সিরাতুন নবী (সাঃ) - ১৫ || তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার || ইসলাম কবুলকারী প্রথম দল || ইসলামের প্রাথমিক যুগে সালাত বা প্রার্থনা ||





ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ 


এই পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার

সূরাহ মুদ্দাসসিরের প্রথম আয়াত প্রথম থেকে ষষ্ঠ আয়াত পর্যন্ত

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (1) قُمْ فَأَنذِرْ (2) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (3) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (4) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (5) وَلَا تَمْنُن تَسْتَكْثِرُ (6) وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ (7)

‘১. ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪, তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। ৬. (কারো প্রতি) অনুগ্রহ করো না অধিক পাওয়ার উদ্দেশে। ৭. তোমার প্রতিপালকের (সস্তুষ্টির) জন্য ধৈর্য ধর। (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১-৭)

সূরাহ মুদ্দাসসিরের উপযুক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পথহারা মানুষদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার কাজ শুরু করলেন এমন অবস্থায় যে, তাঁর জাতি কুরাইশদের মূর্তি ও প্রতিমার পূজা-অৰ্চনা ব্যতীত কোন দীন ছিল না। তাদের সঠিক কোন হজ্জ ছিল না, তবে তারা হজ্জ করতো যেভাবে তাদের পিতৃপুরুষদেরকে দেখেছে। তাদের আত্মমর্যাদা ও বংশগৌরব ব্যতীত কোন সৎচরিত্র ছিল না। তাদের কোন সমস্যা তলোয়ার ব্যতীত সমাধান হতো না। তা সত্ত্বেও মক্কা ছিল আরববাসীগণের ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রস্থল। এ মক্কাবাসীই ছিলেন কা’বাহর তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেমগণ। এ জন্যই দূরবর্তী স্থানের তুলনায় মক্কায় সংস্কারমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নের ব্যাপারটি ছিল অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় প্রচার ও তাবলীগের কাজকর্ম সন্তর্পণে ও সঙ্গোপনে করার প্রয়োজন ছিল যাতে মক্কাবাসীগণের সামনে আকস্মিকভাবে বৈপ্লবিক কিংবা উত্তেজনামূলক কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে না যায়।

ইসলাম কবুলকারী প্রথম দল

এটা খুবই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কথা যে যাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সবচাইতে কাছের, সব চাইতে ঘনিষ্ঠ এবং সব চাইতে নির্ভরযোগ্য ছিলেন সর্ব প্রথম তিনি তাঁদেরই নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। এ দলের মধ্যে ছিলেন পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। অধিকন্তু, প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঐ সকল লোককে সত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন যাঁদের মুখমন্ডলে কল্যাণ এবং সত্য-প্রীতির আভাষ ছিল সুস্পষ্ট। তাছাড়া যাঁরা নাবী (ﷺ)-এর সততা, সত্যবাদিতা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সুবিদিত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁর প্রতি এত বেশী অনুরক্ত এবং শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, প্রথম আহবানেই সাড়া দিয়ে তাঁরা ইসলাম কবুল করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার এক দুর্লভ গৌরব অর্জন করেন। এদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন নাবী- পত্নী খাদীজাহতুল কোবরা (রাঃ) বিনতে খুওয়াইলিদ, তাঁর স্বাধীনতা প্রাপ্ত ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ বিন শোরাহবীল কালবী,[1] তাঁর চাচাত ভাই আলী বিন আবূ ত্বালিব যিনি তখনো তাঁর লালন-পালনাধীন শিশু ছিলেন এবং তাঁর সওর গুহার সঙ্গী আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)। এরা সকলে প্রথম দিনেই মুসলিম হয়েছিলেন।[2]

তারপর আবূ বাকর (রাঃ) ইসলামের প্রচার কাজে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কোমল-স্বভাব, পছন্দনীয় অভ্যাসের অধিকারী, সচ্চরিত্র এবং দরাজ দিল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দানশীলতা, দূরদর্শিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সৎ সাহচর্যের কারণে তাঁর নিকট লোকজনের গমনাগমন প্রায় সব সময় লেগেই থাকত। পক্ষান্তরে তিনি তাঁর নিকট আগমন ও প্রত্যাগমনকারী এবং আশপাশে বসবাসকারীগণের মধ্যে যাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন তাঁর সামনেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উসমান (রাঃ), জোবায়ের (রাঃ), আব্দুর রহমান (রাঃ) বিন আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ত্বালহাহ বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ মহা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠি।

প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন বিলাল হাবশী (রাঃ)-ও ছিলেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এর পর ইসলাম কবূল করেন বনু হারিস বিন ফিহর গোত্রের আবূ ‘উবায়দাহ ‘আমির বিন জাররাহ (রাঃ), আবু সালামাহ বিন আব্দুল আসাদ মাখযূমী (রাঃ), আরক্বাম বিন আবিল আরক্বাম (রাঃ), উসমান বিন মাযউন যুমাহী (রাঃ), এবং তাঁর দু’ভাই যথাক্রমেঃ কুদামা এবং আব্দুল্লাহ, উবায়দাহ বিন হারিস বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ, সাঈদ বিন যায়দ এবং তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ উমারের বোন ফাত্বিমাহ বিনতে খাত্তাব, খাব্বাব বিন আরাত তামীমী (রাঃ), জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব ও তার স্ত্রী আসমা বিনতে ‘উমায়স, খালিদ বিন সাঈদ বিন ‘আস আল উমাবী ও তার স্ত্রী আমীনাহ বিনতে খালাফ, অতঃপর তার ভাই ‘আমর বিন সাঈদ বিন আস, হাতিব বিন হারিস জুমাহী ও তার স্ত্রী ফাতিমাহ বিনতে মুখাল্লিল ও তার ভাই খাত্তাব বিন হারিস এবং তার স্ত্রী ফুকাইহাহ বিনতে ইয়াসার ও তার ভাই মা’মার বিন হারিস, মুত্তালিব বিন আযহার যুহরী ও তার স্ত্রী রামলাহ বিনতে আবূ ‘আওফ, নাঈম বিন আবদুল্লাহ বিন নুহাম আদবী (রাঃ), এদরে সকলেই কুরাইশ ও কুরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্রের।

কুরাইশ ব্যতীত অন্য গোত্র থেকে প্রাথমিক অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারীরা হলেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, মাসউদ বিন রাবী’আহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ আসাদী ও তার ভাই আহমাদ বিন জাহশ, বিলাল বিন রিবাহ হাবশী, সুহাইব বিন সিনান রূমী, ‘আম্মার বিন ইয়াসার আনসী, তার পিতা ইয়াসার ও তার মাতা সুমাইয়া এবং আমির বিন ফুহাইরাহ।

উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলমান মহিলাদের মধ্যে রয়েছেন, উম্মু আইমান বারাকাত হাবশী, উম্মুল ফযল লুবাবাতুল কুবরা বিনতে হারিস হিলালিয়াহ (আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী), আসমা বিনতে আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)।

উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীর গুণে গুণম্বিতদের সংখ্যা পুরুষ-মহিলা মিলে ৩৩০ জন। তবে এটা অকাট্যভাবে জানা যায় নি যে, তারা সকলেই প্রকাশ্যে দাওয়াত চালু হওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নাকি ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যভাবে চালু হওয়া পর্যন্ত তাদের কেই কেউ ইসলাম গ্রহণে বিলম্ব করেছিলেন।

[1] ইনি যুদ্ধে বন্দী হয়ে দাসে পরিণত হন। পরে খাদীজা (রাঃ) তাঁর মালিক হন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট দেন। এর পর তাঁর পিতা এবং চাচা তাঁকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগমন করেন। কিন্তু তিনি বাড়ি না গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে থাকাকেই বেশী পছন্দ করেন। প্রচলিত প্রথানুযায়ী তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এজন্য তাঁকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে ডাকা হত। পরে সে প্রথার ইসলাম সমাপ্তি ঘোষণা করে।
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৫০ পৃষ্ঠা।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে সালাত বা প্রার্থনা

প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয় তাতে নামাজের নির্দেশেনা বিদ্যমান ছিল । ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবাগণ (রা.) মি’রাজের ঘটনার পূর্বে অবশ্যই সালাত পড়তেন। তবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পূর্বে সালাত ফরজ ছিল কি ছিল না সে ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সূর্যের উদয় এবং অস্ত যাওয়ার পূর্বে একটি করে সালাত ফরজ ছিল।

হারিস বিন উসামাহ ইবনে লাহী’আর মাধ্যমে বর্ণনাকারীদের মিলিত পরম্পরা সূত্রের বরাতে যায়দ বিন হারিসাহ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যখন প্রথম ওহী অবতীর্ণ হল তখন জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন এবং তাকে অযুর পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন। যখন অযু শেখা সমাপ্ত হল তখন এক চুল্লি পানি লজ্জা স্থানে ছিটিয়ে দিলেন। ইবনে মাজাহও এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বারা বিন আযিব এবং ইবনে আব্বাস হতেও ঐ ধরণের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসে এ কথারও উল্লেখ রয়েছে যে, সালাত প্রাথমিক ফরজকৃত কর্তব্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[1]

ইবনে হিশামের বর্ণনায় এ কথা রয়েছে যে, নাবী কারীম (ﷺ) এবং সাহাবীগণ (রা.) সালাতের সময় ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং গোত্রীয় লোকজনদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে সালাত আদায় করতেন। আবূ ত্বালিব এক দফা নাবী কারীম (ﷺ) এবং আলীকে সালাত আদায় করতে দেখেন এবং জিজ্ঞাসা করে প্রকৃত বিষয়টি অবগত হলে এর উপর দৃঢ় থাকার পরামর্শ প্রদান করেন।[2]

প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ এসব ইবাদত করতেন। সালাত সংশ্লিষ্ট ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন ইবাদত বা আদেশ নিষেধের কথা জানা যায় না। সে সময়কার ওহীতে মূলত সে সব বিষয় বর্ণিত হয় যা বিভিন্নভাবে তাওহীদের বর্ণনা, তাদেরকে আত্মশুদ্ধির প্রতি উৎসাহিতকরণ, উন্নত চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা যেন তা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধকরণে প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ যা অন্তরের খোরাক হয়, ঈমানদারদের তৎকালীন মানব-সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং ভিন্নতর এক পরিবেশে পরিভ্রমণ করাতে থাকে।

এভাবে তিন বছর অতিক্রান্ত হয় কিন্তু ইসলামের দাওয়াত গুটিকয়েক ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাসূল (ﷺ)-ও তা লোকসমাজে প্রকাশ করতেন না। তবে কুরাইশরা ইসলামের খবর জানতো ও মক্কাতে ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকসমাজে এর মৃদু গুঞ্জন চলতে থাকে। আবার কেউ একে ঘৃণাও করতো এবং মুমিনদের সাথে শত্রুতা ভাব দেখাতো। তবে সামনা সামনি কিছু বলতো না যতক্ষণ পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ তাদের দীন-ধর্মে হস্তক্ষেপ করতেন এবং তাদের ভিত্তিহীন ও মনগড়া ইলাহ মূর্তিসমূহের সমালোচনা না করতেন।

[1] শাইখ আব্দুল্লাহ মোখতাসার মীরাহ পৃঃ ৮৮৷
[2] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৪৭ পৃঃ।



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url