মা’আরেফুল কোরআন-৬ || সূরা আল-ফাতিহার তাফসীর || প্রতিদান দিবসের স্বরূপ ও তার প্রয়োজনীয়তা || মালিক কে ?





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

প্রতিদান দিবসের স্বরূপ ও তার প্রয়োজনীয়তা

প্রথমত, প্রতিদান দিবস কাকে বলে এবং এর স্বরূপ কি ? দ্বিতীয়ত, সমগ্র সৃষ্টিরাজির উপর প্রতিদান দিবসে যেমনিভাবে আল্লাহ তা'আলার একক অধিকার থাকবে, অনুরূপভাবে আজও সকল কিছুর উপর তাঁরই তো একক অধিকার রয়েছে; সুতরাং প্রতিদান দিবসের বৈশিষ্ট্য কোথায় ?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এই যে, 'প্রতিদান দিবস' সে দিনকেই বলা হয়, যেদিন আল্লাহ তা'আলা ভাল-মন্দ সকল কাজ-কর্মের প্রতিদান দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। ‘রোযে-জাযা' শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে, দুনিয়া ভাল-মন্দ কাজ-কর্মের প্রকৃত ফলাফল পাওয়ার স্থান নয় ; বরং ইহা কর্মস্থল, কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জায়গা। যথার্থ প্রতিদান বা পুরস্কার গ্রহণেরও স্থান এটা নয়। এতে এ কথাও বোঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে কারও অর্থ-সম্পদের আধিক্য ও সুখ-শান্তির ব্যাপকতা দেখে বলা যাবে না যে, এ লোক আল্লাহ্র দরবারে মকবুল হয়েছেন বা তিনি আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র। অপরপক্ষে কাকেও বিপদাপদে পতিত দেখেও বলা যাবে না যে, তিনি আল্লাহর অভিশপ্ত। যেমনি করে কর্মস্থলে বা কারখানার কোন কোন লোককে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যস্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাকে বিপদগ্রস্ত বলতে পারে না এবং সে নিজেও দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত বলে নিজেকে বিপদগ্রস্ত বলে ভাবে না; বরং সে এ ব্যস্ততাকে জীবনের সাফল্য বলেই গণ্য করে এবং যদি কেউ অনুগ্রহ করে তাকে এ ব্যস্ততা থেকে রেহাই দিতে চায়, তবে তাকে সে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর বলে মনে করে। সে তার এ ত্রিশ দিনের পরিশ্রমের অন্তরালে এমন এক আরাম দেখতে পায়, যা তার বেতনস্বরূপ সে লাভ করে।

এই জন্যই নবীগণ এ দুনিয়ার জীবনে সর্বাপেক্ষা বেশি বিপদাপদে পড়েছেন এবং তারপর ওলী-আউলিয়াগণ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। কিন্তু দেখা গেছে, বিপদের তীব্রতা যত কঠিনই হোক না কেন, দৃঢ়পদে তাঁরা তা সহ্য করেছেন। এমনকি আনন্দিত চিত্তেই তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। মোটকথা, দুনিয়ার আরাম-আয়েশকে সত্যবাদিতা ও সঠিকতা এবং বিপদাপদকে খারাপ কাজের নিদর্শন বলা যায় না।

অবশ্য কখনো কখনো কোন কোন কর্মের সামান্য ফলাফল দুনিয়াতেও প্রকাশ করা হয় বটে, তবে তা সে কাজের পূর্ণ বদলা হতে পারে না। এগুলো সাময়িকভাবে সতর্ক করার জন্য একটু নিদর্শন মাত্র। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ 

وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ 

অর্থাৎ এবং আমরা মানুষকে (পরকালের বড় শান্তির) আগেই দুনিয়াতে কিছু শান্তি দিয়ে থাকি, যেন তারা মন্দ কাজ থেকে ফিরে আসে।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছেঃ

كَذَلِكَ الْعَذَابُ وَلَعَذَابُ الْأَخِرَةِ أَكْبَرُ لَوكَانُوا يَعْلَمُونَ .

অর্থাৎ এরূপ শাস্তি হয়ে থাকে এবং পরকালের শান্তি আরো বড়, যদি তা তারা বুঝে ! মোটকথা, দুনিয়ার আরাম-আয়েশ এবং বিপদাপদ কোন কোন সময় পরীক্ষা স্বরূপও হয়ে থাকে, আবার কোন কোন সময় সতর্কীকরণের জন্যও শান্তিরূপে প্রবর্তিত হয় ।

কিন্তু তা কর্মের পূর্ণ ফলাফল নয়, সামান্য নমুনা মাত্র। কেননা, এ সব কিছুই ক্ষণিকের এবং ক্ষণস্থায়ী। চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও শাস্তি হবে পরকালে। যেদিন সে শান্তি অথবা শাস্তি দেওয়া হবে, সেদিনের নামই প্রতিদান দিবস। যখন বোঝা গেল যে, ভাল ও মন্দ কাজের পরিপূর্ণ প্রতিদানের স্থান এ পৃথিবী নয়, তখন বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তির কথা হচ্ছে এই যে, ভাল ও মন্দ যেন একই পর্যায়ভুক্ত হয়ে না যায়, সে জন্য প্রত্যেক কাজের প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া উচিত। এজন্যই এ জগৎ ব্যতীত একটি ভিন্ন জগতের প্রয়োজন। যেখানে ছোট-বড়, ভাল-মন্দ সকল কাজের প্রতিদান ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে দেওয়া হবে। কোরআনের ভাষায় তাকেই 'প্রতিদান দিবস'—কিয়ামত বা পরকাল বলা হয়।

সূরা আল-মু'মিনে আল্লাহ্ তা'আলা এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

وَمَا يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ وَلَا الْمُسِي ، قَلِيلاً ما تَذَكَّرُونَ ، إِنَّ السَّاعَةَ لَاتِيَةٌ لَا رَيْبَ فِيهَا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يُؤْمِنُونَ .

অর্থাৎ-অন্ধ এবং দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি যেমন এক পর্যায়ের নয়, তেমনি যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করে, আর যারা মন্দ কাজ করে তারা পরস্পর সমান নয় । তোমরা অত্যন্ত কম বুঝ। কিয়ামত অবশ্যই হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা বিশ্বাস করে না।

মালিক কে ?

مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ বাক্যটিতে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই একথা জানেন যে, সেই একক সত্তাই প্রকৃত মালিক, যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর লালন-পালন ও বর্ধনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং যাঁর মালিকানা পূর্ণরূপে প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই সর্বাবস্থায় পরিব্যাপ্ত। অর্থাৎ প্রকাশ্যে, গোপনে, জীবিতাবস্থায় ও মৃতাবস্থায় তিনিই একমাত্র মালিক এবং যার মালিকানার আরম্ভ নেই, শেষও নেই। এ মালিকানার সাথে মানুষের মালিকানার কোন তুলনা চলে না। কেননা, মানুষের মালিকানা আরম্ভ ও শেষের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ। এক সময় তা চলে না, কিছুদিন পরেই তা থাকবে না। অপরদিকে মানুষের মালিকানা হস্তান্তরযোগ্য। বস্তুর বাহ্যিক দিকের ওপরই তা বর্তায়, গোপনীয় দিকের ওপর নয়। জীবিতের ওপর, মৃতের ওপর নয়। এজন্যই প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ তা'আলার মালিকানা কেবলমাত্র প্রতিদান দিবসেই নয়, পৃথিবীতেও সমস্ত সৃষ্টজগতের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা'আলা। তবে এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার মালিকানা বিশেষভাবে 'প্রতিদান-দিবসের' এ কথা বলার তাৎপর্য কি ? আল-কোনআনের অন্য আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে, যদিও দুনিয়াতেও প্রকৃত মালিকানা আল্লাহ্ তা'আলারই কিন্তু তিনি দয়াপরবশ হয়ে আংশিক বা ক্ষণস্থায়ী মালিকানা মানবজাতিকেও দান করেছেন এবং জাগতিক জীবনের আইনে এ মালিকানার প্রতি সম্মানও দেখানো হয়েছে। বিশ্বচরাচরে মানুষ ধন-সম্পদ, জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর এবং আসবাবপত্রের ক্ষণস্থায়ী মালিক হয়েও এতে একেবারে ডুবে রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা একথা ঘোষণা করে এ অহংকারী ও নির্বোধ মানব-সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তোমাদের এ মালিকানা, আধিপত্য ও সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনের এবং ক্ষণিকের। এমন দিন অতি সত্বরই আসছে, যে দিন কেউই জাহেরী মালিকও থাকবে না, কেউ কারো দাস বা কেউ কারো সেবা পাবার উপযোগীও থাকবে না। সমস্ত বস্তুর মালিকানা এক একক সত্তার হয়ে যাবে। এ আয়াতের বিস্তারিত বর্ণনা সূরা আল-মু'মিনের এ আয়াতে দেওয়া হয়েছেঃ

يَوْمَ هُمْ بَارِزُونَ لَا يَخْفَى عَلَى اللهِ مِنْهُمْ شَيْئُ لِّمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ طَ لله الواحد القهار . الْيَوْمَ تُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ لَا ظَلَمَ الْيَوْمَ - إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ .

অর্থাৎ-"যেদিন সমস্ত মানুষ আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে উপস্থিত হবে, সেদিন তাদের কোন কথাই আল্লাহ্র নিকট গোপন থাকবে না। আজ কার রাজত্ব ? (উত্তরে) সে আল্লাহ্ তা'আলার যিনি একক ও পরাক্রান্ত। আজ প্রত্যেককে তার কর্মফল দান করা হবে। আজ কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। আল্লাহ তা'আলা অতি তাড়াতাড়ি হিসাব নিতে পারেন। "

সূরা আল-ফাতিহার প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ সূরার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহ্র প্রশংসা ও তা'রীফের বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর তফসীরে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তা'রীফ ও প্রশংসার সাথে সাথে ঈমানের মৌলিক নীতি ও আল্লাহ্র একত্ববাদের বর্ণনাও সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় আয়াতের তফসীরে আপনি অবগত হলেন যে, এর দু'টি শব্দে তা'রীফ ও প্রশংসার সাথে সাথে ইসলামের বিপ্লবাত্মক মহত্তম আকীদা যথা কিয়ামত ও পরকালের বর্ণনা প্রমাণসহ উপস্থিত করা হয়েছে।

   এখন চতুর্থ আয়াতের বর্ণনাঃ إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ এ আয়াতের এক অংশে তা’রীফ ও প্রশংসা এবং অপর অংশে দোয়া ও দরখাস্ত  عباد – نَعْبُدُ শব্দ হতে গঠিত। এর অর্থ হচ্ছে ঃ কারো প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার দরুন তাঁর নিকট নিজের আন্তরিক কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করা।  استعانت — نسْتَعِينُ হতে গঠিত। এর অর্থ হচ্ছে কারো সাহায্য প্রার্থনা করা। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ মানবজীবন তিনটি অবস্থায় অতিবাহিত হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। পূর্বের তিনটি আয়াতের মধ্যে الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ - الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ এবং এ দু’টি আয়াতে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, অতীতে সে কেবল একমাত্র আল্লাহ তা’আলার মুখাপেক্ষী ছিল, বর্তমানেও সে একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী। অস্তিত্বহীন এক অবস্থা থেকে তিনি তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। তাকে সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর আকার-আকৃতি এবং বিবেক ও বুদ্ধি দান করেছেন। বর্তমানে তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের নিয়মিত সুব্যবস্থা তিনিই করেছেন। অতঃপর مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ এর মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতেও সে আল্লাহ তা’আলারই মুখাপেক্ষী। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য পাওয়া যাবে না।

এ তিনটি আয়াতের দ্বারা যখন একথা প্রমাণিত হলো যে, মানুষ তার জীবনের তিনটি কালেই একান্তভাবে আল্লাহর মুখাপেক্ষী, তাই সাধারণ যুক্তির চাহিদাও এই যে, ইবাদতও তাঁরই করতে হবে। কেননা, ইবাদত যেহেতু অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে নিজের অফুরন্ত কাকুতি-মিনতি নিবেদন করার নাম, সুতরাং তা পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য কোন সত্তা নেই । ফল কথা এই যে, একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি মনের গভীরতা থেকেই এ স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি উচ্চারণ করছে যে, আমরা তোমাকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। মৌলিক চাহিদাই إِيَّاكَ نَعْبُدُ -তে বর্ণনা করা হয়েছে।

যখন স্থির হলো যে, অভাব পূরণকারী একক সত্তা আল্লাহ তা'আলা, সুতরাং নিজের সকল কাজে সাহায্যও তাঁর নিকটই চাওয়া দরকার। এ মৌলিক চাহিদারই বর্ণনা وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ -এ করা হয়েছে। মোটকথা, এ চতুর্থ আয়াতে একদিকে আল্লাহ তা'রীফ ও প্রশংসার সাথে একথারও স্বীকৃতি রয়েছে যে, ইবাদত ও শ্রদ্ধা পাওয়ার একমাত্র তিনিই যোগ্য। অপরদিকে তাঁর নিকট সাহায্য ও সহায়তার প্রার্থনা করা এবং তৃতীয়ত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করার শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। এতদসঙ্গে এও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কোন বান্দাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও অভাব পূরণকারী মনে করবে না। অপর কারো নিকট প্রার্থনার হাত প্রসারিত করা যাবে না। অবশ্য কোন নবী বা কোন ওলীর বরাত দিয়ে প্রার্থনা করা এ আয়াতের মর্মবিরোধী নয় ।

এ আয়াতে এ বিষয়ও চিন্তা করা কর্তব্য যে, “আমরা তোমারই নিকট সাহায্য চাই।" কিন্তু কোন্ কাজের সাহায্য চাই, তার কোন উল্লেখ নেই। জমহুর মুফাস্সিরীনের অভিমত এই যে, নির্দিষ্ট কোন ব্যাপারে সাহায্যের কথা উল্লেখ না করে 'আম বা সাধারণ সাহায্যের প্রতি ইশারা করা হয়েছে যে, আমি আমার ইবাদত এবং প্রত্যেক ধর্মীয় ও পার্থিব কাজে এবং অন্তরে পোষিত প্রতিটি আশা-আকাঙ্ক্ষায় কেবল তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি ।

ইবাদত শুধু নামায-রোযারই নাম নয়। ইমাম গায্যালী (র) দ্বীয় গ্রন্থ 'আরবাঈন'-এ দশ প্রকার ইবাদতের কথা লিখেছেন। যথা-নামায, যাকাত, রোযা, কোরআন তিলাওয়াত, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র স্মরণ, হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা, প্রতিবেশী এবং সাধীদের প্রাপ্য পরিশোধ করা, মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়া, রসূলের সুন্নত পালন করা।

একই কারণে ইবাদতে আল্লাহ্র সাথে কাউকেও অংশীদার করা চলে না। এর অর্থ হচ্ছে, কারো প্রতি ভালবাসা আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসার সমতুল্য হবে না। কারো প্রতি ভয়, কারো প্রতি আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ আল্লাহর ভয় ও তাঁর প্রতি পোষিত আশা-আকাঙ্ক্ষার সমতুল্য হবে না। আবার কারো ওপর একান্ত ভরসা করা, কারো আনুগত্য ও খেদমত করা, কারো কাজকে আল্লাহর ইবাদতের সমতুল্য আবশ্যকীয় মনে করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানত করা, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো সামনে স্বীয় কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করা এবং যে কাজে অন্তরের আবেগ-আকুতি প্রকাশ পায়, এমন কাজ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য করা যথা রুকূ বা সিজদা করা ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই বৈধ হবে না ।

শেষ তিনটি আয়াতে মানুষের দোয়া ও আবেদনের বিষয়বস্তু এবং এক বিশেষ প্রার্থনা-পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছেঃ

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ . صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ .

অর্থাৎ-আমাদেরকে সরল পথ দেখাও ; সে সমস্ত মানুষের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছে। যে পথে তোমার অভিশপ্ত বান্দাগণ চলেছে সে পথে নয়, এবং ঐ সমস্ত লোকের রাস্তাও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

এ তিনটি আয়াতে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন সরল পথের হেদায়েতের জন্য যে আবেদন এ আয়াতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, এর আবেদনকারী যেমনিভাবে সাধারণ মানুষ, সাধারণ মু'মিনগণ, ঠিক অনুরূপভাবে আওলিয়া, গাউস-কুতুব এবং নবী-রসূলগণও। নিঃসন্দেহে যাঁরা হেদায়েতপ্রাপ্ত, বরং অন্যের হেদায়েতের উৎসস্বরূপ, তাঁদের পক্ষে পুনরায় সে হেদায়েতের জন্যই বারংবার প্রার্থনা করার উদ্দেশ্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর 'হেদায়েত' শব্দের তাৎপর্য পরিপূর্ণরূপে অনুধাবন করার ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যাতে আলোচ্য প্রশ্নের উত্তর ছাড়াও 'হেদায়েত' শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা যেসব পরস্পর বিরোধিতা আঁচ করেন, তাদের সকল প্রশ্নেরও মীমাংসা হয়ে যায়।

ইমাম রাগেব ইস্‌ফাহানী 'মুফরাদাতুল-কোরআনে' হেদায়েত শব্দের অতি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর সারমর্ম হচ্ছে, 'কাউকে গন্তব্যস্থানের দিকে অনুগ্রহের সাথে পথপ্রদর্শন করা।' তাই হেদায়েত করা প্রকৃত প্রস্তাবে একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলারই কাজ এবং এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে। হেদায়েতের একটি স্তর হচ্ছে সাধারণ ও ব্যাপক। এতে সমগ্র সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। জড় পদার্থ উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ পর্যন্ত এর আওতাধীন। প্রসঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রাণহীন জড় পদার্থ বা ইতর প্রাণী ও উদ্ভিদ-জগতের সঙ্গে হেদায়েতের সম্পর্ক কোথায় ?

কোরআনের শিক্ষায় স্পষ্টতই এ তথ্য ব্যক্ত হয়েছে যে, সৃষ্টির প্রতিটি স্তর, এমনকি প্রতিটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থানুযায়ী প্রাণ ও অনুভূতির অধিকারী। স্ব-স্ব পরিমণ্ডলে প্রতিটি বস্তুর বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে। অবশ্য এ বুদ্ধি ও অনুভূতির তারতম্য রয়েছে। কোনটাতে তা স্পষ্ট এবং কোনটাতে নিতান্তই অনুল্লেখ্য। যে সমস্ত বস্তুতে তা অতি অল্পমাত্রায় বিদ্যমান সেগুলোকে প্রাণহীন বা অনুভূতিহীন বলা যায়। বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ ভারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকেই শরীয়তের হুকুম-আহকামের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সৃষ্টির এ দু'টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোন কিছুর মধ্যে বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্তিত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেছেনঃ

وَإِنْ مِّنْ شَيْئ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلكِنْ لا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ .

অর্থাৎ-এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহ্র প্রশংসার তসবীহ পাঠ করে না, কিন্তু তোমরা তাদের তসবীহ বুঝতে পার না। (সূরা বনী-ইসরাঈল)

সূরা নুরে এরশাদ হয়েছেঃ

أَلَمْ تَرَى أَنَّ اللهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَقْتِ
كُلُّ قَدْ عَلِمَ صَلُوتَهُ وَتَسْبِيحَهُ ، وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ.

অর্থাৎ-তোমরা কি জান না যে, আসমান-যমীনে যা কিছু রয়েছে, সকলেই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা ও গুণগান করে। বিশেষত পাখিকুল যারা দু'পাখা বিস্তার করে শূন্যে উড়ে বেড়ায়, তাদের সকলেই স্ব-স্ব দোয়া তসবীহ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং আল্লাহ তা'আলাও ওদের তসবীহ সম্পর্কে খবর রাখেন।

একথা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ্ তা'আলার পরিচয়ের ওপরই তাঁর তারীফ ও প্রশংসা নির্ভরশীল। আর এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, আল্লাহর পরিচয় লাভ করাই সর্বাপেক্ষা বড় জ্ঞান।

এটা বুদ্ধি-বিবেক ও অনুভূতি ব্যতীত সম্ভব নয়। এ আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুরই প্রাণ ও জীবন আছে এবং বুদ্ধি ও অনুভূতিও রয়েছে। তবে কোন কোনটির মধ্যে এর পরিমাণ এত অল্প যে, সাধারণ দৃষ্টিতে তা অনুভব করা যায় না। তাই পরিভাষাগতভাবে ওগুলোকে প্রাণহীন ও বুদ্ধিহীন জড় পদার্থ বলা হয়। আর এ জন্যেই ওদেরকে শরয়ী আদেশের আওতাভুক্ত করা হয়নি। গোটা বস্তুজগত সম্পর্কিত এ মীমাংসা আল-কোরআনে সে যুগেই দেওয়া হয়েছিল, যে যুগে পৃথিবীর কোথাও আধুনিককালের কোন দার্শনিকও ছিল না, দর্শনবিদ্যার কোন পুস্তকও রচিত হয়নি। পরবর্তী যুগের দার্শনিকগণ এ তথ্যের যথার্থতা স্বীকার করেছেন এবং প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যেও এ মত পোষণ করার মত অনেক লোক ছিল। মোটকথা, আল্লাহ্র হেদায়েতের এ প্রথম স্তরে সমস্ত সৃষ্টিজগত যথা-জড় পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণিজগত, মানবমণ্ডলী ও জ্বিন প্রভৃতি সকলেই অন্তর্ভুক্ত। এ সাধারণ হেদায়েতের উল্লেখই আল-কোরআনের এ আয়াতে ভss is bei করা হয়েছে। অর্থাৎ- “আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্ব দান করেছেন এবং সে অনুপাতে তাকে হেদায়েত দান করেছেন।”

এ বিষয়ে সূরা আ'লায় এরশাদ হয়েছেঃ

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى الَّذِي خَلَقَ فَسَوَى وَالَّذِي قَدَّرَ فَهَدَى .

অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মহান পালনকর্তার গুণগান কর। যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং সেগুলোকে সঠিক অবস্থা দান করেছেন। যিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং পথ দেখিয়েছেন।

অর্থাৎ যিনি সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য বিশেষ অভ্যাস এবং বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন এবং সে মেজাজ ও দায়িত্বের উপযোগী হেদায়েত দান করেছেন। এ ব্যাপারে হেদায়েতের পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুই অতি নিপুণভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে চলেছে। যে বস্তুকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সেই কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব ও নৈপুণ্যের সাথে পালন করছে। যথা—মুখ হতে নির্গত শব্দ নাক বা চক্ষু কেউই শ্রবণ করতে পারে না, অথচ এ দু'টি মুখের নিকটতম অঙ্গ। পক্ষান্তরে এ দায়িত্ব আল্লাহ্ তা'আলা যেহেতু কানকে অর্পণ করেছেন, তাই একমাত্র কানই মুখের শব্দ শ্রবণ করে ও বুঝে। অনুরূপভাবে কান দ্বারা দেখা বা ঘ্রাণ লওয়ার কাজ করা চলে না। নাক দ্বারা শ্রবণ করা বা দেখার কাজও করা চলে না।

সূরা মরিয়মে এ বিষয়ে এরশাদ হয়েছেঃ

إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا أُتِيَ الرَّحْمَنِ عَبْدًا

অর্থাৎ-আকাশ ও যমীনে এমন কোন বস্তু নেই, যা আল্লাহর বান্দারূপে আগমন করেনি । হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তর এর তুলনায় অনেকটা সংকীর্ণ। অর্থাৎ সে সমস্ত বস্তুর সাথে জড়িত, পরিভাষায় যাদেরকে বিবেকবান বুদ্ধিসম্পন্ন বলা হয়। অর্থাৎ মানুষ এবং জ্বিন জাতি। এ হেদায়েত নবী-রসূল ও আসমানী কিতাবের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের নিকট পৌঁছেছে। কেউ এ হেদায়েতকে গ্রহণ করে মু'মিন হয়েছে আবার কেউ একে প্রত্যাখ্যান করে কাফির-বেদীনে পরিণত হয়েছে।

হেদায়েতের তৃতীয় স্তর আরো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তা শুধু মু'মিন ও মুত্তাকী বা ধর্মভীরুদের জন্য । এ হেদায়েত আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতীতই মানুষকে প্রদান করা হয়। এরই নাম তওফীক। অর্থাৎ এমন অবস্থা, পরিবেশ ও মনোভাব সৃষ্টি করে দেওয়া যে, তার ফলে কোরআনের হেদায়েতকে গ্রহণ করা এবং এর ওপর আমল করা সহজসাধ্য হয়ে যায় এবং এর বিরুদ্ধাচরণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ তৃতীয় স্তরের পরিসীমা অতি ব্যাপক । এ স্তরই মানবের উন্নতির ক্ষেত্র। নেক কাজের সাথে এ হেদায়েতের বৃদ্ধি হতে থাকে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ বৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছেঃ

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا .

অর্থাৎ- “যারা আমার পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে আমি তাদেরকে আমার পথে আরো অধিকতর অগ্রসর হওয়ার পথ অবশ্যই দেখিয়ে থাকি।” এটি সেই কর্মক্ষেত্র যেখানে নবী-রাসূল এবং বড় বড় ওলী-আউলিয়া, কুতুবগণকেও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আরো অধিকতর হেদায়েত ও তওফীকের জন্য চেষ্টায় রত থাকতে দেখা গেছে।

হেদায়েতের এ ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে, হেদায়েত এমন এক বন্ধু যা সকলেই লাভ করেছে এবং এর আধিক্য লাভ করার জন্য বড় হতে বড় ব্যক্তির পক্ষেও কোন বাধা-নিষেধ নেই । এ জন্যই সূরা আল-ফাতিহায় গুরুত্বপূর্ণ দোয়ারূপে হেদায়েত প্ৰাৰ্থনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা একজন সাধারণ মু'মিনের জন্যও উপযোগী, আবার একজন বড় হতে বড় রসূলের জন্যও উপযোগী। এজন্যই হযরত রসূলে আকরাম (সা)-এর শেষ জীবনে সূরা ফাত্হতে মক্কা বিজয়ের ফলাফল বর্ণনা করতে গিয়ে একথাও বলা হয়েছে যে,  وَ یَهۡدِیَکُمۡ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا অর্থাৎ মক্কা বিজয় এজন্যই আপনার দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছে, যাতে সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়েত লাভ হয়।

রসূলুল্লাহ্ (সা) কেবল নিজেই হেদায়েতপ্রাপ্ত ছিলেন না; বরং অন্যের জন্যও ছিলেন হেদায়েতের উৎস। এমতাবস্থায় তাঁর হেদায়েত লাভের একমাত্র অর্থ হতে পারে, এ সময় হেদায়েতের কোন উচ্চতর অবস্থা তিনি লাভ করেছেন।

হেদায়েতের এ ব্যাখ্যা

এক. পবিত্র কোরআনের কোথাও কোথাও মু'মিন ও কাফের নির্বিশেষে সবার জন্যই হেদায়েত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কোথাও শুধুমাত্র মুত্তাকীদের জন্য বিশেষ অর্থে হেদায়েত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এতে করে অজ্ঞ লোকদের পক্ষে সন্দেহে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু হেদায়েতের সাধারণ ও বিশেষ স্তরসমূহ জানার পর এ সন্দেহ  আপনা-আপনিতেই দূরীভূত হয়ে যাবে। বুঝতে হবে যে, কারো বেলায় ব্যাপক অর্থে এবং কারো বেলায় বিশেষ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

দুই. আল-কোরআনের স্থানে স্থানে এরশাদ হয়েছে যে, জালেম ও ফাসেকদেরকে আল্লাহ তা'আলা হেদায়েত দান করেন না। অন্যত্র বারবার এরশাদ হয়েছে যে, তিনি সকলকেই হেদায়েত দান করেন। এর উত্তর ও হেদায়েতের স্তরসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে যে, হেদায়েতের ব্যাপক অর্থে সকলেই হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং বিশেষ অর্থে জালেম ও ফাসেকরা বাদ পড়েছে।

তিন, হেদায়েতের তিনটি স্তরের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় স্তর সরাসরি আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ পর্যায়ের হেদায়েত একান্তভাবে একমাত্র তাঁরই কাজ। এতে নবী-রসূলগণেরও কোন অধিকার নেই। নবী-রসূলগণের কাজ শুধু হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তরে সীমিত। কোরআনের যেখানে যেখানে নবী-রসূলগণকে হেদায়েতকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তরের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে। আর যেখানে এরশাদ হয়েছে- اِنَّکَ لَا تَهۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ অর্থাৎ “আপনি যাকে চান তাকেই হেদায়েত করতে পারবেন না”-এতে হেদায়েতের তৃতীয় স্তরের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কাউকে তওফীক দান করা আপনার কাজ নয় ।

মোটকথা, اِهۡدِ نَا الصِّرَاطَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ একটি ব্যাপক ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দোয়া, যা মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। মানবসমাজের কোন ব্যক্তিই এর আওতার বাইরে নেই। কেননা, সরল-সঠিক পথ ব্যতীত দীন-দুনিয়ার কোন কিছুতেই উন্নতি ও সাফল্য সম্ভব নয় । দুনিয়ার আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যেও সিরাতে মুস্তাকীমের প্রার্থনা পরশপাথরের মত। কিন্তু মানুষ তা লক্ষ্য করে না। আয়াতের অর্থ হচ্ছে : “আমাদিগকে সরল পথ দেখিয়ে দিন।”

সরল পথ কোনটি?

সোজা সরল রাস্তা সে পথকে বলে, যাতে কোন মোড় বা ঘোরপ্যাচ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, ধর্মের সে রাস্তা যাতে ইফরাত' বা 'তফরীত'-এর অবকাশ নেই। ইফরাতের অর্থ সীমা অতিক্রম করা এবং তফরীত অর্থ মর্জিমত কাট-ছাঁট করে নেওয়া । এরশাদ হয়েছে  صِرَاطَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡهِمۡ  অর্থাৎ- যে সকল লোক আপনার অনুগ্রহ লাভ করেছে তাদের রাস্তা। যে সকল ব্যক্তি আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভ করেছে তাদের পরিচয় অন্য একটি আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ
والصالحين অর্থাৎ-যাদের প্রতি আল্লাহ্ পাক অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল সালেহীন। আল্লাহ্র দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবীগণের। অতঃপর নবীগণের উম্মতের মধ্যে যাঁরা সর্বাপেক্ষা বড় মরতবা ও মর্যাদার অধিকারী, তাঁরা হলেন সিদ্দীক। যাদের মধ্যে রূহানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে, সাধারণ ভাষায় তাঁদেরকে 'আউলিয়া' বলা হয়। আর যাঁরা দীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, - তাঁদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালেহীন হচ্ছেন—যাঁরা ওয়াজিব, মুস্তাহাব প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে শরীয়তের পুরোপুরি অনুসরণ ও আমলকারী, সাধারণ পরিভাষায় এঁদেরকে দীনদার বলা হয়।

এ আয়াতের প্রথম অংশে হ্যাঁ-সূচক বাক্য ব্যবহার করে সরল পথের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। উপরোক্ত চার স্তরের মানুষ যে পথে চলেছেন তা-ই সরল পথ। পরে শেষ আয়াতে না-সূচক বাক্য ব্যবহার করেও এর সমর্থন করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ . অর্থাৎ-যারা আপনার অভিসম্পাতগ্রন্ত তাদের পথ নয় এবং তাদের পথও নয়, যারা পথহারা হয়েছে। مَغۡضُوۡبِ عَلَیۡهِمۡ বলতে ঐ সকল লোককে বোঝানো হয়েছে, যারা ধর্মের হুকুম- আহকামকে বুঝে জানে, তবে স্বীয় অহমিকা ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচরণ করেছে। অন্য শব্দে বলা যায়, যারা আল্লাহ্ তা'আলার আদেশ মান্য করতে গাফলতি করেছে। যেমন, সাধারণভাবে ইহুদীদের নিয়ম ছিল, সামান্য স্বার্থের জন্য দীনের নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে তারা নবী-রাসূলগণের অবমাননা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করত না। ضَّآلِّیۡنَ তাদেরকে বলা হয়, যারা না বুঝে অজ্ঞতার দরুন ধর্মীয় ব্যাপারে ভুল পথের অনুসারী হয়েছে এবং ধর্মের সীমালঙ্ঘন করে অতিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হয়েছে। যথা-নাসারাগণ। তারা নবীর শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদানের নামে বাড়াবাড়ি করেছে; যেমন নবীদেরকে আল্লাহ্র পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ইহুদীদের বেলায় এটা অন্যায় এজন্য যে, তারা আল্লাহ্র নবীদের কথা মানেনি ; এমন কি তাঁদেরকে হত্যা পর্যন্ত করেছে।

আয়াতের সারমর্ম হচ্ছে- আমরা সে পথ চাই না, যা নফসানী উদ্দেশ্যের অনুগত হয় এবং মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে ও ধর্মের মধ্যে সীমালঙ্ঘনের প্রতি প্ররোচিত করে। সে পথও চাই না, যে পথ অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন ধর্মের সীমারেখা অতিক্রম করে। বরং এ দু'য়ের মধ্যবর্তী সোজা-সরল পথ চাই। যার মধ্যে না অতিরঞ্জন আছে, আর না কম-কছুরী আছে এবং যা নফসানী প্রভাব ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে।

সূরা আল-ফাতিহার আয়াত সাতটির তফসীর শেষ হয়েছে। এখন সমগ্র সূরার সারমর্ম হচ্ছে এ দোয়া- 'হে আল্লাহ্ ! আমাদিগকে সরল পথ দান করুন। কেননা, সরল পথের সন্ধান লাভ করাই সবচাইতে বড় জ্ঞান ও সর্বাপেক্ষা বড় কামিয়াবী। বস্তুত সরল পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে। অন্যথায় অ-মুসলমানদের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করার আগ্রহ-আকুতির অভাব নেই। এজন্যই কোরআন পাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতেই সিরাতে মুস্তাকীমের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।




Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url