রমজানের বিশেষ প্রবন্ধঃ রমযানের মধ্য দশদিনের গুরুত্ব






রমযানের মধ্য দশদিন


আবু সাঈদ খুদুরী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الوسط من رمضان

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মধ্য দশ দিন (১১-২০) ই'তিকাফ করেছেন।” ৭৫

   

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদরের তালাশে রমযানের মাঝের দশদিন সাওম পালন করেছেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে-

أن رسول الله صل الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اعْتكف العشر الأول مِنْ رَمَضَانَ، ثُمَّ اهْتَكَفَ الْعَفْرَ الوسط» ثم قال: «كم أتيت، فقيل لي: إنها في العشر الأواجي، فَمَنْ أَحَبُّ مِنكُمْ أَن يعتكف تليعتكف لالهتكف الناس معه.

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (লাইলাতুল কদরের তালাশে) রমযানের প্রথম দশদিন ইতিকাফ করেছেন। অতঃপর মধ্যদশ দিন ই'তিকাফ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি লাইলাতুল কদরের তালাশে ই'তিকাফ করতে এসেছি। আমাকে বলা হলো, লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে। অতএব, কেউ (এ দশদিন) ই'তিকাফ করতে চাইলে সে ই'তিকাফ করতে পারে। এর ফলে লোকজন তাঁর সাথে ইতিকাফ করল। ৭৬

রমযানের শেষ অর্ধেকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে নির্দেশ এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন-

إلي رأيتها فأنسِيتُها ، لتخرها في النصف الآخره

“আমি লাইলাতুল কদর দেখেছি, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা রমযানের শেষ অর্ধেকে তালাশ করো।৭৭
দিন-রাতের সব সম্মানিত সময়ের শেষার্ধ প্রথমার্ধের চেয়ে উত্তম।

আর দ্বিতীয়ত: আবু দাউদে ইবন মাস'উদ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত,

اطلبوها لَيْلَةَ سَبْعَ عَشْرَةً مِنْ رَمَضَانَ.

“রমযানের সতের তারিখ রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো”।৭৮

আলিমগণ বলেছেন: লাইলাতুল কদরের দিনের সকাল বদরের দিনের সকালের মতোই। আর সীরাত ও মাগাযী বিশেষজ্ঞদের প্রসিদ্ধ মতানুসারে বদরের রাত ছিল সতেরোই রমযান এবং এ দিনটি জুমু'আর দিন ছিল। যায়িদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু 'আনহু সতেরোই রমযানের মত অন্য রাতে এত বেশি জেগে থাকতেন না। তিনি বলতেন, আল্লাহ্ বদরের দিন সকালে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন এবং কাফির নেতাদেরকে সেদিন সকালে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছেন।

ইমাম আহমাদ মদীনাবাসীদের থেকে বর্ণনা করেন, লাইলাতুল কদর সতেরো রমযান তালাশ করা হয়।

   

সতের তারিখের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ঘটনা হলো, এটি বদরের রাত, এ রাতের সকাল হলো ইয়াওমুল ফুরকান তথা সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকারী দিন। এটিকে ইয়াওমুল ফুরকান এ কারণে বলা হয় যে, আল্লাহ এ দিনে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করেছেন, সত্য ও হকপন্থীদেরকে স্পষ্ট করেছেন এবং তাদেরকে বাতিলের ওপর বিজয় দান করেছেন, আল্লাহর কালেমা ও তাওহীদকে বুলন্দ করেছেন এবং তাঁর শত্রু মুশরিক ও আহলে কিতাবীদেরকে অপমানিত করেছেন।

কদরের রাতে ফিরিশতাগণ জমিনে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে শয়তানের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-

تنزل الملتبكةُ وَالرُّوحُ فيها بإذن ربهم من كل أَمْرِ سَلَمُ من حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ)

“সে রাতে ফিরিশতারা ও রূহ (জিবরীল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।" [সূরা আল-কাদর, আয়াত: ৪-৫]

মুসনাদে আহমাদে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن الملائكة تلك الليلة في الأرض أكثر من عدد الحصى.

“সে রাতে (কদরের) পৃথিবীতে নাযিলকৃত ফিরিশতার সংখ্যা জমিনে বিস্তৃত পাথর কণার চেয়েও অধিক। ৭৯

জাবের রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لا يخرجُ شَيْطانُهَا حَتَّى يُضِي فَجْرُهَا».

“কদরের রাতে ফজর উদিত না হওয়া পর্যন্ত শয়তান বের হয় না।” ৮০

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বলেন, প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় শয়তানও উদিত হয়; তবে কদরের দিন ব্যতীত। আর সেদিন সূর্য উদিত হয় তবে এতে আলোকরশ্মি থাকে না। মুজাহিদ ( سَلَمُ من حَتَّى) এর ব্যাখ্যায় বলেন, এ সময় কোন রোগ-ব্যাধি থাকবে না, শয়তান কোন কাজ করতে সক্ষম হবে না। তিনি আরও বলেন, কদরের রাত শান্তির রাত, এ রাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটে না এবং শয়তানও প্রেরিত হয় না। তিনি আরও বলেন, এ রাত নিরাপদ, শয়তান এ রাতে খারাপ কাজ করতে পারে না এবং ক্ষতিকর কিছু সংঘটিত হয় না। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, সে রাতে বিতাড়িত জীন শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়, খবিশ শয়তানদেরকে আবদ্ধ করা হয়, আসমানে দরজা খুলে দেওয়া হয়, সকল তাওবাকারীদের থেকে তাওবা কবুল করা হয়। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-

سَلامُ من حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ) [القدر: ٥]

“শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত"। [সূরা আল-কাদর, আয়াত: ৪-৫] হে মুসলিম! সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের জন্য এ মাসে জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। জান্নাতের হাওয়া মুমিনের অন্তরে বইছে। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শয়তান ও তার দোসরদের পায়ে শিকল লাগানো হয়েছে। সুতরাং তাওহীদের বাণী দিয়ে শয়তানের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দাও। সে ভাঙ্গার এ ব্যথা প্রতিটি ফযিলতপূর্ণ মওসুমে ভোগ করতে থাকবে। সে এ মাসে মানুষের জন্য ধ্বংস কামনা করেন। কেননা সে দেখে এ মাসে আল্লাহ রহমাত ও মাগফিরাত নাযিল করেন। এ মাসে রহমানের দল বিজয় লাভ করে আর শয়তানের দল পরাজিত হয়।

হে আল্লাহর বান্দা! রমযান মাসের প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের মধ্যে কে নিজের আত্মার মুহাসাবা করেছ? কে এ মাসের হক আদায় করেছ? মনে রেখ, এ মাস কিন্তু শেষ হতে চলছে। অতএব, আমলের পরিমাণ বাড়িয়ে দাও। তুমি তো এ মাসে অবস্থান করছ অথচ মাস তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব মাসের পরে আরেকটি মাস আসবে; কিন্তু রমযানের পরে কী আর রমযান পাওয়া যাবে?

   

তথ্যসূত্রঃ
৭৫ মুয়াত্তা মালিক, ১/৩১৯, হাদীস নং ৯; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১১০৩৪, গু'আইব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস ২১৭১।
৭৬ সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ২১৭১; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১১908, শুআইব আৱনাউত হাদীসটিকে শায়খাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।
৭৭  মু'জাম কাবীর, তাবরানী, ১৩/১৪১; শরহে মা'আনিল আসার, ৩/৮৮।
৭৮  আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৮৪, আলবানী রহ. হাদীসটিকে দঈফ বলেছেন। জামেউল উসূল, ৯/২৫৫, মুহাক্কিক আইমান সালিহ শা'বান হাদীসের সনদটিকে হাসান বলেছেন; তাছাড়া শুআইবও আরনাউত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
৭৯  মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১০৭৩৪, শুআইব আরনাউত হাদীসটিকে হাসানের সম্ভাবনা বলেছেন। মাজমাউয যাওয়ায়েদে (৩/১৭৬) হাইসামী রহ. বলেছেন, হাদীসটি আহমাদ, বাযযার ও তারবানী বর্ণনা করেছেন এবং তাদের বর্ণনাকারীগণ সিকাহ। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, সহীহহুল জামে' আস-সাগীর, ২/১৬১।
৮০ সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ২১৯০, আলবানী রহ. হাদীসটিকে ২১৯২ ও ২১৯৩ নং শাওয়াহেদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন। শুআইব আৱনাউত হাদীসটিকে শাওয়াহেদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন।

*** ইবন রজব আল-হাম্বলী রহ. এর ‘লাতায়িফুলমা ‘আয়রফ’ অবলম্বনে ‘রমযানের দায়িত্ব-কর্তব্য’ থেকে সংকলিত



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url