প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১২]




দ্বীনের দাওয়াতের জন্য প্রিয় নবীর (সা:) উপর সীমাহীন অত্যাচার


প্রতিবেশীদের অত্যাচার

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন তাঁর চাচা আবু লাহাব। তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও কষ্টদানকারী অন্যান্য প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, ‘আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৫-১৬)। ইনিই ছিলেন উমাইয়া বংশের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদ বাদে মারওয়ানের বংশধরগণই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের পরপর খলীফা। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। তাতে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوْذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ‘তোমার পূর্বের বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু এ মিথ্যারোপে তারা ছবর করেছেন এবং তারা নির্যাতিত হয়েছেন যতক্ষণ না তাদের কাছে আমাদের সাহায্য এসে পৌঁছেছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। এ বিষয়ে নবীগণের কিছু খবর তোমার নিকটে পৌঁছে গেছে (যার মধ্যে তোমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে)’ (আন‘আম ৬/৩৪)।[১]

[১]. প্রসিদ্ধ আছে যে, প্রতিবেশীরা যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি রাসূল (ছাঃ)-এর বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত। রাসূল (ছাঃ) সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে বলতেন يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ، أَيُّ جِوَارٍ هَذَا؟ ‘হে বনু ‘আব্দে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ? এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৬; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৭)। বর্ণনাটি মওযূ‘ বা জাল (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪১৫১)।

কা‘বাগৃহে সালাতরত অবস্থায় কষ্টদান

(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-

‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[1] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।[২]

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।

উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন। কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।[৩] অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।[৪]

(খ) একদিন সালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (ছাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।

ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।

রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাজার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-

‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।

আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।[৫]

[১]. বুখারী হা/৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব ও অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
[২]. মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০, ১/৪১৭ পৃঃ; মা শা-‘আ ৫০ পৃঃ।
[৩]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[৪]. বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৮৩৩।
[৫]. মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।

সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া

এ ব্যাপারে অন্যতম প্রতিবেশী উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করতেন। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ)-কে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে-তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করতেন এবং তাঁকে অভিশাপ দিতেন। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য’ (হুমাযাহ ১০৪/১)।[১]

[১]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; কেউ অন্য নেতাদের নামও বলেছেন। সনদ ‘মুরসাল’ (তাফসীর কুরতুবী, তাহকীক উক্ত আয়াত)।

রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করা

(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, তার সাথী ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল’। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়,وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً (27) يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً (28) لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- (الفرقان 27-29) ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্তুতঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।[১]

(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতাইবা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত(وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى...ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি, বলেই সে হেঁচকা টানে রাসূল (ছাঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূল (ছাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূমকে তালাক দেয়। তার ভাই উৎবা একইভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর অপর কন্যা রুক্বাইয়াকে তালাক দেয়। পরে যার বিয়ে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে উম্মে কুলছূমের সাথে ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন,اللهُمَّ سَلِّطْ عَلَيْهِ كَلْبًا مِنْ كِلاَبِكَ ‘হে আল্লাহ! তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’।[২]

উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কবি হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) কবিতা রচনা করেন। কিছুদিন পরে উতাইবা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠে,هَذَا وَاللهِ آكِلِي كَمَا قَالَ مُحَمَّدٌ، قَاتِلِي ابْنُ أَبِي كَبْشَةَ وَهُوَ بِمَكَّةَ وَأَنَا بِالشَّامِ ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যাকারী। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। অতঃপর বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল’।[৩]

[১]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৯৭৩১; ইবনু হিশাম ১/৩৬১; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক-৩৫২, আছার ছহীহ; আর-রাহীক্ব ৮৮ পৃঃ।
[২]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৮; হাকেম হা/৩৯৮৪, হাকেম ছহীহ বলেছেন, যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।
[৩]. কুরতুবী হা/৫৬৯০; আবু নু‘আইম ইছফাহানী, দালায়েলুন নবুঅত হা/৩৮১; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৯৮২০; কুরতুবীর মুহাক্কিক বলেন, হাদীছটি একদল তাবেঈ কর্তৃক ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণিত। তবে এগুলির সমষ্টি বর্ণনাটিকে শক্তিশালী করে’ (দ্রঃ কুরতুবী, তাফসীর সূরা নাজম ১ আয়াত)।

মুখে পচা হাড়ের গুঁড়া ছুঁড়ে মারা

উবাই বিন খালাফ নিজে একবার পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি ধারণা কর যে, একটা মানুষ মরে পচে-গলে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে হাতে রাখা পচা হাড়ের গুঁড়া তাঁর মুখের উপরে ছুঁড়ে মারে’ (ইবনু হিশাম ১/৩৬১-৬২)। যেমন আল্লাহ বলেন,وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ؟ قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ‘মানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, হাড়গুলিতে কে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন ওটা পচে-গলে যাবে?’ ‘বলে দাও, ওগুলিকে জীবিত করবেন তিনি, যিনি প্রথমবার সেগুলিকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সকল বিষয়ে সুবিজ্ঞ’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৮-৭৯)। এছাড়া এ প্রেক্ষিতে সূরা মারিয়াম ৬৬, ক্বাফ ৩ ও অন্যান্য আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যদিও শানে নুযূল হিসাবে বর্ণিত ঘটনাসমূহের সনদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘মুরসাল’। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিভিন্ন প্রশ্ন ও ঘটনার প্রেক্ষিতেই কুরআনের অধিকাংশ আয়াত নাযিল হয়েছে, যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর অন্তরে প্রশান্তি আসে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْلاَ نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً كَذَلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيْلاً- وَلاَ يَأْتُوْنَكَ بِمَثَلٍ إِلاَّ جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيْرًا ‘কাফেররা বলে যে, কেন কুরআন তাঁর প্রতি একসাথে নাযিল হল না? এমনিভাবেই আমরা এটি নাযিল করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি, যাতে আমরা তোমার অন্তরকে দৃঢ় করতে পারি’। ‘তারা তোমার নিকটে কোন সমস্যা উত্থাপন করলেই আমরা তার সঠিক জওয়াব ও সুন্দর ব্যাখ্যা দান করে থাকি’ (ফুরক্বান ২৫/৩২-৩৩)।

মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা একজন ব্যক্তি ছিল, যে ছিল জারজ সন্তান। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। ঐ নেতার নাম সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, আখনাস বিন শারীক্ব ছাক্বাফী, কেউ বলেছেন, অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী ইত্যাদি (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। তবে শেষোক্ত নামটিই অধিক প্রসিদ্ধ। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব ও ইকরিমা বলেন, এই ব্যক্তি ছিল ব্যভিচারের সন্তান। সে কুরায়েশ বংশজাত ছিল না। ১৮ বছর পরে জনৈক ব্যক্তি তার পিতৃদাবী করে’ (কুরতুবী)। আল্লাহপাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন,

وَلاَ تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ- (القلم ১০-১৩)-

‘তুমি কথা শুনবে না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিক বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং এরপরেও সে একজন জারজ সন্তান’ (ক্বলম ৬৮/১০-১৩)।

তার এই বাড়াবাড়ির কারণ ছিল তার অতুল বিত্ত-বৈভবের অহংকার। যেমন আল্লাহ বলেন,

أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِيْنَ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- سَنَسِمُهُ عَلَى الْخُرْطُوْمِ-

‘আর এটা এ কারণে যে, সে ছিল বহু মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মালিক’। ‘যখন তার সম্মুখে আমাদের আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, এসব পুরাকালের কাহিনী’। ‘সত্বর আমরা তার নাসিকা দাগিয়ে দেব’ (ক্বলম ৬৮/১৪-১৬)। হাতী বা শূকরের শুঁড়কে আরবীতে ‘খুরতূম’ বলা হয়। এখানে ঐ ব্যক্তির নাম সম্পর্কে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তার হীনতা ও নিকৃষ্টতা প্রকাশ করার জন্য। ক্বিয়ামতের দিন তার নাকে খৎ দিয়ে নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করা হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত থেকে নাক সিঁটকিয়েছিল। ফলে ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী। কেননা সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন সর্বসমক্ষে চিহ্নিত করা হবে। نعوذ بالله من غضبه وقهره

কুরআন শোনার পর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া-
এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহ্ল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তার কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? এ যুগের বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ পন্ডিত ও জ্ঞানপাপী মুসলমানদের অবস্থাও ঠিক অনুরূপ। যারা দিনরাত রাসূল (ছাঃ) কুরআন ও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে মূলতঃ অন্যকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য। লোকেরা ভাবে, তারা বড় বড় জ্ঞানী। তারা কি কিছুই বুঝেন না? অথচ তারা এ ব্যাপারে একেবারেই গোমূর্খ। আবু জাহ্লের এই কপট ও উদ্ধত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে-فَلاَ صَدَّقَ وَلاَ صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى ‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩১-৩৩)। এক বর্ণনায় এসেছে যে, এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) আবু জাহ্লকে লক্ষ্য করে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন,أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ثُمَّ أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى ‘তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’। ‘অতঃপর তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩৪-৩৫)।[১]
[১]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বিয়ামাহ ৩৪-৩৫ আয়াত।

কা‘বায় সালাত আদায়ে বাধা

(ক) নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই সালাত ফরয হয়। তবে তখন ছালাত ছিল কেবল ফজরে ও আছরে দু’ দু’ রাক‘আত করে (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে (অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে)’।[১] আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[২] এছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।[৩]

প্রথম দিকে সবাই সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বাগৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল,يَا مُحَمَّدُ، أَلَمْ أَنْهَكَ عَنْ هَذَا؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব থেকে নিষেধ করিনি?’

তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,يَا مُحَمَّدُ بِأَيِّ شَيْءٍ تُهَدِّدُنِي؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَكْثَرُ هَذَا الْوَادِي نَادِيًا ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ হে মুহাম্মাদ? আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে ভারি। তখন আল্লাহ সূরা ‘আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেন।[৪]

كَلاَّ إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى- كَلاَّ لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلاَّ لاَ تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ- (العلق ৬-১৯)-

‘কখনোই না। নিশ্চয়ই মানুষ সীমালংঘন করে’ (৬)। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (৭)। ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের নিকটেই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (৮)। ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে (আবু জাহলকে) যে নিষেধ করে?’ (৯)। ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে), যখন সে ছালাত আদায় করে’ (১০)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে’ (১১)। ‘অথবা আল্লাহভীতির আদেশ দেয়’ (১২)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (১৩)। ‘সে কি জানেনা যে, আল্লাহ তার সবকিছুই দেখেন’ (১৪)। ‘কখনোই না। যদি সে বিরত না হয়, তবে আমরা অবশ্যই তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে সজোরে টান দেব’(১৫)। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (১৬)। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’ (১৭)। ‘আমরাও অচিরে ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’ (১৮)। ‘কখনোই না। তুমি তার কথা শুনবে না। তুমি সিজদা কর এবং আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-১৯)।

আবু জাহ্ল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে একটি সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।[৫] আর এটাই হ’ল কুরআনের ১৫তম ও সর্বশেষ সিজদার আয়াত’ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭)। উল্লেখ্য যে, এই সিজদার জন্য ওযূ, কিবলা বা সালাম করা শর্ত নয়।

উপরোক্ত ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরদর্শী কাফের-মুশরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই বেশী ভয় পায়। যদিও তারা মুখে বলে যে, ধর্মের ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হ’ল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। অথচ নেতারা ভালভাবেই জানেন যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই তিনি মূল জায়গাতেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হ’লে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দিবে না। অথচ অসীলাপূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছুর চাবিকাঠি। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। সেদিন যেমন কা‘বার পাশেই মূর্তিপূজা হ’ত, এখন তেমনি মসজিদের পাশেই কবরপূজা হয় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেওয়া হয়। ধর্মের নামে এইসব ধর্মনেতারা ধার্মিক মুসলমানদের তাওহীদ থেকে ফিরিয়ে শিরকমুখী করে। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে দ্বীনদার মুসলিম নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।

(খ) সূরা ‘আলাক্ব-এর উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হ’লেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলেন। একদিন তিনি কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসেন, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে ছালাতরত দেখি, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সেখানে ছালাতরত অবস্থায় দেখলেন। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসকে দিল। ফলে তিনি খুব আস্ফালন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছেন’। পিছিয়ে এসে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَوْ دَنَا مِنِّى لاَخْتَطَفَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ عُضْوًا عُضْوًا ‘যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহ’লে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[৬] আশ্চর্যের বিষয়, এতবড় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উপর আল্লাহর সরাসরি সাহায্য প্রত্যক্ষ করেও আবু জাহ্ল তার হঠকারিতা থেকে পিছিয়ে আসেননি কেবলমাত্র নেতৃত্বের অহংকারে স্ফীত হওয়ার কারণে। নমরূদ, ফেরাঊন ও আবু জাহল সহ যুগে যুগে সকল হঠকারী নেতাদের চরিত্র একই।

(গ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো(المكاء والةصدية عند الصلاة فى الكعبة) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বাগৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর বায়তুল্লাহ্র নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা অবিশ্বাসের শাস্তি আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)।

(ঘ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিলেন যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- (فصلت ২৬-২৭)-

‘আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা বিজয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের নিকৃষ্টতম বদলা দেব’ (ফুছসালাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)। এছাড়াও তারা নানাবিধ গালি দিত। তখন নাযিল হয়-وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আর তুমি তোমার ছালাতের ক্বিরাআতে স্বর অধিক উঁচু করো না বা একেবারে নীচু করো না। বরং দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর’ (ইসরা ১৭/১১০)।[৭]

[১]. গাফির/মুমিন ৪০/৫৫; মির‘আত ২/২৬৯।
[২]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।
[৩]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।
[৪]. ত্বাবারী, তাফসীর ‘আলাক্ব ১৮ আয়াত; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৫; তিরমিযী হা/৩৩৪৯।
[৫]. মুসলিম হা/৫৭৮; বুখারী হা/১০৭৪; মিশকাত হা/১০২৪ ‘সুজূদুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।
[৬]. ইবনু হিশাম ১/২৯৯ টীকা -৪; মুসলিম হা/২৭৯৭, মিশকাত হা/৫৮৫৬।

ইবনু ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) সিজদায় গেলে আবু জাহ্ল পাথর উঠিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই দ্রুত ভয়ে পিছিয়ে এল। এ সময় তার হাতের পাথরখন্ডটা এমনভাবে চিমটি লেগে গেল যে, সে তা হাত থেকে ছাড়াতে পারছিল না। লোকেরা তার অবস্থা কি জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, একটা ভয়ংকর উট আমাকে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জিব্রীল স্বয়ং উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে তাকে ভয় দেখিয়েছিল। কাছে এলে তাকে ধরে নিত’ (ইবনু হিশাম ১/২৯৮; বায়হাক্বী দালায়েল ৪/১৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৯)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৮-৪৯)। এ ব্যাপারে ছহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।
[৭]. বুখারী হা/৭৪৯০; মুসলিম হা/৪৪৬; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১১০ আয়াত।

সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন

নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’তেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হ’ত, তাহ’লে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে লূতের কওমের মত গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম কবুল করা হ’তে পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ قَالُوْا اللهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ- (الأنفال ৩২-৩৩)-

‘আর স্মরণ কর, যখন তারা প্রার্থনা করেছিল, যদি এই ব্যক্তি (মুহাম্মাদ) সত্য (নবী) হয়ে থাকে তোমার পক্ষ হতে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর অথবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও’। ‘অথচ আল্লাহ কখনো তাদের উপর শাস্তি নাযিল করবেন না যতক্ষণ তুমি (হে মুহাম্মাদ!) তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যতক্ষণ তারা (অর্থাৎ মক্কার দুর্বল মুসলিমরা) ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে’।[১]

অথচ একবার গযব নেমে এলে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। যেমন পূর্ববতী নবীগণের অবাধ্য উম্মতসমূহের অবস্থা হয়েছে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজ উম্মতের জন্য সেটা কখনোই চাননি।

আয়াত দু’টির মর্মকথা (مغزى الآييتين المذكورتين) :

প্রথম আয়াতে কাফের নেতাদের একটি কূট কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাদের বুঝার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন। প্রতিটি অপরাধের কারণে যখন-তখন গযব নাযিল করে তাদের ধ্বংস করেন না। যেমন আল্লাহ ফেরাঊনের মত দুরাচারকেও অন্যূন বিশ বছরের মত সময় দিয়েছিলেন এবং নানা প্রকার গযব নাযিল করেও যখন সে তওবা করেনি, তখন তাকে সদলবলে ডুবিয়ে মারেন। মক্কার কাফিররাও ভেবেছিল যেহেতু গযব নাযিল হচ্ছে না, অতএব আমরা ঠিক পথে আছি। মুহাম্মাদ নিজে ধর্মত্যাগী হয়েছে এবং সে আমাদের জামা‘আতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।

বস্ত্ততঃ যুগে যুগে কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা নিজেদেরকে সঠিক এবং সংস্কারবাদী নেতাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে দাবী করেছে। মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ফেরাঊন তার লোকদের একই কথা বলে বুঝিয়েছিল যে,وَمَا أَهْدِيْكُمْ إِلاَّ سَبِيْلَ الرَّشَادِ ‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। আর মূসা (আঃ) সম্পর্কে সে বলল,وَإِنِّيْ لاَظُنُّهُ كَاذِباً ‘আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি’ (মুমিন/গাফের ৪০/৩৭)। সে ধর্ম রক্ষা ও দেশে শান্তি রক্ষার দোহাই দিয়ে তাকে হত্যা করার অজুহাত সৃষ্টি করে বলেছিল,ذَرُوْنِيْ أَقْتُلْ مُوْسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّيْ أَخَافُ أَنْ يُّبَدِّلَ دِيْنَكُمْ أَوْ أَنْ يُّظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ ‘তোমরা আমাকে ছাড়, আমি মূসাকে হত্যা করব। ডাকুক, সে তার রবকে। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনকে পরিবর্তন করে দেবে এবং সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬)। মক্কার নেতারা একই কথা বলেছিল। তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ ‘ধর্মত্যাগী এবং ‘কাযযাব’ (كذَّاب) অর্থাৎ ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল।[২] আর সেকারণ তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

যুগে যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কূট কৌশল অবলম্বন করে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার আলেমদের অত্যাচারিত হওয়াকে তাদের ভ্রান্ত হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! তুমি তাদের মধ্যে অবস্থান করবে অথবা তোমার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আমরা তাদের উপর গযব নাযিল করব না। কারণ একজন নবী বা ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সকল বিশ্ববাসীর চাইতে বেশী। এ কারণেই হাদীছে এসেছে,لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللهُ اللهُ ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।[৩]

বস্ত্ততঃ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের উপরে সে গযবই নাযিল হয়েছিল। কেননা যে দুনিয়ার লোভে তারা ইসলামকে সত্য জেনেও তার বিরোধিতায় জীবনপাত করেছিল, সেই দুনিয়াবী নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় মক্কা বিজয়ের দিন এবং সেদিন তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। নিজেদের জীবদ্দশায় বিনা যুদ্ধে এরূপ মর্মান্তিক পতন প্রত্যক্ষ করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী শাস্তি নয় কি? বরং আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণে নিহত হওয়ার চাইতে এটিই ছিল কুরায়েশ নেতাদের জন্য আরও কঠিন গযব ও হৃদয়বিদারক শাস্তি। যুগে যুগে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়েছে। আজও হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। প্রয়োজন কেবল ঈমানদার ও নিঃস্বার্থ নেতা এবং যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দল।

আল্লাহর সান্ত্বনা বাণী (كلماة الةسلية من الله تعالى) :

আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلاَّ سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلاَغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلاَّ الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ‘অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল (তোমার পূর্বেকার) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর অবিশ্বাসীদের জন্য (শাস্তি প্রার্থনায়) ব্যস্ততা প্রদর্শন করো না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা সেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে। সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিবসের কিছুক্ষণের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটি তাদের জন্য খবর পৌঁছানো হ’ল মাত্র। আর পাপাচারী সম্প্রদায় ব্যতীত কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কি?’(আহক্বাফ ৪৬/৩৫)।

[১]. আনফাল ৮/৩২-৩৩; ইবনু হিশাম ১/৬৭০।
[২]. ইবনু হিশাম ১/২৬৭; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮২, ৯৭।
[৩]. মুসলিম হা/১৪৮; আহমাদ হা/১৩৮৬০ ‘মুসনাদে আনাস’; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিৎনাসমূহ’ অধ্যায়, ৭ অনুচ্ছেদ।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
১. সত্য প্রতিষ্ঠায় মূল নেতাকেই আদর্শ হিসাবে সম্মুখে এগিয়ে আসতে হয়।
২. সংস্কারক নেতা উচ্চ বংশের ও সৎকর্মশীল নেককার পিতা-মাতার সন্তান হয়ে থাকেন।
৩. সংস্কারক নিজ ব্যক্তিজীবনে তর্কাতীতভাবে সৎ হন।
৪. সংস্কারক কখনোই অলস ও বিলাসী হন না।
৫. সংস্কারের প্রধান বিষয় হ’ল মানুষের ব্যক্তিগত আক্বীদা ও আমল।
৬. শিরকের সঙ্গে আপোষ করে কখনোই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
৭. সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হ’লেই তার বিরোধিতা অপরিহার্য হবে।
৮. ইসলামী সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী হবে স্বার্থান্ধ ধর্মনেতা ও সমাজ নেতারা।
৯. যাবতীয় গীবত-তোহমত ও অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করার জন্য সংস্কারককে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
১০. সংস্কারককে পুরোপুরি মানবহিতৈষী হ’তে হবে।
১১. স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে ময়দানে নামতে হবে।
১২. আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল মানবতার প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব- দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে।
১৩. নেতাকে অবশ্যই নৈশ ইবাদতে অভ্যস্ত হ’তে হবে এবং ফরয ও সুন্নাত সমূহ পালনে আন্তরিক হ’তে হবে।
১৪. নেতাকে যাবতীয় দুনিয়াবী লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।
১৫. সকল কাজে সর্বদা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে ও তাঁর কাছেই বিনিময় চাইতে হবে।



******************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url