মা’আরেফুল কোরআন-১৮ || সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৩৫-৩৬ || বাকারাহ ৩৫-৩৬ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৩৫-৩৬

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 وَ قُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَ زَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ وَ کُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا ۪ وَ لَا تَقۡرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَۃَ فَتَکُوۡنَا مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۳۵
 فَاَزَلَّهُمَا الشَّیۡطٰنُ عَنۡهَا فَاَخۡرَجَهُمَا مِمَّا کَانَا فِیۡهِ ۪ وَ قُلۡنَا اهۡبِطُوۡا بَعۡضُکُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّ ۚ وَ لَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ مُسۡتَقَرٌّ وَّ مَتَاعٌ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۳۶

সূরা আল-বাকারাহ ৩৫-৩৬নং আয়াতের অর্থ

(৩৫) এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। (৩৬) অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল। পরে তারা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল এবং আমি বললাম, তোমরা নেমে যাও। তোমরা পরস্পর একে অপরের শত্রু হবে এবং তোমাদেরকে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে।

সূরা আল-বাকারাহ ৩৫-৩৬নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

এবং আমি (হযরত) আদম (আ)-কে তাঁর স্ত্রীসহ বেহেশতে বসবাস করতে নির্দেশ দিলাম। (যে স্ত্রীকে আল্লাহ্ পাক স্বীয় কুদরতে হযরত আদমের পাজর থেকে নেওয়া কোন উপকরণ দ্বারা সৃষ্টি করেছিলেন।) অনন্তর তোমরা এখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও স্বচ্ছন্দে ভোগ করতে থাক, কিন্তু ও গাছের নিকটেও যেও না। অন্যথায় তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে, যারা নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে। (সেটা কি গাছ ছিল, আল্লাহ্ পাকই জানেন। যাক তা থেকে বারণ করা হয়েছিল। আর প্রভুর এ ক্ষমতা থাকে যে, নিজ বাড়ির যে সব জিনিস অনুগত দাসকে ভোগ করতে দিতে চান ভোগ করতে দেন এবং যা না চান তা থেকে বারণ করেন।) অতঃপর সে গাছের কারণে শয়তান আদম ও হাওয়াকে পদস্খলিত করে দিল এবং তাঁরা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন তা থেকে তাদেরকে পৃথক করে দিল। অনন্তর আমি তাদেরকে নীচে নেমে যেতে বললাম তোমাদের মধ্যে পরস্পর একে অপরের শত্রু হবে। তোমাদের এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে হবে এবং কাজকর্ম চালাতে হবে। (অর্থাৎ সেখানেও স্থায়িভাবে থাকতে পারবে না। কিছুকাল পর সে অবস্থান ছাড়তে হবে।)

সূরা আল-বাকারাহ ৩৫-৩৬নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

এটা আদম (আ)-এর ঘটনার সমাপ্তিপর্ব। এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের উপর হযরত আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশ্ব খেলাফতের যোগ্যতা যখন স্পষ্ট করে বলে দেয়া হলো এবং ফেরেশতাগণও তা মেনে নিলেন আর ইবলীস যখন আত্মম্ভরিতা ও হঠকারিতার দরুন কাফির হয়ে বেরিয়ে গেল, তখন হযরত আদম (আ) এবং তাঁর সহধর্মিণী হাওয়া (আ) এ নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন যে, তোমরা জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং সেখানকার নিয়ামত পরিতৃপ্তিসহ ভোগ করতে থাক। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট গাছ সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হলো যে, এর কাছেও যেও না। অর্থাৎ সেটির ভোগ পূর্ণভাবে পরিহার করবে। শয়তান আদম (আ)-এর কারণে ধিক্‌কৃত ও অভিশপ্ত হয়েছিল। যে কোন প্রকারে সুযোগ পেয়ে এবং এ গাছের উপকারাদি বর্ণনা করে তাঁদের উভয়কে সে গাছের ফল খেতে প্ররোচিত করল। নিজেদের বিচ্যুতির দরুন তাঁদেরকেও পৃথিবীতে নেমে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো। তাঁদেরকে বলে দেয়া হলো যে, পৃথিবীতে বসবাস জান্নাতের মত নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্তিপূর্ণ হবে না, বরং সেখানে মতানৈক্য ও শত্রুতার উন্মেষ ঘটবে। ফলে বেঁচে থাকার স্বাদ পূর্ণভাবে লাভ করতে পারবে না ।
وَقُلْنَا يَأْدَمُ اسْكُنُ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ (এবং আমি আদম (আ)-কে সন্ত্ৰীক জান্নাতে অবস্থান করতে নির্দেশ দিলাম।) এটা আদম সৃষ্টি ও ফেরেশতাদের সিজদার পরবর্তী ঘটনা। কোন কোন বিশেষজ্ঞ এ নির্দেশ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আদম সৃষ্টি ও সিজদার ঘটনা জান্নাতের বাইরে অন্য কোথাও ঘটেছিল। এর পরে তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে। কিন্তু এ অর্থও সুনিশ্চিত নয়। বরং এমনও হতে পারে যে, সৃষ্টি ও সিজনা উভয় ঘটনা বেহেশতেই ঘটেছিল, কিন্তু তাঁদের বাসস্থান কোথায় হবে সে সম্পর্কে তাদেরকে কোন সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তাঁদের বাসস্থান সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ঘটনার পর শোনানো হলো । رَغَدًا - وَكُلاً مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا আরবী অভিধান অনুযায়ী নিয়ামত ও আহার্যবস্তু বলতে সেই সব নিয়ামত ও আহার্যবস্তুকে বলা হয়, যা লাভ করতে কোন শ্রমসাধনার প্রয়োজন হয় না এবং এত পর্যাপ্ত ও ব্যাপক পরিমাণে লাভ হয় যে, তাতে হ্রাসপ্রাপ্তি বা নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার কোন আশংকাই থাকে না। অর্থাৎ-আদম ও হাওয়া (আ)-কে বলা হলো যে, তোমরা জান্নাতের ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করতে থাক। ওগুলো লাভ করতে হবে না এবং তা হ্রাস পাবে কিংবা শেষ হয়ে যাবে, এমন কোন চিন্তাও করতে হবে না।
وَلا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ  কোন বিশেষ গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছিল যে, এর নিকটে যেও না। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, সে গাছের ফল না খাওয়া। কিন্তু তার্কীদের জন্য বলা হয়েছে, কাছেও যেও না। সেটি কি গাছ ছিল, কোরআন করীমে তা উল্লেখ করা হয়। কোন নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারাও তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। কোন কোন মুফাসির সেটিকে গমের গাছ বলেছেন, আবার কেউ কেউ আঙুর গাছ বলেছেন। অনেকে বলেছেন, আঞ্জীরের গাছ। কিন্তু কোরআন ও হাদীসে যা অনির্দিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে তা নির্দিষ্ট করার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّلِمينَ অর্থাৎ—যদি এই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাও, তবে তোমরা উভয়েই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। زلة - فَازَ لَّهُمَا الشَّيْطنُ عَنْهَـ শব্দের অর্থ বিচ্যুতি বা পদস্খলন। অর্থাৎ শয়তান আদম ও হাওয়াকে পদস্খলিত করেছিল বা তাঁদের বিচ্যুতি ঘটিয়েছিল। কোরআনের এ সব শব্দে পরিষ্কার এ কথা বোঝা যায় যে, আদম ও হাওয়া কর্তৃক আল্লাহ্ পাকের হুকুম লঙ্ঘন সাধারণ পাপীদের মত ছিল না বরং শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হয়েই তাঁরা এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরিণামে যে গাছের ফল নিষিদ্ধ ছিল, তা খেয়ে বসলেন ।
এখানে প্রশ্ন ওঠে যে, যখন সিজদা না করার কারণে শয়তানকে অভিশপ্ত করে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হলো তখন আদম (আ)-কে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে কিভাবে সে বেহেশতে পৌঁছলো ? এর সুস্পষ্ট জওয়াব এই যে, শয়তানের প্রতারণার এবং বেহেশতে পৌঁছার অনেক রূপ হতে পারে। হয়ত সাক্ষাৎ ব্যতীতই তাঁদের অন্তঃকরণে প্রবঞ্চনা ঢেলে দিয়েছিল, কিংবা এমনও হতে পারে যে, শয়তান জিন জাতিভুক্ত বলে আল্লাহ্ পাক তাকে এমন সব কাজের ক্ষমতা দান করেছেন, যা সাধারণত মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাদের বিভিন্ন আকৃতি ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। হতে পারে, দানবীয় ক্ষমতাবলে বা সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে আদম ও হাওয়ার মনকে প্রভাবান্বিত ও প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত করে ফেলেছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, অন্য কোন রূপে—যেমন, সাপ প্রভৃতির আকৃতি ধারণ করে শয়তান জান্নাতে প্রবেশ করেছিল। সম্ভবত এ কারণেই তার শত্রুতার প্রতি হযরত আদম (আ)-এর কোন লক্ষ্যই ছিল না। কোরআন মজীদের আয়াত وَقَاسَمَهُما إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ (শয়তান তাঁদেরকে কসম করে বলল যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কল্যাণকামী ও সদুপদেশদানকারী।) এ আয়াত দ্বারাও একথাই বোঝা যায় যে, শয়তান শুধু প্রবঞ্চনা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আদম ও হাওয়াকে মৌখিক কথার মাধ্যমে এবং কসম দিয়ে দিয়েও প্রভাবিত করেছে।

فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ অর্থাৎ শয়তান এই প্রবঞ্চনা ও পদস্খলনের দ্বারা আদম ও হাওয়া (আ)-কে সেসব নিয়ামতাদি থেকে পৃথক করে দিল, যেগুলোর মাঝে তাঁরা অতি স্বাচ্ছন্দ্যে কালাতিপাত করছিলেন। এই বের করা যদিও আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী হয়েছিল, কিন্তু এর কারণ যেহেতু ছিল শয়তান, সুতরাং বের করাকে শয়তানের সাথেই সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُو  অর্থাৎ 'আমি তাদেরকে হুকুম করলাম তোমরা নীচে নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু থাকবে।' এ নির্দেশে হযরত আদম ও হাওয়াকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর সে সময় পর্যন্ত যদি শয়তানকে আসমান থেকে বের করে না দেয়া হয়ে থাকে, তবে সেও এ সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক্ষেত্রে পারস্পরিক শত্রুতার অর্থ এই যে, শয়তানের সাথে তোমাদের শত্রুতা দুনিয়াতেও সমভাবেই বলবৎ থাকবে। আর যদি এ ঘটনার পূর্বেই শয়তান বিতাড়িত হয়ে থাকে, তবে বাক্যের সম্বোধন আদম ও হাওয়া (আ) এবং তাঁদের বংশধরদের প্রতি হবে। যার অর্থ হবে এই যে, তাঁদের এক শাস্তি তো এই হলো যে, তাঁদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হলো। এরই সাথে দ্বিতীয় শাস্তি এই যে, তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা থাকবে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, সন্তানদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা বিরাজ করলে পিতা-মাতার বেঁচে থাকার আকর্ষণ বিদায় নেয় এবং জীবনের মাধুর্য লোপ পায়। তাই এটাও এক প্রকারের আভ্যন্তরীণ ও মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি । وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلى حِينٍ অর্থাৎ-আদম ও হাওয়ার প্রতি ইরশাদ হয়েছে, তোমাদেরকে পৃথিবীতে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করতে হবে এবং এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতে হবে। কিছুকাল পর এ অবস্থানও ছেড়ে যেতে হবে। 

উল্লিখিত আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট মাস'আলা ও শরীয়তের বিধান
أسكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ (তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক। এ আয়াতে হযরত আদম ও হাওয়া (আ) উভয়ের জন্য জান্নাতকে বাসস্থান বানানোর কথা বলা হয়েছে। যা সংক্ষিপ্ত শব্দে এভাবেও বলা যেতো أسْكُنَا الْجَنَّةَ (আপনারা উভয়ে বেহেশতে বসবাস করুন) যেমন, এরপরে  كُلاً এবং لَا تَقْرَبَا এর মধ্যে দ্বিবচনমূলক একই ক্রিয়ায় উভয়কে একত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এর বিপরীতভাবে أَنْتَ وَزَوْجُكَ শব্দসমূহ গ্রহণ করে প্রত্যক্ষভাবে শুধু আদম (আ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে যে, আপনার স্ত্রীও যেন জান্নাতে বসবাস করেন। এ দ্বারাও দু'টি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথমত স্ত্রীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব স্বামীর উপর, দ্বিতীয়ত বসবাসের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর অধীন। যে বাড়িতে স্বামী বসবাস করবে, সে বাড়িতেই স্ত্রীর বসবাস করা উচিত।
মাসআলাঃ أسكُنْ শব্দে এ ইঙ্গিতও রয়েছে যে, সে সময়ে হযরত আদম ও হাওয়া (আ)-এর জান্নাতবাস ছিল নিতান্তই সাময়িক; ফেরেশতাদের মত স্থায়ী ছিল না। কেননা أسكُنْ শব্দের অর্থ, সে বাড়িতে বসবাস করতে থাক। তাঁদেরকে একথা বলা হয়নি যে, এ বাড়ি তোমাদেরকে দিয়ে দেয়া হলো, সুতরাং এটা তোমাদেরই বাড়ি। কারণ একথা আল্লাহ্ পাকের জানা ছিল যে, অদূর ভবিষ্যতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে, যাতে আদম ও হাওয়া (আ)-কে জান্নাতের আবাস পরিত্যাগ করতে হবে। অধিকন্তু জান্নাতের অধিকার ঈমান এবং সৎকর্মের বিনিময়ে লাভ করা যায়, যা কিয়ামতের পরে হবে। এর দ্বারা ফকীহগণ এ মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি কাউকে বলে, আমার বাড়িতে বসবাস করতে থাক বা আমার এ বাড়ি তোমার বাসস্থান, তবে এর ফলে সে ব্যক্তির জন্য বাড়ির স্বত্ব বা স্বায়ী অধিকার লাভ হয় না।

খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর অনুসারী নয়

وَكُلاً مِنْهَا رَغَدًا অর্থাৎ- 'তোমরা উভয়ে জান্নাতে অতি স্বাচ্ছন্দ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাও-দাও। এখানে পূর্ববর্ণিত পদ্ধতিতে শুধু আদম (আ)-কে সম্বোধন করা হয়নি, বরং উভয়কে একই শব্দের অন্তর্ভুক্ত করে كُلاً (উভয়ে খাও) বলা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর অনুসারী ও অধীন নয়। স্বামী যেমন নিজস্ব ইচ্ছানুসারে প্রয়োজন ও চাহিদা মত খাবার ব্যবহার করবে, তেমনি স্ত্রীও নিজ চাহিদা ও ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করবে।

যে কোন স্থানে চলাফেরার স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার

رَغَدًا - رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا শব্দে খাদ্যদ্রব্যের প্রাচুর্য ও ব্যাপকতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে জিনিস যত ইচ্ছা খেতে পার। শুধু একটি গাছ ছাড়া অন্য কোন বস্তুতে কোন বাধা-নিষেধ নেই। شَئْتُمَا শব্দের দ্বারা স্থান ও জায়গার ব্যাপকতা ও পর্যাপ্ততা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র জান্নাত যেখানে খুশি, যেমন করে খুশি ভোগ করবে। গমনাগমনে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, গতিবিধি এবং বিভিন্ন স্থান থেকে নিজের প্রয়োজনাদি মেটাবার স্বাধীনতা মানুষের অনুগত অধিকার। যদি একটা সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট বাড়ি বা জায়গায় প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাবার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্যের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ থাকে, তবে তাও এক প্রকারের বন্দীদশা। এজন্য হযরত আদম (আ)-কে খাওয়া-পরার যাবতীয় বস্তু প্রচুর ও পর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়নি, বরং حَيْثُ شِئْتُمَا (যেখানে এবং যত ইচ্ছা) বলে তাদেরকে চলাফেরা এবং সর্বত্র যাতায়াতের স্বাধীনতাও প্রদান করা হয়েছে।

মাধ্যমসমূহ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়

وَلا تَقْرَبَا هذه الشَّجَرَةَ অর্থাৎ “এ গাছের ধারে-কাছেও যেও না।” এ বারণের ফলে একথা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, সে বৃক্ষের ফল না খাওয়াই ছিল এই নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত উদ্দেশ্য। কিন্তু সাবধানতাসূচক নির্দেশ ছিল এই যে, সে গাছের কাছেও যেও না। এর দ্বারাই ফিকাহ্ শাস্ত্রের কারণ-উপকরণের নিষিদ্ধতার মাসআলাটি প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ কোন বস্তু নিজস্বভাবে অবৈধ বা নিষিদ্ধ না হলেও যখন তাতে এমন আশংকা থাকে যে, ঐ বন্ধু গ্রহণ করলে অন্য কোন হারাম ও অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিতে পারে, তখন ঐ বৈধ বস্তুও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। যেমন, গাছের কাছে যাওয়া তার ফল-ফসল খাওয়ার কারণও হতে পারতো। সেজন্য তাও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। একে ফিকাহশাস্ত্রের পরিভাষায় তো سدذرائع (উপকরণের নিষিদ্ধতা) বলা হয়।

নবীগণের নিষ্পাপ হওয়া

এ বর্ণনার দ্বারা হযরত আদম (আ)-কে বিশেষ গাছ বা তার ফল খেতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ ব্যাপারেও সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। কাজেই সে যেন তোমাদেরকে পাপে লিপ্ত করে না দেয়। এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (আ)-এর তা খাওয়া বাহ্যিকভাবে পাপ বলে গণ্য। অথচ নবীগণ পাপ থেকে বিমুক্ত ও পবিত্র। সঠিক তথ্য এই যে, নবীগণের যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকার কথা যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা এবং লিখিত ও বর্ণনাগতভাবে প্রমাণিত। চার ইমাম ও উম্মতের সম্মিলিত অভিমতেও নবীগণ ছোট-বড় যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
কারণ, নবী (আ)-দেরকে গোটা মানব জাতির অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল। যদি তাঁদের দ্বারাও আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছার পরিপন্থী ছোট-বড় কোন পাপ কাজ সম্পন্ন হতো, তবে নবীদের বাণী ও কার্যাবলীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যেত এবং তাঁরা আস্থাভাজন থাকতেন না। যদি নবীদের উপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে, তবে দীন ও শরীয়তের স্থান কোথায়? অবশ্য কোরআন পাকের বহু আয়াতে অনেক নবী (আ) সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁদের দ্বারাও পাপ সংঘটিত হয়েছে এবং আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে এজন্য তাঁদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। হযরত আদম (আ)-এর ঘটনাও এ শ্রেণীভুক্ত।

এ ধরনের ঘটনাবলী সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, কোন ভুল বোঝাবুঝি বা অনিচ্ছাকৃত কারণে নবীদের দ্বারা এ ধরনের কাজ সংঘটিত হয়ে থাকবে। কোন নবী (আ) জেনেশুনে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্ পাকের হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেন নি। এ ত্রুটি ইজতেহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তা ক্ষমাযোগ্য। শরীয়তের পরিভাষায় একে পাপ বলা চলে না এবং এ ধরনের ভ্রান্তিজনিত ও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি সেসব বিষয়ে হতেই পারে না, যার সম্পর্ক শিক্ষা-দীক্ষা এবং শরীয়তের প্রচারের সাথে রয়েছে, বরং তাঁদের ব্যক্তিগত কাজকর্মে এ ধরনের ভুল-ত্রুটি হতে পারে।

কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ পাকের দরবারে নবীদের স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চে এবং যেহেতু মহান ব্যক্তিদের দ্বারা ক্ষুদ্র ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘটিত হলেও তাকে অনেক বড় মনে করা হয়, সেহেতু কোরআন হাকীমে এ ধরনের ঘটনাবলীকে অপরাধ ও পাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আদৌ পাপ নয়।

হযরত আদম (আ)-এর ঘটনা সম্পর্কে তফসীরবিদরা বহু কারণ বর্ণনা করেছেন এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন-

১. হযরত আদম (আ)-কে যখন নিষেধ করা হয়েছিল, তখন এক বিশেষ গাছের প্রতি ইঙ্গিত করেই তা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে শুধুমাত্র সে গাছটিই উদ্দেশ্য ছিল না; বরং সে জাতীয় যাবতীয় গাছই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন, হাদীসে বর্ণিত আছে যে, একদিন রসূলুল্লাহ্ (সা) এক খণ্ড রেশমী কাপড় ও এক খণ্ড স্বর্ণ হাতে নিয়ে এরশাদ করলেন, এ বন্ধু দু'টি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্যে হারাম। একথা সুস্পষ্ট যে, ছয়ূর (সা)-এর হাতের ঐ বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখণ্ডের ব্যবহারই শুধু হারাম ছিল না বরং যাবতীয় রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ সম্পর্কেই ছিল এ হুকুম। কিন্তু এখানে হয়তো এ ধারণাও হতে পারে যে, এ নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক সেই বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেগুলো সে সময় তাঁর হাতে ছিল। অনুরূপভাবে হযরত আদম (আ)-এর হয়তো এ ধারণা হয়েছিল যে, যে গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে নিষেধ করা হয়েছিল, নিষেধের সম্পর্ক শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শয়তান এ ধারণা তাঁর অন্তরে সঞ্চার করে বদ্ধমূল করে দিয়েছিল এবং কসম খেয়ে খেয়ে বিশ্বাস জন্মিয়েছিল যে, “যেহেতু আমি তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী, অতএব, আমি তোমাদেরকে এমন কোন কাজের পরামর্শ দিচ্ছি না, যা তোমাদের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। যে গাছ সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে, সেটি অন্য গাছ।”

তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, শয়তান এ প্রবঞ্চনা তাঁর অন্তঃকরণে ঢেলে দিয়েছিল যে, এ গাছ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আপনার সৃষ্টির সূচনাপর্বের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। যেমন, সদ্যজাত শিশুকে জীবনের প্রথম পর্যায়ে শক্ত ও গুরুপাক আহার থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু সময় ও শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে সব ধরনের আহার গ্রহণের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং আপনি এখন শক্ত-সমর্থ হয়েছেন; এখন সে বিধি-নিষেধ কার্যকর নয়।
আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, শয়তান যখন হযরত আদম (আ)-কে সে গাছের * উপকারিতা ও গুণাবলীর বর্ণনা দিচ্ছিল, যেমন-সে গাছের ফল খেয়ে আপনি অনন্তকাল নিশ্চিন্তে জান্নাতের নেয়ামতাদি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে পারবেন, তখন তাঁর সৃষ্টির প্রথম পর্বে সে গাছ সম্পর্কে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা তাঁর মনে ছিল না। কোরআন মজীদের فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا  (অর্থাৎ, আদম (আ) ভুলে গেলেন এবং আমি তাঁর মধ্যে
[সংকল্পের ] দৃঢ়তা পাইনি) আয়াতও এ সম্ভাব্যতা সমর্থন করে ।

যা হোক, এ ধরনের বহু সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে সারকথা এই যে, হযরত আদম (আ) বুঝে-শুনে, ইচ্ছাকৃতভাবে এ হুকুম অমান্য করেন নি, বরং তিনি ভুল করেছিলেন বা তাঁর ইজতেহাদগত বিচ্যুতি ঘটেছিল, যা প্রকৃতপক্ষে কোন পাপ নয়। কিন্তু হযরত আদম (আ)-এর শানে-নয়ত এবং আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে তাঁর উচ্চ-মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচ্যুতিকেও যথেষ্ট বড় মনে করা হয়েছিল। আর কোরআন মজীদ সেজন্যই একে পাপ বলে অভিহিত করেছে। অবশ্য আদম (আ)-এর তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার পর তা মাফ করে দেওয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিতর্ক অনাবশ্যক যে, শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আদম (আ)-কে প্রতারিত করার জন্য কিভাবে আবার সেখানে প্রবেশ করল। কারণ শয়তানের প্রবঞ্চনার জন্য জান্নাতে প্রবেশের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা আল্লাহ পাক শয়তান ও জ্বিন জাতিকে দূরে থেকেও প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন।

অনুরূপভাবে এ প্রশ্ন যে, হযরত আদম ও হাওয়া (আ)-কে পূর্বাহ্নেই সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমাদেরকে দিয়ে যেন এমন কোন কাজ করিয়ে না বসে, যে কারণে তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হতে হয়। এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (আ) শয়তান কর্তৃক কেমন করে প্রতারিত হলেন। উত্তরে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ্ পাক জ্বিন ও শয়তানকে বিভিন্ন আকার ও অবয়বে আত্মপ্রকাশের শক্তি দিয়েছেন। হতে পারে, সে এমন রূপ ধারণ করে সামনে এসেছিল যে, হযরত আদম (আ) বুঝতেই পারেন নি যে, সে-ই শয়তান ।





**********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url