মা’আরেফুল কোরআন - ৩০ || সূরা আল-বাকারাহ ৮১-৮৮নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮১-৮৮


সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮১-৮২

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 بَلٰی مَنۡ کَسَبَ سَیِّئَۃً وَّ اَحَاطَتۡ بِهٖ خَطِیۡٓــَٔتُهٗ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۸۱
 وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۸۲

সূরা আল-বাকারাহ ৮১-৮২ নং আয়াতের অর্থ

(৮১) হ্যাঁ, যে ব্যক্তি গোনাহ অর্জন করেছে এবং সে গোনাহ তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে, তারাই দোযখের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। (৮২) পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকার্য করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে।

সূরা আল-বাকারাহ ৮১-৮২ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

অনন্তকাল দোযখবাসের বিধি

সামান্য কিছুদিন ছাড়া দোযখের আগুন তোমাদের কেন স্পর্শ করবে না ? বরং দোযখেই তোমাদের অনন্তকাল বাস করার কথা। কেননা, আমার বিধি এই যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক মন্দ কাজ করে এবং পাপ ও অপকর্ম তাকে এমনভাবে বেষ্টন করে নেয় (যে, কোথাও সততার কোন চিহ্নমাত্র থাকে না,) এমন সব লোকই দোযখের অধিবাসী। তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে। আর যারা (আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতি) ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতের অধিবাসী। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়
গোনাহ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার যে অর্থ তফসীরের সারাংশে উল্লিখিত হয়েছে, তা শুধু কাফেরদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কারণ কুফরের কারণে কোন সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য নয়। কুফরের পূর্বে কিছু সৎকর্ম করে থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই কাফেরদের মধ্যে আপাদমস্তক গোনাহ্ ছাড়া আর কিছুরই কল্পনা করা যায় না। ঈমানদারদের অবস্থা কিন্তু তা নয়। প্রথমত, তাদের ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য নেক আমল তাদের আমলনামায় লেখা হয়। সে জন্য ঈমানদার সৎকর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। সুতরাং উল্লিখিত বেষ্টনী তাদের বেলায় অবান্তর।

মোটকথা উপরোক্ত রীতি অনুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, কাফেররা অনন্তকাল দোযখে বাস করবে। হযরত মূসা (আ) সর্বশেষ পয়গম্বর নন। তাঁর পর হযরত ঈসা (আ) এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামও পয়গম্বর। তাঁদেরকে অস্বীকার করার কারণে ইহুদীরা কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ফলে উপরোক্ত বিধি অনুযায়ী তারাও অনন্তকাল দোযখে বাস করবে। সুতরাং তাদের দাবি অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে অসার প্রমাণিত হয়েছে।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৩

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ لَا تَعۡبُدُوۡنَ اِلَّا اللّٰهَ ۟ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا وَّ ذِی ‌الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا وَّ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ؕ ثُمَّ تَوَلَّیۡتُمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۸۳

সূরা আল-বাকারাহ ৮৩ নং আয়াতের অর্থ

(৮৩) যখন আমি বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতীম ও দীন-দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামায প্রতিষ্ঠিত করবে এবং যাকাত দেবে, তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, তোমরাই অগ্রাহ্যকারী।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৩ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

স্মরণ কর, যখন আমি (তওরাতে) বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, আল্লাহ্ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতার উত্তম সেবাযত্ন করবে, আত্মীয়-স্বজন, এতিম বালক-বালিকা এবং দীন-দরিদ্রদেরও (সেবাযত্ন করবে) এবং সাধারণ লোকের সাথে যখন কোন কথা বলবে, তখন একান্ত নম্রতার সাথে বলবে। নিয়মিত নামায পড়বে এবং যাকাত দেবে। অতঃপর তোমরা (অঙ্গীকার করে) তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কয়েকজন ছাড়া। অঙ্গীকার করে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াই তোমাদের নিত্যকার অভ্যাস।

জ্ঞাতব্যঃ ’অল্প কয়েকজন’ অর্থাৎ তারাই যারা তওরাতের পুরোপুরি অনুসরণ করত, তওরাত রহিত হওয়ার পূর্বে তারা মূসা (আ) প্রবর্তিত শরীয়তের অনুসারী ছিল এবং তওরাত রহিত হওয়ার পর তারা ইসলামী শরীয়তের অনুসারী হয়ে যায়। আয়াত দৃষ্টে বোঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতীম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রদের সেবাযত্ন করা, সব মানুষের সাথে নম্রভাবে কথাবার্তা বলা, নামায পড়া এবং যাকাত দেওয়া ইসলামী শরীয়তসহ পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহেও বিদ্যমান ছিল।

শিক্ষা ও প্রচার ক্ষেত্রে কাফেরের সাথেও অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ নয়ঃ
قُوْلُوْا لِلنَّاسِ আয়াতে এমন قول বোঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলা মনে বলবে—যার সাথে কথা বলবে, সে সৎ হউক বা অসৎ, সুন্নী হউক বা বেদাতী। তবে ধর্মের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারও মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা যখন মূসা ও হারুন (আ)-কে নবুয়ত দান করে ফেরআউনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন, তখন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন  فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا

অর্থাৎ তোমরা উভয়েই ফেরআউনকে নরম কথা বলবে। আজ যারা অন্যের সাথে কথা বলে, তারা হযরত মূসা (আ)-এর চাইতে উত্তম নয় এবং যার সাথে বলে, সে ফেরআউন অপেক্ষা বেশি মন্দ ও পাপিষ্ঠ নয়।

তালহা ইবনে উমর (রা) বলেনঃ আমি তফসীর ও হাদীসবিদ ’আতা (র)-কে বললামঃ আপনার কাছে ভ্রান্ত লোকেরাও আনাগোনা করে। কিন্তু আমার মেজায কঠোর। এ ধরনের লোক আমার কাছে এলে আমি ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেই। ’আতা বললেনঃ তা করবে না। কারণ আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে এইঃ

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

(মানুষকে সুন্দর কথাবার্তা বল।) ইহুদী-খৃস্টানও এ নির্দেশের আওতাভুক্ত । সুতরাং মুসলমান যত মন্দই হোক, সে কেন এ নির্দেশের আওতায় পড়বে না ?

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৪

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

 وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَکُمۡ لَا تَسۡفِکُوۡنَ دِمَآءَکُمۡ وَ لَا تُخۡرِجُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ ثُمَّ اَقۡرَرۡتُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَشۡهَدُوۡنَ ﴿۸۴

সূরা আল-বাকারাহ ৮৪ নং আয়াতের অর্থ

(৮৪) যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা পরস্পর খুনোখুনি করবে না এবং নিজদিগকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে না, তখন তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছিলে।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৪ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

(পূর্বে যে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছিল, এ আয়াতে তারই পরিশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ) স্মরণ কর, সে সময়ের কথা, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকারও নিলাম যে, (গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে) পরস্পর খুনোখুনি করো না এবং একে অন্যকে দেশত্যাগে বাধ্য করো না, তখন (সে অঙ্গীকারকে) তোমরা স্বীকারও করেছিলে, আর (স্বীকারোক্তি ও আনুষঙ্গিক ছিল না, বরং এমনভাবে অঙ্গীকার করছিলে যেন) তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছিলে।

জ্ঞাতব্যঃ কোন কোন সময় কারও বক্তব্যের ভেতরেই কোন কিছুর অঙ্গীকারও বোঝা যায় যদিও তা সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নয়। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে ثُمَّ اَقْرَرْتُمْ অনিশ্চয়তার অপনোদন করে বলা হয়েছে যে, তাদের অঙ্গীকার সাক্ষ্যদানের মতই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ছিল। 

দেশ ত্যাগ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার অর্থ এই যে, কাউকে এমন উৎপীড়ন করবে না, যাতে সে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৫

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

  ثُمَّ اَنۡتُمۡ هٰۤـؤُلَآءِ تَقۡتُلُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ تُخۡرِجُوۡنَ فَرِیۡقًا مِّنۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِهِمۡ ۫ تَظٰهَرُوۡنَ عَلَیۡهِمۡ بِالۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ؕ وَ اِنۡ یَّاۡتُوۡکُمۡ اُسٰرٰی تُفٰدُوۡهُمۡ وَ هُوَ مُحَرَّمٌ عَلَیۡکُمۡ اِخۡرَاجُهُمۡ ؕ اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡکِتٰبِ وَ تَکۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِکَ مِنۡکُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۸۵

সূরা আল-বাকারাহ ৮৫ নং আয়াতের অর্থ

(৮৫) অতঃপর তোমরাই পরস্পরে খুনোখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে গোনাহ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিষ্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর! যারা এরূপ করে, পার্থিব জীবনে দুৰ্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শান্তির দিকে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে। আল্লাহ্ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৫ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

(অঙ্গীকারের উপসংহারে তাদেরকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার লঙ্ঘন সম্পর্কে এ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে) অতঃপর (সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের পর) তোমরা যা করছ, তা স্পষ্ট। আর তা এই যে, তোমরা পরস্পর খুনোখুনিও করছ এবং একে অন্যকে দেশত্যাগেও বাধ্য করছ। (তা এভাবে যে,) নিজেদেরই লোকের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে তাদের শত্রুদের সাহায্য করছ। (এ দু’টি নির্দেশ তো এভাবেই বানচাল করে দিয়েছ। তৃতীয় আরেকটি নির্দেশ, যা পালন করা তোমাদের কাছে সহজ, তা পালনে বেশ তৎপরতা প্রদর্শন করছ। তা হলো এই যে,) যদি তাদের কেউ বন্দী হয়ে তোমাদের কারও কাছে আসে, তবে কিছু অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করছ। অথচ (এটা জানা কথা যে,) তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করাও তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ (হত্যা করা তো আরো বেশী নিষিদ্ধ)। 

জ্ঞাতব্যঃ বনী ইসরাঈলকে তিনটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রথমত, খুনোখুনি না করা; দ্বিতীয়ত, বহিষ্কার অর্থাৎ দেশত্যাগে বাধ্য না করা, এবং তৃতীয়ত, স্বগোত্রের কেউ কারও হাতে বন্দী হলে অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা। কিন্তু তারা প্রথমোক্ত দু’টি নির্দেশ অমান্য করে তৃতীয় নির্দেশ পালনে বিশেষ তৎপর ছিল। ঘটনার বিবরণ এরূপঃ মদীনাবাসীদের মধ্যে ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’ নামে দু’টি গোত্র ছিল। তাদের মধ্যে শত্রুতা লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে যুদ্ধও বাধত । মদীনার আশেপাশে ইহুদীদের দু’টি গোত্র ‘বনী কুরায়যা’ ও ‘বনী নাজীর’ বসবাস করত। আওস গোত্র ছিল বনী-কুরায়যার মিত্র এবং খাযরাজ গোত্র বনী নাজীরের মিত্র। আওস ও খাযরাজের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে মিত্রতার ভিত্তিতে বনী কুরায়যা আওসের সাহায্য করত এবং নাজীর খাযরাজের পক্ষ অবলম্বন করত। যুদ্ধে আওস ও খাযরাজের যেমন লোকক্ষয় ও ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হতো, তাদের মিত্র বনী কুরাযযা ও বনী নাজীরেরও তেমনি হতো। বনী কুরায়যাকে হত্যা ও বহিষ্কারের ব্যাপারটির শত্রুপক্ষের মিত্র নাজীরেরও হাত থাকত। তেমনি নাজীরের হত্যা ও বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করার কাজে শত্রুপক্ষের মিত্র বনী কুরায়যারও হাত থাকত। তবে তাদের একটি আচরণ ছিল অদ্ভুত। ইহুদীদের দুই দলের কেউ আওস অথবা খাযরাজের হাতে বন্দী হয়ে গেলে প্রতিপক্ষীয় দলের ইহুদী স্বীয় মিত্রদের অর্থে বন্দীকে মুক্ত করে দিত। কেউ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলতঃ বন্দীকে মুক্ত করা আমাদের উপরে ওয়াজিব। পক্ষান্তরে যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে কেউ আপত্তি করলে তারা বলতঃ কি করব, মিত্রদের সাহায্যে এগিয়ে না আসা লজ্জার ব্যাপার। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তাদের এ আচরণেরই নিন্দা করেছেন এবং তাদের এ অপকৌশলের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন।

এ আয়াতে যে সব শত্রু গোত্রকে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো আওস ও খাযরাজ গোত্র। আওস বনী কুরায়যার বন্ধুত্ব লাভের জন্য বনী নাজীরের শত্রু ছিল এবং খাযরাজ বনী নাজীরের বন্ধুত্ব লাভের জন্য বনী কুরায়যার শত্রু ছিল।

عدوانও اثم (গোনাহ্ ও অন্যায়)-আয়াতে ব্যবহৃত এ দু’টি শব্দ দ্বারা দু’রকম হক বা অধিকার নষ্ট করার প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। আর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তারা একদিকে আল্লাহর হক নষ্ট করেছে এবং অপরকে কষ্ট দিয়ে বান্দার হকও নষ্ট করেছে। 

পরবর্তী আয়াতে অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে তিরস্কার করার সাথে সাথে শাস্তির কথাও বর্ণনা করে বলা হয়েছেঃ

“তোমরা কি (আসলে) গ্রন্থের (তওরাতের) কতক (নির্দেশ) বিশ্বাস কর এবং কতক (নির্দেশ) অবিশ্বাস কর ? তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি এমন করে, পার্থিব জীবনের দুর্গতি ছাড়া তার আর কি সাজা (হওয়া উচিত)? কিয়ামতের দিন তারা ভীষণ আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ্ তা’আলা (মোটেই) বে-খবর নন তোমাদের (বিশ্রী) কাজকর্ম সম্বন্ধে।

ঘটনায় বর্ণিত ইহুদীরা নবী করীম (সা) -এর নবুয়ত স্বীকার না করায় নিঃসন্দেহে কাফের। কিন্তু এখানে তাদের কুফর উল্লেখ করা হয়নি। বরং কতিপয় নির্দেশ পালন না করাকে কুফর বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ যতক্ষণ কেউ হারামকে হারাম মনে করে, ততক্ষণ কাফের হয় না। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, শরীয়তের পরিভাষায় কঠোর গোনাহ্‌কে শুধু কঠোরতার প্রেক্ষিতেই কুফর বলে দেওয়া হয়। আমরা নিজেদের পরিভাষায়ও এর দৃষ্টান্ত অহরহ দেখতে পাই । উদাহরণত কাউকে কোন নিকৃষ্ট কাজ করতে দেখলে আমরা বলে দেইঃ তুই একেবারে চামার। অথচ সে মোটেই চামার নয়। এক্ষেত্রে তীব্র ঘৃণা এবং সংশ্লিষ্ট কাজটির নিকৃষ্টতা প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য। مَنْ تَرَكَ الصَّلَاةَ فَقَدْ كَفَرَ (যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ছেড়ে দেয়, সে কাফের হয়ে যায়)। এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদীসের বেলায়ও এ অর্থই বুঝতে হবে।

আয়াতে উল্লিখিত দু’টি শাস্তির প্রথমটি হলো পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ও দুর্গতি। তা এভাবে বাস্তব রূপ লাভ করেছে যে, নবী করীম (সা)-এর আমলেই মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভঙ্গের অপরাধে বনী-কুরায়যা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বন্দী হয়েছে এবং বনী নাজীরকে চরম অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে সিরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছে।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৬

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا بِالۡاٰخِرَۃِ ۫ فَلَا یُخَفَّفُ عَنۡهُمُ الۡعَذَابُ وَ لَا هُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ ﴿۸۶

সূরা আল-বাকারাহ ৮৬ নং আয়াতের অর্থ

(৮৬) এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না ।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৬ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

(তাদের শাস্তির কারণ এই যে,) তারাই (নির্দেশ অমান্য করে) পার্থিব জীবনের স্বাদ গ্রহণ করেছে পরকালের (মুক্তির) বিনিময়ে (অথচ মুক্তির উপায় ছিল নির্দেশ মান্য করা)। অতএব, (শাস্তিদাতার পক্ষ থেকে) তাদের শাস্তি লঘু হবে না এবং (কোন উকিল-মোক্তার বা আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৭

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَ قَفَّیۡنَا مِنۡۢ بَعۡدِهٖ بِالرُّسُلِ ۫ وَ اٰتَیۡنَا عِیۡسَی ابۡنَ مَرۡیَمَ الۡبَیِّنٰتِ وَ اَیَّدۡنٰهُ بِرُوۡحِ الۡقُدُسِ ؕ اَفَکُلَّمَا جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌۢ بِمَا لَا تَهۡوٰۤی اَنۡفُسُکُمُ اسۡتَکۡبَرۡتُمۡ ۚ فَفَرِیۡقًا کَذَّبۡتُمۡ ۫ وَ فَرِیۡقًا تَقۡتُلُوۡنَ ﴿۸۷

সূরা আল-বাকারাহ ৮৭ নং আয়াতের অর্থ

(৮৭) অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি। এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসুল পাঠিয়েছি। আমি মরিয়ম-তনয় ঈসাকে সুস্পষ্ট মো'জেযা দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিদান করেছি। অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে, যা তোমাদের মনে ভাল লাগেনি, তখনই তোমরা অহঙ্কার প্রদর্শন করেছ। শেষ পর্যন্ত তোমরা একদলকে মিথ্যাবাদী বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছ।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৭ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

হে বনী-ইসরাঈল, আমি (তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য অনেক বড় বড় আয়োজন করেছি। তন্যধ্যে সর্বপ্রথম) মূসাকে (তওরাত) গ্রন্থ দিয়েছি। তারপর (অন্তর্বর্তীকালে) একের পর এক পয়গম্বর পাঠিয়েছি। (অতঃপর এ পরিবারের শেষ প্রান্তে) আমি মরিয়ম-তনয় ঈসাকে (নবুয়তের) সুস্পষ্ট প্রমাণাদি (ইঞ্জীল ও মু'জিযা) দান করেছি এবং আমি তাকে পবিত্র রূহ, (তথা জিবরাঈল আলাইহিস্ সালাম)-এর মাধ্যমে শক্তি দান করেছি (এটিও একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ ছিল)। অতঃপর (এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, এতসব সত্ত্বেও তোমরা অবাধ্যতায় অটল রইলে এবং) যখনই কোন পয়গম্বর তোমাদের কাছে এমন নির্দেশ নিয়ে এলেন, যা তোমাদের মনঃপূত হয়নি, তখনই তোমরা (এই পয়গম্বরের অনুসরণ করতে) অহংকার করতে লাগলে। ফলে (এসব পয়গম্বরের একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ এবং আরেক দলকে (নির্ধিধায় হত্যা করেছ।

কোরআন-হাদীসের বিভিন্ন স্থানে হযরত জিবরাঈল (আ)-কে ‘রূহুল কুদুস’ (পবিত্ৰাত্মা) বলা হয়েছে। কোরআনের আয়াত قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ এবং হাদীসে হযরত হাসসান ইবনে সাবেতের কবিতা রয়েছেঃ

وجبرائيل رسول الله فينا - وروح القدس ليس له كفاء

জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে ঈসা (আ)-কে কয়েক রকম শক্তি দান করা হয়েছে। প্রথমত, জন্মগ্রহণের সময় শয়তানের স্পর্শ হতে রক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া তাঁরই দম করার ফলে মরিয়মের উদরে হযরত ঈসার গর্ভ সঞ্চারিত হয়। বহু ইহুদী ঈসা (আ)-এর শত্রু ছিল। এ কারণে দেহরক্ষী হিসাবে জিবরাঈল (আ) তাঁর সাথে সাথে থাকতেন। এমনকি, শেষ পর্যন্ত জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমেই তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়া হয়। ইহুদীরা হযরত ঈসা (আ)-সহ অনেক পয়গম্বরকে মিথ্যাবাদী বলেছে, এবং হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ)-কে হত্যাও করেছে।

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ৮৮

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا غُلۡفٌ ؕ بَلۡ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِکُفۡرِهِمۡ فَقَلِیۡلًا مَّا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۸۸

সূরা আল-বাকারাহ ৮৮ নং আয়াতের অর্থ

(৮৮) তারা বলে, আমাদের হৃদয় অর্ধাবৃত। এবং তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। ফলে তারা অল্পই ঈমান আনে।

সূরা আল-বাকারাহ ৮৮ নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপে

তারা (ইহুদীরা বিদ্রূপের ভঙ্গিতে) বলে, আমাদের হৃদয় (এমন) সংরক্ষিত ( যে, তাতে ধৰ্ম বিরোধী প্রভাব অর্থাৎ ইসলামের প্রভাব প্রতিফলিত হয় না। নিজ ধর্মের ব্যাপারে আমরা খুব পাকাপোক্ত। আল্লাহ্ বলেন যে, এটা দৃঢ়তা নয়;) বরং তোমাদের কুফরের জন্য আল্লাহর অভিসম্পাত (ফলে সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে রহিত ধর্মকেই পুঁজি করে নিয়েছে)। ফলে তারা অল্পই ঈমান আনে। (অল্প ঈমান গ্রহণীয় নয়। কাজেই তারা নিঃসন্দেহে কাফের)।

জ্ঞাতব্যঃ ইহুদীদের ’অল্প ঈমান’ এ সব বিষয়ে যা তাদের ধর্ম ও ইসলামে সমভাবে বিদ্যমান। যেমন, আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করা ও কিয়ামতে বিশ্বাস করা, এসব বিষয় তারাও স্বীকার করে। কিন্তু মুহাম্মদ (সা)-এর নবুয়ত ও কোরআনকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের ঈমান পূর্ণ নয়।

এ অল্প ঈমানকে আভিধানিক দিক দিয়ে ঈমান বলা হয়েছে। এর অর্থ সাধারণ বিশ্বাস। শরীয়তের পরিভাষায় একে ঈমান বলা যায় না। শরীয়তে সে ঈমানই স্বীকৃত, যা শরীয়ত বর্ণিত সব বিষয় বিশ্বাস করার মাধ্যমে হয়ে থাকে।





**************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url