সিরাতুন নবী (সাঃ)- ৭৬ || উহুদ যুদ্ধঃ তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুশরিকদের চাপ বৃদ্ধি ও নবী (সাঃ)-এর শাহাদাতের খবর প্রচার ||





উহুদ যুদ্ধঃ তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুশরিকদের চাপ বৃদ্ধি ও নবী (সাঃ)-এর শাহাদাতের খবর প্রচার

সিরাতুন নবী (সাঃ) ৭৬-তম পর্ব উহুদ যুদ্ধের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আশে পাশে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম

মুসলিম সেনাবাহিনী যখন ভীড়ের মধ্যে এসে মুশরিকদের সারিগুলোর দু’টি সারির মাঝে পড়ে যান এবং তাঁদেরকে প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করা হয়, ঠিক সেই সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আশে পাশেও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে। এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, মুশরিকরা মুসলিমগণকে যখন ঘিরে ফেলতে শুরু করে তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট মাত্র নয় জন সাহাবী ছিলেন এবং যখন মুসলিমগণকে ‏‏(‏هَلُمُّوْا إِلَيَّ، أَنَا رَسُوْلُ اللهِ‏)‏، ‘আমার দিকে এসো, আমি আল্লাহর রাসূল’ এ কথা বলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ডাক দেন তখন তাঁর ডাক মুশরিকরা শুনে ফেলে এবং তাঁকে চিনে নেয় (কেননা, ঐ সময় তারা মুসলিমগণের চেয়ে বেশী তাঁর নিকটবর্তী ছিল) সুতরাং তাঁরা দ্রুত বেগে ধাবিত হয়ে তাঁকে আক্রমণ করে বসে এবং কোন মুসলমানের আগমনের পূর্বেই নিজেদের সম্পূর্ণ বোঝা নিক্ষেপ করে। এ আকস্মিক আক্রমণের ফলে ঐ মুশরিকদের ও সেখানে উপস্থিত নয় জন সাহাবীর মধ্যে ভীষণ লড়াই শুরু হয়ে যায়। এতে নবীপ্রেম, বীরত্বপনা এবং প্রাণ ত্যাগের অসাধারণ ঘটনাবলী সংঘটিত হয়।

সহীহুল মুসলিমে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাত জন আনসার ও দুই জন কুরাইশী সাহাবীসহ পৃথক রয়ে গিয়েছিলেন। যখন আক্রমণকারীরা তাঁর একেবারে নিকটে পৌঁছে যায় তখন তিনি বলেন, ‏‏مَنْ يَّرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّة ؟‏ এমন কেউ আছে কি, যে এদেরকে আমার নিকট হতে দূর করে দিতে পারে? তাঁর জন্যে জান্নাত রয়েছে। অথবা বলেন, هُوَ رَفِيْقِيْ فِيْ الْجَنَّةِ ‏؟‏‏ ‘সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’
তাঁর এ কথা শুনে একজন আনসারী সাহাবী অগ্রসর হন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। এরপর পুনরায় মুশরিকরা তাঁর একেবারে নিকটে এসে পড়ে এবং এবারও তিনি আগের মতোই কথা বলেন। এভাবে পালাক্রমে সাত জন আনসারী সাহাবী শহীদ হয়ে যান। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় অবশিষ্ট দু’জন সাহাবীকে বলেন, (‏(‏مَا أَنْصَفْنَا أَصْحَابَنَا‏ ‘আমরা আমাদের সঙ্গীদের সাথে ন্যায় বিচার করলাম না।’[১]

এ সাতজনের মধ্যে শেষের জন ছিলেন উমারাহ ইবনু ইয়াযীদ ইবনু সাকান (রাঃ)। তিনি লড়তেই থাকেন, শেষ পর্যন্ত অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে মাটিতে পড়ে যান।[২]

উহুদে রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে কঠিন সময়

উমারাহ (রাঃ) পতিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মাত্র দু’ জন কুরাইশী সাহাবী রয়ে গিয়েছিলেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে আবূ উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে যুগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ করেছেন ঐ যুদ্ধগুলোর কোন একটিতে তাঁর সাথে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ছাড়া আর কেউই ছিল না।[৩] আর এ মুহূর্তটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্যে অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল এবং মুশরিকদের জন্যে ছিল সুবর্ণ সুযোগের মুহূর্ত। প্রকৃত ব্যাপার হল, মুশরিকরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। তারা একাদিক্রমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল এবং তাঁকে দুনিয়ার বুক হতে চিরতরে বিদায় করতে চেয়েছিল। এ আক্রমণেই ‘উতবাহ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস তাঁকে পাথর মেরেছিল যার ফলে তিনি পার্শ্বদেশের ভরে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ডানদিকের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল।[৪]
আর তাঁর নীচের ঠোঁটটি আহত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী অগ্রসর হয়ে তাঁর ললাট আহত করে। আব্দুল্লাহ ইবনু ক্বায়িমাহ নামক আর একজন দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার লাফিয়ে গিয়ে তাঁর কাঁধের উপর এতো জোরে তরবারীর আঘাত করে যে, তিনি এক মাসেরও বেশী সময় পর্যন্ত ওর ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করতে থাকেন। তবে তাঁর লৌহবর্ম কাটতে পারে নি। এরপর সে আর একবার তাঁকে তরবারীর আঘাত করে, যা তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের উপর লাগে এবং এর কারণে শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চেহারার মধ্যে ঢুকে যায়।[৫] সাথে সাথে সে বলে ওঠে, ‘এটা লও! আমি ক্বামিয়া’র (টুকরোকারীর) পুত্র।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেহারা হতে রক্ত মুছতে মুছতে বলেন, ‘আল্লাহ তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলুন।’[৬]

সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মাথা আহত করা হয়। ঐ সময় তিনি মুখমন্ডল হতে রক্ত মুছে ফেলছিলেন এবং মুখে উচ্চারণ করছিলেন,

‏‏(‏كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوْا وَجْهَ نَبِيِّهِمْ، وَكَسَرُوْا رُبَاعِيَتِهِ، وَهُوَ يَدْعُوْهُمْ إِلَى اللهِ‏)‏

‘ঐ কওম কিরূপে কৃতকার্য হতে পারে যারা তাদের নবী (ﷺ)-এর মুখমন্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে, অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছিলেন?’

ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেন,

‏(‏لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ‏)‏ ‏[‏آل عمران‏:‏128‏]

‘আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন- এ ব্যাপারে তোমার কিছু করার নেই। কেননা তারা হচ্ছে যালিম।’।[৭]

ত্বাবারানীর বর্ণনায় রয়েছে যে, ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন, ‏‏(‏اِشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلٰى قَوْمٍ دَمُّوْا وَجْهَ رَسُوْلِهِ‏) ‘ঐ কওমের উপর আল্লাহর কঠিন শাস্তি হোক যারা তাদের নবী (ﷺ)-এর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‏(‏اللهم اغْفِرْ لِقَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)‏ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন, তারা জানে না।’[৮]

সহীহুল মুসলিমের হাদীসেও এটাই আছে যে, তিনি বার বার বলছিলেন,

(‏رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)‏

অর্থাৎ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার কওমকে ক্ষমা করে দিন, তারা জানে না।’[৯]

কাযী আইয়াযের ‘শিফা’ গ্রন্থে নিম্নলিখিত শব্দ রয়েছে,‏(‏اللهم اهْدِ قَوْمِيْ فَإِنَّهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ‏)

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে হিদায়াত দান করুন, নিশ্চয় তারা জানে না।’[১০]
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দুনিয়া হতে বিদায় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দু’জন কুরাইশী সাহাবী অর্থাৎ সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ও ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) অসাধারণ বীরত্ব ও অতুলনীয় বাহাদুরীর সাথে কাজ করে শুধু দু’জনই মুশরিকদের সফলতা অসম্ভব করে দেন। এ দু’ব্যক্তি আরবের সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তাঁরা তীর মেরে মেরে আক্রমণকারী মুশরিকদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে দূরে সরিয়ে রাখেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর জন্যে স্বীয় তূণ হতে সমস্ত তীর বের করে ছড়িয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, (‏اِرْمِ فِدَاكَ أَبِيْ وِأُمِّيْ‏)‏ ‘তীর ছুঁড়তে থাক, তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোন।’[১১]

সা‘দ (রাঃ)-এর সৌজন্য ও কর্মদক্ষতা এর দ্বারাই অনুমান করা যেতে পারে যে, তিনি ছাড়া আর কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পিতামাতা উৎসর্গিত হওয়ার কথা বলেন নি।[১২]

ত্বালহাহ (রাঃ)-এর কর্মদক্ষতা অনুমান করা যেতে পারে সুনানে নাসায়ীর একটি বর্ণনার মাধ্যমে, যাতে জাবির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর মুশরিকদের ঐ সময়ের আক্রমণের উল্লেখ করেছেন যখন তিনি মুষ্টিমেয় আনসারদের সাথে রয়ে গিয়েছিলেন।

জাবির (রাঃ) বলেন যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটবর্তী হয়ে গেলে তিনি বলেন,

‏‏(‏مَنْ لِلْقَوْمِ ‏؟‏‏)‏ ‘এদের সাথে মোকাবালা করে এমন কেউ আছ কি?’

উত্তরে ত্বালহাহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি আছি।’ এরপর জাবির (রাঃ) আনসারদের অগ্রসর হওয়া এবং একে একে শহীদ হওয়ার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যা সহীহুল মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি। জাবির (রাঃ) বলেন যে, যখন তাঁরা শহীদ হয়ে যান তখন ত্বালহাহ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হন এবং এগারো জন লোকের সমান একাই যুদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতের উপর তরবারীর এমন এক আঘাত লাগে যে, এর ফলে তার হাতের আঙ্গুলিগুলো কেটে যায়। ঐ সময় তার মুখ দিয়ে ‘হিস’ শব্দ বের হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

‏(‏لَوْ قُلْتُ ‏:‏ بِسْمِ اللهِ، لَرَفَعَتْكَ الْمَلَائِكَةُ وَالنَّاسُ يَنْظُرُوْنَ‏)‏

‘তুমি যদি বিসমিল্লাহ বলতে তবে তোমাকে ফিরিশতা উঠিয়ে নিতেন এবং জনগণ দেখতে পেত।’
জাবির (রাঃ) বলেন যে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে ফিরিয়ে দেন।[১৩] ইকলীলে হা’কিমের বর্ণনায় রয়েছে যে, উহুদের দিন তাঁকে ৩৯টি বা ৩৫টি আঘাত করা হয়েছিল এবং তাঁর শাহাদত ও মধ্যমা আঙ্গুলিদ্বয় অকেজো হয়ে গিয়েছিল।[১৪]

ইমাম বুখারী (রহ.) ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, ‘আমি ত্বালহাহ (রাঃ)-এর হাত দেখেছি যে, ওটা নিষ্ক্রিয় ছিল। ঐ হাত দ্বারাই তিনি উহুদ যুদ্ধের দিন নবী (ﷺ)-কে রক্ষা করেছিলেন।’[১৫]

ইমাম তিরমিযীর (রহ.) বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ দিন ত্বালহাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে বলেছিলেন,

(‏مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَّنْظُرَ إِلٰى شَهِيْدٍ يَمْشِيْ عَلٰى وَجْهِ الْأَرْضِ فَلْيَنْظُرْ إِلٰى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ‏)‏

কেউ যদি ভূ-পৃষ্ঠে কোন শহীদকে চলতে ফিরতে দেখত চায় তবে সে যেন ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ)-কে দেখে নেয়।’[১৬]

আবূ দাঊদ তায়ালিসী (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) যখন উহুদ যুদ্ধের আলোচনা করতেন তখন বলতেন, ‘এ যুদ্ধ সম্পূর্ণটাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্যে ছিল[১৭] (অর্থাৎ এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হিফাযাত করার আসল কাজ তিনিই আনজাম দিয়েছিলেন)। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর ব্যাপারে নিম্নের কথাও বলেন,

يا طلحة بن عبيد الله قد وَجَبَتْ ** لك الجنان وبُوِّئتَ المَهَا العِينَا

অর্থাৎ ‘হে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ), তোমার জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে এবং তুমি তোমার এখানে আয়তলোচনা হুরদের ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছ।’[১৮]

এ সংকটময় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য হতে স্বীয় সাহায্য নাযিল করেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেছি, তাঁরা তাঁর পক্ষ হতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। আমি এর পূর্বে এবং পরে এ দু’জন লোককে আর কখনো দেখিনি।’ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা দু’জন ছিলেন জিব্রাঈল (আঃ) ও মীকাঈল (আঃ)।[১৯]

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিরাপত্তার জন্য সাহাবায়ে কিরামের একত্রিত হওয়া

এ সব ঘটনা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একেবারে অকস্মাৎ এবং অত্যন্ত ত্বড়িৎ গতিতে সংঘটিত হয়ে যায়। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাছাইকৃত সাহাবায়ে কেরাম, যারা যুদ্ধ চলাকালে প্রথম সারিতে ছিলেন, যুদ্ধের পট পরিবর্তন হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দ্রুতগতিতে আসেন যাতে তাঁর কোন অঘটন ঘটে না যায়। কিন্তু তাঁরা প্রথম সারিতে থাকার কারণে এ সব খবর জানতে পারেন নি। অতঃপর যখন তাঁদের কানে এ খবর পৌঁছল তখন তাঁরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দৌঁড়িয়ে আসলেন। কিন্তু যখন তাঁরা তাঁর নিকট পৌঁছলেন তখন তিনি আহত হয়েই গেছেন। ৬ জন আনসারী শহীদ হয়েছেন এবং সপ্তম জন আহত হয়ে পড়ে আছেন। আর সা‘দ (রাঃ) এবং ত্বালহাহ (রাঃ) প্রাণপণে যুদ্ধ করে শত্রুদেরকে প্রতিহত করছেন। তাঁরা পৌঁছা মাত্রই নিজেদের দেহ ও অস্ত্র দ্বারা নবী (ﷺ)-এর চতুর্দিকে বেড়া তৈরি করে দেন এবং শত্রুদের ভীষণ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেন। যুদ্ধের সারি হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যাঁরা ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্ব প্রথম ছিলেন তাঁর গুহার বন্ধু আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)।
ইবনু হিববান (রঃ) তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) বলেছেন, ‘উহুদ যুদ্ধের দিন সমস্ত লোক নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হতে চলে গিয়েছিলেন (অর্থাৎ রক্ষকগণ ছাড়া সমস্ত সাহাবী তাঁকে তাঁর অবস্থানস্থলে রেখে যুদ্ধের জন্যে আগের সারিতে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর কাফিরদের দ্বারা মুসলিমগণ পরিবেষ্টিত হওয়ার পর) আমি সর্বপ্রথম তাঁর নিকট ফিরে আসি। দেখি যে, তাঁর সামনে একজন মাত্র লোক রয়েছেন যিনি তাঁর পক্ষ হতে যুদ্ধ করছেন এবং তাঁকে রক্ষা করছেন। আমি (মনে মনে) বললাম, ‘তুমি ত্বালহাহ (রাঃ)-ই হবে। তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গিত হোক! ইতোমধ্যে আবূ উবাইদাহ ইবনু জাররাহ (রাঃ) আমার নিকট এসে পড়েন। তিনি এমনভাবে দৌড়াচ্ছিলেন যেন পাখী (উড়ছে), শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সাথে মিলিত হয়ে যান। এখন আমরা দুজন নবী (সাঃ)-এর দিকে দৌঁড় দেই। তাঁর সামনে ত্বালহাহ (রাঃ) অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ে রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রূষা কর। সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মুবারক আহত হয়েছে এবং শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চক্ষুর নীচে গন্ডদেশে ঢুকে আছে। আমি কড়া দুটি বের করতে চাইলে আবূ উবাইদাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমি আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি যে, এ দু'টি আমাকেই বের করতে দিন।’ এ কথা বলে তিনি দাঁত দিয়ে একটি কড়া ধরলেন এবং ধীরে ধীরে বের করতে শুরু করলেন, যেন তিনি কষ্ট না পান। শেষ পর্যন্ত তিনি কড়াটি টেনে বের করলেন বটে, কিন্তু তাঁর নীচের একটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেল। এখন দ্বিতীয় কড়াটি আমিই বের করতে চাইলাম। কিন্তু এবারও তিনি বললেন, ‘আবূ বকর (রাঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আপনাকে আমি বলছি যে, এটাও আমাকেই বের করতে দিন।’ এরপর দ্বিতীয়টিও তিনি আস্তে আস্তে টেনে বের করলেন। কিন্তু তাঁর নীচের আর একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- বললেন,

‏(‏دُوْنَكُمْ أَخَـاكُمْ فَقَـدْ أَوْجَبَ‏)‏

‘তোমাদের ভাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর শুশ্রুষা কর, সে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।’

আবূ বকর (রাঃ) বললেন এখন আমরা ত্বালহাহ (রাঃ)-এর দিকে মনোযোগ দিলাম এবং তাঁকে সামলিয়ে নিলাম। তাঁর দেহে দশটিরও বেশী যখম হয়েছিল। ত্বালহাহ (রাঃ) ঐ দিন প্রতিরোধ ও যুদ্ধে কত বীরত্বের সাথে কাজ করেছিলেন এর দ্বারা তা সহজেই অনুমান করা যায়।[২০]
আর এ সংকটময় মুহূর্তেই প্রাণ নিয়ে খেলাকারী সাহাবাদের (রাঃ) একটি দলও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চতুর্দিকে এসে পড়েন। তাঁরা হলেন, আবূ দুজানা (রাঃ), আবূ মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ), মালিক ইবনু ত্বালিব (রাঃ), সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ), মালিক ইবনু সিনান (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর পিতা, উম্মু আম্মারা রাহনুসাইবাহ বিনতু কাব মায়িনিয়্যাহ (রাঃ), কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ), উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ), হা’তিব ইবনু আবী বলতাআহ (রাঃ) এবং আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)।

মুশরিকদের চাপ বৃদ্ধি

এদিকে মুশরিকদের সংখ্যাও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর ফলে তাদের আক্রমণও কঠিন হতে কঠিনতর আকার ধারণ করছিল যার ফলে শক্তি এবং চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐসময় কতগুলো গর্তের মধ্যে একটি গর্তে পড়ে যান যেগুলো আবূ আ’মির ফা’সিক এ প্রকারের অনিষ্টের জন্যেই খনন করে রেখেছিল। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাঁটু মুবারক মচকে যায়। আলী (রাঃ) তাঁর হাত ধরে নেন এবং ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) (যিনি নিজেও চরমভাবে আহত হয়েছিলেন) তাঁকে স্বীয় বক্ষে নিয়ে নেন। এরপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হন।

না’ফে ইবনু জুবায়ের (রাঃ) বলেন যে, তিনি একজন মুহাজির সাহাবীকে বলতে শুনেছেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধে হাযির ছিলাম। আমি দেখি যে, চতুর্দিক হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর তীর বর্ষিত হচ্ছে, আর তিনি তীরগুলোর মাঝেই রয়েছেন। কিন্তু সমস্ত তীরই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে (অর্থাৎ তাঁকে বেষ্টনকারী সাহাবীগণ ওগুলো রুখে নিচ্ছেন) আমি আরো দেখি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী বলতেছিল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) কোথায় আছে তা আমাকে বলে দাও। এখন হয় আমি থাকব না হয় সে থাকবে।’ অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বাহুতেই ছিলেন (অর্থাৎ তার অতি নিকটে ছিলেন) এবং তাঁর সাথে আর কেউ ছিল না। অতঃপর সে তাঁকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে যায়। এ দেখে সাফওয়ান তাকে ভৎর্সনা করে। জবাবে সে বলে, আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে দেখতেই পাই নি। আল্লাহর শপথ! আমার নিকট হতে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছে। এরপর আমরা চারজন লোক তাঁকে হত্যা করার প্রতিক্ষা করে বের হই। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি নি।[২১]

উহুদে অসাধারণ বীরত্ব ও প্রাণপণ লড়াই

যাহোক এ সময় মুসলিমরা এমনভাবে বীরত্বের সাথে ও জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে মিলে না। যেমন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে ঢাল স্বরূপ বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি স্বীয় বক্ষ উপরে উঠিয়ে নিতেন, যাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে শত্রুদের তীর হতে রক্ষা করতে পারেন। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, উহুদের দিন লোকেরা (অর্থাৎ সাধারণ মুসলিমরা পরাজয় বরণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসার পরিবর্তে এদিক ওদিক পালিয়ে যায়, আর আবূ ত্বালহাহ একটি ঢাল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি একজন সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। তিনি খুব টেনে তীর চালাতেন। ঐ দিন তিনি দু’টি কিংবা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দিয়ে কোন লোক তূণ নিয়ে গমন করলে তিনি বলতেন, ‏(‏اُنْثُرْهَا لِأَبِيْ طَلْحَةَ)‏
‘তোমার তূণের তীরগুলো আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্য ছড়িয়ে দাও।’

আর তিনি যখন এক একবার মাথা উঠিয়ে যুদ্ধের অবস্থা দেখতেন তখন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) চমকিত হয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতামাতা আপনার প্রাণের বিনিময়ে উৎসর্গিত হোক। আমার দেহ আপনার দেহের ঢাল হোক। মাথা বের করবেন না।’[২২] এ সময় আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীরগুলো নিজের বুক পেতে গ্রহণ করছিলেন।

আনাস (রাঃ) থেকে এটাও বর্ণিত আছে যে, আবূ ত্বালহাহ নাবী (ﷺ) সহ একই ঢালের মধ্যে আত্মরক্ষা করছিলেন। আবূ ত্বালহাহ ছিলেন খুব দক্ষ তীরন্দাজ। যখন তিনি তীর নিক্ষেপ করতেন তখন নবী করীম (ﷺ) গর্দান উঠিয়ে দেখতেন যে, তীরটি কোথায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।[২৩]

আবূ দুজানাহ (রাঃ)-এর বীরত্বের কথা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এ বিপদের মুহূর্তে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং নিজের পিঠকে করলেন ঢাল। ওর উপর তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল অথচ তিনি ছিলেন অনড়। ওয়াক্কাস হাতিব ইবনু বালতাআহ (রাঃ) ‘উতবাহ ইবনু আবী ওয়াক্কাসের পিছনে ধাওয়া করেন যে নবী করীম (ﷺ)-এর দন্ত মুবারক শহীদ করেছিল। তাকে তিনি ভীষণ জোরে তরবারীর আঘাত করেন। এর ফলে তার মস্তক দেহচ্যুত হয়ে যায়। তারপর তিনি তার ঘোড়া ও তরবারী অধিকার করে নেন। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর নিজের ঐ ভাই ‘উতবাহকে নিজ হাতে হত্যা করার জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু এতে তিনি সফলকাম হননি। বরং এ সৌভাগ্য হাতিব (রাঃ) লাভ করেন।

সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ) একজন সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট মৃত্যুর দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুশরিকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও তীর চালাচ্ছিলেন। যেমন কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় ধনুক দ্বারা এতো তীর চালিয়েছিলেন যে, ওর প্রান্ত ভেঙ্গে গিয়েছিল।’ অতঃপর ঐ ধনুকটি কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) নিয়ে নেন এবং ওটা তার কাছেই থাকে। ঐ দিন এ ঘটনাও সংঘটিত হয় যে, কাতাদা (রাঃ)-এর একটি চোখে চোট লেগে ওটা তাঁর চেহারার উপর ঝুলে পড়ে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ হাতে ওটাকে ওর নিজ স্থানে ঢুকিয়ে দেন। এরপর তাঁর ঐ চক্ষুটিকেই খুব সুন্দর দেখাত এবং ওটারই দৃষ্টি শক্তিও বেশী তীক্ষ্ণ হয়েছিল।
আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) যুদ্ধ করতে করতে মুখে আঘাত প্রাপ্ত হন, ফলে তার সামনের দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং তাঁর দেহে বিশটি কিংবা তার চেয়েও বেশী যখম হন। তাঁর পা যখম হয়, ফলে তিনি খোঁড়া হয়ে যান।

আবূ সাঈদ খুদরী’র (রাঃ) পিতা মালিক বিন সানান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গন্ডদেশের রক্ত চুষে নিলেন আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর তিনি (ﷺ) বললেন, থুথু ফেলে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি থুথু ফেলব না। তারপর তিনি ফিরে গেলেন ও লড়াইয়ে যোগ দিলেন। তারপর নাবী (ﷺ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতি কোন ব্যক্তিকে দেখতে চায় সে যেন একে দেখে। তারপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।

এ যুদ্ধে উম্মু ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতু কা’ব (রাঃ) নাম্নী এক অসাধারণ মহিলাও অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরিচয় প্রদান করেন। তিনি ‘আয়িশাহ (রাঃ) ও অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে শুশ্রূষা কারিণীরূপে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আহত সৈনিকদের পানি সরবরাহ এবং তাদের অন্যান্য প্রকার সেবা শুশ্রূষা করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, মুসলিমরা পরাজিত হয়েছেন এবং কুরাইশ সৈন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। এ সংবাদ শ্রবণ মাত্র উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) কাঁধের মশক ও হাতের জলপাত্র ছুঁড়ে ফেলেন। ঐ সময় মুষ্টিমেয় ভক্ত প্রাণপণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেহ রক্ষা করছিলেন। উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) সিংহীর ন্যায় বিক্রম সহকারে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বিশেষ ক্ষিপ্রতা ও নৈপুণ্য সহকারে তীর বর্ষণ করে কুরাইশদেরকে ধ্বংস করতে লাগলেন। এক সময় তিনি ইবনু ক্বামিয়ার সামনে পড়ে গেলেন। ইবনু ক্বামিয়ার তার কাঁধের উপর এত জোরে তরবারীর আঘাত করল যে, এর ফলে তার কাঁধ গভীরভাবে যখম হল। তিনিও তার তরবারী দ্বারা ইবনু কামআরকে কয়েকবার আঘাত করলেন। কিন্তু নরাধম দুটি লৌহবর্ম পরিহিত ছিল বলে বেঁচে গেল। শত্রুদের বর্শা ও তরবারীর আঘাতে তার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হয়ে পড়ল। কিন্তু এ বীরাঙ্গনা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা কালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ঐ বিপদের সময় আমি দক্ষিণে বামে যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, সে দিকেই দেখি যে, উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) আমাকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন।’
উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের জাতীয় পতাকা মুস’আব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর হাতে অর্পিত হয়েছিল। এ পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসআব (রাঃ)-কে প্রথম থেকেই যুদ্ধ করে আসতে হয়েছিল এবং তীর ও তরবারীর আঘাতে তার আপাদমস্তক একেবারে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য বিপদের সময় দুর্ধর্ষ ইবনু কামআহ অগ্রসর হয়ে তাঁর দক্ষিণ বাহুর উপর তরবারীর আঘাত করল। বাহুটি কেটে যাওয়ার সাথে সাথে মুসআব (রাঃ) বাম হাতে পতাকা ধারণ করলেন। কিন্তু অবিলম্বে ইবনু কামআর তরবারীর দ্বিতীয় আঘাতে তাঁর বাম বাহুটিও দেহচ্যুত হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষের একটি তীর এসে তার জ্ঞান, ভক্তি ও বীরত্বপূর্ণ বক্ষটিভেদ করে চলে গেল এবং তিনি চির নিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে শহীদের অমর জীবন লাভ করলেন। নাবী (ﷺ)-এর আকৃতির সাথে মুসআব (রাঃ)-এর আকৃতির সাদৃশ্য ছিল। সুতরাং মুসআব (রাঃ)-কে শহীদ করে ইবনু কামআর মুশরিকদের দিকে ফিরে গেল এবং চিৎকার করে করে ঘোষণা করল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে হত্যা করা হয়েছে।[২৪]


নবী (সাঃ)-এর শহীদ হওয়ার খবর এবং যুদ্ধের উপর এর প্রতিক্রিয়া

এ ঘোষণায় নবী (ﷺ)-এর শাহাদতের খবর মুসলিম ও মুশরিক উভয় দলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল। এ দুঃখ সংবাদ রটনার পর অধিকাংশ মুসলিমই ক্ষণিকের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। একদল মুসলিম ইতোমধ্যেই শাহাদত প্রাপ্ত হয়েছেন, জীবিতদের মধ্যে একদল গুরুতররূপে আহত হয়ে পড়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শহীদ হয়েছেন শুনে একদল অস্ত্র ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ এমন কি কেউ কেউ মদীনায় পলায়ন পর্যন্ত করলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাহাদতের এ খবরই আবার এদিক দিয়ে কল্যাণকররূপে প্রতীয়মান হয় যে, তারা অনুভব করছিল যে, তাদের শেষ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং এখন বহু মুশরিক আক্রমণ বন্ধ করে মুসলিম শহীদদের মৃত দেহের মূসলা (নাক, কান ইত্যাদি কেটে নেয়ার কাজ) করতে শুরু করে দেয়।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর্যুপরি যুদ্ধ ও অবস্থার উপর আধিপত্য লাভ

মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর শাহাদতের পর আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পতাকা প্রদান করেন। তিনি প্রাণপণে যুদ্ধ করে যান। সেখানে উপস্থিত অবশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামও অতুলনীয় বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ ও আক্রমণ করেন। এর দ্বারা অবশেষে এ সম্ভাবনা দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিকদের সারিগুলো ভেদ করে ভিড়ের মধ্যে আগত সাহাবায়ে কেরামের দিকে পথ তৈরি করতে পারবেন। তিনি সামনে পা বাড়ালেন এবং সাহাবায়ে কেরামের দিকে আসলেন। সর্ব প্রথম তাঁকে চিনতে পারেন কা‘ব ইবনু মা’লিক (রাঃ)। তিনি খুশীতে চিৎকার করে ওঠেন, ‘হে মুসলিমবৃন্দ! তোমরা আনন্দিত হও, এই যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! তিনি তাঁকে ইঙ্গিত করেন, ‘চুপ থাকো, যাতে মুশরিকরা আমার অবস্থান ও অবস্থানস্থলের টের না পায়।’ কিন্তু কা‘ব (রাঃ)-এর আওয়ায মুসলিমগণের কানে পৌঁছেই গিয়েছিল। সুতরাং তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আশ্রয়ে চলে আসতে শুরু করেন এবং ক্রমে ক্রমে প্রায় ত্রিশ জন সাহাবী একত্রিত হয়ে যান।
যখন এ সংখ্যক সাহাবী সমবেত হয়ে যান তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাহাড়ের ঘাঁটি অর্থাৎ শিবিরের দিকে যেতে শুরু করেন। কিন্তু এ সরে যাওয়ার অর্থ ছিল, মুশরিকরা মুসলিমগণকে তাদের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে ফেলার যে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেছিল তা বিফল হয়ে যাবে। তাই, তারা মুসলিমগণের এ প্রত্যাবর্তনকে ব্যর্থ করার মানসে ভীষণ আক্রমণ শুরু করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ আক্রমণকারীদের ভীড় ঠেলে রাস্তা তৈরি করেই ফেলেন এবং ইসলামের সিংহদের বীরত্বের সামনে তাদের কোন ক্ষমতাই টিকল না। এরই মধ্যে উসমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুগীরা নামক মুশরিকদের একজন হঠকারী ঘোড়সওয়ার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে অগ্রসর হল এবং বলল, ‘হয় আমি থাকব, না হয় সে থাকবে।’ এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তার সাথে মোকাবালা করার জন্য থেমে গেলেন। কিন্তু মোকাবেলা করার সুযোগ হল না। কেননা তাঁর ঘোড়াটি একটি গর্তে পড়ে গেল। আর ইতোমধ্যে হারিস ইবনু সম্মাহ (রাঃ) তাঁর নিকট পৌঁছে তার পায়ের উপর এমন জোরে তরবারীর আঘাত করলেন যে, সে ওখানেই বসে পড়ল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি তার হাতিয়ার নিয়ে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলেন। কিন্তু এরই মধ্যে আবার আব্দুল্লাহ ইবনু জাবির নামক আর একজন মক্কার ঘোড়সওয়ার হারিস ইবনু সম্মাহ (রাঃ)-কে আক্রমণ করল এবং তাঁর কাঁধের উপর তরবারীর আঘাত করে যখম করে দিল। কিন্তু মুসলিমরা লাফিয়ে গিয়ে তাঁকে উঠিয়ে নিলেন। আর এদিকে মৃত্যুর সঙ্গে ক্রীড়ারত মর্দে মুজাহিদ আবূ দুজানা (রাঃ), যিনি আজ লাল পাগড়ী বেঁধে রেখেছিলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু জাবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাঁকে এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, তার মাথা উড়ে যায়।

কি স্বর্গীয় মাহাত্ম্য যে, এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলাকালেই মুসলিমরা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে, এটা ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বিশ্রাম ও প্রশান্তি। আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) বলেন, ‘উহুদের যুদ্ধের দিন যারা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। এমনকি, আমার হাত হতে কয়েকবার তরবারী পড়ে যায়। প্রকৃত অবস্থা ছিল এরূপ যে, ওটা পড়ে যাচ্ছিল এবং আমি ধরে নিচ্ছিলাম। আবার পড়ে যাচ্ছিল এবং আবারও আমি ধরে নিচ্ছিলাম।[২৫]

সার কথা হল, এভাবে মরণপণ করে এ বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে পিছনে সরতে সরতে পাহাড়ের ঘাঁটিতে অবস্থিত শিবির পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং বাকী সৈন্যদের জন্যেও এ সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছার পথ পরিস্কার করে দেন। সুতরাং অবশিষ্ট সৈন্যরাও এখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছে গেলেন এবং খালিদের বাহিনী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাহিনীর সামনে অকৃতকার্য হয়ে গেল।


তথ্যসূত্রঃ
[১] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৭ পৃঃ, বাবু গাযওয়াতে উহুদ ।
[২] কিছুক্ষণ পরে সাহাবায়ে কিরামের একটি দল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে পড়েন। তাঁরা কাফিরদেরকে আম্মারাহ (রাঃ) হতে ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরিয়ে দেন এবং তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে নিজের পায়ের উপর ঠেকা লাগিয়ে দেন এবং আম্মারাহ (রাঃ) এ অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন যে, তাঁর গন্ড দেশ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পায়ের উপর ছিল। (ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৮১ পৃঃ) আকাঙ্ক্ষা যেন বাস্তবে রূপায়িত হল। তা হল : ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পায়ের উপর এটাই মনের আকাঙ্ক্ষা।’
[৩] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৭ পৃ: এবং ২য় খন্ড ৫৮১ পৃ।
[৪] মুখের সম্পূর্ণ মধ্যে নীচের দুটি ও উপরের দুটি দাঁতকে সুনায়ী বলা হয় এবং ওর ডান দিকের ও বাম দিকের উপর দুটি ও নীচের দুটি দাঁতকে রুবাঈ দাঁত বলা হয়। কুচলী দাঁতের পূর্বে অবস্থিত।
[৫] লোহা অথবা পাথরের টুপি। যা যুদ্ধের সময় মাথা এবং মুখমন্ডল হেফাজতের জন্য ব্যবহার করা হয়।
[৬] আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এ দু’আ কবুল করে নেন। ইবনু কাময়াহ যুদ্ধ হতে বাড়ী ফিরে যাবার পর তার বকরী খুঁজতে বের হয়। তার বকরীগুলো সে পর্বত চূড়ায় দেখতে পায়। সে সেখানে উঠলে এক পাহাড়ী বকরী তার উপর আক্রমণ চালায় এবং শিং দ্বারা গুতো মারতে মারতে তাকে পাহাড়ের উপর হতে নীচে ফেলে দেয় (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৭৩ পৃ.) আর তাবারানীর বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়ী বকরীকে তার উপর নির্দিষ্ট করেন যে তাকে শিং মেরে মেরে টুকরো টুকরো করে দেয়। (ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৬৬ পৃ.)
[৭] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৮২ পৃঃ।, সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ১০৮ পৃঃ।
[৮] ফাতহুলবারী, ৭ম খন্ড ৩৭৩ পৃঃ।
[৯] সহীহুল মুসলিম, ২য় খন্ড, বাবু গাযওয়াতে উহুদ ১০৮ পৃঃ।
[১০] কিতাবুশ শিফা বিতা’রীফি হুককিল মুসতফা (সাঃ) প্রথম খন্ড ৮১ পৃঃ।
[১১] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৭, ২য় খন্ড ৫৮০-৫৮১ পৃঃ।
[১২] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৭, ২য় খন্ড ৫৮০-৫৮১ পৃঃ।
[১৩] ফাতহুলবারী, ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃ: এবং সুনানে নাসায়ী, ২য় খন্ড ৫২-৫৩ পৃঃ।
[১৪] ফাতহুলবারী ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃঃ।
[১৫] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৫২৭-৫২৮ পৃঃ।
[১৬] মিশকাত, ২য় খন্ড ৫৬৬ পৃ: এবং ইবনু ইশাম, ২য় খন্ড ৮৬ পৃঃ।
[১৭] ফাতহুলবারী ৭ম খন্ড ৩৬১ পৃঃ।
[১৮] মুখতাসার তারীখে দেমাশক ৭ম খন্ড ৮২ পৃঃ, ‘শারহে শুযুরিয়াহব’ এর হাশিয়ার উদ্ধৃতিসহ ১১৪ পৃঃ।
[১৯] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮০ পৃঃ।
[২০] যা’দুল মাআ’দ, ২য় খন্ড ৯৫ পৃঃ।
[২১] যাদুল মাঅদ, ২য় খন্ড ৯৭ পৃঃ।
[২২] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৯১ পৃঃ।
[২৩] সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড ৪০৬ পৃঃ।
[২৪] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৭১-৮৩ পৃঃ, যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯৭ পৃঃ।
[২৫] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮২ পৃঃ।





******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url