তাফসীরে ইবনে কাসীর - ১৭ || সূরা বাকারা - ৭ || মুনাফিক ও নিফাক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা || মুনাফিক কারা ||






মুনাফিক ও নিফাক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

মুনাফিক কারা

সূরার প্রথম চারটি আয়াতে মুমিনদের বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর এই দু'টি আয়াতে কাফিরদের বর্ণনা দেয়া হল। এখন কপটচারী মুনাফিকদের বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে যারা বাহ্যতঃ ঈমানদাররূপে প্রকাশ পায়, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ও গোপনে গোপনে তারা কাফির। সাধারণতঃ তাদের চতুরতা গোপন থেকে যায় বলে তাদের আলোচনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে হয়েছে এবং তাদের অনেক নিদর্শনও বর্ণনা করা হয়েছে। তাদেরই সম্বন্ধে সূরা বারাআত অবতীর্ণ হয়েছে এবং সূরা নূর ইত্যাদিতে তাদের সম্বন্ধেই আলোচনা রয়েছে যাতে তাদের থেকে পূর্ণভাবে রক্ষা পাওয়া যায় এবং মুসলিমরা তাদের জঘন্য ও নিন্দনীয় স্বভাব থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। তাই মহান আল্লাহ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ

وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَ بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ مَا هُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ۘ﴿۸   یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ وَ مَا یَخۡدَعُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَهُمۡ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ ؕ﴿۹
৮। আর মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর উপর এবং শেষ দিনের উপর ঈমান এনেছি, অথচ তারা মোটেই ঈমানদার নয় ।  ৯। তারা আল্লাহ ও মু'মিনদের সঙ্গে ধোকাবাজী করে। প্রকৃত পক্ষে তারা নিজেদের ব্যতীত আর কারও সাথে ধোঁকাবাজী করেনা, অথচ তারা এ সম্বন্ধে অনুভব করতে পারেনা।

নিফাক কী

'নিফাক' এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ভাল গুণগুলির প্রকাশ ও মন্দ গোপন করা। 'নিফাক' দু' প্রকার : (১) বিশ্বাস জনিত ও (২) কাজ জনিত। প্রথম প্রকারের মুনাফিক তো চির জাহান্নামী এবং দ্বিতীয় প্রকারের মুনাফিক জঘন্যতম পাপী। ইনশাআল্লাহ সঠিক স্থানে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হবে ।
ইবন যুরাইয (রহঃ) বলেন যে, মুনাফিকের কথা তার কাজের উল্টা, তার গোপনীয়তা তার প্রকাশ্যের বিপরীত। তার আগমন তার প্রস্থানের উল্টা এবং উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিপরীত হয়ে থাকে। (তাবারী ১/২৭০)

মুনাফিকীর গোড়াপত্তন

নিফাক ও কপটতা মাক্কায় তো ছিলইনা, বরং সেখানে ছিল তার বিপরীত। কিছু লোক এমন ছিলেন যাঁরা বাহ্যতঃ ও আপাতঃ দৃষ্টিতে কাফিরদের সঙ্গে থাকতেন, কিন্তু অন্তরে ছিলেন মুসলিম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা ছেড়ে মাদীনায় হিজরাত করেন তখন ওখানকার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় আনসার উপাধি লাভ করে তাঁর সঙ্গী হলেন ও অন্ধকার যুগের মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে মুসলিম হলেন। কিন্তু ইয়াহুদীরা তখনও যেই তিমিরের সেই তিমিরেই থেকে মহান আল্লাহর এ দান হতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকল। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহ ইবন সালাম এই সত্য ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন পর্যন্ত মুনাফিকদের জঘন্যতম দল সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব ইয়াহুদী ও আরবের অন্যান্য কতকগুলি গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই দল সৃষ্টির সূচনা এভাবে হয় যে, মাদীনায় ইয়াহুদীদের ছিল তিনটি গোত্র ও (১) বানু কাইনুকা, (২) বানু নাযীর এবং (৩) বানু কুরাইযাহ। বানু কাইনুকা ছিল খাযরাজের মিত্র এবং বাকী দু'টি গোত্র ছিল আউসের মিত্র। অল্প কিছু ইয়াহুদী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে মদীনায় কোন মুনাফিকের উপস্থিতি ছিলনা। কারণ তখন মুসলিমগণ এতখানি শক্তিশালী ছিলনা যে, কাফিরদের মনে কোন ভয়- ভীতি সৃষ্টি হতে পারে। বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তা'আলা যখন ইসলাম ও এর অনুসারীদের বিজয় দান করেন তখন মদীনার এক নেতা ছিল আবদুল্লাহ ই উবাই ইবন সালুল।
আবদুল্লাহ ইব্‌ন উবাই ইবন সালুল খাযরাজ গোত্রের লোক হলেও আউস ও খাযরাজ উভয় দলের লোকই তাকে খুব সম্মান করত। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বাদশাহ বলে ঘোষণা দেয়ার পূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে এই গোত্রের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল। ফলে তার বাদশাহ হওয়ার আশায় গুড়ে বালি পড়ল। এই দুঃখ, পরিতাপতো তার অন্তরে ছিলই, এদিকে ইসলামের অপ্রত্যাশিত ক্রমোন্নতি, আর ওদিকে যুদ্ধের উপর্যুপরি বিজয় দুন্দুভি তাকে একেবারে পাগল প্রায় করে তুললো। এখন সে চিন্তা করল যে, এমনিতে কাজ হবেনা। অতএব সে ঝট করে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে নিল এবং অন্তরে কাফির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। দলের যে কিছু লোক তার অধীনে ছিল তাদেরকেও সে এই গোপন পন্থা বাতলে দিল এবং এভাবেই মদীনা ও তার আশে পাশে কপটাচারীদের একটি দল রাতারাতি কায়েম হয়ে গেল। আল্লাহর ফযলে এই কপটদের মধ্যে মক্কার মুহাজিরদের একজনও ছিলেননা। আর থাকবেনই বা কেন? এই সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তো নিজেদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধন-সম্পদ সবকিছু আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এসেছিলেন! আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।

২:৮ নং আয়াতের তাফসীর

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (রহঃ) ইন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, এই কপটচারীরা আউস ও খাযরাজ গোত্রভুক্ত ছিল এবং কতক ইয়াহুদীও তাদের দলে ছিল। এই আয়াতে আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের কপটতার বর্ণনা রয়েছে। (তাবারী ১/২৬৯) আবুল আলীয়া (রহঃ) হাসান বাসরী (রহঃ), কাতাদাহ (রহঃ) এবং সুন্দী (রহঃ) এটাই বর্ণনা করেছেন। বিশ্বপ্রভু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা এখানে কপটাচারীদের অনেকগুলো বদ অভ্যাসের বর্ণনা দিয়েছেন, যেন মুসলিমেরা তাদের বাহ্যিক অবস্থা দেখে প্রতারিত না হয় এবং তাদেরকে মুসলিম মনে করে অসতর্ক না থাকে, নচেৎ একটা বিরাট হাঙ্গামা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, অসৎকে সৎ মনে করার পরিণাম খুবই খারাপ ও ভয়াবহ। যেমন এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, এরা মুখে তো অবশ্যই স্বীকার করছে, কিন্তু অন্তরে ঈমান নেই। এভাবেই সূরা মুনাফিকূনেও বলা হয়েছেঃ

إذَا جَاءَكَ الْمُتَنفِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لرَسُوله
মুনাফিকরা যখন তোমার নিকট আসে তখন তারা বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। আর আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসুল। (সূরা মুনাফিকূন, ৬৩ : ১) কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকদের কথা তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলনা বলেই তাদের জোরদার সাক্ষ্য দান সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করলেন। যেমন তিনি বলেনঃ

وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنفِقِينَ لَكَذِبُونَ

আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। (সূরা মুনাফিকূন, ৬৩ : ১) তিনি আরও বললেন وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِیْنَ তারা ঈমানদার নয়। তারা ঈমানকে প্রকাশ করে ও কুফরীকে গোপন রেখে নিজেদের বোকামী দ্বারা আল্লাহকে ধোকা নিচ্ছে এবং মনে করছে যে, এটা তাদেরকে আল্লাহর কাছে উপকার ও সুযোগ সুবিধা দিবে এবং কতকগুলি মু'মিন তাদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হবে। কুরআন মাজীদের অন্য স্থানে আছেঃ

يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللهُ جَمِيعًا فَيَحْلِفُونَ لَهُ كَمَا يَحْلِفُونَ لَكُمْ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْعَلَى شَيْءٍ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْكَاذِبُونَ
যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, তখন তারা তাঁর (আল্লাহর) নিকট সেরূপ শপথ করবে যেরূপ শপথ তোমাদের নিকট করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা উপকৃত হবে। সাবধান! তারাই তো মিথ্যাবাদী। (সুরা মুজাদালাহ, ৫৮ : ১৮) এখানেও তাদের ভুল বিশ্বাসের পক্ষে তিনি বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কাজের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে অবহিতই নয়। এ ধোকা তো তারা নিজেদেরকেই দিচ্ছে। যেমন কুরআনের অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ

إِنَّ الْمُنفِقِينَ خَدِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَدِعُهُمْ

নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে এবং তিনিও তাদেরকে ঐ প্রতারণা প্রত্যাপর্ণ করছেন। (সূরা নিসা, ৪: ১৪২) অর্থাৎ ফলাফল দান করেন।
ইবন মুরাই (রহঃ) এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেন যে, 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' কালেমা মুখে প্রকাশ করে তারা জীবনের নিরাপত্তা কামনা করে। এই কালেমাটি তাদের অন্তরে স্থান পায়না। (ইবন আবী হাতিম ১/৪৬) কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, মুনাফিকদের অবস্থা এই-ই তাদের মুখ পৃথক, অন্তর পৃথক, কাজ পৃথক, বিশ্বাস পৃথক, সকাল পৃথক, সন্ধ্যা পৃথক, তারা নৌকার মত যা বাতাসে কখনও এদিকে ঘুরে কখনও ওদিকে ঘুরে। (ইব্‌ন আবী হাতিম ১/৪৭) 





**********************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url