সিরাতুন নবী (সাঃ) - ১৩ || মাক্কী জীবনে দাওয়াতী কার্যক্রম || হেরা গুহার অভ্যন্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ||





পয়গম্বরী যুগ পবিত্র জীবনের মক্কাবস্থানকাল : দাওয়াতের সময়কাল ও স্তর

এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

মাক্কী জীবনে দাওয়াতী কার্যক্রম

আলোচনা ও অনুধাবনের সুবিধার্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পয়গম্বরী জীবন কালকে আমরা দুইটি অংশে বিভক্ত করে নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কাজকর্মের ধারা প্রক্রিয়া এবং সাফল্য। সাফল্যের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে এর এক অংশ থেকে ছিল ভিন্নধর্মী এবং ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যময়। অংশ দুটি হচ্ছে যথাক্রমেঃ

১. মক্কায় অবস্থান কাল প্রায় তের বছর
২. মদীনায় অবস্থান কাল দশ বছর

তারপর মক্কী ও মাদীনী উভয় জীবনকাল বৈশিষ্ট্য ও কর্ম প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ছিল স্তর ক্রমিক এবং ভিন্নধর্মী। তাঁর পয়গম্বরী জীবনের উভয় অংশ পর্যালোচনা এবং পরীক্ষণ করলে অনুক্রমিক স্তরগুলো সমীক্ষা করে দেখা বহুলাংশে সহজতর হয়ে উঠবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কাবস্থান কাল এবং কর্মপ্রক্রিয়াকে তিনটি আনুক্রমিক স্তরে বিভক্ত করে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে:

১. সর্ব সাধারণের অবগতির অন্তরালে গোপন দাওয়াতী কর্মকান্ডের স্তর (তিন বছর)।
২. মক্কাবাসীগণের নিকট প্রকাশ্য দাওয়াত ও তাবলীগী কাজের স্তর (৪র্থ বছর থেকে ১০ম বছরের শেষ নাগাদ)।
৩. মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ ও বিস্তৃতির স্তর (১০ম নুবুওয়াতী বর্ষের শেষ ভাগ হতে হিজরত পর্যন্ত।।
মদীনার জীবন এবং মদীনায় অবস্থান কালের স্তর অনুযায়ী বিস্তৃত আলোচনা যথাক্রমে সন্নিবেশিত হবে।


হেরা গুহার অভ্যন্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন চল্লিশে পদার্পণ করলেন, ঐ সময় তাঁর এত দিনের বিচার বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-ভাবনা যা জনগণ এবং তাঁর মধ্যে ব্যবধানের এক প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছিল তা উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেন। খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে মক্কা নগরী হতে দু’মাইল দূরত্বে অবস্থিত হেরা পর্বত গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতে লাগলেন। এটা হচ্ছে ক্ষুদ্র আকার-আয়তনের একটি গুহা। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে চার গজ এবং প্রস্থ পৌনে দু’গজ। এর নীচ দিকটা তেমন গভীর ছিল না। একটি ছোট্ট পথের প্রান্তভাগে অবস্থিত পর্বতের উপরি অংশের একত্রে মিলে মিশে ঠিক এমন একটি আকার আকৃতি ধারণ করেছিল যা শোভাযাত্রার পুরোভাগে অবস্থিত আরোহী শূন্য সুসজ্জিত অশ্বের মতো দেখায়।

পুরো রমাযান রাসূলুল্লাহ (ষাঃ) হেরা গুনায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। বিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের অন্তরাল থেকে যে মহাশক্তি প্রতিটি মুহুর্তে সকল কিছুকে জীবন, জীবিকা ও শক্তি জাগিয়ে চলেছেন, সেই মহা মহীয়ান ও গরীয়ান সত্ত্বার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। স্বগোত্রীয় লোকদের অর্থহীন বহুত্ববাদী বিশ্বাস ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা তাঁর অন্তরে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করত। কিন্তু তাঁর সামনে এমন কোন পথ খোলা ছিল না যে পথ ধরে তিনি শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে পদচারণা করতে সক্ষম হতেন।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্জন-প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।

এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যতের এক মহতী কর্মসূচীর জন্য তাঁকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। যে আত্মার নসীবে নবুয়তরূপী এক মহান আসমানী নেয়ামত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে এবং যিনি পথভ্রষ্ট ও অধঃপতিত মানুষকে সঠিকপথ নির্দেশনা দিয়ে করবেন ধন্য তাঁর জন্য যথার্থই প্রয়োজন সমাজ জীবনের যাবতীয় ব্যস্ততা, জীবন যাত্রা নির্বাহের যাবতীয় ঝামেলা এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থেকে নির্জনতা অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বিশ্বব্যবস্থায় সব চাইতে মর্যাদাশীল ও দায়িত্বশীল-আমানতদার মনোনীত করে তাঁর কাঁধে দায়িত্বভার অর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানবের জীবন বিধানের রূপরেখা পরিবর্তন এবং অর্থহীন আদর্শের জঞ্জাল সরিয়ে শাশ্বত আদর্শের আঙ্গিকে ইতিহাসের পরিমার্জিত ধারা প্রবর্তন করতে চাইলেন, তখন নবুয়ত প্রদানের প্রাককালে তাঁর জন্য একমাসব্যাপী নির্জনতা অবলম্বন অপরিহার্য করে দিলেন যাতে তিনি গভীর ধ্যানের সূত্র ধরে দিব্যজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। নির্জন হেরা গুহার সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করতেন এবং সকল অস্তিত্বের অন্তরালে লুক্কায়িত অদৃশ্য রহস্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করতেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসা মাত্রই তিনি বাস্তবায়নের ব্যাপারে ব্রতী হতে পারেন।[2]

[1] আল্লামা সুলায়মান মানসুরপুরী, রহমাতুল্লি­ল ‘আলামীন ১ম খন্ড ৪৭ পৃষ্ঠা, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, ২৩৫ ও ২৩৬ পৃষ্ঠা। ফী যিলালিল কুরআন: ২৯/১৬৬ পৃষ্ঠা।
[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন

নাবী কারীম (ﷺ)-এর বয়সের ৪০তম বছর যখন পূর্ণ হল- এটাই হচ্ছে মানুষের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বয়স এবং বলা হয়েছে যে, এ বয়স হচ্ছে পয়গম্বরগণের নবুয়ত প্রাপ্তির উপযুক্ত বয়স-তখন নবুওয়তের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে লাগল। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি যখনই কোন স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের মত। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল ছয়টি মাস যা ছিল নবুওয়তের সময় সীমার ছয়চল্লি­শতম অংশ এবং নবুওয়তের সময়সীমা ছিল তেইশ বছর। এরপর তিনি যখন হেরাগুহায় নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে হতে তৃতীয় বর্ষ অতিবাহিত হতে থাকল তখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মানুষের উপর স্বীয় রহমত বর্ষণের ইচ্ছা করলেন। তারপর আল্লাহ রাববুল আলামীন জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর কুরআনুল কারীমের কয়েকটি আয়াতে করীমা নাযিল করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবুওয়তের মহান মর্যাদা প্রদানে ভূষিত করেন।[1]

বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রমাণাদি গভীরভাবে অনুধাবন করলেই জিবরাঈল (আঃ)’র আগমনের প্রকৃত দিন তারিখ ও সময় অবগত হওয়া সম্ভব হবে। আমাদের সন্ধানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রমাযান মাসে ২১ তারিখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে। খ্রীষ্টিয় হিসাব অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট। চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী নাবী কারীম (ﷺ)-এর বয়স ছিল চল্লি­শ বছর ছয় মাস বার দিন এব সৌর হিসাব অনুযায়ী ছিল ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[2]

আসুন, এখন আমরা উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে নেই। এটা নৈসর্গিক নূর বা আসমানী দীপ্তির মতো এমন এক আলোক রশ্নি ছিল যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে, জীবনের গতিধারা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ইতিহাসের পট পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে থাকে। আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল ঘুমের অবস্থায় স্বপ্নযোগে, তিনি যখন যে স্বপ্নই দেখতেন তা প্রভাত রশ্মির মতো প্রকাশিত হতো। তারপর ক্রমান্বয়ে তিনি নির্জনতা প্রিয় হতে থাকলেন। নিরবাচ্ছিন্ন নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন থাকার সুবিধার্থে তিনি হিরা গুহায় অবস্থান করতেন। কোন কোন সময় গৃহে প্রত্যাবর্তণ না করে রাতের পর রাত তিনি এবাদত বন্দেগী এবং গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এ জন্য খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সে সব ফুরিয়ে গেলে পুণরায় তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন।

পূর্বের মতো খাদ্য এবং পানীয় সঙ্গে নিয়ে পুনরায় তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান মগ্ন হতেন। ওহী নাযিলের মাধ্যমে তাঁর নিকট সত্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই তিনি হেরাগুহার নির্জনতায় অবস্থান করতে থাকেন।

এমনভাবে একদিন তিনি যখন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন তখন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট আগমন করে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি বললেন, ‘পড়ার অভ্যাস আমার নেই।’ তারপর তিনি তাঁকে অত্যন্ত শক্তভাবে ধরে আলিঙ্গন করলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি পড়’’। তিনি আবারও বললেন, ‘আমার পড়ার অভ্যাস নেই’’। তারপর তৃতীয় দফায় আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার পর ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘পড়-

‏(‏اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ‏) ‏‏[‏العلق‏:‏1‏:‏ 3‏]‏‏)‏

অর্থঃ সেই প্রভুর নামে পড় যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্ত পিন্ড থেকে। পড় সেই প্রভূর নামে যিনি তোমাদের জন্য অধিকতর দয়ালু।’’[3]

তারপর ওহীর আয়াতগুলো অন্তরে ধারণ করে নাবী কারীম (ﷺ) কিছুটা অস্থির ও স্পন্দিত চিত্তে খাদীজাহ বিনতে খোওয়ালেদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বললেন, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমাকে বস্ত্রাবৃত করো।’ খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে শায়িত অবস্থায় বস্ত্রাবৃত করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত স্পন্দন প্রশমিত হলে তিনি তাঁর সহধর্মিনীকে হেরা গুহার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলেন। তাঁর অস্থিরতা ও চিত্ত চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষ্য করে খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘কোন ভয় করবেন না, আপনি ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচনের চেষ্টা করেন। অসহায়দের আশ্রয় প্রদান করেন। মেহমানদের আদর-যত্ন করেন, অতিথিদের আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণের দায় মোচনে সাহায্য করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।’

এরপর খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে স্বীয় চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নাওফাল বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযার নিকট নিয়ে গেলেন। জাহেলিয়াত আমলে অরকা খ্রীষ্টান ধর্ম অবলম্বন করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। এক সময় তিনি ইবরাণী ভাষায় কিতাব লেখতেন। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। তিনি কী যেন সব কথাবার্তা বলছেন এবং অস্থির হয়ে পড়ছেন।’

অরাকা বললেন, ‘ভাতিজা, বলতো তুমি কী দেখেছ? কী হয়েছে তোমার?

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং হিরাগুহায় যেভাবে যা ঘটেছিল সব কিছু সবিস্তারে বর্ণনা করলেন অরাকার নিকট।

আনুপূর্বিক সব কিছু শ্রবণের পর বিস্ময়-বিহবল কণ্ঠে অরাকা বলে উঠলেন, ‘ইনিই তো সেই মানুষ যিনি মুসা (আঃ)-এর নিকটেও আগমন করেছিলেন।’[4]

তারপর বলতে থাকলেন, ‘হায়! হায়! যেদিন আপনার স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোকেরা আপনার উপর নানাভাবে জুলম অত্যাচার করবে এবং আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে সেদিন যদি আমি শক্তিমান এবং জীবিত থাকতাম।’

অরাকার মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একী! ওরা আমাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে?’

ওয়ারাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, তারা অবশ্যই আপনাকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে।’ তিনি আরও বললেন ‘শুধু আপনার কথাই নয়, অতীতে এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। যখনই জনসমাজে সত্যের বার্তা বাহক কোন সাধক পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে তখনই তার স্বাগোত্রীয় লোকেরা নানাভাবে তার উপর জুলম, নির্যাতন চালিয়েছে এবং তাঁকে দেশ থেকে বহিস্কার করেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘মনে রাখুন আমি যদি সেই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকি তাহলে সর্ব প্রকারে আপনাকে সাহায্য করব।’ কিন্তু এর অল্পকাল পরেই ওরাকা মৃত্যু মুখে পতিত হন। এ দিকে ওহী আসাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।[5]

[1] হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, বায়হাকী এ ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন যে, স্বপ্নের সময় ছয় মাস ছিল। অতএব স্বপ্নের মাধ্যমে নবুওয়তের শুরু চলি­শ বছর পূর্ণ হবার পরে রবিউল আওয়াল মাসেই হয়েছিল। যা তাঁর জন্ম মাস ছিল। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় তাঁর নিকট রমাযান মাসে ওহী আসা আরম্ভ হয়েছিল। ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃষ্ঠা।

[2] ওহী নাজিল শুরুর মাস দিন এবং তারিখঃ নাবী কারীম (সাঃ)-এর ওহী প্রাপ্তি এবং নবুওয়ত লাভের মহান মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার মাস ও দিন তারিখ সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অধিক সংখ্যক চরিতকারগণ এ ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন যে মাসটি ছিল রবিউল আওয়াল। কিন্তু অন্য এক দল বলেন যে, মাসটি ছিল রমাযানুল মুবারক। কেউ কেউ আবার এ কথাও বলে থাকেন যে মাসটি ছিল রজব। (দ্রষ্টব্য- শাইখ আবদুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস ‘সীরাহ’ পৃষ্ঠা ৭৫) দ্বিতীয় দলের মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের মনে হয়, অর্থাৎ যাঁরা বলেন যে, এটা রমাযান মাসে অবতীর্ণ হয়েছিল তাঁদের মত কারণ, আল্লাহ পাক কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ

{شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ} ( البقرة : ১৮৫) {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১)

দ্বিতীয় মতটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) রমাযান মাসেই হেরা গুহায় অবস্থান করতেন এবং এটাও জানা যায় যে, জিবরাঈল (আঃ) সেখানে আগমন করতেন, অধিকমুত যাঁরা রমাযান মাসে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন কোন তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল সে ব্যাপারেও বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন রমাযান মাসের ৭ তারীখে, কেউ বলেছেন ১৭ তারীখে, কেউ বা আবার বলেছেন ১৮ তারীখে তা অবতীর্ণ হয়েছিল (দ্রষ্টব্য- মুখতাসারুস সীরাহ ৭৫ পৃঃ, রাহমাতুল্লি­ল আলামীন ১ম খন্ড ৪৯ পৃঃ) আল্লামা খুযরী অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, তারীখটি ছিল ১৭ই রমাযান (দৃষ্টব্য- তারীখে খুযরী ১ম খন্ড ৬৯ পৃঃ এবং তারীকুত্তাশরীউল ইসলামী ৫-৭ পৃঃ)।

আমার মতে ২১শে রমাযান এ জন্য গ্রহণযোগ্য যে, যদিও এটার স্বপক্ষে কেউ নাই, তবুও অধিক সংখ্যক চরিতকার এ ব্যাপারে এক মত হয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির দিনটি ছিল সোমবার। এ সমর্থন পাওয়া যায় আবূ কাতাদাহর সেই বর্ণনা থেকে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, ‘এ হচ্ছে সেই দিন যেদিন আমি ভূমিষ্ট হয়েছিলাম এবং আমার নিকট ওহী নাযিল করে আমাকে নুবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল।’’(সহীহুল মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ৩৬৮ পৃঃ, মুসনদে আহমাদ ২৯৭ পৃঃ, বায়হাকী ৪র্থ খন্ড ২৮৬ ও ৩০০ পৃঃ, হাকিম ২য় খন্ড ২৬৬ পৃঃ)। সেই রমাযান মাসে সোমবার হয়েছিল ৭, ১৪, ২১ ও ২৮ তারীখগুলোতে। এ দিকে সহীহুল হাদীস সূত্রে এটা প্রমাণিত ও স্বীকৃত হয়েছে যে, পবিত্র কদর রাত্রি রমাযান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে বিজোড় রাত্রিগুলোকেই ধরা হয়ে থাকে।

এখন আমরা এক দিকে কুরআন কারীম থেকে অবগত হচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, {إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ} (القدر : ১) তাছাড়া, আবূ কাতাদার বর্ণিত হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোমবার দিবস নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় সূত্রে পঞ্জিকার হিসেবে জানা যায়, ঐ বছর রমাযান মাসে কোন্ কোন্ তারীখ সোমবার ছিল। অতএব নির্দিষ্টভাবে জানা যায় যে, নাবী কারীম (সাঃ) নবুওয়তপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ২১শে রমাযানের রাত্রিতে। সুতরাং এটা ছিল ওহী অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম তারিখ।

[3] {عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ} পর্যন্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।

[4] তাবারী ২য় খন্ড ২০৭ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৩৭-২৩৮ পৃঃ। শেষে কিছুটা অংশ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এ বর্ণনার বৈধতা নিয়ে আমার মনে কিছুটা দ্বিধা আছে। সহীহুল বুখারীর বর্ণনাভঙ্গী এবং তার বিভিন্ন বর্ণনার সমন্বয় সাধনের পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কাভিমুখে প্রত্যাবর্তন এবং অরাকার সাথে সাক্ষাৎ ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর সেদিনই ঘটে ছিল। অবশিষ্ট হেরাগুহার অবস্থান তিনি মক্কা হতে ফিরে গিয়ে পূর্ণ করেছিলেন।

[5] সহীহুল বুখারী- ওহী নাযিলের বিবরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২ ও ৪৩ পৃষ্ঠা। শব্দের কিছু কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে সহীহুল বুখারী কেতাবুত তাফসীর এবং তা‘বিরুর রুইয়া পর্বেও বর্ণিত হয়েছে।



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url