বিষয় ভিত্তিক আয়াত || ঈমানদার ও নেক আমলকারী বিষয়ক আয়াত || ঈমানদার ও নেক আমলকারীর প্রতিদান (পর্ব-৪)





ঈমানদার ও নেক আমলকারীদের জন্য সফলতা



সুরা আন নাবা   আয়াত: ৩১-৩৭

৭৮:৩১ اِنَّ لِلۡمُتَّقِیۡنَ مَفَازًا 
৭৮:৩২ حَدَآئِقَ وَ اَعۡنَابًا
৭৮:৩৩ وَّکَوَاعِبَ اَتۡرَابًا
৭৮:৩৪ وَّ کَاۡسًا دِهَاقًا
৭৮:৩৫ لَا یَسۡمَعُوۡنَ فِیۡهَا لَغۡوًا وَّ لَا کِذّٰبًا 
৭৮:৩৬ جَزَآءً مِّنۡ رَّبِّکَ عَطَآءً حِسَابًا 
৭৮:৩৭ رَّبِّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَهُمَا الرَّحۡمٰنِ لَا یَمۡلِکُوۡنَ مِنۡهُ خِطَابًا

বাংলা অনুবাদ
৩১. নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা।
৩২. উদ্যানসমূহ ও আঙ্গুরসমূহ। 
৩৩. আর সমবয়স্কা উদ্‌ভিন্ন যৌবনা তরুণী।
৩৪. আর পরিপূর্ণ পানপাত্র।
৩৫. তারা সেখানে কোন অসার ও মিথ্যা কথা শুনবে না।
৩৬. তোমার রবের পক্ষ থেকে প্রতিফল, যথোচিত দানস্বরূপ। 
৩৭. যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এতদোভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর রব, পরম করুণাময়। তারা তাঁর সামনে কথা বলার সামর্থ্য রাখবে না।

আয়াতের তাফসীর

নিশ্চয়ই আল্লাহভীরুদের জন্যই রয়েছে সফলতা

দুর্ভাগ্যবানদের কথা আলোচনা করার পর এখন সৌভাগ্যবানদের আলোচনা এবং তাদের সেই নিয়ামতের বর্ণনা; যা তারা আখেরাতে উপভোগ করবে। আর এই সাফল্য ও নিয়ামত তাকওয়া (আল্লাহভীরুতা)র ফলে লাভ হবে। তাকওয়া হল ঈমান ও আনুগত্যের চাহিদার পরিপূর্ণতার নাম। সৌভাগ্যবান লোক তো তারাই, যারা ঈমান আনার পর তাকওয়া এবং নেক আমলে যত্নবান হয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করুন। আমীন।

উদ্যানসমূহ ও নানাবিধ আঙ্গুর

এই বাক্য مفازًا-এর বদল। অর্থাৎ, সফলতার বিবরণ।

এবং উদ্ভিন্ন-যৌবনা সমবয়স্কা তরুণীগণ

كواعب শব্দটি كاعب-এর বহুবচন। যার অর্থ হল পায়ের গাঁট। যেমন গাঁট উঁচু হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি তাদের স্তনগুলিও অনুরূপ উঁচু উঁচু হবে; যা তাদের রূপ-সৌন্দর্যের একটি সুদৃশ্য। (অর্থাৎ তারা সদ্য উদ্ভিন্ন স্তনের ষোড়শী তরুণী হবে।) أتراب শব্দের অর্থ হল সমবয়স্ক।

এবং পরিপূর্ণ পানপাত্র

دهاقًا -এর অর্থঃ পরিপূর্ণ কিংবা একের পর এক নিরবচ্ছিন্ন অথবা তা স্বচ্ছ ও নির্মল হবে। كأس এমন পানপাত্রকে বলা হয়, যা পূর্ণরূপে ভর্তি থাকে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

সেখানে তারা শুনবে না কোন অসার ও মিথ্যা বাক্য


জান্নাতে কোন কটুকথা ও আজেবাজে গল্পগুজব হবে না। কেউ কারো সাথে মিথ্যা বলবে না এবং কারো কথাকে মিথ্যাও বলবে না। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টিকে জান্নাতের বিরাট নিয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া

আপনার রবের পক্ষ থেকে পুরস্কার, যথোচিত দানস্বরূপ


লক্ষণীয় যে, এসব নেয়ামত বর্ণনা করে বলা হয়েছে, জান্নাতের এসব নেয়ামত মুমিনদের প্রতিদান এবং আপনার রবের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত দান। এখানে জান্নাতের নেয়ামতসমূহকে প্রথমে কর্মের প্রতিদান ও পরে আল্লাহর দান বলা হয়েছে। প্রতিদান শব্দের পরে আবার যথেষ্ট পুরস্কার দেবার কথা বলার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তারা নিজেদের সৎকাজের বিনিময়ে যে প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে কেবলমাত্র ততটুকুই তাদেরকে দেয়া হবে না বরং তার ওপর অতিরিক্ত পুরস্কার এবং অনেক বেশী পুরস্কার দেয়া হবে। বিপরীত পক্ষে জাহান্নামবাসীদের জন্য কেবলমাত্র এতটুকুই বলা হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের যে পরিমাণ অপরাধ তার চেয়ে বেশী শাস্তি দেয়া হবে না এবং কমও দেয়া হবে না। [দেখুন, তাতিস্মাতু আদওয়াউল বায়ান] কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউসুস ২৬–২৭ আয়াত, সূরা আন নামল ৮৯–৯০ আয়াত, সূরা আল কাসাস ৮৪ আয়াত, সূরা সাবা ৩৩ আয়াত এবং সূরা আল মু'মিন ৪০ আয়াত।
তাফসীরে জাকারিয়া

৩৭. যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু'য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, দয়াময়; তার কাছে আবেদন-নিবেদনের শক্তি তাদের থাকবে না।

এই বাক্যটি পূর্বের বাক্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর অর্থ এই হবে যে, এটি সে-রবের পক্ষ থেকে প্রতিদান, যিনি আসমান ও যমীনের রব; তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে কেয়ামতের ময়দানে কারও কথা বলার ক্ষমতা হবে না; যদি-না তিনি অনুমতি দেন। [মুয়াসসার]
তাফসীরে জাকারিয়া



সুরা আল বুরূজ   আয়াত: ১১-১৬ 

৮৫:১১ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَهُمۡ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ۬ؕؑ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡکَبِیۡرُ 
৮৫:১২ اِنَّ بَطۡشَ رَبِّکَ لَشَدِیۡدٌ
৮৫:১৩ اِنَّهٗ هُوَ یُبۡدِئُ وَ یُعِیۡدُ
৮৫:১৪ وَ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الۡوَدُوۡدُ 
৮৫:১৫ ذُو الۡعَرۡشِ الۡمَجِیۡدُ
৮৫:১৬ فَعَّالٌ لِّمَا یُرِیۡدُ

বাংলা অনুবাদ
১১. নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ। এটাই বিরাট সফলতা।
১২. নিশ্চয় তোমার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন। 
১৩. নিশ্চয় তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন।
১৪. আর তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, প্রেমময়। 
১৫. আরশের অধিপতি, মহান।
১৬. তিনি তা-ই করেন যা চান ।

আয়াতের তাফসীর
নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; এটাই মহাসাফল্য।
তাফসীরে জাকারিয়া

নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও বড়ই কঠিন


যারা আল্লাহর রসূলকে মিথ্যা ভেবেছিল এবং তাঁর আদেশ উল্লংঘন করেছিল, যখন আল্লাহ এই সমস্ত শত্রুদেরকে পাকড়াও করলেন তখন তাঁর পাকড়াও হতে কেউ পরিত্রাণ পেল না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান

তিনিই অস্তিত্ব দান করেন ও পুনরাবর্তন ঘটান


অর্থাৎ, তিনিই নিজ পূর্ণ শক্তি ও কুদরত দ্বারা প্রথমবার সৃষ্টি করেন এবং কিয়ামতের দিন পুনর্বার ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করবেন যেভাবে তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান


এবং তিনি ক্ষমাশীল, অতিম্নেহময়

الْوَدُود শব্দটির কয়েকটি অর্থ বর্ণিত আছে। কারও কারও মতে, ‘ওয়াদূদ’ বলা হয় তাকে যার কোন সন্তান নেই। অর্থাৎ যার এমন কেউ নেই। যার প্রতি মন টানতে থাকবে। [ফাতহুল কাদীর] তবে অধিকাংশ মুফাস্‌সিরের মতে এর অর্থ, প্রিয় বা প্রিয়পাত্র। [ইবন কাসীর] যার ভালবাসায় কোন খাদ নেই। যারা তাঁকে ভালবাসেন তিনিও তাদেরকে ভালবাসেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তিনি তাদেরকে ভালবাসেন আর তারাও তাঁকে ভালবাসে”। [সূরা আল-মায়েদাহ: ৫৪] তিনি এমন সত্তা যাঁকে তার ভালবাসার পাত্ররা এমন ভালবাসে যে ভালবাসার কোন উদাহরণ দেয়া সম্ভব হয় না। যার কোন তুলনা নেই। তাঁর খালেস বান্দাদের অন্তরে তাঁর যে ভালবাসা রয়েছে সেটার তুলনা কোন ভালবাসা দিয়ে দেয়া যাবে না। আর এজন্যই ভালবাসা হচ্ছে আল্লাহর দাসত্বের মূল কথা। যে ভালবাসার কারণে যাবতীয় ভালবাসার পাত্রের উপর সেটা স্থান করে নেয়। অন্য ভালবাসা যদি আল্লাহর ভালবাসার অনুগামী না হয় তবে সেটা বান্দার জন্য বিপদ ও শাস্তির কারণ হয়। [সা'দী]
তাফসীরে জাকারিয়া


তিনি আরশের অধিপতি গৌরবময়


[১] অর্থাৎ, তিনি সমস্ত সৃষ্টি হতে সুমহান এবং সুউচ্চ। ‘আরশ’ যা সব থেকে উচ্চে অবস্থিত, যার উপরে আল্লাহ আছেন। যেমন সাহাবাগণ, তাবেয়ীনগণ এবং মুহাদ্দিসগণদের এ বিশ্বাস। المَجِيدُ শব্দের অর্থ হল মর্যাদাবান ও গৌরবময়। পেশ অবস্থায় এ জন্য আছে যে, এটা ذو বা রবের সিফাত (বিশেষণ); العَرشِ এর বিশেষণ নয়। যদিও কেউ কেউ এই শব্দটাকে العَرشِ এর বিশেষণ ধরে المجيدِ শব্দকে যের দিয়ে পাঠ করেছেন। অর্থের দিক দিয়ে উভয় অর্থ নির্ভুল এবং বিশুদ্ধ। (ইবনে কাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান


তিনি যা ইচ্ছে তা-ই করেন


“তিনি ক্ষমাশীল” বলে এই মর্মে আশান্বিত করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি গোনাহ করা থেকে বিরত হয়ে যদি তাওবা করে তাহলে সে আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। তিনি গোনাহগারদের প্রতি এতই ক্ষমাশীল যে, তাদেরকে লজ্জা দেন না। আর তাঁর আনুগত্যকারী বন্ধুদেরকে অতিশয় ভালবাসেন। [ফাতহুল কাদীর] “অতিস্নেহময়” বলে الْوَدُود শব্দের পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায় না। কারণ, স্নেহ ও ভালবাসার মধ্যে খাঁটি হলেই তবে তাকে “ওয়াদূদ” বলা যাবে। তিনি নিজের সৃষ্টিকে অত্যধিক ভালোবাসেন। তাকে তিনি কেবল তখনই শাস্তি দেন যখন সে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করা থেকে বিরত হয় না। এখানে غَفُور বা ক্ষমাকারী বলার পরে وَدُود বা অতি স্নেহময় বলে এটাই বুঝাচ্ছেন যে, যারা অন্যায় করে তারপর তাওবাহ করবে, তাদেরকে তিনি শুধু ক্ষমাই করবেন না। বরং নিখাদভাবে ভালও বাসবেন। [সা’দী] “আরশের মালিক” বলে মানুষের মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয়েছে যে তিনি যেহেতু আরশের মালিক। আর আরশ সবকিছুর উপরে। তাই তিনিও সবকিছুর উপরে। [ইবন কাসীর]

সবকিছু মহান আল্লাহর আরশের সামনে অতি নগন্য। বরং সমস্ত আসমান, যমীন ও কুরসী সবগুলোকেই আরশ শামিল করে। [সা’দী] কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কেউ তার হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে না। “শ্রেষ্ঠ সম্মানিত” বলে এ ধরনের বিপুল মর্যাদাসম্পন্ন সত্তার প্রতি অশোভন আচরণ করার হীন মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। তাছাড়া এটি আরশের গুণও হতে পারে। [ইবন কাসীর] তার শেষ গুণটি বর্ণনা করে বলা হয়েছে, “তিনি যা চান তাই করেন” অর্থাৎ আল্লাহ যে কাজটি করতে চান তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এ সমগ্র সৃষ্টিকুলের কারো নেই। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মৃত্যু শয্যায় কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনাকে কি কোন ডাক্তার দেখেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারা বললেন, ডাক্তার কী বলেছেন? তিনি বললেন, ডাক্তার আমাকে বলেছেন, আমি যা ইচ্ছা তাই করি। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া



সুরা আল আসর   আয়াত: ১-৩ 

১০৩:১ وَ الۡعَصۡرِ ۙ
১০৩:২ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَفِیۡ خُسۡرٍ ۙ
১০৩:৩ اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ۬ۙ وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ

আয়াতের বাংলা অনুবাদ
১. সময়ের কসম, 
২. নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত।
৩. তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।

সময়ের শপথ


আয়াতের প্রথমেই সময় বা যুগের শপথ করা হয়েছে। এখানে প্ৰণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, বিষয়বস্তুর সাথে সময় বা যুগের কি সম্পর্ক, যার কসম করা হয়েছে? কসম ও কসমের জওয়াবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, মানুষের সব কর্ম, গতিবিধি, উঠাবসা ইত্যাদি সব যুগের মধ্যে সংঘটিত হয়। সূরায় যেসব কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলোও এই যুগ-কালেরই দিবা-রাত্রিতে সংঘটিত হবে। এরই প্রেক্ষিতে যুগের শপথ করা হয়েছে। [সা’দী, ইবন কাসীর] কোন কোন আলেম বলেন, আল্লাহ তা'আলার মহত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজ্ঞা ও কুদরতের প্রমাণ-নিদর্শন সময় বা যুগেই রয়েছে; তাই এখানে সময়ের শপথ করা হয়েছে। [মুয়াস্‌সার, বাদায়িউত তাফসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া

নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিপতিত


(১) মানুষ শব্দটি একবচন। এখানে মানুষ বলে সমস্ত মানুষই উদ্দেশ্য। কারণ, পরের বাক্যে চারটি গুণ সম্পন্ন লোকদেরকে তার থেকে আলাদা করে নেয়া হয়েছে। তাই এটা অবশ্যি মানতে হবে যে, এখানে মানুষ শব্দটিতে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সমানভাবে শামিল। কাজেই উপরোল্লিখিত চারটি গুণাবলী কোন ব্যক্তি, জাতি বা সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যার-ই মধ্যে থাকবে না। সেই ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে, এই বিধানটি সর্বাবস্থায় সত্য প্রমাণিত হবে। [আদওয়াউল বায়ান, ফাতহুল কাদীর]

(২) আভিধানিক অর্থে ক্ষতি হচ্ছে লাভের বিপরীত শব্দ। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ শব্দটির ব্যবহার এমন সময় হয় যখন কোন একটি সওদায় লোকসান হয়, পুরো ব্যবসাটায়। যখন লোকসান হতে থাকে। আবার সমস্ত পুঁজি লোকসান দিয়ে যখন কোন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যায়। তখনো এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। [ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া

কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে আর পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে হকের এবং উপদেশ দিয়েছে ধৈর্যের।

(১) এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত মানবজাতি যে অত্যন্ত ক্ষতিগ্ৰস্ততার মধ্যে আছে তার থেকে উত্তরণের পথ বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ক্ষতির কবল থেকে কেবল তারাই মুক্ত, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সাথে পালন করে— ঈমান, সৎকর্ম, অপরকে সত্যের উপদেশ এবং সবরের উপদেশদান। দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহা উপকার লাভ করার চার বিষয় সম্বলিত এ ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দুটি বিষয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দুটি বিষয় অপর মুসলিমদের হেদায়েত ও সংশোধন সম্পর্কিত। [সাদী]

(২) এই সূরার দৃষ্টিতে যে চারটি গুণাবলীর উপস্থিতিতে মানুষ ক্ষতিমুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে তন্মধ্যে প্রথম গুণটি হচ্ছে ঈমান। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্বীকৃতি দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কাজকর্মে বাস্তবায়ন। [মাজমু ‘ফাতাওয়া ৭/৬৩৮] এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, ঈমান আনা বলতে কিসের ওপর ঈমান আনা বুঝাচ্ছে? এর জবাবে বলা যায়, কুরআন মজীদে একথাটি একবারে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহকে মানা। নিছক তাঁর অস্তিত্ব মেনে নেয়া নয়।

বরং তাকে এমনভাবে মানা যাতে বুঝা যায় যে, তিনি একমাত্র প্রভূ ও ইলাহ। তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বে কোন অংশীদার নেই। একমাত্র তিনিই মানুষের ইবাদাত, বন্দেগী ও আনুগত্য লাভের অধিকারী। তিনিই ভাগ্য গড়েন ও ভাঙ্গেন। বান্দার একমাত্র তারই কাছে প্রার্থনা এবং তারই ওপর নির্ভর করা উচিত। তিনিই হুকুম দেন ও তিনিই নিষেধ করেন। তিনি যে কাজের হুকুম দেন তা করা ও যে কাজ থেকে বিরত রাখতে চান তা না করা বান্দার ওপর ফরয। তিনি সবকিছু দেখেন ও শোনেন। মানুষের কোন কাজ তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকা তো দুরের কথা, যে উদ্দেশ্য ও নিয়তের ভিত্তিতে মানুষ কাজটি করে তাও তাঁর অগোচরে থাকে না।

দ্বিতীয়ত রাসূলকে মানা। তাঁকে আল্লাহর নিযুক্ত পথপ্রদর্শক ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে মানা। তিনি যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন, তা সবই সত্য এবং অবশ্যি গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া। সাথে সাথে এটার স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ তা'আলা যুগে যুগে অনেক রাসূল ও নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তার পরে আর কোন নবী বা রাসূল কেউ আসবে না। তৃতীয়ত ফেরেশতাদের উপর ঈমান। চতুর্থত আল্লাহর কিতাবসমমূহের উপর ঈমান, বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের উপর ঈমান আনা ও কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নে সদা সচেষ্ট থাকা। পঞ্চমত আখেরাতকে মানা।

মানুষের এই বর্তমান জীবনটিই প্রথম ও শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর মানুষকে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠতে হবে, নিজের এই দুনিয়ার জীবনে সে যা কিছু কাজ করেছে আল্লাহর সামনে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং হিসেবা-নিকেশে যেসব লোক সৎ গণ্য হবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে এবং যারা অসৎ গণ্য হবে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে, এই অর্থে আখেরাতকে মেনে নেয়া। ষষ্ঠত তাকদীরের ভাল বা মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত থাকার বিষয়টি মেনে নেয়া। মূলত ঈমানের এই ছয়টি অঙ্গ যে কোন লোকের নৈতিক চরিত্র ও তার জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের জন্য অতীব জরুরি। যেখানে ঈমানের অস্তিত্ব নেই সেখানে মানুষের জীবন যতই সৌন্দর্য বিভূষিত হোক না কেন তা আল্লাহ তা'আলার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। [বিস্তারিত দেখুন: ড. আবদুল আযীয আল-কারী; তাফসীর সূরাতিল আসর; ড. সুলাইমান আল-লাহিম, রিবহু আইয়ামিল উমর কী তাদাব্বুরি সূরাতিল আসর]

(৩) ঈমানের পরে মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য সেটি হচ্ছে সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় আমাল সালেহা। সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ধরনের সৎকাজ ও সৎবৃত্তি এর বাইরে থাকে না। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা কখনো সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কুরআন মজীদের সর্বত্র সৎকাজের আগে ঈমানের কথা বলা হয়েছে এবং এই সূরায়ও ঈমানের পরেই এর কথা বলা হয়েছে।

(৪) হক শব্দের কয়েকটি অর্থ বর্ণিত হয়েছে। ইবন আব্বাসের মতে, ঈমান ও তাওহীদ [বাগভী; কুরতুবী] কাতাদা বলেন, কুরআন। [কুরতুবী] সুদ্দী বলেন, এখানে হক্ক বলে আল্লাহকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [কুরতুবী] কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এখানে হক বলে শরী’আত নির্দেশিত কাজগুলো করা এবং শরীআত নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিত্যাগ করা বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর] কারও কারও মতে, হক বলে এমন কাজ বোঝানো হয়েছে যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আর তা হচ্ছে যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজ। সেটা তাওহীদ, শরীআতের আনুগত্য, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ, দুনিয়াবিমুখ ও আখেরাতমুখী হওয়া সবই বোঝায়। [কাশশাফ] বস্তুত: হকের আদেশের প্রতি আসিয়ত করার বিষয়টি ওয়াজিব হক ও নফল হক উভয়টিকেই শামিল করে। [আত-তিবইয়ান ফী আকসামিল কুরআন ৮৩–৮৮]

তাই সার্বিকভাবে আয়াতের অর্থ হচ্ছে: সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফ অনুসারী এবং আকীদা ও ঈমান বা পার্থিব বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত প্রকৃত সত্য অনুসারী কথা বলতে হবে। আর এটা না করলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং আল্লাহর লা'নতে পতিত হবে। একথাটিই পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের মুখ দিয়ে বনি ইসরাঈলদের ওপর লা'নত করা হয়েছে। কারণ এই যে, তাদের সমাজে গোনাহ ও যুলুম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং লোকেরা পরস্পরকে খারাপ কাজে বাধা দেয়া থেকে বিরত থেকেছিল। [সূরা আল মায়িদাহ: ৭৮–৭৯] আবার একথাটি অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, “বনী ইসরাঈলরা যখন প্রকাশ্যে শনিবারের বিধান অমান্য করে মাছ ধরতে শুরু করে তখন তাদের ওপর আযাব নাযিল করা হয় এবং সেই আযাব থেকে একমাত্র তাদেরকেই বঁচানো হয় যারা লোকদেরকে এই গোনাহর কাজে বাধা দেবার চেষ্টা করতো। [সূরা আল আরাফ: ১৬৩–১৬৬]

অন্য সূরায় আবার একথাটি এভাবে বলা হয়েছে, “সেই ফিতনাটি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো যার ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে শুধুমাত্র সেসব লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যারা তোমাদের মধ্যে গোনাহ করেছে। [সূরা আল-আনফাল: ২৫] সুতরাং এ সূরায় মুসলিমদের প্রতি একটি বড় নির্দেশ এই যে, নিজেদের দ্বীনকে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী করে নেয়া যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি, ততটুকুই জরুরি অন্য মুসলিমদেরকেও ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা। এ কারণেই কুরআন ও হাদীসে প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি সাধ্যমতো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ফরয বা দায়িত্ব ও কর্তব্য গণ্য করা হয়েছে। [দেখুন: সূরা আলে ইমরান: ১০৪] আর সেই উম্মতকে সর্বোত্তম উম্মত বলা হয়েছে, যারা এই দায়িত্ব পালন করে। [দেখুন: সূরা আলে ইমরান ১১০]

(৫) ‘সবর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেয়া ও অনুবর্তী করা। এখানে কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক. যাবতীয় গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা। দুই. সৎকাজ করা এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। তিন. বিপদাপদে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। [মাদারেজুস সালেকীন। ২/১৫৬] সুতরাং সৎকর্ম সম্পাদন, গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা এবং এতদসংক্রান্ত বিপদাপদ মোকাবেলা করা সবই ‘সবর’ এর শামিল। সুতরাং আয়াতের অর্থ হচ্ছে, হকের নসিহত করার সাথে সাথে দ্বিতীয় যে জিনিসটি ঈমানদারগণকে ও তাদের সমাজকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবে তা হচ্ছে এই যে, এই সমাজের ব্যক্তিবর্গ পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দিতে থাকবে। হককে সমর্থন করতে ও তার অনুসারী হতে গিয়ে যেসব সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এপথে যেসব কষ্ট, পরিশ্রম, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও বঞ্চনা মানুষকে নিরন্তর পীড়িত করে তার মোকাবেলায় তারা পরস্পর অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। সবরের সাথে এসব কিছু বরদাশত করার জন্য তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে সাহস যোগাতে থাকবে। [ড. কারী, তাফসীর সূরাতিল আসর পৃ. ৬২–৬৩]
তাফসীরে জাকারিয়া




*****************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url