মা’আরেফুল কোরআন - ২৬ || সূরা আল-বাকারাহ ৬২-৬৪নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬২


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬২

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصْرَى وَالطَّبِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَوم وَلَا خَوفٌ عَلَيْهِمْ وَلَاهُمْ يَحْزَنُونَ

সূরা আল-বাকারাহ ৬২নং আয়াতের অর্থ

(৬২) নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।

সূরা আল-বাকারাহ ৬২নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

(এখানে ইহুদীদের গর্হিত আচরণ ও অনাচারের কথা জেনে শ্রোতাদের অথবা স্বয়ং ইহুদীদের এ ধারণা হতে পারে যে, এমতাবস্থায় যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে ঈমান আনতেও চায়, তবে হয়তো আল্লাহ্ পাকের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধারণা অপনোদনের জন্য এ আয়াতে আল্লাহ্ পাক একটি সাধারণ নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। সে নীতি এই,) মুসলমান, ইহুদী, খৃস্টান এবং সাবেঈন সম্প্রদায়-এর মধ্যে যারা আল্লাহ্ তা'আলার (সত্তা ও গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কিয়ামতের উপর এবং (শরীয়তী বিধান অনুসারে) সৎকাজ করে, এমন লোকের জন্য তাদের পালনকর্তার নিকটে (পৌঁছে) তাদের প্রতিদানও রয়েছে। এবং (সেখানে পৌঁছে) তাদের কোন আশংকা থাকবে না এবং তারা সন্তাগ্রস্তও হবে না ।

জ্ঞাতব্য: নীতি বা আইনের মর্ম সুস্পষ্ট। আল্লাহ্ পাক বলেছেন যে, আমার দরবারে কোন ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা নেই। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও কর্মে পুরোপুরি আনুগত্য স্বীকার করবে, সে 'পূর্বে যেমনই থাকুক, সে আমার নিকট গ্রহণযোগ্য এবং তার আমল পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয়। আর এটা সুস্পষ্ট যে, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর 'পূর্ণ আনুগত্য' মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুসলমান হওয়াতে সীমাবদ্ধ। যার অর্থ এই যে, যে মুসলমান হবে, সে-ই পরকালে নাজাতের অধিকারী হবে। এখানে পূর্ববর্তী ধারণার উত্তর হয়ে গেল। অর্থাৎ এতসব অনাচার ও গর্হিত আচরণের পরেও যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে আমি সব মাফ করে দেব।

আরবে সাবেঈন নামে একটি বিশেষ সম্প্রদায় ছিল, তাদের ধর্ম-বিশ্বাস ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না বলে তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। বস্তুত আলোচ্য এ আইনে বাহ্যত মুসলমানদের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কেননা তারা তো মুসলমান আছেই। কিন্তু এতে বাক্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে এবং প্রতিপাদ্য বিষয়ের গুরুত্ব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এর উদাহরণ এই যে, কোন শাসক বা সম্রাট কোন বিধান প্রয়োগকালে যদি এরূপ ঘোষণা করেন যে, আমার বিধান সাধারণ ও ব্যাপক সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য, স্বপক্ষীয়-বিপক্ষীয় শত্রু-মিত্র যে-ই এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে সে-ই অনুকম্পার পাত্র হবে। একথা সুস্পষ্ট যে, যারা স্বপক্ষীয় মিত্র তারা তো আনুগত্য প্রদর্শন করেই চলেছে—আসলে যারা বিরোধী ও শত্রু তাদেরকেই ঘোষণাটি শোনানোর উদ্দেশ্য। কিন্তু এর নিগূঢ় তত্ত্ব এই যে, অনুগত ও মিত্রদের প্রতি আমার যে অনুকম্পা, তার কারণ কোন ব্যক্তিবিশেষ নয় বা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যও নয়; বরং তার মিত্রতা ও বশ্যতাগুণের উপরই আমার অনুকম্পা বা অনুগ্রহ নির্ভরশীল। সুতরাং বিরোধী শত্রুও যদি এ বশ্যতা গ্রহণ করে নেয়, তাহলে সেও স্বপক্ষীয় মিত্রের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে সমপরিমাণ অনুকম্পা ও অনুগ্রহ লাভ করবে। সে জন্যেই পূর্বোক্ত আইনে বিরোধী শত্রুর সাথে স্বপক্ষীয় মিত্রেরও উল্লেখ করা হয়েছে।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬৩

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا أتَيْنَكُم بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ )

সূরা আল-বাকারাহ ৬৩নং আয়াতের অর্থ

(৬৩) আর আমি যখন তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং ভূর পর্বতকে তোমাদের মাথার উপর তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদিগকে যে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাকে ধর সুদৃঢ়ভাবে এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা মনে রেখো, যাতে তোমরা ভয় কর।

সূরা আল-বাকারাহ ৬৩নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর ঐ সময়টির কথা স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম (যে, তোমরা তওরাতের উপর আমল করবে।) এবং (এ অঙ্গীকার গ্রহণ করার জন্য) আমি তূর পর্বতকে উঠিয়ে (সমান্তরালে) ঝুলিয়ে দিলাম এবং (সে সময়ে বললাম,) যে কিতাব আমি তোমাদেরকে প্রদান করেছি (অর্থাৎ, তওরাত) তা (সত্বর) দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর। এবং এতে (কিতাবে) যে নির্দেশাবলী রয়েছে, তা স্মরণ রেখো, যাতে (আশা করা যায় যে,) তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে।

জ্ঞাতব্যঃ যখন হযরত মূসা (আ)-কে তূর পর্বতে তওরাত প্রদান করা হলো, তখন তিনি ফিরে এসে তা বনী-ইসরাঈলকে দেখাতে ও শোনাতে আরম্ভ করলেন। এতে হুকুমগুলো কিছুটা কঠোর ছিল—কিন্তু তাঁদের অবস্থানুযায়ীই ছিল। এ সম্পর্কে প্রথম তারা একথাই বলেছিল যে, যখন স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে বলে দেবেন যে, ’এটা আমার কিতাব’ তখনই আমরা মেনে নেব। (যে বর্ণনা উপরে চলে গেছে) মোটকথা, যে সত্তরজন লোক মূসা (আ)-এর সাথে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে সাক্ষী দিল। কিন্তু তাদের সাক্ষ্যের সাথে এ কথাটিও নিজেদের পক্ষ হতে সংযুক্ত করে দিল যে, আল্লাহ্ তা’আলা সর্বশেষে একথাও বলে দিয়েছেন, “তোমরা যতটুকু পার আমল কর, আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দেব।” এটা কতকটা তাদের স্বভাবগত দুরন্তপনা ও হঠকারিতার পরিচয়। হুকুমগুলো কিছুটা কঠিন হওয়াতে বরং উপরিউক্ত বাক্যটি সংযুক্ত হওয়াতে তাদের এক সুবর্ণ সুযোগ হয়ে গেল। তারা পরিষ্কারভাবে বলে দিল, আমাদের দ্বারা এ গ্রন্থের উপর আমল করা সম্ভব হবে না। ফলে আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলেন, “তুর পর্বতের একটি অংশ উঠিয়ে তাদের মাথার উপরে ঝুলিয়ে রেখে দাও এবং বল, হয় কিতাব মেনে নাও, নইলে এক্ষুণি মাথার উপর পড়ল।" অবশেষে নিরুপায় হয়ে তাদের তা মেনে নিতে হলো।

একটি সন্দেহের অপনোদনঃ এখানে এ সন্দেহ হতে পারে যে, ধর্মে যদি কোন জোর-জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা না থাকবে, তবে এক্ষেত্রে কেন এমন করা হলো? উত্তর এই যে, জবরদস্তি ঈমান গ্রহণ করার জন্য নয়; বরং স্বেচ্ছায় সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করার পর এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে। প্রত্যেক রাষ্ট্রে বিদ্রোহীদের শাস্তি, সাধারণ দুষ্কৃতকারী ও অপরাধী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রে তাদের জন্য দু’টি পথই থাকে- হয় আনুগত্য স্বীকার, না হয় প্রাণদণ্ড। এজন্য শরীয়ত অনুযায়ী ইসলাম পরিত্যাগকারীর শাস্তি প্রাণদণ্ড। কিন্তু কুফরীর (ধর্ম গ্রহণ না করার) শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৬৪

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

مِنْ بَعْدِ ذلِكَ فَلَوْلا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَكُنتُم مِّنَ الْخَسِرِينَ .

সূরা আল-বাকারাহ ৬৪নং আয়াতের অর্থ

(৬৪) তারপরেও তোমরা তা থেকে ফিরে গেছ। কাজেই আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও মেহেরবানী যদি তোমাদের উপর না থাকত তবে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে।

সূরা আল-বাকারাহ ৬৪নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

অতঃপর তোমরা (সেই প্রতিজ্ঞা করার পর) তা থেকে ফিরে গেছ। অতএব, তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী না হতো, তবে (তোমাদের সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের তাগিদ অনুসারে) নিশ্চয়ই তোমরা (সঙ্গে সঙ্গে) ধ্বংস (ও বিধ্বস্ত) হয়ে যেতে। (কিন্তু এ আমার একান্ত অনুগ্রহ ও দয়া যে,) তোমাদের জন্য নির্ধারিত জীবনকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের অবকাশ দিয়ে রেখেছি। অবশ্য মৃত্যুর পর কৃতকর্মের প্রতিফল তোমাদের ভোগ করতে হবে।

জ্ঞাতব্যঃ আল্লাহর সাধারণ রহমত পৃথিবীতে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সবার জন্যই ব্যাপক। তারই প্রভাব হলো পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শারীরিক সুস্থতা। তবে বিশেষ রহমতের বিকাশ ঘটবে আখেরাতে, যার ফলে মুক্তি ও আল্লাহর নৈকট্যলাভ সম্ভব হবে।

বাহ্যিক দৃষ্টিতে আয়াতের শেষাংশের লক্ষ্য হলো সে সমস্ত ইহুদী, যারা মহানবী (সা)-এর সময়ে উপস্থিত ছিল। হুযূর আকরাম (সা)-এর ওপর ঈমান না আনাও যেহেতু উল্লিখিত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু তারাও পূর্বোক্ত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের আওতাভুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, এতদসত্ত্বেও আমি দুনিয়াতে তোমাদের উপর তেমন কোন আযাব অবতীর্ণ করিনি, যেমনটি পূর্বকালে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের উপর অবতীর্ণ হয়ে থাকত। এটা একান্তই আল্লাহর রহমত।

আর হাদীসের বর্ণনার ভিত্তিতে আযাব অবতীর্ণ না হওয়াটা যেহেতু মহানবী (সা)-এর বরকত, কাজেই কোন কোন তফসীরকার মহানবী (সা)-এর আবির্ভাবকেই আল্লাহর রহমত ও করুণা বলে বিশ্লেষণ করেছেন।

এ বিষয়টির সমর্থনকল্পে বিগত বেঈমানদের একটি ঘটনা পরবর্তী আয়াতে বিবৃত হচ্ছেঃ





******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url