তাফসীরে ইবনে কাসীর - ১৪ || সূরা বাকারাহ - ৪ || ঈমান এবং গাইব বা অদৃশ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা ||







সূরা বাকারাহ আয়াত - ৩

ঈমান এবং গাইব বা অদৃশ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা


الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ  ۙ﴿۳
৩। যারা অদৃশ্য বিষয়গুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে

ঈমান কী

আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, সত্য বলে স্বীকার করাকে ঈমান বলে। ইব্‌ন আব্বাসও (রাঃ) এটাই বলেন। যুহরী (রহঃ) বলেন যে, ‘আমলকে ঈমান বলা হয়। রাবী' ইবন আনাস (রহঃ) বলেন যে, ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে ‘অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা'। (তাবারী ১/২৩৫) ইমাম ইব্‌ন জারীর (রহঃ) বলেন যে, এসব মতের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। এগুলির একই অর্থ। ভাবার্থ এই যে, তারা মুখের দ্বারা, অন্তর দ্বারা ও আমল দ্বারা অদৃশ্যের উপর ঈমান আনে এবং আল্লাহর ভয় রাখে। ‘ঈমান’ শব্দটি আল্লাহর উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর এবং তাঁর রাসূলগণের (আঃ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করা-এ কয়টির সমষ্টিকে বুঝিয়ে থাকে। আমি বলি যে, আভিধানিক অর্থে শুধু সত্য বলে স্বীকার করাকেই ঈমান বলে। কুরআন মাজীদেও এ অর্থের ব্যবহার এসেছে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেনঃ
يُؤْمِنُ بِاللهِ وَيُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِينَ
সে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, আর মু'মিনদের বিশ্বাস করে। (সূরা তাওবাহ, ৯ : ৬১) ইউসুফের (আঃ) ভাইয়েরা তাদের পিতাকে বলেছিলঃ

وَمَا أَنتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صَدِقِينَ

কিন্তু আপনি তো আমাদের বিশ্বাস করবেননা, যদিও আমরা সত্যবাদী। (সূরা ইউসুফ, ১২ : ১৭)

إلَّا الَّذِينَ ءَامَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ

কিন্তু তাদের নয়, যারা মু'মিন ও সৎ কর্মপরায়ণ। (সূরা তীন, ৯৫ : ৬)

যা হোক, ঈমানের যথেচ্ছ ব্যবহার হতে পারে বিশ্বাস, আমল এবং প্রচারের মাধ্যমে। (ইব্‌ন আবী হাতিম ১/৩৫) এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, ঈমানের হ্রাস অথবা বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এ বিষয়ে সহীহ বুখারীর প্রথম অংশে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
ইমাম শাফিঈ (রহঃ), ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (রহঃ), ইমাম আবূ উবাইদাহ (রহঃ) প্রভৃতি ইমামগণ একমত হয়ে বর্ণনা করেছেন যে, মুখে উচ্চারণ করা ও কার্যসাধন করার নাম হচ্ছে ঈমান এবং ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। বহু হাদীসে এর প্রমাণ আছে যা আমরা বুখারীর শরাহয় বর্ণনা করেছি।

কেহ কেহ ঈমানের অর্থ করেছেন ‘আল্লাহর ভয়।’ যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেনঃ
 :
إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُم بِالْغَيْبِ

নিশ্চয়ই যারা তাদের রাব্বকে না দেখেই ভয় করে। (সূরা মূলক, ৬৭ : ১২) অন্য এক জায়গায় তিনি বলেনঃ

مِّنْ خَشِيَ الرَّحْمَنَ بِالْغَيْبِ وَجَاءَ بِقَلْبٍ مُّنِيبٍ
যারা না দেখেই দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে এবং বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয়। (সূরা কাফ, ৫০ : ৩৩) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ভয়ই হচ্ছে ঈমান ও ইলমের সারাংশ । যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন :اِنَّمَا یَخْشَى اللّٰهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمٰٓؤُا  মহান আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে। (সূরা ফাতির, ৩৫ : ২৮)

গাইব বলতে কি বুঝায়

غَيْب শব্দটির অর্থ সম্বন্ধে মুফাস্সিরগণের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। কিন্তু ঐ সবগুলিই সঠিক এবং সব অর্থই নেয়া যেতে পারে। আবুল আলীয়া (রহঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উপর, মালাইকার উপর, কিতাবসমূহের উপর, কিয়ামাতের উপর, জান্নাতের উপর, জাহান্নামের উপর, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা । কাতাদাহ ইব্‌ন দিয়ামাহরও (রহঃ) ইহাই অভিমত । (তাবারী ১/২৩৬)

একদা আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদের (রাঃ) মাজলিসে সাহাবীগণের (রাঃ) গুণাবলীর আলোচনা চলছিল । তিনি বলেনঃ যাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন তাদের তো কর্তব্যই হল তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা; কিন্তু আল্লাহর শপথ! ঈমানী মর্যাদার দিক দিয়ে তারাই উত্তম যারা না দেখেই তাঁকে বিশ্বাস করে থাকেন। অতঃপর তিনি الٓمّٓۚ  ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ١ۛۖۚ فِیْهِ١ۛۚ هُدًى لِّلْمُتَّقِیْنَۙ  الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ পর্যন্ত পাঠ করলেন।’ (মুসনাদ ইবনু আবী হাতিম ১/৩৪, মুসতাদরাক হাকিম ২/২৬০) ইমাম হাকিম এই বর্ণনাটিকে সঠিক বলে থাকেন। মুসনাদ আহমাদেও এ বিষয়ের একটি হাদীস আছে। ইবনু মুহাইরীজ (রহঃ) আবূ জুমু‘আহ (রাঃ) নামক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘এমন একটি হাদীস আমাকে শুনিয়ে দিন যা আপনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শুনেছেন। তিনি বলেনঃ ‘আচ্ছা, আমি আপনাকে খুবই ভালো একটা হাদীস শুনাচ্ছি। একবার আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে নাশ্তা করছিলাম। আমাদের সাথে আবূ ‘উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ্ (রাঃ)-ও ছিলেন। তিনি বলেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ‘আমাদের চেয়েও উত্তম আর কেউ আছে কি? আমরা আপনার সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে ধর্ম যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।’ তিনি বললেনঃ ‘হ্যাঁ, আছে। ঐ সমুদয় লোক তোমাদের চেয়ে উত্তম যারা তোমাদের পরে আসবে এবং আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে অথচ তারা আমাকে দেখতেও পাবে না।’ (হাদীস সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ৪/১০৬, ১৬৯৭৬)
তাফসীর ইব্‌ন মিরদুওয়াই- এ রয়েছে সা’লিহ ইবন জুবাইর (রহঃ) বলেন : আবূ জুমু'আ আনসারী (রাঃ) বাইতুল মুকাদ্দাসে আমাদের নিকট আগমন করেন । রিযা ইব্‌ন হাইঅহ্ও (রাঃ) আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি ফিরে যেতে থাকলে আমরা তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলি। তিনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় বলেন : ‘আপনাদের এই অনুগ্রহের প্রতিদান ও হক আমার আদায় করা উচিত । শুনে রাখুন! আমি আপনাদেরকে এমন একটা হাদীস শুনাবো যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে শুনেছি।' আমরা বলি : ‘আল্লাহ আপনার উপর দয়া করুন! আমাদেরকে তা অবশ্যই বলুন'। তিনি বললেন : ‘শুনুন! আমরা দশজন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম । মুআয' ইবন জাবালও (রাঃ) ছিলেন। আমরা বললামঃ

‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের চেয়েও কি বড় সাওয়াবের অধিকারী আর কেহ হবে? আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার অনুসরণ করেছি। তিনি বললেনঃ
‘তোমরা কেন করবেনা? আল্লাহর রাসূল তো স্বয়ং তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছেন। আকাশ হতে আল্লাহর ওয়াহী তোমাদের সামনেই বার বার অবতীর্ণ হচ্ছে। ঈমান তো ঐ সব লোকের যারা তোমাদের পরে আসবে, তারা দুই জিলদের মধ্যে কিতাব পাবে এবং তার উপরেই ঈমান এনে আমল করবে। তারাই তোমাদের দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী।' (ইবন আসাকীর ৬/৩৬৮)





***************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url