ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা- ৭ || ইসলামী সংস্কৃতির গঠন বিন্যাসে তার মূল লক্ষ্যের ভূমিকা ||
পন্থা নিরূপণে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রভাব
ইতিপূর্বে এ সত্যটির প্রতি ইশারা করা হয়েছে যে, জীবনের যাবতীয় কারবারে লক্ষ্য নিরূপণের যেমন একান্ত প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লক্ষ্য অর্জনের পন্থা নির্ধারণেরও। আর পন্থা কখনো লক্ষ্যের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন ভিত্তিতে নিরূপতি হতে পারে না। যদি কোন ব্যক্তির সামনে নিছক ঘুরাফিরা ছাড়া কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বর্তমান না থাকে এবং সে শুধু রাস্তা-ঘাট ও অলি- গলির ধূলো সাফ করে বেড়ায়, তাহলে তাকে আমরা পাগল বা ভবঘুরে বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। আর যদি সে লক্ষ্য পোষণ করেও, কিন্তু তা অর্জনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে কোন বিশেষ পন্থার অনুসারী না হয়, বরং যে পন্থাটি তার লক্ষ্যাভিমুখী বলে মনে হয়, সেটিই অবলম্বন করার জন্যে তৈরী হয়ে যায়, তবে তাকেও আমরা নির্বোধ বলে অভিহিত করি। কারণ যে ব্যক্তি একটি বিশেষ স্থানে যাবার জন্যে দশটি বিভিন্ন পথে চলার চেষ্টা করে, বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী সে কখনো লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারে না। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি যদি কোন বিশেষ জিনিসকে নিজের অভীষ্ট বলে ঘোষণা করে, আর তা অর্জনের জন্যে তার বিপরীত দিকগামী পন্থা অবলম্বন করে, তবে তাকে আমরা বুদ্ধিমান বলে মনে করি না। কারণ সে হচ্ছে, এমন বেদুঈনের মতো যে কাবার দিকে যাবার জন্যে তুর্কিস্তানের পথ ধরেছে। সুতরাং মানুষের বাস্তব সাফল্যের জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে, পথ চলার জন্যে প্রথমে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা, তারপর সেই লক্ষ্যের দিকে তার যাবতীয় ইচ্ছা-বাসনা ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া, আর সেই লক্ষ্যস্থলে পৌছার বিভিন্ন পথ থাকলে তার ভেতরকার সর্বোত্তম পন্থাটি অবলম্বন করা এবং বাকী সমস্ত পথ বর্জন করা।
এ গ্রহণ ও বর্জন সম্পূর্ণ বিচার-বুদ্ধিসম্মত। লক্ষ্য নির্ধারণের ফল এই যে, যে পন্থাটি এ লক্ষ্যের সাথে বিশেষভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ, সেটি অবলম্বন করতে হবে এবং বাদবাকী সমস্ত পন্থা পরিহার করতে হবে। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন ভ্রমণে বেরোয়, তখন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার সবচেয়ে উত্তম পথটিতেই সে এগিয়ে চলে। তার ভ্রমণকালে এছাড়া আর যে দশ-বিশটি পথের সন্ধান পায়, তার প্রতি ফিরেও তাকায় না। একজন বুদ্ধিমান ছাত্রের লক্ষ্য অর্জনের পথে জ্ঞানের যে শাখাটি সবচেয়ে বেশী সহায়ক, সেই শাখাটিই সে অবলম্বন করে। তার সাথে আর যেসব শাখার সম্পর্ক নেই, তাতে সে নিজের সময় ব্যয় করতে পছন্দ করে না। একজন বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসায়ের যে পন্থাটি সাফল্য লাভের সর্বোত্তম উপায় বলে বিবেচিত হয়, নিজের জন্যে সেই পন্থাটি সে অবলম্বন করে । যে কোন কাজে পুঁজি খাটানো এবং যে কোন বৃত্তিতে নিজের শ্রম ব্যয় করাকে সে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করে। এ গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে অনুসৃত পথটি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার পক্ষে সর্বোত্তম হয়েছে কিনা, একজন সমালোচক শুধু এটুকু মতামতই পেশ করতে পারে। কিন্তু গ্রহণ ও বর্জন সম্পর্কে কোন আপত্তি তোলা সম্ভবপর নয় ।
এ সত্যটি জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি সামগ্রীকভাবে গোটা জীবনের বেলায়ও প্রযোজ্য। মানুষ যদি তার জীবন সম্পর্কে কোন লক্ষ্য পোষণ না করে অথবা শুধু বেঁচে থাকার জন্যে বেঁচে থাকাই তার লক্ষ্য হয়, তবে জীবন যাপনের জন্যে সে যে কোন পন্থা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে। তার পক্ষে বিভিন্ন পন্থার মধ্যে ভালো-মন্দ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং উৎকৃষ্ট-অপকৃষ্টের তারতম্য করা একেবারে অর্থহীন। নিজের কামনা-বাসনা ও প্রয়োজনাদি সে যেভাবে খুশী পূর্ণ করতে পারে। বাহ্যিক কার্য-কারণ তাকে এক বিশেষ পন্থার অনুসরণে কিছুটা বাধ্য করলেও তার গোটা জীবনকে কোন নিয়ম-শৃংখলা ও বিধি-বিধানের অনুবর্তী করার ব্যাপারে তো কার্যকরী হতে পারে না । কারণ নিয়ম-শৃংখলার কোন মৌলিক প্রেরণাই তার ভেতরে বর্তমান থাকবে না। পক্ষান্তরে সে যদি জীবন সম্পর্কে কোন লক্ষ্য পোষণ করে কিংবা স্পষ্ট ভাষায় জীবন সম্পর্কে সহজাত জৈবিক লক্ষ্যের উর্ধে কোন যুক্তিসংগত মানবিক লক্ষ্য তার মনে বদ্ধমূল হয়, তবে বিভিন্ন পন্থার মধ্যে র্মে অবশ্যই ভারতম্য করবে। আর প্রকৃতপক্ষে সে যদি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয় তো জীবন-যাপনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে তার লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে অধিকতর উপযোগী একটি পন্থা তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয়ার পর পন্থাবলম্বনে লক্ষ্যহীন মানুষের মতোই আযাদী ভোগ করা তার পক্ষে কিছুতেই সংগত হবে না।
এবার এ নীতিটিকে একটু প্রসারিত করুন। ব্যক্তির জায়গায় সমাজকে নিয়ে দেখুন, বহু ব্যক্তির ওপরও ঠিক এ নীতিই সমভাবে প্রযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন সমাজ সভ্যতার প্রাথমিক স্তরে থাকে এবং জীবন সম্পর্কে সহজাত জৈবিক লক্ষ্যের উর্ধে কোন উচ্চ ও উচ্চতর লক্ষ্য তাদের সামনে বর্তমান থাকে না, ততক্ষণ তারা নিজের রীতিনীতি ও চাল-চলনের একজন লক্ষ্যহীন মানুষের মতোই স্বাধীন থাকে। কিন্তু বুদ্ধির ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার অধিকতর উঁচু স্তরে পৌঁছার পর যখন তাদের ভেতরে একটি সংস্কৃতির জন্ম হয় এবং সে সংস্কৃতি তাদের সামগ্রিক জীবনের জন্যে কোন যুক্তিসংগত লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়, তখন সেই লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আকিদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, লেন-দেন, নৈতিক চরিত্র, সামাজিকতা, অর্থনীতি ইত্যাদির জন্যে একটি বিশেষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা সংস্কৃতির অনুগামীদেরকে সে ব্যবস্থার অনুসারী করে তোলা এবং এর আওতাধীনে থেকে কাউকে এর বহিস্থ কোন আকীদা বা কর্মনীতি অবলম্বন করার স্বাধীনতা না দেয়া একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে ।
আপন বিধি-ব্যবস্থার সংরক্ষণে এবম্বিধ কড়াকড়ি খোদ সংস্কৃতির প্রকৃতির সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ব্যাপারে যে সংস্কৃতির বাঁধন শিথিল হবে এবং বিধি- ব্যবস্থায় দৌর্বল্য ও শিথিলতা পাওয়া যাবে, তা কখনো বেঁচে থাকতে পারে না । কারণ সংস্কৃতির যে আকীদা ও কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, তার অনুগামীগণ কর্তৃক তার অনুসরণের ওপরই নির্ভর করে তার অস্তিত্ব। যখন অনুগামীরা তাদের আকীদা ও কর্মপদ্ধতির অনুসরণ করবে না এবং ঐ পদ্ধতির বহির্ভূত ধ্যান-ধারণা, রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার তাদের বাস্তব জীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, তখন কার্যত সংস্কৃতির কোন অস্তিত্ত্বই বাকী থাকবে না। কাজেই একটি সংস্কৃতির পক্ষে নিজের অনুগামীদের কাছে নিজেদেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতির অনুসরণের দাবী করা এবং অন্যান্য বহিস্থ পদ্ধতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার ব্যাপারে চাপ প্রদান সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত। সমালোচক বড়োজোর এর উদ্দেশ্যের যথার্থ বা অযথার্থ সম্পর্কে কথা বলতে পারেন কিংবা এ উদ্দেশ্যের পক্ষে এ বিশেষ পন্থাটি উপযোগী কিনা, এ সম্পর্কে রায় দিতে পারেন অথবা সর্বাবস্থায় এ পদ্ধতিটির অনুসরণ সম্ভবপর কিনা, এ সম্বন্ধে মত প্রকাশ করতে পারেন । কিন্তু আলোচ্য সংস্কৃতি তার অনুগামীদের কাছে নিজেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতির অনুসরণের দাবী করার অধিকারী নয়, একথা কিছুতেই বলতে পারে না।
পরন্তু এ নীতিও যখন স্বীকৃত হয়েছে যে, মানসিক ও বাস্তব জীবনের জন্যে যে বিশেষ পথ ও পন্থা নির্ধারণ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা নির্ভর করে লক্ষ্যের ধরনের ওপর, আর লক্ষ্যের বিভিন্নতার ফলে পথ ও পন্থার বিভিন্নতাও আবশ্যক, তখন একথাও মানতে হবে যে, যেসব সংস্কৃতি আপন লক্ষ্যের দিক দিয়ে বিভিন্নমুখী হবে, তাদের বাস্তব ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিগুলোও অনিবার্যরূপে পরম্পর থেকে ভিন্নরূপ হতে হবে। সে পদ্ধতিগুলোর কোন কোন অংশের মধ্যে সাদৃশ্য থাকতে পারে, একটি পদ্ধতির মধ্যে অন্য পদ্ধতির কোন কোন খুঁটিনাটি বিষয় এসে যেতে পারে, কিন্তু এ ছোটখাটো সাদৃশ্য থেকে না সামগ্রিক সাদৃশ্যের সিদ্ধান্ত নেয়া চলে, আর না খুঁটিনাটি জিনিস ধার করার ফলে গোটা পদ্ধতিটারই ধারিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে।
এ মূলনীতি থেকে আরো দু'টি সূত্র বেরোয় :
প্রথম এই যে, একটি বিশেষ লক্ষ্য পোষণকারী সংস্কৃতির ব্যবহারিক পদ্ধতি যাচাই করার জন্যে ভিন্ন লক্ষ্য পোষণকারী কোন সংস্কৃতির পদ্ধতিকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। অর্থাৎ এই পদ্ধতিটি যদি ঐ পদ্ধতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তবেই অভ্রান্ত নচেৎ ভ্রান্ত সমালোচনার এ পদ্ধতি সংগত নয় ।
দ্বিতীয় এই যে, একটি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখে তার বাস্তব ও বিশ্বাসগত পদ্ধতিকে অন্য পদ্ধতির সাথে বদলানো যেতে পারে না। আর না একটি পদ্ধতির মৌলিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য পদ্ধতির মধ্যে প্রবেশ করানো চলে। এ ধরনের জগাখিচুড়ীকে যে ব্যক্তি সম্ভব বা সংগত মনে করে, সে সংস্কৃতির মূলনীতির সম্পর্কেই অনবহিত এবং তার মেযাজ ও প্রকৃতি অনুধাবনেই অযোগ্য ।
ইসলামী সংস্কৃতির গঠন বিন্যাসে তার মূল লক্ষ্যের ভূমিকা
এ প্রাথমিক কথাগুলো মনে রাখার পর ইসলামী সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণত একটি পৃথক ও বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপদানে তার মূল লক্ষ্যের ভূমিকা কি, তা সহজেই বোঝা যেতে পারে। পূর্বেকার আলোচনায় একথা সবিস্তারে বিবৃত করা হয়েছে যে, ইসলাম জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির লক্ষ্য থেকে মূলগতভাবেই পৃথক। সেই সঙ্গে একথাও প্রতিপন্ন হয়েছে যে, উদ্দেশ্যের বিভিন্নতার ফলে বিশ্বাস ও কর্মের পদ্ধতিতেও মৌলিক পার্থক্য সূচিত হয়। সুতরাং এর যুক্তিসংগত ফল দাঁড়ায় এই যে, ইসলামের লক্ষ্য তাকে এমন একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপ দিয়েছে, যা মূলগতভাবেই অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। এবং যার বিশ্বাস ও বাস্তব পদ্ধতির সাথে অন্যান্য পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ পদ্ধতির কোন কোন অংশ হয়তো অন্যান্য পদ্ধতিতেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতিতে সে অংশগুলো যে হিসেবে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, এখানে সে হিসেবে সন্নিবেশিত নয়। কোন পদ্ধতিতে সন্নিবিষ্ট হবার পর অংশ বিশেষ তার নিজস্ব প্রকৃতি হারিয়ে সমগ্রের প্রকৃতি ধারণ করে ; আর একটি সমগ্রের প্রকৃতি যখন অপর সমগ্র থেকে ভিন্ন হয়, তখন তার প্রত্যেক অংশের প্রকৃতি অপরের প্রত্যেক অংশের প্রকৃতি থেকে অনিবার্যরূপে ভিন্নতর হবে, – তার কোন কোন অংশের বহিরাকৃতির সাথে অপরের কোন কোন অংশের যতই সাদৃশ্য থাকুক না কেন ।
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইসলাম মানুষকে দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে এবং যে মহান প্রভুর সে প্রতিনিধি, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকেই তার জীবনের লক্ষ্য রূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ লক্ষ্যটি যেহেতু তার গোটা জীবনের লক্ষ্য, এ জন্যেই তার জীবনের সকল ক্রিয়াকলাপের মোড় লক্ষ্যের দিকেই নিবন্ধ হওয়া, তার দেহ ও প্রাণের যাবতীয় শক্তি ঐ লক্ষ্যের পথেই নিয়োজিত হওয়া এবং তার চিন্তা কল্পনা, ধ্যান-ধারণা ও গতিবিধির ওপর ঐ লক্ষ্যেরই কর্তৃত্ব স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। তার জীবন-মৃত্যু, শয়ন-জাগরণ, পানাহার, লেন-দেন, সম্পর্ক-সম্বন্ধ, বন্ধুত্ব ও বৈরিতা, অর্থনীতি ও সামাজিকতা, এক কথায়, তার প্রতিটি জিনিস ঐ একমাত্র লক্ষ্যের জন্যে নিবেদিত হওয়া উচিত। পরন্তু এ লক্ষ্যটিকে তার ভেতর এমন প্রভাবশীল ও ক্রিয়াশীল হওয়া দরকার, যেন এ প্রাণচেতনার কারণেই সে জীবন্ত ও কর্মতৎপর রয়েছে। এবার স্পষ্টতই বোঝা যায়, যে ব্যক্তি তার জীবন সম্পর্কে এমন লক্ষ্য পোষণ করে, আর এ লক্ষ্যের জন্যেই বেঁচে রয়েছে, সে কখনো কোন লক্ষ্যহীন কিংবা ভিন্ন লক্ষ্য পোষণকারী ব্যক্তির মতো জীবন যাপন করতে পারে না। এ লক্ষ্য তো তার নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষকে এক দক্ষ কর্মী ও সক্রিয় কর্মচারীতে পরিবর্তিত করে দেয়, এমন কর্মী ও কর্মচারী, যে শুধু বেঁচে আছে তার জীবনের লক্ষ্য অর্জন করার জন্যে ।
তাই এ লক্ষ্য নির্ধারণ করার পর ইসলাম জীবন যাপন করার জন্যে বিভিন্ন পন্থার মধ্য থেকে একটি বিশেষ পন্থা নির্বাচন করে এবং ঐ পন্থাটি ছাড়া অন্য কোন পন্থা অনুসরণ করে মানুষকে তার প্রিয় সময় ও মূল্যবান শক্তির অপচয় না করার জন্যে বাধ্য করে। সে এ লক্ষ্যের স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে আকীদা- বিশ্বাসও ক্রিয়া-কাণ্ডের একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি, উদ্ভাবন করে এবং কোন অবস্থায়ই এ বিশেষ পদ্ধতির সীমা অতিক্রম না করার জন্যে মানুষের কাছে দাবী জানায়। সে এ পদ্ধতিকে সোজাসুজি আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তিতা বলে ঘোষণা করে এবং এ জন্যে নামকরণ করে 'দ্বীন’ -অর্থাৎ আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তিতা । সে বলে আল্লাহর কাছে দ্বীন হচ্ছে শুধু ইসলাম।'
এ দ্বীনের ভিত্তিতেই ইসলাম তার অনুসারী এবং যারা অনুসারী নয় তাদের মধ্যে পার্থক্য চিহ্ন এঁকে দেয়। যারা এ বিশেষ লক্ষ্য অনুযায়ী এ অনুসরণ পদ্ধতিকে মেনে চলে, তাদেরকে সে 'মুসলিম' (আত্মসমর্পণকারী) ও মু'মিন' (প্রত্যয় পোষণকারী) বলে অভিহিত করে। আর যারা ঐ লক্ষ্যের সাথে এক মত নয় এবং এ অনুসরণ পদ্ধতিকেও মেনে চলে না, তাদেরকে সে 'কাফের' (অবিশ্বাসী)১ বলে ঘোষণা করে। সে বংশ, গোত্র, জাতি, সম্প্রদায়, ভাষা, দেশ এবং এ শ্রেণীর যাবতীয় ভেদ-বৈষম্যকে বিলুপ্ত করে আদম সন্তানের মধ্যে এই এক 'কুফর' ও 'ঈমানের' বৈষম্যকে দাঁড় করায়। যে কেউ এ পদ্ধতি মেনে চলবে— সে প্রাচ্যের হোক কি পাশ্চাত্যের সে তার আপনজন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এর পদ্ধতি মেনে না চলবে – সে কা'বার প্রাচীরের নীচেই থাকুক, আর তার রক্তমাংস মক্কার খেজুর এবং জমজমের পানি দ্বারাই গঠিত হোক— সে তার আপন নয়।
আকীদা-বিশ্বাসের এ ক্রিয়া-কাণ্ডের ভিত্তিতে সে যেমন মানুষের মধ্যে 'কুফর' ও “ঈমানের' বৈষম্য দাঁড় করিয়েছে, তেমনি জীবন যাপনের পন্থা এবং দুনিয়ার সকল জিনিসের মধ্যেও সে হারাম-হালাল, জায়েয-নাজায়েয ও মকরূহ-মুস্তাহাবের পার্থক্য কায়েম করেছে। যেসব ক্রিয়া-কাণ্ড ও রীতিনীতি ঐ লক্ষ্য অর্জন এবং খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পক্ষে সহায়ক, সেগুলো নিজ নিজ অবস্থানুপাতে হালাল, জায়েয বা মুস্তাহাব। আর যেগুলো এ পথের বাধা ও প্রতিবন্ধক, সেগুলোও আপন আপন অবস্থানুপাতে হারাম, নাজায়েয বা মাকরহ। যে মু'মিন এ পার্থক্য চিহ্নকে সমীহ করে, সে 'মুত্তাকী' (পরহেযগার ) আর যে এর প্রতি সমীহ করে না, সে 'ফাসেক' (সীমালংঘনকারী)। আল্লাহর দলের লোকদের ভেতর ছোট-বড়ো ও উচ্চ-নীচ পার্থক্য ধন-দৌলত, বংশীয় আভিজাত্য, সামাজিক পদমর্যাদা বা সাদা-কালো, বর্ণের ভিত্তিতে নয়, বরং 'তাকওয়ার' ভিত্তিতে সূচিত হয়।
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَكُم (الحجرات : ۱۳)
“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মুত্তাকী তারাই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানীয়।”-(সূরা আল হুজুরাত : ১৩)
এভাবে ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-কল্পনা, স্বভাব-প্রকৃতি, নৈতিক চরিত্র, অর্থনীতি, সামাজিকতা, তমদ্দুন, সভ্যতা, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা, এক কথায় মানবীয় জীবনের সমগ্র দিকে ইসলামী সংস্কৃতির পথ অন্যান্য সংস্কৃতির পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। কারণ জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা অন্যান্য সংস্কৃতির ধারণা থেকে একেবারে পৃথক। অন্যান্য সংস্কৃতির জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, ইসলামের লক্ষ্য তার থেকে ভিন্ন ধরনের। সুতরাং ইস- লাম তার ধারণা অনুযায়ী দুনিয়া এবং তার ভেতরকার বস্তুনিচয়ের সাথে যে আচরণ ও কর্মনীতি অবলম্বন করে এবং আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্যে পার্থিব জীবনে যে কর্মপন্থা গ্রহণ করে, তাও মূলগতভাবে অন্যান্য সংস্কৃতির গৃহীত আচরণ ও কর্মপন্থা থেকে ভিন্ন ধরনের। মনের অনেক চিন্তা-কল্পনা ও ধ্যান- ধারণা, প্রবৃত্তির অনেক কামনা-বাসনা ও ঝোঁক-প্রবণতা এবং জীবন যাপনের জন্যে এমন বহু পন্থা রয়েছে, অন্যান্য সংস্কৃতির দৃষ্টিতে যার অনুসরণ শুধু সংগতই নয়; বরং কখনো কখনো সংস্কৃতির পক্ষে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু ইসলাম সেগুলোকে নাজায়েয, মকরূহ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হারাম বলে ঘোষণা করতে বাধ্য। কারণ, সেগুলো ঐ সংস্কৃতিগুলোর জীবন দর্শনের সাথে একেবারে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাদের জীবন লক্ষ্য অর্জনের পক্ষেও সহায়। কিন্তু ইসলামের জীবন দর্শনের সাথে ঐগুলোর কোনই সম্পর্ক নেই অথবা তার জীবন লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্তরায় স্বরূপ। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, দুনিয়ার বহু সংস্কৃতির পক্ষে ললিতকলা হচ্ছে প্রাণ স্বরূপ এবং এ সকল চারুকলায় নিপুণ ও পারদর্শী ব্যক্তিগণ 'জাতীয় বীর'-এর মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু ইসলাম এর কোন কোনটিকে হারাম, কোনটিকে মকরূহ আর কোনটিকে কিছু পরিমাণ জায়েয বলে ঘোষণা করে। তার আইন-কানুন সৌন্দর্য-প্রীতির পরিচর্যা এবং কৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগের অনুমতি মাত্র এটুকু রয়েছে যে, মানুষ যেনো তার সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে, তাঁর পরিতুষ্টির জন্যে কাজ করতে এবং খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু যেখানে গিয়ে এ সৌন্দর্য প্রীতি দায়িত্বানুভূতির চেয়ে প্রবলতর হবে, যেখানে আনন্দ ভোগের আতিশয্য মানুষকে আল্লাহর পূজারী হওয়ার বদলে সৌন্দর্য পূজারী করে তোলে, যেখানে ললিতকলার স্বাদ থেকে মানুষকে বিলাস প্রিয়তার নেশায় ধরে যায়, যেখানে ঐসব শিল্পকলার প্রভাবে ভাবপ্রবণতা ও প্রবৃত্তির তাড়না শক্তিশালী ও তীব্রতর হওয়ায় বুদ্ধির বাধন শিথিল হয়ে যায় এবং বিবেকের আওয়াজের জন্যে হৃদয়ের কান বধির হয়ে যায় এবং কর্তব্যের ডাক শোনার মতো আনুগত্য ও দায়িত্বজ্ঞান বজায় না থাকে, ঠিক সেখানে পৌঁছেই ইসলাম অবজ্ঞা, অবৈধতা ও নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দেয়। এ জন্যেই যে, তার উদ্দেশ্য তানসেন, বান্দাদিন, মানী ও বাহজাদ চার্লিচাপলিন এবং মেরী পিফোর্ড সৃষ্টি করা নয়, বরং সে চায় আবু বকর সিদ্দীক (রা), উমর ফারুক (রা), আলী বিন আবু তালিব (রা), হোসাইন বিন আলী (রা) ও রাবিয়া বছরী (রা) সৃষ্টি করতে।
এ দৃষ্টান্তের সাহায্যে সমাজ, তমদ্দুন এবং অন্যান্য বহু বিষয়েরই বিস্তৃত অবস্থা অনুমান করা যেতে পারে। বিশেষত নারী ও পুরুষের সম্পর্ক, ধনী ও নির্ধনের ব্যবহার, মালিক ও প্রজার সম্বন্ধ এবং অন্যান্য মানবীয় শ্রেণীগুলোর পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশিত পন্থা সমুদয় প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতির উদ্ভাবিত পন্থা থেকে নীতিগতভাবেই ভিন্নতর। এ ব্যাপারে অন্যান্য সংস্কৃতির অনুসৃত পদ্ধতিকে মানদণ্ড বানিয়ে ইসলামের অবলম্বিত পদ্ধতিকে যাচাই করা মূলতই ভ্রান্তির পরিচায়ক। এ ধরনের কাজ যারা করেন, তারা নিতান্তই স্কুলদর্শী এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞ ।
******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.