তাফসীরে ইবনে কাসীর - ১৫ || সূরা বাকারা - ৫ || সালাত, ইকামাতে সালাত ও ঈমানদারদের বিষয়ে আলোচনা || ঈমানদারদের বর্ণনা ||





সূরা বাকারাহ আয়াত - ৩

সালাত, ইকামাতে সালাত ও ঈমানদারদের বিষয়ে আলোচনা

 وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ﴿۳
এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত করে ও আমি তাদেরকে যে উপজীবিকা তা থেকে দান করে থাকে।

ইকামাতে সালাত এর অর্থ

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন : ‘তারা ফার সালাত আদায় করে, রুকূ সাজদাহ, তিলাওয়াত, নম্রতা এবং মনযোগ প্রতিষ্ঠিত করে।' (তাবারী ১/২৪১) কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, সালাত প্রতিষ্ঠিত করার অর্থ হচ্ছে সালাতের সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা, ভালভাবে উযূ করা এবং রুকূ' ও সাজদাহ যথাযথভাবে আদায় করা। (ইবন আবী হাতিম ১/৩৭) মুকাতিল (রহঃ) বলেন যে, সময়ের হিফাযাত করা, পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করা, ‘রুকূ ও সাজদাহ ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা, ভালভাবে কুরআন পাঠ করা, আত্তাহিয়্যাতু এবং দুরূদ পাঠ করার নাম হচ্ছে ইকামাতে সালাত । (ইবন আবী হাতিম ১/৩৭)

কোথায় ব্যয় করতে হবে

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ  এর অর্থ হচ্ছে যাকাত আদায় করা। (তাফসীর তাবারী ১/২৪৩) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং আরো কয়েকজন সাহাবী বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে মানব কর্তৃক তার সন্তান সন্ততিকে পানাহার করানো। এটা যাকাতের হুকুমের পূর্বেকার আয়াত। যাহ্হাক (রহঃ) বলেন যে, সূরাহ্ বারা’আতে যাকাতের যে সাতটি আয়াত আছে তা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে এই নির্দেশ ছিলো যে, বান্দা যেন নিজ সাধ্যানুসারে কমবেশি কিছু দান করতে থাকে। কাতাদাহ (রহঃ) বলেনঃ ‘এই মাল তোমাদের নিকট মহান আল্লাহর আমানত, অতি সত্বরই এটা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে। সুতরাং ইহলৌকিক জীবনে তা থেকে মহান আল্লাহর পথে ব্যয় করো।’

কুরআনুল হাকীমের অধিকাংশ জায়গায় সালাত ও মাল খরচ করার বর্ণনা মিলিতভাবে এসেছে। এ জন্য সালাত হচ্ছে আল্লাহর হক এবং তাঁর ইবাদাত, যা তাঁর একাত্মবাদ, প্রশংসা, শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন, তাঁর উপর ভরসা এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করার নাম। আর খরচ করা হচ্ছে সৃষ্ট জীবের প্রতি অনুগ্রহ করা, যার দ্বারা তাদের উপকার হয়। এর সবচেয়ে বেশি হকদার হচ্ছে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন এবং দাসদাসী। অতঃপর দূরের লোক এবং অপরিচিত ব্যক্তিরা তার হকদার। সুতরাং অবশ্য করণীয় সমস্ত ব্যয় ও ফার যাকাত এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ইব্‌ন উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। (১) আল্লাহ তা'আলার একাত্মবাদ ও নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেরিতত্ত্বের সাক্ষ্য প্রদান। (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা। (৩) যাকাত প্রদান করা। (৪) রামাযানে সিয়াম পালন করা এবং (৫) বাইতুল্লাহর হাজ্জ সম্পাদন করা। (ফাতহুল বারী ১/৬৪, মুসলিম ১/৪৫) এ সম্পর্কে আরও বহু হাদীস রয়েছে।

সালাত কী

আরাবী ভাষায় সালাতের অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা। আরাব কবিদের কবিতা এর সাক্ষ্য দেয়। সালাতের প্রয়োগ হয়েছে সালাতের উপর যা রুকূ সাজদাহ এবং অন্যান্য নির্দিষ্ট কতকগুলি কাজের নাম এবং যা নির্দিষ্ট সময়ে কতকগুলি নির্দিষ্ট শর্ত, সিফাত ও পদ্ধতির মাধ্যমে পালিত হয়।

وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴
৪। এবং তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখিরাতের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে
ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে : 'তুমি তোমার রাব্ব আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে যা কিছু প্রাপ্ত হয়েছ এবং তোমার পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু প্রাপ্ত হয়েছিল তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। এ নয় যে, কোনটা মানে ও কোনটা মানেনা, বরং রবের সমস্ত কথাই বিশ্বাস করে এবং পরকালের উপরও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।” (তাবারী ১/২৪৪) অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামাত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মীযান ইত্যাদি সমস্তই পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে। (ইবন আবী হাতিম ১/৩৯) কিয়ামাত দুনিয়া ধ্বংসের পরে হবে বলে তাকে আখিরাত বলা হয়েছে।

ঈমানদারদের বর্ণনা

এখানে ঐ সমস্ত লোকদের কথা বলা হয়েছে যাদের পূর্ণ বর্ণনা পরবর্তী আয়াতে রয়েছেঃ (সূরা বাকারাহ, ২৪৩) ঈমানদার আরাবেরই হোক অথবা আহলে কিতাব হোক কিংবা অন্য যে কোন ধরণের লোক হোক। মুজাহিদ (রহঃ), আবুল আলীয়া (রহঃ), রাবী ইবন আনাস (রহঃ) এবং কাতাদাহর (রহঃ) এটাই মত।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেনঃ 'সূরা বাকারাহর প্রথম চারটি আয়াতে মু'মিনদের আলোচনা রয়েছে, এবং তার পরবর্তী তেরটি আয়াতে মুনাফিকদের সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।' (তাবারী ১/২৩৯) সুতরাং এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু'মিনের জন্য সাধারণ বা সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরাবী হোক, আযমী হোক, কিতাবী হোক, মানবের মধ্যে হোক বা দানবের মধ্যেই হোক না কেন। কারণ এর মধ্যে প্রত্যেকটি গুণ অন্যের ক্ষেত্রেই একেবারে ফকরী শর্ত। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা হতেই পারেনা। অদৃশ্যের উপর ঈমান আনা, সালাত প্রতিষ্ঠা করা এবং যাকাত দেয়া শুদ্ধ নয়, যে পর্যন্ত না রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং পূর্ববর্তী নাবীগণের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল তার উপর ঈমান আনবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরকালের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে। যেমন প্রথম তিনটি পরবর্তী তিনটি ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। ভদ্রূপ পরবর্তী তিনটিও পূর্ববর্তী তিনটি ছাড়া পরিশুদ্ধ হয়না। এ জন্য ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার নির্দেশ হচ্ছেঃ

يناها الَّذِينَ ءَامَنُواْ وَامِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَبِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَبِ الَّذِي أَنزَلَ مِن قَبْلُ

হে মু'মিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং এই কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। (সূরা নিসা, ৪:১৩৬) অন্যত্র আল্লাহ
তা'আলা বলেনঃ
ولَا تُجَدِلُوا أَهْلَ الْكِتَبِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ وَقُولُوا وَامَنَّا بِالَّذِي أُنزِلَ إِلَيْنَا وَأُنزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ

তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিভাবীদের সাথে বিতর্ক করবেনা, তবে তাদের সাথে করতে পার যারা তাদের মধ্যে সীমা লংঘনকারী এবং বল : আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের মা'বূদ ও তোমাদের মা'বূদ তো একই। (সূরা আনকাবৃত, ২৯ : ৪৬) পবিত্র কুরআনের আর এক স্থানে ঘোষিত হয়েছেঃ

يَتَأَيُّهَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ وَامِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُم

হে গ্রন্থপ্রাপ্তরা। তোমাদের সঙ্গে যা আছে তার সত্যতা প্রতিপাদনকারী যা অবতীর্ণ করেছি তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। (সূরা নিসা, ৪ : ৪৭) অন্য জায়গায় আছেঃ

قُلْ يَنأَهْلَ الْكِتَبِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَنَةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَاأُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ
বলঃ হে আহলে কিতাব! তোমরা কোনো পথেই প্রতিষ্ঠিত নও যে পর্যন্ত না তাওরাত, ইঞ্জীল এবং যে কিতাব (অর্থাৎ কুরআন) তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে তার উপর আমল কর। (সূরা মায়িদাহ, ৫৪ : ৬৮) অন্য জায়গায় সমস্ত ঈমানদারকে সংবাদ প্রদান করে কুরআন মাজীদে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেনঃ

مَا مَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ، وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ ءَامَنَ بِاللَّهِ وَمَلَيكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ

রাসূল তার রাব্ব হতে তৎপ্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করে এবং মু'মিনগণও (বিশ্বাস করে); তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর মালাইকাকে, তাঁর গ্রন্থসমূহকে এবং তাঁর রাসূলগণকে বিশ্বাস করে থাকে; (তারা বলে) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কেহকেও পার্থক্য করিনা। (সূরা বাকারাহ, ২ : ২৮৫) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেনঃ

وَالَّذِينَ ءَامَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ، وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍرٍ مِّنْهُمْ

এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনা। (সূরা নিসা, ৪ : ১৫২)
এ বিষয়ে আরও বহু আয়াত রয়েছে যাতে প্রত্যেক মুসলিমের আল্লাহর উপর, তাঁর সমস্ত রাসূলের উপর এবং সমস্ত কিতাবের উপর ঈমান আনার কথা স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে কিতাবের ঈমানদারগণের যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা অবশ্য ভিন্ন কথা। কেননা তাদের কিতাবের উপর তাদের ঈমান হয় পূর্ণ পরিণত। অতঃপর যখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে তখন কুরআনুল হাকীমের উপরও তাদের ঈমান পূর্ণ পরিণত হয়ে থাকে। এ জন্যই তারা দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী হয়। এই উম্মাতের লোকেরও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনে বটে, কিন্তু তাদের ঈমান হয় সংক্ষিপ্ত আকারে। যেমন সহীহ হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'আহলে কিতাব তোমার নিকট কোন সংবাদ প্রচার করলে তোমরা তাকে সত্যও বলনা আর মিথ্যাও বলনা, বরং বলে দাও- যা কিছু আমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপরও বিশ্বাস করি এবং যা কিছু তোমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপরও আমরা বিশ্বাস রাখি।' (আবু দাউদ ৪/৫৯) কখনও কখনও এমনও হয়ে থাকে যে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনে, তুলনামূলকভাবে আহলে কিতাব অপেক্ষা তাদের ঈমানই বেশি পূর্ণ ও দৃঢ় হয় । এই হিসাবে তারা হয়তো আহলে কিতাব অপেক্ষা বেশি সাওয়াব লাভ করবে; যদিও তারা তাদের নাবীর (আঃ) উপর এবং শেষ নাবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনার কারণে দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী। কিন্তু এরা ঈমানের পরিপক্কতার কারণে সাওয়াবে তাদের সমান। আল্লাহ তা'আলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন।





****************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url