ইউসুফ (আঃ)-এর জীবনী (১০ম পর্ব) || এক নজরে ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী || ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু ||





এক নজরে ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী

(১) জন্মের বৎসরাধিক কাল পরেই মায়ের মৃত্যু (২) অতঃপর ফুফুর কাছে লালন-পালন (৩) ফুফু ও পিতার স্নেহের দ্বন্দ্বে ফুফু কর্তৃক চুরির অপবাদ প্রদান। অতঃপর চুরির শাস্তি স্বরূপ ফুফুর দাসত্ব বরণ (৪) শৈশবে স্বপ্ন দর্শন ও পিতার নিকটে বর্ণনা (৫) পিতৃস্নেহের আধিক্যের কারণে ভ্রাতৃ হিংসায় পতিত হন এবং তাকে হত্যার চক্রান্ত হয় (৬) পরে জঙ্গলে নিয়ে হত্যার বদলে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হয় (৭) সেখান থেকে প্রসিদ্ধ মতে তিন দিন পরে একটি পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে উপরে উঠে আসেন (৮) অতঃপর ভাইদের মাধ্যমে ব্যবসায়ী কাফেলার নিকটে ক্রীতদাস হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়ে যান (৯) অতঃপর ‘আযীযে মিছর’ ক্বিৎফীরের গৃহে ক্রীতদাস হিসাবে পদার্পণ করেন ও পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হন (১০) যৌবনে গৃহস্বামীর স্ত্রী যোলায়খার কু-নযরে পড়েন (১১) অতঃপর সেখান থেকে ব্যভিচার চেষ্টার মিথ্যা অপবাদে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন (১২) প্রসিদ্ধ মতে সাত বছর কারাগারে থাকার পর বাদশাহর স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের অসীলায় বেকসূর খালাস পান এবং তার পূর্বে সম্ভবতঃ জেলখানাতেই তাঁর নবুঅত লাভ হয় (১৩) অতঃপর বাদশাহর নৈকট্যশীল হিসাবে বরিত হন (১৪) এ সময় ক্বিৎফীরের মৃত্যু এবং বাদশাহর উদ্যোগে যুলায়খার সাথে ইউসুফের বিবাহ হয় বলে ইস্রাঈলী বর্ণনায় প্রতিভাত হয়। তবে এতে মতভেদ রয়েছে। (১৫) বাদশাহ ইসলাম কবুল করেন বলে বর্ণিত হয়েছে এবং ইউসুফকে অর্থ মন্ত্রণালয় সহ দেশের পুরা শাসনভার অর্পণ করে তিনি নির্জনবাসী হন (১৬) দুর্ভিক্ষের সাত বছরের শুরুতে কেন‘আন থেকে ইউসুফের সৎ ভাইয়েরা খাদ্যের সন্ধানে মিসরে আসেন এবং তিনি তাদের চিনতে পারেন। দ্বিতীয়বার আসার সময় তিনি বেনিয়ামীনকে সাথে আনতে বলেন (১৭) বেনিয়ামীনকে আনার পর বিদায়ের সময় তার খাদ্য-শস্যের বস্তার মধ্যে ওযনপাত্র রেখে দিয়ে কৌশলে ‘চোর’(?) বানিয়ে তাকে নিজের কাছে আটকে রাখেন (১৮) বেনিয়ামীনকে হারানোর মনোকষ্টে বেদনাহত পিতা ইয়াকূব স্বীয় পুত্র ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে একত্রে পাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে বিশেষ জ্ঞান অথবা গোপন অহী লাভ করেন (১৯) ইউসুফ ও বেনিয়ামীনকে খুঁজে আনার জন্য ছেলেদের প্রতি তিনি কড়া নির্দেশ দেন এবং সেমতে তারা পুনরায় মিসর গমন করেন (২০) এই সময় আযীযে মিছরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে ভাইদের মুখে বৃদ্ধ পিতার ও দুস্থ পরিবারের দুরবস্থার কথা শুনে ব্যথিত ইউসুফ নিজেকে প্রকাশ করে দেন। (২১) তখন ভাইয়েরা তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন (২২) ইউসুফের নির্দেশে ভাইয়েরা কেন‘আনে ফিরে যান এবং ইউসুফের দেওয়া তার ব্যবহৃত জামা তার পরামর্শমতে অন্ধ পিতার চেহারার উপরে রাখার সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান (২৩) অতঃপর ইউসুফের আবেদনক্রমে গোটা ইয়াকূব-পরিবার মিসরে স্থায়ীভাবে হিজরত করে (২৪) মিসরে তাদেরকে রাজকীয় সন্বর্ধনা প্রদান করা হয় এবং প্রসিদ্ধ মতে চল্লিশ বছর পর পিতা ও পুত্রের মিলন হয়। (২৫) অতঃপর পিতা-মাতা ও ১১ ভাই ইউসুফকে সম্মানের সিজদা করেন। (২৬) এভাবে শৈশবে দেখা ইউসুফের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় এবং একটি করুণ কাহিনীর আনন্দময় সমাপ্তি ঘটে।

ইয়াকূব (আঃ)-এর মৃত্যু

ইয়াকূব (আঃ) মিসরে ১৭ বছর বসবাস করার পর ১৪৭ বছর বয়সে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন এবং অছিয়ত অনুযায়ী তাঁকে কেন‘আনে পিতা ইসহাক ও দাদা ইবরাহীম (আঃ)-এর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।[35]

[35]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/২০৫।

ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যু

ইউসুফ (আঃ) ১২০ বছর বয়সে মিসরে ইন্তেকাল করেন। তিনিও কেন‘আনে সমাধিস্থ হওয়ার জন্য অছিয়ত করে যান। তাঁর দুই ছেলে ছিল ইফরাঈম ও মানশা।[36] কেন‘আনের উক্ত স্থানটি এখন ফিলিস্তীনের হেবরন এলাকায় ‘আল-খলীল’ নামে পরিচিত। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُوْلِي الأَلْبَابِ، ‘নিশ্চয়ই নবীগণের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে’ (ইউসুফ ১২/১১১)।

ঐতিহাসিক মানছূরপুরী (মৃ: ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:) বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর অবস্থার সাথে আমাদের নবী (ছাঃ)-এর অবস্থার পুরোপুরি মিল ছিল। দু’জনেই সৌন্দর্য ও পূর্ণতার অধিকারী ছিলেন। দু’জনকেই নানাবিধ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়েছে। দু’জনের মধ্যে ক্ষমা ও দয়াগুণের প্রাচুর্য ছিল। দু’জনেই স্ব স্ব অত্যাচারী ভাইদের উদ্দেশ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেছিলেন, لاَتَثْرِيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই’। দু’জনেই আদেশ দানের ও শাসন ক্ষমতার মালিক ছিলেন এবং পূর্ণ কামিয়াবী ও প্রতিপত্তি থাকা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন’।[37]

পূর্বে বর্ণিত ঐতিহাসিক বর্ণনা সমূহের সাথে মানছূরপুরীর বর্ণনার মধ্যে কিছু গরমিল রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যে এরূপ মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য এই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাইরে সকল বক্তব্যের উৎস হ’ল ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহ। সেখানে বক্তব্যের ভিন্নতার কারণেই মুসলিম ঐতিহাসিকদের বক্তব্যে ভিন্নতা এসেছে। এই সঙ্গে এটাও জানা আবশ্যক যে, ইহুদীরা ছিল আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকারকারী, অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যাকারী, আল্লাহর কিতাবসমূহকে বিকৃতকারী ও তার মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জনকারী এবং নবীগণের চরিত্র হননকারী। বিশেষ করে ইউসুফ, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা ও তাঁর মায়ের উপরে যে ধরনের জঘন্য অপবাদ সমূহ তারা রটনা করেছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। অতএব ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে তাদের বর্ণিত অভব্য ও আপত্তিকর বিষয়াবলী থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

[36] . ঐ, পৃঃ ১/২০৬, ১৯৬।
[37]. সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, রহমাতুল লিল আলামীন (সুইওয়ালাঁ দিল্লী-২ : ই‘তিক্বাদ পাবলিশিং হাউস, ১ম সংস্করণ ১৯৮০ খৃঃ), ৩/১৩৩ পৃঃ।

সূরা ইউসুফের কিছু আয়াতের ব্যাখ্যার সংশয় নিরসন

সূরা ইউসুফের মোট ৯ (নয়)টি আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আয়াতগুলি হ’ল যথাক্রমে ৪, ৬, ৮, ১৫, ২৪, ২৬, ২৮, ৪২ ও ৫২ আমরা এখানে সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরব এবং গৃহীত ব্যাখ্যাটি পেশ করব।-

১. আয়াত সংখ্যা ৪ : (أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَباً ) ‘এগারোটি নক্ষত্র’। জনৈক ইহুদীর প্রশ্নের উত্তরে রাসূলের বরাত দিয়ে উক্ত ১১টি নক্ষত্রের নাম সহ হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে।[38] যাদেরকে ইউসুফ আকাশে তাকে সিজদা করতে দেখেন। অথচ হাদীছটি ভিত্তিহীন।

এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল, ইউসুফের বাকী ১১ ভাই হ’লেন ১১টি নক্ষত্র এবং তাঁর পিতা-মাতা হ’লেন সূর্য ও চন্দ্র, যারা একত্রে ইউসুফকে সম্মানের সিজদা করেন। যা বর্ণিত হয়েছে সূরা ইউসুফ ১০০ নম্বর আয়াতে।

২. আয়াত সংখ্যা ৬ : (وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأْوِيلِ الأَحَادِيثِ ) ‘এবং তোমাকে বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন’। এখানে একদল বিদ্বান বলেছেন, ‘বাণী সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব’ অর্থ আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের সুন্নাত সমূহের অর্থ উপলব্ধি করা। এখানে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল : স্বপ্ন ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা, যা বিশেষভাবে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর বাণী সমূহ, যা তাঁর কিতাব সমূহে এবং নবীগণের সুন্নাত সমূহে বিধৃত হয়েছে, সেসবের ব্যাখ্যাও এর মধ্যে শামিল রয়েছে।

৩. আয়াত সংখ্যা ৮ : (إِنَّ أَبَانَا لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ ) ‘নিশ্চয়ই আমাদের পিতা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন’। ইউসুফের বিমাতা দশ ভাই তাদের পিতা হযরত ইয়াকূব (আঃ)-কে একথা বলেছিল শিশুপুত্র ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বেনিয়ামীনের প্রতি তাঁর স্নেহাধিক্যের অভিযোগ এনে। একই কথা তাঁকে পরিবারের অন্যেরা কিংবা প্রতিবেশীরাও বলেছিল, যখন ইউসুফের সাথে সাক্ষাতের পর তার ব্যবহৃত জামা নিয়ে ভাইদের কাফেলা কেন‘আনের উদ্দেশ্যে মিসর ত্যাগ করছিল। পিতা ইয়াকূব তখন বলেছিলেন, إِنِّي لَأَجِدُ رِيْحَ يُوْسُفَ ‘আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি’ (ইউসুফ ৯৪)। জবাবে লোকেরা বলেছিল, تَاللهِ إِنَّكَ لَفِيْ ضَلاَلِكَ الْقَدِيْمِ ‘আল্লাহর কসম! আপনি তো সেই পুরানো ভ্রান্তিতেই পড়ে আছেন’ (ইউসুফ ৯৫)।

এখানে ‘ভ্রান্তি’ (ضلل ) অর্থ ‘প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে না জানা’। যেমন শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, وَوَجَدَكَ ضَالاًّ فَهَدَى ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথহারা। অতঃপর তিনি পথ দেখিয়েছেন’ (আয-যোহা ৭)। অতএব গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল এই যে, এখানে ضلال বা ভ্রান্তি কথাটি আভিধানিক অর্থে এসেছে পারিভাষিক অর্থে নয়। কেননা পারিভাষিক অর্থে ضلال বা ভ্রষ্টতার অর্থ ضلال في الدين ‘ধর্মচ্যুত হওয়া’। নবীপুত্র হিসাবে ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতা নবী ইয়াকূবকে নিশ্চয়ই ধর্মচ্যুত কাফের বলেনি।

৪. আয়াত সংখ্যা ১৫ : (فَلَمَّا ذَهَبُوا بِهِ وَأَجْمَعُواْ أَن يَّجْعَلُوْهُ فِي غَيَابَةِ الْجُبِّ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِأَمْرِهِمْ هَـذَا وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ) ‘অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে যাত্রা করল এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হ’ল, তখন আমরা তাকে অহী (ইলহাম) করলাম যে, (এমন একটা দিন আসবে, যখন) অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কুকর্মের কথা অবহিত করবে। অথচ তারা তোমাকে চিনতে পারবে না’।

এখানে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন ‘যখন তারা তাকে নিয়ে যাত্রা করল’-এর لَمَّا অর্থাৎ ‘যখন’-এর জওয়াব নিয়ে। অর্থাৎ কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বে না পরে এই ইলহাম হয়েছিল। কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর ভাইয়েরা যখন রক্ত মাখা জামা নিয়ে পিতার নিকটে এসে কৈফিয়ত পেশ করে (ইউসুফ ১৭), তখন ইউসুফকে সান্ত্বনা দিয়ে এ ইলহাম করা হয়।

এক্ষেত্রে গৃহীত ব্যাখ্যা হ’ল: (وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ )-এর واو এসেছে (لَمَّا )-এর জওয়াব হিসাবে এবং তা বাক্যে صلة হয়েছে। ফলে ব্যাখ্যা দাঁড়াবে এই যে, কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই এ ইলহাম করা হয়েছিল। আর এটি বাস্তবায়িত হয়েছিল বহু বৎসর পরে যখন ইউসুফের সঙ্গে তার ভাইদের সাক্ষাৎ হয়। অথচ তারা তাঁকে চিনতে পারেনি (ইউসুফ ৫৮)। ইউসুফ তার ভাইদের সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি জানা আছে যা তোমরা করেছিলে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে? যখন তোমরা (পরিণাম সম্পর্কে) অজ্ঞ ছিলে’? ‘তারা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেন, আমিই ইউসুফ, আর এ হ’ল আমার (সহোদর) ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন... (ইউসুফ ৮৯-৯০)।

৫. আয়াত সংখ্যা ২৪ : (وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلاَ أَن رَّآ بُرْهَانَ رَبِّهِ) ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল। আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত..’।

এখানে প্রথম প্রশ্ন হ’লঃ ইউসুফ উক্ত মহিলার প্রতি কোনরূপ অন্যায় কল্পনা করেছিলেন কি-না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হ’ল, তিনি যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘প্রমাণ’ (برهان ) অবলোকন করেছিলেন সেটা কি?

প্রথম প্রশ্নের জওয়াব হ’ল দ্বিবিধ: (১) অনিচ্ছাকৃতভাবে কল্পনা এসে থাকতে পারে। যা বেগানা নারী-পুরুষের মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু বুদ্বুদের ন্যায় উবে যাওয়া চকিতের এই কল্পনা কোন পাপের কারণ নয়। কেননা তিনি নিজেকে সংযত রেখেছিলেন এবং ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ নবী হিসাবে যেটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সত্তাকে ভয় করে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখে’, ‘নিশ্চয়ই জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৪০-৪১)। মুনাফিকদের কুপরামর্শে ওহোদের যুদ্ধ থেকে বনু হারেছাহ ও বনু সালামাহ পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পালায়নি। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, إِذْ هَمَّتْ طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَن تَفْشَلاَ وَالله ُوَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যখন তোমাদের দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ তাদের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরেই বিশ্বাসীদের ভরসা করা উচিত’ (আলে ইমরান ১২২)।

এখানে একই هَمَّتْ (কল্পনা করছিল) ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবং নিজেকে তাদের অভিভাবক বলে বরং তাদের প্রশংসা করেছেন। উল্লেখ্য যে, هَمٌّ বা কল্পনা দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক- هم ثابت বা দৃঢ় কল্পনা, যা আযীয-পত্নী করেছিল ইউসুফের প্রতি। দুই- هم عارض অনিচ্ছাকৃত কল্পনা, যাতে কোন দৃঢ় সংকল্প থাকে না। ইউসুফের মধ্যে যদি এটা এসে থাকে বলে মনে করা হয়, তবে তাতে তিনি দোষী হবেন না। কেননা তিনি ঐ কল্পনার কথা মুখে বলেননি বা কাজে করেননি। বরং তার বিরুদ্ধে বলেছেন ও করেছেন।

দ্বিতীয় জওয়াব হ’ল এই যে, ইউসুফের মনে আদৌ কোন অন্যায় কল্পনা আসেনি। প্রমাণ মওজুদ থাকার কারণে এটা তাঁর চরিত্রে নিষিদ্ধ ছিল। মুফাসসির আবু হাইয়ান স্বীয় তাফসীর ‘বাহরুল মুহীত্বে’ একথা বলেন। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় আয়াতটির বর্ণনা হবে, لولا أن رَّآ برهان ربه لهمَّ بها ‘যদি তিনি তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখতেন, তাহ’লে তার (অর্থাৎ উক্ত মহিলার) ব্যাপারে কল্পনা করতেন’। আলোচ্য আয়াতে لولا (যদি) শর্তের জওয়াব আগেই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَن رَّآ بُرْهَانَ رَبِّهِ ‘আর সেও তার প্রতি কল্পনা করত, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত’। আর সেই ‘বুরহান’ বা প্রমাণ ছিল আল্লাহ নির্ধারিত ‘নফসে লাউয়ামাহ’ অর্থাৎ শাণিত বিবেক, যা তাকে কঠোরভাবে বাধা দিয়েছিল।

আরবী সাহিত্যে ও কুরআনে এ ধরনের বাক্যের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন জান্নাতীগণ বলবেন, وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلاَ أَنْ هَدَانَا اللهُ ‘আমরা কখনো সুপথ পেতাম না, যদি না আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন করতেন’ (আ‘রাফ ৪৩)। অর্থাৎ لولا أن هدانا اللهُ ما كنا لِنهتديَ ‘যদি আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করতেন, তাহ’লে আমরা হেদায়াত পেতাম না’।

[38]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/১৮৬।


ইউসুফ (আঃ) এর সুন্দরতম জীবন কাহিনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url