জামাতে নামাজ আদায় ও জামাতের কাতার সোজা করার বিধান



জামাতে নামাজ আদায় ও জামাতের কাতার সোজা করার বিধান


জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব

ইসলামের প্রতিটি বিধানেই দুনিয়া ও আখিরাতের অসংখ্য কল্যাণ নিহিত আছে। মুমিনের জীবনে ঈমানের পর আবশ্যকীয় একটি বিধান হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। এর কল্যাণ বলে শেষ করা যাবে না। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পদ্ধতিগত বিধান হচ্ছে জামাতে আদায় করা। জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব ও বহুবিধ ফায়দার কথা হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে। জামাতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব ও ফজিলত এখানে উল্লেখ করা হলো:

* জামাতে নামাজ আদায়ের তাগিদ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ (সূরা : বাকারা : ৪৩)। অর্থাৎ জামাতে নামাজ আদায়কারীদের সাথে নামাজ আদায় করো।

* নবীজী সা: সারা জীবন জামাতে নামাজ আদায় করে দেখিয়েছেন, নামাজ জামাতে আদায় করতে হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা: সারা জীবন জামাতের সাথেই নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি ইন্তেকালপূর্ব অসুস্থতার সময়ও জামাত ছাড়েননি। সাহাবায়ে কেরামের পুরো জীবনও সেভাবে অতিবাহিত হয়েছে (বুখারি-হাদিস : ৬৪৪)। 

* পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই জামাতে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যা ওয়াজিবের সাথে তুলনীয় (অর্থাৎ এটি ওয়াজিবের কাছাকাছি) (মুসলিম, হাদিস : ১০৯৩)।

* শরিয়ত অনুমোদিত কোনো ওজর বা অপারগতা ছাড়া জামাতে শরিক না হওয়া বৈধ নয়। যে ব্যক্তি জামাত ত্যাগে অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে গুনাহগার হবে (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৪)।

* জামাতে নামাজ আদায় করলে এক রাকাতে ২৭ রাকাতের সওয়াব লাভ হয়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জামাতে নামাজের ফজিলত একাকী নামাজের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি’ (মুসলিম-১৪৭৭)।

* জামাতে নামাজ আদায় করলে প্রতি কদমে নেকি লাভ হয় এবং গুনাহ মাফ হয়। সাথে একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, নবীজী সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে পবিত্রতা লাভ করে মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে তার প্রতি কদমে একটি নেকি দেয়া হয়। একটি করে গুনাহ মাফ করা হয়। একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় (মুসলিম-১০৯৩)।

* জামাতে নামাজ আদায় করলে প্রথম কাতারের সওয়াব লাভ করার সুযোগ হয়। নবীজী সা: ইরশাদ করেছেন, মানুষ যদি আজান এবং প্রথম কাতারে নামাজের সওয়াব জানতো তাহলে প্রয়োজনে লটারি করে হলেও তারা তা লাভ করতো (বুখারি- হাদিস : ৬১৫)।

* জামাতে নামাজ আদায় করলে সারা রাত ইবাদতের সওয়াব লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইশার নামাজ জামাতে আদায় করে সে যেন অর্ধরাত্রি ইবাদত করল। আবার যদি ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করে তবে সে যেন পূর্ণ রাত ইবাদত করল (মুসলিম-১৪৯১)।

* জামাতে নামাজ আদায় করলে সারা দিন আল্লাহর হেফাজতে থাকা যায়। নবীজী সা: ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করে, সে আল্লাহর হেফাজতে থাকে। আল্লাহর হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে যে কষ্ট দেবে, আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-২/২৯)।

* বিনা ওজরে জামাত পরিত্যাগকারীর নিন্দায় নবীজী কঠোর কথা বলেছেন। রাসূল সা: বলেন, ‘আমার প্রাণ যাঁর হাতে, তাঁর শপথ করে বলছি, আমার ইচ্ছা হয় আমি কাঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দেই আর নামাজের আজান দেয়ার জন্য হুকুম দেই। তারপর আমি এক ব্যক্তিকে হুকুম করি, যেন সে লোকদের নামাজের ইমামতি করে। আর আমি ওই সব লোকদের দিকে যাই, যারা নামাজের জামাতে হাজির হয়নি এবং তাদের বাড়িঘরগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৮)।


কখন এবং কার জন্য জামাতে নামাজ আদায়ের বিধান প্রযোজ্য নয়

কিছু অপারগতার কারণে জামাতে উপস্থিত না হওয়ার অনুমতি আছে। যথা:

১. যদি মুষলধারে বৃষ্টি হয় (বুখারি : ১১২৬)।
২. প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ঘর থেকে বের হলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকলে জামাতে শরিক না হওয়ার অবকাশ আছে (বুখারি : ৬২৬)।
৩. রাস্তায় বেশি কাদা হলে (বদরুল মুনির : ৪/৪১৯)।
৪. অতি আঁধার হওয়া (জমউল জাওয়ামে : ১/৩০৫৮)।
৫. রাতে যদি অতিমাত্রায় মেঘ হয় (মুসনাদে আহমাদ : ৫৩০২)।
৬. অসুস্থ হলে (আবু দাউদ : ৪৬৪)।
৭. দৃষ্টিহীন ব্যক্তির জন্য (সহিহ বুখারি : ৬২৭)।
৮. এমন বৃদ্ধ, যিনি মসজিদে আসতে সক্ষম নন (ইবনে মাজাহ : ৭৮৫)।
৯. কোনো রোগীর সেবাশুশ্রƒষায় আত্মনিয়োজিত থাকলে (প্রাগুক্ত)।
১০. ঘন ঘন প্রস্রাব-পায়খানার বেগ হলে (তিরমিজি : ১৩২)।
১১. বন্দী অবস্থায় (ইবনে মাজাহ: ৭৮৫)।
১২. এক পা বা উভয় পা কর্তিত হলে (আবু দাউদ : ৪৬৪)।
১৩. এমন রোগ হওয়া, যার কারণে চলতে অক্ষম। যেমন অর্ধাঙ্গ রোগ ইত্যাদি (প্রাগুক্ত)।
১৪. খানা সামনে, সেও ক্ষুধার্ত, মনের আকর্ষণ খানার দিকে। এমন অবস্থায় জামাতে না গেলেও চলবে (সহিহ বুখারি : ৬৩১)।
১৫. সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের সময় (সহিহ বুখারি : ৩/৬৭)।
১৬. জামাতে নামাজ আদায় করতে গেলে কোনো সম্পদ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকলে জামাত ত্যাগ করতে পারবে (আবু দাউদ : ৪৬৪)।
১৭. জামাতে যাওয়ার কারণে ট্রেন, ফ্লাইট বা গাড়ি চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে জামাতে শরিক না হওয়ার অনুমতি আছে (আবু দাউদ : ৪৬৪)।

উল্লেখ্য, মহিলাদের জন্য মসজিদ থেকে ঘরে নামাজ আদায় করা উত্তম। মহিলারা মসজিদে না গিয়ে বাড়িতে নামাজ পড়বে। এটাই নবীজীর পছন্দ। সুতরাং মহিলারা বাড়িতে আদায় করবেন।


নামাজের কাতার সোজা করার গুরত্ব

নামাজে কাঁধে কাঁধ ও গিঁটে গিঁট লাগিয়ে দুই জনের মাঝে ফাঁক বন্ধ করা ও কাতারগুলো প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে পূর্ণ করার গুরুত্ব অপরিসীম। পূর্ব যুগের উম্মতের ইবাদাতের কাতার ছিল গোলাকার। আর উম্মাতে মুহাম্মাদির নামাজের কাতার লম্বালম্বি। এটা ইসলামের একটি শৃঙ্খলা। ইসলাম বিশৃঙ্খলা অনিয়মন্ত্রাতিকতা পছন্দ করে না। নামাজে কাতার সোজা করার মধ্যে এর বাস্তব দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে।

কাতার সোজা করে নামাজে দাঁড়ানোকে অনেকে সুন্নাত, কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন। দুররে মুখতারে এসেছে, ইমামের পিছনে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো ওয়াজিব এবং কাতার সোজা না করে দাঁড়ানো মাকরূহে তাহরিমি।

কাতার সোজা করে নামাজে দাঁড়ানো মুস্তাহাব, সুন্নাত বা ওয়াজিব; যাই হোক না কেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাতার আঁকা-বাকা করে দাঁড়ানোর ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক করে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-

হজরত নোমান ইবনে বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সারিসমূহ সোজা করতেন এমনভাবে যেন তার সাথে তিনি তীর সোজা করছেন। তিনি এরূপ করতেন যতক্ষণ না তিনি বুঝতে পারতেন যে, আমরা বিষয়টি তার নিকট হতে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি।

একদিন তিনি ঘর হতে বের হয়ে আসলেন এবং নামাজে দাঁড়ালেন, এমনকি তাকবিরে তাহরিমা বলতে উদ্যত হলেন, এমন সময় দেখলেন এক ব্যক্তি সারি হতে সম্মুখে সিনা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে; তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহর বান্দাগণ! হয় তোমরা তোমাদের সারি সোজা করে দাঁড়াবে; নতুবা আল্লাহ তাআলা তোমাদের মুখমণ্ডলসমূহে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিবেন। (মুসলিম)

অন্য হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝের ফাঁক বন্ধ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন এবং এর দ্বারা তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।

মুসলিম সমাজে কাতার সোজা করার প্রভাব

কাতার সোজা করার প্রভাব সমাজে ফুটে ওঠে। সুন্দর সমাজ গঠন করার ক্ষেত্রে এর অসামান্য অবদান রয়েছে। যে সমাজ নামাজের কাতারের প্রতি বেশি যত্নবান হবে সে সমাজ তত সুন্দর ও সুসংহত থাকবে। নোমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের (নামাজের) কাতারগুলো সোজা করে দিতেন, মনে হতো তিনি যেন কামানের কাঠ সোজা করছেন। যতক্ষণ না বুঝতে পারতেন যে আমরা তার থেকে পুরোপুরি বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। অতঃপর তিনি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে তাকবিরে তাহরিমা বলতে যাবেন, এমন সময় দেখলেন এক ব্যক্তি কাতার থেকে সামনে এগিয়ে আছে, তখন তিনি বলেন, আল্লাহর বান্দাগণ তোমাদের লাইন সোজা কোরো, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করে দেবেন। (মুসলিম, হাদিস : ৮৬৫)

কাতারের মাঝখানে ফাঁকা রাখলে কি হয়?

যারা কাতারের মাঝখানে ফাঁকা রেখে নামাজ আদায় করে তাদের শয়তান খুব সহজেই ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়। কারণ শয়তান এই ফাঁকা জায়গায় অবস্থান করে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কাতারে পরস্পর মিশে দাঁড়াও। কাতারসমূহকে পরস্পর নিকটবর্তী রাখো এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর শপথ! আমি শয়তানকে দেখছি ছোট ছোট বকরির মতো কাতারের মধ্যে প্রবেশ করছে। (নাসায়ি, হাদিস : ৮১৫)

কাতারের মাঝখানে ফাঁকা রাখলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মিল মোহব্বত-ভালবাসা কমে যায়। সমাজে দ্বন্দ রেশারেশি বেড়ে যায়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বেড়ে যায়। কাতার সোজা করার মাধ্যমে যেমন মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা ও ঐক্যের বন্ধন বৃদ্ধি পায়, তেমনি কাতারের মাঝখানে ফাঁকা না রাখলে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়। এটা হচ্ছে ইসলামের এক অতুলনীয় শিক্ষা। যা পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মের মধ্যে নেই।






***********************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url