প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-২৯]





পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ঐতিহাসিক বিজয় এবং পূর্বাপর প্রতিক্রিয়া

বদর যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী

(১) বদর যুদ্ধে যাত্রা পথে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (ছাঃ), আলী ও আবু লুবাবা ইবনুল মুনযির এবং পরবর্তীতে তার বদলে মারছাদ বিন আবু মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এসময় সাথীগণ নিজেরা হেঁটে তাঁকে উটে সওয়ার থাকার অনুরোধ করেন। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا أَنْتُمَا بِأَقْوَى مِنِّى وَلاَ أَنَا بِأَغْنَى عَنِ الأَجْرِ مِنْكُمَا ‘তোমরা দু’জন আমার চাইতে শক্তিশালী নও এবং আমিও নেকী পাওয়ার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে কম মুখাপেক্ষী নই’।[1]

(২) বেলাল (রাঃ)-কে নির্যাতনকারী মনিব এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারী নরাধম উমাইয়া বিন খালাফ-এর সাথে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর জাহেলী যুগে চুক্তি ছিল যে, তিনি মক্কায় তার লোকদের রক্ষা করবেন এবং আব্দুর রহমান মদীনায় উমাইয়ার লোকদের রক্ষা করবেন। সেকারণ যুদ্ধ শেষে তিনি উমাইয়া ও তার ছেলেকে পাহাড়ের একটি গুহায় লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু যেভাবেই হোক সেটি বেলালের নযরে পড়ে যায়। ফলে তিনি একদল আনছারের সামনে গিয়ে চীৎকার দিয়ে বলে উঠেন, ওহে আল্লাহর সাহায্যকারীগণ! শীর্ষ কাফের উমাইয়া এখানে। হয় আমি থাকব, নয় সে থাকবে’। তার ডাকের সাথে সাথে চারদিক থেকে সবাই এসে তাকে ঘিরে ফেলল। আব্দুর রহমান শত চেষ্টা করেও তাকে রক্ষা করতে পারলেন না। ফলে পিতা-পুত্র দু’জনেই সেখানে নিহত হ’ল। এতে আব্দুর রহমান-এর পা যখমী হয়।[2]

(৩) তিনদিন অবস্থানের পর বিদায়কালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার মৃত নেতাদের উদ্দেশ্যে কূয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একে একে পিতা সহ তাদের নাম ধরে ডেকে বলেন,

يَا فُلاَنُ بْنَ فُلاَنٍ، وَيَا فُلاَنُ بْنَ فُلاَنٍ، أَيَسُرُّكُمْ أَنَّكُمْ أَطَعْتُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّا قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا، فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا؟ قَالَ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللهِ، مَا تُكَلِّمُ مِنْ أَجْسَادٍ لاَ أَرْوَاحَ لَهَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ –صلى الله عليه وسلم – وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ. قَالَ قَتَادَةُ أَحْيَاهُمُ اللهُ حَتَّى أَسْمَعَهُمْ قَوْلَهُ تَوْبِيخًا وَتَصْغِيرًا وَنَقِيمَةً وَحَسْرَةً وَنَدَمًا-

‘হে অমুকের পুত্র অমুক! হে অমুকের পুত্র অমুক! তোমরা কি এখন বুঝতে পারছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে তোমরা আজ খুশী হতে? নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে (বিজয়ের) ওয়াদা দিয়েছিলেন, আমরা তা সত্যরূপে পেয়েছি। তোমরা কি তা সত্যরূপে পেয়েছ যা তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে (আযাবের) ওয়াদা করেছিলেন? এ সময় ওমর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন দেহগুলির সাথে কথা বলছেন, যাদের মধ্যে রূহ নাই। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’।

এর ব্যাখ্যায় ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তাদেরকে (সাময়িকভাবে) জীবিত করেন, যাতে তারা নবীর ধিক্কারবাণীগুলি শুনতে পায় ও লজ্জিত হয়’ (বুখারী হা/৩৯৭৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রাঃ) বলেন, يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ يَسْمَعُوا وَأَنَّى يُجِيبُوا وَقَدْ جَيَّفُوا قَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ وَلَكِنَّهُمْ لاَ يَقْدِرُونَ أَنْ يُجِيبُوا ‘ওরা কিভাবে শুনবে এবং ওরা কিভাবে জওয়াব দিবে। অথচ ওরা মরে পচে গেছে’। জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা ওদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’। কিন্তু ওরা জওয়াব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا رَسُولَ اللهِ أَتُنَادِيهِمْ بَعْدَ ثَلاَثٍ وَهَلْ يَسْمَعُونَ؟ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ (إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى). فَقَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ مِنْهُمْ وَلَكِنَّهُمْ لاَ يَسْتَطِيعُونَ أَنْ يُجِيبُوا ‘হে আল্লাহর রাসূল! তিন দিন পরে আপনি ওদের ডাকছেন। ওরা কি শুনতে পাবে? অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারো না কোন মৃতকে’ (নামল ২৭/৮০; রূম ৩০/৫২)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি’। কিন্তু ওরা জওয়াব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না’ (আহমাদ হা/১৪০৯৬, সনদ ছহীহ)।

উক্ত বিষয়ে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্বাতাদাহ (রাঃ) ঐসব ব্যক্তিগণের প্রতিবাদে উপরোক্ত কথা বলেছেন, যারা বদরে মৃত কাফিরদের রাসূল (ছাঃ)-এর আহবান শুনতে পাওয়াকে অস্বীকার করে’ (ফাৎহুল বারী হা/৩৯৭৬-এর ব্যাখ্যা)। ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, ক্বাতাদাহ (রাঃ)-এর ব্যাখ্যায় বুঝা যায় যে, ঐ সময় তাদেরকে জীবিত করার বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘খাছ’ ছিল। কিন্তু এটি জমহূর বিদ্বানগণের মতামতের বিরোধী (মিরক্বাত)।

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় আয়েশা (রাঃ) বলেন,وَالنَّاسُ يَقُولُونَ لَقَدْ سَمِعُوا مَا قُلْتَ لَهُمْ وَإِنَّمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَدْ عَلِمُوا ‘লোকেরা বলে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তারা অবশ্যই শুনেছে যা তুমি তাদের বলছ। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তারা জানতে পারবে’ (আহমাদ হা/২৬৪০৪ সনদ হাসান)। তিনি বলেন, مَا قَالَ إِنَّهُمْ لَيَسْمَعُونَ مَا أَقُولُ إِنَّمَا قَالَ إِنَّهُمُ الآنَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّ مَا كُنْتُ أَقُولُ لَهُمْ حَقٌّ. ثُمَّ قَرَأَتْ (إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى)، (وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِى الْقُبُورِ). تَقُولُ: حِينَ تَبَوَّءُوا مَقَاعِدَهُمْ مِنَ النَّارِ ‘রাসূল (ছাঃ) বলেননি, যা আমি বলছি তা অবশ্যই তারা শুনছে। বরং তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই তারা এখুনি জানতে পারবে, যা আমি তাদেরকে বলতাম (কবরের আযাব বিষয়ে), তা সত্য। অতঃপর তিনি আয়াত দু’টি পাঠ করেন (নমল ২৭/৮০) এবং (ফাত্বির ৩৫/২২)। তিনি বলেন, (তারা জানবে) যখন তাদেরকে জাহান্নামে তাদের ঠিকানায় পৌছানো হবে’।[4] মূলতঃ জীবিতদের শোনানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। যাতে যুগ যুগ ধরে কাফির-মুনাফিকরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।

(৪) আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, হারেছাহ বিন সুরাক্বা আনছারী তরুণ বয়সে বদর যুদ্ধে নিহত হন। তার মা এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে হারেছার অবস্থান সম্পর্কে বলবেন কি? যদি সে জান্নাতে থাকে, তাহ’লে আমি ছবর করব এবং ছবরের বিনিময়ে ছওয়াব কামনা করব। আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহ’লে বলুন আমি কি করব? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, কি বলছ তুমি? জান্নাত কি কেবল একটা? বহু জান্নাত রয়েছে। আর তোমার সন্তান রয়েছে সর্বোচ্চ জান্নাতুল ফেরদৌসে’ (বুখারী হা/২৮০৯, ৩৯৮২)।

[1]. আহমাদ হা/৩৯০১; হাকেম হা/৪২৯৯; মিশকাত হা/৩৯১৫, সনদ হাসান।
[2]. বুখারী হা/২৩০১ ‘দায়িত্ব অর্পণ’ (الوكالة) অধ্যায়-৪০ অনুচ্ছেদ-২।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, অনেক লোককে আবু জাহল যবরদস্তি করে যুদ্ধে এনেছে। অথচ তারা মোটেই যুদ্ধে ইচ্ছুক ছিল না। অতএব তোমরা বনু হাশেমের কাউকে এবং বিশেষ করে আববাসকে কোনভাবেই আঘাত করবে না। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকে যেন হত্যা করো না। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানতে পারেন যে, কুরায়েশ নেতা উৎবাহ বিন রাবী‘আহর পুত্র আবু হুযায়ফা, যিনি আগেই মুসলমান হয়ে মদীনায় হিজরত করেন এবং বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি বলেছেন যে, আমরা আমাদের পিতা ও ভাইদের হত্যা করব, আর আববাসকে ছেড়ে দেব? তা হ’তে পারে না। আল্লাহর কসম! আমার সামনে পড়ে গেলে আমি অবশ্যই আববাসকে হত্যা করব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন ওমর (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে আবু হাফ্ছ! রাসূলের চাচার মুখের উপর তরবারির আঘাত করা হবে? জবাবে ওমর (রাঃ) বলেন, আমাকে ছাড়ুন, আমি এখুনি ওর গর্দান উড়িয়ে দিয়ে আসি’। পরে আবু হুযায়ফা এতে অনুতপ্ত হন। তিনি বলতেন যে, ঐদিন মুখ ফসকে যে কথাটি বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি কোনদিন মনে স্বস্তি পাইনি। সর্বদা ভাবতাম, শাহাদাত লাভই এর একমাত্র কাফফারা হ’তে পারে। পরে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন (আর-রাহীক্ব ২২২ পৃঃ; হাকেম হা/৪৯৮৮; ইবনু হিশাম ১/৬২৯)। বক্তব্যটির সনদ যঈফ। যাহাবী বলেন, ‘সনদ দুর্বল হওয়া ছাড়াও প্রথম দিকের ছাহাবীদের পক্ষে এমনকি পরবর্তীদের পক্ষেও এরূপ আচরণ অতীব দূরতম বিষয়’ (মা শা-‘আ ১১২ পৃঃ)। (২) এই যুদ্ধে আবুবকর (রাঃ) তার পুত্র আব্দুর রহমানকে ‘হে খবীছ! আমার মাল কোথায়? বলে ধমক দেন’ (ইবনু হিশাম ১/৬৩৮; আর-রাহীক্ব ২২৩ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৭৭২)। (৩) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তার মামু ‘আছ বিন হিশাম বিন মুগীরাহকে হত্যা করেন’ (আর-রাহীক্ব ২২৩ পৃঃ, সূত্র বিহীন)। (৪) মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) তার ভাই আবু আযীয বিন উমায়েরকে উদ্দেশ্য করে তাকে বন্দীকারী আনছার ছাহাবীকে বলেন, ওকে ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে যাও। ওর মা বড় একজন ধনী মহিলা। অনেক রক্তমূল্য পাবে। অতঃপর ভাইকে উদ্দেশ্য করে উক্ত ছাহাবীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, إنَّهُ أَخِي دُونَكَ ‘উনিই আমার ভাই, তুমি নও’ (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬৪৬)। বর্ণনাগুলি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। বরং ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তালীক্ব, আর-রাহীক্ব ১৩৩ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১৮ পৃঃ)।

[3]. বুখারী হা/৩৯৭৬; মুসলিম হা/২৮৭৪; মিশকাত হা/৩৯৬৭, ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘বন্দীদের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-৫।
[4]. বুখারী হা/৩৯৭৯; মুসলিম হা/৯৩২।

(১) এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীছটি প্রসিদ্ধ আছে, যা ছহীহ নয়।

يَا أَهْلَ الْقَلِيبِ بِئْسَ عَشِيرَةُ النَّبِيِّ كُنْتُمْ لِنَبِيِّكُمْ كَذَّبْتُمُونِي وَصَدَّقَنِي النَّاسُ وَأَخْرَجْتُمُونِي وَآوَانِي النَّاسُ وَقَاتَلْتُمُونِي وَنَصَرَنِي النَّاسُ ثُمَّ قَالَ: هَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَكُمْ رَبُّكُمْ حَقًّا؟ ‘হে কূয়ার অধিবাসীরা! কতইনা মন্দ আত্মীয় ছিলে তোমরা তোমাদের নবীর জন্য। তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলে, আর লোকেরা আমাকে সত্যবাদী বলেছিল। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছিলে, আর লোকেরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তোমরা আমার সাথে লড়াই করেছ, অথচ লোকেরা আমাকে সাহায্য করেছে’। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তা কি তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ?

আর-রাহীক্ব ২২৪-২৫; ইবনু হিশাম ১/৬৩৯; আলবানী বলেন, এর সনদ মু‘যাল (যঈফ); মুসনাদে আহমাদ-এর বর্ণনায় এসেছে, جَزَاكُمُ اللهُ شَرًّا مِنْ قَوْمِ نَبِىٍّ ‘আল্লাহ তোমাদের মত নবীর কওমকে মন্দ প্রতিফল দিন!’ (আহমাদ হা/২৫৪১১ সনদ মুনক্বাতি‘ বা ছিন্ন সূত্র; মা শা-‘আ ১১৫ পৃঃ)।

(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, মুশরিক নেতাদের মৃতদেহগুলি কূয়ায় নিক্ষেপকালে উৎবা বিন রাবী‘আহর লাশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তার পুত্র আবু হুযায়ফা-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হে আবু হুযায়ফা! তোমার পিতার এ অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই তোমার অন্তরে খারাব লাগছে’? জবাবে আবু হুযায়ফা বললেন, ‘আল্লাহর কসম তা নয় হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা ও তার নিহত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোন ভাবান্তর নেই। তবে আমি জানতাম যে, আমার পিতার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, দূরদর্শিতা ও কল্যাণময়তা রয়েছে। আমি আশা করতাম এগুলি তাঁকে ইসলামের দিকে পথ দেখাবে। কিন্তু এখন তার কুফরী হালতে মৃত্যু দেখে দুঃখিত হয়েছি’। এ জবাব শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন এবং তার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করলেন (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; হাদীছ যঈফ, ঐ, তালীক্ব ১৩৩ পৃঃ)।

(৩) এদিন উক্কাশা বিন মিহছান তার ভাঙ্গা তরবারি নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন তিনি তাকে একটি কাঠের টুকরা দিয়ে বলেন, তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ কর। অতঃপর যখন তিনি সেটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করেন তখন সেটি লম্বা, শক্ত ও ধবধবে সাদা তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর সেটি নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। যতক্ষণ না আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেন। সেদিন থেকে উক্ত তরবারিটির নাম হয় আল-‘আওন (العَوْن) বা সাহায্যকারী। এরপর থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়ে যোগদান করেন। এমনকি আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে রিদ্দার যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আল-আসাদী তাঁকে হত্যা করেন’ (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬৩৭)। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। সেকারণ এটি যঈফ (তালীক্ব, আর-রাহীক্ব ১৩২ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১৬ পৃঃ)।

ইবনু হাজার বলেন, উক্কাশা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁকে হত্যাকারী তুলায়হা ‘মুরতাদ’ ছিল। পরে সে ইসলামে ফিরে আসে। রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৫৬৪৮)।

(৪) এছাড়াও একটি মু‘জেযা প্রসিদ্ধ আছে যে, রেফা‘আহ বিন রাফে‘ বিন মালেক বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন আমি তীরের আঘাতপ্রাপ্ত হই। ফলে আমার চোখ বেরিয়ে যায়। তখন রাসূল (ছাঃ) সেখানে থুথু লাগিয়ে দেন এবং আমার জন্য দো‘আ করেন। ফলে আমি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাই’ (হাকেম হা/৫০২৪; বায়হাক্বী দালায়েল ৩/১০০)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ ১২২ পৃঃ)।

বদর যুদ্ধে পরাজয়ের খবরে মক্কার প্রতিক্রিয়া

হায়সুমান বিন আব্দুল্লাহ আল-খুযাঈ সর্বপ্রথম মক্কায় পরাজয়ের খবর পৌঁছে দেয়। এ খবর তাদের উপরে এমন মন্দ প্রভাব ফেলল যে, তারা শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গেল এবং সকলকে বিলাপ করতে নিষেধাজ্ঞা জারী করল। যাতে মুসলমানেরা তাদের দুঃখ দেখে আননিদত হবার সুযোগ না পায়। যুদ্ধ ফেরত ভাতিজা আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবকে দেখে আবু লাহাব সাগ্রহে যুদ্ধের খবর কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা এমন একটা দলের মুকাবিলা করেছি, যাদেরকে আমরা আমাদের কাঁধগুলি পেতে দিয়েছি। আর তারা ইচ্ছামত হত্যা করেছে ও বন্দী করেছে। এতদসত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদের তিরষ্কার করছিনা এ কারণে যে, প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের মুকাবিলা এমন কিছু শুভ্রবসন লোকের সঙ্গে হয়েছিল, যারা আসমান ও যমীনের মাঝখানে সাদা-কালো মিশ্রিত(خَيْلٌ بُلْقٌ) ঘোড়ার উপরে সওয়ার ছিল। আল্লাহর কসম! না তারা কোন কিছুকে ছেড়ে দিচ্ছিল, না কেউ তাদের মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারছিল’(وَاللهِ مَا تُلِيقُ شَيْئًا وَلاَ يَقُومُ لَهَا شَيْءٌ)। একথা শুনে পাশেই দাঁড়ানো আবু রাফে‘, যিনি আববাস-এর গোলাম ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন, তিনি বলে ওঠেন, تِلْكَ وَاللهِ الْمَلاَئِكَةُ ‘আল্লাহর কসম! ওঁরা ফেরেশতা’। একথা শুনে ক্ষুব্ধ নেতা আবু লাহাব তার গালে ভীষণ জোরে এক চড় বসিয়ে দিল। তখন উভয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আবু লাহাব আবু রাফে‘-কে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে লাগল। তখন আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল (রাঃ) এসে তাঁবুর একটা খুঁটি নিয়ে আবু লাহাবকে ভীষণ জোরে মার দিয়ে বললেন, اسْتَضْعَفْتَهُ أَنْ غَابَ عَنْهُ سَيِّدُهُ ‘ওর মনিব বাড়ী নেই বলে তুমি ওকে দুর্বল ভেবেছ?’ এতে লজ্জিত হয়ে আবু লাহাব উঠে গেল। এর মাত্র সাতদিনের মধ্যেই আল্লাহর হুকুমে সে আদাসাহ (عَدَسَة) নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেহ পচে গলে মারা গেল। গুটি বসন্তের ন্যায় এই রোগকে সেযুগে মানুষ কু-লক্ষণ ও সংক্রামক ব্যাধি বলে জানত। ফলে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে যায় এবং সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। এ অবস্থায় তিনদিন লাশ পড়ে থাকলেও কেউ তার কাছে যায়নি। অবশেষে একজন লোকের সহায়তায় তার দুই ছেলে তার লাশ পাহাড়ের মাথায় নিয়ে একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে গর্তে ফেলে তার উপর মাটি ও পাথর ছুঁড়ে পুঁতে দিল দুর্গন্ধের ভয়ে।[1] এইভাবে এই দুরাচার দুনিয়া থেকে বিদায় হ’ল। ছাফা পাহাড়ের ভাষণের দিন রাসূল (ছাঃ)-কে تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ ‘সর্বদা তুমি ধ্বংস হও’ (বুখারী হা/৪৭৭০) বলার ১৫ বছর পরে তার এই পরিণতি হয়।

[1]. হাকেম হা/৫৪০৩, যাহাবী চুপ থেকেছেন; ইবনু হিশাম ১/৬৪৭।

বদর যুদ্ধে বিজয়ের খবর মদিনায়

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারীকে মদীনার উচ্চ ভূমিতে এবং যায়েদ বিন হারেছাহকে নিম্নভূমিতে পাঠিয়ে দেন মদীনায় দ্রুত বিজয়ের খবর পৌঁছানোর জন্য। ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর কন্যা ও হযরত ওছমানের স্ত্রী রুক্বাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি সমান করা হচ্ছিল। যার অসুখের কারণে রাসূল (ছাঃ) ওছমান ও উসামা বিন যায়েদকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন তার সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য।[1]

অন্য দিকে ইহূদী ও মুনাফিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর পরাজয় এমনকি তাঁর নিহত হবার খবর আগেই রটিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর নিশ্চিত খবর জানতে পেরে মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মদীনা মুখরিত করে তোলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন (আর-রাহীক্ব ২২৭ পৃঃ)।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪২; বায়হাক্বী হা/১৮৩৬৬; হাকেম হা/৪৯৫৯, যাহাবী চুপ থেকেছেন।

বদর যুদ্ধের গণীমত বণ্টন

যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন যে, এরি মধ্যে গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা তার সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গণীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূল (ছাঃ)-কে পাহারা দিয়ে তাঁকে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল। এ সময় সূরা আনফাল ১ম আয়াত নাযিল হয়। يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে। বলে দাও, গণীমতের মাল সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। অতঃপর সেমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন।

বদরে যুদ্ধবন্দী হত্যা

অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ‘ছাফরা’ (الصَّفْرَاء) গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গণীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন।[1] এর পূর্বে ছাফরা গিরিসংকটে কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী দুষ্টমতি নযর বিন হারিছকে রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশক্রমে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এই শয়তান ইরাকের ‘হীরা’ থেকে নাচগানে পারদর্শী সুন্দরী নর্তকীদের খরীদ করে এনে মক্কাবাসীদের বিভ্রান্ত করত। যাতে কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর কথা না শোনে ও কুরআন না শোনে। এরপর ‘ইরকুয যাবিয়াহ’(عِرْقُ الظَّبْيَة) নামক স্থানে পৌঁছে আরেক শয়তানের শিখন্ডী উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে হত্যার নির্দেশ দেন’।[2] যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় গলায় চাদর পেঁচিয়ে এবং পরে মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৩৭৮, ৫২০)। একে মারেন আছেম বিন ছাবিত আনছারী (রাঃ)। মতান্তরে হযরত আলী (রাঃ)। এই দু’জন ব্যক্তি বন্দীর মর্যাদা পাবার যোগ্য ছিল না। কেননা তারা ছিল আধুনিক পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী (مِنْ أَكَابِرِ مُجْرِمِى الْحَرْب)।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৩; আহমাদ হা/২২৮১৪, হাসান লিগায়রিহী; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২৩৪ পৃঃ সনদ ছহীহ।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৪; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫।

বদরে বিজয়ীদেরকে মদীনায় অভ্যর্থনা

বিজয়ী কাফেলা রাওহা (الرَّوْحَاء) পৌঁছলে মদীনা থেকে আগমনকারী অগ্রবর্তী অভ্যর্থনাকারী দলের সাথে প্রথম মুলাকাত হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৪৩)। তারা বিপুল উৎসাহে বিজয়ী রাসূলকে অভ্যর্থনা জানায়। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী ছাহাবী সালামা বিন সালামাহ(سَلَمَةُ بنُ سَلاَمَة) বলেন,مَا الَّذِي تُهَنِّئُونَنَا بِهِ وَاللهِ إِنْ لَقِينَا إِلاَّ عَجَائِزَ صُلْعًا كَالْبُدْنِ الْمُعَقَّلَةِ، فَنَحَرْنَاهَا ‘তোমরা কিজন্য আমাদের মুবারকবাদ দিচ্ছ’? ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো কিছু টেকো মাথা বুড়োদের মুকাবিলা করেছি মাত্র, যারা ছিল বাঁধা উটের মত, যাদেরকে আমরা যবহ করেছি’। তার কথা বলার ঢং দেখে রাসূল (ছাঃ) মুচকি হেসে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي أُولَئِكَ الْمَلَأُ الأَكْبَرُ ‘হে ভাতিজা! ওরাই তো বড় বড় নেতা’।[1] এ সময় ছাহাবী উসায়েদ বিন হুযায়ের আনছারী(أُسَيدُ بنُ الْحُضَير) যিনি বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, তিনি সাক্ষাৎ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে বিজয় দান করেছেন ও আপনার চক্ষুকে শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা ভেবে বদরে গমন হ’তে পিছনে থাকিনি যে, আপনার মুকাবিলা শত্রুদের সাথে হবে। ظَنَنْتُ أَنَّهَا عِيرٌ وَلَوْ ظَنَنْتُ أَنَّهُ عَدُوٌّ مَا تَخَلَّفْتُ ‘আমি তো ভেবেছিলাম এটা স্রেফ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর বিষয়। যদি বুঝতাম যে, এটা শত্রুদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা, তাহ’লে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, (صَدَقْتَ) ‘তুমি সত্য বলেছ’ (আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫)। পরের বছর ওহোদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে আনছার বাহিনীর মধ্যে আউসদের পতাকাবাহী নিযুক্ত করেন। অতঃপর একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ এরি মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৩-৪৪; ত্বাবারাণী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৬৪৪৫; হাকেম হা/৫৭৬৭, সনদ ‘ছহীহ মুরসাল’; যঈফাহ হা/২২৩৫।

বদরে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌঁছে। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান (ইবনু হিশাম ১/৬৪৪-৪৫)। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হ’তে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিলেন। জামাতা আবুল ‘আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল ‘আছ ছিলেন খাদীজার সহোদর বোনের ছেলে এবং রাসূল-কন্যা যয়নবের স্বামী। ফিদইয়া দিতে অক্ষম কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানোর বিনিময়ে মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-এর আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে ছিল নযীরবিহীন। ওছমান (রাঃ)সহ নয় জন ছাহাবীকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও গণীমতের অংশ দেন তাদের যথার্থ ওযর ও অন্যান্য সহযোগিতার কারণে।

উল্লেখ্য যে, ঐ সময় রাসূল-কন্যা রুক্বাইয়া মৃত্যু শয্যায় থাকার কারণে ওছমান গণী (রাঃ) ও উসামা বিন যায়েদ-কে রাসূল (ছাঃ) মদীনায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৭০)। রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘-এর রক্তমূল্য বাবদ তাঁর কন্যা যয়নবের যে কণ্ঠহারটি পেশ করা হয়, তা ছিল হযরত খাদীজার দেওয়া। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, إِنْ رَأَيْتُمْ أَنْ تُطْلِقُوا لَهَا أَسِيرَهَا وَتَرُدُّوا عَلَيْهَا الَّذِى لَهَا ‘যদি তোমরা যয়নাবের জন্য তার বন্দীকে মুক্তি দিতে এবং তার কণ্ঠহারটিকে তার কাছে ফেরৎ দিতে’! তখন সবাই বলল, হ্যাঁ। অতঃপর কন্যা যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়ার শর্ত করা হয়। অতঃপর বদর যুদ্ধের কাছাকাছি এক মাস পর যায়েদ বিন হারেছাহ ও একজন আনছার ছাহাবীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁকে মদীনায় ফিরিয়ে আনা হয়।[1] উক্ত কণ্ঠহার বিষয়ে ‘অনন্য কণ্ঠহার’ (الْعِقْدُ الْفَرِيدُ) নামে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখিত আরবী নিবন্ধ বাংলাদেশের সরকারী ডিগ্রী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসাবে রয়েছে।

হিজরতকালে হাববার ইবনুল আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব(هَبَّارُ بْنُ الْأَسْوَدِ) যয়নাবকে তার হাওদায় বর্শা দিয়ে আঘাত করে। তাতে তিনি উটের পিঠ থেকে একটি পাথরের উপর পতিত হ’লে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। যাতে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায় ও প্রচুর রক্তক্ষরণ হ’তে থাকে। এসময় আবু সুফিয়ান দলবল নিয়ে এসে উটচালক তাঁর দেবর কেনানাহ বিন রবী‘-কে বললেন, মুহাম্মাদের আহত মেয়েটিকে নিয়ে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে যাওয়াটা আমাদের জন্য হীনকর। তাকে আটকিয়ে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তুমি ওকে নিয়ে ফেরৎ যাও। অতঃপর রাতের বেলা গোপনে গিয়ে তার বাপের হাতে মেয়েকে পৌঁছে দাও। তার কথামতে কিনানাহ ফিরে যান এবং কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান শেষে একটু সুস্থ হ’লে রাতের বেলা তাকে নিয়ে যায়েদ বিন হারেছাহর নিকট পৌঁছে দেন। এভাবে ইসলামের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে যয়নব মদীনায় পিতৃগৃহে এবং আবুল ‘আছ মক্কায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে থাকেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন,هِيَ أَفْضَلُ بَنَاتِي أُصِيبَتْ فِيَّ ‘সে আমার সেরা মেয়ে। আমার জন্য সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে’।[2]

পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে আবুল ‘আছ মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে যয়নবকে ছয় বছর পরে তার স্বামীর কাছে ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের পূর্ব বিবাহ বহাল রাখা হয়।[3] যয়নব ৮ হিজরীর প্রথম দিকে এবং আবুল ‘আছ ১২ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।[4]

উল্লেখ্য যে, হাববার মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬২)।

বন্দীমুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,

مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- لَوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ-

‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তোমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি পাকড়াও করত’ (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।

উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত পূর্ব বিধানটি ছিল নিম্নরূপ:

فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوْهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا-

‘অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মার। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ নাও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রু অস্ত্র সমর্পণ করে.. (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।

উল্লেখ্য যে, নাখলা যুদ্ধের পরে ও বদর যুদ্ধের পূর্বে শা‘বান মাসে যুদ্ধ ফরয করে সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যাতে যুদ্ধের বিধি-বিধান সমূহ বর্ণিত হয়। এজন্য এ সূরাকে ‘সূরা ক্বিতাল’(سُوْرَةُ الْقِتَالِ) বলা হয়। তবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে সূরা হজ্জের ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয় হিজরতের সময়কালে, কুরায়েশদের অব্যাহত সন্ত্রাস ও হামলা মুকাবিলার জন্য।

উক্ত সূরা মুহাম্মাদ ৪ আয়াতে অনুগ্রহ অথবা মুক্তিপণের কথা বলা হয়েছে। সেই বিধান মতেই বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূরা আনফালে বর্ণিত ধমকির আয়াত দু’টি (৬৭-৬৮) সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে নাযিল হওয়ার মধ্যে আল্লাহর অশেষ করুণা নিহিত ছিল। যাতে বনু হাশেম সহ মুসলমানদের অনেক হিতাকাংখী বন্দী মুক্তি পান ও পরে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়ে যান। এই সময় বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। যেমন হযরত সা‘দ বিন নু‘মান (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় গেলে আবু সুফিয়ান তাকে আটকে দেন। পরে বদর যুদ্ধে বন্দী তার পুত্র আমর বিন আবু সুফিয়ানকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়।[5]

[1]. আহমাদ হা/২৬৪০৫; আবুদাঊদ হা/২৬৯২; মিশকাত হা/৩৯৭০; সনদ হাসান।
[2]. হাকেম হা/৬৮৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৭১; আল-বিদায়াহ ৩/৩৩১।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬৫৭-৫৯; তিরমিযী হা/১১৪৩; আবুদাঊদ হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ হা/২০০৯, সনদ ছহীহ। যে হাদীছে নতুন বিবাহ ও নতুন মোহরের কথা এসেছে, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/১১৪২; ইবনু মাজাহ হা/২০১০)। অন্য বর্ণনায় ‘দুই বছর’ পরের কথা এসেছে (আবুদাঊদ হা/২২৪০ সনদ ছহীহ)। তার অর্থ হ’ল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কাফির ও মুসলিমে বিবাহ ছিন্ন হওয়ার যে নির্দেশ আসে, তার দু’বছর পরে (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াত)।
[4]. আল-ইছাবাহ, যয়নব ক্রমিক ১১২১৭; ঐ, আবুল ‘আছ ক্রমিক ১০১৭৬।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৫০-৫৩।

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধে ‘খতীবু কুরায়েশ’ বলে খ্যাত বন্দী সুহায়েল বিন ‘আমরকে মুক্ত করার জন্য কুরায়েশরা যখন লোক পাঠায়, তখন ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি সুহায়েল-এর দু’টি দাঁত উপড়ে ফেলি এবং জিহবা টেনে বের করে ফেলি। যাতে সে আপনার বিরুদ্ধে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কখনো বক্তৃতা করতে না পারে। জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি কখনোই তার অঙ্গহানি করব না। তাহলে আল্লাহ আমার অঙ্গহানি করবেন। যদিও আমি নবী’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ওমরকে এ কথাও বলেন, সত্তর সে এমন স্থানে দাঁড়াবে যে, তুমি তাকে তিরষ্কার করবে না’ ( ইবনু হিশাম ১/৬৪৯)। বর্ণনাটি মু‘যাল বা যঈফ (মা শা-‘আ ১১৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, সুহায়েল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা শেষে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হয়। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন। বলা হয়েছে যে, তিনি ১৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

(২) বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী (عُمَيْرُ بن وَهْبٍ الْجُمَحِي) তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনায় আগমন করে। তখন তার পুত্র ওয়াহাব বিন ওমায়ের মদীনায় বদর যুদ্ধে বন্দী হিসাবে ছিল। ছাফওয়ান তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারলে সে তার সকল ঋণ পরিশোধ করে দিবে এবং তার সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করবে। অতঃপর সে মদীনায় আসে এবং রাসূল (ছাঃ)-কে জাহেলী যুগের রীতি অনুযায়ী انْعَمُوا صَبَاحًا (সুপ্রভাত) বলে অভিবাদন করে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে তোমার চাইতে সুন্দর জান্নাতবাসীদের পারস্পরিক অভিবাদন السَّلام (সালাম) দ্বারা সম্মানিত করেছেন। অতঃপর সে তার ছেলের প্রতি সহনুভূতি দেখানোর অনুরোধ জানায়। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তোমার কাঁধে তরবারি কেন? জবাবে সে আসল উদ্দেশ্য লুকাতে চাইল। তখন রাসূল (ছাঃ) তার নিকট মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তার মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তাঁকে হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক ও ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ১/৬৬১; আল-বিদায়াহ ৩/৩১৩; আর-রাহীক্ব ২৩৫-৩৬ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৮২৬)।

 প্রথম ঈদুল ফিৎর

ইবনু ইসহাক বলেন, রামাযানের শেষে বা শাওয়াল মাসে রাসূল (ছাঃ) বদর যুদ্ধ থেকে ফারেগ হন (ইবনু হিশাম ২/৪৩)। অতঃপর এমাসেই অর্থাৎ ২য় হিজরী সনে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়। যাতে যাকাতের নিছাবসমূহ বর্ণিত হয় (মির‘আত ৬/৩৯৯, ৩)। এটি আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। অতঃপর এ বছর ১লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিৎরের উৎসব পালিত হয়, যা মুসলমানদের নিকটে সত্যিকারের বিজয়োৎসবে পরিণত হয় (আর-রাহীক্ব ২৩১-৩২ পৃঃ)।

বদর বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা

বদর যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যার মধ্যে ১-৪৯ পর্যন্ত আয়াতগুলি কেবল বদর যুদ্ধ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। উক্ত সূরার ১ ও ৪১ আয়াতে গণীমত বণ্টনের নীতিমালা বর্ণিত হয়। তাছাড়া সেখানে মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা জাহেলী যুগের যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধবন্দী বিষয়ক নীতি, চুক্তিবদ্ধ গোষ্ঠী ও চুক্তি বহির্ভূত মুমিনদের সাথে ব্যবহার বিধি যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ইসলাম যে কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং একটি বাস্তব রীতি-নীতি সমৃদ্ধ সমাজ দর্শনের নাম, সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উক্ত সূরায় আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,

وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَنْ يَّتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- (الأنفال ২৬)-

‘আর স্মরণ কর যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প ও পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল বলে গণ্য হ’তে। আর তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদের যেকোন সময়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয় দেন ও তোমাদেরকে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। আর তোমাদেরকে উত্তম বস্ত্ত সমূহ জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ (আনফাল ৮/২৬)।

বদর যুদ্ধ পর্যালোচনা

এই যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। বরং আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনায় ও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সুনিপূণভাবে সংঘটিত হয় ও বিজয় লাভ হয়। যা পরবর্তী ইসলামী বিজয়ের ভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়। কারণ ঐদিন মুসলমানরা ছিল নিতান্তই দুর্বল ও কাফেররা ছিল সবল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন বদরের যুদ্ধে। যেদিন তোমরা দুর্বল ছিলে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। এমনকি মুসলমানরা যুদ্ধ করবে, না মদীনায় ফিরে যাবে, এ বিষয়েও ছিল পরামর্শ সভায় মতভেদ। পরে আল্লাহর নির্দেশে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে এ যুদ্ধে বিজয় লাভ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لَاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ ‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্ন ভূমিতে। যদি তোমরা আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইতে, তাহ’লে (সংখ্যায় অল্প হওয়ার কারণে) তোমরা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হবে সে যেন (ইসলামের) সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকবে, সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৪২)।

উক্ত আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বদরের যুদ্ধ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কোন পরিকল্পিত বিজয়াভিযান ছিল না।

জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে প্রায় সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধমূলক। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের অবিরাম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও হামলা মুকাবিলা করতে গিয়েই তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল।

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব

(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সশস্ত্র সংঘর্ষ। (২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ (৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। সেকারণ এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ (يَوْمُ الْفُرْقَانِ) বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে। (৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। উল্লেখ্য যে, ‘বদর’ নামটি কুরআনে মাত্র একটি স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে।

(৫) এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে হাদীছে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে গোপন কথা ফাঁস করে মক্কায় প্রেরিত হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ-এর পত্র ধরা পড়ার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করার অপরাধে ওমর (রাঃ) তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ وَجَبَتْ لَكُمُ الْجَنَّةُ ‘তোমরা যা খুশী কর। তোমাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে’। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) কাঁদতে থাকেন’ (বুখারী হা/৬২৫৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ বলে জনৈক ব্যক্তি মন্তব্য করলে তার উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেন, كَذَبْتَ لاَ يَدْخُلُهَا فَإِنَّهُ شَهِدَ بَدْرًا وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘তুমি মিথ্যা বললে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। কেননা সে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَنْ يَدْخُلَ النَّارَ رَجُلٌ شَهِدَ بَدْراً وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘কখনোই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না ঐ ব্যক্তি যে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[2]

[1]. মুসলিম হা/২৪৯৫; মিশকাত হা/৬২৪৩।
[2]. আহমাদ হা/১৫২৯৭; ছহীহাহ হা/২১৬০।

বদর যুদ্ধের ফলাফল

(১) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী।

এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ ‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় সাহায্যের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়’ (আনফাল ৮/৭-৮)।

(২) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই খাযরাজী ও তার সাথীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয় এবং শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।

(৩) বদরের যুদ্ধে বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এর কিছু দিন পূর্বে শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।

(৪) যুদ্ধটি ছিল অভাবনীয়। কেননা বদর যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না (আনফাল ৮/৪২)। তেমনি বিজয়টিও ছিল অভাবনীয়। যা স্রেফ আল্লাহর বিশেষ রহমতে সাধিত হয়। যুগে যুগে ইসলামী বিজয় এভাবেই হয়ে থাকে।

(৫) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহূদী ও মুনাফিকরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। যারা ছিল স্রেফ দস্যুশ্রেণীর লোক। ঈমান ও কুফর কোনটির প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। উপরোক্ত চারটি শ্রেণীর প্রত্যেকেই নিশ্চিত ছিল যে, মদীনায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হ’লে তা অবশ্যই তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। সেকারণ তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে।

(৬) এ যুদ্ধের ফলে ইহূদী গোত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী গোত্র বনু ক্বাইনুক্বা‘ ভীষণভাবে ভীত ও ক্রুদ্ধ হয়। তাদের ষড়যন্ত্র তুঙ্গে উঠে। ফলে মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কার অবশ্যম্ভাবী হয়। বদর যুদ্ধের পরেই ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে যা কার্যকর হয়।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) মক্কায় সামাজিক পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ)-কে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে ছবর করতে হবে। যেমনটি মাক্কী জীবনে করা হয়েছিল।

(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবূ জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।

(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের আধিক্য বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীলতাই হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন ছাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হ’ল বড় বিষয়।

(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হ’তে হবে জান্নাত লাভ। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হৌক বা ময়দানের সশস্ত্র মুকাবিলা হৌক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে আখেরাত। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাছিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্রশক্তি ব্যয়িত হবে না।

(৫) স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতামন্ডলী পাঠিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধে করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।

(৬) যুদ্ধে গণীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হ’লেও তা কখনোই মুখ্য হবে না। বরং সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমীরের অনুগত থাকতে হবে। বদর যুদ্ধে গণীমত বণ্টন নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হ’লেও তা সাথে সাথে নিষ্পত্তি হয়ে যায় রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে (আনফাল ৮/১)।

(৭) কাফিররা মূলতঃ মুসলমানদের ঈমানী শক্তিকে ভয় পায়। এ কারণেই পরবর্তী ওহোদের যুদ্ধে তারা মহিলাদের সাথে করে এনেছিল। যাতে পুরুষেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে না যায়।

(৮) বদর যুদ্ধের বড় শিক্ষা এই যে, কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপরে ভরসা করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। এ ধারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে ইনশাআল্লাহ।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url