ত্যাগের আদর্শে চীর ভাস্বর, চীর মহান নারী, আইয়ুব (আ:) এর স্ত্রী বিবি রহিমা







আইয়ুব (আ:) এর স্ত্রী বিবি রহিমা


হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের স্ত্রী বিবি রহিমা। আল্লাহ তাআলা তাকে পৃথিবীর নারীসহ সব মানুষের জন্য ধৈর্য ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বানিয়েছেন। তিনি স্বামীর সেবায় এমন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন যে আল্লাহ তাকে ইসলামের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ করেছেন। বিবি রহিমা হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত।


বিবি রহিমার মহিয়সী হওয়ার নেপথ্য কাহিনী

আল্লাহর নবি হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, ক্ষেত-খামার বাগ-বাগিচা সবই ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে আর্থিক, দৈহিক সন্তানের দুঃখ-কষ্টে পতিত করেন। তাঁর ওপর আল্লাহর পরীক্ষা আসে, এবং তার সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ দেহ কুষ্ঠরোগে ভরে যায়।

সবাই হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে ছেড়ে গেলেও বিবি রহিমা তাঁকে ছেড়ে যাননি। তিনি স্বামী খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। সব রকম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে থাকেন।

একবার হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম কোনো কারণে বিবি রহিমার ওপর রাগান্বিত হয়ে বলে কসম করেন যে, আমি যদি সুস্থ হই তবে তাঁকে (বিবি রহিমাকে) ১০০ বেত্রাঘাত করব।

সম্পদশালী হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম নিঃস্ব হয়ে অনেক কষ্ট ভোগের পর আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করেন যে-

এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৩)

অতঃপর আল্লাহ তাআলা হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে সম্মানিত মাস মহররমে ক্ষমা করে দেন। তাঁকে সমুদয় সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান পুনরায় দান করেন। কুরআনে সেকথা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত আর এটা ইবাদাতকারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৪)


বিবি রহিমার ওপর আল্লাহর অসীম দয়া

একদিকে পয়গম্বর হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম-এর কসম। অন্য দিকে সতীসাধ্বী স্বামীর খেদমতে নিয়োজিত মহিয়সী নারী বিবি রহিমা। অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে ইহসান করেন।

রাগের বশবর্তী হয়ে বিবি রহিমাকে বেত্রাঘাতের যে কসম করেন; পয়গম্বর তা পূরণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। যেখানে স্ত্রী-সন্তানরা বিপদের সময় তাকে ছেড়ে চলে গেছে; সেখানে স্বামীর খেদমত পরায়ণা সতীসাধ্বী মহিয়সী নারী বিবি রহিমাকে ১০০টি বেত্রাঘাত করতে হবে। তা ছিল হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের জন্য খুবই কঠিন।

আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের কসম করা ১০০ বেত্রাঘাতের বিষয়টি সহজ করে দেন। আল্লাহ হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে বলে দিলেন যে, ১০০ শলাকা বিশিষ্ট একটি ঝাড়ু দিয়ে একবার আঘাত কর। তাহলে একটি আঘাতকে ১০০টি আঘাত হিসেবে গণ্য করে কসম পূর্ণ করা হবে।

আর এভাবেই পয়গম্বর আইয়ুব আলাইহিস সালামের কসম পূর্ণ হয় এবং বিবি রহিমা কঠোর শাস্তি থেকে মুক্তি পায়। এটা ছিল বিবি রহিমার প্রতি আল্লাহ তাআলার একান্ত অনুগ্রহ।

উল্লেখিত ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, স্বামীর খেদমতকারী বিবি রহিমার ওপর আল্লাহ তাআলা ইহসান করেছেন। একদিকে স্বামীর খেদমতের মাধ্যমে চরম ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বিবি রহিমা। অন্য দিকে স্বামীর অসন্তুষ্টির অকল্যাণ শপথের বিপরীতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে সাহায্য করেছেন।

আল্লাহ তাআলা পরম দয়া অনুকম্পা লাভে বিবি রহিমা সব নারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

প্রকৃতপক্ষে স্বামী সেবাই নারী জীবনের একমাত্র ব্রত। স্বামী সেবাই দেয় নারীকে পূর্ন মর্যাদা। পৃথিবীর ইতিহাসে যেই সকল মুসলিম নারীগন স্বামী সেবা সতীত্ব গুনে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন,তাদের মধ্যে ধৈর্যের সম্রাঙ্গী পতিপরায়ণা সতীকুল শিরোমনি হযরত রহিমার পবিত্র নাম স্বর্ন উজ্জ্বল পূর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় উদ্ভাসিত।

 

একজন নারী ইচ্ছা করলে তার স্বামীর জীবনে অবশ্যই সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি বহন করতে পারে। শুধু তাই নয়,,নারিী ইচ্ছা করলে তার গোটা সংসারকে একটি শান্তির নীড় দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। হযরত রহিমা (আঃ) ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করলেন। তাঁর গুণ- গরিমার কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।

 

 

বিবি রহিমার ত্যাগের কাহিনী সারা পৃথিবী জন্য আদর্শ

আল্লাহর হুকুমে হযরত রাহিমা আইউব (আঃ) এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হল। হযরত রহিমা (আঃ)কে বিবাহ করার আগেই হযরত আইউব (আঃ) আরও তিনটা বিবাহ করেছিলেন এবং তারা সবাই তখন বর্তমান ছিল।

 

বিবি রহিমা ছিলেন সবার ছোট। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি প্রতিদিন আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। শত শত দাসী থাকা সত্ত্বেও নিজ গৃহের সকল কাজ তিনি নিজের হাতেই করতেন। স্বামীর সকল প্রকার সেবা তিনি ইচ্ছা করেই করতে ভালোবাসতেন। তাঁর সতীনগন তাঁর সুমধুর ব্যবহারে এমন মুগ্ধ ছিলেন যে,কারও মনে কোনরূপ অহংকার বা হিংসা ছিল না।

 

তারা সবাই বিবি রহিমাকে ছোটবোনের মত স্নেহ করতেন। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন চলল না। ধীরে ধীরে সবাই হযরত রহিমা (আঃ) এর দুশমন হয়ে পড়ল এবং তা চরম আকার ধারন করল।

 

আইউব (আঃ) এর জীবনে চরম দুঃখ কষ্ট শুরু হল। আল্লাহ তায়ালা হযরত আইউব (আঃ)কে পরীক্ষা করবেন, তাই এক এক করিয়া তাঁর উপরে বিপদের ঝড় আসতে লাগল। বিষয়- সম্পদ, অর্থ-কড়ি,ধন দৌলত প্রায় সব শেষ হইয়া গেল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়াল যে, মাথা গোঁজার মতও আশ্রয়স্থলও আর রইল না।

 

তাঁর এই দুরবস্তা দেখে জনগন হযরত আইউব (আঃ)কে পাপিষ্ট বলে ধারনা করল। হযরত আইউব বিবি রাহিমা সর্বপ্রকার দুঃখ- ক্লেশ নীরবে সহ্য করতেন এবং নিশ্চিন্তে সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। হঠাৎ করে একদিন তিনি দেখলেন যে,তাঁর গায়ে একটি ফুসকা বের হয়েছে এবং সারা দেহ বেদনায় অস্থির হয়ে উঠছে।

 

কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত দেহে বিষাক্ত খতে পরিণত হয়ে অবিরল ধারায় পুঁজ বের হতে লাগল। দুর্গন্ধে কেও তাঁর কাছে বসতে পারে না। ক্ষত স্থানগুলোতে অসংখ্য পোকা জমে হযরত আইউব (আঃ)কে ভীষন কষ্ট দিতে লাগল।

 

হযরত আইউব (আঃ) এর এই দুরবস্থা দেখে সকল বিবিরা চলে গেল,এই ভেবে যে, আইউব (আঃ) হয়তো বা আর সুস্থ হবেন না। তাছাড়া কুষ্ঠ রোগীরা কোনদিন বাঁচেও না। কিন্তু হযরত রহিমা এই সব দুশ্চিন্তা না করিয়া স্বামীর সেবাকেই নারীর মঙ্গল ভেবে সর্বদা স্বামীর খেদমতে লেগে থাকলেন।

 

এমনকি,নিজ হাতে আইউব (আঃ)এর গা থেকে পোকা সাফ করে দিতেন। নিজে আহার না করে স্বামীর আহারের ব্যবস্থা করতেন। একদা গ্রামের লোকেরা বললেন, হে আইউব আপনি কুষ্ঠ রোগী,আর এটা সংক্রামক ব্যাধি। আপনার সাথে সাথে হয়তো বা গ্রামে, শহরময় এই রোগ ছড়িয়ে পরতে পারে। তাই আপনি কালবিলম্ব না করে গ্রাম ত্যাগ করুন। বিবি রহিমা তাই করিলেন। স্বামিকে নিয়ে বহু দূরে চলে গেলেন, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে একটা পাহাড়ি জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

 

একদা হযরত আইউব (আঃ) এর দেহ হইতে দুইটি পোকা পড়ে গেলে তিনি পোকা দুইটিকে সযত্নে তুলিয়া পুনরায় ক্ষতস্থানে বসিয়ে দিলেন এবং বললেন যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের আহার আমার দেহের মধ্যে উৎপন্ন করে দিয়েছেন।

 

একবার বিবি রহিমা সারাদিন ঘুরে কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে ফিরবার পথে এক ধনীর গৃহে প্রবেশ করে বললেন, আমাকে কিছু কাজ দিন আর তার বিনিময়ে কিছু আহার দিন। মহিলাটি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল,তাই সে বলল,তোমার মাথার কেশগুলো বড় সুন্দর, যদি সেগুলো কেটে আমাকে দিতে পার তাহলে অবশ্যই তোমাকে আহার দিব। হযরত রহিমা বললেন,বোন, স্বামীর অনুমতি ছাড়া তা কি করে সম্ভব? তাছাড়া আমার রূগ্ন স্বামি আমার এই লম্বা কেশ ধরে উঠাবসা করে থাকেন।

 

কিন্তু এতেও মহিলার মন নরম হল না বিধায় বিবি রহিমা চুল কেটে দিতে বাধ্য হলেন। সেই দিন গৃহে আহারের কিছুই ছিল না। তাছাড়া খাদ্যের অভাবে স্বামীর অকাল মৃত্যু ঘটতে পারে। শয়তান মরদুদ ইতিমধ্যে আইউব (আঃ) এর নিকটে এসে বলল যে, আপনার আদরের রহিমা মানুষের ঘরে চুরি করেছে এবং ধরা পড়েছে।

 

তাই জনগন জোরপূর্বক তাঁহার মাথার চুল কেটে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রহিমা (আঃ) প্রথম থেকেই আপনার অমঙ্গল কামনা করিয়া আসিতেছে।বলিতে বলিতে রহিমা স্বামির আহার হাতে করিয়া গৃহে উপস্হিত হইলেন,,কিন্তু আইউব (আঃ) মুখমন্ডল মলিন করিয়া বসিয়া আছেন।

 

কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন,হে রহিমা!!শেষ পর্যন্ত তুমি আমার জন্য চুরি করিয়াছ?লোকেরা তোমার মাথার চুল কাটিয়া দিয়েছে? বিবি রহিমা পাথরের ন্যায় চুপ হয়ে নিথর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখ বয়ে অশ্র্র নেমে আসছে। তিনি বললেন, হে স্বামী আমার! আপনি ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভীষণ কষ্ট পাইবেন,সারাদিন ঘুরেও কোন প্রকার কাজ না পেয়ে অবশেষে শুধু আপনার জন্যই মাথার কেশ বিক্রি করে আহারের ব্যবস্হা করেছি।

 

হযরত আইউব (আঃ) জানতেন যে,,বিবি রহিমা (আঃ) কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। তাই তিনি জমিনে সিজদায় পড়ে গেলেন এবং মহান আল্লহর নিকট কেঁদে কেঁদে শিশু বাচ্চার ন্যায় ফরিয়াদ করতে লাগলেনঃ হে আল্লহ! আমি কঠিন ব্যাধিতে ভূগতেছি,প্রায় দীর্ঘ আঠার বৎসর অতিবাহিত হল। তোমার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি যে, তোমাকে ডাকার সুযোগ দান করেছ, তোমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে এর চেয়ে আরও কঠিন শাস্তি আমাকে দাও, আমি নিরবে সহ্য করবো কিন্তু ধনীর দুলালী আমার আদরের রাহিমাকে আর কত কষ্ট দিবে? হে আল্লহ! তুমিতো সর্বশক্তিমান, দয়ালু দাতা এবং পৃথিবীর সেরা ডাক্তার।

 

হযরত আইউব (আঃ) এর মোনাজাত কবুল হয়ে গেল। আল্লাহ তয়ালা ফেরেস্তাদিগকে ডেকে বললেন এইবার তোমরা বল, আমার আইউব কৃত পরীক্ষায় কামিয়াব হল কিনা? সকল ফেরেস্তা একবাক্যে স্বীকার করল যে, হে আল্লহ! আমাদের বিশ্বাস হয়েছে যে,হযরত আইউব (আঃ) সুখে দুঃখে সর্বদাই আপনার ইবাদত করবেন।

 

অতঃপর আল্লাহ হুকুমে সেখানে পানির নহর জারি হয়ে গেল। হযরত জিব্রাইল (আঃ) এসে বললেন হে নবী, আপনি এই নহরে গোসল করুন। নির্দেশ মোতাবেক তিনি গোসল করবার সাথে সাথে পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন।তারপর বিষয়- সম্পদ, ধন-দৌলত ফিরে পেয়ে সুখ-শান্তিতে দিন কাটিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থেকে দুনিয়া হতে বিদায় নিলেন।

 

(বি:দ্র: হযরত বিবি রহিমা শেষ নবী (সা:) এর কোন সাহাবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (আ:) এর স্ত্রী। বিবি রহিমা সর্বকালের সকল নারীর আদর্শ। সেই কারণেই আমরা এই ক্যাটাগরিতে তাঁর জীবনীকে রেখেছি।)


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url