সিরাতুন নবী (সাঃ) - ৫৬ || নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ || মসজিদে নববীর নির্মাণ ||






নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ

ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় আগমন করে প্রথম হিজরী রবিউল আওয়াল মাসের ১২ই তারীখে জুমআর দিন মোতাবেক ২৭শে সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে বনী নাজ্জার গোত্রের আবূ আইউব আনসারীর বাড়ির সম্মুখে অবরতণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘ইন-শা-আল্লাহ এটাই হবে আমার অবস্থান।’ তারপর তিনি আবূ আইউব আনসারীর বাড়িতে স্থানান্তর হয়ে যান।

মসজিদে নববীর নির্মাণ

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রথম কাজ হল মসজিদে নববীর নির্মাণ। আর এজন্য ঐ স্থানটিই নির্ধারিত হল যেখানে সর্ব প্রথম তাঁর উটটি বসে পড়েছিল। এ স্থানটির মালিক ছিল দু’জন অনাথ বালক। তিনি ঐ স্থানটি ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করলেন এবং স্বশরীরে মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করলেন। তিনি ইট ও পাথর বহন করছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলছিলেন,

‏[‏اَللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الآخرة ** فاغْفِرْ للأنصار والمُهَاجِرَة‏]‏

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! জীবন তো কেবল পরকালেরই জীবন। অতএব আনসার ও মহাজিরদেরকে ক্ষমা করুন।’

অধিকন্তু এ কথাও বলছিলেন,

‏[‏هذا الحِمَالُ لا حِمَال خَيْبَر ** هــذا أبـَــرُّ رَبَّنَا وأطْـهَر‏]‏

অর্থঃ ‘এটা খায়বারের বোঝা নয়, এ আমার প্রভূর পক্ষ হতে অধিক পুণ্যময় ও পবিত্র।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্মধারা সাহাবীগণ (রাঃ)-কে উৎসাহিত, উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করছিল। কাজে তারাও বলছিলেন,

لئن قَعَــدْنا والنبي يَعْمَل ** لـذاك مِــنَّا العَمَــلُ المُضَلَّل

অর্থঃ ‘যদি আমরা বসে থাকি এবং নবী (ﷺ) কাজ করেন, তাবে আমাদের এ কাজ হবে পথভ্রষ্টতার’’।

এ জমিতে মুশরিকদের কিছু সংখ্যক কবর ছিল। কিছু অংশ পতিত ছিল। তাছাড়া খেজুর ও গারকাদের কয়েকটি গাছ ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিকদের কবরগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিলেন, অসমতল জায়গাটা সমতল করলেন এবং খেজুর ও অন্য গাছগুলো কাটিয়ে ক্বিবলাহর দিকে খাড়া করে দিলেন। সে সময় ক্বিবলাহ বায়তুল মুক্বাদ্দাস। দরজার দু’বাহুর স্তম্ভগুলো পাথর দ্বারা এবং দেওয়াল নির্মিত হল কাঁচা ইট দিয়ে। ছাদের উপর খেজুরের ডালপালা চাপিয়ে আবরণ তৈরি করা হল আর খেজুর গাছের গুড়ি দিয়ে থাম তৈরি করা হল। মেঝেতে বিছানো হল বালি ও ছোট ছোট কাঁকর। ঘরের তিন দরজা লাগানো হয়েছিল। ক্বিবলাহর দেওয়াল হতে পিছনের দেওয়াল পর্যন্ত দৈর্ঘ ছিল ১০০ (একশত) হাত আর প্রস্থও ছিল ঐ পরিমাণ অথবা কিছু কম। ভিতরে গভীরতা ছিল তিন হাত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের পাশে কয়েকটি ঘর তৈরি করিয়ে নিলেন যার দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের এবং ছাদ ছিল খেজুরের গুঁড়ির বর্গা দিয়ে। ছাউনি দেয়া হয়েছিল খেজুরের শাখা ও পাতা দিয়ে তৈরি। এগুলো ছিল উম্মাহাতুল মু’মিনীন নবী পত্নীগণের (রাঃ) আবাস কক্ষ। এ কক্ষগুলোর কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ আইউব আনসারী (রাঃ)-এর বাসা থেকে এ আবাসস্থানে স্থানান্তর হয়ে গিয়েছিলেন।[১]

মসজিদে নববী নতুন সমাজ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু

মসজিদে নববী শুধুমাত্র সালাত আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুই ছিল না, বরং তা ছিল তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী কর্মকান্ডের উৎসস্থল। এ মসজিদেই ছিল মুসলিম সামাজের আদিশিক্ষা কেন্দ্র যেখানে বসে মুসলিমগণ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাদিক্ষা এবং হেদায়াতের পাঠ গ্রহণ করতেন, এ মসজিদেই ছিল এমন একটি মিলনকেন্দ্র যেখানে জাহেলিয়াত জীবনের দীর্ঘ কালের বিবাদ বিসম্বাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটিয়ে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা হয়েছিল, এ মসজিদেই বসত রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনার পরামর্শ সভা। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ, সৈন্য পরিচালনা, সন্ধি স্থাপন, চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ মসজিদে নববী। অধিকন্তু, এ মসজিদেই ছিল অনেক নিবেদিত সাহাবী (রাঃ)-এর আবাসস্থল, যাঁদের বাড়িঘর, ধন-সম্পদ এবং আত্মীয়-স্বজন বলতে কিছুই ছিল না।

হিজরতের প্রথম দিকেই আযান প্রথা প্রচলিত হয়। এটা এমন এক সুরেলা স্বর্গীয় সঙ্গীত এবং সালাত কায়েমের উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমনের জন্য এমন মনোজ্ঞ আহবান যা প্রত্যহ পাঁচবার প্রচারিত হয় মসজিদের মিনার থেকে। মসজিদে নববীতে যখন আযান দেয়া হতো এবং আযানের গুরু গম্ভীর আওয়াজ যখন আকাশের দিকে দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকত, তখন একদিকে আল্লাহ প্রেমিক মুসলিমদের অন্তর ভালবাসায়, ভক্তিতে, আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠত, অন্যদিকে কাফির মুশরিকদের অন্তর ভয়-ভীতিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠত। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন যায়দ বিন আবদে রাব্বিহীর (রাঃ) স্বপ্নের ঘটনাটি সুপ্রসিদ্ধ রয়েছে (বিস্তারিত অবগতির জন্য জামে তিরমিযী, সুনানে আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ ও সহীহুল ইবনে খুযায়মাহ’য় দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।)

তথ্যসূত্রঃ
[১] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৭১, ৫৫৫ ও ৫৬০ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৬ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url