রাহে আমল-১ || হাদীস সংকলনের ইতিহাস, হাদীস সংকলক ও হাদীসের পরিভাষা ||




হাদীস সংকলনের ইতিহাস

হাদীস শাস্ত্রের সমস্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এজন্য স্বতন্ত্র পুস্তক রচনার প্রয়োজন। এখানে হাদীসের সংগ্রহ ও সংকলনের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে। এ থেকে অনুমান করা যাবে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীসের এই অমূল্য সম্পদ এই তের শত বছর কোন কোন পর্যায় অতিক্রম করে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এ থেকে আরও জানা যাবে, কোন্ মহান ব্যক্তিগণ হিকমাত ও হেদায়াতের এই উৎসকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট সংরক্ষিত আকারে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিজেদের জীবন ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনবোধে এ কাজে জীবনবাজি রাখতেও পশ্চাৎপদ হননি।

তিনটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীসসমূহ আমাদের নিকট পৌঁছেছে। 
(১) লিখিত আকারে, 
(২) স্মৃতিতে ধরে রাখার মাধ্যমে; 
(৩) পঠন-পাঠনের মাধ্যমে। 

হাদীস সংগ্রহ, বিন্যাস ও পুস্তকাকারে সংকলনের সময়টাকে চার যুগে বিভক্ত করা যায়।

হাদীস সংকলনের প্রথম যুগ

নবী পাক (সা)-এর যুগ থেকে ১ম হিজরী শতকের শেষ পর্যন্ত এই যুগের হাদীস সংগ্রাহক, সংকলক ও মুখস্তকারীগণের পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

হাদীসের প্রসিদ্ধ সাহাবা হাফেজ

হযরত আবু হুরায়রা (রা) (আবদুর রহমান): ৭৮ বছর বয়সে ৫৯ হিজরীতে ইঞ্জি কাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত (বর্ণিত) হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪ এবং তাঁর ছাত্র সংখ্যা ৮০০ পর্যন্ত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা): ৭১ বছর বয়সে ৬৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ২৬৬০।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা): ৬৭ বছর বয়সে ৫৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ২২১০।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)৭৪ বছর বয়সে ৭৩ হিজরীতে ইন্ডিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৬৩০।
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা): ৯৪ বছর বয়সে ৭৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ১৫৬০।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা): ১০৩ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রিওয়ায়াতকৃত হাদীসের সংখ্যা ১২৮৬।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা): ৮৪ বছর বয়সে ৭৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১৭০।

এই ক'জন মহান সাহাবীর প্রত্যেকেরই এক হাজারের অধিক হাদীস মুখস্ত ছিল । তাছাড়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (মৃঃ ৬৩ হিজরী), হযরত আলী (মৃঃ ৪০ হিজরী) এবং উমার ফারুক (মৃঃ ২৩ হিজরী) রাদিয়াল্লাহু আনহুম সেইসব সাহাবীর অন্তর্ভুক্ত যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫০০ থেকে এক হাজারের মধ্যে।

অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর (মৃঃ ১৩ হিজরী), হযরত উসমান (মৃঃ ৩৬ হিজরী), হযরত উম্মে সালামা (মৃঃ ৫৯ হিজরী) হযরত আবু মুসা আশআরী (মৃঃ ৫২ হিজরী), হযরত আবু যার গিফারী (মৃঃ ৩২ হিজরী) হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (মৃঃ ৫১ হিজরী) রাদিআল্লাহু আনহুম থেকে এক শতের অধিক এবং পাঁচ শতের কম বর্ণিত আছে।

হাদীসের প্রসিদ্ধ তাবিঈ হাফেজ

সাহাবীদের ছাড়া এ যুগের একদল মহান তাবিঈর কথাও স্মরণ করতে হয় যাদের নিরলস পরিশ্রম ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় হাদীস- ভান্ডার থেকে মিল্লাতে ইসলামিয়া কিয়ামত পর্যন্ত উপকৃত হতে থাকবে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহ)

উমার ফারুক (রা)-এর খিলাফতের দ্বিতীয় বর্ষে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৫ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। তিনি হযরত উসমান (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত আবু হুরায়রা (রা), হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) প্রমুখ সাহাবার নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করে।

উরওয়া ইবনু যুবাইর

মদীনার বিশিষ্ট আলেমগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি হযরত আয়েশা (রা)-এর বোনপুত্র। তিনি তাঁর কাছ থেকেই বেশির ভাগ হাদীস বর্ণনা করেছেন। অনন্তর তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রা) ও যায়েদ ইবনে সাবেতের (রা) নিকটও হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। সালেহ ইবনে কাইসান ও ইমাম যুহরীর মত আলেমগণ তাঁর ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ৯৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন । 


সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)

মদীনার প্রসিদ্ধ সাতজন ফিকহবিলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহ অপরাপর সাহাবীর নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। নাকে, ইমাম যুহরী ও অপরাপর প্রসিদ্ধ তাবিঈগণ তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি ১০৬ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

নাফে (রা) মনিবের বিশিষ্ট ছাত্র

তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)-এর মুক্তদাস। তিনি তাঁর এবং ইমাম মালেক (র)-এর শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইবনে উমার (রা)-এর সূত্রেই বেশীর ভাগ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ১১৭ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

বর্তমান যুগের হাদীসের সংকলনসমূহ

'সহীফারে সালেকা'

এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) ইবনুল আস কর্তৃক সংকলিত হাদীস গ্রন্থ। পুস্তক রচনার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যা কিছু শুনতেন তা লিখে রাখতেন। এজন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। ৭৭ বছর বয়সে ৬৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।

এই সংকলনে প্রায় এক হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছিল। তা কয়েক যুগ ধরে তাঁর পরিবারের লোকদের কাছে সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে তা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মুসনাদ গ্রন্থে পূর্ণরূপে বিদ্যমান আছে।

সহীফায়ে সহীহা'

হাম্মাম ইবনে মুনাব্বেহ (মৃ. ১০১ হিজরী) এটা সংকলন করেন। তিনি হযরত আবু হুরায়রার (রা) ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর উস্তাদ মুহতারামের বর্ণিত হাদীসগুলো এই গ্রন্থে একত্রে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। গ্রন্থটির হস্তলিখিত কপি বার্লিন ও দামিশকের গ্রন্থাগারসমূহে সংরক্ষিত আছে। ইমাম আহমাদ (র) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রার (রা) শিরোনামে পূর্ণ গ্রন্থটি সন্নিবেশ করেছেন। এই সংকলনটি কিছুকাল পূর্বে ডঃ হামীদুল্লাহ সাহেবের প্রচেষ্টায় হায়দরাবাদ (দাক্ষিণাত্য) থেকে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ১৩৮ টি হাদীস রয়েছে।
এই সংকলনটি হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীসের একটি অংশ মাত্র। এর অধিকাংশ হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও পাওয়া যায়। মূল পাঠ প্রায় একই, বিশেষ কোন তারতম্য নাই। হযরত আবু হুরায়রার (রা) অপর ছাত্র বশীর ইবনে নাহীকও একটি সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন। আবু হুরায়রার (রা) ইন্তিকালের পূর্বে তিনি তাঁকে এই সংকলন পড়ে শুনান এবং তিনি তা সত্যায়িত করেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ডঃ হামীদুল্লাহ কর্তৃক সম্পাদিত সহীফায়ে ইবনে হাম্মাম-এর ভূমিকা।

মুসনাদে আবু হুরায়রা (রা)

সাহাবাদের যুগেই এই সংকলন প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর একটি হস্তলিখিত কপি উমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর পিতা এবং মিসরের গভর্নর আবদুল আযীয ইবনে মারওয়ান (মৃঃ ৮৬ হিজরী)-এর নিকট ছিল। তিনি কাসীর ইবনে মুররাকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, তোমাদের কাছে সাহাবায়ে কিরামের যেসব হাদীস বর্তমান আছে তা লিপিবদ্ধ করে পাঠাও। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস লিখে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। কেননা তা আমাদের কাছে লিখিত আকারে বর্তমান আছে। আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর স্বহস্তে লিখিত মুসনাদে আবি হুরায়রা (রা)-এর একটি কপি জার্মানীর গ্রন্থাগারসমূহে বর্তমান আছে। (তিরমিযীর শরাহ তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থের ভূমিকা, পৃ ১৬৫)

সহীফায়ে হযরত আলী (রা)

ইমাম বুখারী (র)-এর ভাষ্য থেকে জানা যায়, এই সংকলনটি বেশ বড় ছিল। এর মধ্যে যাকাত, মদীনার হেরেম, বিদায় হজ্জের ভাষণ ও ইসলামী সংবিধানের ধারাসমূহ বিবৃত ছিল। (সহীহ বুখারী কিতাবুল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, ১ম খন্ড পৃ ৪৫১) 

নবী পাক (সা)-এর লিখিত ভাষণ

মক্কা বিজয়কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু শাহ ইয়ামাन (রা)-র আবেদনক্রমে তাঁর দীর্ঘ ভাষণ লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ভাষণ মানবাধিকারের বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত। (সহীহ বুখারী ১ম খন্ড, পৃ. 20 )

সহীফা হযরত জাবির (রা)

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁর ছাত্র ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ (মৃঃ ১১০ হিজরী) ও সুলাইমান ইবনে কায়েস লশকোরী লিখিত আকারে সংকলন করেছিলেন। এই সংকলনে হজ্জের নিয়মাবলী ও বিদায় হজ্জের ভাষণ স্থান লাভ করে।

রেওয়ায়াতে আয়েশা সিদ্দীকা (রা)

হযরত আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁর ছাত্র ও বোনপুত্র উরওয়া ইবনু যুবায়ের (র) লিখে নিয়েছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৮৩) 

আহাদীসে ইবনে আব্বাস (রা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর রিওয়ায়াতসমূহের সংকলন। তাবিঈ হযরত সাঈদ ইবন জুবায়েরও তাঁর হাদীসসমূহ লিখিত আকারে সংকলন করতেন । (পারমী, পৃ. ৬৮)

সহীফা আনাস ইবন মালেক (রা)

সাঈদ ইবনে হেলাল বলেন, আনাস (রা) তাঁর স্বহস্ত লিখিত সংকলন বের করে আমাদের দেখাতেন এবং বলতেন, এই হাদীসগুলো আমি সরাসরি রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট শুনেছি এবং লিপিবদ্ধ করার পর তা পাঠ করে তাঁকে শুনিয়ে সত্যায়িত করে নিয়েছি। (সহীফায়ে হাম্মামের ভূমিকা পৃ, ৩৪)

আমর ইবনে হাযম (রহ)

যাকে ইয়ামানের গভর্ণর নিয়োগ করে পাঠানোর সময় নবী (সা) একটি লিখিত নির্দেশনামা দিয়েছিলেন। তিনি কেবল এই নির্দেশনামাই সংরক্ষণ করেননি, বরং এর সাথে নবী (স)-এর আরও ফরমান যুক্ত করে একটি সুন্দর সংকলন তৈরি করেন। (ডঃ হামীদুল্লাহ, আল ওয়াসাইকুস সিয়াসিয়া, পৃ. ১০৫)

রিসালা সামুরা ইবন জুনদুব (রা)

তাঁর সন্তান এটা তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হন। এটা হাদীসের একটা উল্লেখযোগ্য সংকলন ছিল। (তাহযীবুত তাহযীব, ৪র্থ খন্ড, পৃ ২৩৬) (১২) সহীফা সা'দ ইবনে উবাদা (রা) এই সাহাবী জাহিলী যুগ থেকেই লেখাপড়া জানতেন ।

মাআন থেকে বর্ণিত

তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর পুত্র আব্দুর রহমান আমার সামনে একটি কিতাব এনে শপথ করে বললেন, এটা আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) স্বহস্তে লিখিত। (জামিউল ইলম, পৃ.৩৭)

মাকতুবাত নাফে (র)

সুলাইমান ইবনে মূসা বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হাদীস বলতেন আর তাঁর ছাত্র নাফে তা লিপিবদ্ধ করতেন। (দারিমী, পৃ.৬৯, সহীফা ইবনে হাম্মামের ভূমিকা, পৃ.৪৫ )

যদি গবেষণা ও অনুসন্ধানের ধারা অব্যাহত রাখা হয় তবে উল্লিখিত সংকলনগুলো ছাড়া আরও অনেক সংকলনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এই যুগে সাহাবায়ে কেরাম ও প্রবীণ তাবিঈগণ বেশীরভাগ নিজেদের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে সংরক্ষিত হাদীসসমূহ লিখে রাখার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ আরও ব্যাপকতা লাভ করে। হাদীস সংকলকগণ নিজেদের ব্যক্তিগত ডান্ডারের সাথে নিজ নিজ শহর ও অঞ্চলের মুহাদ্দিসগণের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সংগ্রহও একত্র করেন ।

হাদীস সংকলনের দ্বিতীয় যুগ

এই যুগটি প্রায় দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে গিয়ে শেষ হয়। এই যুগে তাবিঈদের একটি বিরাট দল তৈরি হয়ে যায়। তাঁরা প্রথম যুগের লিখিত ভাণ্ডারকে ব্যাপক সংকলনসমূহে একত্র করেন। এই যুগের হাদীস সংকলকগণ হলেন :

মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব

ইমাম যুহরী নামে সমাধিক প্রসিদ্ধ (মৃ. ১২৪ হিজরী)। তিনি নিজ যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা), আনাস ইবন মালেক (রা), সাহল ইবনে সা'দ (রা) এবং তাবিঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (র) ও মাহমূল ইবন রাবী (র) প্রমুখের নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম আওযাঈ (র) ও ইমাম মালেক (র) এবং সুফিয়ান ইবন উয়াইনা (র)-এর মত হাদীসের প্রখ্যাত ইমামগণ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে গণ্য। ১০১ হিজরীতে উমার ইবনে আব্দুল আযীয (র) তাঁকে হাদীস সংগ্রহ করে তা একত্র করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি মদীনার গভর্নর আবু বাকর মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হামকে নির্দেশ দেন যেন তিনি আবদুর রহমান-কন্যা আমরাহ ও কাসিম ইবনে মুহাম্মাদের নিকট হাদীসের যে ভান্ডার রয়েছে তা লিখে নেন। এই আমরাহ (র) হযরত আয়েশা সিদ্দীকার (রা) বিশিষ্ট ছাত্রী ছিলেন এবং কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র। হযরত আয়েশা (রা) নিজের তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব, খ., পৃ. 172 )

কেবল এখানেই শেষ নয়, বরং হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয (র) ইসলামী রাষ্ট্রের সকল দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে হাদীসের এই বিরটি ভান্ডার সংগ্রহ ও সংকলনের জোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে হাদীসের বিরাট সম্পদ রাজধানীতে পৌঁছে গেল। খলীফা হাদীসের সংকলন প্রস্তুত করিয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। (তাযকিরাতুল হুফ্ফাজ, খ. ১ পৃ. ১০৬; জামিউল ইলম, পৃ. ৩৮)

ইমাম যুহরীর সংগৃহীত হাদীস সংকলন করার পর এই যুগের অপরাপর আলেমগণও হাদীসের গ্রন্থ সংকলনের কাজ শুরু করেন। আবদুল মালেক ইবনে জুরাইজ (মৃ. ১৫০ হিজরী) মক্কায়, ইমাম আওযাই (মৃ. ১৫৭ হিজরী) সিরিয়ায় মামার ইবনে রাশেদ (মৃ.১৫৩ হিজরী) ইয়ামানে, ইমাম সুফিয়ান সাওরী (মৃ. ১৬১ হিজরী)

কুফায়, ইমাম হাম্মাদ ইবনে সালামা (মৃ. ১৬৭ হিজরী) বসরায় এবং ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (মৃ. ১৮১ হিজরী) খোরাসানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন।

ইমাম মালেক ইবন আনাস (রহ)

(জন্ম ৯৩ হিজরী, মৃত্যু ১৭৯ হিজরী) ইমাম যুহরীর পরে মদীনায় হাদীস সংকলন ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন। তিনি নাফে, যুহরী ও অপরাপর আলেমের ইলম দ্বারা উপকৃত হন। তাঁর শিক্ষক সংখ্যা নয় শত পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাঁর জ্ঞানের প্রস্রবণ থেকে সরাসরি হেজায, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তীন, মিসর, আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার (স্পেন) হাজারো হাদীসের শিক্ষাকেন্দ্র তৃপ্ত হয়েছে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে লাইস ইবনে সা'দ (মৃ. ১৭৫ হিজরী), ইবনুল মুবারক (মৃ. ১৮১ হিজরী), ইমাম শাফিঈ (মৃ. ২০৪ হিজরী) ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানী (মৃ. ১৮৯ হিজরী)- এর মত মহান ইমামগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

এই যুগে হাদীসের অনেকগুলো সংকলন রচিত হয়, যার মধ্যে ইমাম মালেক (র)- এর মুওয়াত্তা বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এই গ্রন্থ ১৩০ হিজরী থেকে ১৪১ হিজরীর মধ্যে সংকলিত হয়। এতে মোট ১৭০০ রিওয়ায়াত আছে। তার মধ্যে ৬০০টি মারুফ, ২২৮ টি মুরসাল, ৬১৩টি মাওকুফ রিওয়ায়াত এবং তাবিঈদের ২৮৫টি বাণী রয়েছে। এ যুগের আরও কয়েকটি সংকলনের নাম নিম্নে দেয়া হল :

১। জামে' সুফিয়ান সাওরী (মৃ. ১৬১ হিজরী) ২। জামে ইবনুল মুবারাক, ৩। জামে ইবনে আওযাঈ (মৃ. ১৫৭ হিজরী), ৪। জামে ইবনে জুরাইজ (মৃ. ১৫০ হিজরী), ৫। ইমাম আবু ইউসুফ (মৃ. ১৮৩ হিজরী)-এর কিতাবুল বিরাজ, ৬। ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুল আসার। এই যুগে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীস, সাহাবাদের আসার (বাণী) এবং তাবিঈদের কতোয়াসমূহ একই সংকলনে সন্নিবিষ্ট করা হত। কিন্তু সাথে একথাও বলে দেওয়া হত যে, কোনটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীস এবং কোনটি সাহাবা অথবা তাবিঈদের বাণী ।

হাদীস সংকলনের তৃতীয় যুগ

এই যুগে প্রায় দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :

(১) এই যুগে নবী পাকের (স) হাদীসসমূহকে সাহাবাদের আসার ও তাবিঈনের বাণী থেকে পৃথক করে সংকলন করা হয়।

(২) নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহের পৃথক সংকলন প্রস্তুত করা হয়। এভাবে যাচাই-বাছাই এবং গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর দ্বিতীয় যুগের সংকলনসমূহ তৃতীয় যুগের বিরাট গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

(৩) এই যুগে হাদীসসমূহ কেবল জমা করাই হয়নি, বরং ইলমে হাদীসের হেফাযতের জন্য মহান মুহাদ্দিসগণ এই ইলমের এক শতাধিক শাখার ভিত্তি স্থাপন করলেন, যার উপর বর্তমান কাল পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন এবং তাঁদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করুন।

হাদীসের জ্ঞানের শাখাসমূহ

সংক্ষিপ্তভাবে এখানে হাদীসের জ্ঞানের কয়েকটি শাখার পরিচয় দেয়া হল :

ইলম আসমাইর রিজাল (রিজাল শাস্ত্র)

এই শাস্ত্রে হাদীস বর্ণনাকারী রাবীদের পরিচয়, জন্ম-মৃত্যু, শিক্ষক ও ছাত্রদের বিবরণ, জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যাপক ভ্রমণ এবং নির্ভরযোগ্য (সিকাহ) বা অনির্ভরযোগ্য হওয়া সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত সন্নিবেশিত হয়েছে। জ্ঞানের এই শাখা বহু ব্যাপক, উপকারী ও আকর্ষণীয়। কোন কোন গোঁড়া প্রাচ্যবিদও স্বীকার না করে পারেননি যে, রিজাল শাস্ত্রের বদৌলতে পাঁচ লাখ রাবীর জীবন ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে। মুসলিম জাতির এই নজীর অন্য কোন জাতির মধ্যে পাওয়া অসম্ভব। রিজাল শাস্ত্রের উপর শত শত গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। কয়েকটি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা

(ক) তাহযীবুল কামাল: গ্রন্থকার ইমাম ইউসুফ আল ম্যিী (মৃ. ৭৪২ হিজরী) রিজাল শাস্ত্রের এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।

(খ) তাহযীবুত তাহযীব: গ্রন্থকার সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবন হাজার আল-আসকালানী (মৃ. ৮৫২ হিজরী) গ্রন্থটি ১২ খন্ডে বিভক্ত এবং হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য) থেকে প্রকাশিত ।

(গ) তাযকিরাতুল হুফফাজ: গ্রন্থকার শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (মৃ. ৭৪৮ হিজরী,) গ্রন্থটি পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত।

ইলম মুসতালাহুল হাদীস (উসুলে হাদীস)

এ শাস্ত্রের সাহায্যে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দূর্বলতা যাচাইয়ের নিয়ম-কানুন জানা যায়। এই শাখার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে 'উলুমুল হাদীস'। এটা 'মুকাদ্দামা ইবলিস সালাহ' নামে পরিচিত। এর রচয়িতা হচ্ছেন আবু উমার ওয়া উসমান ইবনুস সালাহ্ (মৃ. ৫৭৭ হিজরী)।

নিকট অতীতে উসূলুল হাদীসের উপর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে-
(ক) তাওজীহুন নাজার, গ্রন্থকার আল্লামা তাহের ইবনে সালেহ জাযাইরী (মৃ. ১৩৩৮ হিজরী)
(খ) কাওয়াইদুল হাদীস, গ্রন্থকার আল্লামা সায়্যিদ জামালুদ্দীন কাসিমী (মৃ. ১৩৩২ হিজরী)। 

প্রথমোক্ত গ্রন্থে হাদীসের মূলনীতি (উসূল) শাস্ত্র সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে এবং শেষোক্ত গ্রন্থে এই জ্ঞানকে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

ইলম আরীবুল হাস

এই শাস্ত্রে হাদীসের কঠিন ও দ্ব্যর্থবোধক শব্দসমূহের আভিধানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই শাস্ত্রে আল্লামা যামাখশারী (মৃ. ৫৩৮ হিজরী)-এর 'আল্-ফাইক' এবং ইবনুল আছীর (মৃ. ৬০৬ হিজরী)-এর 'নিহায়া' গ্রন্থদ্বয় উল্লেখযোগ্য।

ইলম তাখরীজিল আহাদীস

প্রসিদ্ধ তাফসীর, ফিক্হ, ভাসাওউফ ও আকাইদ-এর গ্রন্থমূহে যেসব হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে- ইলমের এই শাখার মাধ্যমে তার উৎস সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। যেমন-বুরহানুদ্দীন আলী ইবনে আবি বাক্ আল মারগীনানী (মৃ. ৫৯২ হিজরী)- এর 'আল-হিদায়া' নামক ফিক্হ গ্রন্থে এবং ইমাম গাযালী (মৃ. ৫০৫ হিজরী)-এর ইইয়াউ উলুম গ্রন্থে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তার সনদ ও গ্রন্থ বরাত উল্লেখ করা হয়নি। এখন কোন পাঠক যদি জানতে চায় এই হাদীসগুলো কোন্ পর্যায়ের এবং হাদীসের কোন্ সব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তা উল্লেখ আছে, তবে প্রথমোক্ত গ্রন্থের জন্য হাফেয যাইলাঈ (মৃ. ৭৯২ হিজরী)-এর 'নাসাবুর রাইয়াহ ও হাফেয ইবনে হাজার আল আসকালানীর 'আদ-দিরাইয়াহ' গ্রন্থদ্বয়ের সাহায্য নিতে হবে। আর শেষোক্ত গ্রন্থের জন্য হাফেজ যায়নুদ্দীন ইরাকী (মৃ. ৮০৬ হিজরী)-এর 'আল-মুগনী আন হামালিল আসফার' গ্রন্থের সাহায্য নিতে হবে ।

ইলমুল আহাদিসুল মাওদুআহ

এই বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞ আলেমগণ স্বতন্ত্র গ্রন্থ সংকলন করেছেন এবং মাওদু (মনগড়া) রিওয়ায়াতগুলো পৃথক করে দিয়েছেন। এ বিষয়ের উপর কার্যী শাওকানী (মৃ. ১২৫৫ হিজরী)- এর 'আল-আওয়াইদুল মাজমুআহ' এবং হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়তী (৯১১ হিজরী)-এর 'আল-লালিল মাসনুআহ' গ্রন্থদ্বয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । 

ইলমুন মাখিস ওরাল মানসুখ

এই শাস্ত্রের উপর ইমাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা হাযিমী (মৃ. ৭৮৪ হিজরী)-এর 'কিতাবুল ইতিবার' অধিক প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য।

ইলমুত তাওফীক বাইনাল আহাদীস

যেসব হাদীসের বক্তব্যের মধ্যে বাহ্যত পারস্পরিক বৈপরিত্য লক্ষ্য করা যায়, জ্ঞানের এই শাখায় তার সঠিক ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ইমাম শাফিঈ (মৃ. ২০৪ হিজরী) এই বিষয়ের উপর আলোচনা করেন। তাঁর পুস্তিকাখানি 'মুখতালিকুল হাদীস' নামে প্রসিদ্ধ। ইমাম তাহাবী (মৃ. ৩২১ হিজরী)-এর 'মুশকিলুল আহার'ও এ বিষয়ে একখানি সহায়ক গ্রন্থ।

ইলমুল মুখতালিক ওয়াল মুতালিক

এই শাখায় হাদীসের যেসব রাবীর নাম, ডাকনাম, উপাধি, পিতা ও দাদার অথবা শিক্ষকদের নাম পরস্পর সংমিশ্রিত হয়ে গেছে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মিশ্রণ জনিত এই সংশয়ের কারণে যে কোন অনভিজ্ঞ লোক ভুলের শিকার হতে পারে। এই বিষয়ের উপর ইবনে হাজার আল-আসকালানী (র)-এর 'ভাবীরুল মুক্তাবিহ গ্রন্থখানি অধিক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ।

ইলম আতরাফিল হাদী

জ্ঞানের এই শাখার সাহায্যে কোন হাদীস কোন গ্রন্থে আছে এবং কে কে তার রাবী তা জানা যায়। যেমন কোন ব্যক্তির ইন্নামাল আমালু বিন-নির্যাত' হাদীসের একটি বাক্য মনে আছে। সে পূর্ণ হাদীসটি এবং সকল রাবী ও হাদীসের কোন্ গ্রন্থে তা আছে সেটা জানতে চায়। তখন তাকে এই শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হবে। এই বিষয়ে হাফেজ মিযযী (মৃ.৭৪২ হিজরী)-এর 'তুহফাতুল আশরাফ' গ্রন্থখানি অধিক ব্যাপক ও বিস্তৃত। এই গ্রন্থে সিহাহ্ সিত্তার সব হাদীসের সূচি এসে গেছে। এই গ্রন্থের বিন্যাসে তাঁর ২৬ বছর সময় লেগেছে। কঠোর পরিশ্রমের পর গ্রন্থখানি পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়।

বর্তমান কালে প্রাচ্যবিদগণ এইসব গ্রন্থের সাহায্যে কিছুটা নতুন ঢং-এ হাদীসের সূচি প্রস্তুত করেছেন। যেমন: 'মিফতাহ্ কুনুষিস্ সুন্নাহ' গ্রন্থখানি ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৩৪ খৃ. মিসর থেকে এর আরবী সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে 'আল-মুজামুল মাফাহরাস লি- আলফাজিল হাদীসিন্ নাবাবী' নামে একটি সূচী এ. জে. ব্রিল কর্তৃক লাইডেন (নেদারল্যাণ্ড) থেকে আরবীতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা বৃহৎ সাত খণ্ডে বিভক্ত এবং এতে সিহাহ সিত্তা ছাড়াও মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ ও সারিমীর হাদীস সূচীও যোগ করা হয়েছে।

ফিকহুল হাদীস

এই শাখায় হুকুম-আহকাম সম্বলিত হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ের উপর হাফেজ ইবনুল কাইয়োম (মৃ. ৭৫১ হিজরী)-এর ই'লামুল মুকিঈন এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (মৃ. ১১৭৬ হিজরী)-এর 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ' গ্রন্থদ্বয়ের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও বিশেষজ্ঞ আলেমগণ জীবন ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন। যেমন- অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে আৰু উবায়েন কাসিম ইবনে সাল্লাম (মৃ. ২২৪ হিজরী)-এর 'কিতাবুল আমওয়াল' গ্রন্থ সুপ্রসিদ্ধ এবং জমীন, উপর, খাজনা প্রভৃতি বিষয়ের উপর ইমাম আবু ইউসুফ (মৃ. ১৮২ হিজরী)-এর 'কিতাবুল খারাজ' একটি সর্বোত্তম সংকলন। অনন্তর হাদীস শরীআ আইনের অন্যতম দ্বিতীয় উৎস হওয়া সম্পর্কে এবং হাদীস প্রত্যাখানকারীদের (মুনকিরীনে হাদীস) ছড়ানো ভ্রান্ত মতবাদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলো অত্যন্ত উপকারী।

(১) কিতাবুল উম্ম ৭ খন্ড, 
(২) আর-রিসালা ইমাম শাফিঈ, 
(৩) আল- মুওয়াফিকাত ৪ খণ্ড, এর রচিয়তা হচ্ছেন আবু ইসহাক শাতিবী, (মৃ. ৭৯০ হিজরী), (৪) সাওয়াইক মুরসিলা (২ খণ্ড), রচয়িতা ইবনুল কাইয়োম, 
(৫) ইবনে হাযম আন্দালুসী (মৃ. ৪৫৬ হিজরী)-এর 'আল-আহকাম', 
(৬) মাওলানা বদরে আলম মীরাঠির মুকাদ্দামা তারজুমানুস সুন্নাহ (উর্দু), 
(৭) অত্র গ্রন্থের সংকলকের পিতা মাওলানা হাফেজ আবদুস সাত্তার হাসান উমরপুরীর ইসবাতুল খাবার' 
(৮) মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর 'হাদীস আওর কুরআন'। অনন্তর 
(৯) ইনকারে হাদীস কা মানজার আওর পাস মানজার' নামে জনাব ইফতেখার আহমাদ বালবীর গ্রন্থখানিও সুখপাঠ্য। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির দুই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

ইলমে হাদীসের ইতিহাস ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (র)-এর 'ফাতহুল বারী' গ্রন্থের ভূমিকা, হাফেজ ইবনে আবদিল বার আল-আন্দাসুলী (মৃ. ৪৬৩ হিজরী)-এর 'জামি বায়ানি ইল্‌ম ওয়া আলিহি', ইমাম হাকেম নিশাপুরী (মৃ. ৪০৫ হিজরী)-এর মারিফাতু উলুমিল হাদীস, মাওলানা আবদুর রহমান (মুহাদ্দিস) মুবারকপুরী (মৃ. ১৩৫৩ হিজরী)- এর 'তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থের ভূমিকা। নিকট অতীতে রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এই শেষোক্ত গ্রন্থটি আলোচনার ব্যাপকতা ও প্রয়োজনের দিক থেকে একটি শ্রেষ্ঠ অবদান । অনুরূপভাবে মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানীর 'ফাতহুল মুলহিম' গ্রন্থের ভূমিকা এবং মাওলানা মানাজির আহসান গীলানীর 'তাদবীনে হাদীস' (উর্দু) গ্রন্থস্বপ্নেও ইলমে হাদীসের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয় যুগের হাদীস সংকলকবৃন্দ

এ যুগের প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলকবৃন্দ ও নির্ভরযোগ্য সংকলনসমূহের পরিচয় নিজে দেয়া হলঃ

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল

(জন্ম ১৬৪ হিজরী; মৃ. ২৪১ হিজরী)-এর গুরুত্বপূর্ণ সংকলন 'মুসনাদে আহমাদ' নামে পরিচিত। এতে তিরিশ হাজার হাদীস (পুনরাবৃত্তিসহ) বর্তমান রয়েছে। গ্রন্থটি ৫খণ্ডে বিভক্ত। উল্লেখযোগ্য সব হাদীস এতে সংগৃহীত হয়েছে। এতে বিষয়সূচি অনুযায়ী বিন্যাসের পরিবর্তে প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত সব হাদীস একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের হাদীসগুলো বিষয়সূচি অনুযায়ী বিন্যাস করার কাজ শায়খ হাসানুল বান্না শহীদের পিতা আহমাদ আবদুর রহমান সাজাতী শুরু করেছিলেন। তাঁর এ গ্রন্থটি ২৪ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী

(জন্ম ১৯৪ হিজরী, মৃ. ২৫৬ হিজরী)। তাঁর জন্ম তারিখ 'সত্যবাদিতা' এবং মৃত্যু তারিখ নূর বিচ্ছুরণ করে। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে সহীহ বুখারী। এর পূর্ণ নাম 'আল-জামিউস সহীহুল মুসনাদুল মুখতাসার্ মিন উমুরি রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়া আইয়্যামিহি।

এই গ্রন্থ সংকলনে ১৬ বছর সময় লেগেছে। তাঁর কাছে সরাসরি সহীহ বুখারী অধ্যয়নকারী ছাত্রের সংখ্যা ৯০ হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। কখনও কখনও একই মজলিসে উপস্থিতদের সংখ্যা ২ হাজারে পৌঁছে যেত। এই ধরনের মজলিসে পরপর পৌঁছে দেয়া লোকদের সংখ্যা তিন শতের অধিক হত (কারণ তখন মাইক বা লাউড স্বীকারের সুবিধা ছিল না)। এই গ্রন্থে মোট ৯,৬৮৪টি হাদীস রয়েছে। পুনরুক্তি ও তা'লীকাত (সনদবিহীন রিওয়ায়াত), শাওয়াহিদ (সাহাবাদের বাণী) ও মুরসাল হাদীস বাদ দিলে শুধু মারফু হাদীসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬,২৩০-এ। ইমাম বুখারী (র) অপরাপর মুহাদ্দিসের তুলনায় অধিক শক্ত মানদণ্ডে রাবীদের যাচাই বাছাই করেছেন।

ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আবুল হুসাইন আল-কুশাইরী

(জন্ম ২০২ হিজরী; মৃ. ২৬১ হিজরী)। ইমাম বুখারী এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) তাঁর শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমাম তিরমিযী, আবু হাতিম রাযী ও আবু বাক্ ইবনে খুযাইমা তাঁর ছাত্র ছিলেন। তাঁর সংকলিত গ্রন্থ 'সহীহ মুসলিম' বিন্যাসগত দিক থেকে সুপ্রসিদ্ধ। এই গ্রন্থে মোট ১,১৯০টি হাদীস (পুনরুক্তিসহ) রয়েছে।

ইমাম আবু দাউদ আশআছ ইবনে সুলাইমান আস-সিজিস্তানী

(জন্ম ২০২ হিজরী; মৃ. ২৭৫) 'সুনান আবি দাউদ' নামে প্রসিদ্ধ। এই গ্রন্থে আহকাম সম্পর্কিত হাদীস পরিপূর্ণরূপে একত্র করা হয়েছে। ফিকহী ও আইনগত বিষয়ের জন্য এই গ্রন্থ একটি উত্তম উৎস। এতে ৪, ৮০০ হাদীস রয়েছে। ( কিন্তু এর ইংরেজী সংস্করণে ক্রমিক নং ৫২৫৪ পর্যন্ত পৌঁছেছে- অনুবাদক)।

ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী

(জন্ম ২০৯ হিজরী; মৃ. ২৭৯ হিজরী)। তাঁর সংকলিত গ্রন্থ 'জামে আত তিরমিযী' নামে পরিচিত। এতে ফিকহী বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এবং একই বিষয়ে যে যে সাহাবীর হাদীস রয়েছে তাঁর নামও উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম আহমদ ইবনে শুআইব নাসাঈ

(মৃ. ৩০৩ হিজরী)। তাঁর সংকলনের নাম 'আস-সুনানুল মুজতাবা; যা সুনানে নাসাঈ' নামে প্রসিদ্ধ।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে মাজা কাৰ্যবীনী

(মৃ. ২৭৩ হিজরী)। তাঁর সংকলিত গ্রন্থ 'সুনানে ইবনে মাজা' নামে প্রসিদ্ধ। মুসনাদে আহমাদ' গ্রন্থ ছাড়া উল্লিখিত ছ'টি গ্রন্থকে হাদীস বিশারদদের পরিভাষায় 'সিহাহ সিত্তা' বলা হয়। কোন কোন বিশেষজ্ঞ আলেম ইবনে মাজাহ্ গ্রন্থের পরিবর্তে ইমাম মালেকের 'মুওয়াত্তা' গ্রন্থকে সিহা সিত্তার মধ্যে গণ্য করেন।

উল্লিখিত গ্রন্থগুলি ছাড়া এ যুগে আরও অনেক প্রয়োজনীয় এবং পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী- এই তিনটি গ্রন্থকে একত্রে 'জামি' বলা হয়। অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, নৈতিকতা, পারস্পরিক লেনদেন ও আচার-ব্যবহার ইত্যাদি শিরোনামের অধীন হাদীসসমূহ এতে বর্তমান আছে। আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাকে একত্রে সুনান বলা হয়। অর্থাৎ এই গ্রন্থগুলোতে বাস্তব কর্মজীবনের সাথে সম্পর্কিত হাদীসই বেশী স্থান পেয়েছে। 

হাদীসের গ্রন্থাবলীর স্তরবিন্যাস

হাদীস বিশারদগণ রিওয়ায়াতের যথার্থতা ও নির্ভযোগ্যতার তারতম্য অনুযায়ী হাদীসের গ্রন্থাবলীকে চার স্তরে বিভক্ত করেছেন :

(১) মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম-এই তিনটি গ্রন্থ সনদে বিশুদ্ধতা ও রাবীদের নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।

(২) আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ এই তিনটি গ্রন্থের কোন কোন রাবী নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে প্রথম স্তরের গ্রন্থাবলীর রাবীদের তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। কিন্তু তবুও তাদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকার করা হয়। মুসনাদে আহমাদও এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত।

(৩) আবু মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আদ-দারিমী (মৃ. ২৫৫ হিজরী)-এর 'সুনান' (মুসনাদ), ইবনে মাজা, বায়হাকী, দারেকুতনী (মৃ. ৩৮৫/১৯৯৫), তাবারানী (মৃ. ৩৬০ হিজরী)-এর সংকলনসমূহ, তাহাবী (মৃ. ৩১১ হিজরী)-এর সংকলনসমূহ, মুসনাদে শাফিঈ (মৃ. ৪৬৩ হিজরী)-র গ্রন্থাবলী, আবু নাঈম (মৃ. ৪০৩ হিজরী), ইবনে আসাকির (মৃ. ৫৭১ হিজরী), নায়লামী (মৃ. ৫০৯ হিজরী)-র ফিরদাওস, ইবনে আলী (মৃ. ৩৬৫/৯৭)-র আল কামিল, ইবনে মারদাবিয়া (মৃ. ৪১০ হিজরী)-র গ্রন্থাবলী, ওয়াকিদী (মৃ. ২০৭ হিজরী)-র সংকলন এবং এই পর্যায়ের অপরাপর গ্রন্থকারের গ্রন্থাবলী চতুর্থ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। এসব গ্রন্থে সব ধরনের হাদীস স্থান পেয়েছে। এমনকি অনেক মাওদু (মনগড়া) রিওয়ায়াতও এর মধ্যে রয়েছে। সাধারণ বক্তাগণ, ঐতিহাসিকগণ এবং তাসাওউফপন্থীগণ বেশীর ভাগ এসব গ্রন্থের আশ্রয় নিয়ে থাকেন অবশ্য যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে এসব গ্রন্থের মধ্যেও অতি মূল্যবান মনিমুক্তা পাওয়া যায়।

হাদীস সংকলনের চতুর্থ যুগ

এই যুগ হিজরী পঞ্চম শতক থেকে শুরু হয় এবং তা বর্তমান কাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে তৃতীয় যুগের গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্তি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই যুগে যে কাজ হয়েছে তার বর্ণনা নিম্নে দেয়া হল:

(১) হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলীর ভাব্যগ্রন্থ, টীকা এবং অন্যান্য ভাষায় তরজমা গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

(২) হাদীসের যেসব শাখা-প্রশাখার কথা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, সেসব বিষয়ের উপর এই যুগেই অসংখ্য গ্রন্থ এবং এসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও সারসংক্ষেপ রচিত
হয়েছে ।

(৩) বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নিজেদের আগ্রহ অথবা প্রয়োজনের তাগিদে তৃতীয় যুগের রচিত গ্রন্থাবলী থেকে হাদীস চয়ন করে প্রয়োজনীয় গ্রন্থ প্রস্তুত করেছেন। এ ধরনের কয়েকটি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা হল:

(ক) মিশকাতুল মাসাবীহ সংকলক ওয়ালীউদ্দীন খতীব ভাবরীবী। নির্বাচিত সংকলনগুলোর মধ্যে এটাই সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। এতে সিহাহ সিত্তার প্রায় সব হাদীস এবং আরও দশটি মৌলিক গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, পারস্পরিক লেনদেন ও আচার ব্যবহার, চরিত্র, নৈতিকতা, শিষ্টাচার এবং আখেরাত সম্পর্কিত রিওয়ায়াতসমূহ একত্র করা হয়েছে।

(খ) রিয়াদুস সালেহীন: সংকলক ইমাম আবু যাকারিয়া ইবনে শারাফুদ্দীন নববী (মৃ.৬৭৬ হিজরী)। তিনি সহীহ মুসলিমেরও ভাষ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটা বেশীর ভাগ চরিত্র, নৈতিকতা ও শিষ্টাচার সম্পর্কিত হাদীস সম্বলিত একটি চয়নিকা । প্রতিটি অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে প্রাসঙ্গিক আয়াতও উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই এই গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সহীহ বুখারীর সংকলন এবং বিন্যাস পদ্ধতিও এইরূপ।

(গ) মুনতাকাল আখবার: সংকলক মাজদুদ্দীন আবুল বারাকাত আবদুস সালাম ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ৬৫২ হিজরী)। তিনি শায়খুল ইসলাম ডাকিউদ্দীন আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ৭২৮ হিজরী)-র দাদা। আল্লামা শাওকানী 'নাইনুল আওতার' নামে (আট খণ্ডে) এই গ্রন্থের একটি শরাহ (ভাষা গ্রন্থ) লিখেছেন।

(ঘ) বুলুগুল মারাম: সংকলক সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (মৃ. ৮৫২ হিজরী। এই চয়নিকায় ইবাদত ও মুআমালাত সম্পর্কিত হাদীসই অধিক সন্নিবেশিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আস-সানআনী (মৃ. ১১৮২ হিজরী) 'সুবুলুস সালাম' শিরোনামে আরবী ভাষায় এবং নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান (মৃ. ১৩০৭ হিজরী), “মিসকুল খিতাম' নামে ফারসী ভাষায় এর ভাষ্য লিখেছেন ।

হিমালয়ান উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দিহলবী (মৃ.- ১০৫২ হিজরী) সুসংগঠিতভাবে ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু করেন। তাঁর পরে শাহ ওয়ালীউল্লাহ (মৃ. ১১৭৬ হিজরী), তাঁর পুত্রগণ, পৌত্রগণ এবং সুযোগ্য শাগরিদবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই অংশ সুন্নাতে নববীর আলোকে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে।

“পৃথিবী তার প্রভুর নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।" (সূরা যুমার- ৬৯)

শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র)-এর পর থেকে হাদীসের অনুবাদ গ্রন্থ, ব্যাখ্যা এবং চয়নিকা গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশের পূণ্যময় কাজ আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। 'ইস্তেখাবে হাদীস' গ্রন্থখানিও এই প্রচেষ্টারই অংশবিশেষ। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের সংকলকও হাদীসের সেবকগণের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে, যেসব মহান ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস সংকলন ও তার প্রচারে নিজেদের তুলনা হতে পারে না। এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে অনুমান করা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কোন একটি যুগেও হাদীসের চর্চা বন্ধ হয়নি।

হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা 

১. হাদীস: রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুয়াতী জীবনের সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদনকে হাদীস বলে।
২. মুহাদ্দিস: যিনি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলে।
৩. মারফু: যে হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা রাসূলুল্লাহ (স)-থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান থেকে কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েনি, তাকে মারফু হাদীস বলে ।
৪. মাওকুফ: যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র শুধু সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাওকুফ বলে।
৫. মাকতু: সেসব হাদীসের বর্ণনা সূত্র শুধু কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাকতু বলে।
৬. মুত্তাসিল: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে । 
৭. মুনকাতি: যে হাদীসের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানের কোন এক স্তরে কোন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস বলে ।
৮. মুরসাল: সনদের মধ্যে তাবিঈর পর বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়লে তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
৯. মুদাল: যে হাদীসের সনদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে দু'জন বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়ে গেছে তাকে হাদীসে মুদাল বলে।
১০. মুদাল্লাছ: যেসব হাদীসে রাবী উর্ধ্বতন রাবীর সন্দেহযুক্ত শব্দ প্রয়োগে উল্লেখ করেছেন, তাকে মুদাল্লাছ হাদীস বলে।
১১. মুআত্মাক: যে হাদীসে সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুআল্লাক হাদীস বলে।
১২. মুআল্লাল: যে হাদীসের সনদে বিশ্বস্ততার বিপরীত কার্যাবলী গোপনভাবে নিহিত থাকে, তাকে মুআল্লাল হাদীস বলে।
১৩. মুখতারিব: যে হাদীসের বর্ণনাকারী মতন বা সনদকে বিভিন্ন প্রকার এলোমেলো করে বর্ণনা করেছেন তাকে মুখতারিব হাদীস বলে।
১৪. মুদরাজ: যে হাদীসের মধ্যে বর্ণনাকারী তাঁর নিজের অথবা কোন সাহাবী বা তাবিঈর উক্তি সংযোজন করেছেন তাকে মুদরাজ হাদীস বলে।
১৫. মুসনাদ: যে মারফু হাদীসের সনদ সম্পূর্ণরূপে মুত্তাসিল তাকে মুসনাদ হাদীস বলে।
১৬. মুনকার: যে হাদীসের বর্ণনাকারী দুর্বল এবং তার বর্ণিত হাদীস যদি অপর দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী হয়, তবে তাকে মুনকার হাদীস বলে । 
১৭. মাতক: হাদীসের বর্ণনাকারী যদি হাদীসের ব্যাপারে মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে দৈনন্দিন কথায় মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাকে মাতক হাদীস বলে।
১৮. মাওদু: বর্ণনাকারী যদি সমালোচিত ব্যক্তি হন আর যদি তিনি হাদীস বর্ণনায় মিথ্যাবাদী হন তবে তার বর্ণিত হাদীসকে মাওদু হাদীস বলে।
১৯. মুবহাম: যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে তার দোষ-গুণ বিচার করা যেতে পারে, এমন হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে ।
২০. মতন: হাদীসের মূল শব্দাবলীকে মতন বলে ।
২১. মুতাওয়াতির: যে সব হাদীসের সনদে বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত অধিক যে, তাদের সকলের একযোগে কোন মিথ্যার উপর ঐকমত্য হওয়া অসম্ভব। আর এই সংখ্যাধিক্য যদি সর্বস্তরে থাকে তবে তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে।
২২. মাশহুর: যেসব হাদীসের বর্ণনাকারী তিন বা তিনের অধিক হবে কিন্তু মুতাওয়াত্তিরের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছবে না, এমন হাদীসকে মাশহুর হাদীস বলে।
২৩. মারুফ: কোন দূর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল বর্ণনাকারীর হাদীসকে মা'রুফ হাদীস বলে।
২৪. মুতাবি: এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসকে প্রথম হাদীসের মুতাবি বলে।
২৫. সহীহ: যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উদ্ধৃত প্রত্যেক বর্ণনাকারীই নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, প্রখর স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং হাদীসখানি সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত, তাকে সহীহ হাদীস বলে।
২৬. হাসান: যে হাদীসের বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি কিছুটা দুর্বল বলে প্রমাণিত, তাকে হাসান হাদীস বলে।
২৭. যায়ীফ: যে হাদীসের বর্ণনাকারী কোন হাসান বর্ণনাকারীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যায়ীফ হাদীস বলে।
২৮. আধীর: যে সহীহ হাদীস প্রতি স্তরে কমপক্ষে দু'জন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন, তাকে আযীয হাদীস বলে
২৯. গারীব: যে সহীহ হাদীস কোন স্তরে মাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন, তাকে গারীব হাদীস বলে।
৩০. শাব: যে হাদীস কোন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী একাকী বর্ণনা করেছেন এবং তার সমর্থনে অন্য কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, তাকে শাব হাদীস বলে।
৩১. আহাদ: যে হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা মুতাওয়াতিরের সংখ্যা পর্যন্ত পৌঁছেনি তাকে আহাদ হাদীস বলে।
৩২. মুত্তাফাকুন আলাইহি: যে হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) একই রাবী থেকে স্ব-স্ব গ্রন্থে সংকলন করেছেন তাকে মুত্তাফাকুন আলাইহি বলে।
৩৩. আদালত: বর্ণনাকারী মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী হওয়া এবং ফিসকের উপায়- উপকরণ থেকে যুক্ত এবং মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকাকে আদালত বলে।
৩৪. যাবৃত: শ্রুত্ত বিষয়কে জড়তা ও বিনষ্টি থেকে স্মৃতিশক্তি এমনভাবে সংরক্ষণ করা যেন তা যথাযথভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হয়, তাকে যাবৃত বলে।
৩৫. হিকাহ: যে বর্ণনাকারীর মধ্যে আদালাত ও যাত পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাকে হিকাহ বা সাবিত বলে।
৩৬. শায়খ: হাদীসের শিক্ষাদানকারী বর্ণনাকারীকে শায়খ বলে ।
৩৭. শায়খাইন: মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র)-কে শায়খাইন বলে।
৩৮. হাফিয: যিনি হাদীসের সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লাখ হাদীস মুখস্থ করেছেন, তাকে হাফিয বলে।
৩৯. হুজ্জাত: যিনি তিন লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত বলে।
৪০. হাকিম: যিনি সমস্ত হাদীস সনদ ও মতনসহ মুখস্থ করেছেন তাকে হাকিম বলে।
৪১. রিজাল: হাদীসের বর্ণনাকারীর সমষ্টিকে রিজাল বলে।
৪২. তালিব: যিনি হাদীস শাস্ত্র শিক্ষায় নিয়োজিত তাকে তালিব বলে ।
৪৩. রিওয়ারাত: হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে।
৪৪. সিহাহ সিত্তাহ: হাদীস শাস্ত্রের প্রধান ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের সমষ্টিকে সিহাহ সিত্তাহ বলে।
৪৫. সুনানে আরবাআ: আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাকে একত্রে সুনানে আরবাআ বলে।
৪৬. হাদীসে কুদসী: যে হাদীসের মূল ভাব মহান আল্লাহর এবং ভাষা মহানবী (স)- এর নিজস্ব, তাকে হাদীসে কুদসী বলে ।





Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url