তাফসীরে ইবনে কাসীর-৫ || সুরা ফাতিহা - ৫ || ‘রাব্ব’ শব্দের অর্থ || ‘আল-হাম্দ' শব্দের ফাযীলাত || ‘আলামীন' শব্দের অর্থ





সুরা ফাতিহার তাফসীর- ৫ম পর্ব


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّالْعَلَمِينَ

পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
১। আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি বিশ্বজগতের রাব্ব


حمْد শব্দের অর্থ

ইমাম ইবন জারীর (রহঃ) বলেন যে, الْحَمْدُ لِلَّهِ এর অর্থ এই যে, কৃতজ্ঞতা শুধু আল্লাহর জন্য, তিনি ছাড়া আর কেহ এর যোগ্য নয়, তা সে সৃষ্ট জীবের মধ্যে যে কেহ হোক না কেন। কেননা সমুদয় দান যা আমরা গণনা করতে পারিনা এবং তার মালিক ছাড়া কারও সেই সংখ্যা জানা নেই, সবই তাঁর কাছ থেকেই আগত। তিনিই তাঁর আনুগত্যের সমুদয় মালমসলা আমাদেরকে দান করেছেন। আমরা যেন তাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে পারি সেজন্য তিনি আমাদেরকে শারীরিক সমুদয় নি'আমাত দান করেছেন। অতঃপর ইহলৌকিক অসংখ্য নি'আমাত এবং জীবনের সমস্ত প্রয়োজন আমাদের অধিকার ছাড়াই তিনি আমাদের নিকট না চাইতেই পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সদা বিরাজমান অনুকম্পা এবং তাঁর প্রস্তুতকৃত পবিত্র সুখের স্থান, সেই অবিনশ্বর জান্নাত আমরা কিভাবে লাভ করতে পারি তাও তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন। সুতরাং আমরা এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এসবের যিনি মালিক, প্রথম ও শেষ সমুদয় কৃতজ্ঞতা একমাত্র তাঁরই ন্যায্য প্রাপ্য। (তাবারী ১/১৩৫) এটা একটি প্রশংসামূলক বাক্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা নিজের প্রশংসা নিজেই করেছেন এবং ঐ প্রসঙ্গেই তিনি যেন বলে দিলেনঃ তোমরা বল is taji অর্থাৎ 'সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।' কেহ কেহ বলেন যে, 'আলহামদু লিল্লাহ' বলে আল্লাহ তা'আলার পবিত্র নাম ও বড় বড় গুণাবলীর দ্বারা তাঁর প্রশংসা করা হয়। (তাবারী ১/১৩৭)

‘হাম্দ' ও ‘শোকর’ এর মধ্যে পার্থক্য


আরাবী ভাষায় যাঁরা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন তাঁরা এ বিষয়ে এক মত যে, شكر এর স্থলে حمْد ও حمْد এর স্থলে شكر ব্যবহৃত হয়ে থাকে । ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক কৃতজ্ঞের কৃতজ্ঞতা প্রকাশক কথা হল- الْحَمْدُ لله

‘হাম্দ' শব্দের তাফসীর ও সালাফগণের অভিমত

‘উমার (রাঃ) একবার বলেছিলেনঃ سُبْحَانَ اللهِ  ও لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ  এবং কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, اَللهُ أَكْبَرْ - কে আমরা জানি, কিন্তু اَلْحَمْدُ لِلّٰه - এর ভাবার্থ কি? ‘আলী (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা এ কথাটিকে নিজের জন্য পছন্দ করেছেন। (তাফসীর তাবারী ১/১৫। অত্র হাদীসের সনদে হাজ্জাজ ইবনু আরতাত সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেন যে, তিনি সত্যবাদী, তবে খুব বেশি ভুল করতেন এবং তাদলীস করে বর্ণনা করতেন। উসতায কে বাদ দিয়ে উসতাযের উসতায বা উর্দ্ধতন কারো থেকে বর্ণনা করাকে তাদলীস বলে) কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, এটা বললে মহান আল্লাহকে খুবই ভালো লাগে।’ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশক বাক্য। এর উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। (তাফসীর তাবারী ১/১৩)


‘আল-হাম্দ' এর ফাযীলাত


আসওয়াদ ইব্‌ন সারী' (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আরয করেন : 'আমি মহান আল্লাহর প্রশংসামূলক কয়েকটি কবিতা রচনা করেছি। অনুমতি পেলে শুনিয়ে দিব।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'আল্লাহ তা'আলা নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন।' (আহমাদ ৩/৪৩৫, নাসাঈ ৪/৪১৬) মুসনাদ আহমাদ, সুনান নাসাঈ, জামে'উত তিরমিযী এবং সুনান ইবন মাজাহয় যাবির ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

'সর্বোত্তম যিকর হচ্ছে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' এবং সর্বোত্তম প্রার্থনা হচ্ছে 'আলহামদুলিল্লাহ।' (তিরমিযী ৯/৩২৪, নাসাঈ ৬/২০৮, ইব্‌ন মাজাহ ২/১২৪৯) ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এ হাদীসটিকে পরিভাষা অনুযায়ী 'হাসান গারীব বলেছেন। সুনান ইব্‌ন মাজাহ্য় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

'আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কিছু দান করার পর যদি সে তার জন্য 'আলহামদুলিল্লাহ' পাঠ করে তাহলে তার প্রদত্ত বস্তুই গৃহিত বস্তু হতে উত্তম হবে।' (ইবন মাজাহ ২/১২৫০)

সুনান ইব্‌ন মাজাহয় ইবন উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ একদা এক ব্যক্তি এই দু'আ পাঠ করলঃ

يَا رَبِّ لَكَ الْحَمْدُ كَمَا يَنْبَغِي لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَعَظِيْمِ.

হে আমার রাব্ব! তোমার বিশাল ক্ষমতা এবং মহান সত্ত্বার মর্যাদানুসারে তোমার জন্যই সমস্ত প্রশংসা ।


এতে মালাইকা সাওয়াব লিখার ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন । অবশেষে তাঁরা আল্লাহ সুবহানুর নিকট আরয করলেন : আপনার এক বান্দা এমন একটি কালেমা পাঠ করেছে যার সাওয়াব আমরা কি লিখব বুঝতে পারছিনা।' বিশ্বপ্রভু সব কিছু জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলেন : 'সে কী কথা বলেছে?' তাঁরা বললেন যে, সে এই কালেমা বলেছে। তখন আল্লাহ তা'আলা বললেন : 'সে যা বলেছে তোমরা হুবহু তাই লিখে নাও। আমি তার সাথে সাক্ষাতের সময়ে নিজেই তার যোগ্য প্রতিদান দিব।' (ইব্‌ন মাজাহ ২/১২৪৯)

‘হাম্দ' শব্দের পূর্বে 'আল' শব্দ প্রয়োগের গুরুত্ব

'আল হামদু’র আলিফ লাম ‘ইসতিগরাকের’ জন্য ব্যবহৃত অর্থাৎ সমস্ত প্রকারের ‘হামদ' বা স্তুতিবাদ একমাত্র আল্লাহর জন্যই সাব্যস্ত। যেমন হাদীসে রয়েছেঃ

اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ وَ لَكَ الْمُلْكُ كُلُّهُ ۚ وَ بَيَدِكَ الْخَيْرُ كُلُّهُ وَإِلَيْكَ يُرْجَعُ الْأَمْرُ كُلُّهُ.

'হে আল্লাহ! সমুদয় প্রশংসা তোমারই জন্য, সারা দেশ তোমারই, তোমারই হাতে সামগ্রিক মঙ্গল নিহিত রয়েছে এবং সমস্ত কিছু তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে থাকে।' (আত তাগরীব ওয়াত তাহরীব ২/২৫৩)

‘রাব্ব’ শব্দের অর্থ


সর্বময় কর্তাকে 'রাব্ব' বলা হয় এবং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নেতা এবং সঠিকভাবে সজ্জিত ও সংশোধনকারী। এসব অর্থ হিসাবে আল্লাহ তা'আলার জন্য এ পবিত্র নামটিই শোভনীয় হয়েছে। 'রাব্ব' শব্দটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য
ব্যবহৃত হতে পারেনা। তবে সম্বন্ধ পদ রূপে ব্যবহৃত হলে সে অন্য কথা। যেমন رَبُّ الدَّارِ  বা গৃহস্বামী ইত্যাদি। বলা হয়েছে যে, রাব্ব হল আল্লাহর মহান নামসমূহের অন্যতম নাম ।

‘আলামীন' শব্দের অর্থ

عَالَمِيْنَ  শব্দটি عَالَمٌ  শব্দের বহু বচন। মহান আল্লাহ ছাড়া সমুদয় সৃষ্টবস্তুকে عَالَم  বলা হয়। عَالَم  শব্দটিও বহুবচন এবং এ শব্দের এক বচনই হয় না। আকাশের সৃষ্টজীব এবং পানি ও স্থলের সৃষ্টজীবকেও عَوَالِم  অর্থাৎ কয়েকটি عَالَم  বলা হয়। অনুরূপভাবে এক একটি যুগ-কাল ও এক একটি সময়কেও عَالَم  বলা হয়।
ফার্রা (রহঃ) ও আবূ উবাইদার (রহঃ) মতে প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন প্রাণীকে 'আলাম বলা হয়। দানব, মানব ও শাইতানকে ‘আলাম’ বলা হবে। জন্তুকে ‘আলাম’ বলা হবেনা। যায়িদ ইবন আসলাম (রহঃ) এবং আবূ মুহাইসীন (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক প্রাণীকেই 'আলাম বলা হয়। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক শ্ৰেণীকে একটা ‘আলাম’ বলা হয়।

জায্যায (রহঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা ইহজগত ও পরজগতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সবই 'আলাম। কুরতুবী (রহঃ) বলেন যে, এ মতটিই সত্য। কেননা এর মধ্যে সমস্ত 'আলামাই জড়িত রয়েছে। যেমন-

قالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُم مُوقِنِينَ

ফির'আউন বলল : জগতসমূহের রাব্ব আবার কি? মূসা বলল : তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রাব্ব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। (সূরা শু'আরা, ২৬ : ২৩-২৪)

সৃষ্টবস্তুকে ‘আলাম' বলার কারণ

عَلم  শব্দটি عَلَامَت  শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। কেননা ‘আলাম’ সৃষ্ট বস্তু তার সৃষ্টিকারীর অস্তিত্বের পরিচয় বহন করে এবং তাঁর একাত্মবাদের চি‎হ্নরূপে কাজ করে থাকে। (তাফসীর কুরতুরী ১/১৩৯)


٢. الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
২। যিনি পরম দয়ালু, অতিশয় করুণাময়।

এর তাফসীর পূর্বেই করা হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির আর কোন প্রয়োজন নেই। কুরতুবী (রহঃ) বলেন যে, মহান আল্লাহ رَبِّ الْعَلَمِيْنَ এর বিশেষণের পর কোন না কে الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ নামক বিশেষণটি ভয় প্রদর্শনের পর আশা ভরসার উদ্রেক কল্পে আনয়ন করেছেন যেমন তিনি অন্যত্র বলেনঃ

نِي عِبَادِي أَنِي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ. وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ

আমার বান্দাদেরকে বলে দাও : নিশ্চয়ই আমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর আমার শান্তি; তা অতি মর্মন্তদ শাস্তি। (সূরা হিজর, ১৫ : ৪৯-৫০) (কুরতুবী ১/১৩৯) আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

إِنَّ رَبِّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ.

নিঃসন্দেহে তোমার রাব্ব ত্বরিত শান্তিদাতা, আর নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল ও কৃপানিধান। (সূরা আন'আম, ৬ : ১৬৫)

'রাব্ব' শব্দটির মধ্যে ভয় প্রদর্শন রয়েছে এবং 'রাহমান' ও 'রাহীম' শব্দ দু'টির মধ্যে আশা ভরসা রয়েছে। সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
'যদি ঈমানদারগণ আল্লাহর ক্রোধ এবং তাঁর ভীষণ শান্তি সম্পর্কে পূর্ণভাবে অবহিত হত তাহলে তাদের অন্তর হতে জান্নাতের নন্দন কাননের লোভ লালসা সরে যেত এবং কাফিরেরা যদি আল্লাহ তা'আলার দান ও দয়া দাক্ষিণ্য সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখত তাহলে তারা কখনও নিরাশ ও হতাশাগ্রস্ত হতনা।' (মুসলিম ৪/২১০৯)



***********************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url