।”

নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে এ হাদীসে কিছুটা সমস্যা আছে, তবুও মনে করুন যে, এটি দুর্বল নয়। আর এ হাদীসের অর্থ হলো যে, প্রয়োজনীয় জিনিস থাকলেই আপনার তৃপ্ত থাকা উচিত এবং আপনার সে পরিমাণ সম্পদ থাকলেই পরিতৃপ্ত থাকা উচিত যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে ভিক্ষা করতে হয় না ও অন্যের সাহায্য চাইতে হয় না। একই সময়ে আপনার মহৎ ও স্ব-নির্ভর থাকা উচিত এবং নিজেকে অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত রাখার মতো যথেষ্ট উপকরণ আপনার থাকা উচিত।

“আর যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী হতে চায় আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী বানিয়ে দেন।”

একজন আরব কবি বলেছেন-

“স্রষ্টা ছাড়া আমি কখনও অন্য কারো কাছে হাত বাড়াইনি,

আর আমি কখনও এমন কারো কাছে একটি টাকাও চাইনি যে তার করুণার কথা অন্যদেরকে মনে করিয়ে দেয়।”

একখানি সহীহ হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “তুমি যদি তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাও তবে তারা মানুষের নিকট হাত পাতবে। এর চেয়ে বরং তোমার জন্য এটা ভালো যে, তুমি তাদেরকে ধনী অবস্থায় রেখে যাও।”

আরেকটি সহীহ হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে ভালো।” এ হাদীসের অর্থ হলো- দাতা গ্রহীতার চেয়ে ভালো।

“মানুষের নিকট সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকার কারণে মূৰ্খরা তাদেরকে ধনী মনে করে।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-২৭৩)

নিচের আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, অন্যের থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য কারো-তোষামোদ করা কারো উচিৎ নয়, কেননা, আল্লাহ আমাদের রিযিকের নিশ্চয়তা দান করেছেন।”

“তবে কি তারা তাদের নিকট ইজ্জত পেতে চায়? বস্তুত নিশ্চয় সকল ইজ্জত আল্লাহরই।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-১৩৯)

أنا لا أرغب تقبيل يد ٭ قطعها أحسن من تلك القبل
إن جزتني عن صنيع كنت في ٭ رقها أولى فيكفيني الخجل

“অন্যের হাতে চুমু খাওয়ার আমার কোন ইচ্ছে নেই।
আমার জন্য চুমু খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই ভালো।
যখন কেহ আমাকে দয়া করে তখন সে আমাকে দাস বানায়।
অথবা, যদি তা না হয়, তবে কমপক্ষে আমি লজ্জিত হই।”


আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আঁকড়িয়ে ধরা যাবে না

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আঁকড়িয়ে ধরবেন না।
মহান আল্লাহই যদি জীবন মৃত্যুর মালিক হয় এবং তিনি একাই যদি সকল সৃষ্টির রিযিক যোগিয়ে থাকেন তবে কেন মানুষকে ভয় করা বা তাদের কাজে দুঃখ পাওয়া? আমি মনে করি আমাদের সমাজে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা মানুষের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততার কারণেই হয়, তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে চাওয়ার কারণে, তাদের করুণা পাওয়ার চেষ্টা করার কারণে, তাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রশংসা করার জন্য চেষ্টা করার কারণে এবং তাদের অপমানকর ব্যবহারে মনে আঘাত পাওয়ার কারণেই হয়। আর এসব কিছু দ্বারা আল্লাহ্‌র প্রতি মানুষের ঈমানের দুর্বলতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

فليتــك تحـلو والحياة مريـرة ٭ وليتك ترضى والأنام غضاب

إذا صح منك الود فالكل هين ٭ وكل الذي فوق التراب تراب

“জীবন যখন দুর্বিসহ তখন যদি তুমি সন্তুষ্ট থাকতে, আর যখন লোকেরা থাকে রাগান্বিত তখন যদি তুমি তৃপ্ত থাকতে, যদি আল্লাহর প্রতি তোমার ভালোবাসা খাঁটি হয় তবে অন্য সব কিছুই তুচ্ছ। আর ময়লার উপরের সব কিছুই ময়লা।”


যে কাজগুলো করলে মনে শান্তি আসে তা’ই করতে হবে

ইমাম ইবনুল কায়্যিম এমন কিছু বিষয় বর্ণনা করেছেন যা মনকে প্রশান্ত করে। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো-

তাওহীদ বা একত্ববাদ
অর্থাৎ আল্লাহর সাথে তার ইবাদতে কোন শরীক না করে এবং তার সকল গুণের সাথে অন্য কাউকে শরীক না করে একচেটিয়াভাবে শুধুমাত্র তারই ইবাদত করা। কাফের ও মুশরিকরা যারা মহান আল্লাহর সাথে শরীক করে তারা আসলে মৃত, জীবিত নয়।

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ

“আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য অবশ্যই কষ্টকর জীবন রয়েছে এবং আমি তাকে অন্ধ অবস্থার হাশর করাব।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-১২৪)

“আর আল্লাহ্‌ যাকে হিদায়াত করতে চান তার অন্তরকে ইসলামের জন্য খুলে দেন। (৬-সূরা আল আন’আম: আয়াত-১২৫)

“আল্লাহ্ যার অন্তরকে ইসলামের জন্য খুলে দিয়েছেন ফলে সে তার প্রভুর পক্ষ থেকে পাওয়া নূরের উপর আছে- তবে কি সে ঐ কাফেরের মতো যে এমনটি নয়? (৩৯-সূরা আয যুমারঃ আয়াত-২২)

“আমি অচিরেই কাফেরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব, কেননা তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে- যে বিষয়ে তিনি কোন দলীল প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৫১)

“অতএব তাদের জন্য ধ্বংস যাদের অন্তর এতটা কঠোর যে তাতে আল্লাহর কথা মনে পড়ে না।” (৩৯-সূরা আয যুমারঃ আয়াত-২২)

“আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান তার অন্তরকে তিনি সংকুচিত ও সংকীর্ণ করে দেন, মনে হয় যেন সে আকাশে চড়ছে। (৬-সূরা আল আন’আমঃ আয়াত-১২৫)

উপকারী ইলম বা জ্ঞান অর্জন
কেননা আলেমরাই (জ্ঞানীরাই) সর্বাপেক্ষা সুখী; স্বচ্ছন্দ, নির্ঝঞ্জাট এবং পরিতুষ্ট। কেনইবা আলেমরা এমনটি হবেন না? তারা যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উত্তরাধিকারী।

“এবং তুমি যা জানতে না তিনি তোমাকে তা শিখিয়েছেন।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-১১৩)

“সুতরাং তুমি জেনে রাখ যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।” (৪৭-সূরা মুহাম্মদ বা কেতালঃ আয়াত ১৯)

৩. আমলে সালেহ বা নেক আমল বা পুণ্যকর্ম বা সৎকাজ বা ভালো কাজঃ একটি সওয়াবের কাজ বা নেক আমল অন্তরে ও চেহারায় উভয় স্থানেই আলো দেয় এবং রিযিকের প্রশস্ততা বয়ে আনে আর অন্যান্য লোকের অন্তরে নেক আমলকারীর জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করে।

“আমি অবশ্যই তাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করব।” (৭২-সূরা আল জ্বীনঃ আয়াত-১৬)

সাহসিকতা বা বীরত্ব
কেননা সাহসী মানুষ দৃঢ় ও শক্ত হয় এবং একমাত্র-আল্লাহকেই ভয় করে। অভাব-অনটন ও সংকট তাকে বিচলিত করতে পারে না এবং তার অসুবিধাও করতে পারে না।

পাপ থেকে বেঁচে থাকা
পাপ মানুষের মনের শান্তি নষ্ট করে দেয় এবং পাপের ফলে মানুষ নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবে ও চারিদিকে অন্ধকার দেখে। একজন আরব কবি বলেন-

رأيت الذنوب تميت القلوب ٭ وقد يورث الذل إدمانها

“আমি পাপকে দেখেছি যে উহা অন্তরকে মেরে ফেলে,

আর পাপের আসক্তি আসক্তকে (পাপীকে) অপমানিত করে”।

বৈধ কাজেও সংযমী হওয়া
কথা-বার্তায়, ঘুমে, মানুষের সাথে মেলামেশার ব্যাপারে এবং খাওয়া-দাওয়ায় সংযত হতে হবে।

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

“আর যারা অনর্থক ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকে।” (২৩-সূরা আল মু’মিনূনঃ আয়াত-৩)
“মানুষ যে কথাই বলে (তা লিখে নেয়ার জন্য) তৎপর এক প্রহরী তার পাশেই রয়েছে।” (৫০-সূরা কাফঃ আয়াত-১৮)
“এবং পানাহার কর তবে অপচয় করিও না” (৭-সূরা আল আরাফঃ আয়াত-৩১)

একজন আরব কবি বলেছেন-
“হে কুকর্মকারী! তুমি তো অনেক ঘুমিয়েছ,
তুমি কি জাননা যে, মৃত্যুর পর লম্বা ঘুম আছে?”


তক্বদীরে বিশ্বাস রাখা জরুরী

এক ভীষণ উদ্বিগ্ন মানসিক রোগী এক মুসলিম চিকিৎসকের নিকট পরামর্শ চেয়েছিল। চিকিৎসক তাকে উপদেশ দিলেন, “জেনে রাখুন, ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে তা আগেই নির্ধারিত হয়ে আছে, সুতরাং আল্লাহর অজানা ব্যতীত কোন কিছু নড়ে না এমনকি ফিসফিস শব্দও হয় না। অতএব, দুশ্চিন্তা কেন? নিম্নোক্ত হাদীসে একথা এভাবে আছে-

“আল্লাহ সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই সকল সৃষ্টির তকদীর বা ভাগ্যলিপি বা কর্মবিধি লিখে রেখেছেন।”

বিখ্যাত আরব কবি মুতানাব্বি বলেছেন-
“ছোট লোকের চোখে ছোট জিনিস বড় দেখায়
আর মহৎ লোকের চোখে বড় জিনিস ছোট দেখায়।”


বেশি পাওয়ার লোভ মানুষকে পরাধীন বানায়

আর রশীদ ‘আলমাছার’ (المسار) নামক কিতাবে লিখেছেন- “যার তিনশত ষাটখানা রুটি, একটিন তেল এবং একহাজার ছয়শত খেজুর (অর্থাৎ পূর্ণ এক বছরের খোরাক) আছে কেউ তাকে গোলাম বানাতে পারবে না।”

একদা আমাদের এক ধাৰ্মিক পূর্বসূরী বলেছিলেন- “যে ব্যক্তি শুকনো রুটি ও পানিতে তৃপ্ত থাকবে সে আল্লাহর গোলামী ছাড়া অন্য সকলের গোলামী থেকে মুক্ত থাকবে।”

“এবং তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদানে নয়।” (৯২-সূরা আল লাইলঃ আয়াত-১৯)

একজন কবি বলেন- “আমার লোভ-লালসা আমাকে দাস বানিয়েছে, কেননা আমি ওগুলোর আনুগত্য করেছি। আর যদি আমি পরিতুষ্ট থাকতাম তবে আমি স্বাধীন থাকতাম।”

যারা সুখের উপায় হিসেবে সম্পদ ও পদমর্যাদা পেতে চায় অবশেষে তারা জানতে পারবে যে, তাদের চেষ্টা কতটা ব্যর্থ ও নিস্ফল ছিল।

“এবং তোমরাতো অবশ্যই (সঙ্গী-সাথী ও সহায় সম্বলহীন অবস্থায়) একেবারে একাকী আমার নিকট ঠিক সেরূপ অবস্থায় এসেছো যেরূপে আমি প্রথম বার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম এবং আমি যা তোমাদেরকে দান করেছিলাম তা তোমরা পিছনে ফেলে এসেছ।” (৬-সূরা আল আন’আমঃ আয়াত-৯৪)

“বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ পরকাল উত্তম ও স্থায়ী।” (৮৭-সূরা আল আ'লাঃ আয়াত-১৬-১৭)


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



***************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url