মা’আরেফুল কোরআন-৪ || শানে নুযুল প্রসঙ্গ || সাত হরফ বা সাত ক্বেরাআত প্রসঙ্গ || সর্বজন স্বীকৃত সাত কারী ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

শানে নুযুল প্রসঙ্গ


কোরআনের আয়াতসমূহ দু' ধরনের। এক ধরনের আয়াত হচ্ছে যেগুলাে আল্লাহ তা'আলা নিজের তরফ থেকে কোন নির্দেশ বা উপদেশমূলক প্রসঙ্গ বর্ণনা উপলক্ষে নাযিল করেছেন, কোন বিশেষ ঘটনা কিংবা কারাে কোন প্রশ্নের জওয়াব প্রদান প্রভৃতির সাথে সংশ্নিষ্ট হয়ে সেগুলাে নাযিল হয়নি। অন্য এক ধরনের আয়াত রয়েছে, যেগুলাে বিশেষ কোন ঘটনা উপলক্ষে কিংবা কোন প্রশ্নের জওয়াবে নাযিল হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঘটনা কিংবা প্রশ্নগুলোকে সে সব আয়াতের পটভূমি হিসেবে গণ্য করা যায়। এসব আয়াতের পশ্চাৎবৰ্তী সে পটভূমিকেই তফসীরে পরিভাষায় শানে-নুযুল' বা সবে-নুযুল' বলা হয়।

দৃষ্টান্তস্বরূপ সূরা বাকারার নিদ্রোক্ত আয়াতটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। যেমন :

 وَلَا تَنكِحُواْ ٱلْمُشْرِكَٰتِ حَتَّىٰ يُؤْمِنَّ ۚ وَلَأَمَةٌ مُّؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِّن مُّشْرِكَةٍۢ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ

অর্থাৎ “মুশরিক নারীদের বিয়ে করাে না, যে পর্যন্ত তারা ঈমান না আনে। একজন মু'মিন বাদীও একটি মুশরিক নারী থেকে উত্তম, তোমাদের চোখে সে নারী যত আকর্ষণীয়ই মনে হোক না কেন।”

এ আয়াত একটা বিশেষ ঘটনার পটভূমিতে নাযিল হয়েছিল। ঘটনাটি হচ্ছে, হযরত মারসাল ইবনে আবি মারসন নামক এক সাহাবীর জাহেলিয়াত যুগে এক নাম্নী এক স্ত্রীলােকের সঙ্গে গভীর প্রণয় ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত মারসাদ (রা) হিজরত করে মদীনায় চলে যান, কিন্তু এনাক মক্কাতেই থেকে যায়। একবার কোন কাজ উপলক্ষে হযরত মারসাদ (রা) মক্কায় আগমন করলে এনাক তাকে পূর্ব আসক্তির ভিত্তিতে তার সাথে রাত কাটানাের আমন্ত্রণ জানায়। হযরত মারসাদ (রা) সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বললেন। ইসলাম তােমার সাথে আমার অবাধ মিলনের পথে প্রাচীর সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখন যদি তুমি। একান্তই আমার সাথে মিলিত হতে আকাকী হও, তবে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি নিয়ে তোমাকে বিবাহ করতে পারি।

মদীনায় ফিরে এসে হযরত মারিসাদ (রা) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকট উক্ত শ্রীলােককে বিবাহ করার অনুমতি প্রার্থনা করলে এ আয়াত নাযিল হয়, যাতে মুমিনদের পক্ষে মুশরিক নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। (আসবাবুন নুযুল, ওয়াহেদী, পৃ. ৩৮)

উপরিউক্ত ঘটনাটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আয়াতের শানে-নুযুল বা আসবাবে-নুযুল। তফসীরের ক্ষেত্রে শানে-নুযুল অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এমন অনেক আয়াত রয়েছে, যেগুলাে নাযিল হওয়ার পটভূমি বা শানে-নুযুল জানা না থাকলে সেগুলাের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য উদ্ধার করা দুষ্কর। 

সাত হরফ বা সাত ক্বেরাআত প্রসঙ্গ

উম্মতের সব শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই তেলাওয়াত সহজতর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের কিছুসংখ্যক শব্দ বিভিন্ন উচ্চারণে পাঠ করার সুযােগ প্রদান করেছেন। কেননা কোন কোন লােকের পক্ষে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্ষর বিশেষের উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় সে সমস্ত লােক যদি তাদের পক্ষে সহজপাঠ্য এমন কোন উচ্চারণে সে শব্দটি পাঠ করে, তবে সে উচ্চারণও তাদের পক্ষে শুদ্ধ হবে।

মুসলিম শরীফের এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, একদা রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম গিফার গােত্রের জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আ) এসে বললেন আল্লাহ তা'আলা আপনার প্রতি হুকুম পাঠিয়েছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করেন, যেন তাদের সকলে একই উচ্চারণে কোরআন তেলাওয়াত করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম জওয়াব দিলেনঃ আমি এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রার্থনা জানিয়ে বলছি যে, আমার উম্মতের পক্ষে তা সম্ভব হবে না।

জওয়াব শুনে হযরত জিবরাঈল (আ) ফিরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন,  আল্লাহ তা'আলা আপনার প্রতি হুকুম প্রেরণ করেছেন, আপনি আপনার উম্মতকে এ মর্মে নির্দেশ দিন, যেন তারা অনধিক দুই উচ্চারণে কোরআন তেলাওয়াত করে। রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম জওয়াব দিলেন ? আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও অনুগ্রহের দরখাস্ত পেশ করে বলছি, আমার উম্মতের এতটুকু ক্ষমতাও নেই। তখন হযরত জিবরাঈল (আ) ফিরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর পুনরায় ফিরে এসে বললেন, আল্লাহ পাক আপনাকে হুকুম প্রেরণ করেছেন, আপনি উম্মতকে এ মর্মে আদেশ দিন যেন তারা সর্বাধিক তিন উচ্চারণে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লুাম বললেন, আমি আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করে বলছি, আমার উম্মতের এতটুকু ক্ষমতাও নেই। জিবরাঈল (আ) এবারও ফিরে গেলেন এবং চতুর্থবার ফিরে এসে বললেন । আল্লাহ পাক আপনার প্রতি হুকুম প্রেরণ করেছেন, আপনি আপনার উম্মতকে সাত উচ্চারণে কোরআন তেলাওয়াত করার নির্দেশ দিন। অনুমােদিত সে সাত উচ্চারণের মধ্যে যিনি যে উচ্চারণেই পাঠ করুন না কেন, তার তেলাওয়াতই শুদ্ধ বলে গ্রহণ করা হবে। (মনাহেলুল-ইরফান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৩)

এক হাদীসে রাসূলে মকবুল (সা) ইরশাদ করেনঃ

ان هذا القران أنزل على سبعة أحرف فاقرؤا ماتيسر منه

অর্থাৎ এই কোরআন সাত হরফে নাযিল করা হয়েছে। এর মধ্যে তােমাদের যার পক্ষে যেভাবে সহজ হয় সেভাবেই তেলাওয়াত কর। (বােখারী)।

রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ইরশাদ উল্লিখিত সাত হরফ'-এর অর্থ কি.. এ সম্পর্কে আলেমগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তত্ত্বদর্শী আলিমগণের নিকট এ সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহ পাক কোরআন শরীফ যে কেরাআতের সাথে নাযিল করেছেন, তার মধ্যে পারস্পরিক উচ্চারণ পার্থক্য সর্বাধিক সাত রকম হতে পারে। অনুমােদিত সে সাতটি ধরন নিম্নলিখিত ভিত্তিতে হওয়া সম্ভবঃ

(১) বিশেষ্যের উচ্চারণে তারতম্য। এতে এক বচন, দ্বি-বচন, পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ প্রভৃতির ক্ষেত্রে তারতম্য হতে পারে। যেমন এক ক্বেরাআতে وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ - এ আয়াতে ‘কালেমাতু’ শব্দটি এক বচনে এসেছে। কিন্তু অন্য কেরাআতে শব্দটি বহুবচনে উচ্চারিত হয়ে وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ পঠিত হয়েছে। 

(২) ক্রিয়াপদে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতকালের বিভিন্নতা অবলম্বিত হয়েছে।

(৩) রীতি অনুসারে এরাব চিহ্ন বা যের-যবর-পেশ ইত্যাদি প্রয়ােগের ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের কারণে কেরাআতে বিভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে।

(৪) কোন কোন কেরাআতে শব্দের কম-বেশিও হয়েছে।

(৫) কোন কোন কেরাআতে শব্দের আগ-পাছও হয়েছে।

(৬) শব্দের পার্থক্য হয়েছে। এক কেরাআতে এক শব্দ এবং অন্য কেরাআতে তদস্থলে অন্য শব্দ পঠিত হয়েছে। 

(৭) উচ্চারণ পার্থক্য, যেমন কোন কোন শব্দের উচ্চারণভঙ্গী লম্বা, খাটো, হালকা, কঠিন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে শব্দের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না, শুধু উচ্চারণে বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র।

মােটকথা, উচ্চারণের সুবিধার্থে সাত কেরাআতের মাধ্যমে তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে যেসব। পার্থক্য অনুমােদন করা হয়েছে সেগুলাের মধ্যে অর্থের কোন উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন হয় না। শুধুমাত্র বিভিন্ন এলাকা ও শ্রেণী-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত উচ্চারণ-ধারার প্রতি লক্ষ্য রেখেই সাত ধরনের উচ্চারণ-রীতির অনুমােদন করা হয়েছে।

প্রাথমিক অবস্থায় কোরআনের উচ্চারণ-পদ্ধতির ব্যাপারে সাধারণ মানুষের পক্ষে পরিপূর্ণরূপে ওয়াকেফহাল হওয়া সম্ভব ছিল না বলেই আয়াতের উচ্চারণভঙ্গীতে সুবিধামত পন্থা অবলম্বন করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম প্রতি রমযান মাসে হযরত জিবরাঈল (আ)-এর সাথে কোরআন শরীফের পারস্পরিক তেলাওয়াত করতেন। একজনে পড়তেন, অন্যজনে তা শুনতেন। এভাবে শুদ্ধতম কেরাআত-পদ্ধতিও সুনিশ্চিত হতাে। শেষ বিদায়ের বছর রমযানে এ তেলাওয়াতের দু'টি খতম সম্পন্ন হয়েছিল। এ খতমকেই কারীগণের পরিভাষায় 'শেষ-দাওর' বলা হয়। এ উপলক্ষে তেলাওয়াত-পদ্ধতির শুদ্ধতম পন্থাগুলাে বলে দিয়ে অন্য সকল পঠন পদ্ধতি বাতিল করে। দেওয়া হয়। তারপর থেকে শুধু ঐসব কেরাআতই অবশিষ্ট রাখা হয়েছে, যেগুলাে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য বর্ণনা পারায় রক্ষিত হয়ে আসছে।

তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভুল বােঝাবুঝি দূর করার উদ্দেশ্যে হযরত উসমান (রা) কোরআন শরীফের সাতখানা অনুলিপি তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি অনুলিপি এমনভাবে লেখা হয়েছিল যে, এতে অনুমােদিত সাতটি কেরাআতই পাঠ করা সম্ভব হতাে। তখনও পর্যন্ত আরবী লেখনপদ্ধতিতে যের-যুবর-পেশ প্রভুতি হরক-এর প্রচলন না থাকায় সাধারণ যের-যুবপেশ-এর পার্থক্য পাঠকপণ নিজেরাই নির্ণয় করে নিতে পারতেন। যেসব ক্ষেত্রে শব্দের বদল কিংবা অগ্রপশ্চাৎ অনুমােদিত রয়েছে, স্বতন্ত্র সাতটি নােসখতে সে পার্থক্যগুলোও পৃথক পৃথকভাবে লিখে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে উম্মতের আলােমকারী ও হাফেগণ কেরাতপদ্ধতিগুলাে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে এত শ্রম ও সাধনা নিয়ােগ করেছেন যে, অনুমােদিত কেরাআত-রীতির বাইরে কোথাও নােক্তর পার্থক্যও আর কোরআন পাকের পাঠ-রীতিতে অনুপ্রবেশ করতে সমর্থ হয়নি। সাধক আলেম-হাফেয-কারীগণের অগণিত লােক সে যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এ কেরাত পদ্ধতির সুর্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করে রেখেছেন।

হযরত উসমান (রা) তার লিপিবদ্ধকৃত সাত কেরাআতের অনুলিপি মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করার সময় সঙ্গে প্রতিটি কেরাআতের দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্বারীও প্রেরণ করতেন। সেসব কারী নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ পাণ্ডুলিপির অনুলিপির অনুরূপ পদ্ধতিতে কেরাআত শিক্ষা দান করতেন। এভাবেই বিভিন্ন এলাকার অধিবাসিগণ অনুমােদিত কেরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেফহাল হয়ে যান। এসব শিক্ষক সাহাবীর কাছ থেকে যারা শিক্ষা লাভ করেছিলেন, তাদের অনেকেই ইলমে-বেরাআত' চর্চা এবং অন্যকে শিক্ষা দীনের ব্যাপারে সমগ্র জীবন ওয়াকফ করে দেন। এভাবেই ইলমে-কেরাআত' একটা স্বতন্ত্র বিষয়রূপে গড়ে ওঠে। প্রতিটি এলাকা থেকেই কিছু লােক ইলমে কেরাআতে' অধিকতর বুৎপত্তি অর্জন করার উদ্দেশ্যে এ ইলমের ইমামগণের শরণাপন্ন হতে থাকেন। কেউ কেউ আবার দুই-তিন বা সাত কেরাআতেই ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কেরাআতের ক্ষেত্রে এ ধরনের আগ্রহ ও সাধনার ফলে ইলমে কেরাআতের বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতি এমন কি ধ্বনিবিদ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত কাওয়ায়েদ-এর সৃষ্টি হয়। সর্বসম্মত এসব কাওয়ায়েদ মুসলিম-জাহানের সকল জ্ঞানী কর্তৃক সমভাবে সমর্থিত ও অনুসত হতে থাকে।

কেরাআতের পার্থক্যের ক্ষেত্রে যে কয়টি মূলনীতি সর্বসম্মতভাবে অনুসৃত হয়ে আসছে, সংক্ষেপে সেগুলাে নিম্নরূপঃ

এক. হযরত উসমান (রা) কর্তৃক লিপিবদ্ধ লিখন পদ্ধতির সাথে প্রতিটি ক্বেরাআত সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

দুই. আরবী ভাষায় কাওয়ায়েদ বা ব্যাকরণের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে।

তিন. পদ্ধতিটি নির্ভরযােগ্য সনদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে বর্ণিত এবং এ বর্ণনা ইলমে কেরাআতের মশহুর আলেমগণের মধ্যে পরিচিত হতে হবে। 

কোন কেরাআতের মধ্যে যদি উপরিউক্ত তিনটি শর্তের যে কোন একটির অভাব দেখা যায়, তবে সে শব্দ, বাক্য বা পঠন পদ্ধতি কোরআন শরীফের অংশরূপে কোন অবস্থাতেই গণ্য হবে না।

কেরাআতের ব্যাপারে আলেমগণের এ অনন্য সাবধানতার ফলে বহু শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারীর কেরাআত সংরক্ষণ করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। এ সংরক্ষণ প্রচেষ্টার দ্বারাই বিশ্বস্ত বর্ণনাকারিগণের বর্ণনাসূত্রের মাধ্যমে ইলমে কেরাআতের শুদ্ধতম পদ্ধতিগুলাে যুগপরম্পরায় চলে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীগণের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে একই ইমাম বিভিন্ন পদ্ধতির কেরাআত আয়ত্ত করে তা শিক্ষা দান করতে থাকেন। অনেকে আবার বিশেষ এক ধরনের কেরামতিই আয়ত্ত করেন এবং তা শিক্ষা দান করতে থাকেন। ফলে সেই কেরাতি সংশ্লিষ্ট ওস্তাদের নামে খ্যাত হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে আলিমগণ কেরাআত পদ্ধতিগুলাের গুটিনাটি সব দিক বিশ্লেষণ করে কিতাব লেখা শুরু করেন। সর্বপ্রথম ইমাম আবু ওবায়েদ কাসেম বিন সালাম, ইমাম আবু হাতেম সাজেস্তানী, কাজী ইসমাঈল ও ইমাম আবু জাফর তাবারী এই ইলুম সম্পর্কে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আবু বকর ইবনে। মুজাহিদ (ওয়াত ৩২৪ হি.) একটি প্রামাণিক কিতাব লেখেন। এই কিতাবে সাত কারীর কেরাআতই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। তার এই কিতাব এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পরবর্তী যুগে তার কিতাবে উল্লিখিত সাত কারীর ক্বেরাআতই সর্বসাধারণ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায়। অনেকের মধ্যে এমন একটা ধারণা পর্যন্ত সৃষ্টি হয়ে যায় যে, ইমাম আবু বকর কর্তৃক উল্লিখিত সাত ধরনের পঠন পদ্ধতিই শুদ্ধতম বর্ণনা ভিত্তিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সক্সাম থেকে এ পদ্ধতিগুলােই নিরযােগ্য বর্ণনার মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু ইমাম ইবনুল-মুজাহিদ এ উদ্দেশ্যে সাতজন কারীর ক্বেরাআত পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেননি যে, এই সাতজনের কেৱাআতই শুদ্ধতম-এরূপ দাবিও তিনি কোথাও করেননি। ইমাম। ইবনুল-মুজাহিদের কিতাব থেকে আরাে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি এই হয়েছে যে, হাদীস শরীফে উল্লিখিত 'ছাবাত-আহকাফ' বা সাত হরফের যে বর্ণনা রয়েছে তা বােধ হয় এ সাতজন কারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃত প্রস্তাবে এ ধারণাও সত্য নয়। কেননা ইতিপূর্বেই

উল্লিখিত হয়েছে যে, হাদীসে উল্লিখিত যে সাত পদ্ধতিতে কোরআন শরীফ নাযিল হয়েছে উপরে বর্ণিত তিন শর্তের মাপকাঠিতে যে সব পঠন-পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, সেগুলােই সেই সাত-পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। 

সর্বজন স্বীকৃত সাত কারী

ইমাম আবু বকর ইবনুল-মুজাহিদের কিতাব দ্বারা যে সাতজন কারী সর্বাপেক্ষা বেশি খ্যাতি লাভ করেছেন, তারা হচ্ছে ।

১. আবদুল্লাহ ইবনে কাসীর আদদারীঃ
(ওফাত ১২০ হি.) ইনি হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) ও হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (ব্রা) প্রমুখ তিনঞ্জন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। তার কেরাআত মক্কা শরীফে বেশি প্রচলিত হয়েছে। তার কেরাআতের বর্ণনাকারিগণের মধ্যে হযরত রাযী (র) ও হযরত কান্‌বাল (র) অধিকতর খ্যাতি লাভ করেছেন।

২. নাফে বিন আবদুর রহমান বিন আবু নায়ীমঃ
(ওফাত ১৬৯ হি.) ইনি এমন সত্তর জন তাবেয়ী থেকে ইলমে-কেরাআত শিক্ষা লাভ করেছিলেন, যারা সরাসরি হ্যরত উবাই বিন কা'ব (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর শাপৱেদ ছিলেন। তার কেরাত মদীনা শরীফে বেশি প্রসার লাভ করেছে। তার বর্ণনাকারিগণের মধ্যে আৰু মূসা কালুন (ওফাত ২২০ হি.) ও আবু সায়ীদ দরশ (ওফাত ১৯৭ হি.) অধিক খ্যাতি লাভ করেছেন।

৩. আবদুল্লাহিল হিলবীঃ
(ওফাত ১১৮ হি.) ইবনে ‘আমের নামে খ্যাত। ইনি সাহাবীগণের মধ্যে হযরত নােমান ইবনে বশীর (রা) ও হযরত ওয়াছেলা বিন আসকার (রা)-এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। ইলমে কেরাআত হয়ত মুগীরা বিন শেহাব মাখযুমী থেকে হাসিল করেন। মুগীরা বিন শেহাব হযরত উসমান (রা)-এর শাগরেদ ছিলেন। তাঁর কেরাতের বেশি প্রচলন হয়েছে সিরিয়ায়। তার বর্ণনাকারিগণের মধ্যে হেশাম ও যাকওয়ান বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

৪. আৰু আমার আব্বান ইবনুল-আলাঃ
(ওফাত ১৫৪ হি.) ইনি হযরত মুজাহিদ (রা) ও সায়ীদ ইবনুল জুবাইর (র)-এর মাধ্যমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হযরত উবাই ইবনুল কা'ব (রা)-এর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। দ্বার কেরাআত বসরায় বেশি প্রসার লাভ করেছে। তার বর্ণনাকারিগণের মধ্যে আবু উমারুদ-দুয়ালী (ওফাত ২৪৬ হি.) ও আবু শোয়াইব সূমীর (ওফাত ২৬১ হি.) খ্যাতি সমধিক।

৫. হাম বিন হাবীব আয-যাইয়াতঃ
(ওফাত ১৮৮ হি.) ইনি ইকরামা বিন রবী আত-তাইমীর মুক্ত-করা ক্রীতদাস ছিলেন। সুলায়মান আল-আ'মাশ-এর শাগরেদ। সুলায়মান বিন ওয়াসসাব-এর নিকট থেকে, তিনি যর বিন হােবাইশ-এর নিকট থেকে এবং ইয়াহইয়া তিনি হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা)-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তার বর্ণনাকারিগণের মধ্যে খালফ বিন হেশাম (ওফাত ১৮৮ হি.) ও খাল্লাদ বিন খালেদ (ওফাত ২২০ হি.) বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

৬. আসেম বিন আবিননাজুদ আল-আসাদীঃ
(ওফাত ১২৭ হি.) ইনি যর বিন হােবাইশ-এর মাধ্যমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) আবু আবদুর রহমান দুলমার মাধ্যমে হ্যরত





*********************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url