কালোত্তীর্ণ এক জ্ঞানতাপস, ইতিহাসবিদ ও মুফাসসির আত-তাবারি


ইতিহাসবিদ আত-তাবারি, কালোত্তীর্ণ এক মুসলিম জ্ঞানতাপস

 

বর্তমান ইরানের কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে পারস্যের একটি পার্বত্য জেলা তাবারিস্তান। এই জেলারই আনমুল নামক স্থানে আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে জারির আত-তাবারি ৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে (২২৫ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত আত-তাবারি নামেই সমাধিক পরিচিত। জানা যায়, তাঁর জন্মের পূর্বে তাঁর বাবা একটি সুসন্তান লাভের স্বপ্ন দেখেন, যিনি মহানবীর (সা.) আইন ও হাদিস বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারক ও বাহক হবেন। বস্তুত এ কারণে তাঁর বাবা তাঁর বিদ্যার্জনের দিকে সুনজর দেন। জানা যায়, আত-তাবারি সাত বছর বয়সে কুরআন মুখস্ত করেন এবং নয় বছর বয়সে হাদিসশাস্ত্র আয়ত্ব করেন

 

জ্ঞানচর্চার জন্য তিনি জন্মস্থান ত্যাগ করে প্রথমে রাইয়ে আসেন। এখানে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষক মুহাম্মদ বিন হুমায়েদ-এর কাছে এক লক্ষ হাদিস শেখেন। এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে বাগদাদ ও বসরাতে অধ্যয়ন করেন। বসরা থেকে তিনি কুফা চলে আসেন। এখানে স্বনামধন্য হাদিসশাস্ত্রবিদ শেখ আবু কুরাই-এর কাছে আরও এক লক্ষ হাদিস অধ্যয়ন করেন। কুফা থেকে রওয়ানা দেন বাগদাদে। এখানে তিনি কুরআন ও আইনশাস্ত্র অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। তাঁর অগাধ জ্ঞান-তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তিনি পশ্চিমা বিশ্বে অগ্রসর হতে থাকেন। সিরিয়ার বিভিন্ন নগর-বন্দরে অবস্থান শেষে তিনি মিশরের ফুসতাতে পৌঁছেন। ফুসতাতে তিনি নামজাদা অতিথিপরায়ণ সাধক আলি বিন সারাজ-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। এই শিক্ষক আত-তাবারির ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কাব্যচর্চায় পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরিশেষে নিজ জন্মস্থান তাবারিস্তান ভ্রমণ শেষে বাগদাদে ঠাঁই নেন। এখানে ৯২৩ খ্রিস্টাব্দে (৩১০ হিজরি) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

জীবনের প্রথমদিকে আত-তাবারি জ্ঞান আহরণ এবং আরব ও মুসলিম ইতিহাস সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষাদান ও লেখনীতে মনোনিবেশ করেন। যদিও তিনি তেমন ধনী ছিলেন না, কিন্তু অর্থ উপার্জনের সুযোগ গ্রহণ করা থেকে সর্বদাই বিরত থেকেছেন। এমনকি আকর্ষণীয় সরকারি চাকরির প্রস্তাবও তিনি শ্রদ্ধাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 

কখনো নিজের জামা-কাপড় বিক্রি করে বা কখনও আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিল-এর (৮৪৭-৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) উজির উবায়দুল্লাহ বিন ইয়াহিয়া-এর ছেলেকে পড়িয়ে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেছেন বলে জানা যায়। বিনয়ী ও সরল স্বভাবের তাবারি অনেকটা অতিপ্রাকৃত মানুষের ন্যায় তাঁর বিশ্বকোষীয় জ্ঞান অন্যদের মধ্যে বিতরণের চেষ্টাই শুধু করেছেন।

 

বহুমুখী প্রতিভাধর আত-তাবারি ইতিহাস , ফিকহ ও কুরআনের ভাষ্য ছাড়াও কবিতা, ভাষা ও শব্দকোষ, ব্যাকরণ, নীতিবিদ্যা, এমনকি গণিত ও ঔষধশাস্ত্র সম্পর্কেও পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনী লিখেছেন। মিশর থেকে ৯০২-৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ফেরার দশ বছর পর তিনি শাফি মাযহাব অনুসরণ করতে থাকেন। পরে অবশ্য তিনি নিজে একটি ঘরানার বিকাশ ঘটান। এর অনুসারীদের তার নামানুসারে জারিরিয়াহ (Djaririyah) বলা হত।

 

আত-তাবারির সমগ্র রচনা আমাদের হস্তগত হয়নি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আইন ঘরানার নীতিমালা সংক্রান্ত তথ্যও পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে। তবে তাঁর লিখিত কুরআনের সুবিশাল তাফসির Djarni-al-Bayan-fi Tafsir-al-Kuran (কায়রো, ১৩৩১ হি.), নবী ও রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস সমৃদ্ধ তারিখ আল রসুল ওয়া আল মুলক, আইন বিষয়ক গ্রন্থ ইখতিলাফ, হাদিসগ্রন্থ তাহজিব আল আতহার (tahdhib al-at’har), বিচার সংক্রান্ত আল বাসিত (al-Basit) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের জীবন-রচিত সম্বন্ধীয় দায়্যাল আল মুদায়্যাল (Dayl al-Mudayyal) গ্রন্থাবলির সন্ধান মিলেছে । তাঁর লেখনী এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে, তাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর সামানি শাহজাদা মানসুর ৯৬৩ সালে তা ফারসিতে অনুবাদ করেন।

 

আত-তাবারির তাফসির গ্রন্থটি শুধু প্রাচীনতম তাফসির গ্রন্থই নয়, বরং বৃহত্তম ভাষ্যমূলক হাদিস সংকলনও বটে। এ গ্রন্থে আত-তাবারি প্রথমবারের মতো হাদিস সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশন করেছেন। এর উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী মুফাসসিরগণ তাদের রচনা সম্পন্ন করেছেন। একে অদ্যাবধি পাশ্চাত্যের পণ্ডিতবর্গ, ঐতিহাসিকগণ ও সমালোচকবৃন্দ গবেষণার তথ্যের খনি হিসেবে বিবেচনা করেন।

 

আত-তাবারির ইতিহাস বিষয়ক তারিখ আল রসুল ওয়া আল মুলুক (Annals of the Apostles and Kings) বিশ্ব-ইতিহাসের উপর রচিত একটি শীর্ষস্থানীয় মূল্যবান বিশালায়তন গ্রন্থ (monumental work)। আরবি ভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ বিশ্ব-ইতিহাসের ওপর রচিত এটিই প্রথম গ্রন্থ, যা পরবর্তী ইতিহাসবিদ, বিশেষ করে ইবনে মিশকাওয়াইহ (মৃ. ১০৩৭ খ্রি.), ইবুনল আসির (১১৬০-১২৩৪ খ্রি.), আবুল ফিদা (১২৭৩-১৩৩২ খ্রি.) প্রমুখের নিকট আকর গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ১৮৭৯-১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক ডে গয়েজে ও অন্যান্য অনেকের সম্পাদনায় প্রকাশিত বিদ্যমান পনের খণ্ডের এ গ্রন্থের লিডেন সংস্করণকে আত-তাবারির বিশালায়তন গ্রন্থের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। মূল গ্রন্থটি এর দশগুণ আয়তনের ছিল বলে জানা যায়। হিজরি ২৮৩-২৯০ এই আট বছরে লিখিত এ পুস্তকের পৃষ্ঠা সংখ্যা তিন হাজার।

 

বিশ্ব সৃষ্টির শুরু থেকে ৩০২ হিজরি/৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাক-ইসলামী আরব, মহানবীর (সা) জীবনী, খুলাফায়ে রাশিদীন, উমাইয়া ও আব্বাসি বংশ প্রভৃতি নিয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। আত-তাবারির শিষ্য আবু মুহম্মদ আল-ফারগানি এবং স্বনামধন্য ঐতিহাসিক আল হামাদানি (মৃ . ১১২৭ খ্রি.) আত-তাবারির লেখাকে ১০৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছেন।

 

আত-তাবারি তার যুগের সাহিত্যিক উপাদান, আবু মিখনাফ, উমর বিন শাব্বার, কিতাব আল আখবার আহল আল বসরা, নসর বিন মাজাহিম, মুহম্মদ ইসহাকের সিরাহ, আল ওয়াকিদি, ইবনে সা, হিশাম আল কালাবি, সাইফ বিন উমর, ইবনে তাইফুর প্রভৃতি তাঁর লেখনীতে ব্যবহার করেছেন । সাসানি যুগের ইতিহাসের জন্য তিনি মুখাফফার খুদাইনামাহ অনুকরণ করেছেন। তিনি তাঁর সুবিস্তৃত ভ্রমণকালে বাগদাদ ও অন্যান্য জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে শিক্ষা গ্রহণকালে অলিখিত মৌখিক তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা তার লেখনীতে ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণ মেলে। ইতিহাস-উপাত্ত সংগ্রহে ও সেসবের ব্যবহারে একাগ্রতা ও মননশীলতায় ইতিহাসচর্চার প্রতি আত-তাবারির অকৃত্রিম অনুরাগ ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাস-চর্চার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ও কষ্টসহিষ্ণুতার প্রমাণ মেলে তাঁর সম্পর্কে এ তথ্যে- আত-তাবারি দৈনিক চল্লিশ পৃষ্ঠা করে লিখতেন 

 

সমসাময়িক পাশ্চাত্য বিশ্বের দুজন নেতৃস্থানীয় ইতিহাসতত্ত্ববিদ হাইডেন হোয়াইটলা ক্যাপরার ন্যায় আত-তাবারির কাছে ইতিহাস হলো অতীত ঘটনা লিপিবদ্ধকরণ যা যুক্তিতর্ক বা প্রজ্ঞা নয়; বরং শুধু তথ্য বর্ণনার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হবে। তাঁর দৃষ্টিতে ইতিহাস হলো এর বিভিন্ন ধরনের ঘটনাবলির সংকলন। তিনি মনে করতেন, ঐতিহাসিক ইতিহাসের বিষয়বস্তুর পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যে নিজেকে জড়াবেন না এবং পাঠককে প্রভাবিত না করার লক্ষ্যে তিনি নিজ মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকবেন। আত-তাবারির দৃষ্টিতে কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনার মূল্য এর সনদের বলিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে। সনদ ঘটনার যত নিকটবর্তী হবে, তা ততই উৎকৃষ্ট বা নির্ভরযোগ্য। এজন্যই তিনি সতর্কতার সাথে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবি বা বর্ণনাকারীর কাছ থেকে ঐতিহাসিক উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।

 

আত-তাবারি কোনো একটি ঘটনা কিংবা বিষয়বস্তুর সমর্থনে বিভিন্ন রেওয়াত বা বর্ণনা পরিবেশন করেছেন। তবে লক্ষণীয় এই যে, এসবের উপস্থাপনায় তিনি নিজস্ব অভিমত পেশ করা থেকে সর্বদা বিরত থেকেছেন। এটা ইতিহাস রচনায় তার বস্তুনিষ্ঠতার স্বাক্ষ্য দেয়। বস্তুত সঠিক ও বিশ্বস্ত তথ্য উপস্থাপন আত-তাবারির লেখার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। গবেষকদের দৃষ্টিতে, আত-তাবারি প্রথম মুসলিম ঐতিহাসিক যিনি ইতিহাসে সর্বাত্মক বর্ষানুক্রমিক পদ্ধতিতে ঘটনাসমূহের উপস্থাপন করেছেন। বস্তুত ইতিহাস লিখন শাস্ত্রে ঘটনাক্রম রক্ষা একটি বড় শৈল্পিক দক্ষতা। আত-তাবারি তার লেখনীতে বেশ দক্ষতার সাথে হিজরি সনের কালানুক্রমিক ধারাবাহিকতায় ঘটনার বর্ণনা রীতি মেনে চলেছেন।

 

এটা নিশ্চিত যে, হিজরি দ্বিতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে মেসোপটেমিয়ার খবর লেখক হায়সুম বিন আদি ও অন্যান্য আরব লেখক, যেমন- আবু ইসা বিন আল মুহাজিম, উমারা বিন ওয়াতিমা প্রমুখের লেখনীতে তারিখ আল আস-সিনিন বা বর্ষভিত্তিক ইতিহাস রচনা পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল। এমনকি আত-তাবারির পূর্বে আল-ওয়াকিদিও বর্ষানুক্রমিক ধারায় ইতিহাস রচনা করেছেন। তবে আত-তাবারি নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে অধিক দক্ষতা ও বলিষ্ঠতার পরিচয় প্রদান করেছেন। তাঁরই প্রভাবে পরবর্তীতে মিশকাওয়াইহ (মৃ. ১০৩৭ খ্রি.), ইবনুল আসির (১১৬০-১২৩৪ খ্রি.), আবুল ফিদা (১২৩৭-১৩৩১ খ্রি.) ও আয জাহাবি (১২৭৪-১৩৪৮ খ্রি.) তাঁদের লেখনীতে বর্ষানুক্রমিক ধারায় ইতিহাস-লিখনকে জনপ্রিয় করেন।

 

আত-তাবারি তাঁর রচনায় ধর্মবেত্তাদের নীতিজ্ঞান ও অধ্যবসায়ী উদারতা, বিজ্ঞ বিচারকের নির্ভুলতা ও সহানুভূতি এবং সক্রিয় আইনজ্ঞ রাজনীতিকের গণসচেতন রাজনীতির বিশেষ জ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। ইতিহাস লেখার এসকল মৌলিক বৈশিষ্ট্য গোঁড়া ইসলামি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আত-তাবারিকে সহনীয় ও ক্রমবর্ধিষ্ণু সম্মান এনে দিয়েছে। তাই এটা স্বাভাবিক যে, ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের জন্য আত-তাবারির লেখনী একটি মানদণ্ড হিসেবে অগাধ প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে।

 

আত-তাবারির ইতিহাস গ্রন্থের সম্পাদক ডি গয়েজে বলেন, তাবারির গ্রন্থের স্বাতন্ত্র্যের প্রতিফলন ঘটেছে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণীতে, নির্ভুল উপস্থাপনায় ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যে। এ গ্রন্থের আগাগোড়া এসবের প্রতিফলন ঘটেছে বিধায় ঐতিহাসিক ও ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি মূল্যবান তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচ্য।

 

তাঁর ইতিহাস উপস্থাপনা ও লেখনীর পদ্ধতি বিশ্লেষণে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। প্রাক-ইসলামি ইতিহাস বর্ণনায় ইসলামীকরণকৃত বাইবেলীয় ইতিহাস এবং আরব-পারসিক ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে সমন্বয়করণের প্রয়াস লক্ষণীয়। মহানবীর (সা.) জীবন ও কর্ম বর্ণনায় সিরাহ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। হিজরত পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ধারাবাহিকভাবে বর্ষানুক্রমিক রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তবে অন্যত্র একক কোনো বছরের ঘটনা উপস্থাপনায় খবর পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। এখানে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্য-উৎস ও বর্ণনাকারী বা রাবির ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

 

আত-তাবারি তার বর্ণনায় কোনো বছরের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহকে অধিকার ভিত্তিতে উপস্থাপন করেছেন। শাসকদের চরিত্র বর্ণনার উপর তাঁর বক্তব্য খুব কমই প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্যক্তি বা শাসকদের পরিচয়মূলক বিবরণী তাদের শাসনকালের শেষাংশে জীবনী আকারে দেয়া হয়েছে। প্রতীয়মান হয় যে, সরকারি ব্যক্তিবর্গের পরিচয় প্রদানের গুরুত্ব, অন্যান্য ঐতিহাসিকদের তুলনায় ধর্মবেত্তা আত-তাবারির নিকট খুবই কম বলে বিবেচিত হয়েছিল।

 

বাগদাদীয় বিদ্যাকেন্দ্রের তথা কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আত-তাবারির লেখনীতে অনেকটা স্পষ্ট। উল্লেখ্য, আব্বাসীয় বংশ সম্পর্কে বর্ণনাও ঘটনাক্রমে দেয়া হয়েছে মাত্র। এখানে লক্ষণীয় যে, ইতিহাস প্রসিদ্ধ খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্যান্য সমসাময়িক মৃত ব্যক্তির জীবনী আত-তাবারির রচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

 

তারিখ বা সময় সচেতনতা, ইতিহাস-উপাত্ত বা তথ্যসমূহের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর ব্যাপারে কুফার ঐতিহাসিক সাইফ বিন উমর-এর (মৃ. ৭৯৬ খ্রি.) নীতির অনুকরণে স্বচ্ছ ইতিহাস রচনার প্রয়াস তাবারির লেখনীকে নিঃসন্দেহে, উন্নত মান প্রদান করেছে। আধুনিক গবেষকগণ, বিশেষ করে গিব, মার্গোলিয়থ, এফ রজেন্থাল প্রমুখ আত-তাবারির ইতিহাস রচনায় কতিপয় ঘাটতি বা দুর্বলতা লক্ষ্য করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হলো-

 

·        ইতিহাস বর্ণনায় হাদিসবেত্তাদের রীতির প্রয়োগ

·        ইতিহাস-উৎস হিসেবে সরকারি দলিলদস্তাবেজ ও ব্যক্তিবর্গের দেয়া তথ্যকে প্রাধান্য দেয়া

·        মুসলিমদের বিভিন্ন বিজয়কাহিনী, বিশেষ করে স্পেন বিজয় সম্পর্কে অপ্রতুল তথ্য পরিবেশনা

·        তাঁর জীবদ্দশায় সংঘটিত সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলী ও বিবরণীর বলয়কে সম্প্রসারিত না করা প্রভৃতি। 

 

এসব ছাড়াও গুস্তাভ রিখটার বলেন, আত-তাবারির লেখনীতে এমন কিছু বিষয়বস্তু ঠাঁই পেয়েছে যা বিশ্ব-ইতিহাস রচনার প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক। আর. এ. নিকলসনের বিবেচনায় তাঁর লেখনী আধুনিক যুগের মূল দলিলাদির আলোকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা কোনো ইতিহাস গ্রন্থের মতো নয় বটে, তবে এর মনোযোগী অধ্যয়নে অসংখ্য গুরুত্বহীন ঘটনার মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে তাজা প্রাণ নিয়ে একটি মূল্যবান বিষয় উদ্ভাসিত হয়।

 

বস্তুত, আত-তাবারি আল ওয়াকিদির চেয়ে আখবারিদের, বিশেষ করে সাইফ বিন উমরের কাছ থেকে বেশি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর কারণ অবশ্য এই যে, আল ওয়াকিদি ইহুদি উৎসাদি-নির্ভর ইতিহাস রচনা করেছেন। গিব যথার্থই মন্তব্য করেছেন,

 

তাবারির চরম উৎকর্ষের দিক হলো তাঁর প্রামাণিকতা ও সর্বাত্মকতা, যা চলমান একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। পরবর্তী যেকোনো ইতিহাসবিদই ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস রচনার জন্য নতুন উপকরণ সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করার কাজে এত গভীর আত্মনিয়োগ করেননি। বরং তারা হয় আত-তাবারির (কখনো অবশ্য সম্পূরক হিসেবে আল বালাজুরির) সারবস্তু নিয়েছেন, না হয় যেখানে তাবারি শেষ করেছেন, এরপর থেকে তারা শুরু করেছেন।

 

সবকিছু বিবেচনা করে জর্জ সার্টন (১৯২৭ খ্রি.) তাঁকে প্রকৃত অর্থেই 'সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক' (The greatest historian) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

 


**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url