ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা-৫ || জীবনের স্বাভাবিক ধারণা || বিভিন্নধর্ম ও মতাদর্শের ধারণা || ইসলামী ধারণার বৈশিষ্ট্য ||






জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের ধারণা এবং ইসলামী ধারণার বৈশিষ্ট্য



ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা, ৫ম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ
  • জীবনের স্বাভাবিক ধারণা
  • বিভিন্নধর্ম ও মতাদর্শের ধারণা
  • ইসলামী ধারণার বৈশিষ্ট্য


জীবনের স্বাভাবিক ধারণা


জীবনের স্বাভাবিক ধারণা দুনিয়া এবং দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে অন্যান্য ধর্মগুলো যে ধারণা পেশ করেছে কিছুক্ষণের জন্যে তা আপনার মন থেকে দূর করে দিন। অতপর একজন সূক্ষ্মদর্শী হিসেবে আপনি চারপাশের দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই গোটা পরিবেশে আপনার মর্যাদা কি, তা অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করুন। এই পর্যবেক্ষনের ফলে কয়েকটি জিনিস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আপনার চোখে পড়বে।

আপনি দেখতে পাবেন যে, যতগুলো শক্তি আপনি লাভ করেছেন তার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। যে ইন্দ্রিয় শক্তির ওপর আপনার জ্ঞান নির্ভরশীল, আপনার নিকটতম পরিবেশের সীমা অতিক্রম করতে পারে না। যে অংগ-প্রত্যঙ্গের ওপর আপনার গোটা কর্মকান্ড নির্ভরশীল তা মাত্র কতিপয় দ্রব্যকেই তা আয়ত্তাধীন রাখতে পারে। আপনার চারদিকের বেশুমার জিনিস আপনার দেহ এবং শক্তির তুলনায় অনেক বড়ো এবং এসবের মুকাবেলায় আপনার ব্যক্তি সত্তাকে অত্যান্ত তুচ্ছ ও কমজোর বলে মনে হয়। দুনিয়ার এই বিরাট কারখানায় যে প্রচন্ড শক্তিগুলো ক্রিয়াশীল রয়েছে, তার কোনটাই আপনার আয়ত্তাধীন নয়, বরং ঐ শক্তিগুলোর মুকাবেলায় নিজকে অত্যন্ত অসহায় মনে করেন। দৈহিক দিক থেকে আপনি একটি মধ্যম শ্রেণীর প্রানী। নিজের চেয়ে ছোট জিনিসের ওপর আপনি বিজয়ী, কিন্তু নিজের চেয়ে বড়ো জিনিসের নিকট আপনি পরাজিত।

কিন্তু আপনার ভেতরকার আর এক শক্তি আপনাকে ঐ সমস্ত জিনিসের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। সেই শক্তির বদৌলতেই আপনি সম জাতীয় সমস্ত প্রাণীর ওপর আধিপত্য বিস্তর করেন এবং আপনার চেয়ে তাদের দৈহিক শক্তি অনেক বেশী হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে কর্তৃত্বাধীন করে নেন। সেই শক্তির দরুনই আপনি আপনার চারপাশের বস্তুগুলোকে ভোগ-ব্যবহার করে থাকেন এবং ঐগুলো থেকে আপন মর্জী মাফিক সেবা গ্রহণ করেন। সেই শক্তির বদৌলতেই আপনি শক্তির নব নব উৎসের সন্ধান পান এবং সেগুলোকে বের করে নিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতিতে ব্যবহার করেন। সেই শক্তির দরুনই আপনি জ্ঞান অর্জনের উপায়-উপাদান সমূহ বৃদ্ধি করেন এবং যে সকল বস্তু আপনার স্বাভাবিক শক্তির আওতা বহির্ভূত সেগুলো পর্যন্ত উপনীত হন। মোটকথা, ঐ বিশেষ শক্তিটির বদৌলতে দুনিয়ার সকল বস্তুই আপনার খাদেমে পরিণত হয় এবং আপনি তাদের খেদমত গ্রহণকারীর সৌভাগ্য অর্জন করেন।

আবার বিশ্ব কারখানার যে সকল উচ্চতর শক্তি আপনার আয়ত্তাধীন নয়, সেগুলোও এমনি ধারায় কাজ করে চলছে যে, সাধারণভাবে সেগুলোকে আপনার শত্রু বা বিরোধী বলা চলে না, বরং তারা আপনার মদদগার এবং আপনার কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধার অনুকূল। হাওয়া, পানি, আলো, উত্তাপ এবং এই ধরনের আর যেসব শক্তির ওপর আপনার জীবন নির্ভরশীল তার সবগুলোই এমন একটি বিশেষ নিয়মের অধীন কাজ করে যাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার সাহায্য করা। এই হিসেবে আপনি বলতে পারেন যে, উল্লেখিত বস্তু-গুলো আপনার অনুগত।

এই গোটা পরিবেশের ওপর আপনি যখন গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করেন তখন এক মহাশক্তিশালী বিধানকে আনি ক্রিয়াশীল দেখতে পান। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু থেকে শুরু করে বৃহৎ হতে বৃহত্তর সকল বস্তুই এই শক্তিধর বিধানের অক্টোপাশে সমানভাবে আবদ্ধ। এরপরও তার শৃংখলা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর সমগ্র আলমের স্থিতি একান্তভাবেই নির্ভরশীল। আপনি নিজেও সেই বিধানের অধীন। কিন্তু আপনি এবং দুনিয়ার অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য বস্তুগুলো ঐ বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করার অণু পরিমাণও ক্ষমতা নেই। কিন্তু তার বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং আপনি যখন তার বিরুদ্ধাচরণ করতে চান, তখন এ কাজে সে আপনার সাহায্যও করে থাকে। অবশ্য এমন প্রতিটি সঙ্গে সঙ্গে কিচুটা প্রতিক্রিয়া রেখে যায় এবং সে বিরুদ্ধাচরণের পর তার মন্দ পরিণতি থেকে আপনিও বাঁচতে পারেন না।

এই বিশ্বব্যাপী ও অপরিবর্তনীয় বিধানের অধীনে সৃষ্টি ও ধ্বংসের বিভিন্ন দৃশ্য আপনারা দেখতে পান। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ভাঙা ও গড়ার এক অসমাপ্য ধারা অব্যাহত রয়েছে। যে বিধান অনুযায়ী একটি জিনিস পয়দা ও প্রতিপালন করা হয়, সেই বিধান অনুসারেই তাকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্নও করে দেয়া হয়। দুনিয়ার কোন বস্তুই সেই বিধানের বাঁধন থেকে মুক্ত নয়। দৃশ্যত যে বস্তুগুলোকে এ থেকে মুক্ত বলে মনে হয় এবং যেগুলোকে অচল-অনড় বলে সন্দেহ হয়, সেগুলোকেও গভীরভাবে নিরীক্ষা করলে বোঝা যায় যে, তাদের মধ্যেও আবর্তন ও পরিবর্তনের ক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের কবল থেকে তাদেরও নিস্তার নেই। যেহেতু বিশ্বপ্রকৃতির অন্যান্য বস্তু চেতনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন নয় অথবা নূ্ন্যকল্পে এ সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এ জন্যেই আমরা তাদের ভেতরে এই সৃষ্টি ও ধ্বংসের ফলে কোন আনন্দ বা বিষাদের লক্ষণ অনুভব করি না। কিন্তু মানুষ এক চেতনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন প্রাণী বিধায় তার চারপাশের এই পরিবর্তনগুলো দেখে সে আনন্দ ও বিষাদের এক তীব্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করে। কখনো অনুকূল বিষয়ের প্রকাশ দেখে এতো তীব্র আনন্দানুভব করে যে, এ দুনিয়ায় যে ধ্বংসেরও সম্ভাবনা রয়েছে, একথাটাই সে ভুলে যায়। আবার কখনো প্রতিকূল বিষয় দেখে তার বিষাদ এতোটা তীব্র হয়ে ওঠে যে, এ দুনিয়ায় শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসই সে দেখতে পায় এবং এখনো যে সৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে সে সত্যটা সে ভুলে যায়।

কিন্তু আপনার ভেতর আনন্দ ও বিষাদের যতো পরস্পর বিপরীত অনুভূতিই থাকুক না কোন এবং তার প্রভাবে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে আপনি যতোই কড়াকড়ি বা বাড়াবাড়ির দৃষ্টিভংগি গ্রহণ করুন না কেন, এই দুনিয়াকে কার্যত ভোগ-ব্যবহার করতে এবং আপনার ভেতরকার শক্তিনিচয়কে কাজে লাগাতে আপনি নিজস্ব প্রকৃতির কারণেই বাধ্য। আপনার প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার আকাংখা রয়েছে এবং এ আকাংখাকে চরিতার্থ করার জন্যে আপনার ভেতর ক্ষুদা নামক এক প্রচন্ড শক্তি দেয়া হয়েছে য আপনাকে হামেশা কাজের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করছে। প্রকৃতি আপনাকে আপনার বংশধারা বাঁচিয়ে রাখার কাজে নিয়োজিত করতে ইচ্চুক; এই জন্যে সে যৌনচেতনা নামক এক অদম্য শক্তি আপনার ভেতর সঞ্চার করেছে, যা আপনার দ্বারা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে অনুপ্রণিত করে। এমনিভাবে আপনার স্বভাব-প্রকৃতিতে অন্যান্য উদ্দেশ্য আরো কতিপয় শক্তির সমাবেশ করা হয়েছে এবং তার প্রতিটি শক্তিই আপনার দ্বারা নিজ নিজ অভীষ্ট পূর্ণ করে নেয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতির এই বিভিন্নমুখী উদ্দেশ্য আপনি উৎকৃষ্টভাবে আঞ্জাম দেবেন কি নিকৃষ্টভাবে, সানন্দচিত্তে নিষ্পন্ন করবেন কি জোর-জবরদস্তির চাপে তা সম্পূর্ণত আপনার জ্ঞান-বুদ্ধির ওপরই নির্ভর করে। শুধু তাই নয় খোদ প্রকৃতি আপনার ভেতর ঐ উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করার কাজ আঞ্জাম দেয়া বা না দেয়ার এক বিশেষ ক্ষমতা পর্যন্ত প্রদান করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রকৃতি এই বিধানও করে দিয়েছে যে, সানন্দচিত্তে ও ভালোভাবে তার উদ্দেশ্য পূরণ করা আপনার জন্যেই কল্যানকর এবং তা পূরণ করতে পরান্মুখ হওয়া কিংবা পূর্ণ করলেও নিকৃষ্টভাবে করা খোদ আপনার পক্ষেই ক্ষতিকর।

বিভিন্নধর্ম ও মতাদর্শের ধারণা

একজন সুষ্ঠ প্রকৃতি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এবং এই দুনিয়ার প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে ওপরে বর্ণিত প্রতিটি বিষয়ই তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু মানব জাতির বিভিন্ন দল এই গোটা দৃশ্যটিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখেছেন এবং প্রায়শ এমনি ব্যাপার ঘটেছে যে, যাদের চোখে যে দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই তার পার্থিব জীবন সম্পর্কে একটি মতবাদ গড়ে নিয়েছেন এবং অন্যান্য দিকগুলো প্রতি দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি।

দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, একটি দল মানুষের দুর্বলতা ও অসহায়তা এবং তার মুকাবেলায় প্রকৃতির বড়ো শক্তিগুলো প্রভাব ও পরাক্রম দেখে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, দুনিয়ায় মানুষ নিতান্তই একটি তুচ্ছ জিনিস আর দুনিয়ার এই মংগলকারী ও ক্ষতিকারক শক্তিগুলো কোন বিশ্বব্যাপী বিধানের অধীন নয় বরং এরা স্বাধীন কিংবা আধা স্বাধীন। এই চিন্তাধারা তাদের মনের ওপর এতখানি প্রাধান্য বিস্তার করেছে, তাদের দৃষ্টিপাত থেকেই তা অপসৃত হয়ে গেছে। তারা আপন অস্তিত্বের উজ্জ্ব দিকটি ভুলে গেলেন এবং নিজেদের কমজোরী ও অক্ষমতার আতিশষ্যপ্রসূত স্বীকৃতির দ্বারা তাদের সম্মান ও সম্ভ্রমের অনুভূতিকে বিসর্জন দিলেন। মূর্তি পূজা, বৃক্ষ পূজা, নক্ষত্র পূজা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা এই মতবাদেরই প্রত্যক্ষ ফল।

আর একটি দল দেখতে পেলেন যে, দুনিয়ায় শুধু বিপর্যয়েরই লীলাভূমি। সমস্ত বিশ্ব সংসার চালিত হচ্ছে শুধু মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর নিগ্রহ ভোগের জন্যে। দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক সম্বন্ধই হচ্ছে মানুষকে অশান্তি আর বিপদের জালে জড়িত করার ফাঁদ বিশেষ। কেবল মানুষের কথাই বলি কেন, গোটা বিশ্বজাহানই এই বিষাদ ও ধ্বংসের কবলে আবদ্ধ। এখানে যা কিছু সৃষ্টি হয়, ধ্বংসের জন্যেই হয়। বসন্ত আসে এই জন্যে যে, শীত এসে তার শ্যামলিমা হরণ করে নিয়ে যাবে। জীবনের বৃক্ষ পল্লবে সুশোভিত হয় এই জন্যে যে, মৃত্যুরূপ শয়তান এস তার মজা লুণ্ঠন করবে। স্থিতির সৌন্দর্য এতো পরিপাট্য নিয়ে আসে এই জন্যে যে, ধ্বংসের দেবতা তার সঙ্গে খেলা করার বেশ সুযোগ পাবে। এই মতবাদ ঐ লোকগুলোর জন্যে দুনিয়া এবং তার জীবনে কোন আকর্ষণই অবশিষ্ঠ রাখেনি। তারা সংসার ত্যাগ, আত্মপীড়ন ও কৃচ্ছ্রসাধনা করে নিজেদের ভেতরকার সমস্ত অনুভূতিকে বিলুপ্ত করা এবং প্রকৃতির বিধান শুধু নিজের কারখানা চালিত করার জন্যে মানুষকে উপকরণে পরিণত করেছে সে বিধানটিকে ছিন্ন করার মধ্যেই তারা মুক্তির পথ দেখতে পেয়েছে।

অন্য একটি দল দেখলো, দুনিয়ায় মানুষের জন্যে আনন্দ ও বিলাসের প্রচুর উপকরণ রয়েছে এবং মানুষ এক স্বল্প সময়ের জন্যে এর রসাস্বাদনের সুযোগ পেয়েছে। দুঃখ ও বিষাদের অনুভূতি এই রস্বাসাদনকে বিস্বাদ করে দেয় সুতরাং মানুষ ঐ অনুভূতিটাকে বিলুপ্ত করে দিলে এবং কোন জিনিসকেই নিজের জন্যে দুঃখ ও বিষাদের কারণ হতে না দিলে এখানে শুধু আনন্দ আর ফুর্তিই দেখা যাবে। মানুষের জন্যে যা কিছু রয়েছে এই দুনিয়াতেই রয়েছে; তার যা কিচু মজা লটার এই পার্থিব জীবনেই লুটতে হবে। মৃত্যুর পর না মানুষ থাকবে আর না থাকবে দুনিয়া বা তার আনন্দ-ফূর্তি, সবকিছুই যাবে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে।

এর বিপরীত আরেকটি দল এমন রয়েছে, যারা দুনিয়ার আনন্দ-স্ফূর্তি এমন কি গোটা দুনিয়াবী জিন্দেগীকেই সম্পূর্ণ গুনাহ বলে মনে করে। তাদের মতে মfনবীয় আত্মার জন্যে দুনিয়ার বস্তুগত উপকরণগুলো হচ্ছে এক প্রকার নাপাকী-অশুচিতার শামিল। এই দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করা, এর কায়-কারবারে অংশগ্রহণ করা এবং এর আনন্দ স্ফূর্তির রসাস্বাদন করার ভেতরে মানুষের জন্যে কোন পবিত্রতা বা কল্যাণ নেই। যে ব্যক্তি আসমানী রাজত্বের দ্বারা সৌভাগ্যবান হতে চায়, দুনিয়া থেকে তার দূরে থাকাই উচিত। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার দৌলত ও হুকুমাত এবং পার্থিব জীবনের রসাস্বাদন করতে চায়, তার নিশ্চিত জেনে রাখা উচিত যে, আসমানী রাজত্বে তার জন্যে কোন স্থান নেই। এ দলটি এ-ও অনুভব করেছে যে, মানুষ তার নিজস্ব স্বভাব-প্রকৃতির তাগিদেই দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করতে এবং তার কায়-কারবারে লিপ্ত হতে বাধ্য; আসমানী রাজত্বে প্রবেশ করার কল্পনা যতোই চিত্তাকর্ষক হোক না কেন, তা এতখানি শক্তিশালী কিছুতেই হতে পারে না যে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ তার প্রকৃতির মুকাবেলা করতে পারে। তাই আসমানী রাজত্ব অবধি পৌঁছার জন্যে তারা একটি সংক্ষিপ্ত পথ আবিষ্কার করে নিয়েছে, আর তাহলো এই যে, এক বিশেষ সত্তার প্রতি যারা ঈমান আনবে, তাঁর প্রায়শ্চিত্তই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবে।

অপর একটি দল প্রাকৃতিক আইনের ব্যাপকতা দেখে মানুষকে নিছক এক অক্ষম ও দুর্বল সত্তা বলে মনে করে নিয়েছে। তারা দেখেছে যে, মানুষ যে আদৌ কোন স্বাধীন ও অনন্যপর সত্তা নয়, মনস্তত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব এবং উত্তরাধিকার আইনের সাক্ষ্য এই সত্যকেই প্রতিপন্ন করেছে। প্রকৃতিক আইন তাকে আষ্টপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এ আইনের বিরুদ্ধে সে না কিছু ভাবতে পারে, না পারে কোন জিনিসের ইচ্ছা পোষণ করতে, আর না সে কোন কাজ করার ক্ষমতা। সুতরাং তার ওপর তার কোন কাজের দায়িত্ব আরোপিত হয় না।

এর সম্পূর্ণ বিপরীত আর একটি দলের মতে মানুষ শুধু এক ইচ্ছা শক্তিসম্পন্ন সত্তাই নয়, বরং সে কোন উচ্চতর ইচ্ছাশক্তির অধীন বা অনুগতও নয়, আর না সে আপন কৃতকর্মের জন্যে নিজের বিবেক বা মানবীয় রাজ্যের আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারোর সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য। সে হচ্ছে এই দুনিয়ার মালিক। দুনিয়ায় সমস্ত জিনিস তারই অধীন। তার ইখতিয়ার রয়েছে এগুলোকে স্বাধীনভাবে ভোগ-ব্যবহার করার। নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার এবং নিজের আমল ও আচরণে এক সুষ্ঠ নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে সে নিজেই বিধি-নিষেধ আরোপ করে নিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক দিক দিয়ে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এ ব্যাপারে কোন উচ্চতর সত্তার সামনে জাবাবদিহি করার ধারণাও সম্পূর্ণ অবান্তর।

এই হচ্ছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের বিভিন্ন রূপ ধারণা। এর বেশীর ভাগ ধারণার ভিত্তিতেই বিভিন্ন রূপ সংস্কৃতির ইমারত গড়ে উঠেছে। বস্তুর বিভিন্ন সংস্কৃতির ইমারতে যে বিভিন্ন ধরন ও প্রকৃতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাদের এক বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্ররূপ গ্রহণের প্রকৃত কারণ এই যে, তাদের মূলে রয়েছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ ধারণা। এই ধারণাই এই বিশিষ্ট রূপ গ্রহণের দাবী জানিয়ে থাকে। আমরা যদি এর প্রত্যেকটি বিস্তৃতভাবে পর্যালোচনা করে কিভাবে এটা এক বিশেষ ধরনের সংস্কৃতির জন্ম দিল তা অনুসন্ধান করি, তবে তা হবে নিসন্দেহে এক মনোজ্ঞ আলোচনা। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে এরূপ আলোচনার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ আমরা চাই শুধু ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টরূপে তুলে ধরা।আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, জীবন সম্পর্কে যতগুলো ধারণা ইতিপূর্বে বিবৃত হয়েছে, তার সবই দুনিয়াকে এক একটি বিশেষ দিক থেকে দেখার ফলমাত্র। এর কোন এটি মতবাদ ও সামগ্রিকভাবে সমস্ত বিশ্বজাহানের ওপর পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে এবং এই দুনিয়ায় সবকিছুর মধ্যে সঠিক মর্যাদা নিরূপণ করার পর গড়ে উঠেনি। এ কারণেই আমরা যখন কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ বর্জন করে অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দুনিয়াকে নিরীক্ষন করি, তখণ প্রথমোক্ত দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মতবাদটি বাতিল ও ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। আর দুনিয়ার প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে তো সকল মতবাদের ভ্রান্তিই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইসলামী ধারণার বৈশিষ্ট্য

এখন অতি সুন্দরভাবে উপলদ্ধি করা যেতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মতবাদের মধ্যে ইসলামী মতবাদই হচ্ছে প্রকৃতি ও বাস্তব সত্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল। একমাত্র এই মতবাদেই দুনিয়া এবং মানুষের মধ্যে এক নির্ভুল সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। এর ভেতরেই আমরা দেখতে পাইঃ দুনিয়া কোন ঘৃণ্য বা বর্জনীয় জিনিস নয়, অথবা মানুষ এর প্রতি আসক্ত হবে এবং এর আনন্দ উপকরণের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, এ এমন কোন জিনিসও নয়। এখানে না পুরোপুরি গঠন ক্রিয়া চলছে, আর না চলছে এক তরফা বিপর্যয়। একে পরিহার করা যেমন সংগত নয়, তেমনি এর ভেতরে পুরোপুরি ডুবে থাকাও সমীচীন নয়। না সে পুরোপুরি পংকিল ও অপবিত্র, আর না তার সবটাই পবিত্র ও পংকিলতা মুক্ত। এই দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক আপন রাজত্বের সাথে কোন বাদশাহর সম্পর্কের মতোও নয়। কিংবা জেলখানার সাথে কয়েদীর যে সম্পর্ক সেরূপ সম্পর্ক সেরূপ সম্পর্কও নয়। মানুষ এতটা তুচ্ছ নয় যে, দুনিয়ার যে কোন শক্তিই তার সেজদার উপযোগী হবে অথবা সে এতখানি শক্তিধর ও ক্ষমতাবানও নয় যে দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসের কাছ থেকেই সে সেজদা লাভ করবে। না সে এতটা অক্ষম ও অসহায় যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা- অভিপ্রায়ের কোন মূল্যই নেই, আর না সে এতখানি শক্তিমান যে, তার ইচ্ছা প্রবৃত্তিই সবকিছুর উর্ধে। সে যেমন বিশ্বপ্রকৃতির একচ্ছত্র সম্রাট নয়, তেমনি কোটি কোটি মনিবের অসহায় গোলামও নয়। এই চরম প্রান্তগুলোরই মধ্যবর্তী এক অবস্থায় তার প্রকৃত স্থান।

এ পর্যন্ত তো প্রকৃতি ও সুষ্ঠ বিবেক আমাদের পথনির্দেশ করে। কিন্তু ইসলাম আরো সামনে এগিয়ে মানুষের যথার্থ মর্যাদা কি তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করে দেয়। সে বলে দেয়ঃ মানুষ এবং দুনিয়ার মধ্যে কি ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান? মানুষ দুনিয়াকে ভোগ ব্যবহার করবে কি ভেবে? সে এই বলে মানুষের চোখ খুলে দেয় যে, তুমি অন্যান্য সৃষ্টির মত নও। বরং তুমি দুনিয়ায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি (Viceroy)। দুনিয়া ও তার শক্তিগুলোকে তোমারই অধীন করে দেয়া হয়েছে। তুমি সবার শাসক, কিন্তু একজনের শাসিত; সকলের প্রতি আজ্ঞাকারী, শুধু একজনের আজ্ঞানুবর্তী। সমগ্র সৃষ্টির ওপরে তোমার সম্মান, কিন্তু যিনি তোমায় প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে দুনিয়ায় এ সম্মান দান করেছেন, তুমি যখন তার অধীন ও আজ্ঞানুবর্তী হবে এবং তাঁর দেয়া বিধি-বিধানের আনুগত্য করে চলবে কেবল তখনি তুমি এ সম্মানের অধিকারী হতে পারো। দুনিয়ায় তোমায় পাঠানো হয়েছে এই জন্যে যে, তুমি তাকে ভোগ-ব্যবহার করবে। তারপর এই দুনিয়ার জীবনে তুমি ভালো-মন্দ বা শুদ্ধ-অশুদ্ধ যা কিছুই কাজ করো না কেন, তার ভিত্তিতেই তুমি পরকালীন জীবনে ভাল বা মন্দ দেখতে পাবে। সুতরাং দুনিয়ায় এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে তোমার ভেতরে হামেশা ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত থাকা উচিত এবং যে বস্তুগুলোকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তোমার কাছে আমানত রেখেছেন, তার প্রতিটি জিনিস সম্পর্কেই পুংখানুপুংখ হিসেব গ্রহণ করা হবে- একথাটি মুহূর্তের তরেও বিস্মৃত না হওয়া উচিত।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই ধারণাটি বিস্তৃত ও পুংখানুপংখরূপে প্রত্যেক মুসলমানের মনে জাগরুক নেই। এমন কি, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশ ছাড়া আর কেউ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাও পোষণ করে না। কিন্তু এই ধারণাটি যেহেতু ইসলামী সংস্কৃতির মর্মমূলে নিহিত রয়েছে, এ জন্যেই মুসলমানের চরিত্র তার প্রকৃত মর্যাদা ও যথার্থ বৈশিষ্ঠ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেলেও আজো তারা তার প্রভাব থেকে একেবারে মুক্ত হয়নি। যে মুসলমান ইসলামী সংস্কৃতির আওতায় প্রতিপালিত হয়েছে, তার আচরণ ও কাজ-কর্ম বাইরের প্রভাবে যত নিকৃষ্ট হয়ে থাক না কেন, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান বোধ, আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত না করা, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করা, আল্লাহ ভিন্ন আর কাউকে মালিক ও মনিব না ভাবা, দুনিয়ায় নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বশীল মনে করা, দুনিয়াকে কাজের ক্ষেত্র এবং পরকালকে প্রতিফলের ক্ষেত্র বলে বিশ্বাস করা, নিছক ব্যক্তিগত আমলের উৎকর্ষ-অপকর্ষের ওপর পরকালীন সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভরশীল বলে ধারণা পোষণ করা, দুনিয়া এবং তার দউলত ও ভোগ উপকরণকে অস্থায়ী ও শুধু ব্যক্তিগত আমল ও তার ফলাফলকে চিরস্থায়ী মনে করা-এই জিনিসগুলো তার প্রতিটি ধমনীতে অনুপ্রবিষ্ট হবেই। আর একজন সূক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি তার কথাবার্তা ও কর্মতৎপরতার ভেতর তার আত্মা ও হৃদয়ের গভীরে বদ্ধমূল ঐ আকিদা ও বিশ্বাসের প্রভাব (তা যতোই ক্ষীণ হোক না কেন) অনুভব করবেই।

ইসলামী সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে কোন ব্যক্তি এ সত্যটি স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারবে যে, এর ভেতরে যতদিন পূর্ণাঙ্গ অর্থে সত্যিকার ইসলাম বর্তমান ছিলো, ততদিন এ একটি নির্ভেজাল বাস্তব সংস্কৃতি ছিলো। এর অনুবর্তীদের কাছে দুনিয়া ছিল আখেরাতেরই ক্ষেত্রস্বরূপ। তারা দুনিয়াবী জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে এই ক্ষেত্রটির চাষাবাদ, বীজ বপন ইত্যাদি কাজে ব্যয় করারই চেষ্টা করতো, যাতে করে পরকালীন জীবনে বেশী পরিমাণে ফসল পাওয়া যেতে পারে। তারা বৈরাগ্যবাদ ও ভোগবাদের মধ্যবর্তী এমন এক সুষম ভারসান্যপূর্ণ অবস্থায় দুনিয়াকে ভোগ-ব্যবহার করতো, অন্য কোন সংস্কৃতিতে যার নাম-নিশানা পর্‍যন্ত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। আল্লাহর খেলাফতের ধারণা তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে পুরোপুরি লিপ্ত হতে এবং তার কায়-কারবারকে পূর্ণ তৎপরতার সাথে আঞ্জাম দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করতো এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ববোধ এবং জবাবদিহির অনুভূতি তাদেরকে কখনো সীমা অতিক্রম করতে দিত না। তাঁরা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে খুবই আত্ম-মর্‍যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলেন। আবার এই ধারণাই তাদেরকে দাম্ভিক ও অহংকারী হতে বিরত রাখতো। তাঁরা সুষ্ঠুভাবে খেলাফতের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রতিটি পার্থিব জিনিসের প্রতিই অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে যে সকল জিনিস দুনিয়ার ভোগাড়ম্বরে আচ্ছন্ন করে মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে ভুলিয়ে রাখে তার প্রতি তাদের কোনই আসক্তি ছিল না। মোটকথা, দুনিয়ার কায়-কারবার তাঁরা এভাবে সম্পাদন করতো, যেন এখানে তাঁরা চিরদিন থাকবেন না, আবার এর ভোগাড়ম্বরে মশগুল হওয়া থেকে এই ভেবে বিরত থাকতেন, যেন এ দুনিয়া তাদের জন্য এক পান্থশালা, সাময়িক কিছুদিনের জন্যেই তাঁরা এখানে বসতিস্থাপন করেছেন মাত্র।

পরবর্তীকালে ইসলামের প্রভাব হ্রাস এবং অন্যান্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় মুসলমানদের চরিত্রে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বৈশিষ্ট্য আর বাকী থাকল না। এর ফলে তারা পার্থিব জীবন সম্পর্কে ইসলামী ধারণার যা কিছু বিপরীত তার সব কাজই করলো। তারা বিলাশ-ব্যসনে লিপ্ত হলো। বিশাল ইমারত নির্মাণ করলো। সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্‍য এবং চারুকলার প্রতি আকৃষ্ট হলো। সামাজিকতা ও আচার-পদ্ধতিতে ইসলামী রুচির সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যয়-বাহুল্য ও আড়ম্বরে তারা অভ্যস্ত হলো। রাষ্ট্র শাসন ও রাজনীতি এবং অন্যান্য বৈষয়িক ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অনৈসলামী পন্থা অনুসরণ করলো। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও তাদের হৃদয়ে দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে যে ইসলামী ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ছিলো, কোথাও না কোথাও তার স্পষ্ট প্রভাব প্রতিভাত হতো। আর এ প্রভাবই অন্যান্যদের মোকাবিলায় তাদের এক বিশেষ মর্যাদা দান করতো। জনৈক মুসলমান বাদশাহ যমুনার তীরে এক বিশাল ইমারত নির্মাণ করেন এবং তার ভেতর আমোদ প্রমোদ ও জাক-জমকের এমন সব আয়োজনই করেন, যা তখনকার দিনে ছিলো অচিন্তনীয়। কিন্তু সেই ইমারতের সবচেয়ে আনন্দদায়ক প্রমোদ কেন্দ্রটির পিছন দিকে (অর্থাৎ কেবলার দিকে) এই কবিতাটি খোদাই করা হয়ঃ

“তোমার পায়ে বন্ধন, তোমার দিল তালাবদ্ধ,
চক্ষুযুগল অগ্নিদগ্ধ আর পদযুগল কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত;
ইচ্ছা তোমার পাশ্চিমে সফর করার
অথচ চলেছ পূর্বমুখী হয়ে,
পশ্চাতে মঞ্জিল রেখে কে তুমি চলেছো
এখনো সতর্ক হও।”

সে প্রাসাদটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে অতুলনীয় ছিল না। তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাসাদ দুনিয়ার অন্যান্য জাতির মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু দুনিয়ার বুকে বেহেশত নির্মাণকারীদেরকে ‘পশ্চাতে মঞ্জিল রেখে কে তুমি চলেছো অনিশ্চিতের দিকে সতর্ক হও’ বলে সতর্ক করে দেয়, এমনি চিন্তাধারার নজির দুনিয়ার আর কোন জাতির মধ্যে পাওয়া যাবে না।১

কাইসার ও কিসরার ধরনের বাদশাহী পরিচালনাকারীগণও কোন শত্রুকে পরাজিত করে শক্তির অহমিকা প্রকাশ করার পরিবর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে সেজদায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছেন, ইসলামী ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। বড়ো বড়ো অত্যাচারী ও উদ্ধত শাসকরা ইসলামী শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করতে চাইলে কোন আল্লাহর বান্দাই তাদেরকে মুখের উপর শাসিয়ে দেন এবং তার ফলে তারা আল্লাহর ভয়ে কেঁপে ওঠেন। নিতান্ত দুষ্কৃতিকারী ও কদাচারী ব্যক্তিগণও কোন একটি মামুলি কথায় সচেতন হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনের রঙ বদলে যায়। পার্থিব ধন দৌলতের প্রতি মোহগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনে দুনিয়ার অস্থায়িত্ব এবং আখেরাতের জিজ্ঞাসাবাদের চিন্তা জাগলো আর অমনি তারা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সবকিছু বিলিবণ্টন করে দিয়ে এক মধ্যমপন্থী আদর্শ জীবন অবলম্বন করেছেন। মোটকথা, মুসলমানদের জীবনে যতো অনৈসলামী প্রভাবই বিস্তার লাভ করুক না কেন, তাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি দিকেই ইসলামী মতবাদের দীপ্তি কোন না কোন কোনরূপে আপনার দৃষ্টিগোচর হবেই। আর এটা দেখে আপনার মনে হবে, যেন অন্ধকারের মধ্যে সহসা আলোর প্রকাশ ঘটেছে।

১. এ হচ্ছে দিল্লীর লাল কেল্লার কথা।





*******************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url