মা’আরেফুল কোরআন-১১ || সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াতঃ ৮-২০ || বাকারাহ্ ৮-২০ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||







بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াতঃ ৮-২০

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الاخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ ) يُحْدِعُونَ اللهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ ) في قُلُوبِهِمْ مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ اَلِيمَ هُ بِمَا كَانُوا يَكذِبُونَ وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ ) الا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِن لَّا يَشْعُرُونَ وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ أَمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ الا انَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاء وَلَكِنْ لاَ يَعْلَمُونَ وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيْطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُونَ اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّ هُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ ) أوليك الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَلَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهُ ذَهَبَ اللهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِي ظُلت لاَ يُبْصِرُونَ هُم بِكُمْ عُمَى فَهُمْ لَا يرْجِعونَ اَوْ كَصَيْبٍ مِنَ السَّمَاءِ فِيهِ ظُلُمَتٌ وَرَعْدٌ وَبَرْقٌ، يَجْعَلُونَ اَصَابِعَهُمْ فِي أَذَانِهِمْ مِّنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الْمَوْتِ وَاللَّهُ مُحِيطٌ بِالْكَفِرِينَ ® يكَادُ الْبَرْقُ يَخْطَفُ أَبْصَارَهُمْ كُلَّمَا أَضَاءَ لَهُمْ مَشَوافِيهِ وَإِذَا أَظْلَمَ عَلَيْهِمْ قَامُواد وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرُن

সূরা আল-বাকারাহ্ ৮-২০ আয়াতের অর্থ

(৮) আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি, অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। (৯) তারা আল্লাহ্ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না। (১০) তাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রস্ত আর আল্লাহ্ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুত তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন। (১১) আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। (১২) মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী- কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না। (১৩) আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বুঝে না। (১৪) আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি ---আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র। (১৫) বরং আল্লাহই তাদের সাথে উপহাস করেন আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে। (১৬) তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়তের বিনিময়ে গোমরাহী র করে। বস্তুত তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি। (১৭) তাদের অবস্থা সে ব্যক্তির মত, যে লোক কোথাও আগুন জ্বালালো এবং তার চারদিককার সবকিছুকে যখন আগুন স্পষ্ট করে তুলল, ঠিক এমনি সময় আল্লাহ্ তার চারদিকের আলোকে উঠিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে অন্ধকারে ছেড়ে দিলেন। ফলে, সে কিছুই দেখতে পায় না। (১৮) তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। (১৯) আর তাদের উদাহরণ সেসব লোকের মত যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ো রাতে পথ চলে, যাতে থাকে আঁধার, গর্জন ও বিদ্যুৎচমক। মৃত্যুর ভয়ে গর্জনের সময় কানে আঙুল দিয়ে রক্ষা পেতে চায় । অথচ সমস্ত কাফেরই আল্লাহ্ কর্তৃক পরিবেষ্টিত। (২০) বিদ্যুতালোকে যখন সামান্য আলোকিত হয়, তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেন। আল্লাহ যাবতীয় বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতাশীল।

সূরা বাকারা ৮-২০ আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর মানবকুলের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ্ তা'আলা ও পরকালে ঈমান এনেছি ; অথচ তারা আদৌ ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ্ এবং ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দেয়। অথচ তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না এবং তারা অনুভব করতে পারে না যে, এ ধোঁকার পরিণাম তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। তাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিপূর্ণ; আর আল্লাহ্ তাদের এ ব্যাধি আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। (তাদের দুষ্কর্ম, অবিশ্বাস এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি দেখে হিংসার আগুনে জ্বলা এবং তাদের কুফর প্রকাশ হওয়াতে সর্বদা তাদের দুশ্চিন্তা ও নাভিশ্বাস সবই অন্তর্ভুক্ত।) আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি । কারণ, তারা মিথ্যা কথা বলে। (অর্থাৎ ঈমানের মিথ্যা দাবি করে!) আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে ঝগড়া ও ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। তাদের দু'মুখো নীতির দরুন যখন ফেতনা-ফাসাদের সৃষ্টি হতে থাকে এবং শুভাকাঙ্ক্ষী যখন বলেন যে, এ জাতীয় কাজ-কর্মে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়, তা ত্যাগ কর, তখন তারা নিজেদেরকে মীমাংসাকারী বলে দাবি করে (অর্থাৎ তাদের দ্বারা সৃষ্ট বিবাদকেই মীমাংসা মনে করে)। স্মরণ রেখ, তারাই ফাসাদী, কিন্তু তারা তা অনুভব করে না । (এ তো তাদের অজ্ঞতা ও অহমিকার পরিণাম যে, নিজের দোষকে তারা গুণ মনে করে এবং সৎ ও ভাল কাজ যথা অন্যের ঈমানকে দোষ মনে করে।) আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, অন্যান্য মানুষের মত তোমরাও ঈমান আন, তখন তারা বলে যে, বোকাদের মত আমরাও কি ঈমান আনব? স্মরণ রেখ, তারাই বাস্তবপক্ষে বোকা কিন্তু তারা তা বুঝে না। (এ সব মুনাফিক প্রকাশ্যে সরলপ্রাণ মুসলমানদের সাথে এভাবে কথাবার্তা বলত, যাতে তাদের সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ করা না যায় এবং নিজেদের অন্তরে অবিশ্বাসকে গোপন রাখত।) আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশত তখন বলত, আমরা তো ঈমান এনেছি। আবার যখন মুনাফিক সরদারদের সাথে মিশত, তখন বলত আমরা তোমাদের সাথেই আছি। তাদের (মুসলমানদের) সাথে উপহাস ও তাদেরকে বিদ্রূপ করার জন্য মেলামেশা করি। (বিদ্রূপচ্ছলে আমরা তাদেরকে বলি, আমরাও ঈমান এনেছি।) বরং আল্লাহ তা'আলাই তাদের সাথে বিদ্রূপ করেন, আর তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন, যেন তারা তাদের অহংকার ও কু-মতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে। (আল্লাহর বিদ্রূপের নমুনাই হচ্ছে যে, তাদেরকে সময় দিয়েছেন যাতে তারা কুফর ও অবাধ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করে; আর চরম অন্যায়ে লিপ্ত হয়, তখন, হঠাৎ একবারে তাদের মূল উৎপাটন করবেন। তাদের বিদ্রূপের প্রত্যুত্তরেই আল্লাহর এ কাজ, তাই একে বিদ্রূপ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।) তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি, আর তারা হেদায়েতও লাভ করেনি। (অর্থাৎ তাদের ব্যবসার যোগ্যতাও নেই, তাই হেদায়েতের মত মূল্যবান বস্তুর পরিবর্তে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছে।) তাদের অবস্থা সে ব্যক্তির মত, যে ব্যক্তি অগ্নি-প্রজ্বলিত করে, যখন তার চারদিক আলোকিত হয় এমন সময় আল্লাহ্ তা'আলা তার কাছ থেকে আলো উঠিয়ে নিয়ে তাকে অন্ধকারে ছেড়ে দেন, যাতে সে কিছুই দেখতে না পায়। (সে ব্যক্তি এবং তার সাথিগণ যেভাবে আলোর পরে অন্ধকারে রয়ে গেল; মুনাফিকরাও অনুরূপভাবে হক ও সত্য প্রকাশ হবার পরও গোমরাহীর অন্ধকারে নিমগ্ন হয়ে রইল। আর অন্ধকারে প্রথমোক্ত ব্যক্তির হাত, পা, কান, চক্ষু সবই অকর্মণ্য হয়ে গেল, অনুরূপভাবে গোমরাহীর অন্ধকারে শেষোক্ত ব্যক্তিদের (মুনাফিকদের) অবস্থাও তা-ই হলো ।

তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। সুতরাং তারা এখন আর ফিরবে না। (অর্থাৎ তাদের অনুভূতিতে সত্য ও হক বুঝবার মত যোগ্যতা রইল না। যে সমস্ত মুনাফিক মনখোলাভাবে কুফরীতে নিমগ্ন, ঈমানের কল্পনাও কোনদিন করেনি, তাদের এ অবস্থা। মুনাফিকদের আর একটি দল, যারা ইসলামের সত্যতা দেখে এ দিকে ধাবিত হয় কিন্তু পরে স্বার্থপরতার চাপে মত পরিবর্তন করে নেয়, পরবর্তী আয়াতে তাদেরই বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে।) আর তাদের উদাহরণ ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের মত, যারা দুর্যোগপূর্ণ বৃষ্টির রাতে পথ চলে, যাতে অন্ধকার ও বিজলীর গর্জন হতে রক্ষা পেতে চায়। অথচ সমস্ত কাফের আল্লাহরই ক্ষমতার আওতাভুক্ত। বিদ্যুতের অবস্থা যে, মনে হয় তাদের দৃষ্টিশক্তি এখনই হরণ করবে। যখন একটু আলোকিত হয়, তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার বিরাজ করে, তখন দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, তাদের শ্রবণশক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেন। আল্লাহ্ সকল বস্তুর উপর সর্বশক্তিমান (যেভাবে এ সমস্ত লোক কখনও তুফানের দরুন, কখনও ঠাণ্ডা বায়ুর দরুন আবার কখনও বৃষ্টির দরুন পথচলা বন্ধ করে, আবার একটু সুযোগ পেলেই সামনে অগ্রসর হয়, সন্দিহান মুনাফিকদের অবস্থাও তদ্রূপ।)

সূরা বাকারা ৮-২০ আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্কঃ সূরা আল-বাকারার প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কোরআন এমন এক কিতাব, যা সর্বপ্রকার সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে। অতঃপর বিশটি আয়াতের মধ্যে কোরআনকে যারা মান্য করে, আর মানে না, তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম পাঁচ আয়াতে মান্যকারীদের কথা, 'মুত্তাকীন' শিরোনামে এবং অন্য দু'আয়াতে সে সমস্ত অমান্যকারীর কথা, যারা প্রকাশ্যে অমান্য করে এবং বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তী তেরটি আয়াতে সে সমস্ত মুনাফিকের কথা বলা হয়েছে, যারা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মু'মিন বলে প্রকাশ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মু'মিন নয়। কোরআন তাদেরকে মুনাফিক বলে আখ্যা দিয়েছে।

উপরিউক্ত আয়াতের মধ্যে দু'টি আয়াতে মুনাফিকদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক লোক আছে, যারা বলে যে, আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তারা আদৌ ঈমানদার নয় ; বরং তারা আল্লাহ্ তা'আলা ও মু'মিনদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদেরকে ব্যতীত অন্য কাউকেও ধোঁকা দিচ্ছে না।

এতে তাদের ঈমানের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবিও ধোঁকা। একথা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না এবং তারাও একথা হয়তো ভাবে না যে, তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে পারবে, বরং রাসূল (সা) এবং মুসলমানদের সাথে ধোঁকাবাজি করার দরুনই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করছে। (কুরতুবী)

এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃত প্রস্তাবে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলা সমস্ত ধোঁকা ও ফেরেবের ঊর্ধ্বে। অনুরূপ তাঁর রসূল এবং মু'মিনগণও ওহীর বদৌলতে ছিলেন সমস্ত ধোঁকা ও ফেরেব থেকে নিরাপদ। কারো পক্ষে তাঁদের কোন ক্ষতি করা ছিল অস্বাভাবিক। পরন্তু তাদের এ ধোঁকার ক্ষতিকর পরিণতি দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই তাদের উপর পতিত হতো। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের অন্তর রোগাক্রান্ত বা অসুস্থ। তাই আল্লাহ্ তা'আলা তাদের এ রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।

রোগ সে অবস্থাকেই বলা হয়, যে অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিক অবস্থার বাইরে চলে যায় এবং তাদের কাজ-কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। শেষ পরিণাম ধ্বংস ও মৃত্যু। হযরত জুনায়দ বাগদাদী (র) বলেন, যেভাবে অসতর্কতার দরুন মানুষের শরীরে রোগের সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে প্রবৃত্তির প্ররোচনার অনুকরণের দ্বারা মানুষের অন্তরেও রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এ আয়াতে তাদের অন্তর্নিহিত কুফরকে রোগ বলা হয়েছে, যা আত্মিক ও শারীরিক উভয় বিবেচনায়ই বড় রোগ। রূহানী ব্যাধি তো প্রকাশ্য; কেননা, প্রথমত এ থেকে স্বীয় স্রষ্টা -পালনকর্তার না-শোকরি ও অবাধ্যতা সৃষ্টি হয়। যাকে কুফর বলা হয়, তা মানবাত্মার জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যাধি। এতদসঙ্গে মানব সভ্যতার জন্যও অত্যন্ত ঘৃণ্য দোষ। দ্বিতীয়ত, দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সত্যকে গোপন করা এবং স্বীয় অন্তরের কথাকে প্রকাশ করার হিম্মত না করা--এ দ্বিতীয় ব্যাপারটিও অন্তরের বড় রোগ। মুনাফিকদের শারীরিক রোগ এজন্য যে, তারা সর্বদাই এ ভয়ের মধ্যে থাকে যে, না জানি কখন কোথায় তাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। দিবারাত্র এ চিন্তায় ব্যস্ত থাকাও একটা মানসিক তথা শারীরিক ব্যাধিই বটে! তাছাড়া এর পরিণাম অনিবার্যভাবেই ঝগড়া ও শত্রুতা। কেননা, মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে তারা সব সময়ই হিংসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে কিন্তু সে হতভাগা নিজের অন্তরের কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারে না। ফলে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে ।

“আল্লাহ্ তাদের রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।” এর অর্থ এই যে, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি দেখে জ্বলে-পুড়ে দিন দিন ছাই হতে থাকে। আল্লাহ্ তো দিন দিন তার দীনের উন্নতি দিয়েই যাচ্ছেন। ফলে তারা দিন দিন শুধু হিংসার আগুনে দক্ষিভূত হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থ ও পঞ্চম আয়াতে মুনাফিকদের সে ভুলের আলোচনা করা হয়েছে যে, তারা ফেতনা-ফাসাদকে মীমাংসা এবং নিজেদেরকে মীমাংসাকারী মনে করে। কোরআন পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে যে, ফাসাদ ও মীমাংসা মৌখিক দাবির উপর নির্ভরশীল নয়। অন্যথায় কোন চোর বা ডাকাতও নিজেকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলতে রাজী নয়। এ ব্যাপারটি একান্তভাবে ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সমষ্টির আচরণের উপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণ যদি ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টির কারণ হয়, তবে এসব কাজ যারা করে তাদেরকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুসিদই বলতে হবে। চাই একাজে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা তার উদ্দেশ্য হোক বা না-ই হোক ।

ষষ্ঠ আয়াতে মুনাফিকদের সামনে সত্যিকার ঈমানের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে- أَمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ অর্থাৎ অন্যান্য লোক যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও অনুরূপভাবে ঈমান আন। এ স্থলে 'নাস' শব্দের দ্বারা সাহাবীগণকে বোঝানো হয়েছে। মুফাসসিরগণ এতে একমত। কেননা কোরআন অবতরণের যুগে তাঁরাই ঈমান এনেছিলেন। আর আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে সাহাবীগণের ঈমানের অনুরূপ ঈমানই গ্রহণযোগ্য; যে বিষয়ে তাঁরা যেভাবে ঈমান এনেছিলেন অনুরূপ ঈমান যদি অন্যেরা আনে তবেই তাকে ঈমান বলা হয়। অন্যথায় তাকে ঈমান বলা চলে না। এতে বোঝা গেল যে, সাহাবীগণের ঈমানই ঈমানের কষ্টিপাথর। যার নিরিখে অবশিষ্ট সকল উম্মতের ঈমান পরীক্ষা করা হয়। এ কষ্টিপাথরের পরীক্ষায় যে ঈমান সঠিক প্রমাণিত না হয়, তাকে ঈমান বলা যায় না এবং অনুরূপ ঈমানদারকে মু'মিন বলা চলে না। এর বিপরীত যত ভাল কাজই হোক না কেন আর যত নেক-নিয়তেই করা হোক না কেন, আল্লাহর নিকট তা ঈমানরূপে স্বীকৃতি পায় না। সে যুগের মুনাফিকগণ সাহাবীগণকে বোকা বলে আখ্যায়িত করেছে। বস্তুত এ ধরনের গোমরাহী সর্বযুগেই চলে আসছে। যারা গোমরাহদেরকে পথ দেখায়, তাদের ভাগ্যে সাধারণত বোকা, অশিক্ষিত প্রভৃতি আখ্যাই জুটে থাকে। কিন্তু কোরআন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, এসব লোক নিজেরাই বোকা । কেননা, এমন উজ্জ্বল ও প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী থাকা সত্ত্বেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার মত জ্ঞান-বুদ্ধি তাদের হয়নি।

সপ্তম আয়াতে মুনাফিকদের কপটতা ও দ্বিমুখী নীতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; তারা যখন মুসলমানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি; ঈমান এনেছি। আর যখন তাদের দলের কাফেরদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথেই রয়েছি, মুসলমানদের সাথে একটু রহস্য এবং তাদের বোকা বানাবার জন্য মিশেছি।

অষ্টম আয়াতে তাদের এ বোকামির উত্তর দেওয়া হয়েছে। তারা মনে করে, আমরা মুসলমানদেরকে বোকা বানাচ্ছি। অথচ বাস্তবপক্ষে তারা নিজেরাই বোকা সাজছে। আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে একটু ঢিল দিয়ে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছেন। প্রকাশ্যে তাদের কোন শাস্তি না হওয়াতে তারা আরো গাফলতিতে পতিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা তাদের উপহাস ও ঠাট্টার প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি এরূপ আচরণ করেছেন বলেই একে উপহাস বা বিদ্রূপ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
নবম আয়াতে মুনাফিকদের সে অবস্থার বর্ণনা রয়েছে যে, তারা ইসলামকে নিকট হতে দেখেছে এবং তার স্বাদও পেয়েছে, আর কুফরীতে তো পূর্ব থেকেই লিপ্ত ছিল। অতঃপর ইসলাম ও কুফর উভয়কে দেখে বুঝেও তাদের দুনিয়ার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করেছে। তাদের এ কাজকে কোরআনে তেজারতের সাথে তুলনা দিয়ে জানানো হয়েছে যে, তাদের তেজারতের যোগ্যতাই নেই। তারা উত্তম ও মূল্যবান বস্তু ঈমানের পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও মূল্যহীন বস্তু কুফরকে ক্রয় করেছে।

শেষ চার আয়াতে দু'টি উদাহরণ দিয়ে মুনাফিকদের কার্যকলাপকে ঘৃণ্য আচরণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মুনাফিকদের দু'শ্রেণীর লোকের পরিপ্রেক্ষিতেই এখানে পৃথক দু'টি উদাহরণ পেশ করা হয়েছে।

মুনাফিকদের একশ্রেণীর লোক হচ্ছে তারা, যারা কুফরীতে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন ছিল। কিন্তু মুসলমানদের নিকট থেকে জাগতিক স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে মুখে ঈমানের কথা প্রকাশ করত। ঈমান ও ইসলামের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হচ্ছে তারা, যারা ইসলামের সত্যতায় প্রভাবিত হয়ে, কখনো প্রকৃত মু'মিন হতে ইচ্ছা করত, কিন্তু দুনিয়ার উদ্দেশ্য তাদেরকে এ ইচ্ছা হতে বিরত রাখত। এভাবে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দিনাতিপাত করত।

আলোচ্য আয়াতগুলোর মধ্যে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর নাগালের ঊর্ধ্বে নয়। সব সময়, সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাক তাদের ধ্বংসও করতে পারেন। এমনকি তাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিকে পর্যন্ত রহিত করে দিতে পারেন। এই তেরটি আয়াতে মুনাফিকদের অবস্থার পূর্ণ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক আহকাম ও মাসআলা এবং গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত বা উপদেশ রয়েছে। যথা-

কুফর ও নেফাক সে যুগেই ছিল না এখনও আছে

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আমরা জানতে পারি যে, মুনাফিকদের কপটতা নির্ধারণ করা এবং তাদেরকে মুনাফিক বলে চিহ্নিত করার দু'টি পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত, আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁর রাসূলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, অমুক ব্যক্তি আন্তরিকভাবে মুসলমান নয়; বরং মুনাফিক। দ্বিতীয়ত, এই যে, তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপে ইসলাম ও ঈমানবিরোধী কোন কাজ প্রকাশ পাওয়া। হুযুর (সা)-এর তিরোধানের পর ওহী বন্ধ হওয়ার প্রথম পদ্ধতিতে মুনাফিকদের শনাক্ত করার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটি এখনও রয়েছে। যে ব্যক্তি কথাবার্তায় ঈমান ও ইসলামের দাবিদার হয়, কিন্তু কার্যকলাপে হয় তার বিপরীত, তাকে মুনাফিক বলা হবে। এ সমস্ত মুনাফিককে কোরআনের ভাষায় 'মুলহিদ'ও বলা হয়। যেমন এরশাদ হয়েছে-

الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا .

হাদীস শরীফে এসব লোককে 'যিন্দীক'ও বলা হয়েছে। যেহেতু এসব লোকের কুফরী দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তাই এরা অন্যান্য কাফেরের ন্যায় একই হুকুমের আওতাভুক্ত। এদের জন্য স্বতন্ত্র কোন হুকুম নেই। এ জন্যই এক শ্রেণীর লোক এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাসূল (সা)-এর তিরোধানের পর মুনাফিকদের ব্যাপার শেষ হয়েছে। সুতরাং এখন যারা মুসলমান নয়, তারা সরাসরি কাফের বলেই পরিচিত হবে।

বুখারী শরীফের শরাহ্ উমদা'তে হযরত ইমাম মালেক (র) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূল (সা)-এর পরেও মুনাফিকদের পরিচয় করা যেতে পারে। পরিচয় হলে তাদেরকে মুনাফিক বলা হবে।

ঈমান ও কুফরের তাৎপর্য

আলোচ্য আয়াতে চিন্তা করলে ঈমান ও ইসলামের পূর্ণ তাৎপর্যটি পরিষ্কার হয়ে যায়। অপরদিকে কুফরের হাকীকতও প্রকাশ হয়। কেননা, এ আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের ঈমানের দাবি اٰمَنَّا بِاللّٰ এবং কোরআনের পক্ষ হতে এই দাবীকে মিথ্যা বলে ঘোষণা করা  وَ مَا هُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ বাক্যের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে আরো কিছু বিশেষ চিন্তা-ভাবনার অপেক্ষা রাখে:
প্রথমত, যে সমস্ত মুনাফিকের বর্ণনা কোরআনে দেওয়া হয়েছে, সাধারণত তারা ছিল ইহুদী। আল্লাহ্ তা'আলা এবং রোজ কিয়ামতে বিশ্বাস করা তাদের ধর্মমতেও প্রমাণিত ছিল। তাদেরকে রাসূল (সা)-এর রিসালাত ও নবুওতের প্রতি ঈমান আনার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং মাত্র দু'টি বিষয়ে ঈমান আনয়নের কথা বলা হয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ বিচারের দিনের প্রতি। এতে তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলা চলে না। তা সত্ত্বেও কোরআন কর্তৃক তাদেরকে মিথ্যাবাদী এবং তাদের ঈমানকে অস্বীকার করার কারণ কি? আসল কথা হচ্ছে যে, কোন-না-কোন প্রকারে নিজ নিজ ধারণা ও ইচ্ছামাফিক আল্লাহ এবং পরকাল স্বীকার করাকে ঈমান বলা যায় না। কেননা, মুশরিকরাও তো কোন-না-কোন দিক দিয়ে আল্লাহকে মেনে নেয় এবং কোন একটি নিয়ামক সত্তাকে সবচাইতে বড় একক ক্ষমতার অধিকারী বলে স্বীকার করে। আর ভারতের মুশরিকগণ 'পরলোক' নাম দিয়ে আখেরাতের একটি ধারণাও পোষণ করে থাকে। কিন্তু কোরআনের দৃষ্টিতে একেও ঈমান বলা যায় না। বরং একমাত্র সেই ঈমানই গ্রহণযোগ্য, আল্লাহ্র প্রতি তাঁর নিজের বর্ণিত সকল গুণসহ যে ঈমান আনা হয় এবং পরকালের ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসূলের বর্ণিত অবস্থা ও গুণাগুণের সাথে যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয়।

জানা কথা যে, ইহুদীগণ কোরআনে উল্লিখিত বর্ণনানুযায়ী আল্লাহ বা আখেরাত, কোনটির প্রতিই ঈমান আনেনি। একদিকে তারা হযরত উযায়র (আ)-কে আল্লাহ্র পুত্র মনে করে, অপরদিকে আখেরাত সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে যে, নবী ও রাসূলগণের সন্তানগণ যা কিছুই করুক না কেন, যেহেতু তাঁরা আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র, পরকালে তাঁদের কিছু হিসাব-নিকাশ ও শান্তি হলে তা হবে অতি নগণ্য। অতএব, তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমানের কথা বলে থাকে, কোরআনের ভাষায় তাকে ঈমান বলা যায় না।

কুফর ও ঈমানের সংজ্ঞা

কোরআনের ভাষায় ঈমানের তাৎপর্য বলতে গিয়ে সূরা বাকারাহর ত্রয়োদশতম আয়াতে বলা হয়েছে اٰمِنُوۡا کَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ যাতে বোঝা যাচ্ছে যে, ঈমানের যথার্থতা যাচাই করার মাপকাঠি হচ্ছে সাহাবীগণের ঈমান। এ পরীক্ষায় যা সঠিক বলে প্রমাণিত না হবে, তা আল্লাহ্ ও রাসূলের নিকট ঈমান বলে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না ।

যদি কোন ব্যক্তি কোরআনের বিষয়কে কোরআনের বর্ণনার বিপরীত পথ অবলম্বন করে বলে যে, আমি তো এ আকীদাকে মানি, তবে তা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয় । যথা : আজকাল কাদিয়ানীরা বলে বেড়ায় যে, আমরা তো খতমে নবুওতে বিশ্বাস করি। অথচ এ বিশ্বাসে তারা রাসূল (সা)-এর বর্ণনা ও সাহাবীগণের ঈমানের সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অবলম্বন করেছে। আর এ পর্দার অন্তরালে মির্জা গোলাম আমদের নবুয়ত প্রতিষ্ঠার পথ বের করেছে। তাই কোরআনের বর্ণনায় এদেরকেও وَ مَا هُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ -এর আওতাভুক্ত করা হয়।

শেষ কথা, যদি কোন ব্যক্তি সাহাবীদের ঈমানের পরিপন্থী কোন বিশ্বাসের কোন নতুন পথ ও মত তৈরি করে সে মতের অনুসারী হয় এবং নিজেকে মু'মিন বলে দাবি করে, মুসলমানদের নামায-রোযা ইত্যাদিতে শরীকও হয়, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কোরআনের প্রদর্শিত পথে ঈমান আনয়ন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোরআনের ভাষায় তাদেরকে মু'মিন বলা হবে না ।

একটি সন্দেহের নিরসন: হাদীস ও ফেকাহশাস্ত্রের একটা সুপরিচিত সিদ্ধান্ত এই যে, আহলে- কেবলাকে কাফের বলা যাবে না। এর উত্তরও এ আয়াতেই বর্ণিত হয়েছে যে, আহলে-কেবলা তাদেরকেই বলা হবে, যারা দীনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় বিষয়ের স্বীকৃতি জানায়; কোন একটি বিষয়েও অবিশ্বাস পোষণ করে না বা অস্বীকৃতি জানায় না। পরন্তু শুধু কেবলামুখী হয়ে নামায পড়লেই কেউ ঈমানদার হতে পারে না। কারণ, তারা সাহাবীগণের ন্যায় দীনের যাবতীয় জরুরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় ।

মিথ্যা একটি জঘন্য অপরাধ

اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ এ আয়াতে মুনাফিকদের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে, তারা প্রথম স্তরের কার্ফের হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জানামতে মিথ্যাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইত। তাই তারা ঈমানের ব্যাপারে আল্লাহ এবং রোজ কিয়ামতের কথা বলেই ক্ষান্ত হতো, রাসূলের প্রতি ঈমানের প্রসঙ্গে দৃঢ়তার সাথে পাশ কাটিয়ে যেতো। কেননা, এতে করে তাদের পক্ষে সরাসরি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার ভয় ছিল। এতে বোঝা যায় যে, মিথ্যা এমন একটি জঘন্য ও নিকৃষ্ট অপরাধ, যা কোন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লোকই পছন্দ করে না—সে কাফের ফাসেকই হোক না কেন।

নবী এবং ওলীগণের সাথে দুর্ব্যবহার করা প্রকারান্তরে আল্লাহর সাথে দুর্ব্যবহারেরই শামিল 

উপরিউক্ত আয়াতে মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে একথাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ অর্থাৎ এরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। অথচ এ মুনাফিকদের মধ্যে হয়তো একজনও এমন ছিল না, যে আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়ার মনোভাব পোষণ করত। বরং তারা রাসূল (সা) এবং মু'মিনগণকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ সমস্ত ঘৃণ্য কাজ করেছে।

আলোচ্য আয়াতে তাদের এ আচরণকে আল্লাহ্কেই ধোঁকা দেওয়া বলে উল্লিখিত হয়েছে এবং প্রকারান্তরে বলে দেওয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর রাসূল বা কোন ওলীর সাথে দুর্ব্যবহার করে, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা আল্লাহ্র সাথেই খারাপ আচরণ করে। প্রসঙ্গত আল্লাহ্র রাসূলের সাথে বে-আদবী করায় আল্লাহর সাথেই বে-আদবী করা হয়, একথা উল্লেখ করে আল্লাহর রাসূল (সা) এবং তাঁর অনুসারিগণের বিপুল মর্যাদার প্রতিও ইশারা করা হয়েছে।

মিথ্যা বলার পাপ

আলোচ্য আয়াতে মুনাফিকদের কঠোর শাস্তির কারণ- بِمَا کَانُوۡا یَکۡذِبُوۡنَ অর্থাৎ তাদের মিথ্যাচারকে স্থির করা হয়েছে। অথচ তাদের কুফর ও নিফাকের অন্যায়ই ছিল সবচেয়ে বড়। দ্বিতীয় বড় অন্যায় হচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা। একদসত্ত্বেও কঠোর শাস্তির কারণ তাদের মিথ্যাচারকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে একথাই বোঝা যায় যে, মিথ্যা বলার অভ্যাসই তাদের প্রকৃত অন্যায়। এ বদ অভ্যাসই তাদেরকে কুফর ও নিফাক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এ জন্যই অন্যায়ের পর্যায়ে যদিও কুফর ও নিফাকই সর্বাপেক্ষা বড়, কিন্তু এসবের ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। তাই কোরআন মিথ্যা বলাকে মূর্তিপূজার সাথে যুক্ত করে এরশাদ হয়েছে-

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الرُّور

অর্থাৎ-মূর্তিপূজার অপবিত্রতা ও মিথ্যা বলা হতে বিরত থাক।

সংশোধন ও ফাসাদের সংজ্ঞা এবং সংশোধনকারী ও হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীর পরিচয়

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে—যখন এসব মুনাফিককে বলা হয় যে, কপটতার মাধ্যমে জগত ফেতনা-ফাসাদের সৃষ্টি করো না, তখন তারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে বেড়ায় اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ এখানে اِنَّمَا শব্দটি প্রাসঙ্গিক শব্দের অর্থে সার্বিকতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এই বাক্যের অর্থ হচ্ছে : আমরা তো আপোস-মীমাংসা বা কল্যাণ সাধনকারী। আমাদের কোন কাজের সম্পর্ক ফেতনা-ফাসাদের সাথে নেই। কিন্তু কোরআন এ দাবির উত্তরে বলেছে-

أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لا يَشْعُرُونَ .

অর্থাৎ-স্মরণ রোখো, তারাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী। কিন্তু তা অনুভব করতে পারে না।

এতে দু'টি বিষয় উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। প্রথমত, মুনাফিকদের কার্যকলাপ প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ বিস্তারের কারণ। দ্বিতীয়ত, মুনাফিকরা ফেতনা-ফাসাদ বিস্তারের নিয়ত বা উদ্দেশ্যে এসব কাজ করত না, বরং তারা জানতও না যে, তাদের এ কাজ ফেতনা সৃষ্টির কারণ হতে পারে। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, وَ لٰکِنۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ দ্বারা এ অর্থই বোঝা যাচ্ছে। কারণ, পৃথিবীতে এমন কতগুলো কাজ আছে যেগুলো দ্বারা শান্তি ভঙ্গ হয়, ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়—এ সহজ বোধ সকলেরই রয়েছে। যথা—হত্যা, লুণ্ঠন, চুরি-ডাকাতি, ধোঁকা ও শঠতা প্রভৃতি। এগুলো বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই ফেতনা মনে করে এবং প্রত্যেক ভদ্র ও শান্তিকামী লোক প্রকারান্তরে এসব হতে দূরে থাকে। এমনও কিছু কাজ রয়েছে, যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে ফেতনা-ফাসাদের কারণ মনে না হলেও সেগুলোর প্রতিক্রিয়া মানব-চরিত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং চরিত্রকে চরম অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায়। ফলে জগতে ফেতনা-ফাসাদের দ্বার অবারিত হয়ে যায়। এ মুনাফিকদের অবস্থাও তাই। তারা চুরি ডাকাতি, ব্যভিচার প্রভৃতি হতে বিরত থাকত আর সে জন্যই অত্যন্ত জোরগলায় বলে বেড়াতো যে, আমরা ফাসাদ সৃষ্টিকারী তো নই-ই, বরং আমরা শান্তি ও কল্যাণকামী। কিন্তু নিফাক বা হিংসা-বিদ্বেষপ্রসূত চক্রান্ত প্রভৃতির ফলে মানুষ চারিত্রিক অধঃপতনের এত নিম্নস্তরের চলে যায় এবং এমন সব কাজে লিপ্ত হয়, যা কোন সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। মানুষ যখন মানবচরিত্র হারিয়ে ফেলে তখন জীবনের পদে পদে শুধু ফেতনা-ফাসাদই আসতে থাকে। আর সে ফেতনা এত মারাত্মক যে, তা হিংস্র জন্তু বা চোর-ডাকাতও করতে পারে না। অবশ্য তাদের এ কার্যে রাষ্ট্রীয় আইন বাধা দিতে পারে। কিন্তু আইন তো মানুষের রচিত। যখন মানুষই মনুষ্যত্বের গণ্ডি থেকে দূরে সরে পড়ে, তখন আইনের নীতিমালা পদে পদে লঙ্ঘিত হয়। আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাপারেই তা প্রত্যক্ষ করেছেন। আধুনিক বিশ্বে তাহযীব-তমদ্দুন উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছে, শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি শব্দ দু'টো আজ মানুষের মুখে মুখে, আইন প্রণয়নকারী সংস্থার দৃষ্টি আজ অত্যন্ত সচেতন। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; ব্যবস্থাপনা ও শাসন পরিচালনার বিভিন্ন বিভাগও এ কাজে সদা ব্যস্ত আছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ফেতনা-ফাসাদ, অন্যায়-অনাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর একমাত্র কারণ এই যে, আইন নিজে কোন যন্ত্র নয়; এর পরিচালনা মানুষের হাতেই ন্যস্ত। যখন মানুষ মানবীয় গুণাবলী হারিয়ে ফেলে, তখন এ ফেতনার প্রতিকার না আইনের দ্বারা হতে পারে, না সরকার করতে পারে, না প্রতিকারের অন্য কোন পন্থা দৃষ্টিগোচর হয়। এজন্য রাসূল (সা) তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টায় মানুষকে সত্যিকারের মানুষরূপে গঠন করার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। মানুষ যদি প্রকৃত মনুষ্যত্বের গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হয়, তবে ফেতনা-ফাসাদ বন্ধ করার জন্য পৃথকভাবে আইন প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা বড় একটা থাকে না। তখন আর পুলিশেরও এত বেশি প্রয়োজন হবে না, এত বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানেরও দরকার হবে না। যখনই দুনিয়ার কোন অংশে তাঁর শিক্ষা ও উপদেশ যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে, তখন দুনিয়ার সে অংশের মানুষ প্রকৃত শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজমান দেখেছেন। এ দৃশ্য অন্য কোথাও দেখা যায়নি, বিশেষত এ শিক্ষা বর্জনকারীদের মধ্যে তো নয়ই।

নবী করীম (সা)-এর উপদেশ আমল করার মূল কথাই হচ্ছে, আল্লাহ্র ভয় এবং পরকালের হিসাব-নিকাশের চিন্তা। এ ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই মানুষকে অন্যায় হতে বিরত রাখার বাস্তব শিক্ষা দান করতে পারে না।

সমকালীন পৃথিবীতে যাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে, তারা এসব অন্যায় ও অপরাধ রোধ করার জন্য নতুন নতুন পন্থা বের করেন বটে, কিন্তু মানুষের চরিত্র শুদ্ধির মূল উৎস, অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার ব্যাপারে তারা যে শুধু গাফেল তা-ই নয়; বরং মানুষের হৃদয়-মন থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি ঈমান চিরতরে উৎখাত করার ফিকিরে ব্যস্ত। এর পরিণাম হচ্ছে এই যে, দিন দিন অন্যায় ও অপরাধ শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

প্রকাশ্যভাবে ফাসাদ সৃষ্টিকারী চোর-ডাকাতের প্রতিকার করা তো সহজ, কিন্তু যারা মানবতা হারিয়ে ফেলেছে, তাদের ফাসাদ কল্যাণের ছদ্মাবরণে প্রসার লাভ করছে। তারা এজন্য মনোমুগ্ধকর এবং শঠতাপূর্ণ পরিকল্পনাও তৈরি করে। আর স্ব স্ব জাতীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য কলাণ্যের আবরণে اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ -এর ধুয়া তোলে। এজন্য আল্লাহ্ তা'আলা যেখানে অন্যায় অপরাধ ফিতনা-ফাসাদ বন্ধ করার কথা বলেছেন, সেখানে এরশাদ করেছেন-

واللهُ يَعْلَمُ المُفسد مِنَ المُصلِح.

অর্থাৎ "কে কল্যাণকারী আর কে ফাসাদকারী তা আল্লাহই জানেন।” তাছাড়া প্রত্যেক কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিণামও তিনি জানেন যে, এতে মীমাংসা হবে, না ফাসাদ হবে । এজন্য আপোষ-মীমাংসার জন্য শুধু নিয়ত করাই যথেষ্ট নয়; বরং কর্ম-পদ্ধতি ও শরীয়ত অনুযায়ী ঠিক হতে হবে। অনেক সময় কোন কোন কাজ কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যই করা হয়, কিন্তু তার পরিণাম দাঁড়ায় ফেতনা-ফাসাদ এবং মারাত্মক অকল্যাণ ।





*********************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url