মা’আরেফুল কোরআন - ৪০ || সূরা আল-বাকারাহ ১২৬-১২৮নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||





بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّ اجۡعَلۡ هٰذَا بَلَدًا اٰمِنًا وَّ ارۡزُقۡ اَهۡلَهٗ مِنَ الثَّمَرٰتِ مَنۡ اٰمَنَ مِنۡهُمۡ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ قَالَ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاُمَتِّعُهٗ قَلِیۡلًا ثُمَّ اَضۡطَرُّهٗۤ اِلٰی عَذَابِ النَّارِ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۲۶
وَ اِذۡ یَرۡفَعُ اِبۡرٰهٖمُ الۡقَوَاعِدَ مِنَ الۡبَیۡتِ وَ اِسۡمٰعِیۡلُ ؕ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۱۲۷
رَبَّنَا وَ اجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَیۡنِ لَکَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّۃً مُّسۡلِمَۃً لَّکَ ۪ وَ اَرِنَا مَنَاسِکَنَا وَ تُبۡ عَلَیۡنَا ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۲۸


সূরা আল-বাকারাহ ১২৬-১২৮ নং আয়াতের অর্থ

(১২৬) যখন ইব্রাহীম বললেন, পরওয়ারদেগার! এ স্থানকে তুমি শান্তিধাম কর এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা অল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে, তাদেরকে ফলের দ্বারা রিযিক দান কর। বললেনঃ যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরও কিছুদিন ফায়দা ভোগ করার সুযোগ দেব, অতঃপর তাদেরকে বলপ্রয়োগে দোযখের আযাবে ঠেলে দেবো; সেটা নিকৃষ্ট বাসস্থান। (১২৭) স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ পরওয়ারদেগার! আমাদের থেকে কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। (১২৮) পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি তওবা কবুলকারী। দয়ালু।


সূরা আল-বাকারাহ ১২৬-১২৮ নং আয়াতের তাফসীর

তফসীরের সার-সংক্ষেপ
(সে সময়টিও স্মরণযোগ্য ) যখন ইবরাহীম (আ) (দোয়া প্রসঙ্গে) বললেন, পরওয়ারদেগার, এ (স্থান)-কে তুমি (আবাদ) শহর কর, (কেমন শহর ?) শান্তিধাম কর, এর অধিবাসীদের রিযিক দান কর ফলমূলের মাধ্যমে, (আমি সব অধিবাসীর কথা বলি না, বিশেষ করে তাদের কথা বলি,) যারা তাদের মধ্যে আল্লাহ্ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে। (অবশিষ্টদের ব্যাপার আপনিই জানেন। আল্লাহ্ তা’আলা) বললেন, (আমার রিযিক বিশেষভাবে দেওয়ার রীতি নেই। এ কারণে ফলমূল সবাইকে দেব- মু’মিনকেও এবং) যারা অবিশ্বাস করে, (তাদেরকেও। তবে পরকালে মু’মিনরাই বিশেষভাবে মুক্তি পাবে। তাই যারা কাফির) তাদের কিছুদিন (অর্থাৎ ইহকালে) প্রচুর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেব। অতঃপর (অর্থাৎ মৃত্যুর পর) তাদের বল প্রয়োগের মাধ্যমে দোযখের আযাবে পৌঁছে দেব। (পৌছার) এ জায়গাটি খুবই নিকৃষ্ট। (সে সময়টিও স্মরণযোগ্য) যখন উত্তোলন করছিল ইবরাহীম (আ) কা’বাঘরের প্রাচীর (তার সঙ্গে) ইসমাঈলও। (তারা বলছিল,) পরওয়ারদেগার! আমাদের এ শ্রম কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ (আমাদের দোয়া শোন এবং আমাদের নিয়ত জান) পরওয়ারদেগার! (আমরা উভয়ে আরও দোয়া করি) আমাদের উভয়কে তোমার আরও আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধরের মধ্যেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর; আমাদের হজ্জ (ইত্যাদির) বিধি-বিধান বলে দাও এবং আমাদের প্রতি সদয় মনোযোগ দাও। (প্রকৃতপক্ষে) তুমিই মনোযোগদাতা, দয়ালু।
হযরত খলীলুল্লাহ (আ) আল্লাহর পথে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। অর্থ-সম্পদ, পরিবার-পরিজন এবং নিজের মনের কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ্ আদেশ পালনে তৎপর হওয়ার যেসব অক্ষয় কীর্তি তিনি স্থাপন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও নজীরবিহীন সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা শুধু একটি স্বাভাবিক ও সহজাত বৃত্তিই নয়। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলারও নির্দেশ রয়েছে। উল্লিখিত আয়াতসমূহ এর প্রমাণ। তিনি সন্তানদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।

হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া

ইবরাহীম (আ) رب শব্দ দ্বারা দোয়া আরম্ভ করেছেন। এর অর্থ, ’হে আমার পালনকর্তা!’ তিনি এই শব্দের মাধ্যমে দোয়া করার রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ, এ জাতীয় শব্দ আল্লাহর রহমত ও কৃপা আকৃষ্ট করার ব্যাপারে খুবই কার্যকর ও সহায়ক। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রথম দোয়া এইঃ “তোমার নির্দেশে আমি এই জনমানবহীন প্রান্তরে নিজ পরিবার-পরিজনকে ফেলে রেখেছি। তুমি একে একটি শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়ে দাও যাতে এখানে বসবাস করা আতঙ্কজনক না হয় এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহজলভ্য হয়।" এ দোয়াটিই সূরা ইবরাহীমে هَذَا الْبَلَدَ آمِنًا শব্দের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। তাতে الف ও لام সহ الْبَلَدَ উল্লিখিত হয়েছে। আরবী ব্যাকরণে একে معرفة বলা হয়। পার্থক্যের কারণ সম্ভবত এই যে, সূরা বাকারার এই প্রথম দোয়াটি তখন করা হয়, যখন স্থানটি একান্তই জনমানবহীন প্রান্তর ছিল। আর দ্বিতীয় দোয়াটি বাহ্যত তখন করা হয়, যখন মক্কায় বসতি স্থাপিত হয়ে স্থানটি একটি নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এর সমর্থনসূচক ইঙ্গিত সূরা ইবরাহীমের শেষভাগে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছেঃ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ

- “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বার্ধক্য সত্ত্বেও আমাকে ইসমাঈল ও ইসহাক- এ দু’টি সন্তান দান করেছেন ।” এতে বোঝা যায় যে, দ্বিতীয় দোয়াটি হযরত ইসহাকের জন্মের পরবর্তী সময়ের। হযরত ইসহাক হযরত ইসমাঈলের তের বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। (ইবনে কাসীর) 

হযরত ইবরাহীম (আ)- এর দ্বিতীয় দোয়ায় বলা হয়েছে, পরওয়ারদেগার! শহরটিকে শান্তিধাম করে দাও অর্থাৎ হত্যা, লুণ্ঠন, কাফিরদের অধিকার স্থাপন, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখ।
হযরত ইবরাহীমের এই দোয়া কবুল হয়েছে। মক্কা মুকাররমা শুধু একটি জনবহুল নগরীই নয়, সারা বিশ্বের প্রত্যাবর্তনস্থলেও পরিণত হয়েছে। বিশ্বের চারদিক থেকে মুসলমানগণ এ নগরীতে পৌঁছাকে সর্ববৃহৎ সৌভাগ্য মনে করে। নিরাপদ ও সুরক্ষিতও এতটুকু হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত কোন শত্রুজাতি অথবা শত্রু-সম্রাট এর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ‘আসহাবে-ফীলের’ ঘটনা স্বয়ং কোরআনে উল্লিখিত রয়েছে। তারা কা‘বাঘরের উপর আক্রমণের ইচ্ছা করতেই সমগ্র বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল।

এ শহরটি হত্যা ও লুটতরাজ থেকেও সর্বদা নিরাপদ রয়েছে। জাহিলিয়ত যুগে আরবরা অগণিত অনাচার, কুফর ও শিরকে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কা’বাঘর ও তার পার্শ্ববর্তী হরমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করত। তারা প্রাণের শত্রুকে হাতে পেয়েও হরমের মধ্যে পাল্টা হত্যা অথবা প্রতিশোধ গ্রহণ করত না। এমনকি, হরমের অধিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের রীতি সমগ্র আরবে প্রচলিত ছিল। এ কারণেই মক্কাবাসীরা বাণিজ্যব্যাপদেশে নির্বিঘ্নে সিরিয়া ও ইয়ামানে যাতায়াত করত। কেউ তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করত না।
আল্লাহ্ তা’আলা হরমের চতুঃসীমার জন্তু-জানোয়ারকেও নিরাপত্তা দান করেছেন। এই এলাকায় শিকার করা জায়েয নয়। জন্তু-জানোয়ারের মধ্যেও স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা সেখানে শিকারী দেখলেও ভয় পায় না।

হরমের শান্তিস্থল হওয়ার এসব বিধান (যা ইবরাহীম (আ)- এর দোয়ারই ফল) জাহিলিয়ত যুগ থেকেই কার্যকরী রয়েছে। ইসলাম ও কোরআন এগুলোকে অধিকতর সুসংহত ও বিকশিত করেছে। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ও করামেতা শাসকবর্গের হাতে হরমে অত্যাচার-উৎপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে, কোন কাফির জাতি আক্রমণ করেনি। কেউ নিজ হাতে নিজের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে তা শান্তির পরিপন্থী নয়। এছাড়া এগুলো একান্তই বিরল ঘটনা। হযরত ইবরাহীম (আ) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার বছরের মধ্যে কয়েকটি গুনাগুনতি ঘটনা। হত্যাকাণ্ডের নায়কদের ভয়াবহ পরিণতিও সবার সামনে ফুটে উঠেছে।

মোটকথা, হযরত ইবরাহীমের দোয়া অনুযায়ী আল্লাহ্ তা’আলা শহরটিকে প্রাকৃতিক দিক দিয়েও সারা বিশ্বের জন্য শান্তির আলয়ে পরিণত করে দিয়েছেন। এমনকি দাজ্জালও হরমে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। এছাড়া শরীয়তের পক্ষ থেকে এ বিধানও জারি করা হয়েছে যে, হরমে পারস্পরিক হত্যাকাণ্ড তো দূরের কথা, জন্তু-জানোয়ার শিকার করা পর্যন্ত হারাম।
হযরত ইবরাহীমের তৃতীয় দোয়া এই যে, এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসাবে যেন ফলমূল দান করা হয়। মক্কা মুকাররমা ও পার্শ্ববর্তী ভূমি কোনরূপ বাগবাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল না পানির নাম-নিশানা। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা ইবরাহীমের দোয়া কবুল করে নিয়ে এ মক্কার অদূরে ’তায়েফ’ নামক একটি ভূখণ্ড সৃষ্টি করে দিলেন। তায়েফে যাবতীয় ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়ে তা মক্কার বাজারেই বেচাকেনা হয়। কোন অসমর্থিত রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তায়েফ সিরিয়ার একটি ভূখণ্ড। আল্লাহর নির্দেশে জিবরাঈল (আ) তায়েফকে এখানে স্থানান্তরিত করে দিয়েছেন


হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দোয়ার রহস্য

হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর দোয়ায় একথা বলেন নি যে, মক্কা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে ফলোদ্যান অথবা চাষাবাদযোগ্য করে দাও। বরং তাঁর দোয়া ছিল এই যে, ফলমূল উৎপন্ন হবে অন্যত্র, কিন্তু পৌঁছাবে মক্কায়। এর রহস্য সম্ভবত এই যে, হযরত ইবরাহীমের সন্তানরা চাষাবাদ অথবা বাগানের কাজে মশগুল হয়ে পড়ুক, এটা তাঁর কাম্য ছিল না। কারণ, তাদের এখানে আবাদ করার উদ্দেশ্যই ছিল হযরত ইবরাহীমের ভাষায় رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ এতে বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর সন্তানদের প্রধান বৃত্তি কা’বাঘরের সংরক্ষণ ও নামাযকে সাব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন। নতুবা স্বয়ং মক্কা মুকাররমাকে এমন সুশোভিত ফলোদ্যানে পরিণত করা মোটেই কঠিন ছিল না—যার প্রতি দামেস্ক এবং বৈরুতও ঈর্ষা করত।
জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ ফলেরই অন্তর্ভুক্তঃ এ শব্দটি مثرات-এর বহুবচন। এর অর্থ ফল। বাহ্যত এর দ্বারা গাছের ফল বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সূরা কাসাসের ৫৭তম আয়াতে এ দোয়া কবুল হওয়ার কথা এভাবে প্রকাশ করা হয়েছেঃ يُجْبَى إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ (মক্কায় সবকিছুর ফল আনা হবে) এখানে প্রথমত, বলা হয়েছে  যে, স্বয়ং মক্কায় ফল উৎপন্ন করার ওয়াদা নয়; বরং অন্য স্থান থেকে এখানে আনা হবে। يُجْبَى শব্দের অর্থ তাই। দ্বিতীয়ত, ثَمَرَاتُ كُلِّ شَجَرٍ (প্রত্যেক গাছের ফল) বলা হয়নি । এ শাব্দিক পরিবর্তন থেকে বোঝা যায় যে, এখানে ফলকে ব্যাপক অর্থে বোঝানোই উদ্দেশ্য। কারণ সাধারণ প্রচলিত ভাষায় ثمر প্রত্যেক বস্তু থেকে উৎপন্ন দ্রব্যকে বোঝায়। গাছ থেকে উৎপন্ন ফল যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি মেশিন থেকে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীও মেশিনের ফল। বিভিন্ন হাতের তৈরি আসবাবপত্রও হস্তশিল্পের ফল। এভাবে ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ -এর মধ্যে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় যাবতীয় আসবাবপত্রই ফলের অন্তর্ভুক্ত। অবস্থা এবং ঘটনাবলী ও প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা হরমের পবিত্র ভূমিকে চাষাবাদ ও শিল্পোৎপাদনের যোগ্য না করলেও সারা বিশ্বে উৎপাদিত কৃষি ও শিল্পসামগ্রী এখানে সহজলভ্য করে দিয়েছেন। সম্ভবত আজও কোন বৃহত্তম বাণিজ্য ও শিল্প শহরে এমন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান নেই, যাতে সারা বিশ্বের উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী মক্কার মত প্রচুর পরিমাণে ও সহজে লাভ করা যায়।


হযরত খলীলুল্লাহ্ (আ)-এর সাবধানতা

আলোচ্য আয়াতে মু’মিন ও কাফির নির্বিশেষে সমগ্র মক্কাবাসীর জন্য শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দোয়া করা হয়েছে। ইতিপূর্বে এক দোয়ায় যখন হযরত খলীল স্বীয় বংশধরের মু’মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, মু’মিনদের পক্ষে এ দোয়া কবুল হলো, জালিম ও মুশরিকদের জন্য নয়। সে দোয়াটি ছিল নেতৃত্ব লাভের দোয়া; হযরত খলীল (আ) ছিলেন আল্লাহর বন্ধুত্বের মহান মর্যাদায় উন্নীত ও আল্লাহ্-ভীতির প্রতীক। তাই এ ক্ষেত্রে সে কথাটি মনে পড়ে গেল এবং তিনি দোয়ার শর্ত যোগ করলেন যে, আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির এ দোয়া শুধু মু’মিনদের জন্য করেছি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ভয় ও সাবধানতার মূল্য দিয়ে বলা হয়েছেঃ وَمَنْ كَفَرَ অর্থাৎ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতা আমি সমস্ত মক্কাবাসীকেই দান করব, যদিও তারা কাফির ও মুশরিক হয়। তবে মু’মিনদেরকে ইহকাল ও পরকাল সর্বত্রই তা দান করব, কিন্তু কাফিররা পরকালে শাস্তি ছাড়া আর কিছুই পাবে না।


স্বীয় সৎকর্মে তুষ্ট না হওয়া

হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশে সিরিয়ার সুজলা-সুফলা সুদর্শন ভূখণ্ড ছেড়ে মক্কার বিশুষ্ক পাহাড়সমূহের মাঝখানে স্বীয় পরিবার-পরিজনকে এনে ফেলে রাখেন এবং কা’বাগৃহের নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মত্যাগী সাধকের অন্তরে অহংকার দানা বাঁধতে পারত এবং সে তাঁর ক্রিয়াকর্মকে অনেক মূল্যবান মনে করতে পারত। কিন্তু এখানে ছিলেন আল্লাহর এমন এক বন্ধু, যিনি আল্লাহর প্রতাপ ও মহিমা সম্পর্কে যথার্থভাবে অবহিত। তিনি জানতেন, আল্লাহর উপযুক্ত ইবাদত ও আনুগত্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে। তাই আমল যত বড়ই হোক সেজন্য অহংকার না করে কেঁদে কেঁদে এমনি দোয়া করা প্রয়োজন যে, হে পরওয়ারদেগার! আমার এ আমল কবুল হোক । কা’বাগৃহ নির্মাণের আমল প্রসঙ্গে হযরত ইবরাহীম তাই বলেছেনঃ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا হে পরওয়ারদেগার! আমাদের এ আমল কবুল করুন। কেননা, আপনি শ্রোতা, আপনি সর্বজ্ঞ।

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ
-এ দোয়াটিও হযরত ইবরাহীম (আ)- এর আল্লাহ্ সম্পর্কিত জ্ঞান ও আল্লাহভীতির ফল, আনুগত্যের অদ্বিতীয় কীর্তি স্থাপন করার পরও তিনি এরূপ দোয়া করেন যে, আমাদের উভয়কে তোমাদের আজ্ঞাবহ কর। কারণ, মা’আরেফাত তথা আল্লাহ্ সম্পর্কিত জ্ঞান যার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, সে তত বেশি অনুভব করতে থাকে যে, যথার্থ আনুগত্য তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।

وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا
-এ-দোয়াতেও স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, তিনি আল্লাহর প্রেমিক, আল্লাহর পথে নিজের সন্তান-সন্ততিকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুণ্ঠিত নন। তিনিও সন্তানদের প্রতি কতটুকু মহব্বত ও ভালবাসা রাখেন। কিন্তু এই ভালবাসার দাবিসমূহ কয়জন পূর্ণ করতে পারে ? সাধারণ লোক সন্তানদের শুধু শারীরিক সুস্থতা ও আরামের দিকেই খেয়াল রাখে। তাদের যাবতীয় স্নেহ-মমতা এ দিকটিকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শারীরিকের চাইতে আত্মিক এবং জাগতিকের চাইতে পারলৌকিক আরামের জন্য চিন্তা করেন অধিক। এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ) দোয়া করলেনঃ ‘আমাদের সন্তানদের মধ্য থেকে একটি দলকে পূর্ণ আনুগত্যশীল কর। সন্তানদের জন্য এ দোয়ার মধ্যে আরও একটি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, সমাজে যারা গণ্যমান্য, তাদের সন্তানরা পিতার পথ অনুসরণ করলে সমাজে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তাদের যোগ্যতা জনগণের যোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। (বাহরে মুহীত)
হযরত খলীলুল্লাহ্ (আ)- এর এ দোয়াটিও কবুল হয়েছে। তাঁর বংশধরের মধ্যে কখনও সত্যধর্মের অনুসারী ও আল্লাহ্ আজ্ঞাবহ আদর্শ পুরুষের অভাব হয়নি। জাহিলিয়ত আমলের আরবে যখন সর্বত্র মূর্তিপূজার জয়-জয়কার ছিল, তখনও ইবরাহীমের বংশধরের মধ্যে কিছু লোক একত্ববাদ ও পরকালে বিশ্বাসী এবং আল্লাহর আনুগত্যশীল ছিলেন। যেমন যায়েদ ইবনে আমর, ইবনে নওফেল এবং কুস ইবনে সায়েদা প্রমুখ। রসূলুল্লাহ (সা)- এর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম সম্পর্কেও বর্ণিত আছে যে, মূর্তিপূজার প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা ছিল।- (বাহরে মুহীত)

منسك - مَنَاسِكَ - وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا
এর বহুবচন। হজ্জের ক্রিয়াকর্মকে مَنَاسِكَ বলা হয় এবং আরাফাত, মিনা, মুযদালেফা ইত্যাদি হজ্জের স্থানকেও ‘মানাসিক’ বলা হয়। এখানে শব্দটি উভয় অর্থেই হতে পারে। দোয়ার সারমর্ম এই যে, হজ্জের ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জের স্থানসমূহ আমাদের পুরোপুরি বুঝিয়ে দাও। أَرِنَا শব্দের অর্থ ‘দেখিয়ে দাও’ দেখা চোখ দ্বারাও হতে পারে, অন্তর দ্বারাও। দোয়ার মর্মানুযায়ী জিবরাঈলের মাধ্যমে হজ্জের স্থানসমূহ দেখিয়ে দেওয়া হয় এবং হজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে শিখিয়ে দেওয়া হয়।



Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url