তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন-৩ || কোরআনের উপস্থাপিত আগামী বিপ্লবের ঘোষণাপত্র: সাইয়েদ কুতুব শহীদ





কোরআনের উপস্থাপিত আগামী বিপ্লবের ঘোষণাপত্র

সাইয়েদ কুতুব শহীদ


গোটা মানবজাতি আজ একটি অতলান্ত খাদের প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান কালের বহুমুখী ধ্বংসলীলা আজ তাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে নিতে উদ্যত হয়েছে বলেই যে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, বরং এ অবস্থাটা হচ্ছে ভয়াবহ রোগের একটা লক্ষণ মাত্র। আসল রোগ কিন্তু এটা নয়। মানবজাতি আজ যে কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের সার্বিক উন্নয়ন ও সত্যিকার অগ্রগতির জন্য জীবনের জন্য যে মূল্যবোধ প্রয়োজন, তা হারিয়ে ফেলেছে। আজ পাশ্চাত্য জগতের বুদ্ধিজীবীদের কাছেও তাদের আধ্যাত্মিক দেউলিয়াপনা সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে এবং তারা একথা অনুভব করছে যে, মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার উপযোগী জীবনের কোনো মূল্যবোধ তাদের কাছেও বর্তমান নেই। তারা জানে যে, তাদের নিজেদের বিবেককে পরিতুষ্ট করা ও তার স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখার মত কোন মূলধনও তাদের কাছে নেই।
পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র নিষ্ফল ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে; ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে প্রাচ্যের চিন্তাধারা, মতবাদ গ্রহণ করতে। তার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এই যে, তাদের কিছু কিছু দেশ এখনো সমাজতন্ত্রের নামে প্রাচ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। ওদিকে প্রাচ্য জোটেরও একই দশা। তাদের সমাজ বিধান, বিশেষ করে মার্কসীয় অর্থনৈতিক মতবাদ শুরুতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিপুল সংখ্যক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো, কিন্তু চিন্তা থেকে নেমে যখন তা বাস্তব ভূমিতে পা রেখেছে তখনই মার্কসীয় মতবাদ পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। একথা বলা আজ মোটেই অত্যুক্তি নয় যে, বর্তমান দুনিয়ায় কেন একটি দেশও সত্যিকার মার্কসবাদ কায়েম হয়নি। কেননা, এ মতবাদ সার্বিকভাবে মানুষের জন্মগত স্বভাব ও তার মৌলিক প্রয়োজনের পরিপন্থী। মার্কসীয় আদর্শ শুধুমাত্র অধপতিত অথবা দীর্ঘকাল যাবত একনায়কত্বের যাতাকলে নিষ্পিষ্ট নিষ্প্রাণ সমাজেই সাময়িকভাবে প্রসার লাভ করতে পারে। যদিও দেখা গেছে, সে ধরনের সমাজেও এই বন্ধুবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান দানে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ এই বন্ধুবাদী অর্থনীতিই হচ্ছে মার্কসীয় মতবাদের ভিত্তি। কম্যুনিষ্ট দেশগুলোর গুরু রাশিয়াই আজ ভয়াবহ খাদ্যাভাবের সম্মুখীন। জারের শাসনামলে যে রাশিয়া উদ্ধৃতি খাদ্য উৎপাদন করতো, সে দেশই আজ তার সংরক্ষিত স্বর্ণের বিনিময়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে সমবায় খামারভিত্তিক চাষাবাদই এ ব্যর্থতার কারণ। অন্য কথায় বলা যায় মানব স্বভাবের বিপরীতধর্মী ব্যবস্থা কায়েমের ফলেই মার্কসীয় মতবাদ আজ এ নির্মম ব্যর্থতার সম্মুখীন।*

* স্মরণ রাখা প্রয়োজন প্রবন্ধটি প্রায় ৫০ বছর আগের লেখা।

মানবজাতির আজ নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন। পাশ্চাত্যের নেতৃত্ব আজ ক্ষয়িষ্ণু। এর কারণ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বক্তৃতান্ত্রিক অবস্থা অথবা আর্থিক ও সামরিক শক্তির দুর্বলতা নয়, এর কারণ আরো গভীরে। পাশ্চাত্য জগত মানবজাতির নেতৃত্বের আসন থেকে এ জন্যে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে যে, জীবনীশক্তি সঞ্চারকারী যেসব মৌলিক গুণাবলী তাকে একদিন নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলো, সেসব গুণ আজ তার কাছে অবশিষ্ট নেই।
       
অনাগত দিনের নতুন নেতৃত্বকে ইউরোপের যাবতীয় সৃজনশীল প্রতিভার অবদানগুলোকে সংরক্ষণ করে তার উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটাতে হবে, সাথে সাথে মানব জাতির সামনে এমন মহান আদর্শ ও মূল্যবোধ পেশ করতে হবে, যা আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে মানবজাতির সামনে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও বাস্তব জীবন বিধানও পেশ করতে হবে, যা মানব স্বভাবের সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যশীল হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না একমাত্র ইসলামী ব্যবস্থাই উল্লেখিত মূল্যবোধ ও জীবন বিধান দান করতে সক্ষম।

দেখতে দেখতে বিজ্ঞানের প্রতাপও এখন শেষ হয়ে এসেছে। ষোড়শ শতকে যে রেনেসাঁ আন্দোলন সূচনা হয়েছিলো, আঠারো ও উনিশ শতকে এসে যে বিজ্ঞান বিজয়ের উঁচু শিখরে পৌঁছে গেছে বলে দাবী করছিলো আজ তা নিষ্প্রভ হয়ে পুনরুজ্জীবন শক্তি মনে হয় হারিয়ে ফেলেছে। আধুনিক যুগে যেসব জাতীয়তাবাদী ও উগ্র স্বদেশিকতাবাদী মতবাদ জন্য নিয়েছে এবং এগুলোকে ভিত্তি করে যেসব আন্দোলন ও জীবনযাত্রার প্রণালী গড়ে উঠেছে, সবগুলোই আজ বলতে গেলে নির্জীব হয়ে পড়েছে। সংক্ষেপে বলতে হয়, মানুষের তৈরী সকল জীবন বিধানই আজ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

এ নাযুক ও বিভ্রান্তিকর ও অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে মুসলমানদের নিজ দায়িত্ব পালনের সময় এসেছে। জেনে রাখতে হবে যে, ইসলাম কখনো সৃষ্টিজগতকে তার বন্ধুসভার আবিষ্কারে বাধা দেয়নি। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানুষকে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর সময়ই মানবজাতিকে সৎপথ দেখানোর দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করেছেন।

এ দায়িত্ব পালনকে কয়েকটি শর্তাধীনে আল্লাহ তায়ালার এবাদাত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এটাকেই মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন,
       
'তোমার মালিক যখন ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি দুনিয়ার বুকে আমার খলীফা পাঠাতে চাই। (সূরা আল বাকারা ৩০)

'আমি জ্বিন ও মানবজাতিকে আমার বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।' (সুরা আয যারিয়াত ৫৬)

এ তো হচ্ছে খেলাফাত ও বন্দেগীর কথা। কিন্তু এর সাথে আল্লাহ তায়ালা তাঁর মোমেন বান্দাদের ওপর যে দায়িত্ব পালনের ভার নিয়েছেন, তা পূরণ করার সময় আজ এসে গেছে এবং তা এভাবে তোমাদের আমি এক মধ্যবর্তী উম্মত হিসেবে পয়দা করেছি যেন তোমরা মানবজাতির ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রসূল (স.) তোমাদের ওপর সাক্ষী হয়ে থাকতে পারেন।' (সুরা আল বাকারা ১৪৩)

'তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্যেই তোমাদের উত্থান। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং নিজেরা আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান আনবে । (সূরা আলে ইমরান ১১০)

ইসলাম কখনো সমাজ ও জাতির বুকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে তার এ ভূমিকা পালন করতে পারে না। কেননা মানুষ নিছক প্রশংসা শুনে কোনো মতবাদ গ্রহণ করতে রাযী হয় না। তারা বাস্তবে রূপায়িত ব্যবস্থাকেই সহজে বিচার করতে পারে এবং তাকেই পেতে চায়। এ দৃষ্টিভংগী থেকে বলা যায় যে, বিগত কয়েক শতক যাবত মুসলিম জাতি তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে তারা আল্লাহ তায়ালার দুনিয়ায় এমন একটি ভূখণ্ড দেখাতে সক্ষম হবে না যেখানে ইসলাম তার পূর্ণ সত্তায় বিরাজমান রয়েছে। আজকের মুসলমানদেরকে দেখলে একথা বিশ্বাসই হয় না যে, তাদের পূর্ব পুরুষেরা সত্যি সত্যিই ইসলামের অনুসারী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান হবে এমন একদল লোকের নাম, যাদের চলন বলন, ধ্যান-ধারণা, আইন-কানুন ও মূল্যবোধ সবকিছুই | ইসলামী উৎস থেকে গৃহীত হবে। যে মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিধান পৃথিবীর ওপর থেকে | অপসারিত হয়েছে, সে মুহূর্ত থেকেই নিজস্ব বৈশিষ্টপূর্ণ মুসলিম দলটি ধরাপৃষ্ঠ থেকে বলতে গেলে বিলীনই হয়ে গেছে।

ইসলামকে পুনরায় মানবজাতির নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মুসলিম জাতিকে আগে তার আসল রূপ পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুসলিম জগত শত শত বছর ধরে মানব রচিত রীতিনীতির আবর্জনায় চাপা পড়ে রয়েছে। ইসলামী শিক্ষার সাথে যেসব ভ্রান্ত আইন-কানুন আচার-আচরণের দূরতম সম্পর্কও নেই, সেগুলোর গুরুভারেই আজ মুসলমানরা নিষ্পিষ্ট। তবু তারা নিজেদের এলাকাকে ইসলামী জগত মুসলিম দেশ আখ্যা দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে।
       
আমি জানি, নিজেদের সঠিক পুনর্গঠন ও মানবজাতির নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করা, এ দু'টো কাজের মধ্যে বিরাট একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। কারণ, দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলমান জাতির অস্তিত্ব দৃশ্যমান জগত থেকে বিলুপ্ত প্রায়। মানবগোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনেক আগে থেকেই বৈরী আদর্শ, ইসলাম বিরোধী অমুসলিম জাতিগুলোর করায়ত্ত হয়ে আছে।

একথা সত্য যে মুসলমানদের এই দীর্ঘ অনুপুস্থিতিতে ইউরোপীয় প্রতিভা বিজ্ঞান-সংস্কৃতি, আইন-কানুন ও বক্তৃতান্ত্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধন করেছে এবং এর ফলে মানুষের সৃষ্টি শক্তি ও বস্তুগত সুবিধার উপকরণ নির্মাণ কৌশল অনেক উপরে উঠে গেছে। এসব চমৎকার আবিষ্কারের উপকরণ ইত্যাদি দোষত্রুটির প্রতি ইশারা করা সহজ কথা নয়। বিশেষ করে ইসলামী জগত যখন এসব সৃজনশীল প্রতিভা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত, তখন পাশ্চাত্য দেশীয় যান্ত্রিক উপকরণ আবিষ্কারকদের সমালোচনা করা তার পক্ষে আরও বেশী কঠিন।

কিন্তু এসব বিশাল বাধা-বিপত্তি থাকা সত্তেও আজ ইসলামী বিপ্লব অপরিহার্য। ইসলামী আদর্শের পুনরুজ্জীবন ও বিশ্বনেতৃত্বের আসন পুনরুদ্ধারের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ও অনেক বাধা-বিঘ্ন আছে এটা সবার জানা। তবু ইসলামী আদর্শের পুনরুজ্জীবন সাধনের জন্যে সময় নষ্ট না করে এখনি কাজ শুরু করা দরকার।

যদি সঠিক জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি সহকারে আমরা এ কাজ শুরু করতে চাই, তাহলে মুসলিম উম্মতের ওপর আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বিশ্ব নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের জন্যে কোন্ কোন্ গুণাবলী আগে ভাগেই অর্জন করা দরকার, তা আমাদের অবশ্যই জেনে নিতে হবে। সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে গিয়ে যেন হোঁচট খেতে না হয় সে জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী আমাদের অর্জন করা দরকার।

আজকের প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মত মানবজাতির সামনে বক্তৃতান্ত্রিক আবিষ্কারের যোগ্যতা অথবা সম্ভাবনাময় প্রতিভা প্রদর্শনে অক্ষম এটা ঠিক। বর্তমান দুনিয়ার মানুষ মুসলিম উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে তাকে নেতৃত্বের আসন দান করবে, এ অবস্থায় তার এরূপ আশা বাতুলতা মাত্র। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সৃজনশীল মস্তিষ্ক এতো দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গেছে যে, পরবর্তী কয়েক শতক পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতায় ইউরোপকে পরাজিত করে যান্ত্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার কল্পনাও আমরা করতে পারি না। তাই আমাদেরকে এখন কিছু ভিন্ন জাতের গুণাবলী অর্জন করতে হবে যা তাদের কাছে পাওয়া যায় না।
       
তাই বলে বক্তৃতান্ত্রিক উন্নতির বিষয়টিকে আমরা মোটেই অবহেলা করবো না। এ পার্থিব সুখ-সুবিধার প্রতিও আমাদের যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কারণ শুধু মানবজাতির নেতৃত্ব প্রদানের জন্যেই যে বৈষয়িক উন্নতি জরুরী তাই নয়, নিজেদের এবং ইসলামের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেও এটা অপরিহার্য। ইসলাম মানুষকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তায়ালার খলীফার মর্যাদা দিয়েছে এবং খলীফার দায়িত্ব পালন ও আল্লাহ তায়ালার বন্দেগী করাকে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা করেছে। তাই আল্লাহ তায়ালার খলীফা হিসেবে দুনিয়ার উন্নতি সাধন আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

মানবজাতির নেতৃত্বদানের জন্য আমাদের তাই আজ বৈষয়িক উন্নতি ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু পেশ করতে হবে, আর এ অতিরিক্ত জিনিসটি হচ্ছে মানব জীবন সম্পর্কিত মৌলিক বিশ্বাস অর্থাৎ ঈমান এবং সে বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান। এ বিধান আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার সকল অবদান সংরক্ষণ করবে। এ অতিরিক্ত জিনিসটি মানবজাতির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের আরাম-আয়েশের যে চমৎকার উদ্যোগ আয়োজন করেছে, তার মান বজায় রাখবে।

আধুনিক জীবন যাত্রার উৎসমূলের দিকে লক্ষ্য করলে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, গোটা বিশ্বই আজ জাহেলিয়াতের পংকিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং সুখ-সুবিধার সকল আধুনিক উপায় উপকরণ ও চমৎকার উদ্ভাবনী প্রতিভার পাশাপাশি নিরেট অজ্ঞতাও এখন সুস্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণই এই জাহেলিয়াতের প্রমাণ। এর ফলে আল্লাহ তায়ালার জন্যে নির্ধারিত সার্বভৌমত্ব মানুষের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ সমাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই- এ জাহেলিয়াত প্রাচীন ও প্রাথমিক যুগের মত আল্লাহ তায়ালাকে সরাসরি অস্বীকার করে না, বরং জীবনের ভাল-মন্দের মান নির্ণয়, সমষ্টিগত জীবনের জন্যে আইন প্রণয়ন, জীবন বিধান রচনা করার অধিকার দাবীর মাধ্যমেই তারা আল্লাহ তায়ালার সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আলোচ্য বিষয়গুলোতে আল্লাহ তায়ালা তাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করা মানেই একজন মানুষের আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করা। আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে তার সৃষ্টির ওপর যুলুম ও নির্যাতন।

কম্যুনিষ্ট সমাজে মানবতার প্রতি চরম লাঞ্ছনা প্রদর্শন করা হয় এবং পুঁজিবাদী সমাজে অর্থলোড ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দরুন দুর্বল জাতিগুলোর প্রতি নির্মম শোষণ নিষ্পেষণ করা হয়। মূলত আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্বের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং মানুষের আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মর্যাদা অস্বীকার করার এ হচ্ছে অনিবার্য পরিণতি।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, ইসলামই হচ্ছে একমাত্র জীবন বিধান যেখানে সব দিক থেকে মানুষের নিরাপত্তার গ্যারান্টি রয়েছে। কেননা অন্যান্য জীবন বিধানের অধীনে কোনো না কোনো প্রকারে মানুষ মানুষেরই দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। একমাত্র ইসলামী জীবন বিধানেই মানুষ মানুষের দাসত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালারই বিধি-নিষেধ মোতাবেক শুধু তাঁরই বন্দেগী করতে সমর্থ হয়।
       
এখান থেকেই ইসলামের যাত্রাপথ অন্যান্য জীবন বিধান থেকে পৃথক হয়ে যায়। জীবন সম্পর্কে এ নতুন দৃষ্টিভংগীর ভিত্তিতে রচিত ও বাস্তব জীবনের উপযোগী এই জীবন বিধানই আমরা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে মানব সমাজের সামনে আজ তুলে ধরতে পারি। বর্তমান মানব সমাজ ইসলামের এ মৌলবাণী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এটা পাশ্চাত্যের আবিষ্কারক প্রাচ্য প্রতীচ্যের প্রতিভাধর ব্যক্তিদের চিন্তাপ্রসূত জীবন দর্শন নয় ।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা যে জীবন দর্শনে বিশ্বাসী, তা সকল দিক থেকেই পূর্ণাংশ। বিশ্ববাসীর কাছে ইসলামের এ বৈশিষ্ট আজও অজ্ঞাত। এর চেয়ে উত্তম বা এর সমকক্ষ কোনো জীবন বিধান পেশ করতে তারা মোটেই সক্ষম নয় ।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, বিশেষ কোনো এলাকায় ইসলাম বাস্তবে রূপায়িত না হলে এ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য কোনোদিনই উপলব্ধি করা যায় না। তাই এ ব্যবস্থার অধীনে একটি সমাজ গড়ে দুনিয়ার সামনে তার নমুনা পেশ করা আজ সব চেয়ে বড়ো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই কোনো একটি মুসলিম দেশে ইসলামী সমাজের পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরী। মূলত ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবনকারী এমন একটি দলই বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করবে।
       
এই ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবন কিভাবে সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে, এ জন্যে একটি অগ্রগামী দলকে নিজেদের গন্তব্যস্থল ঠিক করে জাহেলিয়াতের বিশ্বাসী অকূল সাগর পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চলার পথে এ দলের সৈনিকরা সর্বব্যাপী জাহেলিয়াতের ছোঁয়া থেকে নিজেদের যথাসম্ভব হেফাযত করে চলবে।

এ অগ্রগামী দলকে অবশ্যই তাদের যাত্রা শুরু করার সময় এর সঠিক স্থান, পথের দিশা, এর অলিগলি, চলার পথের সকল বিপদ-আপদ এবং দীর্ঘ ও কষ্টকর সফরের উদ্দেশ্য জেনে নিতে | হবে। শুধু তাই নয়, সারা দুনিয়ার আজ জাহেলিয়াত কোথায় কি পরিমাণ শেকড় বিস্তার করেছে তা ভালো করে জানতে হবে। চলার পথে কখন কার সাথে কি পরিমাণ সহযোগিতা করতে হবে | আবার কখন তাদের তা বন্ধ করতে হবে, ভালো করে তা জানতে হবে। কোন্ কোন্ গুণাবলী ও বৈশিষ্টে তাদের সজ্জিত হতে হবে তাও নিশ্চিত হতে হবে। পরিবেষ্টনকারী জাহেলিয়াতের কি কি বৈশিষ্ট রয়েছে, জাহেলিয়াতের ধারক বাহকদের সাথে কোন্ ভাষায় কোন ভংগীতে আলাপ করতে হবে, কোন্ কোন্ বিষয় এ আলোচ্যসূচীতে স্থানলাভ করবে এবং কিভাবে কোথা থেকে এর জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ পাওয়া যাবে এসব বিষয়েই পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে ময়দানে নামতে হবে।

মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ঈমানের শক্তির উৎস হচ্ছে কোরআনের মৌলিক শিক্ষা। যে কোরআনের শিক্ষা ও বাণী থেকে স্বর্ণ যুগে ইসলামের পতাকাবাহীদের মনে আলোর মশাল জ্বলে উঠেছিলো, তাই হবে আমাদের পাথেয়। এ পাথেয়কে সম্বল করেই অতীতে আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ব্যক্তিরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মানব ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
মূলত এ বিপ্লবের অগ্রনায়কদের উদ্দেশ্যেই আমি এ গ্রন্থ রচনা করেছি এবং এতে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থাও পেশ করার চেষ্টা করেছি।

তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন' শীর্ষক আমার লেখা তাফসীর গ্রন্থের চারটি অধ্যায়কে আলোচ্য বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল করার উদ্দেশ্যে দু'চার জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করে এ গ্রন্থের রূপ দেয়া হয়েছে ।

এই বইয়ের ভূমিকা এবং অন্যান্য অধ্যায়গুলো আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছিলাম, পবিত্র কোরআনের উপস্থাপিত জীবন দর্শন সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার সময় আমি যে সুগভীর সত্য উপলব্ধি করেছি, তাই আমি এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। আমার এ চিন্তাগুলোকে আপাত দৃষ্টিতে এলোপাতাড়ি এবং পরস্পর যোগসূত্রবিহীন মনে হতে পারে, তবে একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, আমার এ চিন্তাগুলো আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আমার এ লেখাগুলো মূলত এক ধারাবাহিক রচনার কয়েকটা কিস্তি মাত্র। ভবিষ্যতে আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে আমি এ বিষয়ে আরও কিছু লেখা প্রস্তুত করবো ।

আল্লাহ তায়ালার রহমতই এ পথে আমার প্রধান সম্বল ।
(আলোচ্য প্রবন্ধটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'মায়ালেম ফীত্ তারীক'-এর ভূমিকা। অনুবাদঃ খাদিজা আথতার রেজায়ী। রে এই গ্রন্থের জন্যেই যালেমরা তাকে ফাঁসীর কাষ্টে ঝুলিয়েছিলো )






*******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url