মা’আরেফুল কোরআন - ৪২ || সূরা আল-বাকারাহ ১৩০-১৩২নং আয়াতের অর্থ ও তাফসীর || ইবরাহীমী দীনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা




بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ১৩০-১৩২

ইবরাহীমী দীনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা


بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

وَ مَنۡ یَّرۡغَبُ عَنۡ مِّلَّۃِ اِبۡرٰهٖمَ اِلَّا مَنۡ سَفِهَ نَفۡسَهٗ ؕ وَ لَقَدِ اصۡطَفَیۡنٰهُ فِی الدُّنۡیَا ۚ وَ اِنَّهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ لَمِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۳۰
اِذۡ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسۡلِمۡ ۙ قَالَ اَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۳۱
وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبۡرٰهٖمُ بَنِیۡهِ وَ یَعۡقُوۡبُ ؕ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰی لَکُمُ الدِّیۡنَ فَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۳۲

সূরা আল-বাকারাহ ১৩০-১৩২ নং আয়াতের অর্থ

       
(১৩০) ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে কে মুখ ফেরায়? কিন্তু সে ব্যক্তি, যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে। নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। (১৩১) স্মরণ কর, যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। (১৩২) এরই ওছিয়ত করেছে ইব্রাহীম তার সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না।

সূরা আল-বাকারাহ ১৩০-১৩২ নং আয়াতের তাফসীর

سَفِهَ نَفۡسَهٗ এখানে سَفِهَ অর্থ অজ্ঞতা বিখ্যাত পণ্ডিত ফাররা তাই বলেছেন। হযরত শায়খুল হিন্দ (র) এ মতই অবলম্বন করেছেন। সুতরাং প্রথম ব্যাখ্যা অনুযায়ী سَفِهَ نَفۡسَهٗ অর্থ হবে যে, নিজের সত্তাগতভাবে নির্বোধ। এটাই তফসীরের সার-সংক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা মোতাবেক অর্থ হবে এই যে, ইবরাহীমী মিল্লাত থেকে সে-ই বিমুখতা অবলম্বন করতে পারে, যে মনস্তাত্ত্বিকভাবেও মূর্খ হবে। অর্থাৎ নিজের সত্ত্বা সম্পর্কেও যার কোন জ্ঞান নেই—অর্থাৎ আমি কে বা কি, সে সম্বন্ধে সে অজ্ঞ। কয়েকটা জাতির গ্রন্থাগার আয়ত্ত করার পরও তার সে এতীমী ঘুচে না।

তফসীরের সার-সংক্ষেপ

       
<script type="text/javascript">
atOptions = { 'key' : '0e994c30e03e67c06d903f6559358258', 'format' : 'iframe', 'height' : 250, 'width' : 300, 'params' : {} }; document.write('<scr' + 'ipt type="text/javascript" src="http' + (location.protocol === 'https:' ? 's' : '') + '://www.effectivecreativeformat.com/0e994c30e03e67c06d903f6559358258/invoke.js"></scr' + 'ipt>'); </script><script type="text/javascript"> atOptions = { 'key' : '0e994c30e03e67c06d903f6559358258', 'format' : 'iframe', 'height' : 250, 'width' : 300, 'params' : {} }; document.write('<scr' + 'ipt type="text/javascript" src="http' + (location.protocol === 'https:' ? 's' : '') + '://www.effectivecreativeformat.com/0e994c30e03e67c06d903f6559358258/invoke.js"></scr' + 'ipt>'); </script>
ইবরাহীমের ধর্ম থেকে ঐ ব্যক্তিই মুখ ফেরাবে, যে নিজের সম্পর্কে বোকা। (এমন ধর্ম বর্জনকারীকে বোকাই বলা হবে। এ ধর্মের অবস্থা এই যে, এর কারণেই) আমি তাকে [অর্থাৎ ইবরাহীম (আ)-কে রসূল পদের জন্যে] পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং (এরই কারণে) সে পরকালে অন্যান্য যোগ্য লোকের অন্তর্ভুক্ত (যারা সবকিছুই পাবে। রসূল পদের জন্য এ মনোনয়ন তখন হয়েছিল,) যখন তার পালনকর্তা (ইলহামের মাধ্যমে) তাকে বললেনঃ তুমি আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য অবলম্বন কর। তিনি বললেন, আমি বিশ্বপালকের আনুগত্য অবলম্বন করলাম। (এহেন আনুগত্য অবলম্বনের ফলে আমি তাকে নবুয়তের মর্যাদা দান করলাম। তা তখনই হোক কিংবা কিছুদিন পর) বর্ণিত ধর্মের উপর কায়েম থাকার নির্দেশ ইবরাহীম তদীয় সন্তানদের দিয়েছেন এবং ইয়াকুবও (তাই করেছেন)। (নির্দেশের ভাষা ছিল এই,) হে আমার সত্তানগণ! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য (ইসলাম ও আল্লাহর আনুগত্যের) এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা (মৃত্যু পর্যন্ত একে পরিত্যাগ করো না এবং) ইসলাম ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।

সূরা আল-বাকারাহ ১৩০-১৩২ নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে ইবরাহীমী ধর্মের মৌলিক নীতিমালা, তার অনুসরণের তাগিদ এবং তা থেকে বিমুখতার অনিষ্টতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, এতে ইবরাহীমী ধর্মের অনুসরণ সম্পর্কে ইহুদী ও খৃস্টানদের দাবি খণ্ডন করা হয়েছে। একমাত্র ইসলামই যে ইবরাহীমী ধর্মের অনুরূপ এবং ইসলাম যে সকল পয়গম্বরের অভিন্ন ধর্ম—এসব বিষয়ও উল্লিখিত হয়েছে।

ইবরাহীমী দীনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা

       
আলোচ্য আয়াতসমূহে সন্তানদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের প্রতি পয়গম্বরগণের বিশেষ মনোযোগের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াতে ইবরাহীমী দীনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এর দৌলতেই ইহকাল ও পরকালে ইবরাহীম (আ)-এর সম্মান লাভের কথা বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এ ধর্ম থেকে বিমুখ হয় সে নির্বোধদের স্বর্গে বাস করে।

وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ

অর্থাৎ—ইবরাহীমী ধর্ম থেকে সে ব্যক্তিই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, যার বিন্দুমাত্রও বোধশক্তি নেই। কারণ, এ ধর্মটি হুবহু স্বভাব-ধর্ম। কোন সুস্থ-স্বভাব ব্যক্তি এ ধর্মকে অস্বীকার করতে পারে না। পরবর্তী আয়াতে এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ এতেই এ ধর্মের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা’আলা এ ধর্মের বদৌলতেই হযরত ইবরাহীম (আ)-কে ইহকালে সম্মান ও মাহাত্ম্য দান করেছেন এবং পরকালেও। ইহলৌকিক সম্মান ও মাহাত্ম্য সারা বিশ্বই প্রত্যক্ষ করেছে। নমরূদের মত পরাক্রমশালী সম্রাট ও তার পারিষদবর্গ এই মহাপুরুষের একার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, ক্ষমতার যাবতীয় কলাকৌশল তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে এবং সর্বশেষে ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে তাঁকে নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু জগতের যাবতীয় উপাদান ও শক্তি যে অসীম ক্ষমতাবানের আজ্ঞাধীন, তিনি নমরূদের সমস্ত পরিকল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা প্রচণ্ড আগুনকেও স্বীয় দোস্তের জন্য পুষ্পোদ্যানে পরিণত করে দিলেন। ফলে বিশ্বের সমগ্র জাতি তাঁর অপরিসীম মাহাত্ম্যের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হলো। বিশ্বের সমস্ত মু’মিন ও কাফির, এমনকি পৌত্তলিকেরাও এ মূর্তি সংহারকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। আরবের মুশরিকরা আর যাই হোক, হযরত ইবরাহীমেরই সন্তান-সন্ততি ছিল। এ কারণে মূর্তিপূজা সত্ত্বেও হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সম্মান ও মাহাত্ম্য মনেপ্রাণে স্বীকার করত এবং তাঁরই ধর্ম অনুসরণের দাবি করত। ইবরাহীমী ধর্মের কিছু অস্পষ্ট চিহ্ন তাদের কাজেকর্মেও বিদ্যমান ছিল। হজ্জ, ওমরা, কোরবানী ও অতিথিপরায়ণতা এ ধর্মেরই নিদর্শন। তবে তাদের মূর্খতার কারণে এগুলো বিকৃত হয়ে পড়েছিল। বলা বাহুল্য, এটা ঐ নেয়ামতেরই ফল—যার দরুন খলীলুল্লাহ্ (আ)-কে ’মানব নেতা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিলঃ

إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا

ইবরাহীম (আ) ও তাঁর ধর্মের অপ্রতিরোধ্য প্রাধান্য ছাড়াও এ ধর্মের জনপ্রিয়তা ও স্বভাবধর্ম হওয়ার বিষয়টি সারা দুনিয়ার সামনে প্রতিভাত হয়ে গেছে। ফলে যার মধ্যে এতটুকুও বোধশক্তি ছিল, সে এ ধর্মের সামনে মাথা নত করেছিল।
       
এই ছিল ইবরাহীম (আ)-এর ইহলৌকিক সম্মান ও মাহাত্ম্যের বর্ণনা। পারলৌকিক ব্যাপারটি আমাদের সামনে উপস্থিত নেই, কিন্তু ইবরাহীম (আ)-এর মর্যাদা কোরআনের সে আয়াতেই ফুটে উঠেছে, যাতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা ইহকালে তাঁকে যেমন সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তেমনি পরকালেও তাঁর উচ্চাসন নির্ধারিত রয়েছে।

ইবরাহীমী ধর্মের মৌলনীতি আল্লাহর আনুগত্য শুধু ইসলামেই সীমাবদ্ধঃ অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে ইবরাহীমী ধর্মের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেঃ

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

অর্থাৎ-ইবরাহীম (আ)-কে যখন তাঁর পালনকর্তা বললেন, “আনুগত্য অবলম্বন কর, তখন তিনি বললেন, আমি বিশ্বপালকের আনুগত্য অবলম্বন করলাম।" এ বর্ণনা ভঙ্গিতে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ্ তা’আলার أَسْلِمْ (আনুগত্য অবলম্বন কর।) সম্বোধনের উত্তরে সম্বোধনেরই ভঙ্গিতে أَسْلَمْتُ لَكَ (আমি আপনার আনুগত্য অবলম্বন করলাম) বলা যেত, কিন্তু হযরত খলীল (আ) এ ভঙ্গি ত্যাগ করে أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ বলেছেন। অর্থাৎ আমি বিশ্বপালকের আনুগত্য অবলম্বন করলাম। প্রথমত, এতে শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহর স্থানোপযোগী গুণকীর্তনও করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, আমি আনুগত্য অবলম্বন করে কারো প্রতি অনুগ্রহ করিনি; বরং এমন করাই ছিল আমার জন্য অপরিহার্য। কারণ, তিনি রাব্বুল আলামীন — সারা জাহানের পালনকর্তা। তাঁর আনুগত্য না করে বিশ্ব তথা বিশ্ববাসীর কোনই গত্যন্তর নেই। যে আনুগত্য অবলম্বন করে, স্বীয় কর্তব্য পালন করে লাভবান হয়। এতে আরও জানা যায় যে, ইবরাহীমী ধর্মের মৌলনীতির যথার্থ ও স্বরূপ এক ’ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই নিহিত—যার অর্থ আল্লাহর আনুগত্য। ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের সারমর্মও তাই। ঐসব পরীক্ষার সারমর্মও তাই, যাতে উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর এই দোস্ত মর্যাদার উচ্চতর শিখরে পৌঁছেছেন। ইসলাম তথা আল্লাহর খাতিরেই সমগ্র সৃষ্টি। এরই জন্য পয়গম্বরগণ প্রেরিত হয়েছিলেন এবং আসমানী গ্রন্থসমূহ নাযিল করা হয়েছে।
       
এতে আরও বোঝা যায় যে, ইসলামই সমস্ত পয়গম্বরের অভিন্ন ধর্ম এবং ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত আগমনকারী সমস্ত রসূল ইসলামের দিকেই মানুষকে আহবান করেছেন এবং তাঁরা এরই ভিত্তিতে নিজ নিজ উম্মতকে পরিচালনা করেছেন। কোরআন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেঃ

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ

“ইসলামই আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করে, তা কখনও কবূল করা হবে না।”

জগতে পয়গম্বরগণ যত ধর্ম এনেছেন, নিজ নিজ সময়ে সে সবই আল্লাহর কাছে মকবুল ছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে সেসব ধর্মও ছিল ইসলাম— যদিও সেগুলো বিভিন্ন নামে অভিহিত হতো। যেমন, মূসা (আ)-এর ধর্ম, ঈসা (আ)-এর ধর্ম, তথা ইহুদী ধর্ম, খৃষ্ট ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু এসব ধর্মের স্বরূপ ছিল ইসলাম, যার মর্ম আল্লাহর আনুগত্য। তবে এ ব্যাপারে ইবরাহীমী ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি নিজ ধর্মের নাম ’ইসলাম’ রেখেছিলেন এবং স্বীয় উম্মতকে ‘উম্মতে-মুসলিমাহ্’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তিনি দোয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ

অর্থাৎ-“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের উভয়কে (ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে) মুসলিম (অর্থাৎ আনুগত্যশীল) কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও এক দলকে আনুগত্যকারী কর।" হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর সন্তানদের প্রতি ওসীয়ত প্রসঙ্গে বলেছেনঃ

فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

-তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া অন্য ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করো না।
       
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পর তাঁরই প্রস্তাবক্রমে মুহাম্মদ (সা)-এর উম্মত এই বিশেষ নাম লাভ করেছে। ফলে এ উম্মতের নাম হয়েছে ’মুসলমান’। এ উম্মতের ধর্মও ‘মিল্লাতে ইসলামিয়াহ্’ নামে অভিহিত।

কোরআনে বলা হয়েছেঃ

مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا

“এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্ম। তিনিই ইতিপূর্বে তোমাদের ‘মুসলমান’ নামকরণ করেছেন এবং এতেও (অর্থাৎ কোরআনেও) এ নামই রাখা হয়েছে।”

ধর্মের কথা বলতে গিয়ে ইহুদী, খৃস্টান এবং আরবের মুশরিকরাও বলে যে, তারা ইবরাহীমী ধর্মের অনুসারী, কিন্তু এসব তাদের ভুল ধারণা অথবা মিথ্যা দাবি যাত্র। বাস্তবে মুহাম্মদী ধর্মই শেষ যমানায় ইবরাহীমী ধর্ম তথা স্বভাব-ধর্মের অনুরূপ।

মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে যত পয়গম্বর আগমন করেছেন এবং যত আসমানী গ্রন্থ ও শরীয়ত অবতীর্ণ হয়েছে, সে সবগুলোর প্রাণ হচ্ছে ইসলাম তথা আল্লাহর আনুগত্য। এ আনুগত্যের সারমর্ম হলো, রিপুর কামনা-বাসনার বিপরীতে আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ ত্যাগ করে হেদায়েতের অনুসরণ।

পরিতাপের বিষয়, আজ ইসলামের নাম উচ্চারণকারী লক্ষ লক্ষ মুসলমান এ সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা ধর্মের নামেও স্বীয় কামনা-বাসনারই অনুসরণ করতে চায়। কোরআন ও হাদীসের এমন ব্যাখ্যাই তাদের কাছে পছন্দ, যা তাদের কামনা-বাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা শরীয়তের জামাকে টেনে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের কামনার মূর্তিতে পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে—যাতে বাহ্যদৃষ্টিতে শরীয়তেরই অনুসরণ করছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কামনারই অনুসরণ।

গাফেলরা জানে না যে, এসব অপকৌশল ও অপব্যাখ্যার দ্বারা সৃষ্টিকে প্রতারিত করা গেলেও স্রষ্টাকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর জ্ঞান প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পরিব্যাপ্ত। তিনি মনের গোপন ইচ্ছা ও ভেদকে পর্যন্ত দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে খাঁটি আনুগত্য ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণীয় নয় ।
       
কোন্ কাজে আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট হন এবং আমার জন্য তাঁর নির্দেশ কি ? খাহেশ ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করাই সত্যিকার ইসলাম। আল্লাহ্ কোন্ দিকে যেতে বলেন এবং কোন কাজের নির্দেশ দেন, তা শোনার জন্য আজ্ঞাবহ গোলামের মত সদা উৎকর্ণ থাকা উচিত। কাজটি কিভাবে করলে আল্লাহ্ কবুল করবেন এবং সন্তুষ্ট হবেন—এসব চিন্তা করাই প্রকৃত ইবাদত ও বন্দেগী।

আনুগত্য ও মহব্বতের এই যে প্রেরণা, এর পূর্ণতাই মানুষের উন্নতির সর্বশেষ স্তর। এ স্তরকেই ’মাকামে আবদিয়াত’ তথা দাসত্বের স্তর বলা হয়। এখানে পৌছেই হযরত ইবরাহীম (আ) ’খলীল’ উপাধি লাভ করেছিলেন এবং মহানবী (সা) عبدنا (আমার দাস) উপাধিতে ভূষিত হন। এ স্তরের নীচেই রয়েছে আউলিয়া ও কুতুবদের স্তর। এটাই সত্যিকার তওহীদ, যা অর্জিত হলে মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে ভয় করে না, কারও কাছে কিছু আশা করে না।

মোটকথা, ইসলামের অর্থ ও স্বরূপ হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। এ আনুগত্যের পথ রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সুন্নাহ্ অনুসরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ সম্পর্কে কোরআন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছেঃ

 فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

-“আপনার পালনকর্তার কসম, তারা কখনও ঈমানদার হবে না, যে পর্যন্ত না তারা আপনাকে নিজেদের কলহ-বিবাদে বিচারক নিযুক্ত করে, অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত ও মীমাংসাকে খোলা ও সরল মনে স্বীকার করে নেয়।"

উল্লিখিত আয়াতে ইবরাহীম (আ) সন্তানদের ওসীয়ত করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করবে না। অর্থাৎ ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষাকে দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করতে থাকবে, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের মৃত্যুও ইসলামের উপরই দান করেন। কোন কোন রেওয়ায়েতে বলা হয়েছেঃ তোমরা জীবনে যে অবস্থাকে আঁকড়ে থাকবে, তোমাদের মৃত্যুও সে অবস্থাতেই হবে এবং হাশরের ময়দানেও সে অবস্থতেই উপস্থিত হবে। আল্লাহ্ তা’আলার চিরন্তন রীতিও তাই। যে বান্দা সৎকর্মের ইচ্ছা করে এবং সেজন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে সে কর্মেরই সামর্থ্য দান করেন এবং তার জন্য তা সহজ করে দেন।
       
এক্ষেত্রে অপর এক হাদীস থেকে বাহ্যত এর বিপরীত অর্থও বোঝা যায়। তাতে বলা হয়েছে, “কেউ কেউ জান্নাত ও জান্নাতবাসীদের কাজ করতে করতে জান্নাতের নিকটবর্তী হয়ে যায়, যখন জান্নাত এবং তার মাঝে মাত্র এক হাতের ব্যবধান থাকে, তখন তার ভাগ্য বিরূপ হয়ে ওঠে। ফলে সে দোযখীদের মত কাজ করতে আরম্ভ করে। পরিণামে সে দোযখে প্রবেশ করে। এমনিভাবে কেউ কেউ সারা জীবন দোযখের কাজে লিপ্ত থাকে, দোযখ এবং তার মাঝে যখন এক হাতের ব্যবধান থাকে, তখন তার ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সে জান্নাতীদের মত কাজ করতে আরম্ভ করে; পরিণামে সে জান্নাতে প্রবেশ করে।” প্রকৃতপক্ষে এ হাদীসটি বিপরীত অর্থ বোঝায় না। কারণ, কোন কোন জায়গায় এ হাদীসেই فيما يبدو للناس কথাটি যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সারা জীবন জান্নাতের কাজ করে অবশেষে দোযখের কাজে লিপ্ত হয়, প্রকৃতপক্ষে পূর্বেও সে দোযখের কাজেই লিপ্ত থাকে, কিন্তু বাহ্যদৃষ্টিতে মানুষ তাকে জান্নাতের কাজে লিপ্ত মনে করে। এমনিভাবে, যে ব্যক্তি সারা জীবন দোযখের কাজে লিপ্ত থাকে এবং অবশেষে জান্নাতের কাজ করতে থাকে, সেও প্রকৃতপক্ষে পূর্বেও জান্নাতের কাজই করে থাকে, কিন্তু মানুষের বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা দোযখের কাজ বলে মনে হয়। (ইবনে কাসীর)
       
মোটকথা, যে ব্যক্তি সারা জীবন সৎকাজে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহর ওয়াদা ও রীতি অনুযায়ী আশা করা দরকার যে, তার মৃত্যুও সৎকাজের মধ্যেই হবে।




*************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url