তাফসীরে ইবনে কাসীর - ৭ || সুরা ফাতিহা-৭ || ‘ইবাদাত' শব্দের ধর্মীয় তত্ত্ব || সূরা ফাতিহা আল্লাহর প্রশংসা শিক্ষা দেয় ||







إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
৪। আমরা আপনারই ইবাদাত করছি এবং আপনারই নিকট সাহায্য চাচ্ছি।

‘ইবাদাত' শব্দের ধর্মীয় তত্ত্ব


'ইবাদাত' শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সার্বিক অপমান ও নীচতা। যেমন 'তারীকে মোয়াবাদ' সাধারণ ঐ পথকে বলে যা সবচেয়ে হীন ও নিকৃষ্ট হয়ে থাকে। এ রকমই بَعِيْرٌ مُعَبَّدٌ ঐ উটকে বলা হয় যা হীনতা ও দুর্বলতার চরম সীমায় পদার্পণ করে। শারীয়াতের পরিভাষায় প্রেম, বিনয়, নম্রতা এবং ভীতির সমষ্টির নাম 'ইবাদাত'।

আল্লাহর উপর নির্ভর করার উপকারিতা


চতুর্থ আয়াতটির অর্থ এ দাঁড়ায় : 'আমরা আপনার ছাড়া আর কারও ইবাদাত করিনা এবং আপনার ছাড়া আর কারও উপর নির্ভর করিনা।' আর এটাই হচ্ছে পূর্ণ আনুগত্য ও বিশ্বাস। সালাফে সালেহীন বা পূর্বযুগীয় প্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধ বিজ্ঞজনদের কেহ কেহ এ মত পোষণ করেন যে, সম্পূর্ণ কুরআনের গোপন তথ্য রয়েছে সূরা ফাতিহার মধ্যে এবং এ পূর্ণ সূরাটির গোপন তথ্য

اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ এই আয়াতটিতে রয়েছে।

আয়াতটির প্রথমাংশে রয়েছে শিরকের প্রতি অসন্তুষ্টি এবং দ্বিতীয়াংশে রয়েছে স্বীয় ক্ষমতার উপর অনাস্থা ও মহাশক্তিশালী আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা। এ সম্পর্কীয় আরও বহু আয়াত পবিত্র কুরআনে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন তিনি বলেনঃ

فَاعْبُدْهُ وَ تَوَكَّلْ عَلَیْهِ١ؕ وَ مَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ

সুতরাং তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর উপর নির্ভর কর, আর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তোমার রাব্ব অনবহিত নন। (সূরা হুদ, ১১ : ১২৩) তিনি আরও বলেনঃ

قُلْ هُوَ الرَّحْمٰنُ اٰمَنَّا بِهٖ وَ عَلَیْهِ تَوَكَّلْنَا

বল: তিনি দয়াময়, আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি ও তাঁরই উপর নির্ভর করি। (সূরা মূলক, ৬৭ : ২৯) আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেনঃ

رَبُّ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِیْلًا

তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের অধিকর্তা, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই; অতএব তাঁকেই কর্ম-বিধায়ক রূপে গ্রহণ কর। (সূরা মুয্যাম্মিল, ৭৩ : ৯)


اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ - এই আয়াতেও এই বিষয়টিই রয়েছে। পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে সম্মুখস্ত কেহকে লক্ষ্য করে সম্বোধন ছিলনা। কিন্তু এ আয়াতটিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলাকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং এতে বেশ সুন্দর পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে। কেননা বান্দা যখন আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করল তখন সে যেন মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর সম্মুখে হাযির হয়ে গেল। এখন সে মালিককে সম্বোধন করে স্বীয় দীনতা, হীনতা ও দারিদ্রতা প্রকাশ করল এবং বলতে লাগল : 'হে আল্লাহ! আমরা তো আপনার হীন ও দুর্বল দাস মাত্র এবং আমরা সব কাজে, সর্বাবস্থায় ও সাধনায় একমাত্র আপনারই মুখাপেক্ষী। এ আয়াতে এ কথারও প্রমাণ রয়েছে যে, এর পূর্ববর্তী সমস্ত বাক্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ খবর দেয়া হয়েছিল।

সূরা ফাতিহা আল্লাহর প্রশংসা শিক্ষা দেয়


আল্লাহ তা'আলা স্বীয় উত্তম গুণাবলীর জন্য নিজের প্রশংসা নিজেই করেছিলেন এবং বান্দাদেরকে ঐ শব্দগুলি দিয়েই তাঁর প্রশংসা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এজন্যই যে ব্যক্তি এ সূরাটি জানা সত্ত্বেও সালাতে তা পাঠ করেনা তার সালাত হয়না। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে উবাদাহ ইব্‌ন সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
'ঐ ব্যক্তির সালাতকে সালাত বলা যায়না যে সালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করেনা। (ফাতহুল বারী ২/২৭৬, মুসলিম ১/২৯৫) সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, আল্লাহ বলেছেন: আমি সালাতকে আমার মধ্যে ও আমার বান্দার মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছি। অর্ধেক অংশ আমার ও বাকী অর্ধেক অংশ আমার বান্দার। বান্দা যা চাবে তাকে তাই দেয়া হবে।

অতএব বান্দা যখন  اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ  বলে, তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করলো।’ বান্দা যখন বলে  الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ তখন তিনি বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার গুণগান করলো।’ যখন সে বলে  مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ  তখন তিনি বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করলো।’ সে যখন বলে  اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘এটা আমার এবং আমার বান্দার মধ্যকার কথা এবং আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে যা সে চাবে।’ তারপর বান্দা যখন  اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَۙ۝ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ١ۙ۬ۦ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ  পাঠ করে তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘এ সবই তো আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা যা চাবে তার জন্য তাই রয়েছে।’ (সহীহ মুসলিম ১/২৯৭)

তাওহীদ আল উলুহিয়া


ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, اِیَّاكَ نَعْبُدُ এর অর্থ হচ্ছে: 'হে আমার রাব্ব! আমরা বিশেষভাবে একাত্মবাদে বিশ্বাসী, আমরা ভয় করি এবং মহান সত্ত্বায় সকল সময়ে আশা রাখি। আপনি ছাড়া আর কারও আমরা ইবাদাতও করিনা, কেহকে ভয়ও করিনা এবং কারও উপর আশাও রাখিনা।' আর وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ এর তাৎপর্য ও ভাবার্থ হচ্ছে : 'আমরা আপনার পূর্ণ আনুগত্য বরণ করি ও আমাদের সকল কাজে একমাত্র আপনারই কাছে সহায়তা প্রার্থনা করি।

তাওহীদ আর রুবুবিয়াহ


কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : 'এর ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, 'তোমরা একমাত্র তাঁরই উপাসনা কর এবং তোমাদের সকল কাজে তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। اِیَّاكَ نَعْبُدُ পূর্বে আনার কারণ এই যে, ইবাদাতই হচ্ছে মূল ঈস্পিত বিষয়, আর সাহায্য চাওয়া ইবাদাতেরই মাধ্যম ও ব্যবস্থা। আর সাধারণ নিয়ম হচ্ছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পূর্বে বর্ণনা করা এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পরে বর্ণনা করা। আল্লাহ তা'আলাই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন ।

আল্লাহ তাঁর নাবীকে বলেছেন ‘দাস’


যেখানে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বড় বড় দানের কথা উল্লেখ করেছেন সেখানেই শুধু তিনি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম عَبْد বা দাস নিয়েছেন। বড় বড় নি'আমাত যেমন কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করা, সালাতে দাঁড়ানো, মিরাজ করানো ইত্যাদি। যেমন তিনি বলেনঃ
 
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ عَلٰى عَبْدِهِ الْكِتٰبَ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর দাসের প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। (সূরা কাহফ, ১৮৪১) আরও বলেনঃ 

وَّ اَنَّهٗ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللّٰهِ یَدْعُوْهُ

আর এই যে, যখন আল্লাহর বান্দা তাঁকে ডাকার জন্য দন্ডায়মান হল। (সূরা জিন, ৭২ : ১৯) অন্যত্র বলেনঃ

سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَیْلًا

পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন। (সূরা ইসরাহ, ১৭ : ১)

বিপদাপদে আল্লাহর কাছে সাজদাবনত হতে হবে


আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে এ শিক্ষা দিয়েছেনঃ 'হে নাবী! বিরুদ্ধবাদীদের অবিশ্বাসের ফলে যখন তোমার মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে তখন তুমি আমার ইবাদাতে লিপ্ত হয়ে যাও।' তাই নির্দেশ হচ্ছেঃ

وَلَقَدْ نَعْلَمُ اَنَّكَ یَضِیْقُ صَدْرُكَ بِمَا یَقُوْلُوْنَۙ۝۹۷ فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ كُنْ مِّنَ السّٰجِدِیْنَۙ۝۹۸ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى یَاْتِیَكَ الْیَقِیْنُ

আমি তো জানি যে, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং তুমি তোমার রবের প্রশংসা দ্বারা তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং সাজদাহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত কর। (সূরা হিজর, ১৫ : ৯৭-৯৯)






****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url