আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন (পর্ব-০৭) || বিষন্নতা একটি মারাত্মক রোগ || মধ্যপন্থা অবলম্বন করুন || মৃদু হাসতে চেষ্টা করুন ||





বিষন্নতা একটি মারাত্মক রোগ, মিতচার হোন এবং সব সময় মৃদু হাসুন


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

মধ্যপন্থা অবলম্বন করুন 

এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতি বানিয়েছি
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا

“এরূপে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতি বানিয়েছি।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৪৩)

আপনার বিবেক ও আপনার ধর্ম উভয়টিই দাবি করে যে, আপনি মধ্যপন্থী হোন। তার মানে আপনার চরমপন্থী ও নরমপন্থী কোনটাই হওয়া উচিত নয়। বাড়াবাড়ি করাও উচিত নয়, খুব কম করাও উচিত নয়। যে সুখ চায় তাকে মধ্যপন্থী বা ন্যায়ানুগ হতে হবে-সে রাগান্বিত, বিষন্ন বা আনন্দিত যে কোন অবস্থাতেই থাকুক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না (অর্থাৎ সর্বাবস্থায়ই তাকে ন্যায়পরায়ণ বা মধ্যপন্থী হতেই হবে। -অনুবাদক)। অন্যের সাথে আমাদের আচরণে বাড়াবাড়ি গ্রহণযোগ্য নয়।

মধ্যমপন্থাই সর্বোত্তমপস্থা। যে তার প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করে, কোন বিশেষ অবস্থার গুরুত্বকে বড় করে দেখারই কথা; এভাবে অকারণে সে বহুকিছু করে। সে অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে। যেহেতু সে বাড়াবাড়ি ও কল্পনার জগতে বাস করে তাই সে অন্য সবাইকে তার বিরুদ্ধবাদী বলে মনে মনে জল্পনা-কল্পনা করে। এমনকি এতটা পরিমাণে যে, সে ভাবতে থাকে অন্যেরা তাকে ধ্বংস করার সর্বদা চক্রান্ত করছে। এ কারণে সে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অন্ধকার মেঘের নিচে বসবাস করে।

লোকশ্রুতি ও কুসংস্কার অনুযায়ী জীবন যাপন করা আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ।

يَحْسَبُونَ كُلَّ صَيْحَةٍ عَلَيْهِمْ

তারা মনে করে প্রত্যেক শোরগোলই তাদের বিরুদ্ধে। (৬৩ সূরা মুনাফিকূন: আয়াত-৪)

প্রায়ই এমন হয় যে, আপনি যা ঘটবে বলে আশংকা করেন তা ঘটে না। এমন পরিস্থিতিতে আপনার কিছু একটা করা উচিত। আর তা হলো- যখন আপনি কোন কিছুর ভয় করেন তখন কল্পনা করুন যে, সর্বাপেক্ষা অশুভ পরিণতি দেখা দিয়েছে এবং তারপর সে পরিণতিতে নিজেকে প্রস্তুত ও সন্তুষ্ট ভাবতে নিজেকে প্রশিক্ষণ দিন। যদি আপনি এ কাজ করেন তবে আপনি নিজেকে আতঙ্ক ও কুসংস্কার থেকে রক্ষা করতে পারবেন। অন্যথায় এই আতঙ্ক ও কুসংস্কার আপনার অনেক দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাড়াবে।

প্রতিটি বিষয়ের প্রতি তার গুরুত্ব অনুসারে মনোযোগ দিন। কোন (নির্দিষ্ট) অবস্থাতেই তিলকে তাল করবেন না। বরং নিরপেক্ষ বিচার ও দৃঢ়তার কথা মনে রাখুন। অহেতুক সন্দেহ ও বৃথা আশার প্রতারণায় মোহের অন্ধ অনুসরণ করবেন না বা আলেয়ার আলোর পিছে ছুটবেন না। বরং ভারসাম্যপূর্ণ হোন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত ভালোবাসা ও ঘৃণার মাপকাঠির কথা শুনুন

“তোমরা প্রিয়জনকে পরিমিত পরিমাণে ভালোবাস, কেননা এমন দিন আসতে পারে, যখন তুমি তাকে ঘৃণা করবে এবং যাকে তুমি ঘৃণা কর তাকে সংযত পরিমাণে ঘৃণা কর, কারণ এমন দিন আসতে পারে যখন তুমি তাকে ভালোবাসবে।”

عَسَى اللَّهُ أَن يَجْعَلَ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ الَّذِينَ عَادَيْتُم مِّنْهُم مَّوَدَّةً وَاللَّهُ قَدِيرٌ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

“সম্ভবত তোমাদের মাঝে ও যাদেরকে তোমরা শক্ৰ মনে কর তাদের মাঝে আল্লাহ বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিবেন। আর আল্লাহ (সবকিছুর উপর) ক্ষমতাবান এবং আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।” (৬০-সূরা মুমতাহিনা: আয়াত-৭)

বিষন্ন হওয়া পরিহার করুন 


وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

যদি তোমরা ঈমানদার (মু’মিন) হয়ে থাক তবে তোমরা (তোমাদের শক্ৰদের বিরুদ্ধে) দুর্বল হয়ো না এবং দুশ্চিন্তাও করো না।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৩৯)

وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلَا تَكُ فِي ضَيْقٍ مِّمَّا يَمْكُرُونَ

“এবং তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না ও তারা যে ষড়যন্ত্র করে তার কারণে মনঃক্ষুন্ন হয়ে না।” (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত ১২৭)

“বিষণ্ণ হয়ো না, অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা আমাদের সাথে আছেন।” (৯-সূরা তাওবাহ: আয়াত-৪০)

সত্যিকারের ঈমানদারদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে,

فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

“তাদের কোন ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-৩৮)

বিষণ্ণতা মনের কাজ করার ইচ্ছা শক্তিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে অকেজো বানিয়ে দেয়। বিষগ্নতা মানুষকে কাজ করতে বাধ্য না করে বরং কাজ না করতে বাধ্য করে। দুঃখবোধ করে আত্মার কোন লাভ হয় না। শয়তানের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো ইবাদতগুজার ব্যক্তিকে বিষগ্ন করে দেয়া, যাতে সে ক্রমাগত ইবাদত না করতে পারে।

মহান আল্লাহ বলেন, “মু’মিনদেরকে বিষগ্ন করার জন্য শয়তানের পক্ষ থেকে গোপন পরামর্শ বা চক্রান্ত করা হয়ে থাকে।” (৫৮-সূরা আল মুজাদালা: আয়াত-১০)

নিম্নোক্ত হাদীসখানিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তিনজন সঙ্গীর মাঝ থেকে একজনকে বাদ দিয়ে অপর দু’জনের গোপন পরামর্শ করা নিষিদ্ধ। কেননা, এ কাজ তৃতীয় ব্যক্তির দুঃখের কারণ হবে।"

কিছু কিছু কঠোরমনা মানুষ যা বিশ্বাস করে তার বিপরীতে ঈমানদারদের দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। কারণ দুঃখবোধ এমন এক অবস্থা যা মন-মানসিকতার ক্ষতি করে। মুসলমানদেরকে অবশ্যই দুঃখ-বিষন্নতা দূর করতে হবে এবং আমাদের জীবন ব্যবস্থায় বৈধ সকল পন্থায় এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। দুঃখ করাতে প্রকৃত কোন লাভই নেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিচের দু'আতে এর থেকে পানাহ চেয়েছেন।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ

“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট (ভবিষ্যতের) দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং (অতীতের) দুঃখ-বেদনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।”

এ হাদীসে উদ্বিগ্নতার সাথে দুঃখ-বেদনাকে যোগ করা হয়েছে। এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য হলো-যদি ভবিষ্যতে কী ঘটবে এ দুর্ভাবনা হয় তবে আপনি উদ্বিগ্নতা বোধ করছেন। আর যদি অতীতের ঘটনা নিয়ে মন খারাপ হয় তবে আপনি দুঃখবোধ করছেন। উভয়টাই মনকে দুর্বল করে, অক্ষমতা সৃষ্টি করে ও ইচ্ছা শক্তিকে দমন করে। উপরে যা বলা হলো তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দুঃখবোধ অলঙ্ঘনীয় ও প্রয়োজনীয় হতে পারে। বেহেশতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করে বলবেঃ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ

“সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাদের থেকে সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন।” (৩৫-সূরা ফাতির: আয়াত-৩৪)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, তারা ইহজীবনে তেমনি দুঃখগ্ৰস্ত ছিল, যেমন না-কি তারা অন্যান্য সমস্যা কবলিত হয়েছিল। উভয়টিই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল । সুতরাং, যখন কেউ দুঃখপীড়িত হয় এবং এটাকে এড়ানোর কোন পথ থাকে না তখন সে পুরস্কৃত হয়। কেননা দুঃখ এক ধরনের কষ্ট এবং মু'মিন ব্যক্তি কষ্ট ভোগ করার কারণে পুরস্কৃত হবে। তবুও মু'মিন ব্যক্তিকে অবশ্যই দু'আর মাধ্যমে ও অন্যান্য কার্যকর উপায়ে দুঃখবোধ দূর করতে হবে। যেমনটি মহান আল্লাহ্‌র বাণীতে বুঝতে পারা যায়-

“তাদের কোন অপরাধ নেই, যারা আপনার নিকট বাহনের জন্য এসেছিল এবং আপনি তাদের বলেছিলেন ‘আমি তোমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি না’। তারা অর্থব্যয়ে অসামর্থ্যতার কারণে অশ্রু বিগলিত নয়নে ফিরে গেল।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৯২)

এখানে তাদের দুঃখের কারণে তাদের প্রশংসা করা হয়নি বরং দুঃখ সত্ত্বেও তাদের দৃঢ় ঈমানের প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু এর সাথে একথার ইঙ্গিতও করা হলো যে, তারা দুঃখিত হতে বাধ্য হয়েছিল। এ ঘটনা ঘটেছিল তখন, যখন তারা অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় রসদ যোগাড় করতে না পারায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন এক যুদ্ধাভিযানে যোগ দিতে পারেনি।

এ আয়াতটি মুনাফিকদের স্বরূপও উদঘাটিত করেছিল। কারণ, তারা যুদ্ধে যোগ না দেয়ার কারণে দুঃখিত হয়নি। (আরও একথা বুঝা গেল যে, সৎকাজ না করতে পারলে মু'মিনগণ দুঃখিত হতে বাধ্য হন এবং এর প্রয়োজনও রয়েছে। যেমনটি লেখক একটু আগেই বলেছেন। -অনুবাদক)

সুতরাং, শুভ দুঃখ হলো তা, যা সৎ কাজ করতে পারার কারণে বা পাপ করার কারণে উদ্ভূত হয়। যখন কেউ আল্লাহর হক আদায় করার ব্যাপারে অবহেলা করার কারণে দুঃখবোধ করে তখন সে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত লোকদের বৈশিষ্ট্যই প্রদর্শন করে। যেমনটি নিম্নের হাদীসে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

“মু’মিনদের ওপর উদ্বিগ্নতা, সংকট, অভাব-অনটন বা দুঃখকষ্ট নামে যা কিছুই আপতিত হোক না কেন, আল্লাহ তায়ালা এটাকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণ বানাবেন।”

একথা থেকে বুঝা যায় যে, মু’মিনগণ দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার দ্বারা জর্জরিত হয় এবং এর বিনিময়ে তাদের কিছু পাপ মাফ হয়। যা হোক, এতে একথা বুঝায় না যে, দুঃখবোধ কাঙ্খিত কোন কিছু দুঃখবোধকে ইবাদত মনে করে দুঃখ করা মু’মিনদের উচিত নয়। দুঃখবোধ করা যদি প্রকৃত কথা হতো তবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম দুঃখিত হতেন। কিন্তু তিনি কখনও অভাব বোধ করতেন না, বরং তার চেহারা মুবারক সদাহাস্য থাকত, তার আত্মা থাকত পরিতৃপ্ত এবং তিনি সর্বদা হাঁসি-খুশি থাকতেন।

হিন্দের বর্ণিত হাদীস “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বিষন্ন থাকতেন” এ প্রসঙ্গে বলতে হয়-এটি মুহাদ্দিসগণ দ্বারা (হাদীসরূপে বা বিশুদ্ধ হাদীস হিসেবে) অপ্রমাণিত। কেননা, এর বর্ণনাকারীগণের মধ্যে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি আছেন। এটা শুধু এর রাবীদের সনদের (বর্ণনাকারীদের ধারাক্রমের) দুর্বলতার কারণেই দুর্বল নয় বরং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃতপক্ষে যেমন ছিলেন তার বিপরীত হওয়ার কারণেও দুর্বল।

আমাদেরকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এটি একটি ইসরাঈলী বর্ণনা, যা তাওরাতে আছে বলে দাবি করা হয়। তবুও এতে অবশ্যই সঠিক ভাবার্থ আছে। কেননা, মু’মিনগণ সত্যিই তাদের গুনাহের কারণে দুঃখবোধ করেন এবং পাপীরা সদা খেল-তামাসায় ব্যস্ত, চপল, হালকা ও আনন্দিত। অতএব, যদি ঈমানদারদের অন্তরে ব্যথা লাগে তবে তা নেক কাজ করার সুযোগ হারানো বা পাপ কাজ করার কারণেই। এটা পাপীদের বিষন্নতার বিপরীত যাদের দুঃখের কারণ দৈহিক আনন্দ বা পার্থিব সুবিধা হারানো। তাদের আকুল আকাঙ্ক্ষা, উদ্বিগ্নতা ও বিষন্নতা সবসময় এ উদ্দেশ্যেই এবং অন্য কোন কিছুর জন্যই নয়। এ আয়াতে মহান আল্লাহ তার নবী ইসরাঈল (আঃ) [ইসরাঈল (আঃ) ইয়াকুব (আঃ)-এর আরেক নাম] সম্বন্ধে বলেন-

وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ

“দুঃখে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল ও তিনি ছিলেন মর্মাহত।” (১২-সূরা ইউসুফ : আয়াত-৮৪)

তার প্রিয় পুত্রকে হারানোর কারণে তার দুঃখের কথা এখানে আমাদেরকে জানানো হলো। শুধু ঘটনা জানানোর কারণেই কোন কিছু অনুমোদিত বা অননুমোদিত হয়ে যায় না। আসল কথা হলো- আমাদেরকে দুঃখবোধ করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে আদেশ করা হয়েছে। যেহেতু এটা (দুঃখবোধ) তার শিকারের মাথার উপর বিশাল মেঘখণ্ডের মতো ভেসে বেড়ায় ও (এটা এমন এক প্রাচীর যা) তাকে মহৎ লক্ষ্যে পৌছতে বাধা প্রদান করে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিষন্নতা একটা ফিতনা ও কষ্ট এবং কিছু রোগ-সদৃশ। যা হোক, বিষন্নতা এমন কিছু নয়, যেটাকে ধার্মিকদেরকে কায়মনোবাক্যে কামনা করতে হবে বা চেষ্টা করে বর্জন করতে হবে।

আপনাকে নির্দেশ করা হয়েছে সুখ-শান্তির উপায় অন্বেষণ করতে। আপনার জন্য একটি শুভজীবন মঞ্জুর করার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে, এমন শুভ জীবন যা আপনাকে একটি স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন বিবেক ও একটি প্রশান্ত মন উপহার দিবে। এ সুখ অর্জন করা একটি প্রাথমিক পুরস্কার ও এমন একটি বিষয় যা কিছু কিছু লোকের কথায় নিম্নলিখিতভাবে (গুরুত্বপূর্ণ) করা হয়েছে। আর তা হলো: “এ পৃথিবীতে একটি স্বৰ্গ আছে, আর যে এ স্বর্গে প্রবেশ করবে না সে পরকালের স্বর্গেও প্রবেশ করতে পারবে না।”

(হাদীস শরীফে আছে দুনিয়া মু’মিনদের জেলখানা। সুতরাং এ দুটি কথা পরস্পর বিরোধী মনে হচ্ছে। আসল কথা হলো, দুনিয়া কষ্টের জায়গা হওয়া সত্ত্বেও দুঃখবোধ না করে বরং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট থেকে দুনিয়া নামক এই নরককে স্বর্গে পরিণত করা যায় ও তাই করা উচিত। এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন এ পুস্তকের “কষ্টের পরেই আরাম আছে” অধ্যায়। -অনুবাদক)

আর আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের আত্মাকে সরল-সোজা পথে পরিচালিত করেন এবং আমাদেরকে দুর্দশাগ্রস্ত, শোচনীয় ও হতভাগা জীবন থেকে রক্ষা করেন।

এক মুহূর্ত ভাবুন 

আসুন, আমরা নিচের এই দোয়াগুলো আবৃত্তি করি-এ দোয়াগুলোর উদ্দেশ্য দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা ও অভাব-অনটন দূর করা।

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ، وَرَبُّ الْأَرْضِ، وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ

اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ

أسْتَغْفِرُ اللهَ العَظِيمَ الَّذِي لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ، الحَيُّ القَيُّومُ، وَأتُوبُ إلَيهِ

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، ابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجَلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي وجلاء حزني

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

অর্থাৎ, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য (ইলাহ) নেই, তিনি চিরধৈর্যশীল, অতি মহান। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই, তিনি বিশাল আরশের অধিপতি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি আসমানসমূহের অধিপতি এবং পৃথিবীর প্রতিপালক এবং মহা আরশের প্রভু। হে চিরঞ্জীব! হে সব কিছুর ধারক, রক্ষক ও প্রতিপালক আপনি ছাড়া কোন ইলাহ (উপাস্য ও প্রভু) নেই। আমরা আপনার দয়ার দোহাই দিয়ে আপনার সাহায্য কামনা করি।”

“হে আল্লাহ! আমি আপনার করুণার আশা করি। তাই আমাকে আমার নিকট সোপর্দ করবেন না, এমনকি এক মুহুর্তের জন্যও না। আর আমার সকল কাজকে বিশুদ্ধ করে দিন। আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।”

“আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাই; তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব সবকিছুর প্রতিপালক, রক্ষক এবং আমি তার নিকট তওবা করছি। (অনুতপ্ত হয়ে ফিরছি)।"

“আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; আপনি কতই না পবিত্র, উত্তম ও নিখুঁত। আমিতো অত্যাচারীদের একজন ছিলাম।"

“হে আল্লাহ! নিঃসন্দেহে আমি আপনার বান্দা, আপনার এক বান্দা ও এক বান্দির সন্তান, আপনার হাতে আমার মালিকানা, আমার ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্তই অবধারিত, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালাই সঠিক, যে সমস্ত নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন বা আপনার কিতাবে আপনার যেসব নাম অবতীর্ণ করেছেন বা আপনার সৃষ্টির কাউকে শিখিয়েছেন, অথবা আপনার নিকটই ইলমে গাইবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন সেসব নামের উসিলায়

বিষন্নতা দূরকারী ও আমার দুশ্চিন্তা মুক্তকারী বানানোর জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি।”

“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুশ্চিন্তা, দুঃখ-বেদনা, অক্ষমতা, অলসতা, কৃপণতা, ভীরুতা-কাপুরুষতা, ঋণগ্রস্ত হওয়া ও মানুষের নিকট পরাজিত হওয়া থেকে পানাহ চাই।"

“আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তিনি কতই না চমৎকার অভিভাবক!”

মৃদু হাসতে চেষ্টা করুন 

মৃদু বা সংযত হাসি- হতাশা ও বিষন্নতার চিকিৎসা বা ঔষধ হিসেবে কাজ করতে পারে। মনকে হালকা ও অন্তরকে পরিষ্কার রাখার উপর মৃদু হাসির শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন: “আমার আত্মাকে বিশ্রাম ও শান্তি দেয়ার জন্য আমি হাসার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করি। সর্বাপেক্ষা সম্মানিত মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে এমনভাবে হাসতেন যে, তাঁর মাডির দাঁত দেখা যেত।”

শান্তি পাওয়ার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো হাসা। তবে মনে রাখবেন যে, অন্যান্য বিষয়ের মতোই আপনাকে (সংযত থাকতে হবে) অসংযত হওয়া চলবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“অতিরিক্ত হেসো না, কেননা, অবশ্যই অতিরিক্ত হাসি আত্মাকে মেরে ফেলে বা অতিরিক্ত হাসিতে দিল মারা যায়।”

যা কাঙ্ক্ষিত তাই মিতচার

تبسمك في وجه أخيك صدقة

“যদি তুমি তোমার ভাইয়ের সামনে মুচকি হাসি দাও, তবে তুমি সদকা করার সওয়াব পাবে।”

“তাই সুলাঈমান (আঃ) তার কথায় কৌতুকাবিষ্ট হয়ে মুচকি হাসলেন।” (২৭-সূরা আন নামল: আয়াত-১৯)

যখন আপনি হাসবেন তখন ঠাট্টা-বিদ্রুপের হাসি হাসবেন না। “যখন তিনি তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ নিয়ে এল অমনিই তারা (বিদ্রুপের হাসি) হাসতে লাগল।” (৪৩-সূরা আয যুখরুফ: আয়াত-৪৭)

 ৩৬. জান্নাতের আনন্দসমূহের মধ্যে হাসিও থাকবে
“কিন্তু সে দিন (কেয়ামতের দিন) মু’মিনগণ কাফিরদের প্রতি (বিদ্রুপের হাসি) হাসবে।” (সূরা-৮৩ আল মুতাফফিফীন: আয়াত-৩৪)

যে ব্যক্তি আরবদের মাঝে তার হাসির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল আরবরা তার সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করত। তারা এ হাসিকে উদার ও মহান ব্যক্তিত্ব, মহৎ মানসিকতা ও পরিষ্কার মনের লক্ষণ বলে বিশ্বাস করত।

সত্যকথা হলো যে, ইসলামের মূলনীতি মিতাচার ও সুপরিমিতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তা ঈমান, ইবাদত, চাল-চলন বা আচার-ব্যবহারের বিষয় বা যাই হোক না কেন। ইসলাম ভ্ৰকুঞ্চিত ও গোমরামুখ সহ্য করে না আবার সর্বদা লীলাপরায়ণ ইন্দ্রিয় বিলাসিতাও সহ্য করে না। বরং ইসলাম যা প্রবর্তন করে তা হলো, প্রয়োজনে গাম্ভীর্য এবং প্রয়োজনে যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় হাসি-খুশি।

“তারপর সে ভ্ৰকুঞ্চিত করল ও গোমরা মুখে তাকাল।” (৭৪-সূরা আল মুদদাছছির: আয়াত-২২)

لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যতই সামান্য হোক না কেন, কোন নেক আমলকে তুচ্ছ ভাববে না, এমনকি তা যদি তোমার ভাইয়ের সাথে প্রসন্ন মুখভাব নিয়ে (হাসিমুখে) সাক্ষাৎ করাও হয়।”

আহমদ আমীন তার ‘ফয়যুল খাতির’ নামক পুস্তকে বলেছেনঃ “যারা সদা হাসি-খুশি তারা তাদের নিজের জীবনকে শুধু অধিকতর আনন্দময়ই করে তোলে না, অধিকন্তু তারা তাদের কাজে অধিকতর উৎপাদনশীল এবং তাদের দায়িত্ব পালনে তাদের অধিকতর সক্ষমতা রয়েছে। সমস্যার মুকাবিলা করতে এবং তাদের জন্য সুবিধাজনক সমাধান খুঁজে বের করতে তারা অধিকতর উপযোগী। তারা অতি উর্বর ও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদনকারী এমন কর্মচারী যারা নিজেদেরকে ও অন্যদেরকে লাভবান করে।”

আমাকে যদি সামাজিক মর্যাদা ও প্রচুর অর্থকড়ি এবং সুখী, আলোকিত ও হাসি-খুশি ব্যক্তিত্ব এতদুভয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার এখতিয়ার দেয়া হতো তবে আমি পরেরটিকে বেছে নিতাম। কারণ, প্রচুর সম্পদ যদি দুঃখ-কষ্টের সূত্রপাত করে, তবে তা কিসের সম্পদ? উচ্চ মর্যাদা যদি সদা বিষণ্ণতা বয়ে আনে, তবে তা কিসের উচ্চ মর্যাদা? পরমা সুন্দরী নারী যদি তার ঘরকে জ্বলন্ত নরকে রূপান্তরিত করে, তবে সে কিসের ভালো? যে স্ত্রী ঐ রূপসী নারীর মতো সৌন্দর্যের অনুপম পরাকাষ্ঠায় পৌছেনি তবুও তার গৃহকে এক ধরনের স্বর্গে পরিণত করেছে সে ঐ অনুপম রূপসী নারীর চেয়ে বহুগুণে, কম করে হলেও হাজারগুণ ভালো।

নিম্নোক্ত কল্পিত দৃশ্যাবলীর কথা একটু ভেবে দেখুন। এক হিসেবে গোলাপ হাসছে আর বনও হাসছে। সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, আকাশ, তারকারাজি আর পাখ-পাখালি সবই হাসছে। অনুরূপভাবে মানব জাতিও তার প্রকৃতি অনুসারেই এক হাসি-খুশি সত্তা— যদি এই প্রাকৃতিক প্রবণতাকে বাধাদানকারী জিনিসগুলো না থাকত যেমন লোভ, স্বার্থপরতা ও এমন সব মন্দকাজ, যা ভ্ৰকুটি ঘটায়। এ হিসেবে মানুষ অস্বাভাবিক ও তার চারপাশের সবকিছুর প্রাকৃতিক ঐকতানের সাথে বিরোধপূর্ণ।

সুতরাং যে ব্যক্তির আত্মা কলঙ্কিত সে বস্তুসমূহের প্রকৃতরূপ দেখতে পায় না। প্রতিটি ব্যক্তিই পৃথিবীকে তার নিজের সমগ্র সত্তার ভিতরে, তার কাজ-কর্মে, তার চিন্তা-ভাবনা ও তার প্রেরণা ও উদ্দেশ্যের মাঝে দেখে। আমাদের কাজ-কর্ম যদি মহৎ হয়, আমাদের চিন্তা-ভাবনা যদি বিশুদ্ধ হয় আর আমাদের চেতনা ও উদ্দেশ্য যদি সম্মানজনক হয় তবে যে চশমা (দৃষ্টিভঙ্গি) দিয়ে আমরা পৃথিবীকে দেখি তা পরিষ্কার হবে এবং পৃথিবী আসলে যেমন একটি সুন্দর সৃষ্টি তেমনি (সুন্দর) দেখা যাবে। চশমা যদি ময়লাযুক্ত ও দাগযুক্ত হয় তবে সবকিছুই কালো ও রুগ্ন দেখাবে।

কিছু মন আছে যারা সবকিছুকেই দুঃখ-কষ্টে রূপান্তরিত করতে পারে, যখন নাকি এমন কিছু মন আছে, যারা জটিলতম-কঠিনতম পরিস্থিতিতেও সুখের সন্ধান করে নিতে পারে। নারী জাতি তো আছেই। তাদের চোখ তো ভুল ছাড়া অন্য কিছুর উপর পড়েই না! (তারা বলে) আজকের দিনটি অশুভ, কারণ (আজ) একটি সুন্দর চীনামাটির প্লেট ভেঙ্গে গেছে বা বাবুর্চি (আজ) খাবারে অনেক বেশি লবণ দিয়েছে। তাই সে রাগে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে বাড়ির সবাইকে অভিশাপ বা গালাগাল দিতে থাকে।

সুতরাং মানুষেরাই তাদের নিজেদের উপর দুঃখ-কষ্ট নিয়ে আসে এবং তাদের স্বভাবের কারণে একই সমস্যা অন্যদের উপরও পূঞ্জীভূত করে। যে শব্দই সে শুনতে পায় সম্ভাব্য সর্বাপেক্ষা মন্দভাবে তার অর্থ করে। নগণ্যতম যে ঘটনা তাকে নিয়ে ঘটে, তাতেই সে গুরুতরভাবে ভেঙ্গে পড়ে। প্রত্যাশিত মুনাফা না হলেই তারা দুঃখ-কষ্টে পড়ে। তার দৃষ্টিতে গোটা দুনিয়াটাই কালো এবং তাই সে তার চারপাশের সবার জন্যই পৃথিবীটাকে কালো বানায়।

তাদের যা কিছু ঘটে, তাতেই তারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার ক্ষমতা রাখে। তারা তিলকে তাল করে। তাদের ভালো কাজ করার ক্ষমতা অবহেলিত এবং তাদের যা আছে যদিও তা প্রচুর পরিমাণে আছে-তাতে তারা কখনও সুখী বা পরিতৃপ্ত নয়। তাদের বিত্তবিভব-সহায় সম্পদ যতই বিশাল হোক না কেন তারা কখনও তাতে কোনরূপ রহমতের কথা বুঝতে পারে না।

জীবন তো একটি শিল্পকলা বা বিজ্ঞানের মতোই। এই শিল্পকলা বা বিজ্ঞানকে শিখতে হয় এবং চর্চা করতে হয়। পকেটে বা একাউন্টে সহজে টাকা আসার পথকে পরিষ্কার করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে টাকা বাড়ানোর চেয়ে জীবনের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করা অনেক বেশি ভালো। চারিত্রিক সৌন্দর্য, মহিমা-গৌরব ও স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা চর্চার প্রতি কোনরূপ চেষ্টা-তদবীর না করে যখন জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে শুধুমাত্র সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তখন জীবনের কী মূল্য আছে?

অধিকাংশ লোকই জীবনের সৌন্দর্য্যের প্রতি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে না। শুধু সোনা-রূপার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা আরামপ্রদ ও বিলাসবহুল বাগান, সুন্দর ফুলশয্যা, বহমান নদী বা গানেরত পাখির বাকের মাঝেই তাদের জীবন অতিবাহিত করে। তবে এসব দৃশ্য দেখেও তাদের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে না। তাদের অন্তর শিহরিত হয় না। তাদের মনে সাড়া জাগে না।

তাদের পকেটে টাকা আসা আর যাওয়াই শুধু তাদের মনকে দোলা দেয় বা নাড়া দেয়। টাকা সুখী জীবনের একটি উপায় মাত্র, তারা এ সত্যকে উল্টে-পাল্টে দিয়েছে। তাদের সুখী জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে এবং টাকাকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বানিয়েছে। সৌন্দর্যকে দেখার জন্য আমাদের শুধুমাত্র টাকার দিকেই তাক করেছি।

নৈরাশ্যের চেয়ে অধিকবার ও অধিক গভীরভাবে ভ্ৰকুটি করতে অন্য কিছুই পারে না। আপনি যদি একজন হাসি-খুশি ব্যক্তি হতে চান তবে নৈরাশ্য ও হতাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনার ও অন্যদের জন্যে সুযোগের দরজা যেমন সর্বদা খোলা আছে, সাফল্যের দ্বারও তেমনি খোলা আছে। সুতরাং, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির আশা দিয়ে আপনার মনকে প্রলুব্ধ, উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, জাগরিত বা চেতনাপ্রাপ্ত করুন।

আপনি যদি মনে করেন যে, আপনি অকিঞ্চিতকর, তুচ্ছ বা নগণ্য এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তবে আপনার জীবনের সাফল্য বা কৃতিত্ব কখনও এই প্রাথমিক লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যাবে না। আর যদি আপনি মনে করেন, আপনার জীবনের কর্মই হলো বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করা তবে আপনি আপনার মাঝে এমন এক দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব টের পাবেন, যা সকল বাধার প্রাচীরকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারে। এ কথাটিকে নিম্নোক্তভাবে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

যে লোক একশত মিটার দৌড় প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করে, সে দৌড় শেষ করার পর মুহুর্তেই ক্লান্তিবোধ করবে। পক্ষান্তরে কেউ চারশত মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে সে একশত মিটার বা দুইশত মিটার চিহ্ন অতিক্রম করার পর ক্লান্তিবোধ করবে না। সুতরাং মনই দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি জুগিয়ে দেয় এবং আপনার লক্ষ্যের অনুপাতে শক্তি যোগায়। এ কারণে আপনাকে অবশ্যই আপানার লক্ষ্য স্থির করতে হবে এবং তা হতে হবে উচ্চ (লক্ষ্য)। যতদিন পর্যন্ত সে লক্ষ্যে পৌছার পথে আপনি প্রতিদিনই একটি নতুন পদক্ষেপ ফেলবেন ততদিন পর্যন্ত কখনই হতাশাবোধ করবেন না। কিসে আত্মাকে ভ্ৰকুটি করে অন্ধকার কারাগারে বন্দী করে এর অগ্রগতিরোধ করে? উত্তর হলো-নৈরাশ্য, হতাশা, সবকিছুকেই মন্দ ভাবা, অন্যের দোষ অন্বেষণ করা এবং সবসময় পৃথিবীর দোষ বর্ণনা করা।

ধন্য সে ব্যক্তি, যে ব্যক্তির প্রাকৃতিক দক্ষতা ও গুণকে উন্নত করার জন্য এবং তার (জ্ঞান ও গুণের) পরিমণ্ডলসমূহকে প্রশস্ত করার জন্য একজন সাহায্যকারী শিক্ষক আছে। সর্বোত্তম শিক্ষক তিনিই, যিনি তার ছাত্রের মাঝে দয়া ও উদারতা ধীরে ধীরে সঞ্চার করেন। মানুষ যে সর্বোত্তম কাজের জন্য চেষ্টা করতে পারে তা শিক্ষা দেন আর তা হল, সাধ্যানুসারে অন্যের উপকার করা। আত্মাকে সূর্যের মতো আলো বিকিরণকারী ও আশাপ্রদ হতে হবে। আত্মাকে কোমলতা, পুণ্য বা সদগুণ, বদান্যতা এবং যারা কল্যাণ পেতে চায় তাদের নিকট কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ হতে হবে।

হাসি-খুশি লোকে সমস্যা দেখলে তা কাটিয়ে উঠতে ভালোবাসে। তিনি সমস্যা দেখলে হাসেন, সেগুলোর সমাধান করার সুযোগে প্রচুর আনন্দ লাভ করেন। ভ্ৰকুটিকারী ব্যক্তি যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন সে সমস্যাকে বড় করে দেখে এবং এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে করে সময় নষ্টের মাধ্যমে নিজের দৃঢ় প্রত্যয়কে খর্ব করে। সে জীবনে সফলতা চায়, তবে এর মূল্য দিতে (পরিশ্রম করতে) রাজি নয়, সে সব পথে দাত বের করা সিংহ দেখতে পায়। সে শুধু আকাশ থেকে স্বর্ণ বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে বা জমিন ফেটে কোন গুপ্তধন বেরিয়ে আসার প্রতীক্ষা করে।

জীবনে জটিল-কঠিন জিনিস তো আপেক্ষিক বিষয় মাত্র। কারণ, সাধারণ লোকের কাছে সবকিছুই কঠিন। অপরদিকে উল্লেখযোগ্য লোকের জন্য ভীষণ জটিলতা বলতে কিছুই নেই। যখন স্মরণীয় ব্যক্তিরা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নিজেদের মূল্য বৃদ্ধি করে, তখন দুর্বল ব্যক্তি সমস্যার ভয়ে পালিয়ে নিজের হীনতা বৃদ্ধি করে। সমস্যা হলো পাজি কুকুরের মতো। এটা আপনাকে ভীতু বা পলায়নকারী দেখতে পেলে ঘেউ ঘেউ করে এবং আপনার পিছু নেয়। অবশ্য, এটা আপনার অবজ্ঞা, নিরুদ্বিগ্নতা ও এটার দিকে আপনার চোখ রাঙানো দেখলে রণেভঙ্গ দিয়ে পিছু হটে যায়।

এতদ্ব্যতীত হীনমন্যতাবোধের চেয়ে বেশি মারাত্মক আর কোন কিছুই নেই। এটা এমনই অনুভূতি, যা হীনমন্য ব্যক্তিকে তার চেষ্টার চূড়ান্ত পর্যায় সকল বিশ্বাস হারাতে বাধ্য করে। তাই, যখনই সে কোন প্রকল্প শুরু করে তখনই সে এটাকে সমাপ্ত করার ব্যাপারে বা সফলতার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং এই সন্দেহকে প্রশ্রয় দিয়ে তদানুপাতে কাজ করে (অর্থাৎ প্রকল্প বাদ দেয়)। এভাবে সে ব্যর্থ হয়, আত্মবিশ্বাস থাকা এক মহৎ গুণ এবং এটা জীবনে সফলতার ভিত্তি।

এটা লক্ষ্য করা জরুরি যে, আত্মগরিমা ও আত্মবিশ্বাসের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। আত্মগৰ্ব বলতে বুঝায় প্রবঞ্চণাময় কল্পনার উপর এবং মিথ্যা গর্বের উপর নির্ভর করা। আর আত্মবিশ্বাস বলতে বুঝায়, সত্যিকার দক্ষতার উপর নির্ভর করা; এর অর্থ দায়িত্ব সম্পন্নকরণ, মেধা ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতাসমূহের উন্নতি সাধন। একটি হাসি, একটি হাসি-খুশি মুখ, সহজ রীতিনীতি-আচার-আচরণ এবং একটি ভদ্র, উদার আত্মা আমাদের সত্যিই কতই না অভাব! নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

“অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমার নিকট এই মর্মে ওহী পাঠিয়েছেন যে, তোমাদের (এতটা) বিনীত হওয়া উচিত, যাতে একে অপরের উপর অত্যাচার না করে, একে অপরের উপর গর্ব না করে।”


“আল্লাহর উপর ভরসা” শিরোনামের আকর্ষনীয় এই টপিকসের সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-
১ম পর্ব    ২য় পর্ব    ৩য় পর্ব    ৪র্থ পর্ব    ৫ম পর্ব    ৬ষ্ট পর্ব    ৭ম পর্ব    ৮ম পর্ব    ৯ম পর্ব    ১০ম পর্ব    ১১-তম পর্ব    ১২-তম পর্ব    ১৩-তম পর্ব    ১৪-তম পর্ব    ১৫-তম পর্ব    ১৬-তম পর্ব    ১৭-তম পর্ব    ১৮-তম পর্ব    ১৯-তম পর্ব    ২০-তম পর্ব    ২১-তম পর্ব    ২২-তম পর্ব    ২৩-তম পর্ব    ২৪-তম পর্ব    ২৫-তম পর্ব    ২৬-তম পর্ব    ২৭-তম পর্ব    ২৮-তম পর্ব    ২৯-তম পর্ব    ৩০-তম পর্ব    ৩১-তম পর্ব    ৩২-তম পর্ব    ৩৩-তম পর্ব    ৩৪-তম পর্ব    ৩৫-তম পর্ব    ৩৬-তম পর্ব    ৩৭-তম পর্ব    ৩৮-তম পর্ব 



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url