সাহাবাগণের জীবনকথা-৩৭ || আবু হুরাইরা আদ-দাওসী (রা) || আবু হুরাইরা (রাঃ) এর জীবনী





আবু হুরাইরা আদ-দাওসী (রা)

আবু হুরাইরা’ এ নামটি জানে না মুসলিম জাতির মধ্যে এমন কেউ কি আছে? ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগে লােকে তাকে ডাকতো- 'আবদু শামস' বলে। পরবর্তীকালে আল্লাহ তা'আলা যখন ইসলামের দিকে হিদায়াত দান করে তার ওপর অনুগ্রহ করলেন এবং রাসুলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ দানের মাধ্যমে তাঁকে গৌরবান্বিত করলেন, রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি? তিনি জবাব দিলেন, 'আবদু শামস (অরুণ দাস)।

রাসূল (সা) বললেন, 'না আজ থেকে তােমার নাম- আবদুর রহমান

আবু হুরাইরা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার নামে কুরবান হােক। আমার নাম আজ থেকে আবদুর রহমান-ই হবে।'

আবু হুরাইরার নামকরণ ও গোত্র পরিচয়

আবু হুরাইরা' তার কুনিয়তি বা উপনাম। ছােট বেলায় একটি বিড়াল শাবকের সাথে তিনি সবসময় খেলতেন। তা দেখে সাথীরা তার নাম দেন আবু হুরাইরা (বিড়াল শাবকওয়ালা)। আস্তে আস্তে এ নামেই তিনি সকলের মাঝে পরিচিত হন এবং তার আসল নামটি ঢাকা পড়ে যায়। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে যখন তার সম্পর্ক গম্ভীর হয় তখন মাঝে মাঝে তিনি আদর করে ডাকতেন আবু হিররিন'। তাই তিনি আবু হুরাইরার পরিবর্তে আবু হিররিন নামটিকেই প্রাধান্য দেন। তিনি বলতেন। আমার হাবীব 'আল্লাহর রাসূল আমাকে এ নামেই ডেকেছেন। তাছাড়া হিরন পুং লিঙ্গ এবং হুরাইরা স্ত্রী লিঙ্গ। 

আবু হুরাইরা (রাঃ) এর রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য লাভ

আবু হুরাইরা ইসলামে দীক্ষিত হন প্রখ্যাত সাহাবী তুফান্মিল ইবন আমর 'আপ-পওসীর হাতে।ইসলাম গ্রহণের পর তিনি স্বীয় পাওস গােত্রের সাখেই অবস্থান করতে থাকেন। যষ্ঠ হিজরী সনে তার গোত্রের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে তিনিও এলেন মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করতে। আমর ইবনুল খালাস বলেন, মদীনায় তার প্রথম আগমন হয় খাইবার বিজয়ের বছর সপ্তম হিজরীর মুহাররাম মাসে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) এর মায়ের ইসলাম গ্রহণ

মদীনা আসার পর দাস গােত্রের এ যুবক নিরবচ্ছিনস্তাবে রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমত ও সাহচর্য অবলম্বন করেন। রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা মসজিদেই অবস্থান করতে থাকেন। সব সময় রাসূলুল্লাহর (সা) কাছ থেকে তালীম ও তারবিয়াত লাভ করতেন এবং তারই ইমামতিতে নামায আদায় করতেন। রাসূলের (সা) জীবদ্দশায় তার স্ত্রী বা সন্তান সন্ততি ছিল না। একমাত্র তার বৃদ্ধা মা ছিলেন। তখনও তিনি পৌত্তলিকতার ওপর অটল। আবু হুরাইরা স্নেহময়ী মাকে সর্বদা দাওয়াত দিতেন, আর তিনি অস্বীকার করতেন। এতে তিনি গভীর ব্যথা ও দুঃখ অনুভব করতেন। একদিন তিনি মাকে আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানালে তিনি নবী (সা) সম্পর্কে এমন কিছু অশ্রাব্য কথা বলেন যাতে আবু হুরাইরা ভীষণ মর্মাহত হন। কাঁদতে কাঁদতে তখনই রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হন। রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কাদছাে কেন?

তিনি বললেন, 'আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিই, আর তিনি অস্বীকার করেন। প্রতিদিনকার মত আজও আমি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম, তিনি আমাকে আপনার সম্পর্কে এমন কিছু কথা বললেন যে আমাকে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি আবু হুরাইরার মায়ের অন্তরটি ইসলামের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দু’আ করুন। রাসূল (সা) দু'আ করলেন।

আবু হুরাইরা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) দরবার থেকে বাড়ীতে ফিরে গেলাম। দেখি ঘরের দরজাটি বন্ধ, তবে ভেতরে পানি পড়ার শব্দ শুনা যাচ্ছে। আমি ভেতরে প্রবেশ করতে যাব এমন সময় মা বললেন, “আবু হুরাইরা, একটু অপেক্ষা কর’ একথা বলে তিনি কাপড় ঠিকঠাক করে নিলেন। তারপর আমাকে ভেতরে ডাকলেন। আমি প্রবেশ করলাম। তখনই তিনি পাঠ করতে লাগলেন! “আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহদুিন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।”

আমি আবার রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে ফিরে গেলাম। আনন্দে তখন আমি কাঁদছি, যেমন কিছুক্ষণ আগে দুঃখে কেঁদেছিলাম। বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, সুসংবাদ! মহান আল্লাহ আপনার দুআ কবুল করেছেন, তিনি আবু হুরাইরার মাকে হিদায়াত দান করেছেন, আবু হুরাইরার মা ইসলাম গ্রহণ করেছেন।' | আবু হুরাইরা রাসূলকে (সা) ভালােবাসেন। সে ভালােবাসা ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি রাসূলের (সা) দিকে এক দুবার মাত্র তাকিয়ে পরিতৃপ্ত হতেন না। তিনি বলতেন, রাসূল (সা) অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর ও দীপ্তিমান কোন কিছু আমি দেখিনি। তাঁর চেহারায় যেন সুর্যের কিরণ ঝলমল করতে থাকে।

তিনি নবীর (সা) সাহাবী হওয়ায় মর্যাদা লাভ করেছেন এবং তার দ্বীনের অনুসারী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। এজন্য তিনি সব সময় মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। বলতেন, আবু হুরাইরাকে যিনি ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়েছেন, সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর। আর সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আবু হুরাইরাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সাহচর্য দান করে অনুগ্রহ করেছেন।'

আবু হুরাইরা (রাঃ) এর ইসলামী জ্ঞান চর্চা

আবু হুরাইরা রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি যেমন নিবেদিত ছিলেন, তেমনি ছিলেন জ্ঞানের প্রতিও কুরবান। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানচর্চা তার অভ্যাস ও প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। যায়িদ বিন সাবিত (রা) বলেনঃ

একদিন আবু হুরাইরা, আমদের এক বন্ধু ও আমি মসজিদে আল্লাহর কাছে দু'আ করছিলাম। এমন সময় রাসূলকে (সা) আমরা দেখতে পেলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমাসের মাঝখানে বসলেন। আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। তিনি বললেন, 'তােমরা তােমাদের কাজ আবার শুরু কর।' আমি ও আমার বন্ধুটি আবু হুরাইরার আগেই আল্লাহর কাছে দু'আ করলাম। রাসূল (সা) আমাদের দু'আর সাথে সাথে আমীন বললেন। তারপর আবু হুরাইরা দু'আ করলেন ।

“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাই, আমার দু'বন্ধু যা কিছু চেয়েছে। আর সেইসাথে চাই এমন জ্ঞান যা কখনও ভুলে না যাই।' এবারও রাসূল (সা) আমীন বললেন। আমরা দু'জনও বললাম, 'আমরাও চাই ভুলে না যাই এমন জ্ঞান।' রাসূল (সা) বললেন, 'দাওস গােত্রের এ লােকটি এক্ষেত্রে তােমাদের দু'জনকে হারিয়ে দিয়েছে।'

আবু হুরাইরা নিজের জন্য যেমন জ্ঞান ভালােবাসতেন, তেমনি অপরের জন্যও। ইতিহাসে এ সম্পর্কিত একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ আছে। একদিন তিনি মদীনার বাজারে গেলেন। সেখানে বেচা-কেনা, লেন-দেন ইত্যাদির মধ্যে মানুষের নিমগ্নতা দেখে বিস্মিত হলেন। থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, 'ওহে মদীনাবাসী, তােমরা দারুণভাবে বঞ্চিত।' লােকরা জিজ্ঞেস করলাে, “আবু হুরাইরা, আপনি আমাদের বঞ্চনার কি দেখলেন?' | তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহর (সা) মীরাস (উত্তরাধিকার) বণ্টিত হচ্ছে, আর তােমরা এখানে বসে আছো, সেখানে গিয়ে তােমাদের নিজ নিজ অংশগুলি নিয়ে নাও না কেন?

তারা বলল, “কোথায়? তিনি বললেন, 'মসজিদে।

লােকেরা মসজিদের দিকে ছুটে গেল। আবু দুৱাইরা তাদের অপেক্ষায় সেখানে দাড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর তারা ফিরে এসে বলল, 'আবু হুরাইরা, আমরা তো মসজিদে গিয়েছি, ভেতরে প্রবেশ করেছি, কিন্তু কোন কিছু বন্টন হচ্ছে এমন তো দেখলাম না।'

তিনি বললেন, 'মসজিদে তোমরা কাউকে দেখনি।'

তারা বলল, “অবশ্য দেখেছি, কিছু লোক নামাযে দণ্ডায়মান, কিছু লােক কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল এবং কিছু লােক হারাম-হালাল সম্পর্কে পরস্পর আলোচনারত।'

তিনি বললেন, “তােমাদের ধ্বংস হােক, এ-ই তাে রাসূলুল্লাহর (সা) মীরাস।'

আবু হুরাইরা মুসলিম উম্মাহর জন্য নবীর হাজার হাজার হাদীস স্মৃতিতে ধারণ করে সংরক্ষণ করে গেছেন। সহীহ বুখারীতে আবু হুরাইরা থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের মধ্যে একমাত্র আবদুল্লাহ ইবন উমার ব্যতীত আর কেউ আমার থেকে বেশী হাদীস বর্ণনাকারী নেই। আর তাও এজন্য যে, তিনি হাদীস লিখতেন, আর আমি লিখতাম না।'

রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণনার ব্যাপাটি অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতাে। তাই তিনি বলেন, 'তােমরা হয়তো মনে করছে আমি খুব বেশী হাদীস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম রিক্তহস্ত, দরিদ্র, পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতাে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং আনসাররা তাদের ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে।' তিনি আরও বলেন, “একদিন আমি বললাম । ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার অনেক কথাই শুনি, কিন্তু তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।' একথা শুনে রাসূল (সা) বল্লেন, “তােমার চাদরটি মেলে ধর।' আমি মেলে ধরলাম। তারপর বললেনঃ তােমার বুকের সাথে লেপ্টে ধর। আমি লেপ্টে ধরলাম। এরপর থেকে আর কোন কথাই আমি ভুলিনি।" ইমাম বুখারী বলেনঃ আটশ'রও বেশী সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জাবির, আনাস, ওয়াসিলা (রা) প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযােগ্য।

এক পেয়ালা দুধ দিয়ে এক দল মানুষের পেটপূর্তি

জ্ঞান অর্জনের প্রতি অতিরিক্ত মনােযােগ এবং রাসূলের (সা) মজলিসে উপস্থিতির ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদানের কারণে জীবনে তিনি এত ক্ষুধা ও দারিদ্র সহ্য করছেন যে তার সমকালীনদের মধ্যে কেউ তা করেননি। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ | “মাঝে মাঝে আমি এত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম যে, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাসূলুল্লাহর কোন কোন সাহাবীর নিকট কুরআনের কোন একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম অথচ আমি তা জানতাম। আমার উদ্দেশ্য হত, হয়ত তিনি আমার এ অবস্থা দেখতে পেয়ে আমাকে’সংগে করে তার বাড়ীতে নিয়ে আহার করাবেন।

একদিন আমার ভীষণ ক্ষুধা পেল। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমি পেটে একটি পাথর বেঁধে নিলাম তারপর সাহাবীদের গমনাগমন পথে বসলাম। আবু বকরকে যেতে দেখে তাকে একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। মনে করেছিলাম, তিনি আমাকে তার সাথে যেতে বলবেন। কিন্তু তিনি ডাকলেন না।

তারপর এলেন উমার ইবনুল খাত্তাব। তাকেও একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও কিছু বললেন না। সবশেষে এলেন রাসূল (সা)। তিনি আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করলেন। বললেন, আবু হুরাইরা বললাম লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ একথা বলে পেছনে পেছনে আমি তার বাড়ীতে গিয়ে ঢুকলাম। রাসূল (সা) বাড়ীতে ঢুকে এক পেয়ালা দুধ দেখতে পেলেন। বাড়ীর লােকদের জিজ্ঞেস করলেনঃ “দুধ কোখা থেকে এসেছে। | তারা বললেন, 'আপনার জন্য অমুক পাঠিয়েছে।' রাসূল (সা) বললেন, 'আবু হুরাইরা। তুমি আহলুস সুফফার নিকট গিয়ে তাদের একত্রিত কর।' একথা বলা মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম। আমি মনে মনে বলেছিলাম: মাত্র এক পেয়ালা দুধ, আহলুস সুফফার এতগুলি লোকের কি হবে? আমি চাচ্ছিলাম, প্রথমে আমি পেট ভরে পান করি, তারপর তাদের কাছে যাই। যাইহোক, আমি আহলুস সুফফার কাছে গেলাম এবং তাদের ডেকে একত্র করলাম। তারা সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে বসলে তিনি বললেন । | আবু হুরাইরা, তুমি পেয়ালাটি নিয়ে তাদের হাতে দাও। আমি এক এক করে সবার হাতে দিলাম এবং তারা সবাই পান করে পরিতৃপ্ত হল। তারপর পেয়ালাটি হাতে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে ফিরে এলাম। তিনি মাথা উচু করে আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেনঃ

'তুমি আর আমিই বাকী আছি।' বললামঃ 'সাদাকতা ইয়া রাসূলুল্লাহ সত্যই বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল।' তিনি বললেন, 'তুমি পান কর” আমি পান করলাম। তিনি বললেন, “আরও পান কর।' আমি আরও পান করলাম। এভাবে তিনি বার বার পান করতে বললেন, আর আমি বার বার পান করলাম। শেষে আমি বললাম, “যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, তার শপথ, আমি আর পান করতে পারছিনে। অতঃপর রাসূল (সা) পেয়ালাটি হাতে নিয়ে বাকীটুকু পান করলেন।

আবু হুরাইরা (রাঃ) এর জীবনাচরণ

এত চরম দারিদ্র ও দুরবস্থার মধ্যে আবু হুরাইরাকে অবশ্য বেশী দিন থাকতে হয়নি। অল্প কালের মধ্যেই মুসলমানদের হাতে ধন ও ঐশ্বর্য আসে। চতুর্দিক থেকে প্রবহমান গতিতে গনিমতের মাল মুসলমানদের হাতে আসতে থাকে। আবু হুরাইরা অর্থ, বাড়ী, ভূ-সম্পত্তি, স্ত্রী ও সন্তানাদি সবকিছুর অধিকারী হন। কিন্তু এসব তার মহান অন্তকরণের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি তার অতীত দিনের কথা একদিনের জন্যও ভুলেননি। সবসময় তিনি বলতেন- ইয়াতীম অবস্থায় বড় হয়েছি, রিক্ত হস্তে হিজরত করেছি। পেটেভাতে, বুসরা বিনতু গাওয়ানের মজদুর খেটেছি। তারা যখন কোথাও তাবু ফেলত, তাদের নানা রকম ফুটফরমাশ পালন করতাম আর যখন তারা বাহনে আরোহণ করত, তাদের উটগুলি তাড়িয়ে নিতাম। অবশেষে আল্লাহ তা'আলা বুসরাকে আমার স্ত্রী হিসাবে দান করেন। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তার দ্বীনকে শক্তিশালী করেছেন এবং আবু হুরাইরাকে সে দ্বীনের একজন নেতা বানিয়ে দিয়েছেন।”

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা) আবু হুরাইরাকে বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তাকে অপসারণ করেন। তারপর আবার নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মদীনা ত্যাগ করে আকীক নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন।

হযরত মুয়াবিয়ার শাসনামলে আবু হুরাইরা একাধিকবার মদীনার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে শাসন ক্ষমতা তার স্বভাবগত মহত্ব, উদারতা ও অল্পেভুষ্টি ইত্যাদি শুণাবলীতে কোন পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারেনি।

আবু হুরাইরা তথন মদীনার শাসক। নিজ পরিবারের জন্য কাঠের বােঝা পিঠে চাপিয়ে মদীনার একটি রাস্তা দিয়ে তিনি চলছেন। পথে সা'লাবা ইবন মালিকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললেন, 'সা'লাবা, আমীরের জন্য পথটা একটু ছেড়ে দাও।' সা'লাবা বললেন, 'আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। এত প্রশস্ত পথ দিয়েও আপনি। যেতে পারছেন না?' তিনি বললেন, 'তােমাদের আমীর ও তার পিঠের বােঝাটির জন্য পথটা প্রশস্ত করে দাও।'

অগাধ জ্ঞান, সীমাহীন বিনয় ও উদারতার সাথে আবু হুরাইরার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহ প্রীতির এক পরম সম্মিলন ঘটেছিল। তিনি দিনে রােযা রাখতেন, রাতের তিন ভাগের প্রথম ভাগ নামাযে অতিবাহিত করতেন। তারপর স্ত্রীকে ডেকে দিতেন। তিনি রাতের দ্বিতীয় ভাগ নামাযে কাটিয়ে তাদের কন্যাকে জাগিয়ে দিতেন। কন্যা রাতের বাকী অংশটুকু নামাযে দাঁড়িয়ে অতিবাহিত করতেন। এভাবে তার বাড়ীতে সমস্ত রাতের মধ্যে ইবাদত কখনও বন্ধ হত না।

ইকরিমা বলেন, আবু হুরাইরা প্রতিদিন বার হাজার বার তাসবীহ পাঠ করতেন। তিনি বলতেন। 'আমি আমার প্রতিদিনের পাপের সম পরিমাণ তাসূবীহ পাঠ করে থাকি।'

আবু হুরাইরার একটি নিম্নো দাসী ছিল। একদিন তার আচরণে তিনি ও তার পরিবারবর্গ খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি তাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। চাবুকটি উঠিয়ে আবার থেমে গেলেন। বললেন, 'কিয়ামতের দিন যদি এর বদলার ভয় না করতাম। তাহলে চাবুক মেরে তােমাকে কষ্ট দিতাম, যেমন তুমি আমাদের দিয়েছ। তবে তােমাকে আমি এমন একজনের কাছে বিক্রি করবাে যিনি আমাকে তােমার ন্যায্য মূল্যই দেবেন। আর আমিও এ মূল্যেরই অধিকতর মুখাপেক্ষী। যাও আল্লাহর ওয়াস্তে তােমাকে আমি আযাদ করে দিলাম।' | আবু হুরাইরার মেয়ে একদিন বললেন, ‘আব্বা, অন্য মেয়েরা আমাকে লজ্জা দেয়। তারা বলে তোমার আব্বা তোমাকে সোনার গহনা বানিয়ে দেন না কেন?

তিনি বললেন, “বেটী, তাদের তুমি বলাে, আমার আব্বা জাহান্নামের লেলিহান শিখার ভয় করেন।' মেয়েকে সােনার গহনা না দেওয়ার কারণ ধন-সম্পদের প্রতি তার লালসা ও কৃপণতা নয়। তিনি তাে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ব্যাপারে সবসময় ছিলেন দরাজহস্ত। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে ইতিহাসে অনেক কথাই আছে। একদিন মারওয়ান ইবনুল হিমি একশ' দিনার আবু হুরাইরার কাছে পাঠালেন। কিন্তু পরের দিনই মারওয়ান আবার লােক পাঠিয়ে জানালেন, আমার চাকরটি ভুলক্রমে দিনারগুলি আপনাকে দিয়ে এসেছে, ওগুলি আমি আপনাকে দিতে চাইনি, বরং অন্য এক ব্যক্তিকে দিতে চেয়েছিলাম' একথা শুনে আবু হুরাইরা লজ্জা ও বিস্ময়ের সাথে বললেনঃ 'আমি তাে সেগুলি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেলেছি। রাত পােহানাে পর্যন্ত একটি দিনারও আমার কাছে ছিলনা। আগামীতে বাইতুল মাল থেকে যখন আমার ভাতা দেওয়া হবে, সেখান থেকে নিয়ে নেবেন। আসলে মারওয়ান তাকে পরীক্ষার উদ্দেশেই এমনটি করেছিলেন।

মা যতদিন জীবিত ছিলেন আবু হুরাইরা তার সাথে সর্বদা সদাচরণ করেছেন। তিনি যখন বাড়ী থেকে বের হতেন, মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে বলতেন, ‘মা’ আসসালামু আলাইকি ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।'

জবাবে মা বলতেন, প্রিয় সন্তান, ওয়া আলাইকি সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।'
সালাম বিনিময়ের পর আবু হুরাইরা বলতেন, 'আল্লাহ আপনার ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করুন, যেমন আপনি করেছেন ছোট্ট বেলায় আমার ওপর।' মা বলতেন, বড় হয়ে আমার সাথে তুমি যে সদাচরণ করেছ, তার বিনিময়ে আল্লাহ তােমার ওপর রহম করুন।' বাড়ীতে প্রত্যাবর্তনের পর মাতা-পুত্রের মধ্যে এরূপ দু'আ ও সালাম বিনিময় হতাে।

আবু হুরাইরা নিজে যেমন মুরুব্বিজনদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, তেমনি সকলকে তিনি উপদেশ দিতেন মাতাপিতার সাথে সদাচরণের, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক কায়েম রাখার। একদিন তিনি দেখতে পেলেন, দু'জন লােক রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন অন্যজন থেকে অধিকতর বয়স্ক। কনিষ্ঠজনকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'সংগের লােকটি তােমার কি হয়?

সে বলল 'আব্বা।

তিনি বললেন, 'তুমি কখনও তার নাম ধরে ডাকবে না, তার আগে আগে চলবে না এবং তার বসার আগে কোথাও বসবে না।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) এর ইন্তেকাল

অন্তিম রােগ শয্যায় তিনি আকুল হয়ে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করা হলাে কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, 'তোমাদের এ দুনিয়ার জন্য আমি কাঁদছি না। কাদছি, দীর্ঘ ভ্রমণ ও স্বল্প পাথেয়'র কথা চিন্তা করে। যে রাস্তাটি জান্নাতে বা জাহান্নামে গিয়ে পৌছেছে, আমি এখন সে, রাস্তার শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়েছি। জানিনে, আমি সেই দু'টি রাস্তার কোনটিতে যাব।

অন্তিম রােগ শয্যায় তিনি শায়িত। মারওয়ান ইবনুল হিকাম তাকে দেখতে এলেন। বললেন, 'আবু হুরাইরা, আল্লাহ আপনাকে শিফা দান করুন।

উত্তরে তিনি বললেন, 'আল্লাহ, আমি আপনার দিদার ভালবাসি, আপনিও আমার দিদার পছন্দ করুন এবং আমার জন্য তা তাড়াতাড়ি করুন।" | মারওয়ান তার সাথে সাক্ষাৎ করে বের হতে না হতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ". ঐতিহাসিক ওয়াকিলী বলেন, ওয়ালিদ বিন উকবা' আসরের নামাযের পর তাঁর জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। হযরত ইবন উমার, আবু সাঈদ খুদরী (রা) প্রমুখ সাহাবী তার জানাযায় উপস্থিত ছিলেন।

ওয়ালিদ তার মৃত্যুর খবর হযরত মুয়াবিয়াকে অবহিত করলে তিনি তাঁকে লিখেন, তার উত্তরাধিকারীদের খুঁজে বের করে দশ হাজার দিরহাম দাও এবং তার প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ কর। কারণ, উসমানের গৃহবন্দী অবস্থায় তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।

আল্লামা ইবন হাজার আসকিলানী আল ইসাবা’গ্রন্থে আবু সুলাইমানের সূত্রে উল্লেখ করেছেন, আবু হুরাইরা আটাত্তর বছর জীবন লাভ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহর (সা) মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল তিরিশ বছরের কিছু বেশী। অনেকের মতে তিনি ৫৫ হিজরীতে ইনতিকাল করেন; কিন্তু ওয়াকিদীর মতে তাঁর মৃত্যুসন ৫৯ হিজরী। তবে ইমাম বুখারীর মতে তার মৃত্যুসন হিজরী ৫৭।




**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url